Thursday 14 June 2018

চতুস্পাঠি নয় ঠান্ডা ঘরে বসে কবি বিদ্যাপতির কথা শোনালেন বিদেশী গবেষক

দীপেন্দু চৌধুরী 

বিশ্বায়ন উত্তর ভারতে আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে তরুণ-তরুণীরা কতটা আগ্রহী? সারা রাজ্য আধুনিক মধ্য শিক্ষিত যুবসম্প্রদায়কে নিয়ে গবেষণা করলে কি দেখা যাবে? বিশ্বায়নের আশীর্বাদ হিসেবে আমরা যে উন্নত ঘরানার তথ্য-প্রযুক্তি পেয়েছি, সেই প্রযুক্তির দৌলতে বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা আমাদের থেকে অনেক বেশি আধুনিক। তারা যেমন পোশাকে নতুন ভাষা এনেছে, নতুন রঙ এনেছে, চেহারায় পালিশ চক চক করছে। খাদ্যাভাসেও আমাদের থেকে লোভ অনেক কম। শারীরিক ভারসাম্য মেনে চলা যায় এমন খাদ্য তারা পছন্দ করে। শারীরিক ভাষায় সব সময় চনমনে, গতিশীল। এরপরেই আসছে কথ্য ভাষা। হিন্দি, বাংলা, ইংরেজিকে ককটেল করে একটা নতুন ত্রিবেণী সংগম। কখনও বলিউড, কখনও টলিউডের সিনেমা থেকে টুকরো শব্দ। অথবা ওইসব ছবির জনপ্রিয় সংলাপের একটা দু’টো শব্দ বাক্যের সংমিশ্রণে আধুনিক ভাষা তাঁদের মুখে।
বর্তমান সভ্যতায় এই ভাষা ‘জলচল’ হয়ে গেছে। আমি সেকেলে বুড়ো হয়ে যাইনিঅথবা সব কিছু চলে গেল বলে হা হুতাশ করছি না। কারণ রক্ষণশীলতা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। সেদিন বিদেশী গবেষককে প্রথম প্রশ্নটা করেছিলাম এই বিষয়টা জানতে চেয়ে। আমার প্রশ্ন ছিল, ‘হারিয়ে যাওয়া একটা বিষয়। তথা জনপ্রিয় নয় এমন একটা ভারতীয় বিষয় নিয়ে আপনি গবেষণা করছেন? আমাদের দেশে ‘সংস্কৃত ভাষা’ প্রায় মৃতপ্রায়। আমরা জার্মানের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। আপনি সেই ভাষার এক কবিকে নিয়ে গবেষণা করছেন?’
বিদেশী ভদ্রলোক আমার প্রশ্নের উত্তরে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন। গত কয়েক দশকে ভারতে সংস্কৃত ভাষাচর্চা প্রায় নেই বললেই চলে। আমি আগ্রহী ছিলাম মৈথিলী কবি বিদ্যপতির বিষয়ে। কবি বিদ্যপতিকে নিয়ে গবেষণা করতে গেলে সংস্কৃত ভাষা জানতেই হবে। তাই এই ভাষা শিখে নিলাম।‘’
আমরা আলোচনা করছি আমেরিকা থেকে কলকাতা শহরে আসা ক্রিস্টোফার ডায়ামন্ডকে নিয়ে। ১৩ জুন আমেরিকান সেন্টারে একটা অনুষ্ঠান হয়ে গেল। অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু ছিল পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি বিদ্যাপতি এবং তার মৈথিলী ভাষায় লেখা কবিতা। সংস্কৃত ভাষায় অন্যান্য লেখার বিষয়েওকবি বিদ্যাপতির সাহিত্যের প্রভাব সেই সময় এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে কতটা পড়েছিল? আমন্ত্রণ পত্রে ছাপা হয়েছিল, Fulbright-Nehru fellow Christopher Diamond for a discussion about the influence of 15th Century poet Vidyapati on Bengali literature and culture.’  আমাদের আলোচ্য গবেষক সম্পর্কে আরও যেটা জানা যায়, Christopher Diamond Ph.D. Candidate-Fulbright-Nehru Fellow with the dept. of Jadavpur University, South Asian Languages and Literature, University of Washington-Seatle, USA    
মৈথিলী কবি বিদ্যপতির নামের তর্জমা করলে পাওয়া যাচ্ছে ‘বিদ্যা’ অর্থে ঞ্জান। ‘পতি’ শব্দের মানে শিক্ষক। বিদ্যপতি একটি সংস্কৃত শব্দ।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারছি ‘বিদ্যাপতি’ (১৩৫২-১৪৪৮) নামেই তিনি শুধুমাত্র পরিচিত ছিলেন না। তাঁকে ডাকনামে আদর করে ডাকা হত মৈথিলী ‘কবি কোকিল’ নামে। তিনি মূলত ছিলেন মৈথিলী কবি এবং সংস্কৃত ভাষার জনপ্রিয় লেখক। বিদ্যপতি জন্মগ্রহণ করেন ভারতের অবিভক্ত বিহার রাজ্যের মধুবনী জেলার মিথিলা অঞ্চলের ‘বিস্ফি’ গ্রামে। তিনি মারা যান সমস্তিপুরে। বিদ্যপতির পিতার নাম ছিল গণপতি ঠাকুর। কবি বিদ্যপতির রচিত কবিতা, পদ্য, পদাবলী পঞ্চদশ শতাব্দীতে ‘হিন্দুস্তানি’, বাংলা, মৈথিলী ভাষার লেখক, কবি সাহিত্যকদের মধ্যে ব্যপক প্রভাব ফেলে। প্রচ্ছন্নভাবে হলেও নেপালী ভাষা এবং পূর্বভারতীয় সাহিত্যের ধারায় এই প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ‘কাঁহা হরব দু’খ মোর’?   
বাংলা সাহিত্যে কবি বিদ্যপতির কাব্যের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। রাধাকৃষ্ণের প্রেমকে বিষয় করে তৎকালে বাংলা কাব্য রচনা করা হত। মধ্যযুগীয় সময়ে বাংলা কাব্যের ধারা শিল্পজাত হয়ে উঠতে থাকে। ষোড়শ শতাব্দীতে আমরা পাই ‘ব্রজবুলি’ ছন্দ বা ঘরানা। মধ্যযুগের মৈথিলী থেকে মূলত ‘ব্রজবুলি’ পৃথক ছন্দ বা ধারা হিসাবে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। মধ্যযুগের বাঙালি কবি গোবিন্দদাস কবিরাজ, কবি ঞ্জানদাস, কবি বলরাম দাস এবং কবি নরোত্তম দাস তাঁদের কবিতায় বা কাব্যে ‘ব্রজবুলি’ ছন্দ ব্যবহার করেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ (১৮৮৪) লেখেন ‘ব্রজবলী’ ছন্দে। বাংলা ভাষায় কবি বিদ্যাপতির লেখনীর প্রভাব কতটা পড়েছিল সেটা আমরা বুঝতে পারি দিকপাল এইসব কবি সাহিত্যিকদের ছন্দ বা পদাবলীতে ‘ব্রজবুলী’ ঘরানা। উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা রেনেসাঁর অন্যতম পথিকৃৎ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘ব্রজবুলী’ ভাষা বা ছন্দ ব্যবহার করেছিলেন। ইউরোপেও এই ছন্দের প্রভাবের কথা শোনা যায়।
এদিনের আলোচনা সভায় আমরা প্রথমে দেবকী বসু পরিচালিত বাংলা বিদ্যপতি সিনেমার ক্লিপিংস দেখি। পাহাড়ি সান্যাল অভিনীত সবাক যুগের ছবিটি দেবকী বসু নির্মাণ করেন ১৯৩৪ সালে। পর্দায় স্লাইড শোয়ের মাধ্যমে আমাদের সামনে বিদ্যাপতি বিষয়ক গবেষণা পত্রের বিষয়গুলি তুলে ধরেন বিদেশী গবেষক ক্রিস্টোফার। Inventing the Vidyapati Tradition: Lyric poetry and Memorialization in Mithila and Bengali Literature.
2.3 Malla in Nepal
Dates: 1360-1450CE?
Brahrun-Smata Courtier to Oinvara Court of Trihut works in 3 Languages.
Nepal as ‘’refuge’’ for politically turbulent Tirhut.
Malla Dynasty [c.1201-1769], especially Three Kingdom period.
বিষটাকে তিনি গুলে খেয়েছেন। ক্রিস্টোফার আরও জানালেন, বিদ্যপতির লেখা ১০০ পাতার খসড়া ১৯৩৬ সালে উদ্ধার করে নেপাল সরকার সংগ্রহশালায় রেখেছে। এক শ্রোতার প্রশ্নের উত্তরে তিনি আরও বলেন, ‘’আমি বাংলাদেশ যাইনি। এবারের সফরে ঢাকা যাওয়া সম্ভব হল না। তবে কলকাতায় আমার গবেষক বন্ধু এবং শিক্ষকদের কাছে শুনেছি বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য পরিষদের সংগ্রহে বিদ্যাপতি সম্পর্কিত অনেক তথ্য রয়েছে।‘’
ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সুভদ্র, সুশিক্ষিত ক্রিস্টোফার জানালেন, তিনি ১০ মাস আগে কলকাতায় গবেষণার কাজে এসেছেন। হিন্দুস্থান পার্কে থাকতেন। চলতি সপ্তাহে তিনি আমেরিকা ফিরে যাবেন। গত বছর দুর্গা পুজোর আগে কলকাতায় এসেছিলেন। তাই ১০-১৫টা দুর্গা মণ্ডপ দেখেছেন। বাঙালির সেরা উৎসব দুর্গা পুজোর মণ্ডপগুলি তিনি পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে দেখেন। বাংলার উৎকর্ষ, বাঙালি সংস্কৃতি, বাংলার কৃষ্টি, লোকাচারকে তিনি কলকাতা এসেই চিনতে শুরু করেন। তিন বছর আগে এই বিষয় নিয়ে ক্রিস্টোফার কাজ শুরু করেন। এশিয়া তথা ভারতের একটা লুপ্তপ্রায় ভাষার বিষয়ে আগ্রহ কেন হল?
বক্তিগত আলাপ চারিতায় ক্রিস্টোফার বললেন, ‘’আমি আমেরিকান সঙ্গীত ভালোবাসতাম। আমেরিকান লিরিক, সঙ্গীত থেকে ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের খবর পাই। শুনতে থাকি। আমার ভালো লাগে। তারপরেই আমি সংস্কৃত এবং বিদ্যপতি বিষয়ে আগ্রহী হয়ে পড়ি। প্রথমে হিন্দি শিখতে ইংল্যান্ডে যাই। লন্ডনে থেকে হিন্দি শিখি। পরে বাংলা তারপর সংস্কৃত। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৮ মোট ১১ বছরের জার্নি।‘’
তিনি বর্তমানে অনুবাদের কাজ শুরু করেছেন। সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দি, মৈথিলী মোট চারটে ভাষায় ‘বিদ্যাপতি-এর পদাবলী অনুবাদ করছেন। পরে এই অনুবাদগুলি থেকে বই প্রকাশ করবেন। অনুবাদের জন্য বিদেশী গবেষক এশিয়াটিক সোসাইটি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সাহায্য নিয়েছেন। ঘুরেছেন বাংলার নবদ্বীপ, বিহারের মিথিলা জেলা সহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য। এবং নেপালের কাঠমান্ডু সহ কয়েকটি স্থানে। আমাদের মনে হল ‘বিদ্যাপতি’-কে নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি নিজেও প্রভাবিত হয়ে পড়েছেন। অত্যন্ত সুভদ্র হাসি এবং ব্যবহারে আমরা ১৩ জুন আমেরিকান সেন্টারের লিঙ্কন সভাঘরের ঠাণ্ডা ঘরে তাঁকে পেলাম।              
স্লাইড শোতে দেখতে পেলাম ভারতের মধুবনী, নেপালের গবেষণা বিষয়ক তথ্য। এবং আমাদের বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতিতে ‘রাধাকৃষ্ণ’-এর প্রেম তথা বৈষ্ণব পদাবলী বা চৈতন্য যুগ। সে সম্পর্কে ক্রিস্টোফার বিস্তারিত আমাদের বললেন। তার কাছ থেকে জানতে পারলাম বিহারের মিথিলা অঞ্চলে বিদ্যপতির প্রভাব ব্যপক। স্থানীয় মানুষ তাঁকে ভগবানের মত পুজো করেন। হোরি খেলিছে ব্রজবাসি।                  
     

No comments:

Post a Comment