Monday 4 June 2018

ঘাম আর শ্রমের মূল্য চিনতেই নতুন এক সার্বজনীন আকাশ খুঁজে নিতে হবে


দীপেন্দু চৌধুরী
বর্তমান বাংলার রাজনৈতিক রঙ যাই হোক। বদলে যাওয়া আকাশের সভ্যতা যেটাই হোক না কেন, আমার মন পড়ে আছে, পড়ে থাকে উদোম খাটা মানুষগুলোর আস্তানায়। বস্তিতে। আগ্নেয়গিরির লাভার মতই রক্তকরবি আজও আমার ভালো লাগে। রক্তজবার মতই। সাধনার প্রাপ্তি বলুন অথবা রোমান্টিক স্বপ্নের এক নদী ঢেউ। হ্যা এক নদী ঢেউয়ের কথা বলতে হয়। এই বাংলায় সাগর আর কতটা আছে? নদীর জলে আজও ভেসে যায় উদোম খাটা মানুষের চোখের জল। নোনা ঘামের জল নদীর মিষ্টি জলে আশ্রয় খুঁজে নিতে চায়।  
আমার কৈশোর যৌবনের চঞ্চল অচঞ্চল স্বতঃস্ফূর্ত একান্ত অনুভবে থেকে গেছে ওরা। ভাঙাগড়ার খেলা চলতেই থাকে। চলবে যুগ যুগান্তের ভাষা উপভাষায়। আগন্তুক পাখির কলরবে। মরশুমি ফুলের রঙবাদলের বৃষ্টি ধারায়। রঙমাদলের সৃষ্টি সুখের ক্লান্তিহীন চা বাগানের ‘টি পাই টি পাই’ শব্দের পদ চারণায়। ঘুমিয়ে থাকা পাহাড় উপত্যকায় আগ্নেয়গিরি থাকে। সময়ের দাবিতে আগুনের ফুলকি ছুটে আসে আগ্নেয়গিরি থেকে। সেই আগুন থেকে কৃষকের বুকে জ্বলতে থাকা আগুন, কুয়াশা ভেঙে তছনছ করে ছুটে আসে আগুনের গোলা নিয়ে। আর কে তখন ঘুমিয়ে থাকতে পারে? পাহাড়ি উপত্যকার ঝর্ণার জলে রক্ত এসেছিল। সাত কিষাণীর আত্মত্যাগ এনে দিয়েছিল সামাজিক স্বীকৃতির এক আহ্বান। ধ্বংস নয় নতুন সমাজ। নতুন পল্লীসমাজনতুন নাগরিক সমাজের আহ্বান ছিল ষাটের দশকের সেই চেনা অচেনা পাখিদের লেখা ইস্তেহারে। এক সভ্যতা শেষে আরও এক সভ্যতার খোঁজে মানবসবাজ ছুটতে চায়। আমার কৈশোর যৌবনে ‘কালশিটে’ হয়ে আছে। জন্মদাগ হয়ে আছে লাল কালিতে লেখা রক্তের দাগ। হারিয়ে গেছে আমার চেনা বন্ধু আত্মীয়। আমাদের চেনা আত্মীয় সমাজ। সেই স্পর্শকাতর সময়কে যতই ভুলে থাকতে চাই। আবার কেন জানি না ফিরে তাকাই। ওই যে ওইখানে বসে আছে। আমাকে ডাকছে আমার মামাতো দাদা দুলুদা।
সালটা ঠিক মনে করতে পারব না। জলপাইগুড়িতে আমার মামার বাড়ি। সোনামামা এবং নোয়ামামা থাকতেন। সোনামামা রাশভারী লোক ছিলেন। আর্থিকভাবে গর্ব করে বলার মতো স্বচ্ছল ছিলেন। সেই মামা তাঁর দুই ছেলেকে আমাদের নলহাটীর বিদুপাড়ার ভাড়া বাড়িতে রেখে গেলেন। আমরা বুলুদা এবং দুলুদা নামে ডাকতাম।  নলহাটীর একটি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দু’ই ভাই ভর্তি হয়েছিলেন। বুলুদা ক্লাস টেনে ভর্তি হয়েছিল। দুলুদা ক্লাস নাইনে পড়ত। দুজনেই একক্লাস করে নীচে ভর্তির সুযোগ পেয়েছিল। আমার তখন বয়স আর কত ছয় সাত বছর। সময়টা সম্ভবত ১৯৬৭-৬৮ শিক্ষা বৎসর। আমার মাতৃতুল্য বড়দির বিয়ে হয়েছে। আমার মায়ের পরে আমার উপর বড়দির প্রভাব ছিল ব্যপক। কারণ আমি বাড়ির ছোট ছেলে হিসাবে আলাদা আদর যত্ন এবং প্রযত্ন পেতাম।
গরিব বাঙাল তথা ব্রাহ্মণের মেয়ের বিয়েতে যেটুকু সম্ভব সেটুকু আয়োজন করা হয়েছিল। পণের তালিকায় যেসব পণ্যসামগ্রী ছিল সেগুলির প্রধান কয়েকটি সেই সময় দেওয়া যায়নি। আমার জামাইবাবু যদিও কোনও দিন সেই নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। তবু আমার বড়দি চাপা যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে ছিলেন। লোকলজ্জা এবং পরিবারের সম্মানের কথা মনে রেখে কোনওদিন প্রতিবাদ করেছেন বলে আমার মনে পড়ে না। সব কষ্ট ব্যথা মেনে নিয়ে ৪০ বছর সংসার করে নীরবে চলে গেছেন। আমার বড়দির বিয়ে আমাকে প্রথম দারিদ্র চিনিয়েছে। দারিদ্রের নীরব যন্ত্রণা চিনিয়েছে।
ফারাক্কার স্ট্রীমার ঘাটে আজও কি ১৯৬৯ সালের মতো স্ট্রিমারের ‘বোঁ বোঁ’ আওয়াজ হয়? তখনও গঙ্গার জল সভ্যতার হস্তক্ষেপে আটকে যায়নি। তখনও আমরা বলতে শুনেছি ‘এ পাড়ে গঙ্গা ও পাড়ে গঙ্গা......মধ্যেখানে চড়......।’ দার্জিলিং মেল ধরতে হত স্ট্রিমারে গঙ্গা পাড় হয়ে। খেজুরিয়া ঘাট থেকে। মনে পড়ে কম বয়সে পড়া রবীন্দ্রনাথের ‘এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে না।’ মনে পড়ত শরৎচন্দ্রের ‘অভয়া-শ্রীকান্ত’ পর্বের স্ট্রীমারযাত্রা। বর্মা যাওয়ার বর্ণনা।                        
সে বছর আমি নলহাটী হরিপ্রসাদ হাই স্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্র। আমার মনে চাপা উত্তেজন। চোখে ভোরের স্বপ্ন। দেহ মনে বড় এবং নামী স্কুলে পড়ার গর্ব। অনেক বড় আকাশের নীচে ছুটে চলার কাব্যিক গঙ্গাপক্ষের ছলাৎ ছল, ছলাৎ ছল জলের ধ্রুপদী স্পন্দন শুনতে পাচ্ছিলাম। গঙ্গার ঢেউ পদ্যের ধ্রুপদী পয়ার ছন্দে আমাদের সঙ্গে কথা বললেও আমাকে শান্ত হতে দিতনা বড়দির বিয়ের সময় একটি বিষাদময় ঘটনা। যে ঘটনা আমাকে আর দুলুদাকে বয়ে নিয়ে চলতে হয়েছে। দুলুদা কোথায় হারিয়ে গেলে? আমরা আজও জানতে পারলাম না। ১৯৬৯ সালের পর দুলুদার কোনও খোঁজ আমরা জানতে পারিনি। আমার মামিমার সন্তানহারা মায়ের ডুকরে উঠে কান্নার অধিকার ছিল না। কারণ সবাই জেনে যাবে ‘দুলু’ নকশাল ছিল। মামার ছদ্ম হাসির আড়ালে ছিল একঘর আভিজাত্যের শাসন। শান্ত লাল চোখের চাউনিতে ছিল ভয়ঙ্কর এক দাপট। মামিমা এক মাথা ঘোমটার আড়ালে আমার মায়ের কাছে ভেঙে পড়েছিলেন। কিন্তু সহজ সরল এক মা নিজেও জানতেন না তাঁর প্রিয় সন্তান দুলু কোথায় আছে? বাড়িতে সোনামামার অলিখিত নির্দেশ ছিল, কেউ যেন না বলে দুলু নকশাল ছিল। দুলু খুন হয়েছে। রাষ্ট্রশক্তির শাসন বজায় রাখতে আর পাঁচজন ষাট সত্তর দশকের ছাত্র যুবদের মতই মায়ের আঁচল থেকে আমার ‘দুলুদা’-কে ওরা টেনে নিয়ে গিয়েছিল। রাষ্ট্র ঠিক ছিল না নকশাল আন্দোলন ঠিক ছিল সেটা আজ আর আমার কাছে মূল বিষয় নয়। ফারাক্কার গঙ্গায় গেট হয়েছে। দেশের প্রয়োজনে। তাই সংসদীয় গণতন্ত্রে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দর্শনের আকাশটা বদলে যেতে পারে। বৃহত্তর এবং উদার গণতন্ত্রের দাবিতে।  পরে অনেক পরে প্রায় ১৪-১৫ বছর পরে আমার মা আমাকে দুলুদার উপখ্যান বলেছিলেন। জলপাইগুড়ির চা বাগানের শুকনো পাতার গল্প আমার মাও বেশি জানতেন না। আমি পরে বার কয়েক জলপাইগুড়ি গিয়েছি। শুকনো পাতার মড়মড়ে মর্মিত আওয়াজ আমি শুনেছি। পরম আত্মীয়তায় দুটি পাতা একটি কুড়ি ছুঁয়ে অনুভব করেছি। আমার দুলুদাকে খুঁজেছি। হিমশীতল চা বাগানের ছোট ছোট গাছের আড়ালেই যে লুকিয়ে থাকে হিংস্র জন্ত-জানোয়ারের দল।
আমার মা ছিলেন অন্তর্মুখী এক সহজ সরল ব্যক্তিক্তময়ী মহিলা। তাই আমি আজও উচ্চারণ করি, কেউ যেন না বলে দুলু নকশাল ছিল। দুলু খুন হয়েছে। রাষ্ট্রশক্তির শাসন বজায় রাখতে আর পাঁচজন ষাট সত্তর দশকের ছাত্র যুবদের মতই মায়ের আঁচল থেকে আমার ‘দুলুদা’-কে ওরা টেনে নিয়ে গিয়েছিল।     
আমার মনে আছে আমরা সোনামামার বড় ছেলে বাচ্চুদার বিয়েতে জলপাইগুড়ি গিয়েছিলাম। আর্থ-সামাজিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত সোনা মামার বড় ছেলেও উচ্চ শিক্ষিত এবং বড় চাকুরে। বিয়েও করলেন এক উচ্চ শিক্ষিত মহিলাকে। বাঙাল পরিবারের বড় ছেলের বিয়ে। সোনামামার জলপাইগুড়ির তেলিপাড়ায় আনুমানিক ১০-১২ কাঠা জমিতে বাড়ি এবং বাগান বাড়ি। দু’কামরার পাকা দালানবাড়ি। বারান্দাসহ। পাশাপাশি আরও দু’টো কাঠের তৈরি পুরনো দিনের বাড়ি। টিনের চাল দেওয়া। মোট ছ’টা ঘর। বাংলার বিভিন্ন জেলা থেকে সোনামামার পূর্ববঙ্গের আত্মীয়স্বজনরা এসেছেন। সবাই দুলুকে খুঁজছে। কিন্তু কেউ জানে না দুলু কোথায়। সবাইকে বলা হয়েছিল দুলু বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে।
বড়দির বিয়ের বিষাদের সুর মনে রেখে আজও বেঁচে আছি। বেঁচে থাকতে হল দুলুদার খোঁজ না পেয়ে। আমাদের বিদুপাড়ার পাথুরে ইটের রাস্তার বাড়িটা ছিল নলহাটী রেল স্টেশন সংলগ্ন। তখন ছোট একটা গঞ্জ শহর। ইংরেজি ‘টি’ হরফের মত আকৃতি ছিল শহরটার। বিদুপাড়ায় আমরা পাঁচটা বাড়ির ভাড়াটিয়ারা সব একসঙ্গে থাকতাম। অনেকটা যৌথ পরিবারের মত। বারঘর এক উঠনের মতো আমাদের সম্পর্ক ছিল। কিশোর, বিকাশ, আমার থেকে বয়সে এক বছরের বড় ছিল। কিন্তু আমরা তিনজন একটা সময় খুব কাছাকাছি এসেছিলাম। আমাদের সঙ্গে ছোটবাবু, দেবু থাকলেও ওরা বেশিদিন আমাদের গোষ্ঠীতে থাকতে পারেনি। আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিল কিশোর, বিকাশ এবং ছোটবাবুওদের স্কুলছুট হয়নি। আমরা তিনজন নলহাটী স্টেশনে বাংলার গাদা বন্দুক হাতে পাঁচ ছজন লোককে স্টেশনে বসে থাকতে দেখে প্রথমে ডাকাত ভেবেছিলাম। পরনে লুঙ্গি আর হাফহাতা সার্ট। কাঁধে রাইফেল। পরে জানতে পেরেছিলাম ওরা বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের মুক্তিসেনা বা মুক্তিযোদ্ধা১৯৭০ সাল সেটা। সেই বছর আমরা সচেতনভাবে দেখতে পেলাম নলহাটীর মাটির দেওয়াল, পাকা বাড়ির দেওয়ালে লেখা ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ায়ারম্যান’। ‘নকশাল বাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘কমরেড চারু মজুমদার জিন্দাবাদ’। ‘আমার বাড়ি, তোমার বাড়ি, নকশালবাড়ি, নকশালবাড়ি। নকশালবাড়ি লাল সেলামকিশোর বয়সে আমাদের সামনে স্লোগানগুলি এনে দিয়েছিল অচেনা এক কৌতুহল। হাজারো প্রশ্নের শব্দমালা। পরের বছরগুলিতে আমি আমার দুলুদাকে খুঁজে পেতাম। দু’টি পাতা একটি কুড়ি খুঁজে পেতাম।  
অজানা এক পথ, অচেনা এক পথের দেওয়াল লিখনের শব্দ বাক্য খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম আমরা। আমাদের সরল মনে শব্দবাক্যগুলি ক্রমশঃ চেপে বসে যেতে চাইল। ১৯৭০ সালের কোনও একটা মাস হবে সেটা। আমাদের স্কুলে মাঝেমধ্যে একটা দু’টো বোমা পড়ছে। ভয় আতঙ্কের মধ্যে থেকেও আমাদের সাহস বাড়ছে। উঁচু ক্লাসের দাদাদের কথায় আমরা স্বাভাবিক থাকছি। সে বছর ছোটবাবুর ব্যবসায়ী বাবা নলহাটীর নীচু বাজারে তিনতলা বাড়ি করে চলে গেছেন। আমরা প্রায় সেই বাড়িতে যাই। ভালো ভালো খাবারের লোভে। ছোট মাসিমার রান্না ছিল সুস্বাদু। একদিন আমি আর অশোকদা ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। অশোকদা ছিল কিশোরের দাদা। মেধাবী ছাত্র। স্কুল থেকে এম এ পাশ পর্যন্ত কোনওদিন সেকেন্ড হয়নি। বা সেকেন্ড ক্লাস পায়নি। সেই অশোকদা আর আমি ছোটবাবুদের বাড়ি থেকে বেড়তেই দেখলাম মাঝবয়সী একজন অবাঙালি লোককে তিন চারজন তরুণ মারতে মারতে দেওয়ালের ধারে নিয়ে গেল। তারপর গুলির আওয়াজ। এবং বোমা পড়ার আওয়াজ। আমরা দূর থেকে দেখছি। লোকটা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। স্থানীয় কয়েকজন ছুটে এল। যারা খুন করতে এসেছিল তাঁদের ধাওয়া করল। স্থানীয় মানুষগুলির হাতেও রিভলবার ছিল। জোয়ান ছেলেগুলো ছুটে পালাল। যাওয়ার সময় স্লোগান দিতে দিতে গেল ‘নকশাল বাড়ি জিন্দাবাদ’। চারু মজুমদার জিন্দাবাদ, কানু সান্যাল জিন্দাবাদ’। আমি শুনতে পাচ্ছি কে যেন বলছে ‘এক বাঁও মেলে না। দো বাঁও মেলেনা।’
ঘটনার সময় আমরা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। অশোকদা আমাকে বলল, ‘কেউ জিগ্যেস করলে বলবি কিছু দেখিনি। লোকটা জোতদার। অনেক গরিব মানুষের টাকা, জমি আত্মসাৎ করেছে।’
পুলিশের গাড়ি আসতেই আমরা ছুটে পালালাম। আমাকে পরের দিন আমার বড়দির বাড়ি পাঁচড়া পাঠিয়ে দেওয়া হল। সে বছর আমাদের স্কুলে পরীক্ষা হল না। আমরা ক্লাস সেভেনে উঠে গেলাম। ক্লাস সেভেনে আমাদের ‘এ’ সেকশনে বোমা পড়ল। ক্ষিতিশস্যার অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। বোমার আওয়াজ শুনতেই শুনতেই আমরা পড়াশোনা করছি। বড় হচ্ছি। গোফের কালো রেখা আমাদের জানান দিচ্ছে। আমাদের যৌবন আসছে। ‘যৌবন সরসী নীড়ে......’। দেওয়ালের লিখন পড়তে পড়তে আমরা প্রেমের কবিতা লিখতে চাইছি। একান্ত নিবিড় বান্ধবী খুঁজছি। কৈশোর থেকে যৌবনে হেঁটে আসার লাল সাদা গোলাপের সম্ভ্রান্ত আবেদনের মুহূর্ত সেটা। ‘ওলি বার বার ফিরে আসে......, ওলি বার বার ফিরে যায়......’। কেউ কেউ কাছে আসছে আবার ফিরে যাচ্ছেপড়াশোনার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলাম। অশোকদা, আলোদা (আমার বড়দার ছোট শালা, অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। পরে বীরভূম জেলা স্কুলের শিক্ষক), রুদ্রদাদের মেধা আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক পা আগামীর কেরিয়ার গড়ার সরণি ধরে যেতে বলছে। এক পা ‘দুলুদাকে’ খুঁজছে। আমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খুঁজছে। আমার বড়দির বিয়ের বিষাদ আমাকে প্রশ্ন করতে শেখাচ্ছে। ক্লাস সেভেনে খুব ভালো রেজাল্ট করলাম। ১৯৭২ সাল। ক্লাস এইট। আবার সেকশন ‘এ’। গ্যালারি কাঠামোর শ্রেণীকক্ষ। সব ছাত্রদের কাছে লোভনীয় ছিল।  
ক্লাস এইটে পড়ি। আলোদা বিড়ি খেতে দিলো। আমি লজ্জা পেয়ে বলেছিলাম, ‘আমি খাই না’। কে কার কথা শোনে। শুরু হল বিড়ি খাওয়া। কিছুদিন পরে ‘রেড বুক’ পড়লাম। কার্ল মার্কস-এঙ্গেলসের লেখা ইস্তেহার পড়লাম। কিছুই বুঝতে পারিনি। তবু পড়েছিলাম। পরে ভালো করে পড়েছি। তর্ক বিতর্কে অংশ নিয়েছি। ভারত একটি আধা ঔপনিবেশিক আধা সামন্ত্রতান্ত্রিক দেশ, বলতে বলতে আমাদের অনেক কিছু মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি কার্ল মার্কস-এঙ্গেলসের লেখা বাংলা অনুবাদ পাচ্ছি। বইটার প্রচ্ছদ সহ দ্বিতীয় পাতাও সভ্যাতার মায়াজালে ছিঁড়ে গেছে। তাই প্রকাশক এবং সময়কাল উল্লেখ করতে পারলাম না।
‘’পঞ্চম দশকে মার্কস তাঁর অর্থশাস্ত্রের সমালোচনা সম্পূর্ণ করেন নি। ষষ্ঠ দশকের শেষ দিকেই তা সম্ভব হয়। ফলে তাঁর ‘অর্থশাস্ত্রের সমালোচনা প্রসঙ্গে’ (A Contribution to the Critique of Political Economy) (1859) প্রথম ভাগ বার হবার আগেকার লেখার সঙ্গে ১৮৫৯ সালের পরেকার লেখার কোনো কোনো বিষয়ে পার্থক্য আছে......। মূল লেখা অনুসারে মজুর মজুরির বদলে পুঁজিপতির কাছে তাঁর শ্রম বিক্রয় করে, বর্তমান পুস্তক অনুসারে সে বিক্রয় করে তার শ্রমশক্তি। এই পরিবর্তনের জন্য আমি একটি কৈফিয়েত দিতে বাধ্য। কৈফিয়ত দিতে হবে  মজুরদের কাছে যাতে তারা বোঝে যে এটা একটা কথার মার প্যাঁচ নয়, সমগ্র অর্থশাস্ত্রেরই একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিষয়।‘’ পৃষ্ঠা- ৬/৭ সম্পাদক ফুটনোটে লিখছেন, Neue Rheinische Zeitung: organ der Democratie (‘নতুন রাইন পত্রিকা’,গণতন্ত্রের মুখপত্র) দৈনিক পত্র, কার্ল মারক্সের স্মপাদনায় ক্লোন থেকে ১৮৪৮ সালের ১লা জুন থেকে ১৮৪৯ সালের ১৯শে মে পর্যন্ত প্রকাশিত হয়, সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যে এঙ্গেলসও ছিলেন।        
আমার শুরু হল দুলুদার আততায়ীকে খুঁজে ফেরার রাত। আমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের খুঁজে ফেরার রাত। আমার বড়দির বিয়ের সময়ের বিষাদগ্রস্ত স্মৃতির চাপা অভিমান আমাকে এগিয়ে যেতে বলল। শুরু হল গ্রাম বাংলার উদোম খাটা মানুষগুলোকে নিবিড়ভাবে দেখার ভোর। দু’টি পাতা একটি কুঁড়ি ছুয়ে দেখার শপথ। সাত পাহাড়ের গল্প বলার রাত। সবটাই গোপনে। আমি বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিলাম বলে আমাকে গোপন চিঠি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কখনো কখনো সাদা বোমা বড় দাদাদের দিয়ে আসতে হত। ক্রিকেট বলের মত দেখতে সাদা বোমা আমরা বড়দের হাতে পৌঁছে দিয়েছি। ১৯৭২ সালে দেখলাম আমার দু’একজন বন্ধুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করল। তাঁদের একজন জেল থেকে বেড়িয়ে ডাক্তার হয়েছে। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত আমি ক্রমশঃ নকশাল রাজনীতির কাছাকাছি চলে এলাম। নলহাটী, রামপুরহাট, সিউড়ি, বোলপুর, কলকাতা ছিল আমাদের প্রতিদিনের রাজনৈতিক ম্যাপে। রামপুরহাটের ‘গ্রন্থায়ন’ হয়ে উঠেছিল কলকাতার কফিহাউস।  পরে নকশাল বাড়ির রাজনীতি বামপন্থী রাজনীতি চিনতে সাহায্য করেছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের ভাষা বুঝতে কাজ দিয়েছে। বামপন্থার বৃহত্তর ঘরানার আঙিনায় শ্রমজীবি মানুষদের জন্য সত্য খুঁজছি। আজও খুঁজছি। কার্ল মার্ক্সের জন্ম গ্রহণের দুশো বছর পরেও আমরা নতুন আকাশ খুঁজছি। 
 দারিদ্র এবং রাজনীতির কারণে আমি স্কুলে একবার এবং কলেজে একবার। মোট দু’বার ফেল করেছিলাম। কমবেশি প্রায় ৪৫ দিন বিভিন্ন থানার লকআপ চিনেছিলাম। অভিভাবকের মতো আমার স্কুল-কলেজের বামপন্থী, দক্ষিণপন্থী শিক্ষকরা আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাই হয়ত আজ এই লেখা লিখতে পারছি। 
১৯৭২ সাল থেকে গোপনে বিপ্লবী পার্টিকোরের সঙ্গে যুক্ত হলাম। ১৯৭৭ সালে ‘পরিবর্তন’ আমরা দেখলাম। ১৯৭৫ সালের ‘জরুরী অবস্থার রাজনীতি’ এই বাংলায় ‘বামফ্রন্ট’ নামক একটি সরকারকে আনার একমাত্র কারণ বলে আমার কোনওদিন মনে হয়নি। একটা দেশে অথবা আমাদের মতো সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশে দীর্ঘকালীন প্রস্তুতি প্রয়োজন হয়। সেই প্রস্তুতি অনেকটাই করে দিয়েছিলেন এই বাংলার উদোম খাটা শ্রমিক, কৃষক, মজদুর, ছাত্র, যুবদের দল। আমরা মধ্য রাতের সন্তান নই। আমরা ষাটের দশকের সন্তান। আমরা সত্তর দশকের সন্তান। আদর্শ ভাঙা খান খান হয়ে যাওয়া যৌবন দেখেছি। স্বপ্নভাঙা ক্লান্ত পৌঢ়ের কন্ঠে নতুন আদর্শের সাতকাহনের পাঁচালী শুনেছি। সত্তর দশকের আদর্শ লালিত স্বপ্ন, বিপ্লব, ‘সত্তর দশক মুক্তির দশক’ চিনের চেয়ারমযান আমাদের চেয়ারমযান’ দেওয়ালে লেখা রক্তের আলপনায় আঁকা। বরাহনগর, বেলেঘাটা, বীরভূম, গোপীবল্লভপুরে লাশের মিছিল। তেলেঙ্গানা, শ্রীকাকুলাম আরও বড় রাস্তার বিতর্কে এনে দিয়েছিল। তবুও আমরা উচ্চারণ করছি ‘উই শ্যাল ওভার কাম, ‘পথেই এবার নামো সাথী পথেই হবে পথ চেনা।’ ‘নাম তাঁর ছিল জন হেনরি, ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন।’
আমদের উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দমকা বাতাসের মতই ১৯৭৭ সালে সংসদীয় গণতন্ত্রের শিরোনামের ‘ব্রেকিং নিউজ’ শুনিয়ে ‘বামফ্রন্ট’ নামক একটি কোয়ালিশন সরকার তৈরি হল। আর তারপরেই সারা দেশে ‘বন্দীমুক্তি’ আন্দোলনের নয়া শপথ। ১৯৭৮ সাল। জেল থেকে বেরিয়ে আসছেন একে একে কানু সান্যাল, জঙ্গল সাওতাল, সন্তোষ রাণা, অসীম চ্যাটার্জি সহ কত অজানা নামের মেধাবী বাঙালি, মেধাবী ভারতীয়। একাধিক নামী অনামী আগুনখেকো বিপ্লবীর দল। ‘রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি আন্দোলনঃ পরম্পরা, বিবৃতিঃ ১৯৭৭-এর আবেদনে স্বাক্ষর করেছিলেন সত্যজিৎ রায়, সুশোভন সরকার, সমর সেন, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, মৃণাল সেন, শঙ্খ ঘোষ, মহাশ্বেতা দেবী, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সহ প্রায় দুশোজন শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী। তথ্যসূত্রঃ Frontier: ১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৭’   
সত্তর দশক শেষ হয়ে শুরু হল আশিরর দশকের প্রস্তুতি। ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যা। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, ত্রিস্ত্রর পঞ্চায়েত, বর্গা আন্দোলন। এই কঠোর কঠিন মেঠো পথেই আশির দশকে মন কেমন করার জন্য বাঙালি পেল ‘ডাগর নয়নে কেন চেয়ে থাক?’ ‘রাগের বাহারে’। রাগ প্রধান বাংলা গানঅজয় চক্রবর্তীর গাওয়া গান।                                                        
 

No comments:

Post a Comment