Friday 28 July 2017

ছন্দপতন

ছন্দপতন: 
গদ্যের ছন্দ থেকে মুক্ত বিহঙ্গ খুঁজে পেতে চায়,
কেউ কেউ হেসে ভেসে থাকে উত্তুঙ্গ মেঘ মল্লারে।
বলা না বলা কথথক সুরের ছন্দ-শৈলী...... 
জানা না জানায় বেসুর হয়ে আসে
সাদা কবুতর নূপুর পায়ে অচেনা ঠিকানায়
নেচে যায়, ডেকে চলে এক সমুদ্র অহংকারে।
লাল-হলুদ-নীল গোলাপের পাশে......  
সাদা কবুতর হাসতে ভুলে গেছে। ওকে কি
মেঘের নীচে পথ বলে দেবে তোমরা?  
সাদা সাদা পেঁজা মেঘেদের সঙ্গে নূপুর বাজাবে?
শরৎ মেঘের সময় সব ঋতু বয়ে আনতে জানে না।
সাদা মেঘ হারিয়ে যায় অসময়ের অকাল ভৈরবী
প্রভাতি গানে, আজ গঙ্গায় প্লাবন নেই,
সাদা কবুতর নূপুর পায়ে অচেনা ঠিকানায়
এসে খোঁজে, হেমন্তের হিমেল বিকেল।
সাদা শিউলির বরণডালায় টুপ টুপ টুপ
হেমন্ত ভোরের শিশির ভাসে।
কেউ কেউ হেসে ভেসে থাকে উত্তুঙ্গ ঠুমরী গানের
পেয়ালা হাতে, বসন্ত এসে ফিরে গেছে,
বসন্ত ডাকে বারে বারে, ডাকে ‘কুহু কুহু রবে’, সাদা কবুতর বাসা খুঁজে নিতে চায়।    

Wednesday 19 July 2017

পাশ্চাত্যের আয়না

পাশ্চাত্যের আয়না:

হাজারটা দুয়ার খুলে দিলেও ‘সম্রাট’ কি ফিরবেন?
চাল্লিশ চোরের নতুন গল্প লিখলেও কি ‘আলিবাবা’
বলবেন, ‘আমার বাড়ির দেওয়ালে আচড় কেটোনি!’
দাগ সাদা বা কালো যাই হোক
নজর পড়ুক, দেখা না যাক, প্রাচ্যের শৈশব হারিয়ে
যায়, তৈলাক্ত মরুভূমির শীতল রক্তের ধূসর প্রান্তরে।
কৈশোর খোজে হারিয়ে যাওয়া সময়ের......
শিশির ভেজা পাথরের আপ্যায়ন। 
হাজারটা দুয়ার খুলে দিলেও সম্রাট
কি আবার বলবেন? ‘আমি মুঘল সাম্রাজ্য, মৌর্য সাম্রাজ্য এবং
গৌর বাংলার অদ্বিতীয় গণিতবিদ!
প্রিন্স দ্বারকানাথ গঙ্গাতীরে সপ্তম নৌবহর ভেড়ালেন,
ব্রিটিশ, পর্তুগীজ বণিক ফিরে এলেন, হুতোম লিখতে চাইল।
সতীদাহপ্রথা রদ হয়েছে, বিধবা বিবাহের স্বীকৃতি এল,
স্ত্রী শিক্ষার প্রচলন হয়েছে!  
সধবার দল নগর সন্ন্যাসিনী হয়ে ‘মহানাগরিক’
খুঁজে রাজ্য রাজধানী চিনলেন।
একশত উপাখ্যান লেখা হল.........  
আলিবাবা ফিরলেন না।          
         


Wednesday 5 July 2017

উপচিত উপঢৌকন সংস্কৃতি খুঁজতে খুঁজতে:

উপচিত উপঢৌকন সংস্কৃতি খুঁজতে খুঁজতে: 

যৌথ সমাজ নামক সোনার পাথর বাটির গল্প বর্তমানে কেউ কি আর বলে? যৌথ পরিবার এখনও কোথাও কোথাও আভিজাত্যের অভিজাত প্রাসাদে ঝাড় বাতির ঝাঁপটায় ঝাঁপতাল বাজাচ্ছে। বলতে চাইছি উল্টোদিকে হাঁটতে চাইলে কেন প্রশ্ন ওঠে? প্রশ্ন তোলার অধিকার তাঁরা পায় কোথায়? ভেলা ভাসিয়ে দিলে ভেলা জানে না কোথায় কোন তীরে গিয়ে ভীড়বে। কয়েকদিন আগে উল্টোরথ ছিলমাসির বাড়ি থেকে জগন্নাথদেব ফিরলেন নিজের বাড়িতে। সঙ্গে ভাই বলরাম এবং বোন সুভদ্রা। জগন্নাথদেবের এই সময় ভাই ফোঁটা হয় হয়ত। সোজা পথে এসে উল্টো পথে ফেরেন তিনি, সেই কারণেই কি উল্টো রথ? বেশ কয়েক বছর আগে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ নামক যৌথ পরিবার এবং যৌথ সমাজ তথা যৌথ সংস্কৃতির সদস্য হিসাবে প্রশ্ন তুলেছিলাম। বাংলা সাহিত্য, সঙ্গীত সহ সংস্কৃতি ক্ষেত্রে  আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিনিধিত্ব করবে কারা? লেখাটি শব্দ এবং ভাষার কোমর নাচানোর চেষ্টা থাকলেও আবেগের আধিক্য কয়েক চামচ বেশি ছিল। আধুনিক পণ্য বাংলা সিনেমা প্রসঙ্গে কিছুদিন আগে বাংলা সিনেমার এক প্রবীণ অভিনেতা কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমা তথা মূল ধারার সিনেমা আজও পথ হাতরাচ্ছে। খুব খারাপ সময় বাংলা চলচ্চিত্রের। বর্তমান সময়ের দুই জনপ্রিয় প্রথম সারির নায়ক অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযোজনায় নেমেছেন। কতদিন? আধুনিক প্রযুক্তি ‘ডাবিং’ নামক চলচ্চিত্রকে যৌথ সমাজে প্রবর্তিত করতে পেরেছে। ফল কি  দাঁড়াল? বাংলার কি লাভ হইল? যদিও কৌশিক গাঙ্গুলী, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো (আমার সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। তৈলাক্ত মাথায় বাংলা ব্রান্ডের তেল দিচ্ছি না।) পরিচালক চেষ্টা করছেন পণ্য সংস্কৃতির ভীড়ে বাঙালির মূল্যবোধ, যৌথ পরিবারের স্মৃতি, যৌথ সমাজের বন্ধনের কথা মনে করিয়ে দিতে। অন্য ধারার গল্পকে দর্শকদের সামনে এনে হেচকাটানে আমাদের অন্য ধারার ছবি দেখাতে চাইছেন তাঁরা দুজনে। যে ছবি আজকের বাস্তবতায় খুব বেশি প্রয়োজন। এ ছাড়াও দু’একজন পরিচালক মেধার দৈন্যতায় ‘আঁতেল’- বাঙালিবাবুদের জন্য কিছু সিনেমা করেছেন এবং করছেন। কিছু বেশি রকমের ‘রিমেক’ নয় কি সেগুলি? সেইসব ছবি করতে যে শ্রম, মেধা, অর্থ খরচ হয় সেই যৌথ প্রচেষ্টা গবেষণায় দিলে ছবির ‘কনটেন্ট’ আরও ভালো হতে পারে বলেই মনে হয়। অতপর? হুতোম ফিচেল হেসে কয় বিশ বছর সিনেমা, নাটক না দেইখা, বাংলা ধ্রুপদী বই না পইড়া তর এসব লেখা ক্যান দরকার? হুতোমের সব কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।  
পণ্য উৎসবের মেজাজে ঝাঁকে ঝাঁকে নতুন উত্তর আধুনিক মেধার অভিনেতা অভিনেত্রীরা এসেছেন। অদৃশ্য অর্থের প্রাচুর্য এইসব নব্য যুবা সম্প্রদায়কে টেনে এনেছে। এদের মধ্যে অবশ্যই অনেকে আছেন যাঁদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কিছু নেই। প্রশ্ন হচ্ছে কোন পরিচালক সৃষ্টিশীল সিনেমার জন্য এদের সুযোগ করে দিতে পারবেন? গল্প কোথায়? চিত্রনাট্য কে লিখবে? নতুন ভাষায়? নতুন আঙ্গিকে? আজকের সিনেমাওয়ালারা উল্টো রথে চড়তে আগ্রহী নন। রথের দিন বা উল্টোরথের দিন জগ্ননাথ দেবের মতো ভাইফোঁটা করতে আগ্রহী নন তাঁরা? তবে আমাদের মত ছিঁচ কাদুনি কাঁদার মতো আম বাঙালি উত্তম-সুচিত্রার স্বর্ণ সময়েও ছিল বর্তমানেও আছে। ২০০২ সালে একটি টিভি চ্যানেলের অফিসে বার কয়েক বাংলা সিনেমার অন্যতম ব্যতিক্রমী অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গল্প করার সুযোগ হয়েছিল। সে সময়েও তিনি বলেছিলেন, ভালো গল্প বলার মতো পরিচালক এসেছেন। ভালো ছবি নতুনদের কেউ কেউ করছেন। কিন্তু ভালো আধুনিক সামাজিক সাহিত্য আমরা পাচ্ছি না। এই কারণে বর্তমানের ভালো পরিচালকরা সাহিত্য নির্ভর গল্প থেকে সিনেমা করতে চাইছেন না। মননশীল চিন্তার দুর্বলতাও আর একটা কারণ হতে পারে। মাধবীদি বলেছিলেন। অদৃশ্য পুঁজির বিনিয়োগের ঢল যত কমে আসবে বাংলা চলচ্চিত্র ততই নিজের শক্ত পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে। দক্ষিণের ছবি যদি রমরমিয়ে চলতে পারে হিন্দি ছবির সঙ্গে তাল রেখে বাংলা ছবি কেন পারবে না? সমস্যা যেটা থেকে যাচ্ছে বাংলা আধুনিক মননশীল সাহিত্য।
বাংলা সঙ্গীত তবু বলতে হয় তুলনা মূলকভাবে নিজের পায়ে হাঁটতে পারছে। যে সব নতুন সঙ্গীত শিল্পীদের আমরা পাচ্ছি তাঁরা যথেষ্ট চর্চা করে নিজস্বতা গড়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের গানে যেমন সেইসব শিল্পী আলাদা আসন করে নিতে পেরেছেন। লোকসঙ্গীতেও তাঁরা আমাদের কাছে সমানভাবে জনপ্রিয়। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলা সঙ্গীতে জয়তি চক্রবর্তী, ইমন চক্রবর্তী আলাদা দাবি নিয়ে বাংলা গানের শ্রোতাদের কাছে এসে হাজির হয়েছেন। তাদের গানের গায়কি এবং আবেদন আমাদের কাছে অন্য মাত্রা পেয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে অগ্নীভ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সুপ্রতীক দাস রবীন্দ্রনাথের গানকে বর্তমান সময়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন তাদের নিজস্ব ঘরানায়। লোকসঙ্গীত শিল্পী অমর পালের সুযোগ্য ছাত্র প্রাণেশ সোমকে পেলাম প্রভাতি গানে এবং লোকগানে। বিশেষত প্রাণেশের গলায় ‘’ভ্রমর কইও গিয়া শ্রীকৃষ্ণ বিহনে অঙ্গ যায় জ্বলিয়া, কইও কইও কইও গিয়া......’’ এই গানটি জয়তি চক্রবর্তীর গলাতে শুনেও আমরা লোকগীতিকে আপন করে নিতে পারি। এই সময়ের একজন জনপ্রিয় লোকগীতি শিল্পীকে আমরা হারালাম। কালীকাপ্রসাদ যে দায়িত্ব নিয়েছিলেন লোকগানে নতুন করে সেই দায়িত্ব কাউকে নিতে হবে।
বাংলা নাটক নিয়েই বরং আমরা গর্বিত। উৎপল দত্ত, অজিতেশ, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, কেয়া চক্রবর্তী, মনোজ মিত্র, বিভাস চক্রবর্তী, শাঁওলী মিত্র, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, সীমা মুখোপাধায়দের পরে নতুন যারা এসেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম দেবশঙ্কর হালদার, মনীশ মিত্র, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, অর্পিতা ঘোষ, সোহিনী সেনগুপ্ত সহ একঝাঁক নাট্য ব্যক্তিত্ব এবং নাট্য কর্মী। রাজনৈতিক থিয়েটার আজ থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও ছিল বর্তমানেও আছে। বাংলা নাটকে শুরুর সময়ে রামণারায়ণ-মাইকেল-দীনবন্ধু প্রমূখের নাটকে জমিদার প্রথা তথা সামন্ত ব্যাবস্থার বিরুদ্ধে লেখা বিষয় বস্তু যেমন আমরা পেয়েছি। আবার বিভিন্ন কৃষকের চরিত্রও পেয়েছি। পরবর্তী সময়ে গিরিশ-অমৃতলালের যুগের নাটকে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার বিষয়বস্তু আমাদের দেশমাতৃকার আরাধনায় ডেকে নিতে পেরেছে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পেরেছিল ওইসব নাটক। স্বাধীনতার পক্ষে সেই নাটক সামাজিক দায়িত্ব পালন করত। আবার বিষয়বস্তু, আঙ্গিক প্রভৃতি বিষয় বংলা নাটককে সমৃদ্ধ করেছে। প্রগতি ধারার জয়গাঁথা শুনিয়েছে আমাদের। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটেও আমরা প্রচুর ভালো নাটক পাচ্ছি। সমীক্ষকরা বলতে পারবেন বাংলা সাহিত্যের তুলনায় নাটকের দর্শক এবং আলোচকের সংখ্যা বেশি কেন?                
গত দু দশকে যে সব নতুন সাহিত্য আমরা পড়েছি সেই সব গল্প উপন্যাস থেকে কোনও একটি স্ত্রী চরিত্র বা নারী চরিত্র কে আলাদা করে চেনা যাবে? যে চরিত্র আজও আমরা মনে রেখে সেই চরিত্রের নামের সঙ্গে পরিবারে কোনও মেয়ের নাম করণ করেছি। যেমনটি সত্যবতী, সুবর্ণলতা, মাধবীলতার নাম আমরা মনে করতে পারি। অথবা আরও আগে বিমলা, চারুলতা, সর্বজায়া, দুর্গার কথা আমরা মনে করতে পারি একই কথা বলা যায় পুরুষ চরিত্রের ক্ষেত্রেও। শ্রীকান্ত, ইন্দ্র, দেবদাস, গোরা, সন্দীপ, অনিমেষ, অপু, হরিহর, ঢোঁড়াই, করালি ইত্যাদিএইসব নামগুলি আমাদের বাঙালি তথা ভারতীয় সমাজের পরিবারগুলিতে ছড়িয়ে আছে। আমরা যারা মননশীল সাহিত্যের পাঠক তাঁরা মিথ হয়ে যাওয়া সেইসব চরিত্রগুলির নাম মনে রেখেছি। সাহিত্যের আড্ডায় ওইসব নাম ঘুরে ফিরে আসে। বছর খানেক আগে আমার সঙ্গে সদ্য পরিচিত একটি তরুণের নাম শুনে জানতে চেয়েছিলাম বাড়িতে কে সাহিত্য পড়ে? সে বলেছিল আমার বাবা। সেই তরুণটির নাম শাম্ব। শাম্ব একটি তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মী। ব্যঙ্গালোরে আছেন। তার কথায়, ‘আমার বাবা সমরেশ বসু মানে কালকূটের ‘শাম্ব’ পড়েই আমার নাম রেখেছিলেন।’
গোয়েন্দা উপন্যাসেও সেই ‘ব্যোমকেশ’-এর সময় ধরে কিরীটি, অজিত, দীপক, ফেলুদা হয়ে নতুন চরিত্র আর কোথায়? সুনীল- শীর্ষেন্দু তাদেরমতো করে চেষ্টা করেছেন। ঘনাদা, টেনিদার মতো জনপ্রিয় চরিত্র বাংলার পাঠক আর খুঁজে না পাওয়ার কারণ কি?    
প্রথমত সাহিত্যের ফর্ম নিয়ে ‘সবুজ পত্র’-এর সময় থেকেই বিভিন্ন আলোচনা আমরা শুনি। সে প্রমথ চৌধুরী হোক অথবা ‘কবিতা’ পত্রিকার বুদ্ধদেব বসু। এবং ‘শনিবারের চিঠি’ এর সজনীকান্ত দাস। শিল্প সাহিত্যের ভাষা যতই উন্নত, ভাবগর্ভ, ব্যঞ্জনাময়, অপ্রয়োজনীয় অলঙ্কারযুক্ত হোক আপত্তি কেউ করবে বলে মনে হয় না। সে সব শিল্প নৈপুণ্যে উচ্চস্তরের হলেও বিষয়বস্তু যদি দুর্বল হয়? তাতেও সমাজের বা সাহিত্যের কিছু এসে যাবে না। সব কিছুর উর্ধে বিষয়বস্তুটাকে সম সাময়িক হতে হবে। বিষয় বস্তুর মধ্যে সূক্ষমতা থাকতে হবে, জটিলতা থাকতে হবে, টান টান উত্তেজনা, ব্যতিক্রমী ঋজু চরিত্র গড়ে না উঠলে সেই সাহিত্য কালোত্তীর্ণ হতে পারে না। সেই সাহিত্যসৃষ্ট চরিত্রগুলিও বাদাবনে হারিয়ে যেতে বাধ্য। বাজার চলতি বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলিই আমাদের কালজয়ী সৃষ্টিশীল উপন্যাস দিয়েছে। চার পাঁচ বছর আগে একটি বহুল প্রচলিত এবং বাংলা প্রকাশনার অন্যতম সংস্থার পাক্ষিক পত্রিকার ‘শারদীয়’ সংখ্যায় নারীপাচার বিষয়কে কেন্দ্র করে একটি উপন্যাস লেখা হয়েছিল। অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য লেখা। লেখক এবং উপন্যাসের নাম আজ আর আমার মনে নেই।                                              
‘বিবর’, ‘রাতভোর বৃষ্টি’-এর সময় পেরিয়ে বাংলা সাহিত্য পণ্য হলেও পণ্য সাহিত্যের পাঠক বর্তমানে কতজন? আমরা পণ্য সাহিত্য পড়ব? না পর্ণ মুভি দেখব? ‘সোশ্যাল মিডিয়া’-এর সৌজন্যে বাংলা সহ সব ভাষার ছবি আরও সহজলভ্য হয়েছে। হাতে একটি স্মার্টফোন থাকলেই হল। সাহিত্যের অশ্লীলতা নিয়ে তাবড় তাবড় ব্যক্তি বিভিন সময়ে লিখে গেছেন। কিছুদিন আগে উর্দু সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক সাদাত হোসেন মানটোর একটি বাংলা অনুবাদ লেখা পড়ছিলাম পুরনো একটি পত্রিকায়। লেখাটির অনুবাদ করেছেন জাফর আলম। মানটো সাহেব লিখছেন,
‘’আজকের নূতন সমস্যা অতীতের পুরাতন সমস্যার মধ্যে মূলত বিশেষ তারতম্য নেই। আজকের দুষ্কর্মের বীজ হয়তো অতীতেই বপন করা হয়েছে। যৌন-সমস্যা যেমন আধুনিক লেখকের সম্মুখে রয়েছে তেমনি অতীতেও প্রাচীন লেখকদের কাছে একই সমস্যা বিদ্যমান ছিল। অতীতে লেখকরা প্রাচীন নীতিতে এই সমস্যাকে তুলে ধরেছেন, আমরা একে নিজস্ব ঢং-এ লিপিবদ্ধ করছি।
আমি জানি না আমাকে কেন বার বার যৌন সমস্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। কারণ লোকেরা আমাকে প্রগতিবাদী লেখক নামে আখ্যায়িত করেছে, কারণ আমার কয়েকটি গল্প যৌন সমস্যা নিয়ে লিখিত। নতুবা কেন জানিনা আজকের তরুণ লেখকদেরকে কিছু সংখ্যক লোক ‘’যৌন বিকারগ্রস্ত’’ বলে সাহিত্য ধর্ম ও সমাজ থেকে কলমের খোঁচায় বহিস্কার করতে চান। কারণ যাই হোক না কেন, আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব ব্যাখ্যা করছি। রুটি আর পেট, নারী ও পুরুষের সম্পর্ক সনাতন ও চিরস্থায়ী। রুটি ও পেটের মধ্যে কোনটি বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং নারী-পুরুষের মধ্যেকার প্রয়োজনীয়তা কার বেশী তা বলা মুশকিল। কারণ আমার ক্ষুধার্ত পেট রুটি চায়। কিন্তু পেটের ন্যায় গমও আমার পেটের জন্য লালায়িত কিনা জানি না। তবে যখন ভাবি, জমিতে গম বেকার উৎপন্ন হয়নি বরং আমার উদর পূর্তির জন্য বিস্তৃত মাঠে এই সোনালী গমের চাষ করা হয়েছে তখন বেশ আনন্দ পাই। হয়তো আমার উদর প্রথমে সৃষ্টি হয়েছে আর গমের বীজ পরে।‘’
শ্রদ্ধেয় সাদাত হোসেন মানটোরমতো লেখক এই সময়ে উর্দু সাহিত্য কেন প্রায় যে কোনও ভাষায় পাওয়াটা বিরল। তারমতো উন্নত চিন্তার মননশীল লেখক উর্দু সাহিত্যকে মর্যাদার আসন দিয়ে গেছে। নিপীড়িত মানুষের কথা মনটো সাহেবের মরমী কলমে ক্ষুরধার ভাষায় উঠে এসেছে। যে সব জীবন গাঁথা তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন আজ সেসব ধ্রুপদী সাহিত্য হয়ে আছে। তার সঙ্গে সমকালের লেখকদের এক আসনে বসানো যাবে না।   
বর্তমান সময়ে এই বাংলায় দু’একজন লেখক কতটা সাহিত্য ধর্মে দীক্ষিত সেটা পরবর্তী সময় বলবে। তাদের লেখা এবং তাদের গল্প উপন্যাস সম্পর্কে সমালোচকরা লিখছেন, কোনও জাতক যদি বাজারি পণ্য সংস্কৃতিকে ‘পর্ণ’ সাহিত্যের আঙ্গিকে ভাষা দিতে চায় আমাদের আপত্তি করার কি আছে? নিশ্ছিদ্র আর্থিক এবং সামাজিক নিরাপত্তায় পণ্য হোক বা পর্ণ হোক সেইসব লেখকের কাছে পাঠক অস্থায়ি বিনোদন পাচ্ছে। যে সংস্থা ওইসব লেখকদের সম্মানিত করে বাজারে পৌঁছে দিচ্ছে সেই সংস্থার ব্যবসা হওয়া নিয়ে দরকার। প্রকাশনা সংস্থার সাহিত্যের জাতকদের তীর্থঙ্কর ভাষায় দীক্ষা থাকতে হবে এমন বাধ্য বাধকতার কি আছে? পণ্য তারকারও প্রয়োজন। পর্ণ তারকাদের জন্য বাজার খোলা থাকে। ধ্রুপদী সাহিত্যের ভাষা, চরিত্র, সময়কাল যুগ পরম্পরায় পাঠকমণ্ডলীকে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যায়। সত্যকে আরও চিরসত্য করে রেখে যায় ধ্রুপদী সাহিত্যের চরিত্ররা। প্রকৃতি আসে কবিতার শব্দের মতো উপন্যাস নির্মাণের সহায়ক ভাষা হিসাবে।
বাংলা সাহিত্য আলোচনায় যে নামগুলি চিরন্তন হয়ে আছে তারমধ্যে অন্যতম বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। লেখকের সর্বকালের পাঠকের জন্য শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’। এই উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনায় সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি প্রবন্ধে লিখছেন, ‘’.........‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের প্রথম বিস্ময়কর দুঃসাহস এর প্রকৃতিপট নির্মাণে নয়। প্রকৃতিপট নির্মাণে তিনি রবীন্দ্রনাথকে অতিক্রম করেননি— করার চেষ্টাও করেননি। তিনি শুধু তীক্ষ পর্যবেক্ষণে অধিকতর সানুপুঙ্খ হয়েছেন। তা নইলে ‘ছিন্নপত্রাবলী’-র চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ যেমন প্রকৃতির সঙ্গে তার অস্তিত্বের সজীব সম্পর্কের কথা বলেন, প্রকৃতির যে টান তিনি তার রক্তধারায় অনুভব করেছেন, হাডসন সম্বন্ধে যে কথা উনিশশো ষোল সালে গলসওয়ারদি বলেছেন— তা এখানে স্মরণীয়। Hampshire Days থেকে গলসওয়ারদি উদধৃত করেছেন এই অংশ— ‘The blue sky, the brown soil beneath, the grass, the trees, the animals, the wind and rain, the stars are never strange to me; for I am in and am one with them; and my flesh and the soil are one, and the heat in my blood and in the sunshine are one, and the winds, and the tempests and my passions are one.’  আমরা মিলিয়ে নিতে চাইব না, কিন্তু মনে করতে পারি ‘ঊর্মিমুখর’-এর এই অংশঃ ‘আজ রবিবার দিনটা দুপুরে একটু ঘুমিয়ে উঠেচি- কি পরিপূর্ণ ঝলমলে শরতের দুপুর। এর সঙ্গে জীবনের কি যে একটা বড় যোগ আছে— ভাদ্র মাসের এই রোদভরা দুপুরে কেন যে আমায় পাগল করে তোলেবনে বনে মটর লতার কথা মনে পড়ে, ইছামতীর ঘোলা জল, পাখীর ডাক— মনটা যেন কোথায় টেনে নিয়ে যায়। ‘’পথের পাঁচালী’’ কিন্তু এসবের জন্য বিশিষ্টমাত্র একথা বললে সবটা বলা হল না । ‘’পথের পাচালী’’-র একমাত্রতা এবং অনন্যতা তার কেন্দ্রীয় চরিত্র নির্বাচনে।’.........’’
এই লেখার যখন পরিকল্পনা করি তখন আমার কাছে একটি খবর আসে। এই বছর আমেরিকায় বঙ্গ সম্মেলন হবে ৭-৯ জুলাই। নর্থ আমেরিকান বেঙ্গলি কনফারেন্স (এনএবিসি)-এর উদ্যোগে এবছর ৩৭তম বঙ্গ সম্মেলন। আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো শহরে সান্টা ক্লারায় হবে এবছরের সম্মেলন। একটি বাংলা দৈনিকের উদ্যোগে দু’ই বাংলার বিভিন্ন ক্ষেত্রের পাঁচজন সেরা বাঙালিকে এবার বেছে নেওয়া হয়েছে ‘সেরা বাঙালি’ হিসাবে। তাদের সম্মানিত করা হবে এবারের প্রবাসী বাঙালিদের পীঠস্থান আমেরিকায়। এর থেকে গর্ব আর কিছু হয় না। যে পাঁচজনকে বেঁছে নেওয়া হয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে এক একজন নক্ষত্র। নামগুলি আশা করি ইতিমধ্যে বিশ্বের আপামর বাঙালি স্বজনেরা জেনে গেছেন। আত্মার আত্মীয়তার অনুভবে।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকার ৫ জুলাই, ২০১৭ সংখ্যায় একটি খবর পড়লাম। মার্কিন মুলুকের ১৪ জন শিক্ষক আসছেন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পড়াতে নয়। পড়তে আসছেন নিউ ইয়র্ক শহরের বিভিন্ন স্কুল থেকে ওই ১৪ জন শিক্ষক তাঁরা আসছেন বাংলা ভাষা শিখতে। বাংলা সংস্কৃতি জানতে আসছেন। ফিরে গিয়ে তাঁরা আমেরিকার অভিজাত শহর নিউ ইয়র্কের প্রবাসী অভিজাত ভারতীয় তথা বাঙালিদের সাহায্য করতে পারবেন। এমনটাই খবরে প্রকাশ। নিউ ইয়র্ক শহরের ১৪ জন শিক্ষক আসছেন এই বাংলায়। বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সংস্কৃতির ছাত্র হয়ে। আমি প্রশ্ন তুলতে চাইছি বিশ্বের অভিজাত দেশ, সুশিক্ষিত দেশ, মেধা চর্চার দেশ, উন্নত বিঞ্জানের দেশ, উন্নত প্রযুক্তির দেশ, মিশ্র সংস্কৃতির দেশ, উন্নত গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকা। জ্ঞান চর্চার অন্যতম পীঠস্থান সেই আমেরিকার অভিজাত শিক্ষাবিদেরা এদিন পর্যন্ত এই বাংলার বাঙালিদের নিয়ে এত উদাসীন ছিলেন কেন? এই বাংলার বাঙালি দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে  ইউরোপ আমেরিকার সহ বিভিন্ন দেশের ঞ্জান আহরণ করেছে। সভ্যতার আধুনিকতম মেধা প্রবাসী আমেরিকান বাঙালিরা আমাদের পৌঁছে দিয়েছেনকিন্তু আমেরিকার সাহিত্য আমরা বাঙালিরা কতটা চিনি? আমেরিকার ধ্রুপদী সাহিত্য আমরা বাংলা ভাষায় কতটা অনুবাদ সাহিত্যে পেয়েছি? এই দায়িত্ব কোন দেশ বা কারা নেবে? এবছরের বঙ্গ সম্মেলনে কেউ কি থাকবেন এই প্রশ্ন তোলার জন্য? অথবা গর্বিত বাঙালি উল্লেখিত বিষয়ে ধ্রুপদী ঘরানায় এবং ঐতিহাসিক ভাবনায় তার্কিক মেজাজে একটা সেমিনার করবেন কি তিনদিনের অভিজাত সম্মেলনে?                  
 

অপরাহ্ণ বেলায়

অপরাহ্ণ বেলায়: 

সহাস্য আগুনে হাত দিলে শিশু প্রথম
চেনে-জানে আগুন দেহের তাপ উত্তাপ।
যুগান্তের দিগন্তে প্রচলিত সামাজিকতায়—
ছাই হয়ে যাওয়া নিভন্ত চুল্লি আছে—
কয়েকশত যোজন হেঁটেও
শ্রীকান্ত পৌঁছে যায় রাধাচূড়ার পড়ন্ত বিকেলে।
‘রিনা ব্রাউন’-এর ঝাপসা শহর থেকে দূরে.........
ভ্রমরের ‘বঁ’ ‘বঁ’ ‘বঁ’ শব্দে গ্রাম জীবনের
রাখাল বালকের উচ্ছলতা? তিরপিতা, ব্রহ্মাণী, ময়ুরাক্ষী
অজয়ের ঢেউয়ের কথাব্রত কোন অজান্তে হারিয়ে যায়...
শহর উপকণ্ঠের ‘চূনীবাবু’-দের জলসায় ঘুরে ঘুরে
বিশ্ব অয়নের ভাষা ছিনিয়ে নিতে চায়
শ্রীকান্তের শরৎ জ্যোৎস্না.........
প্রৌঢ় পথিকের গ্রন্তিত সঞ্চায়নে
অপরাহ্ণ বেলায়, ফুল মেলার
হোলি শেষে, হেঁটে চল, হেঁটে যাও......
হাঁটতে দাও শিশুর হাতের নরম স্পর্শে
উচ্চ-নীচ সব প্রাঞ্জনে।
অনিমেষ আজও অপেক্ষায় থাকে,  
সামাজিক সামিয়ানার নীচে ‘উত্তরাধিকার’
আসবে কোনও একদিন.........
‘সত্যবতী’, ‘সুবর্ণলতা’, মাধবীলতা -‘ন হন্যতে’  
ভাষার প্রাপ্ত স্বাধীনতায়।