Thursday 27 September 2018

রাজনীতির সৌজন্য সৌজন্যের রাজনীতি


দীপেন্দু চৌধুরী
পুজোর বাজার শুরু হয়ে গেছে। বাজার সরগরম। একদিনের দুপুবেলা। গোলপার্কের লাইব্রেরি যাচ্ছি। গড়িয়াহাটের একজন হকার দ্বিতীয় এক হকারকে বলছেন, ‘’এই মহাজাগতিক ঢপ মারিস না।‘’ বিষয়টা কী ছিল বলতে পারব না। তবে ভদ্রলোকের কথাটা আমার ভালো লেগেছে তাই মনেও রেখেছি। ঢপ আমরা সবাই মারি। জাগতিক মহাজাগতিক ঢপ কি হতে পারে অনুসন্ধান না করে বলা সম্ভব নয়। আমার এক বন্ধুর ভায়ের মেয়ে বছর কয়েক আগে একটা অনুষ্ঠান বাড়িতে দুপুরের নেমন্ত্রণ খেতে গেছে। তখন বাচ্চা মেয়েটির বয়স হবে তিন থেকে চার বছরওর থেকে কিছুটা বড় কয়েকজন ছেলেমেয়ে সেই বাড়ির খাটের তলায় রেখে দেওয়া ‘চাটনি’-র গামলা টেনে নিয়ে সবাই মিলে হাতা দিয়ে একটু একটু করে খাচ্ছিল। আমার বন্ধুর ভাইয়ের স্ত্রী দেখতে পেয়ে ছুটে গিয়ে ওদের এসব করতে নিষেধ করেন। নিজের মেয়েকে জিগ্যেস করে, ‘’পৃথা তুমি এসব কী করছ? পৃথা উত্তর দিয়েছিল, ‘’মা আমি ঝাড়ি করছি। ঝাড়ি করে খাচ্ছি।‘’ বন্ধুর ভায়ের স্ত্রীয়ের কাছে শোনা। ভদ্রমহিলা আমাকে বলেন, ‘’দাদা আমি ভেতরে ভেতরে হাসছি। কিন্তু ওদের সামনে ছদ্ম গাম্ভীর্য বজায় রেখে উত্তর দিতে হয়েছিল, আচ্ছা ঠিক আছে। এবার সবাই চল খেয়ে নেবে। পরে মেয়েকে বলেছিলাম পৃথা এইসব শব্দ বা কথা বলতে নেই। মেয়ে উত্তরে বলেছিল ‘দিদি’-দের কথা তুমি আমাকে শুনতে বলেছ। এর পরে কী বলব আমি বলুনতো?’’
বিষয়গুলি কতটা সামাজিক হলে আমাদের শুনতে হয়। অথবা কতটা অসামাজিক হলে আমাদের দূরত্ব রাখতে হয়। সম্প্রতি আমদের শহরের একটি পাড়ার চায়ের দোকানের মালিক, বয়স আনুমানিক ৩৫ বছর। দোকানে উপস্থিত বিভিন্ন বয়সের খদ্দেরদের বলছে, ‘না ওই ছেলেগুলো আর আসে না। আমি ওদের বলেছি যতক্ষণ বাজে আড্ডা মারবি সেই সময়টা বাড়িতে বাবা-মায়ের পা টিপে দিবি। বলুন কিছু খারাপ বলেছি?‘’
আমাদের বিষয়টিও উল্লেখিত তিনটে বিষয়ের খুব কিছু উর্ধে নয়। আমাদের দেশে গত দু’তিন দশক রাজনীতি নামক কঠিন এবং বিষম এক বিষয়ে ‘সৌজন্য’ কতটা আছে? বিরোধী দলের সঙ্গে সরকার পক্ষের ‘সৌজন্য’ অথবা উল্টোদিকে সরকার পক্ষের লোকেরা নিজেদের কতটা সামনে এগিয়ে আনতে পারেন বিরোধী দলের সঙ্গে ‘সৌজন্য’ মূলক আলাপচারিতায়? সম্প্রতি আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে দু’জন (উত্তর বঙ্গের রায়গঞ্জে) ছাত্রের পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর প্রতিবাদে একটি ১২ ঘণ্টার বাংলা বনধ হয়ে গেল। বনধ ডেকেছিল কোন দল? বিজেপি। বাংলা বন্ধের মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। উত্তরবঙ্গের বনধের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের বন্ধের দিন (২৬ সেপ্টেম্বর)-এর প্রভাবের ফারাক কিছুটা নজরে পড়েছে। কিন্তু আমাদের এই বিষয়ের সঙ্গে একদিনের ‘বনধ’ খাপ খায় কী? হ্যা সাযুজ্য আছে। কারণ এটাও সৌজন্যের রাজনীতি এবং রাজনীতির সৌজন্যের মধ্যে পরে। গত সাত বছরে বামপন্থীদের অবস্থা সারা ভারতে উল্লেখ করার মতো তেমন কিছু নেই। বিষয়টা আমরা কলাম লিখিয়ে এবং নিরপেক্ষ, নির্ভীক সাংবাদিকের দল বলছি তথাকথিত বামপন্থীদের কয়েকজন নেতার যদিও আমাদের মতামতের কোন মূল্য নেই। তাঁদের নাক এতটাই উঁচু। যে কেউ সমালোচনা করলে ‘উগ্র হিন্দু’ বলে দেগে দিতে তাঁদের সময় লাগে না। অথবা ‘পাগলা বাবা’ এবং ক্যামেরাম্যান সময়ের মানদণ্ডে বর্তমান সময়ে প্রতিটি সাংবাদিক, লেখককে ক্যামেরাম্যন হতে হয়। যে সামাজিক কর্পোরেট ব্যবস্থা দু’দশক আগে থেকে শুরু হয়েছে। তিনি বা তাঁরা এসব খবর রাখতেন না।
ভারত তথা বাংলার বামপন্থীদের দায়িত্বের কথা আমাদের মত অখ্যাত কলমচির দল বলছি এমনটা নয়। প্রখ্যাত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ তথা সমাজবিঞ্জানী অমর্ত্য সেন সম্প্রতি একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে আবার বলেছেন। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন বামপন্থীদের ঐতিহাসিকভাবেই গতিশীল সমাজের দায়িত্ব নিতে হবে।  
গত সাত বছর আমাদের বাংলায় পরিস্থিতি সব থেকে জটিল। কংগ্রেসের রাজনৈতিক মূল্যবোধ এবং ৩৪ বছরের শাসক সিপিএম তথা বামফ্রন্টের ঘরানায় রাজনীতি শেখা দল তৃণমূলকংগ্রেস বর্তমানে রাজ্যের শাসকদলরাজ্যের উন্নয়নের স্বার্থে এবং শিল্পপতিদের আস্থা যোগাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনধ রাজনীতির বিরোধী। যে কারণে তিনি ইতালির মিলান শহর থেকে বাংলা বনধের প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘’বনধের বন্ধ্যা রাজনীতি বাংলার মানুষ বন্ধ করে দিয়েছেন। আমি তাঁদের কাছে কৃতঞ্জ।‘’ বামফ্রন্টের আমলে মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে কোনও বনধের বিরোধিতা করেছেন। বাংলার উন্নয়নের প্রশ্নে। বিজেপি নিজেদের দলের কর্মীসমর্থকদের চাগাতে লোকসভা ভোটের আগে দু’জন ছাত্রের মৃত্যুকে বিষয় করে ‘বাংলা বনধ’ ডেকে বাংলার মানুষের অবস্থান জেনে নিতে চেয়েছিলরাজনীতির পরিভাষায় তাৎক্ষনিক প্রতিক্রিয়া দেখা মানে গাঁধিজী বা লেনিনের কথায় মানুষের কাছে যাও। তাঁদের রায় নাও এবং তত্বে প্রয়োগ কর। বিজেপি বাংলার মানুষের রায় বুঝে নিতে চাইল। সামনে লোকসভা ভোট। বিজেপির টার্গেট ২২ জন সাংসদকে নির্বাচিত করে দিল্লি পাঠানো। পরে আসছে ২০২১ বিধানসভা ভোট। তত্বের প্রস্তুতির মঞ্চে বিজেপি কাদের সাহায্য নিয়ে থাকে? তাঁদের দলের মেরুদন্ড ‘আরএসএস’ নামক একটি শক্তিশালী সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। যাঁদের সাহায্য ছাড়া ‘বিজেপি’ দলটি মুখ থুবড়ে পড়বে।
২৬ সেপ্টেম্বর বিজেপির ডাকা বাংলা বনধ সফল বলা যাবে না। তবে শাসক তৃণমূল দলকে তথা প্রশাসনকে  একটা ধাক্কা দিতে পেরেছে বলেই বিশেষঞ্জদের মত। বিজেপি বনধের দিনটা বেছে নিয়েছিল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলকংগ্রেসের অন্যতম মেরুদন্ড মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপস্থিতির দিন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১২ দিনের বিদেশ সফরে। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি জার্মানী গেছেন পরে ইতালি। ঠিক এই সময়ে রাজনীতির সৌজন্যে বিজেপি এই সময়টাকে বেছে নিয়েছে। বিজেপির ডাকা বনধের দিন বামপন্থী দলগুলি রাস্তায় ছিল বনধকে সমর্থন না করেও। দু’জন ছাত্রের মৃত্যুর প্রতিবাদে সৌজন্যের রাজনীতিকে গুরুত্ব দিতে তারমানে আমাদের ধরে নিতে হবে সিপিএম, প্রদেশ কংগ্রেস এবং বিজেপি তৃণমূল কংগ্রেসকে নয়। আসলে আমি কি ডরাই সখি রাখবে? আমি এবং আমরা ডরাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। নেত্রী এবং প্রশাসক হিসেবে। কারণ মমতার প্রত্যুৎপন্ন রাজনীতি তথা সৌজন্যের রাজনীতির অন্যতম উদাহারণ। চলতি বছরের ১৬ জুলাই মেদিনীপুর শহরের কলেজ কলেজিয়েট মাঠে নরেন্দ্র মোদীর জনসভায় ছাউনি ভেঙে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। সেই ঘটনায় কয়েকজন বিজেপি সমর্থক আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তাঁর দলের আহতদের দেখতে যাবেন এটাই রাজনীতির সৌজন্য। সমাজবিঞ্জান এই দাবি করে। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ওইদিনের দুর্ঘটনায় আহতদের হাসপাতালে দেখতে গেলেন। পাশাপাশি আহতদের নিজের ত্রাণ তহবিল থেকে আর্থিক সাহায্যও করলেন। এটাকে কি বলা যায়? রাজনীতির সৌজন্য না সৌজন্যের রাজনীতি?   
আবার এটাও মানতে হবে গত সাত বছরে তৃণমূল প্রশাসনের মন্ত্রীরা অনেক পরিণত। তুলনামূলকভাবে অনেক শান্ত, ধীরস্থীর। অনেক কৌশলী। এটার অন্যতম উদাহারণ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুপস্থিতে তাঁর গড়ে দেওয়া ‘মন্ত্রিগোষ্ঠী’-র মাঝেরহাট সেতু ভেঙে পড়া এবং বাংলা বনধের মতো দু’টি বড় ঘটনাকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা। কয়েকজন নেতা মন্ত্রীর প্রথম দিকের নতুন ক্ষমতা পাওয়ার ছদ্ম অহংকার এবং তথাকথিত ‘আবেগ’ কেটেছে। কাটছে। এটাই দক্ষতার লক্ষণ। তাঁদের কর্মীসমর্থদের মধ্যে একটা তথাকথিত ঔদ্ধত্য এসেছে। সেই কারণে সমাজে একটা রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিসর তৈরি হচ্ছে। অত্যন্ত জনপ্রিয় গণমাধ্যম ‘সোশ্যাল মিডিয়ায়’ সুযোগ পেলেই বয়সে বড় মানুষকে হেয় করা। অপমান করা। অকারণে ‘তুই’- ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করা। তৃণমূল সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে তথাকথিত এক ছাত্রনেতা (আদৌ তৃণমূলের লোক কি সে?), একজন কাঠের মাথা তথকথিত কবি, (সে এখনও আছে। দলে থাকলেও সেও কি তৃণমূল করে?) এই গোষ্ঠীর উদ্যোগে সৎ, নিরপেক্ষ সাংবাদিক, লেখকদের ‘ভাম’ বলে দেগে দেওয়া হত। মহাকরণ, নবান্ন, প্রেসক্লাব, তৃণমূল ভবনে সুযোগ পেলেই অপমান করা হত। ‘তুই’ বলে প্রকাশ্যে অপমান করা হয়েছে।  ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশের কয়েকদিন পরে ‘বাংলা অ্যাকাদেমী’তে আমাকে নোংরা অপমান করার চেষ্টা হয়েছিল। সম্ভব হয়নি অ্যাকাদেমির আধিকারিকদের সৌজন্যে। আমাকে অপমান করার পেছনে ছিল ওই কাঠের মাথা কবি। যে বালখিল্যসুলভ আচরণ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। আমি সেদিন বাংলা অ্যাকাদেমির সভাপতি শাওলী মিত্রের একটি সাক্ষাৎকার আনতে গিয়েছিলাম। যে সাক্ষাৎকারটি পরে বাংলা নাটকে পাঁচজন নারীর অবদান নিয়ে আমার একটি লেখায় প্রকাশ হয়। লেখাটি রাজ্য সরকারের ‘পশ্চিমবঙ্গ’ পত্রিকার ‘সিঙ্গুর’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে
পঞ্চায়েত, পুরসভা এলাকায় মানুষ বামপন্থীদের অনুপস্থিতিতে নতুন পরিসর খুঁজছে। তৃণমূল কংগ্রেস দলে এবং সরকারে এত বেশি ‘পপুলিস্ট রাজনীতি’-র চর্চা হচ্ছে অনেকে বামফ্রন্টের শেষ দশকের সঙ্গে তুলনা করছে। গত ১৫ অগস্ট কলকাতা প্রেস ক্লাবের মধ্যহ্নভোজের অনুষ্ঠানে কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত প্রবীণ সাংবাদিক বিষয়টা নিয়ে চর্চা করছিল। তাঁরা প্রত্যেকে ব্যক্তিগতভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রশাসক হিসাবে নম্বর দিলেও তাঁর দলের ‘পপুলিস্ট রাজনীতি’-র বিষয়ে সন্দিহান। আমি সেদিন যুক্তি দিয়েছিলাম কিছু নেতা মন্ত্রী ‘পপুলিস্ট রাজনীতি’ থেকে বেরিয়ে আস্তে চাইছে। আমার বলা কথার সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায় পরিবহনমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর শিশুসুলভ রাজনীতির পর্ব পার হয়ে আসা। উত্তর নন্দীগ্রাম এবং জঙ্গলমহল আন্দোলনের সময় যে আবেগ তাড়িত রাজনীতির চর্চা তিনি করেছেন তাঁর খেসারত তাঁকে জাতীয় এবং স্থানীয় ক্ষেত্রে দিতে হয়েছে। বনধের দিন ২৬ সেপ্টেম্বর ইসলামপুর শহরে জনসভা করলেও মৃত দু’ই ছাত্রের বাড়িতে যাননি। আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এটাকেও রাজনীতির সৌজন্যের মধ্যেই দেখতে হবে। ২৬ সেপ্টেম্বরের সভা থেকে তৃণমূলের যুবনেতা বলেন, ‘’নিহত রাজেশ সরকার ও তাপস বর্মণের পরিবার যে ধরণের ক্ষতিপূরণ বা সাহায্য চাইবেন, তাই নিয়েই তাঁদের পাশে দাঁড়াব। দাড়িভিটের ঘটনায় পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হবে। হত্যাকারীদের শাস্তি হোক।‘’ পরিবহণমন্ত্রী আরও বলেন, ‘’কয়েক দিনের মধ্যেই রাজেশ এবং তাপসের বাড়িতে যাব। তাঁদের দাবি দাওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করব।‘’ সংবাদ মাধ্যম সূত্রে খবর রাজ্য সরকার দু’ই ছাত্রের মৃত্যুর তদন্তভার সিআইডির হাতে তুলে দিল।
‘’দাড়িভিট তদন্তের দায়িত্ব নিল রাজ্য সিআইডি। বৃহস্পতিবারই রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবের নির্দেশে, ছাত্র মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত জেলা পুলিশের কাছ থেকে সিআইডিকে দেওয়া হয়।
জেলা পুলিশ উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরে দাড়িভিট উচ্চবিদ্যালয়ে দুই ছাত্রের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশের সঙ্গে ছাত্র এবং গ্রামবাসীদের সংঘর্ষের পৃথক মামলায় জেলা পুলিশ কয়েক জনকে গ্রেফতার করলেও এখনও কোনও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করতে পারেনি’’ (সূত্রঃআনন্দবাজার ডিজিটাল)
আলিঙ্গনের রাজনীতি এবং সৌজন্য
আমাদের দেশে লোকসভার বর্ষাকালীন অধিবেশন চলাকালীন কংগ্রেস সভাপতি তথা সাংসদ রাহুল গাঁধি অনাস্থা প্রস্তাবের উপর একটি আগুন ঝরানো বক্তব্য রাখেন। এর পরের ঘটনাটির জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। বক্তৃতার পরে রাহুল গাঁধি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদীর সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। যে ব্যবহারের জন্য পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসক নরেন্দ্র মোদী প্রস্তুত ছিলেন না। ২০ জুলাই সংসদে বক্তৃতার শেষে রাহুল বলেন, ‘’আপনাদের অন্তরে আমার প্রতি ঘৃণা থাকতে পারে। আপনারা আমাকে পাপ্পু বলে হাস্যস্পদ করতে পারেন, গালি দিতে পারেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার অন্তরে আপনাদের প্রতি একটুও রাগ বা ঘৃণা নেই! প্রধানন্ত্রীর বিরুদ্ধেও কোনও বিদ্বেষ নেই। আমি এক এক করে আপনাদের অন্তর থেকেও ভালবাসা বার করে আনব।‘’ রাহুল গাঁধির এই আচরণ নিয়ে তর্ক বিতর্ক যতই হোক বা থাক এটা ইতিহাসে চলে যাবে। কারণ আমরা ভারতীয়রা নমস্কার বিনিময়, আলিঙ্গন করা এইসব সংস্কৃতিকে রাজনীতির ময়দানে দেখতে অভ্যস্ত নই। এটা ভারতীয় সংস্কৃতির সৌজন্যমূলক আচরণের মধ্যে পড়ে। যেমন পূর্ব ভারতের দুর্গা পূজোর পর বিজয়া উপলক্ষে নমস্কার করা এবং কোলাকুলি করে আলিঙ্গন করা। ঈদের পরেও এই সংস্কৃতি আমরা দেখেছি। জাতি, বর্ণ, সম্প্রদায়, ধনী, নির্ধন কোনও ভেদাভেদ না রেখে ‘কোলাকুলি’ সংস্কৃতি আমাদের সামাজিক সনাতন সম্পর্ককে আরও অটুট রাখে।  যদিও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংসদে দাঁড়িয়ে রাহুলের প্রতুৎপন্ন সামাজিক সংস্কৃতিকে শ্লেষ করতে ছাড়েননি। ২০ জুলাই সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, ‘’কুর্সিতে বসার এত তাড়া, প্রধানমন্ত্রীর কাছে এসে উঠে বলেন, উঠে দাঁড়াও! উনি জানেন না, এই কুর্সিতে বসতে যোগ্যতা লাগে। দেড়শো কোটি ভারতবাসীর আশীর্বাদ লাগে।‘’
বিষয়টা এখানেই থামল না। রাহুল গাঁধির নেতৃত্বে কংগ্রেস আর্থিক প্রতারণায় অভিযুক্ত শিল্পপতিদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে ধারাবাহিক আক্রমণ করে যাচ্ছে। ২৯ জুলাই লখনউ বিনিয়োগ কারীদের একটি সম্মেলনকে বেছে নিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। তিনি বলেন, ‘’দেশের উন্নতিতে অংশ নেওয়া শিল্পপতিদের পাশে দাঁড়াতে আমি ভয় পাই না। কারণ আমার অভিপ্রায় সৎ।‘’ প্রধানমন্ত্রী সেদিন আরও বলেন, গাঁধিজীর উদ্দেশ্য স্পষ্ট ছিল। তাই তিনি বিড়লাদের বাড়িতে থাকতেও দ্বিধা করেননি। যদি তোমার উদ্দেশ্য ভাল ও সৎ হয়, তা হলে যে কারও সঙ্গে ছবি তুলতেই পার। এতে চরিত্রে কোনও দাগ পরে না।‘’
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উত্তরের প্রতিক্রিয়া পেলাম দু’জন ইতিহাসবিদের কাছ থেকে। আমরা সংবাদ মাধ্যম মারফৎ তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানতে পারলাম। সাংসদ-ইতিহসবিদ সুগত বসু বলেন, ‘’আশা করি উনি নিজেকে মহাত্মা গাঁধি ভাবতে শুরু করেননি। উনি নিদেনপক্ষে দীনদয়াল উপাধ্যায়ও নন। বিড়লা সম্বন্ধে সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু তিনি দেশ ছেড়ে পালাননি।‘’
ইতিহাসবিদ দীপেশ চক্রবর্তী বলেন, ‘’বিড়লা গাঁধিকে টাকা দিতেন। গাঁধি বছরশেষে পাইপয়সার হিসেব দিতেন। মোদী শিল্পপতিদের থেকে কত টাকা নেন, সেই হিসেব যদি তিনি জানান, তা হলে অসুবিধা ছিল না।‘’ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করলাম বর্তমানে ভারতীয় রাজনীতিতে ফরাসি যুদ্ধবিমান ‘রাফেল’ নিয়ে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি রাজনৈতিক সৌজন্য বজায় রেখেই একটার পর একটা আক্রমণ করে চলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। আজ সিপিএম পলিটব্যুরো এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তাঁদের দাবি ফরাসি সংস্থা ‘দাসো অ্যাভিয়েশন’-এর রাফাল বিমান সংক্রান্ত যে চুক্তি হয়েছে সেই বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) গঠন করতে হবে। রাফাল নিয়ে বিতর্ক এমন একটা উচ্চতায় পৌঁছেছে বাধ্য হয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ বিবৃতি দিয়েছেন। কংগ্রেস সভাপতি সেই বিবৃতিকে লুফে নিয়ে নতুন ভাষায় নতুন করে আক্রমণ শুরু করেছেন। এই বিষয়টাকে কি বলা যায়? রাজনৈতিক অথবা কূটনৈতিক সৌজন্যের বাধ্যবাধকতা?
রাজনীতির সৌজন্য এবং সৌজন্যের রাজনীতিকে প্রসঙ্গ করে কয়েকশো পাতার একটা বই লেখা যায়। ইতিহাস থেকে সংগ্রহ করে এই বই গবেষকরা লিখতে পারেন। উন্নত গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকা, গ্রেট ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া সহ ইউরোপের অতীত এবং বর্তমান রাষ্ট্রনায়কদের নাম এবং তাঁদের কাজের তথ্যসাবুদের ঘটনা উল্লেখ করে এই বই লেখা যায়। আমাদের দেশেও মহাত্মা গাঁধি, পণ্ডিত নেহরু, নেতাজী সুভাষ বোস, জ্যোতির্ময় বসু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, অটলবিহারী বাজপেয়ী, মনমোহন সিংহ, সনিয়া গাঁধি সহ একাধিক প্রথমসারির রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আলোচ্য বিষয়ে একটি প্রামাণ্য দলিল লিখে ফেলা যায়। তরুণ প্রজন্মের নেতাদের কাছে আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের সৌজন্যের রাজনীতি এবং সংস্কৃতি আশা করলে কি খুব ভুল কিছু প্রত্যাশা করা হবে? শ্যামধারীদের বাড়িতে বাঁশের সরু বাতা দিয়ে বাঁধানো ক্যালেন্ডারে ‘সত্যমেব জয়তু’ লেখা এক সভ্যতায় আমার দেশ দেখা হয়েছিল। শ্যামধারীকেও আমি ‘আপনি’ সম্বোধন করে আলিঙ্গন করেছিলাম। কোলাকুলি করেছিলাম। ওদের বাড়িতে আমার গাঁধির দেশ দেখা হয়েছিল। আজ বলি আমি এবং আমরা ‘সত্যমেব জয়তে’-র দেশে সাংবিধানিক সৌজন্য সকলের থেকে আশা করি।          

Wednesday 19 September 2018

আপনারা ঘুমতে যান, আমরা শুল্কযুদ্ধে...... পরমাণু বোমার আর ভয় নেই


দীপেন্দু চৌধুরী  
প্রায় চারমাস আগের কথা। একটা নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সঙ্গীত, সাহিত্য, খেলা, বাণিজ্য, শুল্কবাণিজ্য, প্রতিরক্ষা এবং কূটনীতির এক নতুন বাতায়নের ভাষা আমরা পেয়েছি। সম্মিলিত ঐকতানের আশায় ‘প্রাচ্য-পাশ্চাত্য’-র অতিথিপরায়ণ মানুষ দুই দেশের আঙিনায় বিনিময়ের নতুন ঘরানায় অবগাহন করতে চাইছি। কূটনীতির এই নতুন ঘরানাকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম বিশ্ববাণিজ্য ও বিশ্ব রাজনীতির আঙিনায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছে। অভিঞ্জ পাঠক, নাগরিক সমাজ সচেতন মানুষ আশা করি বুঝতে পারছেন আমরা কোন দেশের কথা বলছি। এবং কাদের কথা বলছি।
দীর্ঘ টানাপড়েনের পরে সিঙ্গাপুরে অভিজাত সভাঘরে বিশ্বের পরমাণু শক্তিধর দুই নেতার প্রস্তাবিত বৈঠকটি ১২ জুন, ২০১৮ তে হয় বৈঠকের কুশীলব ছিলেন বিশ্বের তাবড় সংবাদ মাধ্যমে বহু আলোচিত শব্দবন্ধ ‘বেঁটে রকেটম্যান’ আর ‘খ্যাপাটে বুড়ো’। ‘খ্যাপাটে বুড়ো’ মানে বিশ্বের সব চেয়ে শক্তিধর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর ‘বেঁটে রকেটম্যান’ কে নিশ্চয় বলে দিতে হবে না। তবু নামটা উল্লেখ করি। উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন। ক্যাপিলা হোটেলে বৈঠকের আগে বা পরে বিশ্বের কাছে পরিচিত ‘স্মল রেড ডেট’ নামে পরিচিত সিঙ্গাপুরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বা উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্টকে কেউ ‘কালো পতাকা’ দেখায়নি। এই লক্ষণের অন্যতম কারণ সিঙ্গাপুর সহ সমস্ত বিশ্বের শান্তিপ্রিয় নাগরিক কেউ ‘পরমাণু যুদ্ধ’ চায় না। ২০১৮ সালের সংবাদ মাধ্যমের সোজন্যে প্রথম সারির এবং চিরকালের বড় খবর হয়ে থাকবে ‘মোটা আর খ্যাপাটে’ বুড়োর এই ঐতিহাসিক বৈঠক। একুশ শতাব্দীর এক নয়া অধ্যায়। প্রায় সাত দশক পরে জুন মাসের হাই প্রোফাইল ওই বৈঠকের সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ দাবি তুলেছিলেন ১২ জুন সিঙ্গাপুর সরকার ছুটি ঘোষণা করুক। বিশ্ব শান্তি প্রয়াস দিবস উপলক্ষে। বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমের প্রায় ১২০০ প্রতিনিধির সামনে এবং আড়ালে এই বৈঠক হয়েছে। সব থেকে বেশি আলোচিত চলতি বছরের ১১ জুন দুই পরমাণু শক্তিধর দেশের দু’ই রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য ব্যবস্থাও ছিল ঢালাও। সূত্রের খবর সিঙ্গাপুর সরকার কিম এবং তাঁর পারিষদদের হোটেল খরচ সহ আরও বিভিন্ন খাতে প্রায় দুকোটি টাকা খরচ করেছে। সেসময় সিঙ্গাপুরের সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন উঠেছিল এই খরচ করে সিঙ্গাপুর কী পাবে?মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন জি-৭ বৈঠকের টাটকা উত্তেজনা সঙ্গে নিয়ে। হাত মেলাতে গিয়ে বয়সে ছোট ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরঁ-এর হাতে প্রায় কালশিটে ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। বিশ্বের সবথেকে শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। কিন্তু এসব কিছুর উত্তেজনা সেদিন উবে গিয়েছিল। কিমের পরশ ট্রাম্পকে নতুন উত্তেজনা দিয়েছিল। ‘বেঁটে  রকেটম্যান’-ও নিজের আবেগ চেপে রাখতে পারেননি। বৈঠক শুরুর আগেই ‘মোটা আর খ্যাপাটে’ বুড়োর হাতে হাত রেখে উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন বলেছিলেন, ‘’গোটা দুনিয়ার কাছে এই মুহূর্ত নির্ঘাত কল্পবিঞ্জানের মতো মনে হচ্ছে। কিন্তু এটাই বাস্তব।‘’
কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রথম শ্রেণীর দৈনিক ১৩ জুন লিখল
·         পারস্পরিক শান্তি ও সমৃদ্ধি, নতুন সম্পর্ক স্থাপনের অঙ্গিকার
·         কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি রক্ষায় একজোটে কাজের প্রতিশ্রুতি
·         পারমাণবিক অস্ত্র ছাড়ার প্রতিশ্রুতি উত্তর কোরিয়ার। বিনিময়ে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবে আমেরিকা।
·         উত্তর কোরিয়ায় নিহত মার্কিন যোদ্ধাদের দেহাবশেষ আমেরিকায় ফেরানো হবে।
বয়সে প্রায় দ্বিগুণ ট্রাম্প সাহেবকে সম্মান জানাতে ১২ জুন ৩৪ বছরের কিম বৈঠক শুরুর মিনিট সাতেক আগে ক্যাপিলায় পৌঁছে গিয়েছিলেন। কূটনৈতিক ভদ্রতা বলুন অথবা একটা আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশের উন্নত শিক্ষা সংস্কৃতি। সকাল ৯টা। বৈঠকে কী হতে পারে তাঁর একটা আগাম বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলে পরমাণু শক্তিধর দু’ই রাষ্ট্রনেতা। সমস্ত বিশ্ব একটা ‘ট্রেলার’ দেখে। ১২ সেকেন্ডের করমর্দন। কয়েকটি কথা। এরপর হাসিমুখে লাইব্রেরি লাগোয়া প্রাইভেট চেম্বারের দিকে হাঁটতে দেখা যায় দু’জনকে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজের মেজাজে বলেছিলেন ‘’এক মিনিটে বুঝে যাব কিম কী চান।‘’ কিন্তু সময়ের বিচারে বৈঠক হল ৫ ঘণ্টা ৮ মিনিট। দু’ই রাষ্ট্রপ্রধানের একান্ত বৈঠক ৩৮ মিনিটের। দু’ই দেশের সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে চুক্তি বৈঠক আরও সাড়ে ৪ ঘণ্টা। এবং পরমাণু অস্ত্র সহ একাধিক বিষয়ে চুক্তিও হয়ে গেল দু’ই দেশের। যৌথ বিবৃতিতে সই করলেন ট্রাম্প এবং কিম। সইয়ের পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বললেন, ‘’সারা জীবন তো চুক্তি করেই এসেছি। তাই জানি, কে কখন কী চুক্তি চায়।‘’
কিম বলেছিলেন, ‘’চ্যালেঞ্জ আসবে সেটা বুঝছি। তবু আশা রাখছি, বৈঠক নিয়ে যাদের সন্দেহ আছে, অচিরেই তা মিটে যাবে।‘’
নিউ ইয়র্ক টাইমস ১২ জুন অনলাইন সংস্করণে প্রতিবেদক Mark Landler লিখলেন,
He also repeated his determination to keep imposing sanctions on the North until it abandons nuclear weapons. But he confirmed that China, the North’s largest trading partner, had eased a clampdown on cross-border trade in recent weeks — a reversal he attributed partly to the trade tensions between China and the United States.
Still, the president said he did not plan to return to bellicose threats like “fire and fury,” which fueled tensions last year and helped drive South Korea to seek a diplomatic overture to the North.
Appearing to accept the views of his predecessors, as well as most of his own military commanders, Mr. Trump said he could not imagine a war in a country where the largest city, Seoul, is only 35 miles from the border where the conflict would likely erupt.
For Mr. Trump, averting such massive bloodshed justified the risk of meeting with Mr. Kim. He bridled at critics who said he had elevated a brutal dictator by agreeing to meet, and had extracted little in return.
“If I have to say I’m sitting on a stage with Chairman Kim and that gets us to save 30 million lives — it could be more than that — I’m willing to sit on the stage,” Mr. Trump said. “I’m willing to travel to Singapore.”
Still, as ever, the president hedged his bets.
“I think, honestly, I think he’s going to do these things,” Mr. Trump said. “I may be wrong. I mean, I may stand before you in six months and say ‘Hey, I was wrong.’ I don’t know that I’ll ever admit that, but I’ll find some kind of excuse.”
David E. Sanger contributed reporting from Singapore, and Choe Sang-Hun from Seoul, South Korea.’’ 
এই চুক্তির পরেও চারমাস অতিক্রান্ত। কিন্তু উত্তর কোরিয়া এবং মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের মধ্যে চুক্তির পরের অধ্যায় কী হচ্ছে বা কী হতে যাচ্ছে সে বিষয়ে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ আমরা আজও অন্ধকারে। রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট উডরো উইলসন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লয়েড জর্জ নিজেদের কূটনৈতিক দ্বন্দ মেটাতে শান্তি আলোচনায় বসেন। কিন্তু সেই আলোচনা ব্যর্থ হয়। শুরু হয় নতুন বিশ্বের ভারসাম্য। তথা দ্বিতীয় বিশ্বের মঞ্চ। সোভিয়েত ইউনিয়নের দুর্দান্ড প্রতাপ শাসক জোসেফ স্তালিন এবং আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান নিজেদের দ্বন্দকে একটি ঠান্ডাযুদ্ধের ‘কূটনীতি’ হিসাবে দেখতেন। তারই ফলস্বরূপ আমাদের সামনে এল পরমাণুযুদ্ধের ভয়াবহ ছবি। দু’ই শক্তিশালী দেশের পরবর্তী দু’ই রাষ্ট্রনায়ক নিকিতা ক্রুশ্চেভ এবং জন এফ কেনেডি বিশ্বকে পরমাণু যুদ্ধের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। যাকে বলা হয় ব্রিঙ্ক অফ নিউক্লিয়ার ওয়ার। Brink of nuclear war. যুদ্ধ। পরমাণু যুদ্ধ। জাপানের হিরোশিমার অভিঞ্জতা বিশ্বের প্রথম সারির আর্থিক এবং পরমাণু  প্রযুক্তিতে বলিয়ান শক্তিধর রাষ্ট্রের মানুষ আজও ভোলেনি। রাষ্ট্রপ্রধানরা আরও বেশি ইতিহাস সচেতন তাই তাদেরও ভোলার কথা নয়।
এই প্রসঙ্গে আমরা উল্লেখ করতে পারি ভারত এবং মার্কিন পরমাণু চুক্তির কথা। ভারতের সঙ্গে ২০০৫ সালে  পরমাণু চুক্তি হওয়ার পরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বলেন, ‘’২০০৫-এর যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে মার্কিন দেশ এই প্রথম প্রচ্ছন্নভাবে হলেও ভারতের নিউক্লিয়ার বোমার প্রকল্পটিকে মান্যতা দিয়েছে। এ ছাড়াও মার্কিন দেশের জনমত এই প্রথম মেনে নিল যে নিউক্লিয়ার গবেষণা ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ভারত একটি অগ্রগণ্য দেশ, এবং সে দেশ দায়িত্ব নিয়ে এগুলির সুরক্ষা দিচ্ছে; তাই পৃথিবীর অন্যান্য নিউক্লিয়ার শক্তিধর দেশ যেসব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, ভারতেরও সেই সব সুযোগসুবিধা পাওয়া উচিত।...... এই ১২৩ চুক্তি করার সময় আমরা আমাদের দেশের বর্তমান ও সুদূর ভবিষ্যতের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনার বিষয়টি সর্বদা মাথায় রেখেছি— এটাও খেয়াল রেখেছি যে এটা যেন আমাদের ‘নিউক্লিয়ার ডকট্রিন’-এর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ হয়।...’’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ প্রবাদ প্রতিম দেশ। আধুনিক শিল্প এবং প্রযুক্তির প্রতীক বলা চলে। এই দেশেও একটা সময় আদৌ শিল্প সম্ভব কিনা সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। উন্নত গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকা। সেই দেশ উচ্চশিক্ষা, ধ্রুপদী সংস্কৃতির এক মহান তীর্থ ক্ষেত্র।     
পরমাণু যুদ্ধের আতঙ্ক কী এবং কতটা হতে পারে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে অনেকটা বোঝা যায়। তাই আমরা সচেতন ভাবেই এই প্রশ্ন তুলতে চাইছি।  প্রমাণ অতীতের পরমাণু যুদ্ধের যে আতঙ্ক আমাদের সামনে রয়েছে। জাপানের মানুষের সঙ্গে সহমর্মিতা ভাগ করে নিয়েই বলতে চাই বর্তমানে আমরা আরও বেশি আতঙ্কিত ‘শুল্ক যুদ্ধে’-এর ঠান্ডা লড়াই নিয়ে। একমেরু পৃথিবী এক সময় দু’টো মেরুর বুদ্ধির যুদ্ধ অথবা ঠান্ডাযুদ্ধ দেখেছে। বর্তমান বিশ্ব দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বহুমুখী পৃথিবীর দিকে। আমরা অতীত পার হয়ে এসে পড়েছি পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ বনাম সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ উত্তর বিশ্বে। বিশ্বায়ন উত্তর নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় সীমান্ত বাণিজ্য বনাম ‘শুল্ক যুদ্ধ’। জাতীয় স্বাধীনতা অবশ্য সব কিছুর উর্ধে কথা বলতে এগিয়ে আসে। যে কোনও দেশের মুক্তচিন্তা এবং স্বাধীনতার স্বাদ আমাদের স্বাধীন হতে শিখিয়েছে।      
এই নিবন্ধ লেখার খুব কিছু প্রয়োজন বা গুরুত্ব দাবি করে কী? হ্যাঁ করে। কারণ চলতি বছরের ১২ জুন ‘মোটা এবং খ্যাপাটে বুড়ো’-র সঙ্গে ‘বেঁটে রকেটম্যানের চুক্তির পরে আরও একটা নতুন যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সেই যুদ্ধ হচ্ছে ‘শুল্ক যুদ্ধ’। পরিবর্তনশীল সমাজে তথা আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় ধনতন্ত্র বনাম সমাজতন্ত্র শিবিরের একটা যুদ্ধ ছিল। কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু সমাজতন্ত্র শিবির পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অত্যন্ত সন্তর্পণে সমাজতন্ত্রের পতাকা হাতে নিজেদের দেশের আর্থসামাজিক মান একটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছে। যদিও এই দেশটির সামজতন্ত্র নিয়ে বিভিন্ন মত উঠে আসছে। কারণ বামপন্থী মতাদর্শের চিরন্তন সত্য মানব কল্যাণ। মার্ক্সের সমাজ বিঞ্জান সেই দাবি করে। মার্ক্সের প্রঞ্জাও উল্লেখিত সত্যের জন্য মানব কল্যাণের ব্রতের কথা শোনায়। বর্তমান ধনী সমাজতান্ত্রিক দেশ, যেমন চিন নিজের দেশকে ‘কূটির শিল্প’-এর উন্নত দেশ হিসাবে বিশ্বের স্বীকৃতি আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের চোখে চোখ রাখতে শুরু করেছে। চিনের শ্রমিকের ঘামের বিনিময়ে তৈরি সস্তার পণ্য সারা বিশ্বের ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছিল। স্বল্প পারিশ্রমিকে চিনা শ্রমিকের ঘামের বিনিময়ে তৈরি দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত সামগ্রী সারা বিশ্বের বাজারে ছেয়ে গেছে। চিনের শ্রমিকের ঘামে সস্তার সামগ্রী চিনের অর্থনীতিকে আজ স্বাবলম্বী করেছে।  আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া মহাদেশে চিনের বর্তমান সরকার নিজেদের দেশের পণ্য ছড়িয়ে দিতে আরও এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়েছে। ‘ওবর প্রকল্প’ বলি অথবা ‘ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট’। যদিও চিনের বামপন্থী মতাদর্শের পাশাপাশি আরও একটি অসংগঠিত আধুনিক বামপন্থী চিন্তার কথা শোনা যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই নতুন কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। নতুন জীবনবোধ গড়ে তোলার জন্য নতুন বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে লড়াই করার মতো মতাদর্শ আজ বড় বেশি প্রয়োজন। বিষয়টা মার্ক্সবাদের আধুনিক পণ্ডিত বিদ্দজ্জনেরা ভাববেন।
আমরা নতুন বিশ্বের আলোচ্য শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ‘শুল্কযুদ্ধ’ নামক একটি বিষয়ে বেশি চিন্তিত। কারণ সমস্ত বিশ্বে বেকারি বাড়ছে, নিরক্ষ মানুষের সংখ্যা আমরা কতটা কমাতে পেরেছি? শিশু শ্রমিক ব্যবস্থা এখনও রয়ে গেল। মানব পাচারের মতো সভ্যতার এক অভিশাপ আমাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। নতুন করে ‘শুল্ক যুদ্ধ’ নামক একটি অস্ত্র আমাদের ভাবতে বলছে। এই বিষয়ে আলাদা একটা নিবন্ধ দাবি করছে। আমরা চেষ্টা করব নভেম্বরে আমেরিকার অন্তর্বর্তী নির্বাচনের আগে এই বিষয়ে একটি নিবন্ধ আলোচ্য স্তম্ভে পরিবেশন করার।                                            
                

Wednesday 12 September 2018

সীমান্ত ভাঙা নতুন সীমান্তের স্বপ্ন দেখা শতাব্দী?

 দীপেন্দু চৌধুরী 

অসমের নাগরিকপঞ্জি ৩০ জুলাই প্রকাশের পরে সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টা ক্রমশঃ ছোট হয়ে আসলেও আলোচনা, মতবিনিময় সভা, তর্কবিতর্ক কিন্তু চলছে। পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভ এবং পিপলস স্টাডি সার্কেল যৌথ উদোগে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮ যোগেশ মাইম মঞ্চে এই আলোচনা সভা ছিল। উল্লেখিত দু’টি সংস্থা গত দু’বছর যাবৎ রাজ্যের কলকাতা শহর সহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় সমাজ সচেতন সিনেমার প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করছে ছোট ছোট সিনেমা তথা তথ্যচিত্রের মাধ্যমে সামাজিক বিভিন্ন ইস্যুভিত্তিক আলোচনা সভার আয়োজন করে এই আলোচ্য গোষ্ঠীটি। কয়েকজন উচ্চ শিক্ষিত, সমাজ সচেতন তরুণতরুণী সামাজিক দায়িত্বের অবস্থান থেকে বর্তমানে ‘টক অব দ্যা টাউন’ হয়ে উঠছে বলা যায়। এই গোষ্ঠীর উদ্যোগেই আমরা দেখেছি একটি বস্তুনিষ্ঠ তথ্যচিত্র। ভারতের বিভিন্ন শহরে পরিচারিকাদের দৈনন্দিন জীবনের যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সেই বিষয়ের উপরে ছবি দেখেছি। যে বিষয়টি নিয়ে আমি আমার একটি ব্লগে লিখেছিওওই তথ্যচিত্রে যে পরিচারিকা ছবির মুখ্য চরিত্র ছিল তাঁর পরিচয় পত্র ছিল নাসেই প্রসঙ্গে আসে ‘আধার কার্ড’। অত্যন্ত মুনশিয়ানার সঙ্গে ছবিটিতে বক্তব্য হাজির করেছিলেন পরিচালক। সঙ্গে ছিল আলোচনা।
পরে আরও একটি ছবি আমরা দেখি। নকশাল বাড়ি আন্দোলনের প্রথম সারির প্রবাদ প্রতিম নেতা তথা সাংবাদিক, লেখক এবং স্বনামধন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় কবি সরোজ দত্তকে নিয়ে তৈরি করা হয়েছে ছবিটিসরোজ দত্তের বিতর্কিত মৃত্যু অথবা নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াকে বিষয় করে এধরণের ছবি গত চার-পাঁচ দশকে হয়েছে বলে মনে করতে পারছি না। ছবিটির নাম ছিল ‘সরোজ দত্ত অ্যান্ড হিজ টাইমস’, পরিচালনায় কস্তুরী এবং মিতালী। ছোট্ট একটা ওয়েবক্যাম ক্যামেরায় তোলা হয়েছে ছবিটি। অনেক অজানা তথ্য এই ছবিতে আমরা দেখতে পেয়েছি। কস্তুরী এবং মিতালীকে অভিনন্দন। সীমিত আর্থিক সহায়তায় স্বউচ্চারিত শব্দের নস্টালজিয়া, তথ্য, সংলাপ এবং প্রশ্ন তুলে দেওয়ার জন্য। আমরা অভিনন্দন জানাব কলকাতার জার্মান কনস্যুলেট জেনারেলকেও। সম্প্রতি কলকাতার ম্যাক্সম্যুলার ভবন ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছিল।      
৯ সেপ্টেম্বরের অনুষ্ঠানের বিষয়ে বলার আগে আমরা একটু প্রাককথন সেরে নিতে চাইছি। চলতি বছরের ৩০ জুলাই অসম নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পরে দেশবাসির উদ্বেগ ছিল বড় ধরণের কোনও গন্ডগোল হতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকার, অসম রাজ্যসরকার সহ উত্তর পূর্ব রাজ্যের সরকারগুলি সব রকমের নিরাপত্তার আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। সূত্রের খবর সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত সেনা বাহিনীকে যে কোনও পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে বলা আছে। অসম এবং প্রতিবেশী রাজ্য গুলিতে ২২০০০ আধাসেনা পাঠানো হয়েছে। প্রকাশিত খসড়া তালিকা থেকে আমরা জানতে পেরেছি মোট ৩ কোটি ২৯ লাখ ৯১ হাজার ৩৮৪ জন এনআরসিতে আবেদন করেছিলেন। নাম বাদ পড়েছে ৪০ লক্ষ ৭ হাজার ৭০৭ জনের। সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে কাদের নাম বাদ পড়েছে নাগরিকপঞ্জি কতৃপক্ষ জানাবে না। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসএমএসের মাধ্যমে অথবা অনলাইনে বা হেল্পলাইনে ফোন করে জেনে নেওয়া যাবে। কেউ মনে করলে সেবাকেন্দ্র থেকে জেনে নিতে পারবে।
৩০ জুলাই নাগরিকপঞ্জি প্রকাশ করে এনআরসি রেজিস্টার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া শৈলেশ বলেছিলেন, ‘’ আজ শুধু অসম নয়, দেশের পক্ষে ঐতিহাসিক দিন। এত বিরাট, জটিল প্রক্রিয়া আজ পর্যন্ত দেশ তো বটেই বিশ্বেও হয়নি১৯৫৫ ও ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইন ও নির্দেশিকা মেনে স্বচ্ছভাবে প্রক্রিয়া চলেছে। সাড়ে ৬ কোটি নথিপত্রের অনেক তদন্ত, যাচাই ক্রমাগত হয়ে চলেছে। ২০১৩ সাল থেকে শুরু। কেন্দ্র ও রাজ্যের করা পরিশ্রম, হাজেলা এবং তাঁর দল মিলিয়ে ৫০ হাজার কর্মী এই প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন। এটা খসড়া মাত্র। সকলে নিজের নাম ঢোকানো বা সংশোধনের পর্যাপ্ত সুযোগ পাবেন। যারা পাবেন না, তাঁদের সাহায্য করবে দফতর। সম্পূর্ণ ন্যায় বিচার পাবেন প্রত্যেক ভারতীয়।‘’
এদিনের অনুষ্ঠান মঞ্চে ‘আসামের নাগরিক পঞ্জির সাতকাহন’ বইটি ‘পিপলস স্টাডি সার্কেল’ এর তরুণ প্রকাশক দ্বৈপায়ন ব্যানার্জী লেখক দেবর্ষি দাসের হাতে তুলে দিয়ে বইটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘোষণা করেন। বইটির প্রচ্ছদে লেখা আছে ‘’আসামে নাগরিকপঞ্জি বা ‘এন আর সি’-র খসড়া বেরিয়েছে ৩০ জুলাই। ৪০ লক্ষ মানুষ নাগরিক তালিকাতে জায়গা পান নি। নাগরিকপঞ্জির পিছনের ইতিহাস কী? পূর্ববাংলা থেকে আসা আসামের প্রজন্মের সাথে ‘এন আর সি’-র দাবির কী সম্পর্ক? কোন রাজনীতি নাগরিক পঞ্জির পেছনে রয়েছে? ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে? ৪০ লক্ষ দেশহীন মানুষকে নিয়ে কী করা উচিৎ? প্রশ্ন অনেক। প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে পড়ুন এই ছোট বই।‘’
দেবর্ষি বলেন, ‘’আসামের নাগরিকপঞ্জির প্রাক ইতিহাস আছে। নাগরিকপঞ্জিকে কেন্দ্র করে একটা সেন্টিমেন্ট তৈরি হয়েছে। সেই ট্রাজিক দিকটা আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি আমার এই ছোট্ট বইয়ে। আমি বলতে চেয়েছি লড়াইটা অত্যন্ত মানবিক এবং স্পর্শকাতরতার।‘’ দেবর্ষি এর পরে নাগরিকপঞ্জির তৈরির ইতিহাস শোনান আমাদের। ভারতের স্বাধীনতা এবং ভারত ভাগের আগে থেকে অসম জাতি, উচ্চবর্ণ বাঙালি, উচ্চবর্ণ অহমজাতি, জনজাতি, বিহারের ছোট নাগপুর থেকে চা বাগানে কাজ করতে যাওয়া নতুন ‘চা-জাতি’।  এঁদের সম্পর্কে তিনি বলেন। আমি নিজে দেবর্ষির লেখা বইটি এখনও পড়ে উঠতে পারিনি। তাঁর বিষয়গুলি তিনি এদিন আলোচনায় আনলেন। ১৮৯০ সাল থেকে পূর্ববঙ্গ থেকে আসা ছোটচাষি, ভূমিহীন চাষিদের অসমে আসার কথা উল্লেখ করেন দেবর্ষি। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অসমের জনবিন্যাস বদলে যাওয়ার প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন।
দেবর্ষি মূলত পাঁচটা বিষয়ে আলোকপাত করতে চেয়েছেন তাঁর লেখা বইয়ে। ১) আসামের নাগরিকপঞ্জি মানে কী? ২) বিদেশী তাড়ানো নিয়ে গোলমাল কেন? ৩) আদৌ কি বিদেশী আছে? ৪) নাগরিকপঞ্জির অন্যায়ের বিষয়গুলি কী? ৫) বর্তমান অবস্থায় কী করতে হবে?
‘পিপলস স্টাডি সার্কল’ অসম নাগরিকপঞ্জি বিষয়ে ৬টি বই প্রকাশ করবে। সংস্থার আমন্ত্রণপত্র থেকে আমরা এই বিষয়টা জানতে পারি। আমন্ত্রণ পত্রে লেখা হয়েছে।              
‘’Dear Friends,

The People's Study Circle was formed in Kolkata in April 2017, as a group of individuals - alarmed by the rise and rise of fascism in the country - came together feeling the urgent need to create an accessible independent and non-partisan study space where activists and academics could converge to study the society with an interventionist approach but without losing the discipline and rigour that serious and in-depth study demands. 

The Study Circle successfully ran a monthly lecture series on Fascism, Nationalism and Religion for 8 months. After that, we began our Group Study sessions, held every 3 weeks, where we extensively read primary texts concerning communal polarisation, the migration issue, critical texts on the Hindutva iconography in Bengal and even went over some of the Rightwing texts and books.

We are happy to announce a series of six 'Little Books', to be published by the People's Study Circle over the next 3-4 months. The first two titles (on the NRC in Assam, and an appraisal of the myths around Shyamaprasad Mukherjee) are as follows. The Little Books are typically 40 pages long, cost Rs. 15 each, and are written in lucid, jargon-free, attractive styles, which we hope will appeal to one and all!

Please spread the word. Buy our books, place bulk orders, and also donate generously to our 'Little Books' publishing fund. We will fight the rightwing propaganda machine with all mediums at our disposal.’’

 আমাদের যে সময় চলে গেছে সেই সময়ের কথা নতুন করে ভাবেত বলছেন দেবর্ষি। তিনি আরও বলেন, ‘’আসাম জাতীয়তাবাদী একটি এনজিও ২০০৯ সালে একটি জনস্বার্থের মামলা করে। ২০১৪ সালে সেই মামলার রায় বের হয়। ২০১৮ সালে দ্বিতীয় খসড়া প্রকাশ হয়। ২ কোটি ৯০ লক্ষের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে। ৪০ লক্ষের নাম ওঠেনি। যাঁদের নাম ওঠেনি তাঁদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা সব থেকে বেশি। আমার নিজের বাড়ি কাছাড় অঞ্চলে। আমাকেও বার কয়েক ডেকে পাঠানো হয়েছে। আমি নিজের অঞ্চলে থেকে ক্ষেত্র সমীক্ষা করেছি।‘’

৪ জুলাই, ২০১৮ সালে অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘ফার্স্ট পোস্ট’- সংস্করণে সুশান্ত তালুকদার অসম নাগরিকপঞ্জির বিষয়ে একটি লেখা লেখেন, সেই লেখায় তিনি অসমের নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পরে মহিলাদের সমস্যার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন। তিনি লেখেন,

Sometimes, it can be the other way round and it turns out in the hearings that the three have ganged up together to deprive the fourth lone person who is the real descendant. As such, during the hearings that were held from February this year onwards, it was found that some persons who had already been included in the part draft were not the true descendants. The state coordinator, however, explained that all those 65,694 excluded due to family tree investigation would be able to appeal for reconsideration of their application or submit new documents for verification during the claims and objection after the publication of the complete draft.
When asked about the exclusion of 48,456 married women from the complete draft, who earlier were included in Part Draft, the NRC State Coordinator explains that at the time of publication of the part draft there was little time left for detail verification as directed by the Supreme Court on 5 December on the panchayat certificates submitted by married women.
Hence, based only on verification of authenticity by issuing authority and field verification results, names of some married women who had submitted such certificates were erroneously included by the field officers. However, the Supreme Court made it clear in the judgment dated 5 December 2017 that the certificates issued by the GP Secretary/Executive Magistrate will be acted upon only to establish a linkage between the holder of such certificate and the person(s) from whom a legacy is being claimed.
The apex court said in the judgement the certificate will be put to such limited use only if the contents of the certificate are found to be established on due and proper enquiry and verification.
Thorough verification of the panchayat certificates submitted by married women could not be taken up before publication of part draft and some such applicants were inadvertently included in the part draft. Exhaustive verification as directed by the Supreme Court was started only in April this year and in respect of these women it has been found that the contents of the certificates submitted to claim that she is the daughter of the person whose legacy data has been used were not established during the verification and therefore their linkages were rejected," Hajela says.
However, after the publication of the complete draft, they would be able to appeal during claim and objection process for re-verification of the certificates or submit additional authentic documents that prove their eligibility.’’ 
দেবর্ষি চিন্তিত শুধুমাত্র অসমের জনবিন্যাস বা উত্তরপূর্ব ভারতের জনসংখ্যা নিয়ে নয়। তিনি তাঁর ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে উঠে আসা যে ছবি তাঁর বইয়ে এঁকেছেন সেখান থেকে আরও বলেন, ‘’আসামে ৬টি বন্দিশিবির রয়েছে। যেগুলিকে ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’ বলা হচ্ছে। তালিকায় নাম নেই এমন কিছু মানুষকে এইসব বন্দিশিবিরে রাখা হয়েছে। আসামের ৬টি জেলকে বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যাদের নাম ৩১ ডিসেম্বরের পরেও উঠবে না তাঁদের দেশ থেকে চলে যেতে হবে না। ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’- এ রাখা হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে। এইসব নাগরিকদের ভোটের অধিকার থাকবে না। জমি কিনতে পারবে না। ‘ওয়ার্ক পারমিট’ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। অনেকটা মেক্সিকো থেকে আসা অবৈধ নাগরিকদের বিষয়ে আমেরিকা সরকার যেটা করে থাকে। ২০১৬ সালে ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনে সংযোজনী হিসাবে একটি বিল এনেছে এনডিএ সরকার। এই বিল পাশ হয়ে আইন হিসাবে আসলে আসামের নাগরিকপঞ্জিকে কেন্দ্র করে কী হতে পারে?’’
দেবর্ষি আগামী দিনের ভয়াবহ এক ছবির কথা আমাদের ভাবতে বলছেন। তবে তিনি এটাও বলছেন, ‘’সীমান্ত ভেঙে ফেলা যাবে। অথবা আমাদের প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে কোনও সীমান্ত থাকবে না। আমি এখনই আকাশকুসুম এই স্বপ্নবিলাসিতায় থাকতে চাইছি না। সেইদিনের কথা সুদূরপ্রসারি সময়ের অপেক্ষায় তুলে রাখা ভালো। তবে ভোট রাজনীতির জন্য গরিব এবং সাধারণ অশিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষের পাশে আমাদের থাকতেই হবে। সেখানে নির্দিষ্ট জাতি, ধর্ম বলে কিছু হয় না। হতে পারে না‘’
ভারতের বৈধ নাগরিক হিসাবে আমাদের এই কথা বলতে হবে অসমের ২০১৮ সালের নাগরিকপঞ্জি যেন আমাদের দেশে তথাকথিত এক অভিশপ্ত দিন ডেকে না আনে। সাধারণ মানুষ, ভারতের নাগরিক সমাজকে সামনে এগিয়ে আস্তে হবে। মানবিক সমাধান কী হতে পারে এটা ঠিক করতে। এখনও অনেকটা সময় আছে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে দেশের বিদ্বৎ সমাজ সেমিনার ডাকুক। বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আলোচনা হোক।  কেন্দ্রীয় সরকার আরও আলোচনায় যাক। লোকসভা, রাজ্যসভায় বিরোধীরা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করুক। সমাধান বেরিয়ে আসবেই। ভারতের মতো উন্নত গণতান্ত্রিক একটি দেশ মানবিক সমাধান ঠিক খুঁজে নিতে পারবে বলেই মনে হয়।                      
 

Tuesday 11 September 2018

সামাজিক তর্পণে বর্তমান সময়েও গাঁধীজী চিরন্তন




দীপেন্দু চৌধুরী
সালটা খুব সম্ভবত ১৯৭৬। আমরা স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। রাজনৈতিক সচেতনতা মাত্র ১৭-১৮ বছর বয়সে ততটা আসার কথা নয়। তবু কিছুটা ছিল। প্রেক্ষাপট অবশ্যই আমার বাবা, মা, দাদা সহ আমাদের পরিবার। আমাদের আত্মীয়স্বজনদের ‘কংগ্রেস’ পরিবারের সঙ্গে যোগসূত্র। এছাড়া ছিল আমার উপর আমার মায়ের ‘স্বদেশী আন্দোলন’-এর প্রভাব। এই ১৯৭৬ সালে আমার জীবনে তথা আমার সামাজিক জীবনে একটি বড় ঘটনা ঘটে যায়। সে বছর দুর্গাপূজোর সময় একাদশির দিন ‘শ্যামধারী’ নামে একজন ‘দলিত’ (বর্তমানে বিতর্কিত শব্দ) শ্রেণির মানুষ আমাদের বাড়িতে ‘সিঁদে’ নিতে আসে। গাঁধীজীর ভাষায় সেই সময় এই সমাজের  প্রান্তিক মানুষদের ‘হরিজন’ বলা হত।  অথবা তথাকথিত সমাজপ্রভুদের কাছে তপসিলি সম্প্রদায়ভুক্ত যেসব  মানুষরা ‘অচ্ছুৎ’  ছিলঅস্পৃশ্য ছিল তাঁদের অবস্থানকে ‘হরিজন’ হিসেবে লেখা হত। পরে হরিজন শব্দটির ব্যবহারও উঠে যায়। আমাদের প্রসঙ্গ ‘শ্যামধারী’। সে আমাদের ছোট্ট গঞ্জ শহরের বিভিন্ন পাড়ায় কাঁচা ড্রেন পরিষ্কার করত। প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ‘বর্জ’, মল, মূত্র পরিষ্কারের কাজ করতে হত শ্যমধারীকে। যে সব বাড়িতে খাঁটা পায়খানা ছিল সেইসব বাড়িতেও শ্যামধারী মল, মুত্র পরিষ্কারের কাজ করত। শ্যামধারীদের মত ‘মেথর’, ‘ডোম’ এঁরা একাদশী থেকে চতুর্দশী পর্যন্ত বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি ঘুরে ‘সিঁদে’ নিতে যেত।
সে বছরও আমাদের বাড়িতে তিনি এলেন। পড়নে ‘মার্কিন কাপড়’-এর নতুন কোরা ধুতি। লুঙ্গির মতো করে পড়েছেন তিনি। খালি গায়ে একটা নতুন সস্তার গামছা। খালি পা। হাতে একটা বাঁশের ঝুড়ি। তাতে ‘বাবু বাড়ি’ থেকে যে যা যা দেবে সে সব শ্যামধারীর ঝুড়িতে ফেলতে হবে। আমার মা-ও দিলেন। সিঁদুর লাগানো সুপারি,  চাল, আলু, নারকেল নাড়ু, খইয়ের নাড়ু, চিড়ের নাড়ু। এবং সিঁদুর লাগানো পাঁচটা টাকা সঙ্গে ধাগা সুতোর ধাগা সিঁদুর এবং হলুদ জলে চোবানো। শ্যামধারী দূর থেকে মাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন। আমি পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমাকেও প্রণাম করতে এলোশ্যামধারি আমার থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছরের বড়। আমি থামিয়ে দিয়ে প্রথমে নমস্কার পরে ‘কোলাকুলি’ করলাম। এবং আবার নমস্কার করলাম। শ্যামধারীর দু’চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। টপ টপ করে চোখের জল শিশির বিন্দুর মতো আমার পীঠে পড়ল। শ্যামধারী ওইদিনের পর থেকে আমাদের বাড়িতে আর কোনওদিন ড্রেন পরিষ্কার করতে আসেন নিওর ছেলে আসত। পরে আমি ওর সঙ্গে বহুবার কথা বলতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমাকে দেখলেই ছুটে পালিয়ে যেত। প্রচুর দেশীমদ খেত। চুল্লু খেত। সেই কারণে অনেকেই ওকে এড়িয়ে চলত। আমি সমাজকর্মী হিসেবে একবার শ্যামধারীর বাড়ি গিয়েছিলাম। হাসপাতালের মেথর বস্তিতে থাকত। সেই সময়ের এই সব বস্তির যেমন ছবি হয় সেরকমই ছিল। চারিদিকে নোংরা, শুয়োর, মুরগী ঘুরছে। নাকে পোটা ঝরা ছেলে মেয়ের দল উদোম গায়ে খেলা করছেকম আলোর খড়ের চাল দেওয়া ঘর। শ্যামধারী ছিল না। ওর বড় ছেলে ছিল। এখন নাম মনে নেই। আমাকে ঘরে নিয়ে গেল। ঘরের দেওয়ালে দেখলাম তিনটে ছবি। একটা শিবদুর্গা, একটা কালী আর অন্যটা মহাত্মা গাঁধীর। তিনটে ছবিই ক্যালেন্ডার কেটে বাঁশের সরু বাতা দিয়ে ঘরে বাঁধানো। মহাত্মা গাঁধীর ছবির নীচে বাংলায় লেখা ‘সত্যমেব জয়তু’। যদিও শ্যামধারিরা বিহারের লোক। আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারপ্রান্তিক সমাজের অ-জলচল সম্প্রদায়ের মানুষ ওরা। নিম্নবর্ণের মানুষ। পেটে চুল্লুর জল যতটা পাওয়া যাবে, তুলনায় পেটে ঘুষি মারলে একটা হিন্দি বা বাংলা শব্দ বেরবে না। তাতে ওদের কীই বা এসে যেত? তাই ক্যালন্ডারের ছবি বাঁশের সরু বাতা দিয়ে বাঁধিয়ে রেখেছে। মহাত্মাজীকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছে। এর থেকে আর বেশি কী করতে পারে? আমার সেদিন প্রথম ভারতদর্শন হয়ে যায়। গাঁধীজীর ভারতকে সেদিন প্রথম খুঁজে পাই আমার নিজের শহরে।
সেদিনের পর থেকে দু’টো গানের কয়েকটা কলি আবেগের সঙ্গে মনে মনে আবৃত্তি করি।  একটা ‘ধন ধান্যে পুস্পে ভরা/ আমাদের এই বসুন্ধরা/ তাহার মাঝে আছে যে এক/ সকল দেশের সেরা।’ দ্বিতীয় গানটা ‘ও আমার দেশের মাটি/ তোমার পরে ঠেকাই মাথা’। আজও দুটো গান কোনও শিল্পীর ভরাট গলায় শুনে নিজের আবেগ ধরে রাখতে পারি না। মন খোঁজে গাঁধীজীর গ্রাম। গাঁধীজির আটচালা, তাঁর সাধের চরকার আশ্রম।      
আজকে গাঁধীজীকে নিয়ে আমার সীমাবদ্ধ ঞ্জানে যে লেখাটা লিখতে চাইছি সঙ্গে এই অভিঞ্জতা না দিলে নিজেকে হয়ত ঠাকানো হবে। এই কারণে বিদগ্ধ পাঠকদের কাছে বিনীত অনুরোধএই অভিঞ্জতাকে কোনওরূপ আত্মপ্রচার হিসেবে ভাববেন না। গাঁধীজী নিজের আত্মকথায় লিখছেন, ‘’পৃথিবীতে কাহাকেও ঘৃণা করিতে অসমর্থ বলিয়া আমি নিজেকে মনে করি। বহু কালের প্রার্থনাময় ও সংযত জীবন যাপনের ফলে চল্লিশ বৎসরের বেশি হইল কাহাকেও ঘৃণা করা হইতে বিরত আছি। আমি জানি যে এই দাবি খুব বড় রকমের, তথাপি সবিনয়ে আমি এই দাবি করি। কিন্তু যেখানেই পাপ থাকুক আমি তাহা ঘৃণা করিতে পারি এবং করিও। ইংরেজরা ভারতবর্ষে যে- শাসনপ্রণালী চালাইতেছে তাহা আমি ঘৃণা করি। লক্ষ লক্ষ হিন্দু যে-কুৎসিত অস্পৃশ্যতা-রীতির জন্য নিজেদের দায়ী করিয়া রাখিয়াছে আমি অন্তরের অন্তস্থল হইতে তাহা যেমন ঘৃণা করি, ভারতের নির্মম শোষণকেও তেমনি ঘৃণা করি।‘’ ( পৃষ্ঠা- ৪৬, মানুষ আমার ভাই, সাহিত্য অকাদেমী, নিউ দিল্লি, শতবর্ষপূর্তি সংস্করণ, ২ অক্টোবর, ১৯৬৯)
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এবং গাঁধীজী
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন তথা কংগ্রেস নামক দলের ইতিহাসে সবচেয় গুরুত্ব দিতে হয় তিনজন প্রথম সারির ব্যক্তিকে। তিনজন ব্যক্তি ছিলেন মোহনদাস করমচাঁদ গাঁধী, জওহরলাল নেহরু এবং সুভাষচন্দ্র বসু। মা ডাকতেন- মনিয়া। বাবা বলতেন মনিসেই মনি বা মনিয়া হয়ে উঠলেন মহাত্মা, বন্দিত হলেন দেশের পিতা হিসেবে। বর্তমান একুশ শতাব্দীতেও তিনি সমান প্রাসঙ্গিক। নিঃসন্দেহে হিংসার প্রশ্নে তাঁর চিন্তাধারা আজও সমান প্রাসঙ্গিকনিম্নবর্ণের মানুষ আক্রান্ত হলেই জেনে হোক অথবা না জেনে তাঁর চিন্তাধারায় আশ্রয় খোঁজে। ওই অর্ধনগ্ন দেহের একজন মানুষের কাছে ছুটে ছুটে যায়। আমার এক স্কুলের শিক্ষক আমাকে বলেছিলেন, ‘ভেবে দেখেছিস কখনো? গাঁধীজী একজন ব্যারিস্টার মানুষ। যেমন তেমন ব্যারিস্টার নন। বিলেত থেকে পাশ করে আসা ব্যারিস্টার। সেই মানুষ, হেটো ধুতি পড়ে হাতে একটা লম্বা লাঠি নিয়ে দেশের এপ্রান্ত থেকে সে প্রান্ত ছুঁটে চলেছেন। কি করে সম্ভব? ভেবে দেখ।’ আমি সত্য সত্য আজও ভাবি। ভারতের আত্মা চিনে ছিলেন তিনি। আউল, বাউল, ফকির, সুফি, সাধুসন্ন্যাসীদের দেশ ভারতবর্ষ। তৎকালে দেশের নিম্নবর্ণের মানুষ বছরে একবার অথবা দু’বার জামা পড়তেন। বাড়িতে কোনও উৎসবে অথবা সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে। এই সংস্কৃতি তিনি আত্মস্থ করেছিলেন। শুধুমাত্র এই একটা কারণই নয়। নিজের লব্ধ ঞ্জানের উপলব্ধি ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলো বলেই মনে হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকার সময় তিনি অনুভব করেছিলেন খেটে খাওয়া মানুষের হ্রদয়ে পৌঁছতে গেলে তাঁদের নিজেদের লোক হতে হবে। তাঁদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠতে হবে। গাঁধীজীর রাজনীতিতে আবির্ভাব হয়েছিল গত শতব্দীর দ্বিতীয় দশকে। দক্ষিণ আফ্রিকার সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সযত্ন লালিত আপন চর্চা তাঁকে গণদেবতার আসনে বসিয়ে ছিলদক্ষিণ আফ্রিকার প্রেক্ষাপটটা কী ছিল? সেই দেশের নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস মূলত সেখানকার ব্যাবসায়ীরা নিজেদের দাবি সমূহ ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছে পেশ করত। নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেসের মাধ্যমে। এই ব্যাসায়ীরা অবশ্যই ছিলেন ভারতীয় এবং বিত্তবান। খেটে খাওয়া শ্রমিকশ্রেণীর এই সংগঠনের সদস্য হবার অধিকার ছিল না। সেই বিষয়টা গাঁধীজীকে ভাবিয়ে থাকতে পারে। তিনি ভারতে ফিরলেন এমন একটা সময়ে যখন কংগ্রেসের হাল ধরার মতো কেউ নেই। যে ব্যক্তি ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে দর কষাকষি করতে পারবে আবার দেশের স্বাধীনতার দাবি নিয়ে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবেন। এইরকম এক সন্ধিক্ষণে তিনি ভারতে এলেন আট বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় আন্দোলন করে ১৯১৬ সালে তিনি ভারতে এলেন। ভারতে একদিকে খিলাপৎপন্থীরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলছে। পাশাপাশি কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতার আওয়াজ উঠছে। দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট, ব্রিটিশপ্রভুর অত্যাচারে জর্জরিত ভারতীয়রা স্বাধীনতার দাবিতে উদ্বেল হয়ে উঠছে। ভারতের এই গণআন্দোলন গাঁধিজীর জন্য প্রেক্ষাপট তৈরি করেই রেখেছিল।
দক্ষিণ আফ্রিকার সীমিত এবং নিয়ন্ত্রিত গণআন্দোলনের অভিঞ্জতা ভারতের আন্দোলনে কাজে লাগাতে তিনি সচেস্ট হলেন। অভিঞ্জতা থাকলেই গণআন্দোলনের রাশ ধরা যায় না। প্রয়োজন হয়ে থাকে আরও কয়কটি বিষয়। এর মধ্যে অন্যতম উল্লেখিত নেতৃত্বের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির। যেটা গাঁধীজী সযত্নে গড়ে তুলেছিলেন। ফলে তিনি ভারতীয় রাজনীতিতে দ্রুত জায়গা করে নিলেন। পরিসর আগে থেকে তৈরিই ছিল। সঙ্গে তিনি যুক্ত করতে পারলেন নিজের সাধারণ অর্ধউলঙ্গ পোশাক, পায়ে খড়ম, আকর্ষনীয় সরল সাধারণ জীবনযাত্রা। এবং ভারতীয় প্রথম সারির ধর্মের সঙ্গে রাজনীতির মিশ্রণ ঘটাতে সহায়ক হয়ে উঠলেন তিনি। ধর্ম এবং রাজনীতির এই সমন্বয় তাঁকে সাধারণ মানুষের কাছে সহজেই গ্রহণ যোগ্য করে তুলল। ভারতের প্রান্তিক মানুষ, নিম্নবর্ণের মানুষ যাদের অচ্ছুৎ করে রেখেছিল সমাজের উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় শ্রেণী। গাঁধীজী তাঁদের কাছে ‘মিথ’ হয়ে গেলেন। ভারতের নিরন্ন, খেটে খাওয়া মানুষ মোহাবিষ্টের মতো তাঁর গড়ে তোলা আদর্শ, মঞ্চ, আন্দোলন, চরকা, আশ্রমে ভিড় জমাতে থাকলেন।
বিহারের চম্পারন এবং গুজরাটের খেদায় দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা কৃষক আন্দোলনের পাশে থেকে আন্দোলনের সাফল্য আনতে সাহায্য করলেন। এই দু’টি ঘটনা তাঁকে দেবত্বে উত্তীর্ণ করতে সফল হল। পরাধীন ভারত পেল তাঁর নেতা। এরপর আমরা পেলাম তাঁর সেই বিখ্যাত অসহযোগ আন্দোলন। ১৯২০-২১ এবং ১৯৩০-৩১ এর আইন অমান্য তথা অসহযোগ আন্দোলন কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো উথাল পাথাল রূপ নিয়েছিল। ঐতিহাসিকরা বলছেন ‘স্বরাজ’ নামক বৃহত্তর প্রেক্ষাপটের জন্য দেশ প্রস্তুত ছিল না। ভারতীয় বুর্জোয়াদের স্বার্থ দেখা এবং দেশের ধর্ম-বর্ণ সহ একাধিক সম্প্রদায়ের স্বার্থ দেখাটা প্রকৃত নেতার কাজ ছিল। সেই কারণে তিনি অনেক সময় দ্বিধায় ছিলেন। আন্দোলনের রাশ যাতে লাগাম ছাড়া না হয়ে যায় এই বিষয়টা সম্ভবত ব্যক্তি এবং ব্যরিস্টার মোহনদাসকে ভাবতে হয়েছিল। এই কারণেই কী তিনি ব্রিটিশ শাসনের মধ্যে থেকে ভারতীয়দের হাতে কিছু ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে ছিলেন? ১৯২১ সালের কংগ্রেস অধিবেশন, ১৯২৭ সালের মাদ্রাজে কংগ্রেসের অধিবেশন এবং ১৯২৮ সালের কলকাতা অধিবেশনেও তিনি পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন না। কিন্তু এক বছর পরে তিনি উপলব্ধি করছেন ভারতের গণজাগরণকে আর উপেক্ষা করা যাবে না। ১৯২৯ সালের লাহোর অধিবেশনে নিজেই পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করছেন। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ ভারত ছাড়ো আন্দলনের ডাক দেশের একমাত্র এবং অদ্বিতীয় নেতা মহাত্মা গাঁধী নিজেই দিচ্ছেন। অনাহার অনশন মানুষের বলে সভ্যতা জেনেছিল। তিনি সেটাকেই হাতিয়ার করে এগিয়ে আস্তে থাকলেন। অহিংসার সেই মহামন্ত্র বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বের মানুষের আন্দোলনের প্রধান অস্ত্র। সম্প্রতি আমেরিকার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন তাঁর আদর্শ হচ্ছেন তিনজন, মহাত্মা গাঁন্ধী, নেলসন ম্যান্ডেলা এবং মার্টিন লুথার কিং (জুনিয়ার)। মহাত্মা গাঁধীকে নিয়ে সারা বিশ্বে নতুন করে বিশ্লেষণ হচ্ছে। আলোচনা হচ্ছে। অবশ্যই নতুন করে মূল্যায়ণ প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে ভারতে গাঁধীজীর মতো গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তির আবারও প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সেই কারণে কী কংগ্রেস সভাপতি  রাহুল গাঁধী মানসরোবর থেকে ফিরে রাজঘাট গেলেন? কৈলাসে তীর্থ করতে গিয়ে নিয়ে আসা মানসরোবর হ্রদের জল রাজঘাটে গাঁধীজীর সমাধিতে অর্পণ করেন রাহুল। সঙ্গে নিয়ে এসেছেন কৈলাস যাত্রার পাথর। সেই পাথরও তিনি গাঁধীজীর সমাধিতে অর্পণ করেন। ভারতীয়দের বিশ্বাস কৈলাস যাত্রার পাথর কাউকে দেওয়া হলে তাঁরও কৈলাস সফরের সমান পুণ্যলাভ হয়।
বিজেপিও কী অনুভব করছে? কারণ সামনের বছর গাঁধীজীর সার্ধশতবর্ষ পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ইতিমধ্যে দু’টি সভা হয়ে গেছে। এটাও চরম সত্য যে ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট ভারতের স্বাধীনতার দিনে গাঁধীজীর অনশন আর গীতা পাঠের মধ্য দিয়ে দিন শুরু করেছিলেন। মনুবাহেন গাঁধী জানতে চেয়েছিলেন, এমন দিনে তিনি উপবাস কেন করছেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন পুণ্যদিনেই মানুষ উপবাস করে। কারণ তাতে শরীর সুস্থ থাকে। কেউ কেউ উল্লেখ করেন, না সেটা একমাত্র কারণ নয়। খুব সম্ভবত তিনি নীরবে প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলেন। তিনি দেশ ভাগ মেনে নিতে পারেননি। মহাত্মা গাঁধীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী নৃবিঞ্জানী নির্মলকুমার বসু খুব কাছ থেকে মহাত্মাকে দেখেছেন। গাঁন্ধী দর্শনকে উপলব্ধি করেছিলেন। একটি প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, ‘’.........১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে ঘটনা। তখন গান্ধীজী বেলিয়াঘাটায় রহিয়াছেন এবং স্থানীয় যুবকদের সঙ্গে বহু বিষয়ে দীর্ঘ তর্কবিতর্কের পর এই আশ্বাস লাভ করিয়াছেন যে, তাহারা স্থানীয় একটি বস্তি হইতে মুসলমানদের উৎখাত করিয়া দেওয়া সত্বেও এবার তাহাদের মধ্যে যাহারা পরিশ্রম করিয়া খায় (............) তাহাদিগকে ফিরাইয়া আনিবেন ও স্বাধীন ভারতের নাগরিক হিসাবে তাহাদের সহিত সুব্যবহার করিবেন। যাহারা গত এক বৎসর ধরিয়া সর্বতোভাবে পাকিস্তান কায়েম করিবার চেষ্টা করিয়াছিল, তাহাদিগকে সদব্যবহারের দ্বারা আনুগত্যশীল ভারতের নাগরিকে রূপান্তরিত করিবার চেষ্টা করিবেন।
এই প্রতিঞ্জা গান্ধীজী যুবকগণের নিকট ১৫ই অগাস্ট নাগাদ লাভ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে অগাস্টের শেষে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে কলিকাতায় আবার এক দাঙ্গার সূচনা হয় এবং গান্ধীজীর সম্মুখেই বোমার আঘাতে দুইজন পলায়মান মুসলমান প্রাণ হারায়। গান্ধীজী অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া উঠিলেন। পাঞ্জাবে তখন বিপুল দাঙ্গা চলিতেছে। আবার কলিকাতার দাঙ্গা যদি পূর্বাঞ্চলে ছড়াইয়া পড়ে তবে বিপদের অবধি থাকিবে না। সূচনাতেই এই আগুন কি ভাবে নিবানো যায় সে-বিষয়ে চিন্তা করিতে লাগিলেন।‘’
নির্মলকুমার সেই সময়ের ঘটমান ঘটনার এই বিষয়টি উল্লেখ করে থেমে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি থামেননি। তিনি ওই একই প্রবন্ধে আরও লিখছেন, ‘’ইতিমধ্যে বেলিয়াঘাটার যুবকের দল তাঁহার নিকটে এক নিবেদন করিলেন। অবশিষ্ট মুসলমানদিগকে তাঁহারা স্থানান্তরিত করিতে দিবেন না। তাঁহাদের মধ্যে দুই তিনজন গান্ধীজীর যুক্তির প্রতি অনাস্থাবশতঃ পলায়মান মুসলমানদের উপরে বোমা নিক্ষেপ করিয়াছিলেন, কিন্তু অধিকাংশই তাঁহার যুক্তি মানিয়া লইয়াছিলেন। তাঁহারা অবশিষ্ট বস্তিবাসীদের রক্ষার ভার লইবার সংকল্প করিয়াছেন। কিন্তু এই কাজ অস্ত্রের দ্বারা সাধন করিবেন। অহিংসা তাঁহারা জানেন না, বোঝেন না। অতএব তাঁহাদের প্রার্থনা, পুরানো মিলিটারি বন্দুক সমেত যদি পুলিশ তাহাদিগকে রাত্রে গ্রেপ্তার করে তবে গাধীজী যেন পুলিশকে বলিয়া তাঁহাদের ছাড়িয়া দেন।
এই বিচিত্র প্রার্থনা যখন গাধীজীর নিকটে পৌঁছাইল, তিনি মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া বলিলেন— ‘এঁদের বলিয়া দাও যে আমি সঙ্গে আছি।’ (উনকো কহ দো কি ম্যায় উনকে সাথ হুঁ)। আশ্চর্য হইয়া পরে যখন তাঁহাকে জিঞ্জাসা করিলাম, হিংসা বা অহিংসার তাহা হইলে সম্পর্ক কি? তিনি যাহা বলিলেন, তাহার মর্ম আপনাদের নিকট জানাইয়া আমার এই বক্তব্যের সমাপ্তি ঘটাইতেছি।
গাধীজী বলিলেন— ‘গভর্ণমেন্ট আজ প্রত্যেক নাগরিকের জীবন রক্ষা করিতে অসমর্থ হইয়াছেন। এরূপ অবস্থায় যুবকেরা যে সৎ উদ্দেশ্য লইয়া হিংসার ব্যবহার করিতেছেন, আমি নৈতিক বিচারে সেই উদ্দেশ্যকে সমর্থন করি। তাঁহারা অহিংসার কৌশল জানেন না। এ ক্ষেত্রে আমার দায়িত্ব হইল অহিংসার দ্বারা কি ভাবে রক্ষা সম্পাদন করা যায় তাহাই কার্যতর দেখাইতে হইবে, যতক্ষণ তাহা না পারিব ততক্ষণ যুবকদিগকে অপেক্ষা করিতে বলিতে পারি না, তাঁহারা স্বীয় ধর্ম অনুসারে আচরণ করিতে পারেন।’
নির্মলকুমার বসুর লেখা থেকে খুব পরিষ্কার হচ্ছে গাধীজী ‘স্বদেশ’ বলতে বুঝতেন আর্থসামাজিকভাবে উন্নত একটি রাষ্ট্রে সব ধর্ম, সব বর্ণ, সব জাতি এক সঙ্গে থাকবেন। সেটাকেই আধুনিক উন্নত গণতন্ত্র বলে। এই শিক্ষা, সংস্কৃতি তিনি যেমন সনাতন ভারতের গ্রাম সমাজ থেকে পেয়েছেন। পাশাপাশি শিল্প বিপ্লবের পরে ইউরোপের যে আলো ভারতে এসে আছড়ে পড়েছিল। যেটাকে আমরা উনবিংশ শতাব্দীর রেঁনেশা বলি। এই সময়ের একটু আগে পরে রাজা রামমোহন রায়, কালীপ্রসন্ন সিংহ, হেনরি লুই ডিরোজিও, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একঝাঁক বাঙালি তথা ভারতীয় দেশ গঠনের জন্য কাজ করে গেছেন। গুজরাটের ছোট্ট মনিয়াও (গাঁধীজীর মা ডাকতেন) একদিন ওইসব মনীষীদের পথ অনুসরণ করে মহাত্মা হয়ে উঠলেন।
বি কে ভার্মা তাঁর Modern Indian political system: problems and prospects বইয়ে লিখছেন ‘’.......On the other hand, as differentiated from modern western political thought, recent western political thought begins with Hegel and Marx. Roughly the period, is parallel to the period indicated by modern political thought in India. Rammohan Roy was the contemporary of Hegel; Dayananda was the contemporary of Marx. In the history of modern Indian political thought a well-defined, clearcut and precise distinction between recent and modern is not possible. There is a line of distinction, however, between the exponents of the renaissance in India and the builders of the theory of nationalism. Roughly we can say that Rammohan Roy is the key figure in modern Indian political thought. Mahatma Gandhi has been the greatest personality in the contemporary history of India. From Gandhi, we can trace the rise of recent political thought. The recent theorists of Hindu and Muslim communalism may be taken, in some senses, to belong, intelectually, to the early period of the religious reformation of India.’’        
মুনিয়াকে আমরা মহাত্মা বলে সম্বোধন করতে পারি কিন্তু এটাও সত্যি তিনিও মানুষ ছিলেন। গাঁধীর মতে অথবা তাঁর দর্শনে ব্যক্তির ভূমিকা সংগঠনের চেয়েও বড়। গাঁধি কোনও অবস্থাতেই একজন ব্যক্তিকে তাঁর ভূমিকা থেকে রেহাই দিতে চাননি। একজন ব্যক্তি থেকে সমষ্টিতে পৌঁছতে চেয়েছেন তিনি। একজন ব্যক্তির বিকাশ সম্ভব হলে তবেই সমষ্টির বিকাশ সম্ভব। আধুনিক গণতন্ত্রও সম্ভবত সেই আধার খোঁজে। আধুনিক ভারতের আধুনিক সংস্কৃতি, তথ্যপ্রযুক্তি, সামাজিক ভারসাম্যকে মান্যতা দিতে মুনিয়া বা মহাত্মা গাঁধীকে ভারতের খুব প্রয়োজন। আমরা অপেক্ষায় আছি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে তাঁর সার্ধশতবর্ষে গাঁধীজীর আধুনিক মননশীল বিশ্লেষণাত্বক লেখা দেখা এবং পড়ার জন্য। চলতি বছরের ২মে মোহনদাস গাঁধীর সার্ধ শতবার্ষিক উদযাপনের প্রস্তুতি বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। বৈঠকটি হয় রাষ্ট্রপতি ভবনে। প্রস্তুতি কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে প্রধানমন্ত্রী সব রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকেই বৈঠকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেনঅ-বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীদের অনেকে উপস্থিত না হলেও এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উপস্থিত ছিলেন। কংগ্রেসের তরফে বৈঠকে গিয়েছিলেন গুলাম নবি আজাদ প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘’গাঁধীর আদর্শকে দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া নিয়ে অনেকে আজ মতামত জানিয়েছেন। আমরা একটি আন্তর্জাতিক শান্তি সম্মেলন আয়োজনের প্রস্তাব দিয়েছি। পাশাপাশি জানিয়েছি, বছরটিকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বছর হিসাবে পালন করা হোক। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ নিজেও বলেছেন, গাঁধীজীর আদর্শ বজায় রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। গাঁধীর আদর্শ প্রচার করার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রীও।‘’
কংগ্রেস সূত্রে খবর সরকারি উদ্যোগে যেটা করছে করুক। তবে গাঁধীজী কোনও দলের বা একজন ব্যক্তির নয়। গাঁধীজী জাতির জনককংগ্রেস আলাদাভাবে গাঁধী সার্ধশতবর্ষ উদযাপনের কর্মসূচী নিচ্ছে। সম্প্রতি গাঁধী রচনাবলির প্রথম খন্ড পড়ছিলাম। আধুনিক ভারতের রূপকার পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর একটি লেখা পড়লাম। ইতিহাস বলছে পণ্ডিত নেহরু ছিলেন গাঁধীজীর সব থেকে কাছের মানুষতাই দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, দেশ গঠন প্রভৃতি বিষয়ে তাঁদের মধ্যে যেমন মতের মিল হয়েছে, সভ্যতার নিয়ম মেনে মতের অমিলও হয়েছে। তবু গাঁধীজী কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে মতিলাল নেহরুর সামনে ছেলে জওহরলালের নাম প্রস্তাব করেছেন কংগ্রেস অধিবেশনে। ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক থেকে প্রকাশিত মহাত্মা গাঁধীর আত্মজীবনীর প্রথম খন্ডে পণ্ডিত নেহরু লিখছেন,’We shall not think of him as an old man, but rather as one who represented with the vitality of spring the birth of a new India. To a younger generation who did not come in personal contact with him, he is a tradition, and numerous stories are woven round his name and activities. He was great in his life he is greater since he passed away.’’
‘’……….I write this in Darjeeling with the mighty Kinchinjunga looking down upon us. This morning I had a glimpse of Everest. It seemed to me that there was about Gandhiji something of the calm strength and the timelessness of Everest and Kinchinjunga.’’         
পরিশেষে বলা যায়, ইতিহাসবিদ, গাঁধী বিশেষঞ্জরা আগামীদিনে ব্যক্তি গাঁধী, পারিবারিক গাঁধী, সামাজিক গাঁধীর বিভিন্ন দিক উন্মোচন করবেন। সেইসব লেখায় ব্যক্তি গাঁধী এবং মহাত্মা গাঁধীর দ্বান্দিক বিকাশ, ব্যক্তি জীবনের সঙ্গে পারিবারিক জীবনের টানাপড়েন আরও বিস্তারিত সামনে আসবে। কয়েক দশকের তাঁর ব্যপক কর্মকান্ডের কতটা আর আমরা জানি?