Tuesday 27 November 2018

সুন্দর বাগান হাসে ইতিহাসে



দীপেন্দু চৌধুরী
একটা সমাপতন খুঁজে পেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ পর পর কয়েকটাদিন ব্রিটিশ ভারত আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই নিবন্ধেও উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা এসে পড়ল। নবজাগরণের বাংলা, নবজাগরণের কলকাতা উঁকি দিতে চাইছে। ঔপনিবেশিক কলকাতা শহরকে যখন ব্রিটিশ শাসকরা সাজিয়ে তুলছিলেন তখন তাঁদের নজর পরিবেশের দিকেও ছিল। পরিবেশ দূষণ রুখতে ঘোড়ায় টানা ট্রামের ব্যবহারের কথা আমরা জানি। পরে বিদ্যুৎ চালিত ট্রাম চালু করে ব্রিটিশ প্রশাসকরা। যেটা আজও এই শহরে একমাত্র দূষণহীন যানবাহন। যদিও আমাদের নিবন্ধ পরিবেশ বিষয়ক নয়। পরিবেশ এসে গেল একটি সূত্রের খোঁজে। কলকাতা শহরের উত্তরে ১৮৮৯ সালে ‘মোহনবাগান’ নামে একটি সুন্দর বাগান তৈরি হয়েছিল। এই বাগান তৈরি করেছিলেন তৎকালের কলকাতার প্রথম সারির বাঙালি ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক এবং সমাজ কর্মীরা। সেই ক্লাব পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯০৪ সালে ‘ফুটবল ক্লাব’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই সময় সারা রাজ্যে এবং কলকাতায় বাঙালিদের দ্বারা পরিচালিত মাত্র গুটিকয়েক ফুটবল ক্লাব ছিল।
‘গোরা’-দের ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুটবল খেলতে শুরু করে তৎকালীন মোহনবাগান ক্লাবের ফুটবলাররাতাই সাহেবরা মোহনবাগান ক্লাব সম্পর্কে প্রচার শুরু করে এই বলে যে ‘ব্যাঙ্গাচি’ হয়ে আকাশ ধরতে এসেছে বাঙালিদের এই ফুটবল ক্লাব। সাহেবদের বিরুদ্ধে ফুটবল খেলে ১৯১১ সালে প্রথম পরাধীন ভারতে মোহনবাগান জয় ছিনিয়ে আনে। যেন সেই বছরই ভারত স্বাধীনতা পেল। আবার বলতে হয় হ্যাঁ সমাপতন। কারণ মোহনবাগান গোরা সাহেবদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার জয় ছিনিয়ে নেয় ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টের আগে। এই ইতিহাস আমরা শুনলাম একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে। ২৪ নভেম্বর কলকাতায় অক্সফোর্ড বুকস্টোরে ‘সোনায় লেখা ইতিহাসে মোহনবাগান’ নামে বইটি প্রকাশ অনুষ্ঠানে কথাগুলি বলছিলেন সঞ্চালক দেবাশিষ মুখোপাধ্যায়। দেবাশিষবাবু বাঙালির ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন। মোহনবাগান বিষয়ক বইটি লিখেছেন সুবীর মুখোপাধ্যায়। মুখবন্ধ লিখেছেন ভারতীয় ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি বদ্রু ব্যানার্জী। ৪৩২ পাতার বইটির প্রকাশক নব্জাতক প্রকাশনী।
বইটির পরিকল্পনায় প্রথম থেকে যুক্ত আছেন অভীক দত্ত। তিনি বলছিলেন, ‘’সুবীর সহ আরও সাত-আটজন এবং পরিসংখ্যানবিদ নারায়ণ দাশগুপ্তের সাহায্য নিতে হয়েছে এই ঐতিহাসিক বইটি লেখার জন্য। ১৯১১ সালে আমরা মোহনবাগানের ইতিহাস জানি। কিন্তু ফুটবলের টুর্নামেন্টে আমাদের ক্লাব এ পর্যন্ত ২৫০টা ট্রফি পেয়েছে। এই তথ্য কতজন জানেন? মোহনবাগান ক্লাবের ক্রিকেট এবং হকিতেও উল্লেখযোগ্য সাফাল্য আছে। সেই সব কথা এই বইয়ে পাওয়া যাবে।‘’
বইটির কভার পেজের দ্বিতীয় পৃষ্ঠার লেখা থেকে জানা যাচ্ছে ‘সোনায় লেখা ইতিহাসে মোহনবাগান’ বইটি ক্লাবের ইতিহাস সম্পর্কিত একটি তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ। এই গ্রন্থটির প্রথম অংশে একশো উনত্রিশ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান মোহনবাগান ক্লাবের জন্মলগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ফুটবলের গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। পঁচিশটি পরিচ্ছেদের মাধ্যমে। ক্রিকেট এবং হকিতে মোহনবাগানের সাফল্যের কথা তুলে ধরার জন্য সংযোজিত হয়েছে আরও দু’টি পরিচ্ছেদ। মোহনবাগান ক্লাবের প্রতিষ্ঠা, ঐতিহাসিক শিল্ড বিজয়ের কাহিনী, বাঙালির চিরন্তন ‘ডার্বি’-এর বহু অজানা ইতিহাস। বইটির দ্বিতীয় অংশটি পরিসংখ্যান ভিত্তিক। মোহনবাগান যে সমস্ত ট্রফি জিতেছে তাঁর প্রায় প্রতিটিরই বিস্তারিত পরিসংখ্যান এই অংশে দেওয়া হয়েছে।
প্রকাশক বুলবুল ইসলামের কথায় ‘সোনায় লেখা ইতিহাসে মোহনবাগান’ বইটি মোহনবাগান ক্লাবের একটি মিনি এনসাইক্লোপিডিয়া।
প্রকাশকের কাছ থেকে আরও জানা যাচ্ছে মোহনবাগান ক্লাবের কিছু সদস্য-সমর্থকের সহযোগিতায় এই বই প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। এই ধরণের বই লেখা বা প্রকাশ করা ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে আগে হয়নি। বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করেন বদ্রু ব্যানার্জী। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি ফুটবল খেলেছেন। ১৯৫৩ সালে তিনি মোহনবাগান দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। ভারতীয় অলিম্পিক ফুটবলের ক্যাপ্টেন হয়ে বদ্রু ব্যনার্জী শিল্ড এবং কাপ নিয়ে আসেন। তাঁর সময়কালের কথা বলেনতিনি যে কথা আলোচ্য বইয়ে লিখেছেননিজেদের সময়ের ফুটবলের কথা বলেন যথাক্রমে শ্যামল ব্যানার্জী, প্রশান্ত ব্যনার্জী, ক্রম্পটন দত্ত, সত্যজিৎ চ্যাটার্জী এবং বিদেশ বসু। বিদেশ বসু আক্ষেপ করেন মোহনবাগান, ইষ্টবেঙ্গলসহ প্রথম সারির দলে বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে। বিদেশ বসু বলেন, ‘’এখনকার দলগুলিতে কজন বাঙালি ফুটবলার আছে? কেন নেই? আমাদের ব্যর্থতা বলতে হবে। আমি নিজে বর্ধমান জেলার কালনা থেকে আট মাইল দূরের গ্রাম থেকে কলকাতায় খেলতে আসতাম। আমি গর্বিত আমি মোহনবাগান দলের হয়ে খেলার জন্য। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলে বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা এত কম কেন? সেই বিষয়ে আমাদের ভাবার সময় এসেছে। সব দলের উচিৎ গ্রাম থেকে ফুটবলার তুলে আনা।‘’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের অন্যতম সম্মানীয় সদস্য এবং আইনজীবী গীতানাথ গাঙ্গুলী। তিনি বলেন, ‘’এই বইটি আমি পড়েছি। প্রাথমিক পরিসংখ্যান আছে। যারা রেডিও টিভিতে ধারাবিবরণীর কাজ করেন তাঁদের খুব সাহায্য করবে। তবে হকি বিষয়ে কম লেখা হয়েছে। ক্লাবের অন্যান্য বিভাগের খেলা প্রসঙ্গেও কম লেখা হয়েছে। ক্রীকেট, অ্যাথলেটিক্স বিষয়ে বিস্তারিত থাকা উচিৎ ছিল।‘’
মোহনবাগান ক্লাবের অর্থসচিব এবং অন্যতম কর্মকর্তা দেবাশিষ দত্ত বলেন,  ‘’মোহনবাগান একটা ইতিহাস। কেন বলছি আমরা? ১৯১১ সালে সাহেবদের হারিয়ে পরাধীন ভারতে শিল্ড জিতেছিল সেইজন্য আমরা বলছি। ওই বছর ভারটীয় ফুটবলের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু আমি বলছি মোহনবাগান বর্তমান এবং মোহনবাগান ভবিষ্যৎ। এই বইটি লিখে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন সুবীর এবং তাঁর সহযোগীরা। কেউ কেউ বলছেন মোহনবাগান আইএসএল খেলবে। আমরা বলছি আইএসএল খেলাটা আমাদের ফোকাস নয়। আই লীগ কেন এত জনপ্রিয়? মোহনবাগান ফুটবল দল যে লীগে খেলেছে সেই লীগ প্রথমসারির লীগ হয়েছে।‘’
ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বইটির লেখক সুবীর ব্যানার্জী বলেন, ‘’কিছু ত্রুটি আছে। আমাদের পরিকল্পনা আছে বইটার সঙ্গে একটা সংযোজনী জুড়ে দেওয়ারদ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময় আমরা আরও যত্ন নেব। কারণ বইটি অনলাইনে বিপুল সাড়া পেয়েছে। প্রচুর বিক্রি হছে।''                                                                                                                                                      




                                    

সিলেটের আত্মিয়তা চাই পাহাড়ের মেঘেদের পাড়ায়


দীপেন্দু চৌধুরী
গত শতাব্দীর আশির দশকের উত্তর পূর্ব ভারতের আর্থ-রাজনৈতিক বিষয়ে এই প্রজন্মের ভারতীয়রা কতটা জানেন? মেঘালয় রাজ্য গুয়াহাটী রাজ্যের প্রতিবেশী রাজ্য। উত্তর পূর্ব ভারতের জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ একটা সময় ধারাবাহিক বঞ্চনার শিকার হয়েছিলেন যতটা না আশির দশকের আগের কেন্দ্রীয় সরকারের অবহেলা বা উদাসীনতা ছিল তাঁর থেকেও অনেক বেশি ছিল যোগাযোগের অপ্রতুলতা। সম্ভবত অনুন্নত পাহাড়ি উপত্যকায় কেন্দ্রীয় সরকারের উন্নয়নের সুফল উত্তর পূর্ব ভারতের জনজাতি/ আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছয়নি এই কারণে। পাশাপাশি আরও একটি বিষয় আছে, নৃতত্ববিদদের মতে উত্তর পূর্ব ভারতের জনজাতিদের অশিক্ষা, সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সুযোগ নিয়েছিল সমতলের একদল উচ্চশিক্ষিত মানুষ। ব্রিটিশ আমলে সাহেবরা প্রথম এই সুযোগ নেয়। তারপর উত্তর ঔপনিবেশিক ভারতে একদল ‘বাবুশ্রেণী’ সাহেবদের চেয়ারে উপবিষ্ট হয়। পাহাড়ি মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো যত পৌঁছল তাঁরা সচেতন হয়ে উঠল। নিজেদের সম্প্রদায়ের জন্য, শিক্ষা, বাসস্থান, চিকিৎসা সহ বিভিন্ন সরকারি সুযোগের দাবিতে এবং প্রয়োজনে তাঁরা আন্দোলনে নামল।
শুরু হল আসু, খাসি ছাত্র আন্দোলন। বাঙালি, মাড়োয়ারি তথা বহিরাগত খেদাও আন্দোলন এক হিংস্র রাজনীতির জন্ম দিল। পাহাড়ি উপজাতি এবং বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সামাজিক সৌহাদ্র ছিল ভেঙে যেতে থাকল। এই নতুন সামাজিক প্রেক্ষাপটকে নির্ভর করে গড়ে উঠল বিংশ শতাব্দীর নবীন সভ্যতা। ২৩ নভেম্বর কলকাতার অক্সফোর্ড বুক স্টোরে একটি বই প্রকাশ হল। বইটির প্রকাশক ‘স্পিকিং টাইগার’। ইংরেজিতে লেখা বইটি শিলং গড়ে ওঠার গল্প। আশির  দশকের গল্প। বিগত শতাব্দীর আশির দশকে উত্তর পূর্ব ভারতে রাজনৈতিক যোগাযোগও করতে হত ল্যান্ডফোন, টেলিগ্রাম ইত্যাদির মাধ্যমে। এতটাই দুর্গম ছিল সেই সভ্যতা। বলছিলেন বইটির লেখক নীলাঞ্জন পি চৌধুরীলেখক বলছিলেন কলকাতার অভিজাত বই বিপণির শ্রোতাদের সামনে। ‘বাজাজ চেতক’ স্কুটার ছিল সামাজিক অবস্থানের পরিচিতি। লেখক নীলাঞ্জনের শৈশব, কৈশোর কেটেছে শিলং শহরে। পূর্ববঙ্গের সিলেট থেকে তাঁর পরিবার শিলং শহরে আসে। তারপর পারিবারিক উচ্চ শিক্ষা এবং সংস্কৃতির প্রভাব পড়ে লেখক নীলাঞ্জনের মধ্যে। ইংরেজি স্কুল কলেজে পড়লেও নীলাঞ্জন মেঘালয়ের মেঘেদের পাড়ায় পাড়ায় ঘুরেছেনসময় কাটিয়েছেন পাহাড়ি উপজাতি সম্প্রদায়ের সঙ্গে। তাঁদের জীবন, তাঁদের সংস্কৃতি আত্মস্থ করেছেন আপন আত্মীক অনুভবে। সিলেটের ভাষা, কলকাতার আধুনিক বাংলা ভাষা এবং ইংরেজি ভাষাকে রপ্ত করে। পাহাড়ের সবুজ ঘেরা প্রকৃতি তাঁর হ্রদয়ে গেঁথে রয়েছে। উচ্চ শিক্ষা লেখকের অর্জিত পাহাড়ি সারল্য কেড়ে নিতে পারেনি।   
বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে উচ্চ শিক্ষিত এবং বনেদী ঘরানার লেখক নীলাঞ্জন নিজের বক্তব্য রাখার সময় বেছে নিচ্ছিলেন ইংরেজি ভাষা, পশ্চিমবঙ্গের চলিত বাংলা ভাষা এবং সিলেট্টি। বলতে হয় জিও নীলাঞ্জন। দীর্ঘজীবী হও। নীলাঞ্জনের নিজের লেখা থেকে টুকরো টুকরো পাঠ তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল শিলং নামক এক গঞ্জ শহরের পাহাড়ি বস্তিতে। আবেগ, উচ্ছাস, অভিমান ঠিকরে পড়ছিল তাঁর বক্তব্যে। কিছু একটা হারিয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা তাঁকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। সেই বেদনা উঠে এসেছে তাঁর লেখায়।   
বইটি সম্পর্কে প্রথম বললেন কর্পোরেট উপদেষ্টা এবং দুটি ইংরেজি বইয়ের লেখক অভীক চন্দঅভীকের আরও একটি পরিচয় আছে। তিনি সত্যজিৎ রায়ের ছবির নায়ক অভিনেতা বরুণ চন্দের ছেলে। অভীক বইটি নিজে পড়েছেন। তিনি বললেন, ‘’আঁতেল লেখকের বই নয় নীলাঞ্জনের লেখা ‘শিলং টাইমস’। হ্রদয় দিয়ে লিখেছেন লেখক। নীলাঞ্জন আমার বন্ধু হয় বলে বলছি না। বইটা আপনারা পড়লেই বুঝতে পারবেন। দু’জন ভিন্ন সম্প্রদায়ের যুবক যুবতির নিছক প্রেমের গল্প নয় এই উপন্যাস। সামাজিক টানাপোড়েন আছে নীলাঞ্জনের লেখা এই বইয়ে। নসটালজিয়া আছে। ভারতের বর্তমান সময়ে এই বই ইংরেজি, বাংলা সব পাঠকের জন্য সাহায্য করবে।‘’
নীলাঞ্জন বললেন, ‘’কবির সুমনের একটা গান আছে, ‘এ শহর আমার জানে সবকিছু’। সত্তর আশির দশকের  শিলং আমার হ্রদয়ে আছে। নব্বই দশকের আগে ভারতের মানুষ ভীষণ সরল ছিল। খুব গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল। শিলং-এর সেই সময়টা চলে গেছে। মিউজিসিয়ান, গায়ক এবং বর্তমানে চলচ্চিত্র পরিচালক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের ছবি ‘ওপেন টি বাইস্কোপ’ আমাকে প্রভাবিত করেছে। এই বই লিখতে।‘’
অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় সেদিন উপস্থিত ছিলেন বই প্রকাশ অনুষ্ঠানের প্যানেলিস্ট হিসেবে। তিনি বললেন, ‘’ছবিটা দেখে তুমি আমাকে একটা মেল করেছিলে। আমি মেলের বিষয়টা বলব না। মানুষের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি নিয়ে আমরা বেঁচে থাকি। আশি-নব্বই দশকের সময়টা এই প্রজন্মকে আমরা বোঝাতে পারব না। আমাদের কাছে টেনিদা ছিল। ঘনাদা ছিল। গলির মধ্যে যে পৃথিবী সেই পৃথিবীও উজ্জ্বল। আমরা পালাব কোথায়? আমার প্রথম ছবি ‘ওপেন টি বাইস্কোপ’। তাই আবেগ ছুঁয়ে গেছে ছবির পাতায় পাতায়।‘’
অনিন্দ্য আরও বলেন, ‘’বন্ধুত্বের বিষয় নিয়ে লেখা এই উপন্যাস। আমার ছবিও এই গল্পের কাছাকাছি। সামাজিক মান্যতা পাবে না এমন একজন যুবকের গল্প আমার ছবিতে আছে। শেষে তাঁর নিজের পাড়ার মানুষ তাঁকে মান্যতা দেয়। সে সমস্ত বিশ্বের মানুষের সন্তান।‘’
‘শিলং টাইমস’ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র দেবু। দেবুর শৈশব, কৈশোর, যৌবনের অনুভূতি, দ্বন্দ, ব্যক্তিত্বের সংঘাত, সামাজিক টানাপোড়েন এইসব বিষয় বইয়ের বিস্তারে এসেছে। ইংরেজি গান সংস্কৃতির ঝাপটা আছে নীলাঞ্জনের বইয়েআমি প্রশ্ন করেছিলাম উত্তর পূর্ব ভারতের ‘মাতৃতান্ত্রিক সমাজ’ ব্যবস্থা প্রসঙ্গে। নীলাঞ্জন স্বীকার করলেন। যে বর্তমান সময়েও মেঘালয়ের মেঘেদের পাড়ায় গেলে দেখা যাবে পরিবারের মহিলারা সংসারের প্রধান অভিভাবক। নীলঞ্জন বললেন, ‘’আমার এই উপন্যাসে দু’টি ভিন্ন সম্প্রদায়ের দু’জন যুবক যুবতির বড় হয়ে ওঠার গল্প আছে। সেই গল্প এই বিষয়টাকেও ছুঁয়ে গেছে।‘’  
গভীর বন্ধুত্ব এবং ভয়ের এক জীবন্ত উপন্যাস শিলং টাইমস। এই বইয়ের বিষয় প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে, ‘’’About ‘’residents’’,  ‘’outsiders’’  and whose right it is to live in a particular place, this is also the moving story of friendship that transcends all barriers, with humor and profound insight, Chowdhury marches his characters straight into the reader’s heart.’ 

                                                                                                                                Hanseda Sowvendra Shekher

                                 


Monday 26 November 2018

প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দুই জীবনশিল্পীর সেতু




দীপেন্দু চৌধুরী 
উনবিংশ শতাব্দীর ভারতে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের উৎস ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ কলোনী অধ্যুষিত সভ্যতাএবং সেই সভ্যতা নির্ভর বাংলা থেকে পাশ্চাত্য ভাবধারার জীবনশৈলীর খোঁজে ঝাঁকে ঝাঁকে লেখক, শিল্পী, সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবীর দল আমাদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছেন। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বে ‘’নবজাগরণ’’ নামে পরিচিত চিরায়ত সেই আন্দোলনের ভিত্তি ছিল আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, স্বচ্ছ ভাবাদর্শ, যুক্তি নির্ভর বস্তুবাদী জীবনদর্শন, সুগভীর মানবতাবোধ এবং আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাস রাখা। এই আন্দোলনের প্রথম সারির ঋত্বিক তথা সামজিক মহানয়ক ছিলেন রামমোহন রায়, বিদ্যসাগর থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত একধিক প্রথমসারির বিদ্বজ্জন বিংশ শতাব্দীতে এসে উনবিংশ শতাব্দীর জ্ঞানের আলোয় বিচ্ছুরিত মনন, লেখনী, মানবতার আবেদন রবীন্দ্রনাথ আমাদের দিতে থাকলেন। তাঁর আকাশ ছোঁওয়া সীমাহীন ব্যক্তিত্বের স্পর্শে। বাঙালি তথা ভারতের অনুন্নত সাংস্কৃতিক সমাজ সমৃদ্ধ হতে থাকল।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষ দিকে অর্থাৎ ১৯১৯ সালের ২৪ জুন কবিগুরুর হাতে এসে পৌঁছল একটি চিঠি। না সেটা ‘রাশিয়ার চিঠি’ নয়। বা ব্রিটেনের রানীর চিঠি নয়। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর চিঠিও নয়। চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন বিশিষ্ট ফরাসী ঔপন্যাসিক, জীবনের গদ্যশিল্পী, মানবতাবাদী ভাবুক, দার্শনিক রম্যাঁ রলাঁ। তিনি রবীন্দ্রনাথকে আবেদন করেছিলেন ‘মুক্তমনের স্বাক্ষরপত্র’-তে সই করার মানবিক আবেদন নিয়ে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, ‘ছেলেটা’, ‘সাধারণ মেয়ের’ কবি, ‘গোরা’, ‘ঘরেবাইরে’ উপন্যাসের জীবনশিল্পী বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সই  করে দিয়েছিলেন সেই ‘মুক্তমনের স্বাক্ষরপত্র’-তে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দু’ই জীবনশিল্পী সেতু রচনা করলেন। মানবিক বিশ্বের সেতু। শুরু হল এক ধ্বংসোন্মুখ পৃথিবীকে বাঁচানোর ‘পটকথা’। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা দুই মানবতাবাদী ভাবুকের কথোপকথন। ঘুমিয়ে থাকা বিশৃঙ্খল একমেরুর ঝঞ্জা থেকে বিশ্বমানবতাকে বাঁচানোর দায় দায়িত্ব তুলে নিলেন তাঁরা দুজনে। ভারতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফ্রান্সে রঁম্যা রলাঁ। অধ্যাপক, কবি ফরাসি ভাষাবিদ চিন্ময় গুহ বলছিলেন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের দুই ‘নিখিলেশ’-এর দেখা হল। মিলন হল। বিশ্ব পেল আরও স্বচ্ছ কাঁচের পেয়ালা ভর্তি মানবতার আলো। বন্ধনহীন, সীমহীন সঙ্গীতের মূর্ছনা।  
যদিও রবীন্দ্রনাথ তখন ভীষণ ক্লান্ত। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কবি ‘নাইটহুড’ খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি তখন ক্ষুব্ধ, বিষণ্ণ, অবসন্ন। সেই সময় পেলেন আন্তর্জাতিক মানবতার রক্ষার দাবিপত্র। পাঠিয়েছেন নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের জীবনীকার রম্যাঁ রলাঁ। আমরা এতটা জানতে পারলাম একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে। ২২ নভেম্বর আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ সভাঘরে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হল অধ্যপক চিন্ময় গুহ সম্পাদিত ‘ব্রিজিং ইষ্ট অ্যান্ড ওয়েস্টঃ রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড রম্যাঁ রলাঁ করেসপন্ডেস’ ১৯১৯-১৯৪০ গ্রন্থটি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে। বইটি উদ্বোধন করেন চলচ্চিত্র এবং নাট্য ব্যাক্তিত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধায়। ১৪৯ পাতার বইয়ে দুই মানবতাবাদী বিশ্বপথিকের মোট ৫৬টি চিঠি এবং ৩টি সংলাপ আছেসৌমেন্দ্রনাঠ ঠাকুরের বিস্ফোরক চিঠি আছে (১৯১৯-১৯৪০)। গাঁধি বিষয়ে চিন্ময় গুহ জানাচ্ছিলেন, দু-দু’টো বিশ্বযুদ্ধের সময়ের অস্থির বিশ্বের ছবি ধরা আছে এইসব চিঠির ছত্রে ছত্রে।
চিন্ময় গুহ বললেন, ‘’রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘হে আমার অতি প্রিয় বন্ধু’, কবির ভাষায় ‘আমি তো মহাত্মা গাঁধির হাতে হাত রাখতে চাই, যাতে জনসাধারণ খুশি হয়। কিন্তু আমি তো বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারব না যে আমাদের সত্যানুসন্ধান ও ভাবনা সম্পূর্ণ আলাদা।’ আবার তাঁর উত্তরে ১৯২৫ সালে রলাঁ লিখছেন, ‘আমরা যে ঘর বেঁধেছি অনন্ত বৃক্ষের উপর।’ লক্ষ করুণ রবীন্দ্রনাথ ‘হে আমার অতি প্রিয় বন্ধু’ সম্বোধন করে চিঠি লিখছেন। বিশ্বকবি কতজনকে এই সম্বোধনে চিঠি লিখেছেন? খুব পরিষ্কার ছবি আমাদের সামনে নেই।‘’
চিন্ময় গুহ আবেগ প্রবণ হয়ে বলে চলেন, জীবন এবং চলচ্চিত্রকে একটা বন্ধনে বেঁধেছেন সৌমিত্রদা। তিনি এখানে আছেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। স্মৃতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং ধর্মীয় বিষয় নিয়ে রলাঁর বক্তব্য। ঘুমের দরজাকে উপেক্ষা করে আমার বক্তব্য নয়। রম্যাঁ রলাঁ বলছেন। ১৯১৪ সালে কোনও নোবেল পুরষ্কার ছিল না। যুদ্ধের কারণে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ পুরস্কার পান। ১৯১৫ সালে রম্যাঁ রলাঁ পেলেন নোবেল পুরস্কার। তাঁরা দু’জনে এক তরঙ্গ লহমায় থাকেন পরস্পরকে না দেখেও। পাশ্চাত্যের ‘নিখিলেশ’-এর চরিত্র তিনি এঁকেছেন। সংগীতের সমন্বয় বিষয় নিয়ে দু’জনে কথা বলেছেন। সংস্কৃতির ঐতিহ্য আলো। জ্বলে উঠল আলো ঐ নীল দিগন্তে। আনন্দের জ্বলন্ত শিখা হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন নাটকীয়তাকে আমি ঘৃণা করি।
এই বইয়ে চিন্ময় গুহ মূল ফরাসি থেকে রলাঁর চিঠিগুলির নতুন করে অনুবাদ করেছেন। সম্পূর্ণ পত্রাবলি সম্পাদনা করে দীর্ঘ এক ভূমিকা এবং টীকা লিখেছেন অধ্যাপক গুহ। যে কাজ বর্তমান সময়ের মানদন্ডে চিরকালীন হয়ে থাকবে। এই বইয়ে আছে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের ঋষিতুল্য মানবতাবাদী দু’ই লেখকের টেলিগ্রাম, রথীন্দ্রনাথের চিঠি। মুসোলিনি-বিতর্ক। এই বিতর্ক প্রসঙ্গে অধ্যাপক গুহ তাঁর সমৃদ্ধ মেধার মাধ্যমে আমাদের শোনালেন রবীন্দ্রনাথের দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কথা। ইংরেজিতে লেখা বইটিতে আরও আছে দু’জনের সম্পর্কিত ঘটনাবলি, গাঁধি-রবীন্দ্রনাথ-রলাঁর সম্পর্ক বিষয়ক লেখা এবং তথ্য। এই বিষয়ে পাশ্চাত্যের সমকালীন বিশিষ্টজনদের চিঠিপত্রের উধৃতি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘’চিন্ময় সেতু তৈরি করছে নতুন ভাষায় নতুন আঙ্গিকে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দু’জন মহান শিল্পীর সম্পর্কে আমাদের সামনে আরও তথ্য চিন্ময় তুলে ধরেছে। ভারতীয় হিসেবে ফ্রান্সের সঙ্গে চিন্ময়ের  দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। একই সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় রম্যাঁ রলাঁও আমাদের দেশকে জেনেছেন, বূঝেছেন একজন বিশ্বনাগরিক হিসেবে। আর রবীন্দ্রনাথ? তিনি আমাদের নীল আকাশ যেমন চিনিয়েছেন, চিনিয়েছেন সাগর পারের আমন্ত্রণের ভাষা। নদীর ঘাটের খেয়া টানার গান। সেই দু’ই মহান ব্যক্তির সংলাপ চিন্ময় নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেছে। রম্যাঁ রলাঁ রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের জীবনীও লিখেছেন।‘’
এদিনের আলোচনা থেকে অধ্যাপক চিন্ময় গুহের বক্তব্যে আরও পাওয়া গেল, রলাঁ বলছেন, আমরা একই চিন্তা করেছি। ওদের নয়, আমাদের নয়, সবার। অনেক বামপন্থীরা ভেবেছিলেন রলাঁ বামপন্থী। কিন্তু তিনি মানে রম্যাঁ রলাঁ বলছেন ‘আমি সম্পূর্ণ মুক্ত মানুষ।’ রলাঁ র‍্যাডিক্যাল ছিলেন। সনাতন ভারতকে তিনি বুঝতে চেষ্টা করেছেন। মানুষের মধ্যে খুঁজছেন সীমাহীন এক পৃথিবী। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে তাঁর কথায় উঠে এল, রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘আমার সঙ্গে যত মানুষের দেখা হয়েছে তাঁদের মধ্যে রলাঁ আমার সব থেকে কাছের মানুষ। আমরা দু’জনেই স্বদেশী এবং জাতীয়তাবাদী।‘’ অচেতনভাবে রবীন্দ্রনাথ বলছেন আমাদের জয় হবেই আমরা করব জয়।
অধ্যাপক গুহ আরও বলেন, ‘’রবীন্দ্রনাথ স্ত্রোত্র পাঠ করেছিলেন। মন্ত্র পাঠ করেছিলেন। সেটা সংগীতকে ছাপিয়ে যায়। যেন প্রাচীন মনের মৌচাক। আনন্দের জ্বলন্ত শিখা হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। পৃথিবীর ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের জাপান সফরের বক্তব্য সারা বিশ্বের কাছে একটা বাঁক। যে বক্তব্য রবীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন সেই বক্তব্যে তিনি মানবধিকারের কথা বলেছিলেন, যেমনটা তিনি করেছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার প্রতিবাদে। রলাঁর এক বান্ধবী রলাঁকে বলছেন রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ পড়তে এই বইয়ের কবিতা গান নয়, গানের উপরের স্তরের  আরও উচ্চতায়, আরও বাঙময়।‘’
ধ্যানমগ্ন ঋষির অন্তর থেকে প্রস্ফুটিত শব্দের ডালি। ‘গানের ঝর্ণাতলায় তুমি সাঁঝের বেলায়/ এলে ঝর্ণাতলায় ......যে সুর গোপন গুহা হতে/ ছুটে আসে আপন স্রোতে’ রবিন্দ্রনাথের অশ্রু মিশে গেল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।
কলকাতায় ফ্রান্সের কনসাল জেনারেল ভার্জিন কর্টিভেল (Virginie Coteval) বলেন,  ‘’গত শতাব্দীর দুটো দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে দু’জন শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী লেখকের আলোচনার বিষয় আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন অধ্যাপক চিন্ময় গুহ। ফ্রান্স সরকারের কাছেও এই কাজ সম্মানজনক বিষয়। বাংলা, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় দক্ষ চিন্ময় গুহ। বর্তমান শতাব্দীতেও এই বইয়ের বিষয় দু’টো গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে সেতু রচনা করবে।‘’
এদিনের সন্ধ্যায় ফরাসি ভাষায় লেখা রম্যাঁ রলাঁর চিঠি পড়েন আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ কলকাতার ডিরেক্টর ফ্যাব্রিস প্যাল্কন এবং গ্রন্থগারিক সন্ধিয়া ভাসিউর। রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে বাংলায় কবিতা পাঠ করেন মৃন্ময়ী ধর।                                                             

Sunday 25 November 2018

বিশ্বের যে কোনও আক্রান্ত সাংবাদিকের পাশে থাকবেন তিনি




দীপেন্দু চৌধুরী
পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ? না পথ খুঁজিতেছ? তুমি বঙ্কিমচন্দ্রের নবকুমার লহ। তবে বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমের কাছে আজ বিশ্বপথিক। তথা বিশ্বনাগরিক। তাই আমি সঙ্গে হাটিতে চাহিতেছি। কারণ আমি পথ হারাই নাই। আমি পথ খুঁজিতেছি। তুমি আহ্বান জানাইয়াছ। তুমি আমন্ত্রণ করিয়াছ। ‘Join The Journey’.  এই যুগে আমাদের ন্যায় এই দেশে ‘নবকুমার’ হইতে গেলে অনেক কাঠখড় পোড়াইতে হয়। যাহার খবর সন্ধানে তুমি ভারতে আসিয়াছ। আমি নাগরিক সাংবাদিকতায় স্থানও পাইতেছি না। আবার প্রস্থান করিতেও দিতেছে না। তাই সব ধরণের লড়াই করিয়া টিকিয়া থাকিতে চাহিতেছি। আমাদের ন্যায়শীল পাঠকের কাছে ইহাই কহিবার থাকে যে ইহা আমার ন্যায় এক শ্রমজীবী সাংবাদিকের আত্মশ্লাঘা কহিবার নিবন্ধ নহে। শুনাইবার কোনওরূপ অহংবোধ দেখাইতেছি না। আবার সাধুভাষায় লিখিবারও আমাদিগের কোনওরূপ স্বতঃপ্রণোদিত আত্মনিবেদনের শ্রমলব্ধ কলমচির কাজ করিতে মন চাহিতেছে না। তাই চলিত বাংলায় আমেরিকান সংবাদ মাধ্যমের এক ‘পদাতিক’ সাংবাদিক প্রসঙ্গে দু’চার লাইন লিখিবার সাধ জাগিয়াছে।
খবর সংগ্রহের উপকথা
তাঁর নাম পল সালোপেক। তিনি সাংবাদিকতার ছাত্র নন তিনি বিঞ্জানের ছাত্র। সাংবাদিকতাকে ভালোবেসে বিশ্ব পথিক হয়েছেন। পল সালোপক আমেরিকার প্রতিষ্ঠিত লেখক এবং সাংবাদিক। তিনি কাজ করেছেন ‘চিকাগো ট্রিবিউন’, ফরেন পলিসি, দ্যা আটলান্টিক, ন্যাশন্যাল জিয়োগ্রাফিক সহ আরও নিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার হয়েতিনি হেঁটে বিশ্বের কয়েকটি দেশের রাজনীতি, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং লোকায়ত সংস্কৃতির সুলুকসন্ধান করতে চান। সালোপেক ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে হাঁটতে শুরু করেছেন। আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে এসে মানুষ কী রকম ভাবে এক দেশ থেকে আর এক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে সেটা জানাটাও এই সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য। ‘’আউট অফ ইডেন ওয়াক’’ (‘’Out of Eden Walk’’) শিরোনামে তিনি হেঁটে বিশ্বভ্রমণ করতে চান।  এই পরিভ্রমণ প্রায় ২১ হাজার মাইল হবে। আনুমানিক প্রায় ৩৩ হাজার ৭৯৬ কিলোমিটার। তাঁর এই ভ্রমণের জন্য অর্থ দিচ্ছে ন্যাশন্যাল জিয়োগ্রাফিক সোসাইটি, দ্য নাইট ফাউন্ডেশন এবং আবুডান্স ফাউন্ডেশন। তার এই পদব্রজে ভ্রমণ শেষ হবে ২০২০ সালে দক্ষিণ আমেরিকা সফর দিয়ে। সম্প্রতি কলকাতা প্রেস ক্লাব এবং আমেরিকান সেন্টারের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত হল ‘স্লো জার্নালিজম’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভার
ভারত সফরে এসে সালোপেক অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখলেন বিহারের মানুষ কীভাবে সুরাট থেকে চলে আস্তে বাধ্য হয়েছেন। কাজের সন্ধানে গিয়ে সেখানে ‘নাগরিক স্বীকৃতি’ না থাকার জন্য তাঁদের চলে আস্তে বাধ্য হতে হয়েছে। বিহারে থাকার সময় এই গল্প শোনেন দু’বার পুলিৎজার বিজয়ী আলোচ্য সাংবাদিক। সারা বিশ্বের জ্বলন্ত সমস্যা ‘মাইগ্রান্ট’ বা অভিবাসন সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছেন তিনি। অনুভব করছেন বিশ্ব আত্মীয়তার। যেটা তিনি পারেন অনুভব করতে কারণ তিনি পায়ে হেঁটে, পায়ে হেঁটে লাল, কালো, পাথুরে, কাদা, মাটি, জল মেখে, মরুভূমিতে হেঁটে চলেছেন। নাগরিক সভ্যতা টপকে গঞ্জ সভ্যতা তারও আগে অনেক অনেক আগে গ্রামীণ সভ্যতাস্লাইড শোয়ের মাধ্যমে ১৯ নভেম্বর কলকাতা প্রেস ক্লাবের সভাঘরে তিনি বললেন, ‘শিকাগো থেকে ট্রাডিশনাল খবর করেছি। রাজনীতি, পরিবেশ, সামাজিকসহ বিভিন্ন বিভাগে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। আমি ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছি। সাংবাদিকতার প্রয়োজনে। জেনোসাইড বা গণহত্যা আমাকে গভীড়ভাবে ভাবায়।  আমি মানবতা দেখেছি। সন্ত্রাসবাদীদের মধ্যেও মানবতা দেখেছি। ফেস টু ফেস সাংবাদিকতায় অনেক কিছু বোঝা যায়। ‘Single Journalism is my life. New story in the world.’ আমি খুঁজেছি এবং খুঁজছি জীবনের নতুন নতুন উপকথা।‘’
তিনি সন্ত্রাসবাদীদের সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন। আফ্রিকা এবং এশিয়ার মধ্যভাগে তাঁদের সঙ্গে সালোপেকের দেখা হয়েছে। তাই তিনি উপলব্ধি করছেন ‘মাইগ্রেশন’ নামক এক জ্বলন্ত সমস্যার। আফ্রিকা থেকে আমেরিকা হয়ে বাকী বিশ্বের একই সমস্যা। সালোপেকের আক্ষেপ নিজের দেশ আমেরিকা উন্নত গণতন্ত্রের গর্ব করলেও অভিবাসন নীতি ঠিক করতে হিমসিম খাচ্ছে। একশো বছর আগে থেকেই ‘মাইগ্রেশন’ একটা জ্বলন্ত সমস্যা। তাঁর বক্তব্যে তিনি বলছেন। ’In case of India, migration is a very important issue.’’   
সাংবাদিকতা কোনও রকম ‘রেডিমেড ফুড’ নয়। সালোপেক মনে করেন। চট জলদি একটা খবর সংগ্রহ করে ‘বৈদ্যুতিন মাধ্যম’-এ ব্রেকিং নিউজ করলেই সাংবাদিকতার কাজ শেষ হয়ে যায়না। ‘স্লো জার্নালইজম’ বুঝতে গেলে ঞ্জান অর্জন করতে হবে। দিনে তিন চারটে খবর সংগ্রহ করে আমরা গর্ব করতে পারি কিন্তু সংবাদের গভীরে যেতে পারি কী? প্রশ্ন তুলছেন সালোপেকতাঁর বক্তব্য, I am working from story to story for digital news. গতিশীল দুনিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিতে হবে। ‘স্লো জার্নালইজম’ বিষয়ে তিনি আরও বলছেন, ‘’I believe there is space for longer, hopefully more thoughtful storytelling in our lives, and walking accomplishes this. By moving at 5km an hour through the main stories of our time, I think I gather a better understanding.’’  আন্তর্জাতিক বিশ্বায়িত নাগরিকদের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমারআরও দেখা হবে। আমি আরও অনেকের সঙ্গে দেখা করতে চাই। কথা বলতে চাই।
ভারতের রাজনীতি প্রসঙ্গে সলোপেক বলেন ‘’আমি একটা হেডলাইন দেখেছিলাম নোট বাতিলের জন্য মানুষ কি ভাবে অসুবিধায় পড়েছে। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এই খবরের গভীরে গিয়ে সেই গল্প আমাদের কতটা দিতে পেরেছে? এই বিষয়টা আরও বিস্তারিত গেলে তবেই বলতে পারব ‘স্লো জার্নালইজম’-র শর্ত আমরা পালন করতে পেরেছি।‘’
প্রশ করেছিলাম সি এন এন চ্যানেলের সাংবাদিকের কার্ড বাতিল প্রসঙ্গে। ট্রাম্প প্রশাসন যদিও পরে সি এন এন সাংবাদিক জিম অ্যাকোস্টার মার্কিন সরকারের দেওয়া হুয়াইট হাউসের অনুমোদিত কার্ড (Accredited) জিমকে ফেরৎ দিয়েছেন। প্রসঙ্গটি উল্লেখ করে আমি জানতে চেয়েছিলাম ‘মুক্ত সাংবাদিতা’ (Free Press) বিষয়ে তাঁর  মতামত কী? আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘’According to news agency  A federal Judge on 16 November directed the White House to restore the press credentials of Jim Accosta of CNN, while White house spokeswomen Sarah Sanders, said ‘’We will also further develop rules and processes to ensure fair and orderly press conferences in the future.’’ Mr. Salopek what is your opinion about free press Rights? পল সালোপেক উত্তরে বলেন, ‘’বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা রয়েছে। আমি যে কোনও দেশের সংবাদ মাধ্যমের উপর আক্রমণের বিরোধী। আমার সহকর্মী আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমরা ওর পাশে ছিলাম। এবং এখনও পাশে আছি। ভবিষ্যতেও থাকব।‘’               
  

Tuesday 13 November 2018

উদ্বৃত্ত মানবসম্পদ নিয়ে চিন্তিত বুকারজয়ী লেখিকা




দীপেন্দু চৌধুরী
আজকের এই নিবন্ধের সঙ্গে প্রথম যে উধৃতিটি উল্লেখ করছি সেটা কতটা সাযুজ্য দাবি করতে পারে?  সেটা বিচার করার দায়িত্ব বিদগ্ধ পাঠকমণ্ডলীর।  হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কোনও সময় একটি লেখায় লিখেছিলেন, ‘’যা দেখি খারাপ লাগে, যা শুনি খারাপ লাগে, যা পড়ি খারাপ লাগে, যার সঙ্গে কথা বলি খারাপ লাগে, কোথাও সত্যিকার বুদ্ধি, প্রঞ্জা বা প্রতিভার পরিচয় পাইনা। শুধু সমস্ত অন্ধকারের মধ্যে শিবরাত্রির সলতে হয়ে একা জ্বলছেন অন্নদাশঙ্কর। ... তাই শত রাজনৈতিক মতভেদ সত্বেও অন্নদাবাবুকে আমরা মাথায় করে রাখি।‘’
আমি এই জন্মে কোনওদিন এমন ধৃষ্টতা দেখানো বা চিন্তার করার  কথা ভাবতে পারি না। যে আমি অন্নদাশঙ্কর রায়ের সমগোত্রীয় হয়ে যাব পরজন্মে হতে চেষ্টা করব। এমনটাও ভাবতে চাইছি না। কারণ আমার সীমাবদ্ধ ঞ্জানে আমি ‘পরজন্মে’ বিশ্বাস করি না। জীবনের কৈশোর থেকে এ পর্যন্ত আর্থ-সামাজিকভাবে এবং আর্থ-সাংস্কৃতিক মানদন্ডে পিছড়ে বর্গের মানুষ হয়ে থেকে গেলাম। অথবা অদৃশ্য এক রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক ‘জোটঘোট’ এবং তাঁদের অনুগামী দল (স্বার্থান্বেষীর দল) নোনা ঘামের স্রোত দেখতে অভ্যস্তআমাদের মতো অপর’-দের দেখে হাসি ঠাট্টা, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপ করেই এঁরা আনন্দ পায়। আমরা আমাদের কাজ করে যাই। একদল ঠান্ডা ঘরের সুচতুর সাংস্কৃতিক ‘জোটঘোট’ আজ পর্যন্ত আমাকে ‘ক্যামেরাম্যান’, ‘অচ্ছুৎ’ (Untouched), দলিত, জোকার, ভাঁড় ইত্যাদি পদবীতে খ্যাত করেছেন। বিভিন্ন উপায়ে আমদের মতো অক্ষম ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ঘৃণা ছড়িয়েছেন। ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। তাঁদের পরিকল্পিত আক্রমণে আমাদেরমতো ব্যক্তিদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকে না। বারে বারে কেড়ে নেওয়া হয়। তাঁদের দুর্বলতা তাঁরা নিজেরা হয়ত বর্তমান সময়ে বুঝতে পারছেন। আমাদেরমতো মানুষদের যত ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ এবং কুখ্যাত করে প্রচার বা অপপ্রচার করা হয় ততই আমাদের মতো মানুষরা, মানুষের হ্যাঁ সাধারণ মানুষের সমর্থন পাই। জনান্তে এটাও বলে রাখা যায় এইসব গোষ্ঠী তাঁদের নিজেদের অজান্তে আমাদের মতো ‘মূর্খ’-দের নামে অপপ্রচার করতে গিয়ে প্রচার করে বসে। এই প্রসঙ্গটির খুব কিছু প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আমার পরিচিত এক দক্ষিণপন্থী ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি অরুন্ধতী রায়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন? ভদ্রমহিলা উগ্র বামপন্থী’। আমি জানতে চাইলাম, ‘আরবান নকশাল’? তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ তাই’। আমি এর পর আর কথা না এগিয়ে বলেছিলাম, ‘চলুন শুনি ওনার বক্তব্য’। অরুন্ধতী রায়ের বক্তব্য শোনার পরে আমার সঙ্গে অনুষ্ঠান দেখতে যাওয়া ভদ্রলোক মেনে নিলেন যে ‘অরুন্ধতী রায়’ একজন বিদগ্ধ লেখিকা এবং প্রতিবাদী সমাজকর্মী।                   
 সাম্প্রতিককালে ভারতের বুকারজয়ী ইংরেজি লেখিকা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত ঞ্জান ছিল বাংলা এবং ইংরেজি দৈনিকের সংবাদের উপর। কিন্তু ১০ নভেম্বর তাঁর সঙ্গে প্রায় পৌনে দুঘণ্টা কাটানোর পর মনে হল প্রকৃত ঞ্জানী এবং সাহিত্যঋদ্ধ, শিল্পের শৈলী, সৃষ্টির উন্মাদনা যে যে লেখকের, বুদ্ধিজীবীর আছে তিনি আর যাই হোক নিজেকে ফাঁকি দিতে পারবেন বলে মনে হয় না। ব্যক্তি সচেতন এবং সমাজ সচেতন হতে বাধ্য। ‘দ্য ক্যালকাটা ক্লাব’ এবং ‘কলাম ক্লাব’ মতভেদে ‘কলম ক্লাব’ যৌথ উদ্যোগে ১০ নভেম্বর ক্যালকাটা ক্লাবে আয়োজন করেছিল মুক্তমনা লেখিকা অরুন্ধতি রায় (‘Arundhati Roy UNPLUGGED’) আমন্ত্রণপত্রে ইংরেজিতে আরও লেখা ছিল, ‘The acclaimed of The God of Small Things and The Ministry of Utmost Happiness will be in conversation with Sandip Roy.’ এই অনুষ্ঠানে আমার আমন্ত্রণ পাওয়ার কথা ছিল না। কারণ ভিন্নতর এবং বিভিন্নতর। হঠাত আমার সঙ্গের বন্ধুর মাধ্যমে অনুষ্ঠানের বিষয়ে জানতে পারি। এবং আমন্ত্রণপত্র ‘গেমপ্ল্যান’ থেকে নিজের পরিচয় দিয়ে সংগ্রহ করি। আমার মনে ছিল না যে, ‘ক্যালকাটা ক্লাবে ভারতের জাতীয় পোশাক ‘পায়জামা, পাঞ্জাবী’ এবং  ‘ ‘জওহর কোর্ট’ পরে যাওয়া যাবে না। আমি অবশ্য সেদিন ওই তিনটি পোশাক পরেই গিয়েছিলাম। আমাকে কেউ আটকায়নি। কোনওরকম বাড়তি প্রশ্নও করেননি। কিছুটা কৌতূহল হয়ত ছিল। পোশাকের আদিখ্যেতায়। কারণ আধুনিক কলকাতার সাহেব-বিবিদের মাঝে গোলাম হয়ে ছিলাম।
আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানি নাএদিন সত্যি সত্যি হুতোম এসেছিল। মুহূর্তের জন্য। মঞ্চের পিছনের দিকে ‘ডিসপ্লে বোর্ড’- এর উপরে এসে বসেছিল। আমাকে ঈশারায় বলল, ‘তুই এখানে কী করছিস?’ আমি বললাম, ‘বক্তব্য শুনতে এসেছি।’
হুতোম বলল, ‘’এইসব ‘সাহেব-বিবিদে’-র মাঝে তোকে গোলামের মতো দেখাচ্ছে। তুই ইংরেজি বই পড়তে জানিস না। এই লেখিকার একটাও বই পড়িসনি। সাহেবি আদব-কায়দা জানিস না। ‘বাপুরাম-সাপুড়ে’ হয়ে থেকে গেলি। আলকাপ-পঞ্চরসের ‘পাঁচু’ হয়ে থেকে গেলি।‘’ আমি আর উত্তর দেওয়া ঠিক হবে না বুঝে চুপ করে থাকলাম। হুতোম লেখিকা অরুন্ধতীর মাথার উপর চক্কর খেয়ে একটা গাছের ডালে গিয়ে বসে পড়ল। হয়ত ওর অনুষ্ঠান শোনার আগ্রহ আছে। গাছটা কি শিমূল গাছ ছিল? পড়ন্ত সূর্যের আলোয় হাল্কা লালছে রঙের লম্বা লম্বা ফুলের পাঁপড়ি দেখতে পেলাম।                   
জীবনের শতবর্ষ পূর্ণ হওয়া উপলক্ষে ১ নভেম্বর, ১৯৯৭ সালে একটি প্রথম সারির জনপ্রিয় সাপ্তাহিক পত্রিকায়  শ্রী নীরদচন্দ্র চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘’............এই উপলক্ষে বিশেষ উপরোধে লিখিতেছি, কিন্তু কী লিখিব ভাবিয়া পাইতেছি না। আমার মনের ভাব কী? এমন কি, স্থির বুঝিতে পারিতেছি না। তবে ইংরেজি ১৯৪৭ সালের ৫-৬ মে তারিখে কী ধারণার বশে আমার আত্মজীবনী (যাহা The autobiography of an Unknown Indian এই নামে ১৯৫১ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে Macmillan কতৃক প্রকাশিত হইয়াছিল) লিখিতে আরম্ভ করি তাহার কথা বলি।‘’
‘আত্মঘাতী বাঙালি’ নীরদচন্দ্র চৌধুরীর প্রথম আত্মজীবনী প্রকাশ হয়েছিল ৫৪ বছর বয়সে। অরুন্ধতী রায়ের প্রথম আত্মজীবনী The God of Small Things’ (Random House) ১৯৯৭ সালে ৪১ বছর বয়সে প্রকাশ হয়। তিনি তাঁর মধ্য যৌবনে এই উপন্যাস লেখেন। এই উপন্যাস ১৯৯৭ সালে ম্যান বুকার পুরষ্কার পায় ‘ফিকশান’ বিভাগে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সমালোচকদের ভাষায় অরুন্ধতীর প্রথম উপন্যাস The God of Small Things একজন অপরিচিত ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের লেখকের সব থেকে বেশি বিক্রি হওয়া বই। তাঁর প্রথম উপন্যাস The God of Small Things বিক্রি হয়েছে ছয় মিলিয়ন কপি। অনুবাদ হয়েছে চল্লিশটি ভাষায়। সমালোচকদের ভাষায় অরুন্ধতী রায় ভারতীয় সমাজের তথাকথিত মূল্যবোধের বিরোধী এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।India’s most anti National writer’. তাঁর লেখায় সামন্ত ভারতের ছবি, জাতপাতের ছবি, সাম্প্রদায়িক ভারতের ছবি উঠে আসে। ২০১০ সালে অরুন্ধতী রায়ের নামে ‘রাজদ্রোহ’- এর মামলা হয়। কারণ তিনি সে সময় বলেছিলেন, ‘কাশ্মীর ভারতের অংশ নয়’। যদিও পরে তিনি আত্মরক্ষার্থে বলেন, ‘’আমি কাশ্মীরের নির্যাতিত মানুষের কথা ভেবে বলেছিলাম। রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের উপর যে ধরণের চাপ তৈরি করতে চাইছে তার প্রতিবাদ করতে চেয়েছি।‘’   
১০ নভেম্বর শীত শুরুর সন্ধ্যায় কলকাতা শহরের সব থেকে পুরনো অভিজাত পাঁচতারা ক্লাবের খোলা মাঠে অনুষ্ঠান হচ্ছিল। কোনওরকম দ্বিধাদ্বন্দ না রেখেই বলা যায় ইংরেজি সাহিত্য পড়া অভিজাত পাঠকমণ্ডলীর সামনে অরুন্ধতী বলতে শুরু করলেন। প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন লেখক এবং সেদিনের সঞ্চালক সন্দীপ রায়। লেখিকা তাঁর বই The God of Small Things থেকে একটি পরিচ্ছেদ আমাদের জন্য পড়ে শোনালেন। তিনি লিখেছেন, বাংলায় তর্জমা করলে যেটা হয়, কিছুক্ষণ আগে সূর্য অস্তমিত হয়েছে কিন্তু সূর্যের আলো এখনও থেকে গেছে। এই বর্ণনা শোনার পর আমাদের আর অপেক্ষা করতে হয় না। লেখিকা তাঁর স্বমহিমায় নিজস্ব স্বকীয়তায় হাজির হলেন। সঞ্চালক সন্দীপ রায়ের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন, ‘’হ্যাঁ ভারতে জাতপাত একটা বড় বিষয়। আমি কেরলে বড় হয়েছি। এই প্রগতিশীল রাজ্যে আজও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র রয়ে গেছে। ‘টাচেবল’- মানুষের দল ‘আনটাচেবল’ সমাজ ব্যবস্থা কায়েম রেখেছে। আমি শুধু কেরলের কথা বলছি না। উত্তর বিশ্বায়ন ভারতে এই সমস্যা বর্তমান ‘সিস্টেম’-এও খুব জটিল।‘’
সন্দীপ রায় জানতে চেয়েছিলেন বামপন্থীদের বিষয়েঅরুন্ধতী বললেন, ‘’কোনটা বামপন্থা বলবেন? কোনটা সামাজিক গণতন্ত্র বলবেন? কেরল রাজ্যে গণতন্ত্র মেনেই পাঁচ বছর অন্তর সরকার পরিবর্তন হয়। আবার দেখুন পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর বামপন্থীরা সরকার চালাল। এটা কী করে সম্ভব?’’ হুতোম গাছ থেকে আমাকে বলল, ‘শুনলি কিন্তু কিছু লিখবি না। লিখলে আবার ‘ভাঁড়’ শুনতে হবে। এই রাজ্যে বামপন্থীদের সমালোচনা করিস না। ওরা  ‘হুকোমুখো হ্যাংলা’ পেটুক, হাকিম কবরেজ বলবে। তুই কোনও পার্টিতে গেলে তোর খাওয়ার ছবি তুলে রাখে যে ‘বাবু মশায়’-রা।’ হুতোমের কথা শুনলাম, কিন্তু উত্তর দিলাম না।    
আলোচ্য লেখিকা মনে করেন ভারতের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতর পরিবর্তন শুরু হয়েছে ১৯৯৮ সালে। পোখরানে পরমাণু বোমা পরীক্ষার পর। তিনি মনে করেন ভারত এর পরেই আরও জাতীয়তাবাদী হয়ে উঠছে। অনেকটা সংগ্রামপ্রিয় দেশপ্রেমিকেরমতো। তিনি সেই সময়ের একটি লেখায় লেখেন, ‘What wonderful, willing, well-behaved, gullible subjects.’  তিনি তাঁরThe End of Imagination’ নিবন্ধে আরও লেখেন,’We have turned out to be.’’
ভারতের দক্ষিণপশ্চিম রাজ্য কেরালাকে তাঁর লেখা আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের বিচরণভূমি করেছেন আলোচ্য লেখিকাকারণ তিনি বড় হয়েছেন কেরালার সিরিয়ান-খ্রীস্টান সম্প্রদায় পরিবারে। তাঁর আসল নাম সুজানা অরুন্ধতী রায়। এই সম্প্রদায় কেরালার মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। একটি সাক্ষাৎকারে অরুন্ধুতী বলেছেন, ’Kerala is home to four of the world’s great religious: Hinduism, Islam. Christianity, and Marxism.’’ 
 তাঁর সাক্ষর আমরা পাই এদিনের উপন্যাসের আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে। নিজের স্বাক্ষর নিজের ভাষায় তিনি উল্লেখ করেন। নারী বিষয়ক উপন্যাস, গল্প, ছোট গল্প রবীন্দ্রনাথ সহ একাধিক বাংলা এবং ভারতীয় ভাষার মরমী লেখকদের লেখায় পাওয়া যায়। আলোড়নকারী গ্রন্থ ফরাসি সাহিত্যিক সিমোন দ্য বোভোয়ারের ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’। ভারতীয় লেখিকা অরিন্ধতী রায় নিজের লেখা উপন্যাসে শুধুমাত্র ‘নারী’ শব্দে সীমাবদ্ধ থাকেননি। কাশ্মীরের প্রসঙ্গ বারে বারে ঘুরে ফিরে আসছিল একটি মুসলিম মহিলার চরিত্রকে কেন্দ্র করে। ইংরেজিতে বলছিলেন। অত্যন্ত সহজ এবং সাবলীলভাবে। তাঁর দ্বিতীয় বইThe Ministry of Utmost Happiness’ উপন্যাস, প্রথম উপন্যাস The God of Small Things  লেখার ২০ বছরে পরে এই বই লেখেন অরুন্ধতী। এই উপন্যাস প্রসঙ্গে পুস্তক সমালোচকরা বলছেন বিপ্লব দাশগুপ্ত নামে একজন বুদ্ধিদীপ্ত এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভারতীয় আমলার চরিত্র আছে। তিনি কোন একটি প্রসঙ্গে বলছেন, ‘I feel a rush of anger’ আর এখান থেকেই এদিনের মতবিনিময় সভায় প্রশ্ন ছুটে আস্তে থাকল কলকাতার অভিজাত ক্লাবের খোলা আকাশের নীচের প্যাভিলিয়নের মাঠ থেকে‘মি-টু’ আন্দোলন থেকে ‘শবরীমালা’। বিভিন্ন বিষয়ে। ভারতে ‘মি-টু’ আন্দোলনকে অরুন্ধতী মনে করেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে অবশ্যই ‘বিপ্লব’ নয়। আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল। ছদ্মবেশী পিতৃতন্ত্রের মুখোশ খুলে পড়ছে।
শবরীমালা বিষয়ে তাঁর অভিমত ভারতে লোকসভা ভোটের আগে বিষয়টাকে চাগিয়ে তোলা হচ্ছে। ১৯৫০ সালে যে বিষয়টা ছিল আদালতের রায়ের পরে ভারতীয় গণতন্ত্রে এই বিষয়টা নিয়ে আবার নতুন করে হৈ চৈ করার কি থাকতে পারে?
তিনি যত না লেখেন তার থেকে অনেক বেশি আলোচনায় থাকেন রাজনৈতিক সমাজকর্মী হিসেবে। মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট রাজ্যে তার সামাজিক কাজের ক্ষেত্র। নাগরিক সমাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েই তিনি কাজ করতে চান। চলতি বছরের নভেম্বর মাসের কলকাতা সফরে অরুন্ধতী এদিনের আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়  উল্লেখ করেছেন। বিঞ্জান এবং তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সারা বিশ্বে মানবসম্পদ উদ্বৃত্ত হয়ে পড়ছে। এই উদ্বৃত্ত মানবসম্পদ ভবিষ্যতে সারা বিশ্বে জটিল সমস্যা ডেকে আনতে পারে। যেটাতে আমাদের এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে। বুকার পুরষ্কারজয়ী লেখিকা ২০১৫ সালে ভারতে অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে নিজের ‘জাতীয় পুরস্কার’ ফিরিয়ে দিয়েছেন। ১০ নভেম্বর কলকাতায় একগুছ কর্মসূচী ছিল তাঁর। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর হাওড়ার টিকিয়া পাড়ার ‘সামারিটান হেল্প মিশন’- এর ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটান তিনি এবং বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছেন। বালিগঞ্জের ‘হোপ স্কুল’-এ অনুন্নতশ্রেণীভুক্ত ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গেও তিনি সময় কাটান। অরুন্ধতী হাওড়া এবং বালিগঞ্জের দুটি অনুষ্ঠানের পরে সাংবাদিকদের বলেন, ‘No one ever said a particular writer was a social activist because that’s what writers did. They used to write about the society in which they lived. Writers were jailed, writers were killed.’’