Thursday 31 May 2018

পুরনো আঙিনায় নতুন শপথ গণনাট্য কর্মীদের




দীপেন্দু চৌধুরী
অতীতকে ফিরে দেখতে চাই। শুধু সংস্কৃতিবোদ্ধা বাঙালিদের আছে এমনটা ভেবে নেওয়াটা খুব কিছু ঠিক হবে কি? সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ অতীতকে ফিরে দেখতে চায়। এমনই একটি সংগঠন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ (আইপিটিএ)এই নামের সঙ্গে পরিচিত নয় এমন বামকর্মী ভূভারতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভারতে গণআন্দোলনের মঞ্চ তৈরি করতে বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের উজ্জ্বল ভূমিকার কথা আমরা জানি। স্বাধীনতা পূর্ব ভারতে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য ছিলেন ভারতীয় চলচ্চিত্র, নাটক, সঙ্গীত এবং শিল্পকলা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের নামজাদা তথা প্রথিতযশা প্রথমসারির বুদ্ধিজীবীর দল। যাঁদের অবদান ছাড়া গর্বিত বাঙালি, সংস্কৃতিদর্পী বাঙালি আলাদা করে নিজেদের তৈরি আরও এক নতুন আলোকনিকেতন পেতেন না। বাংলা তথা ভারতীয় সংস্কৃতির আকাশে রবীন্দ্রনাথের মত এক উজ্জ্বল, চিরভাস্বর এবং প্রখর ব্যক্তিত্ব জ্বল জ্বল করেছে। সেই আলোয় আমরা ব্যপ্ত থাকতে বাধ্য হতামকিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যক্তির চেষ্টায় গণনাট্যসংঘের মঞ্চে এসে সারা ভারতে শতফুল বিকশিত হয়েছে। বাংলার সাংস্কৃতিক অহংকার গড়ে দিয়েছিল এই মঞ্চ। বিশ্বের যে কোনও সংস্থার যেমন সাফল্যের দিক থাকে আবার ব্যর্থতার দিকটাও অনেক সময় বড় হয়ে দেখা দেয়। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ক্ষেত্রেও সাফল্যের সঙ্গে ভাঙ্গনের দিকটাও একসময় খুব বড় হয়ে সামনে এসেছিল।
অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআইয়ের পার্টিকোর এই সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ১৯৬৪ সালে দল মতাদর্শের কারণে আড়াআড়ি দুটো ভাগে ভাগ হয়ে যায়। পরে সিপিআইএম বড় দল হিসেবে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভারতীয় গণনাট্যের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল১৯৬৪ সালের পরে সিপিএম দলের আদর্শ নিয়ে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতাদর্শের লড়াই হয়েছে। কিন্তু এটা বলতেই হবে গণনাট্য সংঘের প্রথমসারির কিছু সাংস্কৃতিক নেতা এবং কর্মীর প্রচেষ্টায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘের বামপন্থী সংস্কৃতির প্রচার এবং প্রসারে কখনও পূর্ণচ্ছেদ পড়েনি। সেইসব নাটক, গান, সাহিত্য, সৃষ্টিশীল শিল্প, বাণিজ্যিক শিল্প, চলচ্চিত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে অতীতের মত যেমন আমরা ধ্রুপদী ঘরানার শিল্পী সাহিত্যিক পেয়েছি আবার স্লোগানধর্মী শিল্পী সাহিত্যিকদের ভীড়ও লক্ষ করেছি। যে সব ‘পেড শিল্পী’ বশংবদ চিন্তা নিয়ে ‘গণনাট্য সংঘ’-এর মঞ্চকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন তাঁরা কালের নিয়মে হারিয়ে গেছেন। আজও থেকে গেছেন বিজন ভট্টাচার্য,সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, চিন্তামণি কর, তাপস সেন, খাজা আহমেদ আব্বাস, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, তৃপ্তি মিত্র এবং মৃণাল সেন সহ একাধিক গণসংস্কৃতি আন্দোলনের মুখ মানবতার মুখ। এইযুগে এবং প্রাক স্বাধীনতার সময়ের মিলন মঞ্চের অগ্রপথিক হিসেবে এরা বাংলা তথা বাঙালির যুগপুরুষ হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একসঙ্গে হেঁটেছেন। বিশ্বকবিকে ঋণী করেছেন। নিজেরা সমৃদ্ধ হয়েছেন।   
সম্প্রতি কলকাতা গোর্কিসদন কতৃপক্ষ এবং ভারতীয় গণনাট্য সংঘের যৌথ আয়োজনে একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা হয়ে গেল। ২৮ মে কলকাতার গোর্কিসদনে অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রথমটায় ঠিক ঠাউর করতে পারছিলাম না। অনুষ্ঠানটা ঠিক কি হতে পারে। যদিও আমন্ত্রণপত্রে লেখাছিল ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’। তবু ঠাউর করতে কিছুটা অসুবিধা হচ্ছিলগোর্কিসদনের একতলায় (নতুন করে সাজানো) প্রদর্শনী কক্ষে একটি ইজেলের    ক্যানভাসে অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন সোভিয়েত ব্যক্তিত্বের ছবি। ছবির উপরে লেখা ‘A Tribute to Gerasim Stepanovich Lebdev, 1749-1817. দেওয়ালে মৃণাল সেন পরিচালিত বিভিন্ন সিনেমার ছোট বড় পোস্টার। মৃগয়া, আকালের সন্ধানে, একদিন প্রতিদিন, ভূবন সোম, নীল আকাশের নীচে, খারিজ, জেনেসিস, মহাপৃথিবী সিনেমার ছোট বড় সাদাকালো পোস্টারের সঙ্গে রয়েছে উধৃতি। মৃণাল সেন লিখছেন, ‘’.........Behave me. I do not feel fatigued, I still feel sufficiently energetic and youthful at my age. I continue to make both friends and enemies and that. I believe. Saved me from stagnation. Mrinal Sen, আমার ছেলেবেলা –(১) এবং (২)।
‘’......... শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে দিলাম দুজনকেই, আমি-ই বিড়াট দার্শনিকের কথা বললাম। বলেছিলাম ‘’All are genius up to the age of ten.’’ সঙ্গে সঙ্গে দুজনের কাছ থেকেই একটা benefit of the doubt পেয়ে গেলাম। সেই benefit of the doubt নিয়ে চলে এলাম মহানগর কলকাতায়। ছেলেবেলা ডিঙিয়ে এলাম।‘’
মৃণাল সেন আরও লিখছেন, ‘’My entry to cinema was very accidental. I travelled a long and difficult way-difficult, because I did not know how to walk, I learnt through experience.’’- Mrinal Sen. কি করে তিনি সিনেমায় এলেন। আয়োজক কতৃপক্ষ মৃণাল সেনের বক্তব্য তুলে ধরে আমাদের দেশের আর্থ-রাজনৈতিক সময়কে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ, ফ্রান্স বিপ্লব, ভারতে নকশালপন্থী আন্দোলন এগুলি কেমন যেন সব হাত ধরাধরি করে এগিয়ে এল। পরস্পর পরস্পরের দ্যোতক হয়ে। এদিনের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংস্কৃতি। খুব স্বাভাবিকভাবেই এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়া, জার্মানি, হিটলার এবং মিত্রদেশগুলির ভূমিকা। ফ্যাসিবাদ বিরোধী আলোচনায় অবশ্যম্বভাবী হিসেবে স্তালিনের নাম আসবে। আসবে মাও সেতুংয়ের (মাও জে দং) নামও।
একটি তথ্য বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৩-২৮ মিলিয়ন নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিল। কেউ যুদ্ধে, কেউ যুদ্ধজনিত অনাহার বা অসুখে, কেউ কেউ বিদেশে বন্দী শিবিরে। আলোচনায় বারে বারে ফিরে ফিরে এসেছে নাৎসি নেতাদের প্রসঙ্গ। গণনাট্য সংঘের অন্যতম সংগঠক গৌতম ঘোষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন চিঠির অ্যালবাম থেকে পাঠ করে আমাদের শোনান। মর্মান্তিক যন্ত্রণার নিষ্ঠুর ছবি উঠে এসছে সেই সব চিঠি থেকে। সাধারণ নাগরিক যেমন তার মৃত্যুর আগের ঘটনার বর্ণনা লিখে গেছেন তার কোনও আত্মীয়কে উদ্দেশ্য করে। সাধারণ সেনা মাকে লিখেছেন, স্ত্রীকে লিখেছেন যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতার কথা। নিজের আসন্ন মৃত্যুর কথা। সেনাধ্যক্ষ বীভৎস অট্টহাস্যে তাঁদের অত্যাচারের বর্ণনা লিখেছেন সুপিরিয়রকে। একটি ১৫ বছরের মেয়ে তার বাবাকে লিখে গেছে নিজের এবং তার মায়ের জীবন যন্ত্রণা, মৃত্যুর কথা। নাৎসি নেতৃত্ব ঠাণ্ডা মাথায় ইহুদী এবং অন্যান্য সাধারণ মানুষকে যে ভাবে হত্যা করেছিল এসেছে সেই প্রসঙ্গও। হিটলার বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক সময় জার্মানের মানুষও গর্জে উঠেছিল। যার ফসল ১৯৪৫ সালে মে মাসে রাইখস্ট্যাগের মাথায় লাল পতাকার বর্ণাঢ্য জয়যাত্রা। আমরা জানি হিটলার যে ঘোষণা করেছিল সেই ঘোষণা আজ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। হিটলার বলেছিলেন, ‘’আমরা শ্ত্রুদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই করছি না। ......রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইঃ বলশেভিক কমিসার ও সমগ্র কম্যুনিস্ট বুদ্ধিজীবিদের ধ্বংস করা।‘’
অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক সমুদ্র গুহ। তিনি বলেন, ‘১৯৪৫ সালের ২রা মে রাইখস্ট্যাগের মাথায় লাল পতাকা উঠেছিল। ওইদিন থেকেই ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এর পরে পুঁজিবাদের বিকাশ হলেও বিভিন্ন উত্থান পতন আমরা লক্ষ্য করেছি। ১৯৩০ সালে প্রচন্ড ডামাডোল তৈরি হয়েছিল। অর্থ নৈতিক মহামন্দা শুরু হয় এই সময়। কিন্তু বিশ্বের একমাত্র দেশ রাশিয়ায় এই মহামন্দার প্রভাব পড়েনি। চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’ সিনেমায় আমরা দেখি মানুষ ভেড়ার পালের মত কারখানা থেকে বেড়িয়ে আসছে। পুঁজিবাদ আমাদের যে ভাবে দেখেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হয়। তবু বলতে হবে ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তির জয় হয়েছে। শত ফুল বিকশিত হয়েছে।‘’
সমুদ্র গুহ চিনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আরও বলেন, ‘’চিনের সাহিত্যে উপমা ব্যবহার করা হয়। এবং রুপকের মাধ্যমে ঘটনাকে বোঝানোর চেষ্টা হয়। পাথর চাপা দেওয়া কোনও গাছ বা ফুল গাছের উপর থেকে পাথরটা সরিয়ে দিন। দেখবেন ফ্যাকাসে ফুল বা গুল্ম লতা,গাছ পাবেন। পাথরটা সরিয়ে দিন দেখবেন শতফুল বিকশিত হচ্ছে। আমাদের কাজ হচ্ছে পাথরটা সরিয়ে দেওয়ার। শতফুল বিকশিত করতে হবে। যেটা মাও সে তুং (মাও জে দং) বলে গেছেন।‘’
এদিনের অনুষ্ঠানে গণসংগীত গেয়ে শোনান অনন্যা চন্দ। ছিল একটি ৪৫ মিনিটের নাটক। নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের লেখা নাটক ‘পোকামাকড়ের দিনগুলি’’। নাটকটি প্রযোজনা করে গণনাট্য, প্রত্যাশা গোষ্ঠী। এই নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগে আমার কাছে আরও একটি চমক ছিলআমি সাধারণ সাহিত্যের একজন পোড় খাওয়া ব্যক্তি। সামাজিক এবং অন্যান্য অভিঘাতে স্মৃতি ঘোলাটে হয়ে গেছে। আমি নিজে ইতিহাবেত্তাও নই। তাই বিশ্বের সব ইতিহাস আমার পক্ষে জানা সম্ভবও নয়। গোর্কিসদনের প্রদর্শনী কক্ষে সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো একটি উধৃতি চোখে পড়ল। ফ্রেমটি যথেষ্ট বড় মাপের। যে উধৃতি থেকে জানতে পারলাম ভারত এবং রাশিয়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মাত্র একশো বছর আগের নয়। এই সম্পর্ক আরও পুরনো। ভারতে ব্রিটিশ আমল থেকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশকে এই সম্পর্কে সূচনা।  
সূচনা হয়েছিল গেরাসিম স্টেপানোভিচ লেবডেভ (১৭৪৭-১৮১৭)এর মাধ্যমে। প্রদর্শনী কক্ষের দেওয়ালে একটি বোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘’An Imparted review of the systems of East Indian Brahmins, their Sacred Rites and people’s customs’’. First published in St. Petersburg in 1805 (in Russia), পাশের বোর্ডটিতে লেখা রয়েছে, ‘Different times and different personalities have shaped India’s relations with Russia. Gerasim Lebdev, a son of Yaroslavl, contributed to the development of Indian-russian friendship in the last decade of the eighteenth century. Madras and Kolkata are the two Indian cities Levdev lived from 1785 to 1797. Ten out twelve years he stayed in Kolkata.
Lebdev possed the knowledge of the land, its customs and languages, including Sanskrit, Bengali and particularly the Kolkata dialect of Hindustani, spoken language of its natives.’’
 এই দুটি লেখা থেকে আমরা জানতে পারি ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার গাঁট বন্ধন কত শতাব্দী পুরানো এই সম্পর্ককে যেমন কংগ্রেস ঘরানার নেতৃত্ব একটা উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ সে ক্ষেত্রে অন্যতম মাধ্যম ছিল। বর্তমান সরকারের কাছেও আমরা আশা করব সেই সম্পর্ক শুধু আর্থিক বা বিঞ্জান-কারিগরী নয়। সাহিত্য সংস্কৃতির বিনিময় এবং সংস্কৃতির অন্যান্য ধারার ক্ষেত্রেও পুরনো ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।                                                                                                                                                                                                                                                                                                      

Sunday 27 May 2018

বিশ্ব মানবতার পথিকৃৎ ছিলেন বিচারপতি সাচার


দীপেন্দু চৌধুরী       
আমরা কেউ কেউ ভাবি উচ্চ আদালতের বিচারপতি হয়ে অথবা নিম্ন আদালতের বিচারক হয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাজ করা যায় না। এই ধারণা যে ঠিক নয় তার উজ্জ্বল উদাহারণ দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধানবিচারপতি এবং মানবাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ জাস্টিস রাজিন্দর সাচার। আইনঞ্জ এই ব্যক্তি সম্পর্কে আমরা কতটা জানি? বা কতটা খবর রাখি? তাঁর সম্পর্কে বাংলায় কটা বই আছে জানি না। বাংলার কোনও খ্যতনামা  প্রকাশক তাঁকে নিয়ে গবেষণাধর্মী কোনও বই প্রকাশের জন্য আদৌ ভেবেছে বলেও মনে হয় না। প্রকাশকরা এমনিতেই আক্ষেপ করে থাকেন বইয়ের বাজার ভালো নয়। তারপর অচেনা বা কমচেনা একজন ব্যক্তি সম্পর্কে কতজন আগ্রহ দেখাবে? বিচারপতি সাচার কি সত্যি সত্যি অচেনা ব্যক্তি? এর চেয়ে ঢের ঢের ভালো বাজারে জনপ্রিয় কোনও সেলুলয়েডের নায়ক নায়িকাদের সম্পর্কে বই প্রকাশ করা।
বিচারপতি রাজিন্দর সাচার নামটি ভারতীয় রাজনীতিকদের কাছে মাত্র কয়েক বছর আগে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ২০০৫ সালে ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ দেশের মুসলিম সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত অবস্থান খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করেন। জাস্টিস সাচার তার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ যোগ্য ব্যক্তির হাতেই এই কমিটির দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। বিচারপতি সাচার পক্ষপাতহীন, তথ্যনির্ভর বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করেন। ঐতিহাসিক এই রিপোর্ট ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি রাজিন্দর সাচারকে যেমন আলোয় নিয়ে আসে, তার থেকেও অনেক বড় প্রশ্ন তুলে দেয় মুসলিম সমাজের আসল আর্থ-সামাজিক ছবি নিয়ে। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে রিপোর্ট পেশ করার আগে পর্যন্ত আমরা ভারতের সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতাম না। বা ভুল জানতাম। স্বাধীন ভারতে এই রিপোর্ট মুসলিম সম্প্রদায় সহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামাজিক মান উন্নয়নে সহায়ক হয়ে ওঠে। কারণ ভারতের আপামর মানুষের মধ্যে একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল, ভারতের মুসলিমদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। মোটাদাগে বোঝাতে চাইছেন তোষণ করা হচ্ছে। বিচারপতি সাচারের আলোচ্য রিপোর্ট সেই ‘মিথ’ ভেঙে দেয়। রিপোর্টে উঠে আসে এক চরম সত্য। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে পেশ করা রিপোর্টে বলা হয়, ভারতে এবং রাজ্যে রাজ্যে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আয়, শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্য, দারিদ্র, সরকারি আর্থিক সহায়তা বিষয়ে।   
অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানে ভারতের তুল্যমূল্য নয় বাস্তবিকভাবেই মুসলিমরা অনেক পিছিয়ে আছে। তিনি এগুলির সংশোধন ছাড়াও অন্যান্য সুপারিশ করেন। পিছিয়ে থাকা মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি সমস্ত বঞ্চিত শ্রেণীর জন্য তার দেওয়া সুপারিশগুলি কার্যকর করতে বলেন।
আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যা ১০২ কোটির মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা ১৩.৪ শতাংশ। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের ছবি কি? রাজ্যের ৮ কোটি জনসংখ্যার ২৫ শতাংশের বেশি মুসলমান। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের মোট  জনসংখ্যার এক- চতুর্থাংশই মুসলমান। একটি সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেটা হল, সাচার কমিটির রিপোর্টকে ভিত্তি করে এগতে থাকলে আমরা পাই, পশ্চিমবঙ্গের তফসিলি জাতি-উপজাতি ভুক্ত মানুষদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ, এক-তৃতীয়াংশের কিছু কম, আর বর্ণহিন্দুদের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ, এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি। পাশাপাশি ওবিসি-দের সংখ্যা মাত্র ৬ শতাংশ
সাচার কমিটির রিপোর্ট বিস্তারিত দেখতে হলে তফসিলি জাতি-উপজাতিভুক্ত মানুষদের সংখ্যাও আলাদা আলাদাভাবে ভেঙে দেখতেই হবে। কারণ ভারতে এবং আমাদের রাজ্যে মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তফসিলি জাতি-উপজাতির সঙ্গে তুলনা করতেই হয়। ঐতিহাসিক মানদণ্ডে বিচার করলে এটাই বাস্তব। কারণ আমাদের দেশে মুসলমান জনসংখ্যার বেশিরভাগ জাতিভেদ প্রথার নিপীড়নে ধর্মান্তরিত নিম্নবর্ণের হিন্দু।
সাচার কমিটির রিপোর্ট এবং মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টকে সামনে রেখে ২০১০ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। ওই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একটি ঘোষণা করেন। তিনি বলেছিলেন, ওবিসিদের ১৭ শতাংশ সংরক্ষণ থেকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্য আলাদা করে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ করা হবে। এই সংরক্ষণের প্রয়োজনে রাজ্য সরকার একটি স্যাম্পেল সার্ভে করিয়েছিল। সেই স্যাম্পেল সার্ভে করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। ২০১০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক ‘প্রাত্যহিক খবরে’ আমি একটি খবর করি। ‘পিছিয়ে থাকা মুসলিমদের তিনভাগে ভাগ করা হচ্ছে’ শিরোনামে খবরটি ছিল। খবরটির কিছুটা অংশ উল্লেখ করছি। ‘’............কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানথ্রপলজি দপ্তরের নিজস্ব মানদণ্ড এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাজ্যে ১০৬ টি সম্প্রদায় ওবিসি গোষ্ঠীভুক্ত। তার মধ্যে ৫১টি মুসলিম সম্প্রদায়ের। এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষও আছেন। যেমন খ্রীস্টান, জৈন, বৌদ্ধ, এবং দার্জিলিং পাহাড়ের মানুষ। এঁদের সবাই আবার বৌদ্ধ নয়। কেউ কেউ বৌদ্ধ। কেউ কেউ হিন্দু ধর্মাবলম্বী।‘’                                                    
বিচারপতি রাজিন্দর সাচারদের মত মানুষ মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করুন। অথবা রুপোর চামচ। এই ব্যক্তি বিরলতম ব্যক্তিত্বদের মধ্যে পড়েনমানবাধিকার রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশের বিচারব্যবস্থার এক উল্লেখযোগ্য উজ্জ্বল ব্যক্তি ছিলেন তিনি। বাবা কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী হলেও বিচারপতি সাচার বেছে নিয়েছিলেন সোশালিস্ট আদর্শ। এছাড়াও খুব সম্ভবত এম এন রায়ের র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর বর্ণময় কর্মজীবনে তিনি সিকিম এবং দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। ভারতীয় আইনের অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন। গরিব সাধারন মানুষের আইনজীবী হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নাগরিকের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করে গেছেন।
২০০৪ সালে ‘প্রিভেনশন অব টেররিস্ট অ্যাক্টিভিটিভ অ্যাক্ট (POTA)’ প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে বিচারপতি সাচারের বিশেষ অবদান রয়েছে। রাষ্ট্রশক্তি এই আইন প্রত্যাহার করলেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে আবার নতুন এক আইন তৈরি করল। ইউএপিএ (UAPA) আইন। ইউএপিএ (UAPA) আইনের ধারাগুলির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই ‘পোটা’ (POTA) আইনের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। পোটা (POTA) আইন প্রত্যাহারের মত ইউএপিএ (UAPA) আইন প্রত্যাহারের জন্য বিচারপতি সাচার ২০০৯ সালে আবেদন করেন। তিনি আফস্পা (AFSPA) আইন প্রত্যাহারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করেছেন একাধিকবার। কাশ্মীরের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। কাশ্মীরের মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি যেসব রিপোর্টের অংশীদার ছিলেন, সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ৩৭০ ধারা নিয়েও তার আলাদা মতামত ছিল। তিনি ৩৭০ ধারাকে অপপ্রয়োগ না করে সঠিকভাবে কার্যকর করার কথা বলে গেছেন। ভারত সহ সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং মানবাধিকার আন্দোলনের অনির্বাণ পথপ্রদর্শক ছিলেন বিচারপতি সাচার। বিতর্কিত জরুরী অবস্থা নিয়েও তিনি প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন।    
এই লড়াই করতে তাঁর সহায়ক হয়েছিল আইন নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ। আইনজীবীর পেশায় আসার আগে থেকে ভারতীয় গণতন্ত্র এবং মানবতার অন্যতম মুখ বিচারপতি রাজিন্দর সাচার। ছাত্রজীবন থেকে তিনি গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে সামিল হন। সাচার সম্পর্কে যারা জানেন তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল বাবা ভীমসেন সাচার কংগ্রেস করতেন। জওহর লাল নেহরুর আমলে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ভীমসেন সাচার। লাহোর আইন কলেজ থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাস থেকে রাজিন্দর সাচার সিমলা কোর্টে আইনজীবী হিসেবে তার পেশা শুরু করেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এবং কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টিতে অংশগ্রহণ করেন। পরে Peoples Union for Civil Liberty (PUCLL) কমিটিতে আজীবন সদস্য ছিলেন। ছাত্র জীবনে পুলিশের অত্যাচার সহ্য করেছেন আবার জেলও খেটেছেন।
১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে সুপ্রীমকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। সুপ্রীম কোর্টে আইনজীবী হিসেবে সিভিল, ক্রিমিনাল, রেভিনিউ সংক্রান্ত সব ধরণের মামলা তিনি লড়তেন। তার কর্মজীবন এতটাই বিস্তৃত ছিল সেটা আমরা জানতে পারি তার সঙ্গে যারা একসঙ্গে কাজ করেছেন তাঁদের কাছ থেকে। বিশিষ্ট আইনঞ্জ এবং হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধানবিচারপতি হিসেবে রাজিন্দর সাচারকে জাতিসংঘের ‘প্রমোশন অ্যান্ড প্রোটেকশন অব হিউম্যান রাইটস সাব কমিশন’-এর সদস্য নির্বাচিত করা হয়। এবং এটাও উল্লেখ করতে হয়, ‘প্রোটেকশন অব হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট ১৯৯৩’ রিভিউ করার জন্য প্রধানবিচারপতি জাস্টিস আজিজ মুসাব্বর আহমাদির নেতৃত্বে যে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি হয় সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন বিচারপতি সাচার। ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন গঠন এবং সুপারিশ জরুরীভিত্তিতে কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিক নেয় এই কমিটি।
নারী স্বাধীনতা নিয়েও তার ভূমিকা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়। নারীদের সামাজিক অধিকার, সাবলম্বিতা এবং নারীর মর্যাদা নিয়েও তিনি ছিলেন মুখর। দেশের যে কোনও প্রান্তের নারী নির্যাতনের বিরূদ্ধে তার কণ্ঠস্বর গর্জে উঠেছে। কখনও আইন বিশেষঞ্জ হিসেবে কখনও আবার গণতান্ত্রিক অধিকারের কর্মী হিসেবে। মানবাধিকার কর্মী হিসেবে। অশীতিপর বয়সেও রাজপথে নেমে মহিলা সংগঠনের সমর্থনে পায়ে পা মিলিয়ে জনপথে রাজপথে হেঁটেছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন গণতন্ত্র, মানবাধিকারের অতন্দ্র প্রহরী। তথাকথিত অভিজাত সমাজের চকচকে দেখনদারি জৌলুস ভেঙে তিনি সামনের সারিতে নেমে এসেছিলেন। আমাদের তাঁকে চিনতে আরও সহায়ক হয়েছিল। তিনি ছিলেন মানবতার মূর্ত প্রতীক। একজন বিচারপতি হিসেবে তিনি যে উচ্চতায় উঠেছিলেন তারপরেও প্রান্তিক মানুষের অধিকারের জন্য লড়াইয়ে সঙ্গ দেওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। বিচারপতি সাচার সেই কাজটি অনায়াসে করে তথাকথিত ‘আভিজাত্য’ নামক এক মিথ্যের অহংকার ভেঙে  চুরমার করে দিয়েছেন। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কাজের অধিকার বিষয়ক আন্দোলন, দুর্নীতি, জালিয়াতি, মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নিজের ইচ্ছায় ছুঁটে এসেছেন। একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে। আনুষ্ঠানিক কোনও আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করেননি তিনি। বিচারব্যবস্থা থেকে অবসরের পরে এই রুটিন কাজ আরও বেড়েছিল।
সম্প্রতি ৭ মে, ২০১৮ কলকাতায় মোলালি যুব কেন্দ্রে ‘সেন্টার ফর প্রোটেকশন অব ডেমোক্রাটিক রাইটস অ্যান্ড সেকুলারিজম(CPDRS)’ এবং লিগ্যাল সার্ভিস সেন্টার যৌথভাবে একটি স্মরণসভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বিচারপতি সাচার সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ওই দিনের আলোচনাসভায় বিশিষ্ট আইনজীবী পার্থসারথী সেনগুপ্ত বলেন, ‘’মানুষের অধিকার রক্ষায় এক অক্লান্ত মানুষকে আমরা হারিয়েছি। যেখানে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করতে হবে সেখানেই জাস্টিস সাচার হাজির হয়ে লড়াই করেছেন। তাই তিনি সংগ্রামী মানুষের আত্মার আত্মীয়।‘’
সিপিডিআরসি-এর সহ সম্পাদক গৌরাঙ্গ দেবনাথ বলেন, ‘’মানবাধিকার রক্ষার জন্য একজন প্রহরীকে আমরা স্মরণ না করে থাকতে পারিনি। আজকের সমাজে সৎ মানুষের বড়ই অভাব। রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করার জন্য তিনি সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হতে পারেননি।‘’
এদিনের অন্যতম বক্তা ছিলেন শিক্ষাবিদ এবং মননশীল ব্যক্তিত্ব মীরাতুন নাহার। তিনি বিচারপতি রাজেন্দর সাচারকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। বিভিন্ন গণআন্দোলনে একসঙ্গে কাজ করার সুবাদে মানবতাবাদী এই ব্যক্তিটি সম্পর্কে মীরাতুন খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘’এই দেশে অনেক বড় বড় মানুষ জন্মেছেনআমরা যাঁদের দেখে সামনে হাঁটার প্রেরণা পাই। রাজেন্দর সাচার সেইরকম একজন মানুষ। আদর্শকে বাস্তবে পরিণত করা। আদর্শকে আচরণে প্রতিফলিত করা। এটা বিচারপতি রাজেন্দর সাচার করেছেন। তার জীবন অনুকরণযোগ্য। সব সময়ের জন্য বিচারপতি সাচার গ্রহণযোগ্য। তাঁকে অনুকরণ করলে নিজেকে ধন্য মনে করি।‘’
রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং বিশিষ্ট আইনজীবী বিমল চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘’বিচারপতি সাচার ৯৪ বছর বয়সে মারা গেলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে মেলামেশা করেছি। আমি নিজেও PUCLL–এর আজীবন সদস্য। আমি নিজেও র‍্যাডিকযাল হিউম্যানিস্ট। রাজিন্দর সাচারও ওই কমিটির সদস্য ছিলেন। বুদ্ধি, বিদ্যা এবং প্রতিবাদের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বিরাট মাপের মানুষ। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে কথা বলে দেখেছি। নেহরু সম্পর্কে বিচারপতি সাচার PUCLL পত্রিকায় লিখে গেছেন। স্মৃতিচারণ করেছেন তার একটি প্রবন্ধে বিচারপতি সাচারের লেখাগুলি যদি সংগ্রহ করা যায় তাহলে দেখা যাবে তার প্রতিবাদের বিষয়গুলি। আমাদের দেশ নয় তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের প্রয়োজনে আসবে। বাম আমলে প্রচার ছিল পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম সংখ্যালঘুরা ভালো আছেন। সেই প্রচারে বিচারপতি সাচার জল ঢেলে দিয়েছেন। তার রিপোর্ট নিয়ে বাম নেতারাও প্রতিবাদ করতে পারেননি।[‘’
এসইউসিআই দলের প্রাক্তন সাংসদ তরুণ মণ্ডল বলেন, ‘’জাস্টিস সাচারকে দেখে মনে হয় সব মৃত্যু সমান হয় না। সাচারের মৃত্যু পাহাড় হিমালয়কেও হার মানিয়েছে। তিনিই একমাত্র বলতে পারেন, মানুষের ব্যাঙ্কের টাকা যারা লুঠ করেছেন তাঁদের নাম প্রকাশ করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, সরকার প্রভাব খাটিয়ে কোনও মামলার বিচারের কথা বলতে পারেন না। বিচারপতি সাচার ছিলেন সেই বিরল মানুষদের সমতুল্য। আমি ভলতেয়ার, আব্রাহাম লিঙ্কনের কথা বলছি। ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারের কথা, নাগরিক অধিকারের কথা যারা বলে গেছেন। বিচারপতি সাচার সেই গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ।
বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত বলেন, ‘’বিচারপতি সাচারকে নিয়ে এই স্মরণসভা অত্যন্ত গর্বের। জানি না সিকিমে হয়েছে কিনা? সাচারকে নিয়ে এই ধরণের স্মরণসভা দেশে আরও হওয়া উচিৎ।‘’
বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘’আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল ওর সঙ্গে। কিন্তু বিচারপতি সাচারের সিভিল লিবার্টি নিয়ে যা কাজ, এই বিষয়ে তার ভূমিকা সেই কাজে আমার কোনও ভূমিকা ছিল না। তার কর্মজীবনের বাইরে যে তার বৃহত্তর ভূমিকা ছিল সেটা আমরা জানি। যৌথভাবে বিচারের কাজ করার ক্ষেত্রে সবসময় সহমত হতে পারিনি। তবে তিনি সবসময় স্থীর এবং দৃঢ় সঙ্কল্পের মানুষ ছিলেন। ব্যক্তি স্বাধীনতা আন্দোলনে তার উৎসাহ বেশি ছিল। ঋজু ব্যক্তিত্ব। আপনি আমার মতের সঙ্গে ভিন্নমত হতে পারেন। বর্তমান সময়ে সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। এটা আমাদের সময়ে ছিল না। ভিন্নমতের মানুষের কথাও শুনতে হবে। সাচার ছিলেন সেই ধরণের বলিষ্ঠ মানুষ। নেহরুর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাচারকে তুলনা করা যায়।‘’                                                 

Friday 25 May 2018

ছাতিম গাছের ছাওয়ায় ভাষা এবং কূটনীতি


ভারতীয় উপ-মহাদেশ হোক অথবা  যে কোনও উপ-মহাদেশপ্রতিবেশী রাষ্ট্রের দুই রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে যখন আলোচনা হয় তখন কূটনীতি থাকবেই। এমনটা ধরে নেওয়া যায়। আজ শুক্রবার (২৫ মে) ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবিত একটি বৈঠক হচ্ছে। এই বৈঠকে দ্বিপাক্ষিক বিষয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবের পরে এই বৈঠক হওয়ার কথা। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে নরেন্দ্র মোদী মঞ্চে উপস্থিত থাকবনে। এদিনের সমাবর্তন মঞ্চে উপস্থিত আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এসেছেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ‘বাংলাদেশ ভবন’-এর উদ্বোধন করতে। সমাবর্তন এবং ‘বাংলাদেশ ভবন’ উদ্বোধনের পরে দু’ই দেশের প্রধানমন্ত্রী আলাদাভাবে বৈঠকে বসবেন। এমনটাই এখনও পর্যন্ত ঠিক হয়ে আছে।
উল্লেখ করা যায়, বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে এই বৈঠক দু’ই দেশের প্রধানের শেষ বৈঠক। যে কারণে সমাবর্তন অনুষ্ঠানকে ছাপিয়ে  দুই দেশের কূটনীতিকদের কাছে বাড়তি গুরুত্ব রয়েছে। সূত্রের খবর, বুধবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী সাংবাদিক সম্মেলন করেন।  বাংলাদেশের সাংবাদিকদরা দুই প্রতিবেশী দেশের শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হবে কিনা জানতে চাইলে আবুল হাসান মাহমুদ আলী কৌশলে বিষয়টি এড়িয়ে যান। তিনি বলেন, এটা নির্ভর করছে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর
মোদি চাইলে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমনটাই মন্ত্রীর বক্তব্য
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘’ভারত বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া সহ বাংলাদেশ সৃষ্টিতে ভারতের যে অবদান তা বাংলাদেশ কখনো লেনি। কাজেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তাদের আগ্রহ থাকতেই পারে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গও আলোচনায় উঠে আসতেই পারে‘’
তিনি আরও বলেন, ‘’দুই প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে গুরুত্ব পাবে রোহিঙ্গা সংকট, বিশেষত বাস্তুচ্যুতদের ফেরাতে ভারতের কার্যকর সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি নিয়ে মোদ সঙ্গে কথা বলবেন প্রধানমন্ত্রী। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে পরিকাঠামো তৈরিতে ভারত সহযোগিতা করবে বলে এর আগে অনুষ্ঠিত দ্বি-পাক্ষীক বৈঠকে মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন‘’
বাংলাদেশ সচিবালয় সূত্রের খবর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর মন্ত্রীসভার যে উচ্চ পর্যায়ের দল এসেছে সেই দলে বাংলাদেশ জলসম্পদমন্ত্রী নেই। ফলে ধরে নওয়া যায় এইপর্বে তিস্তার জলবন্টন নিয়ে খুব একটা অগ্রগতি হওয়ার সম্ভবনা নেই। যদিও সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমন্ত্রিত হিসেবে উপস্থিত রয়েছেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যেয় শান্তিনিকেতনে পৌঁছে মমতা সাংবাদিকদের বলেন, ‘’বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন আছে। বাংলাদেশ থেকে আমাকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন, আমিও থাকব। কথা হবে। পরের দিন শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাদা করেও কথা হবে।‘’
শুক্রবার সমাবর্তন অনুষ্ঠানের পর বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন। এর পরে রয়েছে মোদী-হাসিনার বৈঠক। বৈঠক চলবে একঘণ্টা। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের খবর, বৈঠকে দু’দেশের স্বার্থ জড়িত আছে এমনসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। প্রাসঙ্গিক এই আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গ এসেই যাবে। সেই কারণে সরকারি নিয়ম কানুনের বাইরে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেকে নেওয়া হতে পারে।
 নির্ধারিত অনুষ্ঠানসূচী অনুযায়ী ২৬ মে (শনিবার) আসানসোলে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্মানিক ডিলিট নিতে যাবেন হাসিনা। কলকাতায় ফিরে নেতাজী ভবনে যাওয়ার কথা তাঁর। সেখান থেকে ফিরে তিনি আলাদা করে মমতার সঙ্গে কথা বলবেন।  বাংলাদেশ বিদেশমন্ত্রক সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদাভাবে তাঁর হোটেলে দেখা করতে চেয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির কথা আলাদা করে উল্লেখ করেছেন। এবারের ভারত সফরে আসার তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য অবিভক্ত বাংলার স্মৃতিকে উসকে দেওয়া। বাংলাদেশ বিদেশ দপ্তর সূত্রে খবর ‘বাংলাদেশ ভবনে’ বাংলা ভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতি বিষয়ক গবেষনার সমস্ত সুযোগ সুবিধা পাওয়া যাবে। এই ভবনে নির্মিত হয়েছে আধুনিক থিয়েটার, প্রদর্শনী কক্ষ, বিশাল লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরিতে রয়েছে সাহিত্য, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস এবং বাংলাদেশ ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক সম্পর্কিত গ্রন্থ বাংলা ভাষা এবং বাংলা জাতি নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নিজের অনুভূতির কথা লিখেছেন সম্প্রতি। কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি প্রথম সারির বাংলা দৈনিকে আজকের প্রভাতি সংস্করণে হাসিনা লিখেছেন, ‘’বিশবকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন হতে চলেছে, এটা কত যে আনন্দের এবং গৌরবের, তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। শান্তিনিকেতনে এই ভবন স্থাপনের সুযোগ প্রদানের জন্য আমি বিশ্বভারতী কতৃপক্ষ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার, ভারত সরকার এবং সর্বোপরি ভারতের বন্ধুপ্রতিম জনগণের প্রতি গভীর কৃতঞ্জতা জানাচ্ছি। আমি আনন্দিত এ জন্য যে, ভবনটি  প্রতিষ্ঠায় যৎসামান্য হলেও আমার সম্পৃক্ততা থাকল।‘’    
২৫ মে বিশ্বভারতী বিশব্দ্যাল্যের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দো্যপাধ্যায়ের বলা কিছু অংশ আমরা উল্লেখ করছি। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রূপকল্প - ২০৪১ বাস্তবায়নে পূর্ণ সহায়তা এবং সমর্থন দিবে ভারত,,,
- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে দুদেশের অমিমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানে আশাবাদ; রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে ভারতের পূর্ন সহযোগীতা কামনা,,,,,

- প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ভবনটি উদ্বোধনের তারিখটিকে ‘গর্বের দিন’ উল্লেখ করে তাকে আমন্ত্রণ জানানোয় কৃতজ্ঞতা জানান মমতা। বলেন, ‘ভবনটি দারুণ’ হয়েছে’।
‘এত সুন্দর লেগেছে, আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে, বিউটিফুল’।
‘আমরা বঙ্গবন্ধুর নামেও একটা একটা ‘বঙ্গবন্ধু ভবন’ করতে চাই। যখনই দেবেন সুযোগ, আমরা কবর।’
- মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জ।