Friday 10 June 2016

ভাঙ্গা-গড়ার সংস্কৃতি

আবার এ বছর ২০১৬ সালে সমস্ত জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ নামক দলটি সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যে দ্বিতীয়বারের জন্য সরকার গঠন করেছে। এই বিষয়টা কিছুটা পুরনো হয়ে গেছে। কাকতালীয় বিষয়টা হচ্ছে। ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ আসন সংখ্যার নিরিখে ২১১ তে এসে থামল। একটা সময় নয় অনেকগুলি বছরেরে যোগ-বিয়োগের ফসল ২০১৬ সাল। বিশেষত এই বাংলায়। কী রকম কাকতালিয় ঘটনা দেখুন। ২০১১ সালে বামফ্রন্টের ৩৪ বছরের জমানার অবসান হয়েছে। আবার ২০১৬ সালের ষোড়শ বিধানসভা নির্বাচনে ২১১ টি আসন পেল 'তৃণমূল কংগ্রেস'। 
 নির্বাচন চলাকালীন আমি নিয়মিত ‘নেট’ ব্যবহার করলেও মধ্যে কিছুদিন ‘নেট’ ব্যবহার করিনি। এই সময় সোশ্যাল মিডিয়ায় চাপানউতর  ভালোই চলেছে বলে মনে হয়।
ওই সময় তীব্র গরম ছিল। প্রখর তাপপ্রবাহ চলছে। আমরা যে বাড়িটায় ভাড়া থাকি, সেটা তিন তলা বাড়ি। আমরা তিন তলায় থাকি ‘আম-জাম’ আদমির মত প্যাঁচ পেঁচে গরম সহ্য করে থাকি। ছাদের কিছুটা অংশ ফাঁকা। মাথায় প্লাস্টিকের ছাউনি। ছাদের রেলিঙে কাক, শালিক, বুলবুলি, টুনটুনি পাখি এসে বসে। ছায়ায় বিশ্রাম নেয়। আবার চলে যায়। আমি ঘরের জানলা দিয়ে ওদের দেখি। মাস খানেক আগের কথা। দুটো শালিক জোড়া পায়ে হাটতে হাটতে জানলার কাছে এসে খুব চেচামেচি করল। জানলার পর্দা তোলা ছিল। আমার স্ত্রীকে বললাম, ‘’গরমে ওরা জল খেতে পারছে না। একটা পাত্রে ওদের জল দিয়ে দ্যাখতো। ওরা সম্ভবত জল চাইছে। সেদিন থেকে একটা প্লাস্টিকের ছোট বাটিতে ওদের পরিষ্কার জল দিচ্ছি। শালিক পাখি দুটি এখন শীস দেয়। জানলার পর্দা তোলা থাকলে জানলার কাছে এসে ঘাড় কাত করে অবুঝ ভাষায় আনন্দ প্রকাশ করে। কখনো কখনো আবার জোড়া পায়ে নাচে। ওরা আমার বন্ধু হয়ে গেছে। কিন্তু একদিন বিড়ম্বনায় পড়তে হল। ‘হুতোম’ সেদিন ছাদের রেলিঙ-এ বসে বলল, ‘’এবার আমাকে ভুলে যাবি নাতো?’’
আমি বললাম, ‘’না ভুলব কেন? ওরা জল চাইছিল। এই গরমে ওদের জল দিলাম।‘’
হুতোম বলল, ‘’এটা ভালো কাজ সবাই জানে। এতে ‘বাহবা’ কুড়োবার মতো কিছু হয়নি। যাই হোক এবার বল ভোটের ফল প্রকাশের পর তুই ইন্টারনেট ব্যবহার করলি না কেন?’’
আমি বললাম, ‘’সেটা আমার ব্যক্তিগত বিষয়। আমি সবাইকে বলব কেন?’’
হুতোম বলল, ‘’ঠিকই। তোকে বলতে হবে না। কিন্তু তুই ‘ফেসবুকে’ ‘ট্যুইটারে’ অনেক মেসেজ মিস করেছিস। আমার একটা মেসেজ খুব ভালো লেগেছে। কেউ একজন লিখেছিল, ’১২ কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে ‘বামপন্থী ভোটার’ করনি।‘’ আমি রবি ঠাকুরের ‘জীবনস্মৃতি’ পড়তে পড়তে হুতোমের কথা শুনছিলাম। বললাম, ‘’আমি এসবের মধ্যে নেই।‘’ মুখ তুলতেই দেখলাম হুতোম চলে গেছে। একটা কাক বাটির জল খেয়ে বাটিটা উলটে দিয়ে চলে গেল।
ভাঙ্গা গড়ার সংস্কৃতি কী একেই বলে? গণতন্ত্রে এটা হয়েই থাকে। ‘মসনদ সংস্কৃতি’র বয়ান আমরা চিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার উজ্জ্বল উদাহারণ। কিন্তু ভারত নামক একটি গণতান্ত্রিক দেশে ‘মসনদ সংস্কৃতি’ খুব বেশিদিন টেনে নিয়ে যাওয়া কি সম্ভব? ‘দলদাস সংস্কৃতি’ অথবা মধ্যমেধার সংস্কৃতি? ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্কৃতি বলে কী কিছু হয়? নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ নেত্রী বলেছিলেন, ‘’সাংস্কৃতিকভাবে আগে বাংলাকে এগিয়ে নিতে হবে। সঙ্গে থাকবে ছাত্র যুব।‘’ আর পরে কি বললেন তিনি? মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেওয়ার পরে তিনি বিধানসভায় বললেন, ‘’যাদের একজন সদস্য আছেন আমি তাদেরও অভিনন্দন জানাচ্ছি। বিধানসভায় আমরা অনেক প্রয়োজনীয় বিষয়ে আলোচনা করব।‘’ মুখ্যমন্ত্রী আরও বলেন, ‘’কটূক্তি, কুৎসা করবেন না, যাতে একে অপরের সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক হয়। যা হওয়ার হয়েছে। সুন্দর সীমারেখা রেখে সকলের বোঝাপড়া, ভালোবাসার মধ্য দিয়ে শুভ উদ্যোগের মধ্য দিয়ে নজির সৃষ্টি করতে হবে। যা পশ্চিমবঙ্গ, ভারতকে পথ দেখাবে।‘’ তিনি এরপরও থামেননি। গত পাঁচ বছরের অভিঞ্জতার মান দন্ডে বিরোধীদের কাছে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে  চেয়েছেন। দেশ নিয়ে যারা ভাবেন। রাজ্যের উন্নয়নের কথা যারা ভাবেন। সাংস্কৃতিক নেতৃত্বের কথা মনে রেখে তিনি আস্থার সঙ্গে বলেছেন, ‘’হয়তো বলে যাব। হয়তো হবে না। কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কী?’’ সময়ের পরম্পরায় কূটনীতি বাস্তবকে চিনে নিতে চায়। বাস্তব সব সময় সামগ্রীক স্বার্থের কথা বলে সম্ভবত। ইতিহাস যে তথ্য সযত্নে ভবিষ্যতে আমাদের সামনে চয়ন করে আনে।
২০১৬ হাটি হাটি পায়ে এই বাংলায় রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বাংলার মানুষ গণতন্ত্রকে কি ফিরিয়ে আনছে? গ্রাম বাংলার আটচালায়, উঠনে, নাগরিক সভ্যতার ‘বহুতল’ বাড়িগুলির গাড়ির শান বাঁধানো ঝা চক চকে চাতালে, দুর্গা মণ্ডপে কি নতুন মহালয়ার সুর বাংলার মানুষ শুনতে পাচ্ছে? এবার এই রাজ্যের বিধানসভার চালচিত্রটা দেখুন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ‘ওরে বিহান হল’ বলে বিধানসভায় বিরোধী আসনে বসল। ১৫ বছর পর। আনুপাতিক হারে ২০১৬ সালের ষোড়শ বিধানসভা নির্বাচনের পরে মুসলিম বিধয়কের সংখ্যা বেড়েছে। ২০১১ সালে মোট মুসলিম বিধায়ক সংখ্যা ছিল ৫৯ জন। ২০১৬ সালে তুলনামুলকভাবে অনেকটা বেড়েছে। এবারের বিধানসভায় তৃণমূল, বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের মিলিত মুসলিম বিধায়ক সংখ্যা সর্বমোট ৬১ জন। বামফ্রন্টকে নিয়ে ভারতীয় বামপন্থীদের যে চিন্তা ছিল, সেটার অনেকটা উত্তর মিলেছে। কমরেড সীতারাম ইয়েচুরির নেতৃত্বে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি দায়িত্ব নিয়েছিল বলেই হয়ত এই ছবি আমারা দেখতে পেলাম। রাজ্যের পোড় খাওয়া নেতা কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্রের নেতৃত্বে রাজ্য কমিটি নতুন পরিষদীয় নেতৃত্ব তুলে আনতে পেরেছেন। সময় বলবে এই নেতৃত্ব মানুষের জন্য, এই বাংলার জন্য কতটা দায়িত্ব নিতে পারছেন। পাশাপাশি বিজেপি তাঁদের দলের নতুন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে একের জায়গায় তিনজন বিধায়ক নিয়ে বিধানসভায় হাজির। গণতন্ত্রের সার্বিক বিতর্ক উপভোগ করার অপেক্ষায় বাংলার মানুষ। কিন্তু এরপরও বলতে হয় পঞ্চাশ বছরের পুরনো বামপন্থীদের ভূমিকা এবগ দায়িত্ব আর সকলের থেকে আজ এই রাজ্যে অনেক অনেক বেশী নয়? যেহেতু তাদরে অতীত ছায়া আমরা বয়ে বয়ে বেড়াচ্ছি।           
তথাকথিত একটা তীব্র সাংস্কৃতিক অভিঘাত এই রাজ্যকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কম বেশি প্রায় চল্লিশ বছরের ‘বামপন্থী’ সংস্কৃতি এই রাজ্যে অন্য একটা মনন দিয়েছিলশুধু এই রাজ্যে নয় সারা দেশে তার প্রভাব বিস্তার করেছিল। গণনাট্যের সময়কালকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু তারপর? কিছুটা তাত্ত্বিক। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত, কখনও আদর্শগত কারণে বাংলার উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক নক্ষত্রদের আমরা অপাংক্তেয় করে দিয়েছিলাম। এবং কিছু বেনোজল এসে প্রথম সারির সাংস্কৃতিক নেতৃত্বকে ‘স্তাবক’ করতে না পেরে বাংলার উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। নামগুলি মনে পড়ছে। দেবব্রত বিশ্বাস, কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরী, বিজন ভট্টাচার্য, তৃপ্তি মিত্র, ঋত্বিক ঘটক, শম্ভু মিত্র, সতীনাথ ভাদুড়ী, তারশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র এবং আরও অনেকে। আমি ‘জি নিউজ’ এ চাকরি করার সময় এক সাংবাদিকের কাছে শুনেছিলাম সে সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ পড়েছে কিন্তু ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস এর’ নাম শোনেনি। আমার কাছে শোনার পরে প্রেস ক্লাবে বসে সে আমাকে বলেছিল, ‘আমি বামপন্থী পরিবারের ছেলে অথচ দাদা দেখ,  আমাকে এই বইটার নাম কোনওদিন বলা হয়নি। তোমার কাছে শুনে বইটা পড়লাম। অসাধারণ উপন্যাস।‘’
জেলে বসে তিনি জাগরী লিখেছেন। পরাধীন ভারতের অন্যতম সৈনিক সতীনাথদেশে স্বাধীনতা এল। নতুন সরকার। সতীনাথ ভাদুড়ীর নাম সাংস্কৃতিক জগতে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে বিপুল জনপ্রিয় তিনি। মন্ত্রিত্বের জন্য তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হল। তিনি সম্মানের সঙ্গে পরিহার করলেন। সতীনাথ বললেন, ‘’আর কী দরকার? দেশ স্বাধীন করার জন্য লড়াই করেছিলাম, দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, এবার রাজনীতিতে থাকলে ক্ষমতার লোভ আসবে মনে।‘’
আর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়? যে বিশাল ক্ষেত্র জুড়ে তার কাজ সেখানে একজন ব্যক্তি মানুষের পক্ষে সবটা মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। সত্তরের দশকে আমার থেকে বয়সে আট বছরের বড় এক অধ্যাপক দাদা বলেছিলেন। ‘আরোগ্য নিকেতন’ নোবেল পেতে পারত। ভদ্রলোকের দেশ-বিদেশের ধ্রুপদী সাহিত্য অনেকটা পড়া ছিল। আমার যতদূর মনে পড়ছে ‘আরোগ্য নিকেতন’ জীবন মশাইয়ের প্রস্থানের গল্প। নতুন সময়কে, নতুন কালকে,  বর্তমান সময়ের চিকিৎসা বিঞ্জানকে মেনে নেওয়ার সময়ের কথা তিনি বলেছেন। পাশাপাশি ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’ উপন্যাসে একই রকমভাবে বা একই ছন্দে তারশঙ্কর ‘করালী’র নেতৃত্বের কথা আমাদের বলে গেছেন। তিনি শিল্পের (ইন্ড্রাস্ট্রী) আহ্বানের কথা বলেছেন। বনোয়ারির ভূমিকার বেলা যে শেষ হয়ে যাচ্ছে সেই কথা আমরা শুনেছি। কালউত্তীর্ণ উপন্যাস।
গোপাল হালদার একটি প্রবন্ধে লিখছেন, ‘’......নরেনবাবু বলেছিলেন তারাশঙ্করের কথা—‘কংগ্রেসের আন্দোলনে (১৯৩১-এ) জেলে গিয়েছিল। আর যাবে না বলেছে। ওর দেশবোধ যাবে কোথায়? ঠিকই, সাহিত্যের কামড়ই শুধু কচ্ছপের কামড় নয়, ওই রাজনীতির কামড়ও কচ্ছপের কামড়—যাকে ধরে তাকে আর ছাড়ে না। ছাড়লেই কি ঘা শুকোয়?’ তারাশঙ্করের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতে বুঝেছিলাম—বাইরের ঘা শুকিয়েছে, কিন্তু মনের ঘা শুকোয়নি, না ভেবে পারেন না—দেশের কী হচ্ছে কী হওয়া চাই।‘’ (পশ্চিমবঙ্গ, ১ অগাস্ট, ১৯৯৭)।
রাজ্যের বামপন্থীদের কাছে আমাদের যে প্রত্যাশার কথা আমরা বললাম, সেই অবস্থান থেকে চিনের বিতর্কিত সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রসঙ্গে মাও ৎসে তুং যে দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন (২রা মে, ১৯৪২), ‘সাহিত্য ও শিল্পকলা প্রসঙ্গে’ (ইয়েনানের আলোচনা সভায় প্রদত্ত ভাষণ) নামে পরিচিত। কিছু অংশ উল্লেখ করা যাক। ‘’.........চীনা জণগনের মুক্তির জন্য পরিচালিত আমাদের সংগ্রামে বিভিন্ন ফ্রন্ট আছে; সেগুলির মধ্যে লেখনী ও বন্দুকের ফ্রন্ট, অর্থাৎ সাংস্কৃতিক এবং সামরিক, এই দুটি ফ্রন্টই রয়েছে।...... মনোভাবের সমস্যা। শ্রেণী দৃষ্টি থেকেই যে কোনো বিষয়ের প্রতি আমাদের বিশেষ মনোভাব প্রকাশ পায়। দৃস্টান্তস্বরূপ ধরা যাক, কাউকে প্রশংসা করতে হবে, না তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে হবে? এ প্রশ্নটি হচ্ছে মনোভাবের প্রশ্ন। কোন মনোভাবের আমাদের প্রয়োজন? আমি বলি, উভয় মনোভাবেরই প্রয়োজন আছে। কাদের নিয়ে কাজ সেটাই হল প্রশ্ন ।‘’ আধুনিক চিনের রূপকার দেং জিয়াওপিং এর নেতৃত্বে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৮১ সালে ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’কে ভুল বলে সেই অধ্যায় মুছে ফেলেছে। উন্নয়ন কে হাতিয়ার করেই ‘নতুন চিন’ এর বুনিয়াদ গড়ে তুলতে চাইছেন বর্তমান চিনা নেতৃত্ব।  সমাজ বিঞ্জানীরা বলছেন ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’। তাই অতীতের যে অংশটা অপ্রয়োজনীয় সেটা ফেলে দেওয়ায় বুদ্ধিমানের কাজ। কিন্তু যে ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় উপাদান আছে সেটাকে কাজে লাগাতেই হবে। বৃহত্তর সমাজের স্বার্থে।
আমেরিকান এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকপ্রাপ্তির যুগ কি বলছে? ‘’অষ্টাদশ শতকে আমেরিকান এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকপ্রাপ্তির প্রধান ঝোঁক ছিল ঐতিহ্যের বদলে যুক্তি, প্রশ্নহীন ধর্মীয় বিশ্বাসের বদলে বৈঞ্জানিক অনুসন্ধান এবং রাজতন্ত্রের বদলে নির্বাচিত সরকারের ওপর। আলোকপ্রাপ্ত চিন্তাবিদ ও লেখকরা ছিলেন ন্যায়, স্বাধীনতা, সমানাধিকার ও মানুষের প্রকৃতিদত্ত অধিকার রক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ।‘’ (মার্কিন সাহিত্যের রূপরেখা, মার্কিন বিদেশ দপ্তর, আন্তর্জাতিক তথ্য কর্মসূচি ব্যুরো)
ভারতেও নববই দশকের পর ‘বাজার অর্থনীতি’র ন্যায্য দাবি আমরা মেনে নিয়েছি। সেই মানদণ্ডে এই রাজ্যেও তার প্রভাব অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রয়োজন এক ঝাঁক ঝাঁ চক চকে ছাত্র-যুব। ১৯৮৭ সালে শান্তিনিকেতনে সমাবর্তনে এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধি কি   বলেছিলেন। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘দেশ’ (৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭) সংখ্যায় লিখছেন, ‘’শান্তিনিকেতনে এসে প্রধানমন্ত্রী তাঁর এই মতামত অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন। আগেও তাঁর এই মত জানা ছিল এবং কেন্দ্রীয় শিক্ষা নীতিতেও এই মত কিছুটা প্রতিফলিত হয়েছে ঠিকই; কিন্তু শান্তিনিকেতনে এসে তিনি এত তীব্রভাবে কথাগুলো বলেছেন যে, এবার বোধহয় সকলেরই নড়েচড়ে বসার কথাতিনি নিঃসংকোচে জানিয়েছেন, সমাজবাদের নামে মাঝারিয়ানাকে আর বরদাস্ত করা হবে না। মাঝারি মাপের মানুষ নয় বড় মাপের প্রতিভাবান চাই। রাজীব বলেছেন, তিনি ‘’ইনটেলেকচুয়াল এলিটিজম’’ চান। এ ব্যাপারে কোনও আপসে তাঁর বিশ্বাস নেই।.........রাজীবও বারবার বলছেন, অনুগত, বাধ্য, দীনাতিদীন, ছাত্র চাই না; ছাত্রদের আক্রমণাত্বক, বৈপ্লবিক, সাহসী ও অশান্ত হতে হবে।‘’                         

                            

Thursday 2 June 2016

সামপ্রতিক এবং নিকট অতীত

  নিকট অতীতঃ  
সময় ছুটতে ছুটতে পেছন ফিরে তাকাতে চায়ব্যক্ত কথার অভিঘাত অব্যক্ত শব্দের আলিঙ্গন খোঁজে। তাই আমার আবেদন হোক প্রত্যায়িত আমন্ত্রণের অভিঘাত। এখানে জনান্তিকে বলে রাখা ভালো, একথা সে কথার পরই শুরু হয় কথপোকথন। মার্জনা করবেন। আবেদন কেন প্রতিবেদন হবে? নিজেকে নিজের মত করে পাইনি দীঘৎ দীঘৎ সময়কাল। আমেরিকার প্রশ্রয়ে আন্তর্জাতিক উঠোন পেয়েছি। মুক্ত গণতন্ত্রের স্বাদ উপভোগ করছি। সেই প্রশ্রয়ে নিকট অতীত নিয়ে ফিরে বসা। এসবের কোনও প্রয়োজন ছিল না। কয়েকজন বলল কিছুটা যখন প্রকাশ হয়েছে আরও কিছুটা হোক। যথা আঞ্জা বলে শুরু করি।
হয়ত বামপন্থা আমাকে অনেকটা গড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আমার গড়ে ওঠা মননের প্রায় ৯০ শতাংশ ওরা ওদের তথাকথিত কুশলী পরম্পরায় ফিরিয়ে নিতে চাইল। পেরেছে কি? সম্ভবত নয়। কারণ গান্ধি-নেহরুর চিন্তা তথা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আমার প্রাথমিক ভিত গড়ে দিয়েছিল। সেই জাতীয়তাবাদী হারিয়ে যাওয়া মননের ধূসর হয়ে যাওয়া পাতার পৃষ্ঠা থেকে চেনা অক্ষরগুলো ফিরতে চাইছে। ফিরতে চাইছে জাতীয়তাবাদী চেতনার রঙ মশালের আলোয়। 
আমি ১৯৭৫ সালের উচ্চমাধ্যমিকের ব্যাচ। মিলন ঘোষ হাজরা এবং ডাঃ নবদ্বীপ সেনদের সঙ্গে আমি প্রাথমিক স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছি। পারিবারিক এবং আর্থ-সামাজিক সীমাবদ্ধতা আমাকে বারে বারে থমকে দিয়েছে। তাই ওদের থেকে একবছর পিছিয়ে পরলাম। মিলন ঘোষ হাজরা (বাবুন) শৈশবের বন্ধুত্বের মর্যাদা আমাকে দিয়েছে। ১৯৭৯ সালে নলহাটি ‘মিলনী সংঘ’ এর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হবার পর মিলন (বাবুন) স্মরণিকা প্রকাশের সিধান্ত নেয়। সে বছর ছিল ৪৪ তম প্রতিষ্ঠা দিবস। (১৯৭৯)। এবং ৪৪ বছরে প্রথম স্মরণিকা। মিলন ঘোষ হাজরা আমাকে ‘স্মরণিকা’ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছিল। প্রকাশকাল ছিল ১৫ আগস্ট, ১৯৭৯। বাবুনকে আমার কৃতঞ্জতা জানাই।

১৯৭৬ সালে পেলাম অমিতাভ ধর (মিঠু), অমিত পাল (বাপী), দেবেশ তালুকদার, শান্তিলাল জৈন। আমরা এই চারজন একসঙ্গে স্কুল যেতাম। দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত আমরা ছিলাম পরস্পরের পরিপূরক। শৈশবের বিহানবেলা থেকে সাঁঝবেলার মাধুকরী করতাম ওদের সহায়তায়। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় অমিত আমাদের ছেড়ে সূদূর আকাশে চলে গেল। দীঘায় স্নান করতে গিয়ে ডাঃ মধুসূধন পালের দ্বিতীয় সন্তান বাবা-মায়ের সামনে মারা যায়। আমার একজন প্রিয় বন্ধুকে তখনই হারাই। অমিত ধর (মিঠু) আমাদের ক্লাশে বরাবর ফাস্টবয় ছিল। বাপী সেকেন্ড হত আর চন্দ্রনাথ দত্ত থার্ড হত। ১৯৭৬ সালে মিঠু উচ্চমাধ্যমিক ভালো ফল নিয়ে পাশ করার পর নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ত। রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হল মিঠু। মানসিকভাবে অসুস্থ হল। মিঠুর মাকে আমি কাকিমা বলতাম। কাকিমা আমাকে বললেন, সমস্ত কথা। ওকে সাহায্য করার কথা। যেহেতু শৈশব থেকে ওদের বাড়িতে আমার যাতায়াত ছিল। আড়াল থেকে ও আমাকে সাহায্য করতে চাইত। মিঠু আমার অন্যতম প্রিয় বন্ধু ছিল। 
২০১৫ সালে জানতে পারলাম রাজ্য সচিবালয়ের এক উচ্চ পদস্থ আইএ এস আধিকারিক অমিতাভ ধর (মিঠু)এর সঙ্গে একসঙ্গে নরেন্দ্রপুর মিশনে পড়তেন। উল্লেখিত আই এ এস অফিসার ভদ্রলোক ১৯৮৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক ছিলেন। আমি তখন ‘দৈনিক বসুমতি’ পত্রিকায় মুক্ত সাংবাদিকতা করি। সেই সময় তাঁর বন্ধু সেই সাংবাদিক বন্ধুকে অনুরোধ করেছিল মিঠু। আমাকে আনন্দবাজার পত্রিকায় নেবার জন্য। তিনি যথেষ্ট চেস্টাও করেছিলেন। কিন্তু ১৯৮৭ সালে আনন্দবাজারের চাকরিটা রাজনৈতিক দাদাদের সন্তর্পণ আলতো ছোঁয়ায় আর হল না। একেই কি বলে বিধির বিধান। যা আজও টেনে নিয়ে যাচ্ছি। আমার প্রিয় বন্ধু মিঠুর আত্মার শান্তি কামনা করছি। মিঠু যেখানে আছ সেখানে আমাদেরও যেতে হবে। তাই তোমাকে আর কৃতঞ্জতা জানাতে চাইছি না মিঠু।
       
১৯৭৯ সালেই নলহাটিতে আমাদের পাড়ায় আমি বয়স্কদের জন্য নৈশ বিদ্যালয় শুরু করি। প্রায় পাঁচ বছর স্কুলটা চালিয়েছিলাম। শ্রমিক, মজদুর, রিকশা চালক অনেককেই অত্যন্ত লড়াই করে শিক্ষিত করেছিলাম। এই বিদ্যালয় সম্ভবত বীরভূম জেলায় প্রথম স্কুল ছিল। দুঃস্থ মানুষদের কলকাতায় নিয়ে এসে চিকিৎসা করানোর কথা আগেই বলেছি। ব্যক্তি হিসেবে কি করেছি বা কি পেয়েছি এটা অত্যন্ত গৌন বিষয়। আমি সমাজ থেকে কি আহরণ করতে পারলাম সেটাই ময়ূরপঙ্খী স্মৃতি হয়ে থাক। আবেগের সযত্ন ঘনঘটা আমাকে প্রজন্ম উত্তর মানবতার প্রশ্রয় দিক। মনে পড়ছে সেই শিক্ষক ভদ্রলোকের কথা। ১৯৮৩-১৯৮৬ সাল পর্যন্ত আমি বৌ বাজারের মেসে থেকেছি। 
এক ভদ্রলোককে দেখতাম প্রতি ইংরেজি মাসের দুতিনদিন রাত ৯।৩০ থেকে ১০টার সময় মদ্যপ অবস্থায় একটি বিলেতি মদের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ইংরেজিতে ভাষণ দিচ্ছেন। কিছুক্ষণ পরে ভদ্রলোকের পরিবারের কেউ একজন এসে তাঁকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। শুনেছিলাম তিনি থাকতেন শিয়ালদহ অঞ্চলে। অবিভক্ত ২৪ পরগণা জেলার কোনও একটি শহরের উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে প্রধান শিক্ষকের চাকরি করতেন। তাঁর স্ত্রী স্কুলের বেতন নিজে গিয়ে নিয়ে আসতেন। সেই টাকা থেকে কিছু টাকা স্বামীকে দিতেন মদ খাওয়ার জন্য। ওই টাকায় দুতিনদিন বিলেতি মদ খাওয়া যেত।

গল্প এখানেই শেষ নয়। ভদ্রলোক প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ির কাছে একটি ফুটপাথে ‘পথশিশুদের’ স্কুল চালাতেন বিনা পারিশ্রমিকে। এটাই সম্ভবত ঠিক। এটাকেই বলে ‘কাজ’ করে যাওয়া। আমাকেও কাজ করতে দিন।

১৯৭৮ সালের বন্যার সময় নলহাটিতে আমি স্থানীয় বামপন্থী নেতাদের ‘দুর্নীতি’ নিয়ে খবর করি ‘চণ্ডীদাস’ সাপ্তাহিক পত্রিকার সাংবাদিক হিসাবে। কয়েকজন বামপন্থী নেতা আমাকে মারে। এবং থানায় নিয়ে য়ায়। ১৪ ঘণ্টা আমাকে থানায় আটকে রাখা হয়। আমি তখন রামপুরহাট কলেজের ছাত্র। আমাদের বাংলার অধ্যাপক আশিস বন্দ্যপাধ্যায় (তৃণমূল কংগ্রেসের বর্তমান বিধায়ক) আমাকে আক্রমনের প্রতিবাদে রামপুরহাট এসডিও অফিসের সামনে কলেজের ছাত্রদের নিয়ে প্রতিবাদ সভা করেন। এবং ‘ডেপুটেশন’ দেয়। ওই আন্দলনে আমিও ছিলাম।
  ১৯৮৫ সাল। নলহাটি ফিরলাম। প্রথমে ৩০০ টাকা বেতনে দু’মাস ইট ভাঁটায় চাকরি নিলাম। সেই টাকায় মায়ের চোখের ছানি অপারেশন করলাম। সেই সময় আমি প্রাথমিক স্কুলে শিখস্কতার চাকরি পেলেও রাজনৈতিক কারণে আমার চাকরি হল না। সিপিএমের গণ সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন এমন দু’একজনের কথা বলছি। যারা আমাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন বীরভূম জেলায়। তাঁরা বললেন তুই নলহাটিতে থাকিস না।এই সময়ে আমি নলহাটিতে ‘প্রগতি মঞ্চ’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলি। স্থানিয় ক্ষেত্রে ব্যপক সাড়া পড়ে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। নলহাটিতে চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করি। তিনটে ছবি কলকাতা থেকে নিয়ে যাই। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘পথের পাঁচালি’, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত পরিচালিত ‘গৃহযুদ্ধ’ এবং উৎপলেন্দু চক্রবর্তী পরিচালিত ‘চোখ’। নলহাটির ‘শঙ্কর টকীজে’ ছবি তিনটে দেখানো হয়েছিল। 

জীবীকার প্রয়োজনে আবার কলকাতায় ফিরলাম। কলকাতাতে এসেই বসুমতিতে ‘ফ্রি লান্স’ সাংবাদিকতার চাকরি। ছ’মাস কাজ করার পরও বেতন পেলাম না। এই সময় ‘আনন্দ বাজার’ পত্রিকা থেকে চাকরির প্রস্তাব পাই। কোনও এক অঞ্জাত কারণে চাকরিটা হয়নি। সালটা ১৯৮৭। তারও আগে ১৯৮৪ সালে ‘আজকাল’- এ চাকরি পাক্কা হয়েছিল। সাহিত্যিক সন্দীপনদা আমকে তৎকালীন সম্পাদক পূষন গুপ্তের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। এবং সব কথা ঠিক হয়ে যায়। আমি বিনোদনের পাতায় (বীভাগে) সাংবাদিকতা করব। ১৯৮৪ সালে ‘বর্তমান’ ‘পত্রিকাতে’ও সুযোগ পাই। অদৃষ্টের কি পরিহাস কোনও চাকরি আমাকে করতে দেওয়া হয়নি। খুব সম্ভবত আমাদের জেলার দু’ই স্বনামধন্য ব্যক্তি আমাকে এইভাবে আটকে রাখলেন
 
১৯৮৬ সালে কলকাতা এসেই একটি ছোট বিঞ্জাপণ সংস্থায় ৬০০ টাকার চাকরি। ৪০০ টাকা নিজের জন্য রেখে ২০০টাকা মাকে পাঠাতাম। এক বছর চাকরি করে পরের বছর থেকে আবার ‘ফ্রি লান্স’ লেখা লেখি এবং অন্যান্য কাজ করে জীবীকা চালিয়ে নিচ্ছিলাম। ১৯৮৮ সালের ২৪ নভেম্বর বিয়ের সিদ্ধান্ত। একটি প্রথম সারির বামপন্থী রাজনৈতিক দল প্রস্তাব দিল বিধানসভা ভোটে দাঁড়ানোর। তাঁরা ফ্ল্যাট সহ কলকাতা শহরে সব দেবে। আমি প্রস্তাব সসম্মানে প্রত্যাখ্যান করলাম। আমার স্ত্রী সাহিত্যিক মনোজ বসুর সম্পর্কে নাতনি।  তাঁর নাগরিক মূল্যবোধ কিছুটা আহত হয়। ১৯৭৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগে ১৯৭৪ সালে আমার স্ত্রীর বাবা মারা যান। ওর বাবা বিড়লা সংস্থার পদস্থ কর্মী ছিলেন। মা এবং দাদার সঙ্গে থাকলেও দাদার কাছ থেকে সে রকম সাহায্য পায়নি। তাই তাঁকেও নিজের চেস্টায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়। কলকাতা শহরে ‘জনঅরন্য’ ‘চৌরঙ্গী’ বা ‘সীমাবদ্ধ’ এর নায়কদের মত ছুটতে শুরু করলাম। সাংবাদিক, লেখক হওয়ার সাধ তখন সলিল সমাধি (‘রেখ মা দাসেরে মনে’)। 
        
কসবায় আমরা থাকতে শুরু করি। আমাদের কিছুটা স্বচ্ছলতা আসতেই তিনজন ভাইপো, একজন ভাগ্নে সহ মাকে কলকাতায় নিয়ে এলাম। এরপর আমার সঙ্গে সেই বিখ্যাত নেতার দেখা হল। তখন একটি ছোট গল্পের বই প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। সালটা ১৯৯৬-১৯৯৭।

সংযোজন পৃষ্ঠাঃ (৩) 
‘সুবর্ণরেখা’ থেকে বইটি প্রকাশ করার সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। তারপর আবার সব এক এক করে হারিয়ে গেল। বইটি আজও প্রকাশ করা গেল না। অভিযোগ শুনলাম। আমি ভাইপোদের ব্যবহার করেছি। আজ কলকাতায় সবাইকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছি। কলকাতায় সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে নলহাটি ফিরলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম সাংবাদিকতা করব। ‘জি নিউজ’ এর তৎকালীন বাংলা চ্যানেল ‘আলফা’ বাংলা থেকে অফারও পেয়ে গেলাম। কপর্দকশূন্য অবস্থায় নলহাটিতে আমি, আমার স্ত্রী, আমার ভাইপো (আমার ছোড়দার একুশ দিনের ছেলেকে আমরা বড় করেছি। কারণ আমার বৌদি ওকে একুশ দিনের রেখে মারা যায়। পরে আমার ওই দাদা আবার বিয়ে করে এবং তাঁর প্রথম পক্ষের দুই ছেলেকে আমাকেই দেখতে হয়।) এগ রোল, ‘মোগলাই পরটার’ ব্যবসা করলাম। পাশাপাশি আমি ‘লেখালেখি’ বজায় রাখলাম। লিটিল ম্যগাজিন করলাম ‘আর্থ-সামাজিক’ নামে।‘জি নিউজের’ ডাকে কলকাতায় আসতে হল। এক দশক আগে যে আভিজাত্য নিয়ে কলকাতায় ছিলাম সে সব এখন ধূসর। ১৯৯১ সালের কঠিন কঠোর বাস্তব চিনেছি। মানুষ, অথবা তাঁরা মুখোশ ব্যবহার করা তথাকথিত ‘কমরেড’। ‘বিপ্লবে’র নামে শপথ নিয়ে তাঁরা মানুষ ঠকায়। চেনা আবেগ দিয়ে এই সব ‘নাগরিক সভ্যতা’ কে আমরা গ্রামীন সভ্যতার মানুষেরা ভুল ঠাউরে বসি। ওদের অট্টহাসির উৎসব চলে। সৌজন্য আছে এমন মানুষদের এঁরা অনন্য এক ভাষায় অচ্ছ্যুত করে রাখে। ওদেরই পরিকল্পিত ‘চক্রব্যুহে’ টেনে আনেতারপর সময় মত ব্যবহার করে। মসৃণ এক অভিজাত চিত্রনাট্যের চরিত্র করে গড়তে চায় এঁরাএইসব লোকেদের ‘অহং’ কে চিহ্নিত করা যায় না। এরপরও যদি থেমে থাকি নিজের কাছে নিজেকে ‘ক্লাউন’ মনে হবে। তাই আরও এক ‘পদাতিক’ এর নেশায় আজও ‘মানবতা’ চিনতে চাইছি। 
        
সাম্প্রতিক
কলকাতার দক্ষিণ শহরতলির যে অঞ্চলে আমরা থাকি সেটাকে ঠিক শহর বলা যাবে না। শহরের উপকণ্ঠ বলা যেতে পারে। বিশেষত সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের জন্য। সাংবাদিকতার সুবাধে গত ১৪-১৫ বছর এই অঞ্চলে আছি। আমি এই শহরে জন্মগ্রহণ করিনি। এখানকার স্কুল কলেজে পড়িনি। স্থানীয় দাদাদের নেতৃত্বে সংগঠিত অপ্রয়োজনীয় প্রচার হয়েছিল। কারণ আমার সত সাংবাদিকতায় অনেকে পদচ্যুত হয়েছেন। অনেকের মুখোশ খুলে গেছে। আরও অনেকের মতো শ্রদ্ধেয় তৃণমূল নেত্রী এবং বর্তমানে রাজ্যে তাঁর দলের দ্বিতীয় বারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে ‘তৃণমূল কংগ্রেস’ এ জয়েন করার কথা বলেছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিয়ে নেবার কথাও বলেছিলেন। আমি সম্মানের সঙ্গে আমার অনিচ্ছার কথা জানাই। তখন আমি ‘Zee News’ এ চাকরি করি। পরবর্তীতে তাঁর কাছ থেকে অকৃত্রিম সাহায্য পেয়েছি। আমি রাজনীতির লোক নই। বাংলা তথা ভারতীয় সংস্কৃতির ‘সেবাদাস’ হয়ে কাজ করতে পারলেই আনন্দ পাব।
২০০৯ সাল থেকে যে ধারাবাহিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়লাম, এটা অনেকে জানতে চাইছেন। ২০০৯-২০০১১ পর্যন্ত তিন তিন বার ‘২৪ ঘণ্টা’ বাংলা ‘নিউজ চ্যানেলে’ চাকরির সুযোগ হল। তারপর ২০১১ সালে আনন্দবাজার পত্রিকাতে। ২০১২ সালে ‘এই সময়’ দৈনিকেকিন্তু না নাগরিক কলকাতা আমাকে মানতে পারল না। 
দিন কয়েক আগে একাডেমী যাচ্ছিলাম। রঙরূপের ‘অব্যক্ত’ নাটক দেখতে। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পড়ছে। যেন মুসল পর্ব শেষ হচ্ছে। ধুয়ে দিচ্ছে। শিশির মঞ্চের পেছনের দিকটায় (নন্দনের উল্টোদিকে) একটা বন্ধ দড়জা শেডের তলায় আমরা দাঁড়িয়ে। জনপ্রিয় নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবশঙ্কর হালদার আর আমি। দেবশঙ্করদা আমাকে চেনেন বুঝলাম। তিনি ‘বহুরূপী’ এর প্রযোজনায় একটি ঐতিহাসিক নাটকের কথা বলছিলেন। সেই নাটককে কেন্দ্র করে একটি বিতর্কের প্রসঙ্গ এল। আমিও সাংবাদিক, লেখক, শিল্পীদের সীমাবদ্ধতার কথা বললাম। প্রায় পঞ্চাশ মিনিটের আলাপ চারিতায় পরস্পরে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, কাজ করতে গিয়ে বাঁধা, বিঘ্ন, সমস্যা, সামাজিক, পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা, জটিলতা, কূটিলতা আসবেই, তবু বৃত্ত পরিপূর্ণ করতে ‘কাজ’ আমাদের করে যেতেই হবে। পারিবারিক বৃত্ত। পারিবারিক দায়বদ্ধতা, অনুভূতি, আবেগ আরও সন্নিকটে চিনলাম। সম্প্রতি ‘নাটক বিষয়ক’ একটি লেখার জন্য নাটক সংক্রান্ত কয়েকটি বই পড়তে হচ্ছে। শ্রদ্ধেয় নাট্য ব্যক্তিত্ব দেবাশিস মজুমদার সম্পাদিত শূদ্রক থেকে প্রকাশিত ‘তৃপ্তি মিত্র’ বইটি পড়লাম। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক বাসু ভট্টাচার্য লিখছেন, ‘’............... শম্ভু মিত্র তার স্বরচিত নাটক ‘চাঁদ বণিক’ এর পালাটি শেষ অবধি মঞ্চস্থ করলেন না-। ওই নাটকটা বেশ কয়েকবার শম্ভুদার মুখেই শুনেছি। ওই নাটকটা তৃপ্তিদি থাকতে থাকতে মঞ্চস্থ হবার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল চাঁদ বণিক, সনকা, এবং বেহুলার ভূমিকায় শম্ভু-তৃপ্তি-শাওলীর একত্রিত হওয়ার—এক সাথে। একই মঞ্চে। এঘটনাটা যদি ঘটত তাহলে আমাদের সৌভাগ্য হত এমন একটা নাটক দেখার, যে নাটক আজ অবধি অনেক অনেক না দেখা নাটকের—না জানা নাটকীয়তার—অনেক না বোঝা দৃষ্টিকোণের অনেক ঝাপসা বক্তব্যের সামনে থেকে পরদা তুলে দিত।‘’
এই জীবনবোধের পরে। অথবা এই উপলব্ধির একাগ্রতায় পারিবারিক বৃত্ত কে কোন অহমিকায় বিসর্জন দিতে চায় আহাম্মকের দল? যেখানে গদ্য থেমে যায়। কবিতার মাদকতায় প্রেম চুপি চুপি বলে আমি সাদা ফুলে আছি। আমি লাল ফুলে ছিলাম। আমি ভালবাসায় আছি। আমি সমাজে থাকতে চাই আমাকে সমাজে থাকতে দাও। তোমরা অর্থ নাও। যশ নাও। মান নাও। আমাকে পরিবারে থাকতে দাও।