Monday 4 June 2018

মার্কসবাদের আলোয় ভারতের রাজনীতি



কার্ল মার্কস ছিলেন মানব সভ্যতার সমসাময়িক সময়ে একমাত্র বুদ্ধিজীবী। এবং অবশ্যই বর্তমান সময়েরও অন্যতম চিন্তাবিদ এবং সমাজ বিঞ্জানী কার্ল মার্কসকে নিয়ে মানব সভ্যতা বিষয়ক তুলনামূলক আলোচনায় আমরা বিশ্বের দু’জন খ্যাতনামা চিন্তাবিদের কথা জানি। অ্যারিষ্টেটল এবং গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। কারণ উল্লেখিত দুই মানবতাবাদী দার্শনিকের মতই মার্কসের মতবাদ ছিল অখণ্ডনীয়। মানব সভ্যতাকে অর্থনৈতিক অসাম্য, দারিদ্র, অসম বন্টন, সামাজিক পীড়ন এবং অন্যায় অবিচার থেকে মুক্ত করার কালজয়ী মতবাদ তিনি দিয়ে গেছেন এই কারণে তিনি আজও অপরিহার্য। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ক্রীতদাস সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কেও আমরা জানি। সেই সামন্ত সমাজ ব্যবস্থার অভিশপ্ত অধ্যায় থেকে মানব সভ্যতাকে মুক্তির আলো এনে দিয়েছিল মার্কসের চিন্তা এবং দর্শন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত শক্তিশালী বিশ্লেষক এবং যুক্তিবাদী অ্যারিস্টটলের মতই তিনি নিজের মতবাদ যুক্তি সহযোগে বিশ্লেষণ করতেন। অ্যারিস্টটলের চিন্তার উজ্জ্বল দিকগুলিকে যুক্তি সহযোগে গভীরভাবে মার্কস সমৃদ্ধ করেছিলেন। নিজের মতবাদকে আলোকিত করারা উদ্দেশ্যে। এ কথা সভ্যতা যতদিন থাকবে ততদিন আমাদের স্বীকার করতে হবে।
মার্কস তাঁর চিন্তা এবং মতবাদ, যেটার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল মানুষের পূর্ণতম আত্মবিকাশ এবং সামাজিক অস্তিত্বের স্বীকৃতি। যে বিষয়টা নিয়ে তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। এক্ষেত্রে তিনি গৌতম বুদ্ধের মতবাদ থেকেও সাহায্য নিয়েছেন। বুদ্ধদেবের সামাজিক চিন্তার গভীর প্রভাব মার্কসের মধ্যে লক্ষ করা যায়। গৌতম বুদ্ধ বিশ্বজনীন এক মৌলিক মতবাদ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। সেই মতবাদ সামাজিক জীবন যাপনে ব্যপক পরিবর্তন নিয়ে আসে। বুদ্ধের ধর্ম উপদেশ বিষয়ক নির্দিষ্ট মতবাদ তথা দর্শন একটি আদর্শের জন্ম দেয়। এবং সেই আদর্শের উপর ভিত্তি করেই বুদ্ধদেবের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে সারা বিশ্বে। সেইসব সংগঠন বুদ্ধের মতবাদ রক্ষা করে চলেছে।       
শিল্প বিপ্লবের পর নতুন সভ্যতার ইতিহাসে মানুষের শ্রমকে পুঁঞ্জিভূত পুঁজির মালিকশ্রেণী শোষণের হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগিয়েছিল। সেই অভিশপ্ত অধ্যায় থেকেও আমাদের উন্নত সভ্যতায় পৌঁছে দিতে কার্ল মার্কসের চিন্তাকেই আশ্রয় করতে হয়েছে। মার্কস সাহেব এমন দাবি কোথাও কখনও করেননি যে তাঁর মতবাদ অখণ্ডনীয়। তিনি সত্য অনুসন্ধানের স্পষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই নিজের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। সেই মতবাদের এতটাই শক্তি ছিল যে সেটা ইউরোপীয় সমাজে আবদ্ধ থাকেনি। তাঁর চিন্তা এবং মতবাদ সত্যি করেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।   
আজ থেকে ২০০ বছর আগে কার্ল মার্কস জন্মগ্রহণ করেন। আমাদের দেশ ভারতে এই সমাজ বিঞ্জানের প্রভাব ১০০ বছরের কিছু আগে থেকে পড়তে শুরু করে। ‘মার্কসবাদ’ ভারতে প্রথমে বুদ্ধিজীবীদের প্রভাবিত করে। আমাদের দেশের উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক, অধ্যাপক, ছাত্র, রাজনীতিবিদ এবং সমাজ সচেতন বুদ্ধিজীবীর দলকে প্রভাবিত করেন মার্কসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এবং লেনিন। তাঁদের লেখা পড়েই মার্কসের চিন্তা ভারতীয় বুদ্ধিজীবিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। মার্কসের চিন্তা এবং প্রঞ্জা আমাদের সেই সূত্রের সন্ধান দিয়েছিল, যে সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি পরিক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে মানবমুক্তির সত্যে পৌঁছতে হবে। এই পরিক্রমায় মার্কসবাদ সম্পর্কিত নিজেদের অবস্থান এঙ্গেলস এবং প্রাথমিকভাবে লেনিন ব্যবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এই দু’ই মার্কসবাদী চিন্তাবিদ ছিলেন মার্কসবাদী চিন্তার ব্যবহারিক প্রয়োগের মুখ্য পথপ্রদর্শক। মার্কসের দর্শন সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্বহারা মানুষের অন্যতম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে। ভারত সহ অবশিষ্ট বিশ্বের খেটে খাওয়া মানুষ এই তিনটে বিদ্ধংশ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মার্কসবাদকেই বেঁছে নিয়েছে।                  
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ‘গণ আন্দোলন’ শুরু হয়েছে। রাশিয়ায় ‘বলশেভিক’ পার্টি লেনিনের নেতৃত্বে নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার দায়িত্ব নিয়েছেনমার্কসবাদ সম্পর্কে সারা বিশ্বে নতুন করে আগ্রহ দেখা দেয়লেনিনের দূরদৃষ্টি ‘বলশেভিক পার্টি’ এবং রাশিয়ার নতুন ‘আর্থ- সামাজিক’ ব্যবস্থার ব্যপক প্রভাব ভারতে আছরে পড়ে। ব্রিটিশ ভারত এবং ব্রিটিশ উত্তর ভারতে এই প্রভাব সম্পর্কে আমরা অবহিত আছি। মার্কসের দর্শন উল্লেখযোগ্য উন্নত সমাজের সূত্র হিসাবে স্বীকৃতি দাবি করে। এবং লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার সফল রাষ্ট্রব্যবস্থা আশা জাগায় সমাজতন্ত্র নামক এক নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। দীর্ঘ শ্রেণীসংগ্রামের পর শ্রেণীহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় এঙ্গেলস এবং প্রাথমিকভাবে লেনিন মুখ্য পথপ্রদর্শক হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
এইসব লড়াই আন্দোলন সংগঠিত করতে রাজনৈতিক ফোরাম, দলগুলিকে নির্ভর করতে হয়েছে মার্কসের পুরনো লেখা এবং বক্তব্যের সংকলনের উপর। ‘মার্কসবাদ’ নামক এক মহাশক্তির উৎসারিত বুদ্ধির অন্যতম ভিত সমাজ উন্নয়নের নানা বিষয়ে কার্ল মার্কসের তত্ব। এইসব তত্বকে উনবিংশ শতাব্দীর অনালোকিত বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন লেনিন এবং এঙ্গেলস। আধুনিক পুঁজিবাদী দর্শনের সঙ্গে লড়তে বিশ্বের মার্কসবাদীরা সবসময় নির্ভর করেছেন মার্কসবাদের অন্যতম এই দুই চিন্তাবিদের উপর। এঙ্গেলস চেষ্টা করেছেন তাঁর বন্ধু কার্ল মার্কসের দর্শনকে একটি শক্তিশালী সমাজ বিঞ্জান হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে। মার্কসবাদ যে মত প্রকাশের একটি অন্যতম গণমাধ্যম সেটা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এঙ্গেলস। তিনি মার্কসবাদকে ডারউইনের ‘বিবর্তনবাদ মতবাদ’-এর পরম্পরায় মানব উন্নয়নের শৃঙ্খল হিসাবে দেখাতে চেয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে দাবি করা যায় মার্কস আবিষ্কার করলেন মানব ইতিহাসের উন্নয়নের ধারা। সমাজ উন্নয়নের বিঞ্জান।
 অন্যদিক থেকে বিচার করলে মার্কসবাদ একটি বিঞ্জান। যে বিঞ্জানকে তুলনা করা যায় পদার্থবিঞ্জানী নিউটন এবং অন্যান্য বিশ্ববরেণ্য পদার্থ বিঞ্জানীর সূত্রের সঙ্গে।
এঙ্গেলস আবার দাবি করলেন যে মার্কস দ্বিতীয় একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়কে আমাদের সামনে এনেছেন। সেটা একটি বাস্তবে ব্যবহারযোগ্য বিঞ্জান। যেটার ভিত্তি হচ্ছে ‘বস্তুবাদ’। মার্কস আরও ব্যাখ্যা করেছিলেন সমাজ গতিশীল থাকে উৎপাদনব্যবস্থা এবং শ্রেণীব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। এই অর্থনীতির কাঠামো চরিত্রগতভাবে নিহিত থাকে সমাজের উপরই কাঠামো, অর্থাৎ রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং ধারণা ইত্যাদি বিষয়ক তত্বের মোড়কে গড়ে তোলার উপর। শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের চাকা নির্দিষ্ট করে দেয় মার্কস প্রদর্শিত পথে। সেটা হচ্ছে, খেটে খাওয়া সাধারন মানুষ এবং তাঁদের শ্রমের সঙ্গে উৎপাদনের যে সংঘাত সেই চিরায়ত দর্শনকে। শ্রেণীসংগ্রামের শেষ ধাপ হিসাবে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায় পুঁজিবাদের উন্নততর চেহারা। এবং অপরিহার্য শ্রেণীসংগ্রাম করেই শ্রেণীসংঘাত শেষ হবে। এই মুল্যায়ন থেকেই মার্কসবাদ আমাদের শেখায় ‘বিপ্লব’ করেই পুঁজি নিয়ন্ত্রিত শোষণ এবং শাসন শেষ হবে একদিন। যেটাকে আমরা সমাজতন্ত্র হিসাবে চিনি।
লেনিন এই তত্বকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাশিয়ায়। তিনি দাবি করেন মার্কসবাদ আধুনিকতম স্বাভাবিক দর্শন যে দর্শন থেকে মার্কস দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ চিনতে বলেছেন। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং সমাজবিঞ্জানকে অনুসরণ করেই দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ গড়ে উঠেছে।
বর্তমান সময়ে কেন্দ্রীয় শ্রেণীস্বার্থ এবং শ্রেণীসংগ্রাম  আমাদের দেখতে বলছে, কায়েমি স্বার্থসম্পন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে যে চিরন্তন সংঘাত সেই সংঘাত মার্কসবাদের ভিত্তি নষ্ট করে দিতে পারে। এবং মার্কসবাদের উপর বিশ্বজনীন আস্থা টলিয়ে দিতে পারে। সুতরাং লেনিনের মত অনুযায়ী একটি কমিউনিস্ট পার্টী পারে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। মার্কসবাদের যে কোনও অবমূল্যায়ন অথবা পরিবর্তন, সংশোধন অথবা পুনঃনির্মাণকে প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজন লেনিন প্রদর্শিত কমিউনিস্ট পার্টিতুলনামূলক আলোচনায় বৈঞ্জানিক মার্কসবাদের তত্ব সব সময় ধর্মীয় তাত্বিক চিন্তবিদ এবং তাঁদের দর্শনকে প্রতিরোধ করতে পারে। মার্কসবাদকে কেউ কেউ ধর্মীয় রুপালঙ্কার হিসাবে চিহ্নিত করতে চেয়েছে। লেনিন পর্যালোচনা করে দেখিয়েছিলেন, যদি মার্কসবাদকে ‘ধর্মীয় ডগমা’ হিসেবে ব্যবহার করা যায় তবুও সেই দর্শন বিশ্বের বৈঞ্জানিক সত্যের প্রয়োজনে বিশ্বব্যাপী ব্যবহার হবে।
প্রাথমিকভাবে ভারতে কার্ল মার্কস আমাদের মননে এবং রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে মার্কসকে আমরা ভগবান হিসাবে দেখি। কিন্তু লেনিন এবং পরে স্তালিন, মাও অথবা ট্রটস্কী মার্কসবাদ তথা বামপন্থী মতবাদের অন্যতম চিন্তাবিদ হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করেনঘটনা হচ্ছে, এই প্রাপ্ত অধ্যায়ে স্তালিন দেখান কিভাবে মার্কসবাদের দ্বন্দমূলক বস্তুবাদ এবং ঐতিহাসিক বস্তুবাদকে প্রয়োগ করতে হয়। আমরা নতুন করে বুঝি মার্কসবাদের তত্ব এবং প্রয়োগের ভাষা। মার্কসের প্রভাব থাকা সত্বেও ভারতীয় বামপন্থীদের মধ্যে লেনিনের কতৃত্ব সব থেকে বেশী লক্ষ করা যায়। যেটাকে লেনিনীয় অবতার বলতেও পারি। আমাদের অন্যতম উদ্দেশ্য এবং কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় ‘মার্কসবাদ-লেনিনবাদ’-এর তত্বকে নির্ভেজাল তত্ব হিসাবে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় প্রয়োগ করা। যদি কোনও সন্দেহ বা খামতি থাকে সেটাকে প্রতিরোধ করতে পারে লেনিনের চিন্তা এবং কর্মধারা। লেনিনকে বাদ দিয়ে আমরা আমাদের মনন, চিন্তা অথবা দায়িত্বের কথা ভাবতে পারব না, বামপন্থী আঙিনায়মার্কবাদের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা প্রসঙ্গে একথা জোরের সঙ্গে বলা যায় যেটাকে সমাজ বিঞ্জানী পার্থ চ্যাটার্জী ব্যখ্যা করেছেন বাগবৈশিষ্ট হিসেবে। it became a ‘derivative discourse’, ভিন্ন ধারা হিসেবে ব্যবহারের প্রসঙ্গে এই কথা তিনি বলেছেন।
আমরা ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলন নিয়ে আলোচনা করতে পারি। দুঃখজনক ঘটনা হচ্ছে, ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির আন্দোলনের দীর্ঘ বিতর্কের ইতিহাস আছে। সেই বিতর্ক থেকে বিভিন্ন মত উঠে এসেছে। একটি দল থেকে বিভিন্ন ফোরাম এবং তিনটে দল গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি গঠনমূলক এই বিতর্ক সঠিক পথের দিশা চিনতে সাহায্য করেছে। যেটাকে মার্কসবাদের সঠিক প্রয়োগ বলা যেতে পারে। বিতর্কগুলির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রত্যেকটি দল, ফোরাম মার্কসবাদের চিরায়ত সত্য নির্ভর আলোচনা করতে চেয়েছেন। আলোচনার সময় মার্কসবাদের বিষয়ে বিদর্ঘ পণ্ডিত, গুণীজনদের লেখা, মতামত ইত্যাদি উল্লখে করেছেন। মার্কসবাদের চিরায়ত সত্তাকে বজায় রেখে এবং প্রাপ্য সম্মান জানিয়েই উল্লেখিত বিতর্কগুলি হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও মার্কসের তন্নিষ্ট শিক্ষাকে আশ্রয় করেই বস্তুনিষ্ট আলোচনাগুলি হয়েছে। মার্কসবাদের বিশুদ্ধতা মেনেই আলোচনাগুলি হয়েছে।  
আলোচনাগুলির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সাহায্য নেওয়া হয়েছে লেনিনের চিন্তা, সি পি এস ইউ-য়ের সিদ্ধান্ত এবং মতামত, কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশন্যাল সহ আরও সমসাময়িক ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের মতামতপরে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় আন্তর্জাতিক লাইন নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় আমরা মাও জে দংয়ের চিন্তার উপর নির্ভর করেছি। আমার ধারণা এই কারণে আমাদের ভারতীয় কমিউনিস্ট আন্দোলন এবং তাত্ত্বিক মতামত ভারতীয় ঘরানায় স্বাধীন হয়ে উঠতে পারেনি। ভারতীয় স্বতন্ত্রতার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা রয়ে গিয়েছে। ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির তিনবার ভাঙনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এই সত্য আমরা খুঁজে পাই। ১৯৬৪ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙনের কারণ ছিল পিকিং এবং মস্কোর মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাত। তথা মার্কসবাদ নিয়ে চিন্তা এবং মতের পার্থক্য। ১৯৬৯ সালে ভাঙনেরও অন্যতম কারণ মাও জে দংয়ের চিন্তা১৯৬৯ সালে সর্বভারতীয় যে সব কমিউনিস্ট নেতৃত্ব নতুন লাইনের কথা বললেন তাঁরা দাবি করলেন সি পি এস ইউ সংশোধনবাদী দলে পরিণত হয়েছে। ১৯৬৯ সালের বিভাজন একটা দলে সীমাবদ্ধ থাকেনি আরও নানান দল উপদলে ভেঙে যায়। মাও জে দংয়ের সঠিক রাজনৈতিক এবং আদর্শগত চিন্তার প্রভাব এইসব দলগুলির উপর থেকে গেছে।
 অভিভাবকহীন ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বুদ্ধিজীবীরা একসময় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবীদের উপর নির্ভর করতে শুরু করেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন গ্রামচী, লুকাচ,এছাড়াও মার্কসবাদীরা নির্ভর করছেন উত্তর আধুনিক চিন্তাবিদ ফৌকাল্ট এবং আরও অনেকের উপরে। ভারতে মার্কসবাদী আন্দোলন প্রসঙ্গে আমাদের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যর্থতা রয়ে গেছে, মার্কসবাদকে সমালোচনার দৃষ্টিতে পড়া এবং উন্নততর মার্কসবাদকে আশ্রয় করার ক্ষেত্রে। স্বদেশের চৌহদ্দির বাইরে লেনিন এবং মাওকে যদি খুঁজতে চেষ্টা করি তাহলে পশ্চিমে আধুনিক মার্কসবাদের প্রজ্বলিত আলো আমরা আবারও খুঁজে পাব। এই অধ্যায়ের শুরু হয়েছে গ্রামচীর দর্শন থেকে। তারপর অলথুসারের পথ ধরে এগিয়ে গেছে। এটাকেই বলা হচ্ছে পশ্চিমী মার্কসবাদ।
আমরা ইতিমধ্যে আবিষ্কার করে ফেললাম নতুন উল্লেখযোগ্য লেখা এবং মাধ্যম। সেই পথ ধরে এগিয়ে এসে আমাদের বোঝাপড়া হয়ে যায়। আমরা নির্দিষ্ট মতবাদ প্রয়োগের কথা ভাবতে পারি। আধুনিক সময়ের মার্কসবাদী খ্যাতনামা চিন্তাবিদদের দর্শনকে আধার করে। মার্কসবাদ চিরসত্য কারণ এটা একটা বিঞ্জান। উল্লেখিত বিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মার্কসবাদী চিন্তাবিদ এবং শিক্ষকদের লেখার কোনও প্রভাব ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি বা আন্দোলনের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় না।
মার্কসবাদী আলোয় ভারতীয় রাজনীতি আলোচনা এবং পর্যালোচনা করার সময় আমাদের উপলব্ধি হয় আমরা মার্কসবাদকে বর্জন করে তাঁকে প্রয়োগ করতে চেয়েছি। এটা অনেকটা তাৎক্ষনিক ফর্মুলা হিসাবে কাজে লাগিয়েছি আমাদের চিন্তা এবং রাজনৈতিক পরিসরে। পাছে ভুল হয়ে যায় এমন একটা ধারণা থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছি। এটা করতে গিয়ে কার্ল মার্কস আবিষ্কৃত বিশ্বজনীন সত্য থেকে আমরা সম্ভবত বিচ্যুত হয়েছি। মার্কস সাহেব তাঁর পূর্বসুরী চিন্তাবিদদের থেকে ঞ্জান আরোহণ করেছিলেন। যেমন বুদ্ধদেব করেছিলেন। মানুষকে কিভাবে শোষণ করা হয় সেটা নিজের অভিঞ্জতায় বুদ্ধ আবিষ্কার করেছিলেন। মার্কস বুদ্ধের দর্শনকে সমালোচনা এবং মানব সভ্যতার বিকাশ ও সৃষ্টির আলোয় দেখে নিজের মতবাদ সামনে এনেছিলেন। মার্কস একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ভগবান আপনাকে ধন্যবাদ, আমি মার্কসবাদী নই’ (Thank God, I’m not a Marxist.’) মার্কসের এই মন্তব্যে মার্কসবাদকে আমরা আরও পরিণত তত্ব হিসেবে পাই। মার্কসের উল্লেখিত মন্তব্য আমাদের সামনে আসে, রাশিয়ায় ভিরা জাসুলিচের নেতৃত্বে যে কৃষক কমিউন গড়ে তোলা হচ্ছিল সেই সময়কালে। তিনি গভীর চিন্তা করতেন। পড়াশোনা করতেন পুঁজিবাদকে বাইরে রেখে কিভাবে কৃষক কমিউন গড়ে তোলা যায় এবং পরিচালনা করা যায়।  খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রমিক, কৃষক, সরকারি কলমজীবীদের জন্য সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার তত্ব তিনি আমাদের দিয়ে গেছেন।
তাঁর মনন ছিল হীরের ঠিকরে পড়া আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মত অত্যন্ত সংবেদনশীল, বিকশিত এবং খাঁটি। মার্কসবাদ ভারতে হস্তারন্তিত হয়েছিল বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত। এই হস্তান্তর হয়েছিল মার্কসবাদকে চকচকে করে সমাপ্ত অধ্যায় হিসেবে।
সরকারি, অসরকারি কমিউনিস্ট পার্টি, গোষ্ঠীর আয়তরেখার বাইরে বিদগ্ধ বুদ্ধিজীবীর দল এবং সমাজ কর্মীরা মার্কসবাদকে নতুন করে পাঠ করেছেন এবং প্রয়োগ করছেন বলেই মনে হয়। সমাজ উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় একবিংশ শতাব্দীতে মূল তিনটে বিষয় আমাদের সামনে রয়েছে। উত্তর আধুনিকতা, উত্তর ঔপনিবেশিক এবং নারীবাদী আন্দোলন। এই উল্লেখযোগ্য তিনটি ক্ষেত্রে মার্কসবাদের আলোয় কাজ করার অপরিমেয় সুযোগ রয়েছে বুদ্ধিজীবীদের। ভারতীয় সমাজের প্রান্তিক শ্রেণী অথবা পিছড়ে বর্গদের নিয়ে সমীক্ষা, পড়াশোনা এবং গবেষণা করার যে গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল সেই গোষ্ঠীর নাম ‘সাব-অলটার্ন স্টাডিজ গ্রুপ’ (Subaltern Studies group)কল্যাণ সান্যাল সহ এই গোষ্ঠীর কয়েকজন কল্পনাশক্তিকে আশ্রয় করে মার্কসবাদ অধ্যায়ন করেছেন। পরেশ চট্টোপাধযায় ব্যতিক্রম। তিনি অনুচ্চ উচ্চতায় জার্মান ভাষায় মার্কসবাদ অধ্যায়ন করেছেন। সমস্ত গোঁড়ামি থেকে মুক্ত থেকে মার্কসবাদের নির্যাস বের করে এনেছেন। কার্ল মার্কসের রচনার আধুনিক অনুবাদক হিসেবে পরেশ চট্টোপাধ্যায়ের নাম আমাদের মনে রাখতে হবে।
দলিত আন্দোলনের নেতাকর্মী এবং অন্যান্য সমাজকর্মীদের যে আন্দোলন বিশ্ব জুড়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সেই আন্দোলনেও মার্কসবাদের প্রভাব আমরা লক্ষ করছি। এই সব আন্দোলন বিশ্বের অভিভাবকহীন কমিউনিস্ট পার্টি  এবং তাঁদের সিংহদুয়ার দ্বাররক্ষী বা প্রহরীদের বাইরে রেখেই হচ্ছে। কার্ল মার্কসের চিন্তা থেকে ধর্মীয় গোষ্ঠী সহ দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি বুদ্ধিবেত্তা এবং দার্শনিক সূত্র আরোহণ করেছে বা খুঁজেছে। এই দলে উল্লেখযোগ্য তিনটে প্রথমসারির প্রতিনিধিত্ব করে এমন গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের নাম আমরা করতে চাইছি। ১) নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আমূল সংস্কারের সমর্থক খ্রীস্টান ২) বুদ্ধধর্ম এবং ৩) গান্ধীবাদীরা অনুসন্ধানের মধ্যে আছেন এক্ষেত্রে মার্কসবাদের ভিত্তিতে আমূল সংস্কারের সমর্থক এম এন রায় ছিলেন ব্যতিক্রম। তিন লেনিনের সঙ্গে বিতর্ক করেছেন। লেনিনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন মার্কসবাদের নতুন ব্যাখ্যা করে গবেষণাপত্র লেখার জন্য। পরে এম এন রায় মার্কসবাদের উদার সমালোচনা করে ‘র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট মুভমেন্ট’ নামে একটি  আন্দোলন সংগঠিত করেন। এম এন রায় প্রতিষ্ঠিত গোষ্ঠীর একটি ধারা ভারতে দীর্ঘদিন সক্রিয় ছিল। মানুষের মনকে কমিউনিস্ট ক্রিতদাস সুলভ দুর্বলতা থেকে মুক্ত করতে পারে মার্কসবাদ। যেটা কার্ল মার্কস নিজে বলেছিলেন। ভগবান আপনাকে ধন্যবাদআমি মার্কসবাদী নই। ‘Thank God, I’m not a Marxist.’ 
(লেখাটি ‘A Guided Tour of Marx’s Journeys in India’ শিরোনামে ইংরেজিতে অধ্যাপক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ের লেখা। মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন লেখক এবং সাংবাদিক দীপেন্দু চৌধুরী)
প্রথম দু’টি পরিচ্ছদ পুনর্লিখিত। ছাপার সময় এই খসড়া ব্যবহার করতে হবে। এবং এই লাইনটি বাদ দিতে হবে।  
(লেখাটি 'A Guided Tour of Marx's Journeys in India' শিরোনামে ইংরেজিতে অধ্যাপক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়ের লেখা। মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন দীপেন্দু চৌধুরী। লেখাটি 'সম্পর্ক' মে-জুন ২০১৮ সংখ্যায় প্রকাশিত) 

                                                              
        

No comments:

Post a Comment