Thursday 28 June 2018

শুধুমাত্র বামপন্থা নয় ভারতীয় গণতন্ত্রের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব তিনি.........



দীপেন্দু চৌধুরী 
ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা প্রথম থেকেই দেখতে পাব বামপন্থীদের ভূমিকা ছিল ভীষণ রক্ষণশীল। অবিভক্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জন্মলগ্ন থেকে এই বিতর্ক শুরু হয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টি সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশগ্রহণ করবে কি করবে না? যতদূর জানি এই বিষয়ে অবিভক্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নীতিগত ঐক্য হয়নি। ১৯৬৪ সালে সিপিআই ভেঙ্গে সিপিএমের জন্ম যেমন চিন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যেকার দ্বন্দকে সামনে এনে দিয়েছিল, পাশাপাশি ১৯৬৯ সালের সিপিএম থেকে সিপিআই(এম-এল) গঠনের সময় অত্যন্ত গুরুত্ব পেয়েছিল ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ভূমিকা। এবং কমিউনিস্ট পার্টির অংশগ্রহণসিপিআই, সিপিএমের সঙ্গে আড়াআড়ি পার্থক্য লক্ষ করা গেছে সদ্যগঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট বিপ্লবী পার্টি সিপিআই(এম-এল) দলের। পরে এই দলটি ভেঙ্গে বিভিন্ন শাখা উপশাখা হয়েছে। সেই সব গোষ্ঠী সশস্ত্র বিপ্লবের নীতিতে বিশ্বাস রাখলেও ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমাদের দেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দগুলিকে গণতন্ত্রপ্রিয় ভারতীয় নাগরিকদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সংসদীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেয়। সংসদীয় গণতন্ত্রকে এইসব দলগুলি গণতন্ত্র বিকাশের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়।  
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এবং
এই নামটির সঙ্গে ভারতীয় গণতন্ত্রের স্রোত দীর্ঘদিন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমরা ২০০৪ থেকে ২০০৯ সালের পাঁচ বছরে সংসদীয় গণতন্ত্রে বামপন্থীদের বিতর্কিত ভূমিকার কথা জানি। এই সময়ে ভারতীয় সংসদীয় রাজনীতিতে এক অত্যন্ত উজ্জ্বল এবং ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। সদরদুর্গে কামান দাগার মতই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় নিজের দলে এবং ভারতীয় বামপন্থী দলের তথাকথিত ঘূণ ধরে যাওয়া এক দর্শনকে সজোরে ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন ভারতীয় সংসদের তৎকালীন অধ্যক্ষ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ভারতীয় গণতন্ত্রের স্বার্থে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল একটি বামপন্থী দলের ‘হুইপ’কে অমান্য করেছিলেন। ভারতীয় উন্নত গণতন্ত্রের স্বার্থে তার সেই সিদ্ধান্ত আজ ইতিহাস হয়ে গেছে। বিষয়টা কি ছিল? একটু উঁকি মেরে আসি।
২০০৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপির নেতৃত্বে এনডিএ জোটকে পরাজিত করে ডঃ মনমোহন সিংহের নেতৃত্বে কংগ্রেস ইউপিএ সরকার গঠন করে। বামফ্রন্ট লোকসভায় ৬১ জন সদস্য নিয়ে বাইরে থেকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করে। বামেদের সমর্থনে কংগ্রেস জোট সরকারের স্পিকার হয়েছিলেন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধি, প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ এবং স্পিকার সোমানাথ চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এই সরকার ভারতের গরীব নাগরিকদের স্বার্থে ন্যুনতম একটি সাধারণ কর্মসূচী প্রণয়ন করে। এই কর্মসূচীর আওতায় ছিল গ্রামের গরিব মানুষের জন্য ১০০দিনের কাজের ব্যবস্থা করা। তারপরের ঘটনা বাঁক নিল অন্যদিকে।
২০০৫ পর্যন্ত সিপিএম দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দগুলির প্রকট বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখতে পাইনি। কিন্তু সিপিএম দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য প্রবাদপ্রতিম বামপন্থী নেতা তথা পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু সেই সময় শারীরিক কারণে আর ততটা স্বক্রিয় থাকতে পারছিলেন না। কেরল এবং বাংলা লবির লড়াই ২০০৫ সালে ভারত সরকারের একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিকে কেন্দ্র করে সামনে চলে এল। ভারত আমেরিকার সম্পর্কের বিষয়টা একটু আগে থেকে দেখি। ১৯৯৫ সালে নরসিমহা রাও সরকারের আমলে ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৮ সাল পোখরান পারমাণবিক পরীক্ষার পর আমেরিকা সামরিক সহযোগিতা কিছুদিনের জন্য ঢিলেমি দিতে থাকে। ২০০০ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন ভারতে আসার পর তৎকালীন বিজেপি সরকার আমেরিকার কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। ২০০৪ সালে বিজেপি সরকার বিদায় নেওয়ার পরে ইউপিএ সরকারের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক আরও ভালো জায়গায় গেল। ২০০৫ সালে কন্ডোলিসা রাইস ভারতে এলেনতিনি সেই সময় ভারতকে নিয়ে আমেরিকার পরিকল্পনার কথা জানিয়ে গেলেন। ২০০৫ সালের জুলাই মাসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর যৌথ বিবৃতি প্রকাশের আগে একটি চুক্তির খসড়া তৈরি হল। এই খসড়া চুক্তিটি পরে ভারত আমেরিকা ১০ বছরের জন্য প্রতিরক্ষা কাঠামো চুক্তি হিসেবে পরিচিত হয়।
এই চুক্তির মাধ্যমে দু’টি দেশ সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের সম্প্রসারণে কাজ করবে। এছাড়া সামরিক ক্ষেত্রে পরস্পরের সহযোগী হিসেবেও কাজ করবে। পরিবর্তে ভারত অসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্রে কিছু ছার পাবে। আমেরিকার ‘হাইড অ্যাক্ট’-এর ১২৩ ধারায় এই চুক্তি হয়েছিল। আন্তর্জাতিকস্তরে আমেরিকার সঙ্গে তাঁদের দেশের নিউক্লিয়ার গবেষণা ও বাণিজ্য ক্ষেত্রে সামরিক এবং অসামরিক খাতে কেমনভাবে নির্ধারিত হবে তা ওই আইনের ১২৩ ধারায় নির্দিষ্ট করা আছে। এই চুক্তির পরেই সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন তুলে নেয়। যদিও সরকারের পতন হয়নি। কারণ তৃণমূল কংগ্রেস মন্ত্রিসভায় অংশগ্রহণ করার শর্তে ইউপিএ সরকারের শরীক হয়। সিপিএম দলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় তাঁরা সমর্থন তুলে নেবেএবং অধ্যক্ষ হিসবে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পদত্যাগ করবেন। তৎকালীন সিপিএম দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পদত্যাগ না করে দলকে বোঝাতে চাইলেন অধ্যক্ষ পদটি একটি নিরপেক্ষ ‘চেয়ার’। পদত্যাগ না করেও নিজেদের প্রতিবাদ জানানো যায়। অতি সুশৃঙ্খল একটি রেজিমেন্টেড বামপন্থী দল হিসেবে সিপিএম কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারল নাতাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হল।
সোমানাথ চট্টোপাধ্যায় পদত্যাগ করলেন না। নির্দল সদস্য হিসেবে পুরো সময় অধ্যক্ষের কাজ চালিয়ে গেলেন। ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রে এক নতুন ইতিহাস রচনা হল। ভারতীয় সংসদে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় বসু, অটলবিহারী বাজপেয়ী সহ একাধিক মেধাবী সাংসদের নামের সঙ্গে বাংলার ব্যরিস্টার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের নাম যুক্ত হল। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় এক বনেদী পরিবারের সন্তান। বাবা নির্মল চট্টোপাধ্যের কাছ থেকে তিনি প্রাথমিক রাজনীতির পাঠ পেয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে প্রেসিডেন্সী কলেজেও তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। দেশে ফিরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। স্বনামধন্য ব্যারিস্টার হিসেবে নিজে প্রতিষ্ঠা পান। ইংল্যন্ডে থাকার সময় থেকেই আর এক ব্যরিস্টার তথা কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর কাছাকাছি আসেন। যিনি নিজে রাজনীতির পাঠ নিয়েছিলেন রজনীপাম দত্তের কাছে। সোম্নাথবাবু সংসদীয় গণতন্ত্রে ক্রমশঃ ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
জ্যোতিবসুর মুখ্যমন্ত্রীর সময় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ‘শিল্প উন্নয়ন নিগম’-এর চেয়ারম্যান ছিলেন। যত দূর মনে পড়ে তার উদ্যোগেই আমাদের রাজ্যে প্রথম ‘শিল্প ও বাণিজ্য’ মেলা শুরু হয়। সিপিএম দলের জ্যোতি বসু এবং প্রমোদ দাশগুপ্ত দু’টি গোষ্ঠী পৃথক ঘরানা বা অস্তিত্বের কথা আমরা জানি। সোমনাথবাবু ছিলেন জ্যোতি বসুপন্থী। সেই কারণে সুভাষ চক্রবর্তী ছিলেন সোমনাথবাবুর খুবই ঘনিষ্ঠ। সুভাষদা যে কোনও বড় কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সোমনাথবাবুর সঙ্গে আলোচনা করে নিতেন।  
২০০৯ সালের পর থেকে আমরা নজর করলাম একজন গণতন্ত্রপ্রিয় ভারতীয় নাগরিক হিসেবে সোমনাথবাবু যে কোনও বিষয়ে মুখ খুলছেন। তার নিজের ভাষায় নিজস্ব শৈলীতে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ২০১৫ সালে ২ অগস্ট তিনি সংসদ অচল প্রসঙ্গে বলেন, ‘’....‘very agonising’ the freequent disruption of parliament and lamented the ‘inadewuancy’ of the position of the presiding officer.’’ সাম্প্রতিককালে দেশের অসহিষ্ণুতা, গোষ্ঠী সংঘর্ষ, দলিত নিগ্রহ নিয়েও সোমনাথবাবু বলেছিলেন. ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি বলেন,‘Intolerance divisiveness, corruption confrontations and disrespect for dissent are increasing vitiating the social-political system in the country.’’ ওই বছর অর্থাৎ ২০১৫ সালে ১৯ জুলাই সিপিএম দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হওয়ার পরে সীতারাম ইয়েচুরি নিজেদের ভুল স্বীকার করেন। এবং সোমনাথবাবুকে দলে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। ইয়েচুরী বলেন, ‘Our veteran leader would be reinducted into the party, seven years after his expulsion.’’  
সোমনাথবাবু ছ’মাস আগে ২৩ জানুয়ারী The Economic Times পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি অল্প কথায় নিজের দল, ভারতীয় সাংসদ এবং সংসদীয় ব্যবস্থা নিয়ে অনেক কথা বলেন। আমরা সেই সাক্ষাৎকারের কিছুটা অংশ এখানে উল্লেখ করছি। লেখাটির শিরোনাম সহ উল্লেখ করলাম।
 Prakash Karat's win is Narendra Modi's win; CPM must partner Congress: Somnath Chatterjee
The crisis in CPM deepens with a visibly serious divide over its political tactical line. Even as the party faces steady erosion in its support base across the country, especially in the east, the distinct split in the decision and policy making bodies in the communist party has added to the gloom. The three day central committee meeting held in Kolkata has widened the fissure. In an exclusive interaction with The Economic Times, Somnath Chatterjee, former Speaker of the Lok Sabha however made the former general secretary Prakash Karat responsible for the mess. “Had Sitaram resigned on Sunday following the voting process, the party would have been on the path of being obliterated. He has been trying hard to put the pieces together, but there is a limit to tolerance,” said Chatterjee. 

A decade after his expulsion from the party for voicing his displeasure over the CPM voting against the United Progressive Alliance, Chatterjee is still a loyalist and upset. “In a sense, Karat’s victory is Modi’s victory. Under the previous general secretary, the party was on the course of extinction. All his decisions and policies cost the party a lot. And it started when he refused to allow Jyoti Basu become the Prime Minister, followed by his decision of withdrawing support from UPA,” he told ET sitting in his residence in Kolkata. 

“Time has come when the party members should seriously think about its continuance as a serious political entity, which will be able to provide protection to people from the disruptive and destructive forces like BJP and TMC and give them a different narrative, an alternative,” added the Communist stalwart .
’’
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় চারটে উল্লেখযোগ্য বই লিখেছেন। সেগুলি হল Keeping the faith, Memoirs of A Parliamentarian, The collected speeches of Somnath Chatterjee. এই বইগুলিতে তিনি নিজের মেধা এবং  অভিঞ্জতা বিনিময় করেছেন ভারত এবং সারা বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষের সঙ্গে। একটি ছোট লেখায় তার সামগ্রীকতা কতটা আর আনা সম্ভব? ভারতের গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে তিনি একটি নতুন অধ্যায়। আমাদের বলতেই হবে শুধুমাত্র বামপন্থা নয় ভারতীয় গণতন্ত্রের ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব তিনি.........
 

Tuesday 26 June 2018

‘অপর’ সমাজের আরও একটা স্রোত



দীপেন্দু চৌধুরী
মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধান। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রশাসন এলজিবিটি (LGBT) সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর জন্য আমেরিকায় যে আইন আনলেন তারপর সেটা আজ ইতিহাস। আমেরিকা সেখানেই থেমে থাকল না। আমেরিকায় সরকার বদল হলেও ট্রাম্প প্রশাসন এই সম্প্রদায়ের আন্দোলনকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় সমস্ত রকমের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন‘এলজিবিটি’ (সমকামী, উভকামী এবং রুপান্তরকামী) গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের স্বীকৃতির লড়াইয়ের ইতিহাস আমরা আমেরিকার সাহিত্য, চলচ্চিত্রে ধারাবাহিকভাবে দেখে আসছি। কলকাতা আমেরিকান সেন্টার পুরো জুন মাস ধরে টানা এই বিষয়ে চলচ্চিত্র প্রদর্শন এবং আলোচনার ব্যবস্থা করেছে। ২ জুন ছিল Pride Month Film Fest. ব্যানারের ছবি। ছবির নাম ‘Philadelphia’ ছবিটা আমি দেখেছি। ছবিটি না দেখলে আমরা বুঝতে পারব না ‘এলজিবিটি’ আন্দোলন কতদিন আগে আমেরিকায় শুরু হয়েছিল।
৯ জুন ছিল ছবি। আবারও Pride Month Film Fest. ব্যানারের ছবি। ছবির নাম ‘Milk’এই ছবি থেকে আমরা সমাজের ‘অপর’ সম্প্রদায়ের মানুষের পারিবারিক যন্ত্রণা, ব্যাক্তিগত যন্ত্রণার এক মর্মস্পর্শী চিত্রনাট্য খুঁজে পাই। ব্যক্তি মানুষের, গোষ্ঠী মানুষের সামাজিক অবহেলা থেকে মুক্তির জন্য ‘এলজিবিটি’ গোষ্ঠীর আন্দোলন আমাদের সেলুলয়েডের পর্দা থেকে বাস্তবে টেনে নামিয়ে আনে। ‘মিল্ক’ নামের একজন সমকামী মানুষ স্থানীয় পুরসভা বা লোকাল বোর্ডের নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তারপর তাঁকে কেন্দ্র করে ছবির গল্প এগতে থাকে। এই ছবিটিও আমি দেখেছি। মিল্ককের আহ্বানে সমকামী, উভকামী রুপান্তরকামীরা একমঞ্চে সংগঠিত হতে থাকে। একসময় নির্বাচন শেষ হয়। মিল্ক জিতে যায়। তবু সমাজের মূলস্রোতে ওদের স্বীকৃতি মেলে না। যে স্বীকৃতির লড়াই সারা বিশ্বে আজও চলছে। মিল্ক নামের এই ছবি আত্মপ্রকাশেরও পঞ্চাশ বছর আগে ‘এলজিবিটি’ আন্দোলনের শুরুয়াত। ইউরোপের জার্মানি থেকে শুরু হয়েছিল এই আন্দোলন।  
জুন মাসের ধারাবাহিকতায় ২০ জুন আমরা পেলাম সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সেদিন দুপুর দুটোয় ‘South Asina Young Queer activists Network/ SAYAN 2nd Conference. LGBT and Livelihood Discrimination.’ শুরু হল অন লাইন সেমিনার। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনের যৌথ আয়োজক সংস্থা ছিল ‘প্রান্তকথা’ নামে একটি এনজিও। প্রান্তকথা আমন্ত্রণপত্রে আহ্বান জানিয়েছিল ‘Across South Asia, including India, queer youth , youth belonging to gender and sexuality minorities are subjected to similar challenges, atrocities, violence and persecution 🛑
SAYAN or South Asian Young Queer Activists Network currently is the only South Asian platform of its kind 🌏 
With technical support from American Posts from Burma, Bangladesh, Sri Lanka, Nepal and India (Kolkata) we will have the 2nd Digital Conference on the existing ground realities across these countries. Please
join us in this historical endeavour.’   
প্রান্তকথা নামের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার বাপ্পাদিত্য মুখোপাধায় ২০জুন অনুষ্ঠানের কয়েকদিন আগে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানিয়েছিলেন, ‘’আমরা ‘এলজিবিটি’ আন্দোলনকে আরও বৃহত্তর সামাজিক প্রেক্ষাপটে নিয়ে যেতে চাই। সেই কারণে এই সম্প্রদায়ের যুবগোষ্ঠীর বক্তব্য আমরা শুনব।‘’  
‘সায়ন’ বা সাউথ এশিয়ান ইয়ুথ ক্যুয়ার অ্যাক্টিভিস্টস নেটওয়ার্ক নামের সম্মিলিত মঞ্চের ছিল এটা দ্বিতীয় বৈঠক। শুধু আমাদের দেশে নয় সারা বিশ্বে সামজিক অধিকারের প্রশ্নে আজও এই সম্প্রদায়কে তথাকথিত সমাজের বাঁকা চাহনি, অবহেলা, কটুকথা সহ্য করতে হয়। আজও ওরা ‘অপর’ হয়ে রয়ে গেল। মনে পড়ছে রাজা রাম মোহন রায়ের আন্দোলনের কথা। সতীদাহ প্রথা বন্ধের আন্দোলন। পরম্পরা হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয় শুরু করেছিলেন বিধবা বিবাহ। সেই সময়কাল থেকে এগিয়ে আসতে থাকলে বর্তমান উচ্চশিক্ষিত, বনেদী সমাজের কতটা পরিবর্তন হয়েছে? এর উত্তর কে দেবে?     
সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে এদেশের রূপান্তরকামীরা কিছু  স্বীকৃতি ও অধিকার পেলেও, সামাজিকভাবে আজও তাঁরা প্রায় একঘরে। আর সমকামী, উভকামীদের লড়াই তো আরও কঠিন। দেশের আইন তাঁদের বিপক্ষে। শতাব্দী প্রাচীন ব্রিটিশ আইনের (ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা) দৌলতে সমপ্রেম এদেশে আজও অপরাধের তকমা পায়। তবে শুধু ভারত নয়, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার, শ্রীলঙ্কার মতো দক্ষিণ এশিয়ার মতো দেশগুলিতেও পরিস্থিতি প্রায় সমান। একমাত্র ব্যতিক্রম নেপাল। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে খবর সেখানে সমকামী বিবাহকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০ জুন ভিডিও কনফারেন্সেরমাধ্যমে আলোচনায় কাঠমান্ডুর প্রতিনিধিদের প্রশ্ন ছিল রুপান্তরকামী, হিজড়েদের সামাজিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে কেন?   
২০১৪ সালের ১৫ এপ্রিল এক ঐতিহাসিক রায় ভারতবাসীর সামনে এসেছিল। সুপ্রীমকোর্ট রায় দিয়েছিল ট্রান্সজেন্ডারদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে গণ্য করতে হবে। এঁরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে, ফলে শিক্ষা, জীবিকা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার যেন এঁদের সমান সুযোগের বন্দোবস্ত করে। সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি কে এস রাধাকৃষ্ণের রায়ে বলা হয়েছিল ‘’তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি কোনও সামাজিক বা চিকিৎসা সংক্রান্ত ইস্যু নয়। মানবাধিকারের প্রশ্ন বলেই বিবেচ্য।‘’ শুধু তৃতীয় লিঙ্গ কেন? সমকামিতা বিষয়ক ৩৭৭ ধারাটি নিয়েও প্রশ্ন আজও থেকে গেল। ঔপনিবেশিক আমলের বস্তাপচা মানসিকতা থেকে এই ধারাটি ভারতীয় আইনের ধারায় সংযোজিত  হয়েছিল। সুপ্রীম কোর্টের পর্যবেক্ষণ ছিল, আইনে একটি সংশোধন করলেই হয়ে যাবে। অবশ্য এই সংশোধনের দায়িত্ব আদালতের নয়। ভারতীয় সংসদের। সেই রায়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত সংসদে এ বিষয়ে কোনওরকম আলোচনা হয়নি।
রাষ্ট্রপুঞ্জ তার অফিসে সমকামী দম্পতিদের জন্য অন্যদের সমান সুবিধা দিতে চাইলেও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় ভারত।
আমরা আলোচিত নিবন্ধে যে বিষয়গুলি উল্লেখ করলাম ২০ জুন কলকাতা আমেরিকান সেন্টারের লিঙ্কন সভাঘরে এই বিষয়গুলি আরও বিস্তারিত এবং আক্রমণাত্বকভাবে উঠে এসেছিল। ওই দিনের আলোচনা দুটি পর্বে বিভক্ত ছিল। প্রথম পর্বে ছিল এলজিবিটি কিউ আই ইয়ুথ এন্ড লাইভলিহুড ডিসক্রিমিনেশনআমরা প্রথমেই একটি বিষয়ে নজর করি। ২০ জুনের ভিডিও সম্মেলনের জন্য বসার আয়োজনটা অত্যন্ত চোখে পড়ার মত। একটা লাটিন বর্ণমালার ‘ইউ’ আকৃতির সুদৃশ্য টেবিলকে কেন্দ্র করে বসার ব্যবস্থা হয়েছিল। টেবিলের সামনে প্রমান সাইজের পর্দা। টেবিলের একদিকে বসেছিলেন ‘এলজিবিটি’ আন্দোলনের প্রথম শ্রেণীর নেতৃত্ব। অপর্ণা, তিস্তা, অনুরাগ, রঞ্জিতা, সমর্পণ মাইতি। তাঁদের পাশে বসে অনুষ্ঠানের ‘মডারেটর’ তথা আমেরিকান সেন্টারের ডেপুটি ডিরেক্টর জয় ট্রেলর। যিনি পুরো অনুষ্ঠানকে নিজস্ব ঘরানা এবং শৈলীতে পরিচালনা করেন। ছিলেন সাংবাদিক তথা সমাজ কর্মী বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায় এবং আমেরিকান সেন্টার, কলকাতার কনস্যূলেট জেনারেল ক্রেগ হল। সম্প্রতি যার নেতৃত্বে কলকাতা, ভারত, এশিয়া এবং আমেরিকার সংস্কৃতির নতুন দিগন্ত আমরা দেখতে পাচ্ছি। তৈরি হচ্ছে নতুন আরও এক মেলবন্ধন। আরও এক সাংস্কৃতিক এবং আধুনিক বাণিজ্যের মেলবন্ধন। যাকে আমরা নতুন ঘরানা বলতে পারি।          
এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, নেপাল এবং ভুটানের প্রায় ১০০ জন প্রতিনিধি। অনুষ্ঠানের শুরুতেই জয় ট্রেলর কলকাতার আমেরিকান সেন্টারে আলোচনার দায়িত্ব ভাগ করে দিয়েছিলেন। এই উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলির মার্কিন কনস্যুলেটের অফিসউল্লেখিত দেশগুলির বিভিন্ন মার্কিন কনস্যুলেট থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য পেশ করেন সেই সমস্ত দেশের প্রতিনিধিরা। কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেট এই আয়োজনের মূল কেন্দ্র। কলকাতার মার্কিন কনসাল জেনারেল ক্রেগ হল অনুষ্ঠান শুরুর কিছুক্ষণ আগে জানান, ‘’এলজিবিটি অধিকারের প্রশ্নে এই দেশগুলিতে একসঙ্গে লড়াইয়ের মঞ্চ প্রস্তুত করতেই এই সেমিনারের আয়োজন এবং তাতে সহযোগিতা করছে মার্কিন কনস্যুলেট।‘’  
আমরা আগেই জানতে পেরেছিলাম পাকিস্তানকে নিয়ে কিছুটা চিন্তা রয়েছে উদ্যোগী সংস্থার। কারণ মাস দুয়েক আগে এই ধরণের পৃথক একটি ভিডিও কনফারেন্সে সে দেশের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেননি। কিন্তু এবারেরটা ব্যতিক্রম। উৎসাহের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইসলামাবাদের যৌন সংখ্যালঘু সমাজের প্রতিনিধিরা পরামর্শ চাইলেন। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের সমস্যার কথা তুলে ধরলেন। মায়ানমার, বাংলাদেশ, ভারত এবং নেপালের সহনাগরিকরা প্রশ্নের উত্তর দিলেন। শুধুমাত্র ইসলামাবাদ নয় করাচী শহরের সমকামীরা নিজেদের অবস্থার কথা জানালেন। তাঁদের বক্তব্যে উঠে এল তাঁদের অবস্থাটা প্রান্তিক জনজাতি গোষ্ঠীর মত। তাঁরা স্থানীয়ভাবে কোণঠাসা। তাঁরা অভিযোগ করলেন, পাঁচ বছর আগে থেকে স্কুল-কলেজে সমস্যা আছে। কিছুটা জোর করেই স্কুল- কলেজ ছাড়তে বাধ্য করানো হয়।
পাকিস্তানেও রুপান্তরকামী বা ট্রান্সজেন্ডাররা কিছুদিন হল আইনি স্বীকৃতি পেয়েছেন। ট্রান্সজেন্ডাররা আইনি স্বীকৃতি পেলেও লেসবিয়ান, গে’দের মতো সমকামীদের সামাজিক বা আইনি স্বীকৃতি নেই। করাচি, ইসলামাবাদ থেকে প্রশ্ন ছিল তাঁরা কি করবে? কিভাবে পাল্টান সম্ভব? স্বীকৃতি আদায় সম্ভব? রেঙ্গুন থেকে দাবি উঠল, ট্রান্সজেন্ডারদের অস্ত্রপচারের সব রকমের ব্যবস্থা করতে হবে। এলজিবিটি অধিকারের জন্য। we have no legal protection. Working of Laws, Implication of Laws-এর কিভাবে ব্যবস্থা করা যায়? প্রশ্নগুলির উত্তর দিলেন কলকাতার যৌন সংক্রান্ত আন্দোলনের সমাজকর্মী বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘’ দলিতদের সংগ্রাম ২০০ বছরের পুরনো। এলজিবিটিদের সংগ্রাম, দলিতদের সংগ্রামকে আমরা একসঙ্গে এক রাস্তায় একটা মিছিলে আনতে চাইছি। আমাদের এই সভাঘরে মুসলিম মহিলারা আছেন। আমরা বিভিন্ন সম্প্রদায় থেকে শিখব। শ্রমিক সংগঠন থেকে আমরা নেব। এখানে অনেক তরুণ প্রতিনিধি হাজির আছেন। তাঁদের থেকেও শিখতে হবে।  কলকাতায় সমকামীরা এডস সচেতনতার মতো বিষয়ে সামাজিক আন্দোলের সমর্থনে লড়াই করছেন। এবং এভাবেই ওরা সমাজের মূল স্রোতের কাছে আসেন।‘’
দিল্লি থেকে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন এ দেশের তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার-সংক্রান্ত যুগান্তকারী রায়ের এক আবেদনকারীও। তৃতীয় লিঙ্গভুক্তদের পিছিয়ে পড়া শ্রেণী বা ওবিসির মর্যাদা দেওয়ার কথা বলেছে নালসা রায়।  এদিন সেই রায়ের কথা মনে করিয়ে দেন সেই আবেদনকারী। ঢাকার যৌন সংখ্যালঘুরা বলছিলেন বিভিন্ন সামাজিক প্রতিবন্ধকতার কথা। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কতটা ঝুঁকি রয়েছে সেই কথা বললেন তাঁরা। আমরা শুনলাম মায়ানমারে রূপান্তরকামী মেয়েদের লিঙ্গান্তরের অস্ত্রোপচারের সমস্যা এবং ঝক্কি ঝামেলার কথা। হাসপাতালে গেলে পুলিশ ধরবে। তাই বাধ্য হয়ে হাতুড়ের স্মরণাপন্ন হতে হয়। উত্তর এল চেন্নাই থেকে। সেখানের একটি এনজিও সংস্থার প্রতিনিধি জানালেন, ‘’তামিল নাড়ুতে এই শল্য চিকিৎসা নিখরচায় করা যায়। এবং অবশ্যই নিরপদে। কেউ এলে সাহায্য করব।‘’
কলকাতার মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল গ্রেগ হল বলেন, ‘’২০১৮ সালের মার্চ মাস থেকে কলকাতার হাসপাতালে ট্রান্সজেন্ডারদের অপারেশনের কাজ শুরু হয়েছে।‘’ তিনি পরে আরও বলেন, ‘’যন্ত্রণার গল্পগুলো এ ভাবে ভাগ করে নিতে পারলেই এগিয়ে চলার রাস্তাটাও খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসবে।‘’    
এলজিবিটি আন্দোলনের সমাজকর্মী তিস্তার উপর দায়িত্ব ছিল অল্প কথায় অনুষ্ঠানের শেষ বক্তব্য রাখার। তিস্তা বলেন, ‘’ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য নিজেদের গোপনীয়তা সামাজিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। Trans Gender Board (TGB) আছে। We need to understands every issues.
দ্বিতীয় পর্বে ছিল মত বিনিময় সভা। আলোচক ছিলেন সমর্পণ মাইতি, তিনি গে সমাজের অধিকার নিয়ে আন্দোলন করছেন। সম্প্রতি তিনি পশ্চিমবঙ্গ থেকে Mr. Gay World’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। 2nd Runners up হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘’গ্রাম থেকে ছোট শহর সেখান থেকে বড় শহর। আমি স্কুল থেকে নিগ্রহের শিকার। আমাকে কলেজ হস্টেল থেকে বের করে দেওয়া হয়। When I got a chance to pursue research in Calcutta, I thought I would no longer be bullied because people here were far more open minded. But I was wrong. আমার কয়েকজন ঘনিস্ট বন্ধু আমার পাশে আছে।‘’
 শুভাগতা ঘোষ,  সাফো নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি বলেন, ‘’ একজন লেসবেন মহিলার প্রতিরোধটা আসে বাবা-মায়ের কাছ থেকে। আমরা সমানাধিকারের জন্য লড়াই করছি ১৯ বছর। বাড়ি থেকে লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। শিক্ষিত হতে না পারলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়া যাবে না। অর্থনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য উচ্চ শিক্ষার সমস্যা হয়। এবং তখন চাকরি বা কাজ পাওয়া যায়না গ্রাম মফসসলের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি হয়। এই বিষয়টাকে আরও গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।‘’  
কুচিনা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান তথা শিল্পপতি নমিত বাজোরিয়া বলেন, ‘’৩-৪ বছর আগে থেকে আমরা সোশ্যাল এন্টরেপেনারশিপ শুরু করেছি। ভারতের বিভিন্ন শহরে আমরা শুরু করি। সামাজিকভাবে এই সম্প্রদায় অবহেলিত। মালদহ জেলার একজনকে আমরা ‘ফেলো’ হিসেবে সাহায্য করছি। যাঁদের মেধা তাঁদের প্রত্যেকের কাজ পাওয়ার অধিকার আছে।‘’  
ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায়ের থেকে নাটক করেন সুজয় এবং অনুরাগ। তাঁরা মূলস্রোতের নাট্য পরিচালকদের প্রসঙ্গে বিভিন্ন অসাম্যের কথা বলেন। কাজ না পাওয়ার কথা বলেন। তাঁরা সমানধিকারের কথা বলেন। অপর্ণা বলেন, ‘’আমি হিজড়ে সম্প্রদায়ের সমাজকর্মী। উচ্চ শিক্ষিতইংরেজি স্কুল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। মূল ধারার মানুষেরা আমাদের সঙ্গে কি ধরণের ব্যবহার করে আমরা জানি। আমি ইংরেজি স্কুল কলেজে পড়েছি বলে কিছুটা সমীহ পাই। কিন্তু যারা সাধারণ সমাজের তাঁদের সঙ্গে কি ধরণের অমানবিক ব্যবহার করা হয়? সমাজ কি আজও পাল্টাবে না? আমদের সরকারি-বেসরকারি চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত কেন? কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় আমাদের কাজের স্বাধীনতা কতটা?’’
কিছুদিন আগে ভারতের বাণিজ্যনগরী মুম্বাইয়ে এলজিবিটি সমাজের মানুষদের কাজের সুযোগ নিয়ে একটি সমীক্ষা হয়। সমীক্ষাটি করেন পরমেশ সাহানি। ‘গে বোম্বে’ নামে একটি বইয়ের লেখকও তিনি। তাঁদের সমীক্ষার কিছু অংশ আমরা উল্লেখ করছি।
              ’The Second Indian LGBT Workplace Climate Survey was conducted with the aim of assessing the workplace environment vis-à-vis LGBT employees in corporate India. While the first such survey in 2012 had revealed many key insights, the second survey sought to follow up on those findings- especially in the context of homosexuality being recriminalized by a Supreme Court ruling in December 2013. Workplace Diversity & Inclusion has now been widely recognized as a business driver. However, one segment of the employee base that is still largely neglected and their presence unrecognized at least in the Indian workplace– is that of LGBT employees. The Supreme Court ruling on Section 377 has also hurt the pace of progress on this issue. Section 377 of Indian Penal Code does not criminalize LGBT identity and hence initiatives that promote inclusion of LGBT employees – such as constituting Employee Resource Groups- do not pose any legal risk for the companies, however, risk-averse organizations have taken a safer route by not taking any steps in this regard. On the other hand, some multinationals- especially those based in the US and Europe are bringing LGBT-friendly policies into their Indian offices as well. This survey focused on three sectors of the economy- Information Technology, Banking & Finance and FMCG & Manufacturing. Hundred respondents from various Indian and foreign multinational companies participated in the survey that showed interesting results. The results were a mixed bag - more than half of LGBT Indians we surveyed could be legally fired from their jobs for being LGBT. Only a small minority- 4% are covered by......’’
আমরা উল্লেখ করছি আরও দু’টি বিষয়ের। প্রথম বিষয়টি হচ্ছে, রক্ষণশীল সমাজ যেভাবে মানসিক অসুস্থতার তকমা দিয়ে থাকেন রুপান্তরকামীদের এটা আর করা যাবে না। ১৮ জুন রাষ্ট্রপুঞ্জ একটি তালিকা প্রকাশ করেছে। এই তালিকায় মোট ৫৫ হাজার রোগ, আঘাত এবং সম্ভাব্য মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এমন সব রোগের কথা বলা হয়েছে। সেই তালিকায় ‘মানসিক অসুস্থতার’ তালিকা থেকে সরিয়ে ‘যৌন স্বাস্থ্য’ সংক্রান্ত তালিকায় রাখা হয়েছে রূপান্তরকামীদের। হু-র এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘’আশা করা যায়, এই নতুন তালিকা প্রকাশের পরে বৈষম্য কমবে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হছে সংসদীয় মন্ত্রক সূত্রে খবর, সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হচ্ছে ১৮ জুলাই। তিন তালাক এবং রূপান্তরকামী সংক্রান্ত বিলও এই অধিবেশনে পেশ হওয়ার কথা। 
  
  

 

Friday 22 June 2018

ঘর ভাঙার ইতিহাস ভোলা যায় কি? আমরা ভারতীয় ছিলাম ভারতীয় আছি



দীপেন্দু চৌধুরী
উপত্যকায় জারি হয়েছে রাজ্য পালের শাসন। প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে জম্মু-কাশ্মীরে যে জোট হয়েছিল এই জোট নিয়ে কাশ্মীরের সদ্য প্রয়াত সাংবাদিক শুজাত বুখারী সহ অনেকেই সন্দীহান ছিল। কাউকে বলতে শুনিনি বিজেপি এবং পিডিপি জোট জম্মু-কাশ্মীরের শাসন পাঁচ বছর চালাতে পারবে। যারা কাশ্মীর নিয়ে খোঁজ খবর রাখেন এমন মানবাধিকার কর্মী বন্ধু, সাংবাদিক, লেখক, আইএএস অফিসার প্রাক্তন সেনা অফিসার কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না এই জোটের বিষয়ে। কিন্তু বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধবের মত একজন দক্ষ প্রাক্তন আরএসএস কর্মীর নেতৃত্বে এই জোট গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। জাতীয় স্বার্থে। এমনকি জোট গড়ে ওঠার পর পিডিপি নিজের রাজ্যে মানুষের কাছে বিশ্বাস যোগ্যতাও হারাতে বসেছিল। জোট ভেঙে যাওয়ার পর রাম মাধব বলেছেন, ‘’জোটে থেকে শান্তি আর উন্নতি হচ্ছে না। বাড়ছে সন্ত্রাস, হিংসা, চরমপন্থা।‘’ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কাশ্মীরে উন্নয়ন কিভাবে সম্ভব? রাম মাধব আপনার দল খুব সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। রমজান মাস চলার সময় গত ১৭ মে থেকে সেনা অভিযান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
মাননীয় রাম মাধব আপনাদের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ ঠিক কথাই বলেছেন কাশ্মীরের শান্তিপ্রিয় মানুষ রমজান পালন করুন শান্তির পরিবেশের মধ্যে। রাষ্ট্র তার জন্য সব ধরণের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু ঘটনা কি ঘটল? সংঘর্ষ বিরতির সময় দু দু’টো বিতর্কিত মৃত্যু। একদিকে সাংবাদিক সম্পাদক শুজাত বুখারির মৃত্যু। যে মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সারা ভারত সহ সারা বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে। অপরদিকে ইদের সময় ভাইয়ের জন্য নতুন পোশাক, ক্রিকেট ব্যট, নতুন উপহার নিয়ে আসার কথা ছিল দাদা ঔরঙজেবের সংঘর্ষহীন নিজের রাজ্যে! তিনি বাড়ি ফিরলেন তার সতীর্থদের কাঁধে করে। তিনি ফিরলেন না। ফিরল তার নির্জীব দেহটা। জম্মু কাশ্মীরের পদাতিক সেনার সদস্য ঔরঙজেবের গুলিতে ঝাঁঝরা মৃতদেহ মেলে। অভিযোগ গত সপ্তাহে সন্ত্রাসবাদীরা অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। এই দু’টি ঘটনার পরেও বলতে হবে জম্মু-কাশ্মীর নামক রাজ্যে সংঘর্ষ বিরতি চলছিল?     
কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি সাংবাদিক শুজাত বুখারির বাবাকে একটি শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছেন, ‘’ঠান্ডা মাথায় শুজাতকে খুনের ঘটনা আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সংকীর্ণ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে কাশ্মীরের পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। এর মধ্যেই যুক্তিবাদী ভাবনা নিয়ে কাজ করছিলেন শুজাত। তবে তার মৃত্যু বুঝিয়ে দিচ্ছে, জঙ্গিরা সব সময়ই এই ধরণের মানুষকে চুপ করিয়ে দিতে কতটা তৎপর।‘’                    
অবশেষে উপত্যকার মানুষ বিশ্বাস করলেন পিডিপি নেত্রী তথা প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ঘর ভাঙার ইতিহাস ভুলে যান নি। তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে আছেন। মেহবুবা মুফতি আপনি আপনার অভিঞ্জতার মানদণ্ডে সম্ভবত ঠিকই বলেছেন। আপনি পদত্যাগ করার পরে বলেছেন, ‘’আমাদের নীতি ছিল ‘হিলিং টাচ’। এটাকেই আমরা একমাত্র অ্যাজেন্ডা হিসাবে রেখেছিলাম। জম্মু ও কাশ্মীরকে আমরা ভারতের শত্রুভূমি বলে ভাবতে পারি না।‘’
আমরাও মনে করতে চাইছি ঘর ভাঙার ইতিহাস জম্মু-কাশ্মীরের আপামর মানুষ সহ ভারতীয় উপ মহাদেশের মানুষ ভুলতে চায় না। তাঁরা বলছে আমরা ভারতীয় ছিলাম ভারতীয় আছি। জম্মু-কাশ্মীরে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ হোক।  
 উপত্যকার মানুষের আজ বড় বেশি প্রয়োজন একজন আপনজনের, যার স্পর্শে তাঁদের আহত মনের নিরাময় হবে! উপত্যকার সাধারণ খেটে খাওয়া যুবক-যুবতি মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। দীর্ঘ দিনের বঞনার কথা তাঁরা কয়েক পুরুষের কাছ থেকে তাঁরা  শুনেছে। এবং  এই প্রজন্মও শুনছে। রাজনীতির রঙ ওরা চিনতে পারছে না। রাজনীতির আঁচ ওরা বিশ্বাস করছে না। সংবাদ মাধ্যমে বিশেষঞ্জ কলাম লেখকেরা লিখছেন। বিভিন্ন রিপোর্ট পর্যালোচনা করে তাঁরা লিখছেন, ‘আগে গ্রামের দিকে সেনা আসছে শুনলে তাঁরা ভয়ে লুকিয়ে পড়তেন, এখন সকলে মিলে সামনের দিকে ছুটতে থাকেন। সেনা বাহিনীকে জান দিয়ে ঠেকানোর জন্য। আগে জঙ্গিদের কবর দেওয়ার সময় সামান্য কিছু লোক জড়ো হতেন, এখন উজাড় করে ভিড় জমে।’ তাঁদের লেখা থেকেই জানতে পারছি, সদ্য প্রয়াত শুজাত বুখারি লিখেছিলেন, ‘ফিউনেরাল প্রসেসন’ গুলো মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে জঙ্গিদের প্রতি সমব্যথার দিকে, কেননা সাধারণ ঘরের ছেলেরাই আজ বুলেটের টার্গেট।’
জোট ভেঙে যাওয়ার পর রাম মাধব একটি সাংবাদিক সম্মেলন করেন। ওই সাংবাদিক সম্মেলনে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়ে বলেন, ‘’সন্ত্রাস, হিংসা এবং কট্টরবাদ উপত্যকায় সাধারণ নাগরিকদের মৌলিক অধিকারকে খর্ব করছিল। শুজাত বুখারির খুন তার উদাহারণ।‘’ তিনি সেদিন জানান, জম্মু-কাশ্মীর মন্ত্রিসভা থেকে বিজেপির সকল সদস্য আজই পদত্যাগ করবেন। পরে ওইদিনের বৈঠকে রাম মাধব আরও বলেন, ‘’দেশের নিরাপত্তা এবং সংহতির মতো বৃহৎ স্বার্থকে মাথায় রেখে বলতেই হয়, জম্মু-কাশ্মীর ভারতের ভারতের  অবিচ্ছেদ্য অংশ। সে কারণেই আমরা সরকার থেকে সরে রাজ্যের ভার রাজ্যপালের হাতে তুলে দিতে চেয়েছি।‘’  
The opportunistic BJP-PDP alliance set fire to J&K, killing many innocent people including our brave soldiers. It cost India strategically & destroyed years of UPA’s hard work. The damage will continue under President’s rule. Incompetence, arrogance & hatred always fails.
জম্মু কাশ্মীরের জোট সরকার থেকে বিজেপি সমর্থন তুলে নেওয়ার পর বিরোধীরা অভিযোগ তোলে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের নীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি টুইট করেন’’
সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি টুইটে বলেন,    
The situation in Jammu & Kashmir has deteriorated completely in the past three years due to naked opportunism and greed for power displayed by the BJP. As a party in power at the centre and state, the BJP cannot avoid responsibility for its actions.

জম্মু কাশ্মীরের জোট সরকার থেকে বিজেপি সমর্থন তুলে নেওয়ার পর ফার্স্টপোস্ট ১৯ জুনের অন লাইন সংস্করণে শ্রীময় তালুকদার একটি প্রতিবেদন লেখেন।
‘’The only legitimate question that can be asked of a moribund alliance lying in a coma at the intensive care unit is this: What motivated the Bharatiya Janata Party (BJP) to pull the life support plug now? There are five reasons why the BJP was finally compelled to dismantle the untenable alliance.
1. Differences over extension of non-initiation of combat operations
The BJP, under pressure from Peoples Development Party (PDP), had half-heartedly agreed to it as part of coalition compulsion but it eventually came to a conclusion it may have to pay a steep political price for extending it and the cost might have a spillover effect nationally in an election season.
The party was also mindful that as a tactical gesture, it may have had limited success for PDP but it sullied BJP's image of a nationalist party that brooks no compromise with separatist elements. An extension would have dealt a further blow to BJP's image and voter base.
Conversely, the PDP was keen to ensure an extension because the Indian Army's search and cordon operation was squeezing further its already perilous political space. A strong local component in separatist violence meant that many neutralised terrorists were locals and with each killing of a terrorist or their civilian aides, the PDP government was experiencing further and further erosion of its voter base.’’  
পাঁচটি বিষয় তিনি উল্লেখ করেনজম্মু-কাশ্মীর বিষয়ক লেখায় তিনি জোট ভেঙে যাওয়া প্রসঙ্গে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা বলেন। তার মধ্যে অন্যতম ছিল প্রথম বিষয়টি। শ্রীময় সহ গণতন্ত্রপ্রিয়, স্বাধীন মত প্রকাশে বিশ্বাস করেন এমন প্রত্যেক সাংবাদিক, কলাম লেখক উল্লেখ করছেন ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের প্রসঙ্গ। সেই কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের এখন পাখির চোখ হচ্ছে, ২৮ জুন থেকে শুরু হওয়া অমরনাথ যাত্রা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করা। এই কাজ করতে গেলে সেনার হাতে সমস্ত দায়িত্ব তুলে দিতেই হত। রাজ্যপালের শাসন রাজ্যে শুরু হওয়ার পর জম্মু-কাশ্মীরের সংযুক্ত কম্যান্ডের দায়িত্ব চলে এল রাজ্যপাল এম এন ভোরার কাছে। এই দায়িত্ব আগে ছিল মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির হাতে। ১৯ জুন সংবাদ মাধ্যম সূত্রের খবর, সেদিন বিকেলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গেও বৈঠকে বসেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। ওইদিনের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আধাসেনা প্রধানরাও। বৈঠকের পরে রাজনাথ বলেন, ‘’রোজা রেখেছেন এমন ব্যক্তির উপরে গুলি চালানো মানবতাবিরোধী।‘’ রাজনাথ সিংহের বক্তব্যকে বিরোধী দলের অনেকে রমজানের পরে অভিযান শুরুর ইঙ্গিত বলে মনে করছেন।
১৯ জুন জম্মু-কাশ্মীর সরকার থেকে বিজেপি সমর্থন তুলে নেওয়ার আগে আমরা আরও একটি সংবাদে নজর দিতে পারি। সংবাদটি ১৪ জুনের। কাস্মীর বিষয়ক একটি রিপোর্ট ওইদিন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার শাখা প্রকাশ করে। সেই রিপোর্টে ভারতীয় সেনার চূড়ান্ত সমালোচনা করা হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৬ থেকে উপত্যকায় অত্যধিক পেশি প্রদর্শন করে অসংখ্য সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে নিরাপত্তা বাহিনী। জখমের সংখ্যাও বহু। রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার শাখার কমিশনার জইদ রাড আল হুসেনের ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত কাশ্মীরের নিরাপত্তা বাহিনী ও জঙ্গিদের হাতে যথাক্রমে নিহত হয়েছেন ১৪৫ জন ও ২০ জন সাধারণ মানুষ। উপত্যকায় গণকবরের তদন্ত,সশস্ত্র বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিলের দাবিও তোলা হয়েছে উল্লেখিত রিপোর্টেজইদ বলেছেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের এই ধরণের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে কমিশন বসান হয়েছে জেনিভায়।     
এই রিপোর্ট প্রকাশের পর প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তান ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের বিদেশ মন্ত্রক বলেছে, ‘’কাশ্মীরের মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে ভারত যে সেনা দিয়ে দমন করে রেখেছে, ইসলামাবাদের পুরনো এই দাবিকে স্বীকৃতি দিল রাষ্ট্রপুঞ্জ।‘’  
ভারতীয় বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের মন্ত্রক এই রিপোর্ট মানতে চায়নি। মন্ত্রক বলছে, ‘’ভারত এই রিপোর্ট প্রত্যখ্যান করছে। এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, প্রতারণাপূর্ণ। এর নেপথ্যে কী উদ্দেশ্য রয়েছে, আমরা জানতে চাই।‘’ মন্ত্রক সংবাদ মাধ্যমের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছে, ‘অসমর্থিত তথ্য গুলিকেই তুলে ধরা হয়েছে ওই রিপোর্টে। এই রিপোর্টকে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব বলেছেন ‘শিশুসুলভ’। কংগ্রেসও দাবি করছে এই রিপোর্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রিপোর্ট।  রাষ্ট্রের স্বার্থ বিচার করেই কংগ্রেসের শীর্ষনেতা তথা সাংসদ আহমেদ পটেল বলেন,  ‘’জম্মু-কাশ্মীরে অন্য কারও হস্তক্ষেপ মানা হবে না। উদ্দেশ্য প্রণোদিত কোনওরকম রিপোর্ট আমরা মেনে নিতে পারব না।‘’
জম্মু-কাশ্মীর এমন একটি ‘পেন্ডিং ইস্যু’ বা বকেয়া বিষয় যার সূত্রপাত ভারতের স্বাধীনতার সময় থেকে। প্রায় ৭১-৭২ বছরের পুরনো। এই সময়কালের মধ্যে বিশ্বে অনেক জটিল বিষয়ের মীমাংসা সম্ভব হয়েছে। ঠান্ডা যুদ্ধের অবসান। বার্লিন প্রাচীরের পতন, পূর্বপাকিস্তান পশ্চিমপাকিস্তানের মধ্যে রাষ্ট্র গঠনের লড়াইয়ের অবসান, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্ম এবং স্বীকৃতি। সোভিয়েত রাশিয়া পুনর্গঠন। মায়ানমারের বিরোধী নেত্রী নোবেল শান্তি পুরষ্কার বিজয়ী গৃহবন্দী নেত্রী ‘আন সান সু চি’-এর মুক্তিলাভ এবং বর্তমানে ওই রাষ্ট্রের অন্যতম মন্ত্রী। মাত্র কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করলাম। আরও একাধিক বিষয় বলা যায়।  উনবিংশ শতাব্দীর বকেয়া বিষয়গুলি মিটে গেলেও এক বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ভারতের জম্মু-কাশ্মীর ‘পেন্ডিং ইস্যু’ হয়ে থাকে কেন? কাদের স্বার্থে? কর্পোরেট স্বার্থ? জাতীয় আন্তর্জাতিক স্বার্থ?
সমাজ বিঞ্জানীরা বলছেন ধর্মের ভিত্তিতে একটি জাতি রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয় এমনটা বলা যাবে না। এই জাতীয় একাধিক উদাহারণও রয়েছে। কিন্তু এটাও সত্যি ধর্মকে কোন জনসমষ্টির জাতীয়তাবাদের বিকাশে বা জাতি গঠনের প্রক্রিয়ার একমাত্র অন্যতম উপাদন হসেবে দেখা হয়না। কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন ধর্ম শুধুমাত্র মানুষকে একত্রই করে না, বিভক্তও করে। পাশাপাশি ঐক্যের বিষয়টাকে লালন করে ছেড়ে দেয় না। ধর্মীয় সম্প্রদায়, গোষ্ঠীর মধ্যেকার বিরোধ, বিবাদ, বৈরিতাকে আরও তীব্রতর করে। খ্রীস্টান, বৌদ্ধ, হিন্দু এবং ইসলাম কোনও ধর্মকেই এর বাইরে রাখা যাবে না। পাকিস্তান গঠনের প্রাক্কালে মহম্মদ আলি জিন্না যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। মহম্মদ ইকবাল ইসলাম রাষ্ট্রের আদর্শগত বিষয় প্রসঙ্গে বলে গেছেন। তিনি বলেছেন অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাম্যের উপর দাড়িয়েই ইসলাম রাষ্ট্র গঠন সম্ভব। এই কারণে বামপন্থীরা ইকবালকে প্রাচ্যের ‘মার্কস’ হিসেবে অভিহিত করেন।
তাই আবার বলছি ঘর ভাঙার ইতিহাস ভোলা যায় না। আমরা ভারতীয় ছিলাম ভারতীয় আছি।