Monday 31 October 2016

প্রিয়দর্শিনী এবং ভারত

প্রিয়দর্শিনী এবং ভারত
বিষয়টা যে গুরুত্ব দাবি করে আমি তার জন্য প্রস্তুত নই। প্রাক্তন কংগ্রেস নেত্রী ইন্দিরা গান্ধির ‘প্রিয়দর্শিনী’ নাম দিয়েছিলেন স্বয়ং গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই ওই বরেণ্য নারীর যে ব্যপ্তি সেই ব্যপ্তি আমার মত আনপোড় ‘শ্রমজীবী সাংবাদিক’ তথা ‘ব্লগ লেখক’-এর কাছে অনেকটাই ঔদ্ধত্য হয়ে যায়। কারণ হিসাবে উল্লেখ করা যায় আমার যোগ্যতা। The WEEK  পত্রিকার সম্পাদক Philip Mathew  ডিসেম্বর ২১, ২০১৪ সালের সংখ্যায় সম্পাদকীয় কলামে লিখছেন, ‘’Edwin LUTYENS NEVER attended school. Rheumatic fever had got the better of his child hood. He spent time observing construction of houses and carpentry in the English countryside. By age 15, he began evolving as an architect. এই প্রসঙ্গ আমার সঙ্গে তুলনায় আসে না। তবুও সত্য এতটাই দাবি করে আমি একজন স্কুল ছুট, কলেজ ছুট, পরিবার ছুট, প্রেম ছুট, সমাজ ছুট, দল ছুট, মঞ্চ ছুৎ, মঞ্চ অচ্ছুৎ দলিত ব্যক্তি।   
আজ ৩১ অক্টোবর 16, তার প্রয়াণ দিবস অথবা আত্মবলিদান দিবস। মনে পড়ছে ১৯৮৪ সালের ওইদিনটির কথা। ওই বছর আমি বীরভূমে দেশের বাড়িতে ছিলাম। ২৮ অক্টোবর অথবা ২৯ অক্টোবর আমার তৎকালীন এক ঘনিষ্ঠ চিত্রকর বন্ধু আমাদের বাড়ি বেড়াতে এসেছিল। পরে সেই বন্ধুটি আভিজাত্যের জঙ্গলে হারিয়ে গেছেনআজ সম্ভবত সেই ব্যক্তিটিরও মনে পড়বে। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর সেই চিত্রকরকে কলকাতার গাড়িতে তুলে দিতে বেলা বারটার সময় ‘নলহাটি’ স্টেশনে এসেছিলাম। গঞ্জ শহর থমথম করছে। স্টেশনে লোক নেই বললেই চলে। স্কুল, বাজারে অঘোষিত বন্ধ। সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে আমি খবরটা রাজনৈতিক সূত্রে এবং প্রশাসনিক সূত্রে আগেই পেয়েছিলাম। সেই চিত্রকর ব্যক্তিটিকে জানিয়েও দিয়েছিলাম। সাবধানে এবং সতর্কভাবে কলকাতা যাওয়ার কথা বলেছিলাম।
ইন্দিরা গাঁন্ধিকে এর আগে প্রথম দেখি ষাটের দশকে সালটা মনে নেই। আমাদের পরিবার কংগ্রেসি হওয়ার কারণে বড়দা এবং বাবার সঙ্গে ‘নলহাটি’ স্টেশনে গিয়ে তাকে দেখি। একটি ট্রেনের সেলুন কামরায় তিনি বসেছিলেন। খুব সম্ভবত আমাদের অঞ্চলে কংগ্রেসের বিধায়ক ছিলেন শিরমনি প্রসাদ ভকত। আমার বয়স এতটাই কম ছিল, স্মৃতিও ঠিক ততটাই দুর্বল। সেইজন্য ইতিহাস নাও মিলতে পারে সময়ের সঙ্গে পদচারণায়। তবে তার ব্যক্তিত্ব, হাসি, কণ্ঠস্বর আজও স্মৃতিপটে অম্লান হয়ে আছে। শৈশবে দেখা মায়ের মুখের মত। অভিভাবকের মুখ মনে রাখার মত। আকাশবাণীতে খবর শোনার সময় তাঁর কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পেতাম। সেই কণ্ঠস্বর আজও অবচেতন মনে এসে ধাক্কা দেয়। এতটাই আত্মশক্তি ছিল সেই কণ্ঠস্বরে।   
এরপর ১৯৭১ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে ইন্দিরা গাঁন্ধির তিনটে জনসভায় গিয়েছিলাম। খুব মনে পড়ছে শেষটা ছিল রামপুরহাট গান্ধী ময়দানে। ১৯৭৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে। এতটাই জনসমাগম হয়েছিল যে কেউ একজন দলছুট হলে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। আমার স্পষ্ট মনে আছে। ভিড় হবে এমনটা আগাম খবর ছিল আমাদের বাড়িতে। বাবা এবং বড়দা সরকারি কর্মী হিসাবে মিছিলে যাবেন সেটাই বাস্তব। দুজনেই কংগ্রেস সমর্থিত ট্রেড ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।  কিন্তু ভিড়ের কারণে আমার যাওয়ার উপর নিষেধাঞ্জা ছিল। আমি নিষেধাঞ্জা অমান্য করেই ইন্দিরা গাঁন্ধির জনসভায় গিয়েছিলাম। যদিও বাড়ি ফিরে মৃদু ধমক খাই।
তারপর সময়ের মানদণ্ডে রাজনৈতিক টানাপোড়েন। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৪। ইন্দিরা গাঁন্ধী এবং রাজীব গাঁন্ধির মৃত্যু ভারতে এক অস্থির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি করে। প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ী এনডিএ সরকারের নেতা হিসাবে দেশের টালমাটাল পরিস্থিতির হাল কিছুটা হলেও ধরতে পেরেছিলেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০৪ পর্যন্ত এবং বর্তমান সময়ে ইন্দিরা গাঁন্ধির প্রয়োজনীয়তা দেশের আর্থসামাজিক স্বার্থেই আলোচনায় আসা উচিত বলেই মনে হয়। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর এ বছর দেশের প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁন্ধির জন্মশতবর্ষ। আগামী ১৯ নভেম্বর দিল্লিতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর জন্মশতবর্ষের আনুষ্ঠানিক সূচনা হবে। শেষ হবে আগামী বছর নভেম্বরে। এই উপলক্ষে সারা বছর কর্মসূচি নেওয়ার জন্য এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক জনার্দন দ্বিবেদী প্রতিটি রাজ্যের প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, পরিষদীয় দলনেতা, শাখা সংগঠনের নেতৃত্বকে চিঠি পাঠিয়েছেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রই বদলে ফেলতে পেরেছিলেন ইন্দিরা গাঁন্ধি। তৎকালীন জনসঙ্ঘ নেতা অটলবিহারি বাজপেয়ীও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে ‘দুর্গা’র সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।  
নেহরু এবং লালনাহাদুর শাস্ত্রী পরবর্তী ভারত কেমন ছিল? ফিরে দেখা যাক এক নজর। সমাজতত্ববিদদের বক্তব্য, ভারতে ষাটের দশকের শুরুতে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্র থেকে জাতীয় আয় ছিল ৯.৯ শতাংশ। নয়া আর্থিক নীতি যে সময় চালু হয় সে সময় যা জাতীয় আয় উৎপন্ন হত তাতে রাষ্ট্রায়ত্ব ক্ষেত্রের অংশ ছিল ২৭.১২ শতাংশ। একটি সূত্র বলছে ‘’ব্যাঙ্ক, বীমা, রেল, বন্দর- এসব বাদ দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন অন্যান্য সংস্থা, যে গুলিকে বলা হয় পাব্লিক এন্টারপ্রাইজ, ভারতে ১৯৫১ সালে তাঁদের সংখ্যা ছিল ৫টি, এগুলিতে যা পুঁজি বিনিয়োগ করা হয় তাঁর পরিমাণ ছিল ২৯ কোটি টাকা। আশির দশকের শেষে এগুলির সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪৪টি; এগুলিতে নিযুক্ত পুঁজির পরিমাণ হয়ে পড়ে ৯৯,৩২৯ কোটি টাকা।‘’
‘’...............ভারতের পক্ষে উপনিবেশ লুঠ করার সুযোগ ছিল না, বানিজ্য পুঁজিরও বাড়বাড়ন্ত ছিলনা সে সময় যা থেকে ট্যাক্স বসিয়ে প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করা যায়। কৃষি থেকে এই আদি সঞ্চয় করা যেত— সোভিয়েত রাশিয়ার শিল্পায়ন সেভাবেই ঘটেছে।‘’
কিন্তু ভারতে কৃষিতে তার জন্য যে সংস্কার করা দরকার তার পরিকাঠামো আমাদের দেশে ছিল না। তৎকালীন শাসকদল জাতীয় কংগ্রেসেরও ছিল না। বিষয়টি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁন্ধির নজর এড়ায়নি। তিনি সেই মোতাবেক কাজ শুরুও করেছিলেন। কিন্তু সামন্ত্রশ্রেণী এবং তাঁদের ফোড়ের দল কৃষিতে রাষ্ট্রীয় পুঁজির বিনিয়োগ বা যৌথ খামার ব্যবস্থাকে সব সময় নাকচ করেছে। নাকচ করেছে কৃষিতে সমবায় ব্যবস্থারও। যার ভয়ঙ্কর ফল ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর ইন্দিরা গাঁন্ধির হত্য। ‘আইরন লেডি’ খ্যাত ভারতের সর্বকালের সেরা মহিলা প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু। ইন্দিরা গাঁন্ধির মৃত্যুর পর যে অবাঞ্ছিত ঘটনা ভারতে ঘটেছিল সেটা আদৌ আবশ্যিক ছিল না। কংগ্রেসের সবাই এই ঘটনার জন্য প্রস্তুতও ছিলেন বলে মনে হয় না। আমরা দেশের জন্য আত্মত্যাগের কথা বলি। স্বাধীন ভারতে তিনটে নাম খুব এবং বারে বারে সামনে আসে। মহাত্মা গাঁন্ধি, ইন্দিরা গাঁন্ধি এবং রাজীব গান্ধিঁ। আমরা কেন ভুলে যাব রাজনীতির জন্য আশির দশকে পাঞ্জাবের সাধারণ মানুষের রক্ত ঝরার কথা। সত্তরের দশকে এই বাংলা সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে রক্ত ঝরেছে। নব্বইয়ের দশকে বোম্বে, উত্তর প্রদেশ সহ আমাদের রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ রক্তাক্ত হয়েছেন। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে গুজরাটের মানুষও নিজেদের মূল্য দিয়েই ভারতে থাকার অধিকার পেয়েছেন সম্ভবত। বর্তমান কাশ্মীরে যে ঘটনা আমরা দেখছি। রাষ্ট্রের ব্যর্থতার দায়িত্ব একজন নেতা বা নেত্রীর উপর বর্তায় না। আমরা যারা সংবেদনশীল লেখক, সাংবাদিক তাঁরা বিষয়গুলিকে উপেক্ষা করতেও পারি না। আমাদের উপর যতই আক্রমণ নেমে আসুক।              
কেউ কেউ বলে ইন্দিরা গাঁন্ধি সোভিয়েত ব্লকের প্রতিনিধি ছিলেন। বামপন্থী নেতা সন্তোষ রাণা গত শতাব্দীর আশির দশকের প্রথম দশকে একটি পত্রিকায় লিখেছিলেন ‘’১৯৬৯ সালে ভারতবর্ষের মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া ও বড় জমিদারদের প্রধান পার্টি কংগ্রেস বিভক্ত হলো এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মোটামুটিভাবে রুশপন্থী ও মার্কিনপন্থীদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতায় রুশপন্থীরা জিতলো।‘’
‘’.........ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ইন্দিরা গাঁন্ধি ১৩০০ কোটি টাকার অস্ত্র চুক্তি করেছে............’’। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় ১৯৮০ সালে সারা বিশ্বে সামরিক খাতে ব্যয় হয়েছে ৫০,০০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় সামরিক খাতে ব্যয় হয়েছে ৫১ কোটি টাকা। প্রতিদিন ১২২৪ কোটি টাকা।    
উল্লেখিত পত্রিকার একই সংখ্যায় প্রবন্ধটির লেখক তপন রায় লিখছেন, ‘’অন্য ধরণের কিছু উদাহারণও তোলা যায়ঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বহু কোটি টাকার অস্ত্র চুক্তি, আন্তর্জাতিক অর্থতহবিল থেকে এ যাবৎ সর্ব বৃহৎ ঋণ ও তার আনুষঙ্গিক গোপন চুক্তি, আফগানিস্তানে বারবাক কারমালের সরকারকে স্বীকৃতি দানের অস্বীকৃতি, বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগ নীতি শিথিল করা, ইত্যাদি।‘’
আলোচনার দুটি বিষয়কে আমরা আধুনিক গণতন্ত্রের টেবিলে রেখে যদি ইন্দিরা গাঁন্ধির বিচার করি তাহলে আমরা একজন স্বয়ং সম্পূর্ণ ভারতীয় নেতা তথা অভিভাবকের ব্যক্তিত্ব দেখতে পাব। যিনি প্রঞ্জায় স্থির অবিচল ছিলেন। তার কাছে দেশ আগে পরে দল। বিচারের মানদণ্ড ছিল এমনটাই। খুব সম্ভবত মহাত্মা গাঁন্ধি, জওহরলাল নেহরু, বল্লভভাই পটেল, আম্বেদকরদের অনুপস্থিতে ইন্দিরা গান্ধি পেয়েছিলেন ভূপেশ গুপ্ত, হীরেন মুখোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় বসু সহ একাধিক দিকপাল ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য। সর্বপরি ছিল ‘শান্তিনিকেতন’-এর মূল্যবোধ।
The Telegraph পত্রিকায় রামচন্দ্র গুহ ১৪ জুলাই, ২০১২ তে লিখছেন, ‘’In my views, the greatest Indians of the 20th century were Mahatma Gandhi, and Rabindranath Tagore, followed, at a short distance, by a quientet whose members were Nehru, B.R. Ambedkar, Vallabhbhai Patel, C. Rajagopalachari and Kamaladevi Chattopadhayay. These visionaries laid the foundation of multy-party political system, prooted linguistic and religius pluralism, fought caste and gender hierarchies, and in other ways helped make India’s transitation to nationhood and democracy somewhat less painful and bloody than it would otherwise have been.
The distace between Jawaharlal Nehru and Sonia Gandhi is clossal. So is the distance between Mahatma Gandhi and Narendra Modi. By making these points in print I have made myself unpopular with the courtries of the Congress president and, it now appears, with the courtiers of the Gujrat chief minister as well.’’
ইন্দিরা গাঁন্ধির পাশ্চাত্য শিক্ষা কোন উচ্চতায় ছিল তার উদাহারণ আমরা পাই প্রাক্তন জাতীয়তাবাদী এবং সমাজবাদী কংগ্রেস নেতা এবং বর্তমান ভারতীয় রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কলমে। তাঁর রুপা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘The Dramatic Decade’ বইয়ে তিনি লিখছেন, ‘’Her visit to Wales was remarkable. At the inauguration of a spiral steel mill owned by Swraj Paul, her emotional speech swept the audience off its feet. Wales is the place where Aneurin Bevan had made his historical speeches to further the cause of socialism. Bevan was a personal friend of Pandit Jawaharlal Nehru. Against this historical backdrop, the followers of Bevan and the daughter of Nehru made a pretty picture together and evoked intense spells of nostalgia. Moved by her speech, a worker commented that she was sure to win the parliamentary seat if she  chose to contest from Wales.’’  প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁন্ধির স্বমহিমায় ফিরে আসা প্রসঙ্গে প্রণববাবু লিখেছেন, ‘’…………..But the media soon lost interest in the subject, since more important developments were taking place in Parliament at the time.
Indira Gandhi took oath as a member of the Lok Sabha on 20 November. Having been elected from Karnataka, she took the oath in Kannada. Janata Party and CPI(M) members like Jyoti Basu stated that with her ‘evil has come back to Parliament’. Other than that, most members welcomed her warmly. But it wasn’t for long that she was an MP.’’ (Reprint : ‘The Week’, 21 December, 2014, page- 39).
কম বেশি ১২৮ বছরের কংগ্রেস দল সময়ের সঙ্গে তাল, লয়, ছন্দ মিলিয়ে দলটির আগা মাথা সব বদলে ফেলতে চাইছে। নতুন যুব নেতৃত্বের হাত ধরে। আধুনিকমনা প্রবীণ এবং প্রবীণতম নেতৃত্ব এই প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করছেন। কংগ্রেসের রাজ্যপাট চালানো তথা সরকার চালানোর একটা গোপন এজেন্ডা আছে। সেই এজেন্ডা গড়ে দিয়ে গিয়েছেন জওহরলাল নেহরু, লালবাহাদুর শাস্ত্রী, ইন্দিরা গাঁন্ধি, রাজীব গাঁন্ধি এবং ডঃ মনমোহন সিংহ। সকলের জন্য শিক্ষা, সকলের জন্য স্বাস্থ্য, তথ্য জানার অধিকার এবং সকলের জন্য উন্নয়ন, এটাই ভারতীয় গণতন্ত্রের মূল ধারাপাতএই ‘মন্ত্রগুপ্তি’ খুব সম্ভবত কংগ্রেস ঘরানা বলে পরিচিত। আমাদের এই রাজ্যে সেই ঘরানার শপথ নিয়ে চলছেন তৃণমূল কংগ্রেসের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় নিজেও।      



Thursday 27 October 2016

প্রান্তিক

প্রান্তিক
হেলা অবহেলায় তোমরা
আমায় পেছনে ফেলে দিলে।
আমার কি দোষ?
সত্য কথা আরও সত্য করে
বলতে জানি।
হেলা অবহেলায় তোমরা
আমার সাত-আটটা আকাশ
কেড়ে নিলে,
তাতে কিই বা যায় আসে?
বানভাসি নদীর এপার ভাসে
সোনালী ধানের ঘ্রাণ,
মহুল ফুল, কদম ফুলের অঘ্রান।
ও পারেতে জোনাক আলোর আবাহন।
আর তবে কেনই বা মানব

তোমাদের অনুশাসন?   

Tuesday 18 October 2016

শারদীয়ার মিলনবেলা

শারদীয়ার মিলনবেলা  
উৎসব মানেই আনন্দ। উৎসব মানেই বন্ধু মিলন, আত্মীয় মিলন। উৎসব মানেই কেনা কাটা। বাণিজ্য। বাণিজ্যক প্রতিযোগিতা। সামাজিক প্রতিযোগিতা। প্রেম প্রেম হুল্লোর। একটি দু’টি সত্যি প্রেমের গল্প। প্রবাসী বাঙালির কনে দেখার গল্প। অনাবাসী বাঙ্গালির ঘরে ফেরার আবেগ। অনেক অনেকগুলি মিথ্যে প্রেমের গল্প। বেশ কিছু আবেগ প্লাবিত ব্যর্থ প্রেমের বিংশ শতাব্দীর চিত্রনাট্য। কাশ ফুলের প্রতিযোগিতা। এবারের  দুর্গা পুজোতে ‘মেঘাসুর’ দাপিয়ে বেড়িয়েছে। থোড়াই পরোয়া! কে কার পরোয়া করে? বৃষ্টি নয় শরতের মেঘ বালিকার অপটু নৃত্য। আয় বৃষ্টি আয়। ঝেপে ঝেপে আয়। কেঁপে কেঁপে আয়। ভিজব আর গাইব ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে আইসক্রিম খাবনা মেপে। ওষুধ দেব তোকে, মেপে মেপে।’ এবছর এই প্রজন্মের ছিল অস্ফুট স্লোগান। ‘বৃষ্টি’ কবিতায় অমিয় চক্রবর্তী লিখছেন, ‘’স্রোতঃস্বনা মৃত্তিকার সত্তা স্মৃতিহীনা/ প্রশস্ত প্রাচীন নামে নিবিড় সন্ধ্যায়/ এক আদ্র চৈতন্যের স্তব্ধ তটে। ভেসে মুছে ধুয়ে ঢাকা সৃষ্টির আকাশ দৃষ্টিলোক/ কী বিহ্বল মাটি, গাছ, মানুষ দাঁড়ানো দরজায়/ গুহার আঁধারে চিত্র, ঝড়ে উতরোল/ বারে-বারে পাওয়া, হাওয়া/ হারানো নিরন্ত ফিরে—ফিরে—‘’
আমারও যেন ফিরে পাওয়ার দিন ছিল। অব্যক্ত অকথিত সম্মেলন হয়ত বা। ঠাকুর দেখা কলা বেচা এই দু’টোর সংস্কৃতি থেকে আমি একশো যোজন দূরে থাকি। আমার ব্যক্তিক নিষেধাঞ্জায়। যেদিন থেকে বড় দিদি নিজের সংসারে ব্যস্ত হল। বড় জামাইবাবু সামাজিক জটিলতায় আর লড়াই করতে পারলেন   না। বড়দাদা আরও আরও জটিল বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। দু’হাত তুলে তুলে দু’গগা, দু’গগা বলে পালিয়ে এলাম। আজও পালিয়ে পালিয়ে ছুটছি। সামাজিক টানাপড়েন চিনে এবং অবশ্যই না চিনে। মনে পড়ছে। এবছর এপ্রিলের এক গ্রীস্মের সন্ধ্যেয় ‘কমিউন’ নামে এক অতিথিশালায় বাবুদের সভায় গিয়েছিলাম। সেদিন চৈত্রমাস ছিলনা ঠিকই। কিন্তু সেদিন সামাজিক অনুশাসন উপেক্ষা করে প্রায় আটবছর পর আমি মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম। আবদ্ধ জীবন থেকে পশ্চিমের ডাকে সেদিন মুক্তি পেয়েছিলাম। চেনা পথঘাটগুলো সেদিন কেমন অচেনা লাগছিল। অত উজ্জ্বল আলোকস্তম্ভ আমাকে আগমনী বারতা দিয়েছিল। কতদিন কলকাতা শহর তোমাকে আদর করিনি। দু’চোখে দেখতে ভুলে গেছি আজ কত বছর? কলরব মুখরিত কল্লোলিনী কলকাতা। তুমি বাঙ্গালির গর্ব। তুমি আমার শহর। আমাদের শহর। আজ ভাবি সেইসব দিনের ব্যস্ততা
উপকণ্ঠের উপকথা ভেঙ্গে ভেঙ্গে কোনওদিন দশ ঘণ্টা ডিউটি করছি, কোনওদিন আঠের ঘণ্টা। আবার চব্বিশ ঘণ্টা। আটচল্লিশ ঘণ্টা। এইভাবে আমি এবং আরও দু’একজন সাংবাদিক, চিত্র সাংবাদিক কাজ করেছি। চ্যানেলটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। তারপর সপ্তাহ শেষে কাজের পর প্রতি শনিবার প্রেসক্লাবে যেতাম। দু’পাত্র হুইস্কি খেয়ে ‘গোষ্ঠগোপাল’দের সঙ্গে বাড়ি ফিরতাম। সেসব আজ ঝাপসা। এবছর আড়ালে আপনি বা আপনারা কে আছেন? বাতাসে বারুদের গন্ধ নয়। বাতাসে নিম পাতার তেতো হাওয়া নয়। নিম গাছের সামাজিক হাওয়া। সমাজের ডাক। সামাজিকতার হাতছানি পাচ্ছি। বেঁচে থাকার শিউলি পরশ। কাঁঠালিচাঁপা, হাসনুহানা ফুলের সুতীব্র আহ্বান। ফুল ফুটছে আজ এই শরতে।
সেদিনের সেই গ্রীষ্মের সন্ধ্যেয় ‘কমিউন’ সভা ঘরে নতুন মানুষ সবাই। উজ্জ্বল আলো। উজ্জ্বল ভাষা। বাবু কলকাতার কৌতূহল। ভাস্বর, ভাব গম্ভীর অচেনা সভাঘরে ভাস্বতী সন্ধ্যা। অবাধ্যের মত   অবিক্ষিপ্ত, অপর্যাপ্ত অবিশ্রান্ত কথা বলেছিলাম। একজন দু’জন আমাকে চিনতে পেরেছিল। সেদিন কেউ কেউ কেউ ভেবেছিল আমি সুস্থ স্বাভাবিক নই। হয়ত হেসেওছিল ওরা আড়ালে নাগরিক সৌজন্যেহাসতেই পারে। গত চারদশক ধরে এই হাসি আমি চিনি। সেদিন একজন দু’জন চিনে ফেলে আমাকে। আমার গ্রাম্যতা আমার আভিজাত্য। টানা মানসিক অত্যাচারের পর ওই ভাস্বর ভাস্বতী সন্ধ্যেয় উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক, ডাক্তার বেসরকারি সংস্থার আমলা, অধ্যাপকরা আমায় নিয়ে ভেবেছিলেন। সেদিন যে বা যারা আমাকে আন্তরিক প্রশ্রয় দিয়েছেন তাদের কাছে আমি কৃতঞ্জ। এবছর (২০১৬) দুর্গা পুজোর মাত্র ছ’মাস আগে আমার মুক্তি হল।
তৃতীয়ার দিনে এক প্রবীণ সাংবাদিক বন্ধু আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন। প্রেসক্লাবে নয়। মধ্য কলকাতার একটি গেস্ট হাউসে। দামি স্কচের নিমগ্নতায় আমরা তিনজন ছিলাম সেদিন। টানা আড্ডা। মাত্র তিন ঘণ্টা। টান টান উত্তেজনা আর বাড়ির কড়া হুকুম। আমরা বাড়ি ফিরেছিলাম রাত দশটার মধ্যে। বাড়ির বাধ্য ছেলেমেয়েদের সময়সীমা মেনে। সেদিন রাজনীতি, সমাজনীতি, বাংলা কবিতা, উর্দু কবিতা, সাহিত্য সিনেমা কত কিছুর উচ্চারণ ছিল নীরব শান্ত সমাহিত সমস্ত দল, ধর্মের উর্ধে আমরা ছিলাম সমাজ সাধক। ওই প্রবীণ সাংবাদিক তাঁর উচ্চশিক্ষা, সৌজন্যবোধ, সংস্কৃতি চেতনা সব কিছুর সমন্বয়ে তিনি নজর টানেনতিনি আমার উপর এতটাই যত্নশীল, মনে হয় যেন আমার নিজের দাদা আমার সমস্ত দায়িত্ব নিতে চাইছেনকিন্তু তারও সীমাবদ্ধতা আছে। আবার সেদিন যে নতুন এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হল তিনিও শিক্ষক কাম সাংবাদিক। তিনিও উচ্চ শিক্ষিত এবং সংস্কৃতি সম্পন্ন। পারিবারিক আভিজাত্যের মানদণ্ডের বাইরে তিনি থাকেন না।
নবমীর সন্ধ্যেয় পেলাম আমার গত পনের বছরের অকথিত, অগ্রন্থিত স্থানীয় অভিভাবককে যে আমার ভাই কাম বন্ধু ছিল। কখন যেন পারিবারিক বন্ধু হয়ে গেছে। সমস্ত ভয়, দ্বিধা, সঙ্কোচ সব কিছুকে উপেক্ষা করে সেই বন্ধু সেদিন এল। একটা হুইস্কির পাঁইট হাতে। আমরা বৈঠকি আড্ডায় বসার সঙ্গে সঙ্গে নামল মুষলধারায় বৃষ্টি। উমা বাপের বাড়ি এসেছেন একথা সেদিন ইন্দ্র ভুলে গেল। অথবা গাঁজা খোর শিবকে জানান দিল তুমি একা ‘ জাতে মাতাল তালে ঠিক, নও’ বাবা। আমরাও নূপূর বাজাতে জানি। চল বৃষ্টিতে নন্দন যাইস্মৃতির নৌকো ভাসাই বলে আমিও গুলাম আলি চালিয়ে সন্ধ্যে মজলিসে বসে পড়লাম। তৃতীয়া আর নবমী হ্রদয়ে আল্পনা এঁকে দিয়ে গেল। আমার বন্ধন মুক্তি হল। কত কত বছর পর আমাকে সমাজ বলল তুমি মুক্ত তুমি সুরা দিয়ে স্নান কর। তুমি ফুলের পাঁপড়ির সুগন্ধ মেখে ঘুমিয়ে পড়। সমাজ তোমাকে চিনতে চাইছে। এখনও তোমার বন্ধু আছে। ভালো বন্ধু আছে। সুবন্ধু আছে। তুমি জীবনে ফিরে এসো। ফিরে এসো চাকা। সমাজে ফিরে এসো। পাখিরা ডাকছে। ভ্রমর ডাকছে। কাঠি পোকা আত্মরক্ষা শিখিয়ে দিল সেদিন। তোমার হুতোম ডাকছে। ফিরে এসো ফিরে এসো চাকা।
এবছর নজর করে দেখলে উপলব্ধী করা যায়, বাংলা সংবাদ মাধ্যম তুলনামুলকভাবে অন্যান্য বারের তুলনায় এবছর শারদ উৎসবকে অনেক অনেক ব্যপ্তিতে দেখেছে। মা দুর্গার ভাসান এবং মহরম পিঠোপিঠি থাকার কারণে রাজ্য প্রশাসন অনেক সতর্ক ছিল। কিন্তু এগিয়ে এলেন সব সম্প্রদায়ের মানুষ। হাতে হাত মিলিয়ে পুরনো আটচালার বাংলায় আমাদের নিয়ে গেলেন। ‘বাংলা আমরা মা, বাংলা আমার অহংকার’ এই বার্তা আবার আমাদের মনে করিয়ে দিল।
শ্রীক্ষিতিমোহন সেন আজ থেকে সত্তরবছর আগে ‘ভারতে ধর্মের উদারতা’ নামক এক প্রবন্ধে লিখছেন, ‘’.........এই মহাপুরুষ রজ্জবজী ছিলেন দাদুর শিষ্য। জয়পুরের কাছেই তাঁদের স্থান। জয়পুর তিন শতাধিক পূর্বে তাঁদের চরণপাতে পবিত্র হয়েছে।
রজ্জবের গুরু ছিলেন দাদু তাঁরও গুরু পরম্পরায় আদি গুরু কবীর। তাঁরই বাণীতে দেখি যখন সব সঙ্কীর্ণমনা লোকেরা হিন্দু-মুসলমানের ভেদই দেখছিল তখন তিনি বললেন, ‘রাম কহিয়া মরে হিন্দু, খোদা কহিয়া মরে মুসলমান।’ কবীর বলেন, ‘সেইতো জীবন্ত যে এই দুই কোটি(Extreme)- তে না প্রবেশ করে’ (কবীর E Nagari Procharini নাগরী প্রচারিণী Editor Madhi Anga7) কবীর আরও বললেন, ‘আমি পূজাও করি না নামাজও করি না, হ্রদয়ের মধ্যে এক নিরাকার দেবতাকে নমস্কার করি। (pada 338) ‘যেখানে ভক্তি সেখানে ভেখ নাই সেখানে দলাদলি ও সম্প্রদায় বিচার নাই।’ (দেশ ৭ ডিসেম্বর ১৯৪৬)                                  
কেউ বলছে বিশ্বায়ন সংস্কৃতির প্রভাবে দেহ-নট আজ অন্য কিছু চায় অন্য কথা বলে। শরতের মেঘের মতই কাব্যিক আজকের চেনা মুখ। অচেনা মুখোশ। যখন মুখ কথা বলে অনেকে চিনতে চায়না। কিন্তু মুখোশ কথা বললে সকলে আপ্যায়ন করে। এমনই সাগরের ঢেউয়ের মত প্রভাব তার। এই প্রভাবের কারণে সামনের সপ্তাহ থেকে বারোয়ারী পুজো কমিটিগুলির বিভিন্ন কর্মকর্তা ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আগামী বছরের প্যান্ডেলের থিম কি হবে? কোন শিল্পী কাজ করবে? ইত্যাদি সব। এর সঙ্গে আপনাদের বিরধীতা আছে? থাকবেই বা কেন? এসব খবর আমরা জানতেও পারিনা। আপনারা জানতেও চান না। বাঙালির পুজোকে কেন্দ্র করে গ্রাম বাংলার শিল্পীরা যদি এক বছরের জন্য কাজ পায় সেটাই বা কম কিসের?         

Sunday 9 October 2016

সম্পূর্ণা

সম্পূর্ণা
এ ঘরে অলংকর্তা থাকে, অর্জুন নয় সে
অশ্লেষামণ্ডিত আকাশে।
বনলতা হারায়েছে অর্জুন—
সুমধ্যমা গৃহলতা আছে তাঁর।
যেন সুভদ্রাসম, সুদাম আসিল চক্রব্যুহ ভাঙ্গি,
‘হা অভিমুন্য কোথা গেলে তুমি এ প্রত্যুষে......’?
অস্ফুট উচচারণ ধ্বনিত হয়-----
পাহাড়ে-বাতাসে, সাগর সাগরে,
দূর দিগন্তে নিশী জাগা ভোরে......
‘আমি সুভদ্রাসম, প্রমদা নহি’।
এ ঘরে গৃহলতা আজও হাসে প্রষ্টব্য নয়নে,
ছায়াশীতল তিতিক্ষা তব।
পাথর পাহারে ছিল নূপুরের ছন্দ,
বাতায়ন খুলে দেখেছিলে দরবেশ আছে দাঁড়ায়ে।
কৃষ্ণচূড়ার প্লাবিত বন্যায়
তুমি ‘বনলতা’ হয়ে চলে গেছ প্রবাসে।
লাল রাস্তার বারান্দায় দেখ দেখ
এখনও চুপটি করে চাঁদ কেমন হাসে—
আজও হাসে চাঁদ কোজাগরী পূর্ণিমায়।
বনলতা হয়ে থেক তুমি লক্ষ্মীর আলপনায়।

এ ঘরে আজ সম্পূর্ণা আছে।              

Friday 7 October 2016

নাগরিক সৌজন্য

নাগরিক সৌজন্য
কোন মানুষ তাঁর শিশুকে—
আর আমার কোলে দেবে?
ওগো কলকাতা তুমি সৌজন্য ভাঙ্গ—
তোমার আদিম সৃষ্টির বাস্তবতায়।
একদিন কোথাও কথা হয়েছিল,
বলছিল সবাই—
বলেছিলাম অনেককে;
তারপর দিন গেল, দিন যায়।
বিশ্বাস চুঁইয়ে চুঁইয়ে অবিশ্বাস—
টেবিলে ফিন ফিনে গ্লাস।
বিশ্বাস যায়। চ্যাপলিনের ‘সিটি লাইট’।
গোয়েবলস তুমি যতই প্রান্তিক হও—
তোমায় নমস্কারঐ নীতি
সেই নীতি আমার ও আরও অনেকের সম্প্রিতি।
প্রিয়, প্রিয়া স্বজন বন্ধু সবে—
ঐ দিন সেই দিন—
বসব আমি ‘বাণিজ্যিক গ্রামে’।
সংলাপ-প্রিয়ালাপ—
আমায় ফিরাবে অনাসৃষ্টির আনন্দ ভৈরবে।

(কবিতা যদি হয়ে থাকে। লেখাটি ১৪০৮ সালে কার্তিক মাসে প্রকাশিত)     

    

Sunday 2 October 2016

আমার শৈশব হোক জাতির গৌরব

আমার শৈশব হোক জাতির গৌরব

যে শিশুর শৈশব হারিয়ে যায়। যে কিশোরের কিশোরবেলা থাকে না, তাঁরা অভিজাত সমাজকে বিদ্রুপ করবেই। আজ করুক অথবা ভবিষ্যতে। চেতনার মান উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বোধ তৈরি হলে। গত কয়েক প্রজন্ম ধরে যে সব পরিবার ধরাবাহিকভাবে অবঞ্জা, অবহেলা, বঞ্চনার অভিশাপ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে,  সেইসব অভিশপ্ত পরিবারের সদস্যরা শৈশব থেকেই গুমরে গুমরে যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে চলেছে। তাঁরা মুক্তি পেলে সমাজের মুক্তি। এই মুক্তির পথ দেখাতে পারে ‘ফর্মাল’ এবং ‘ইনফর্মাল’ শিক্ষা। বর্তমান পরিস্থিতির বিচারে বলা যায়, সামাজিক চেতনার মঞ্চ চিনে আমাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে আজকের পথভ্রষ্ট শিশুকে মুল স্রোতে ফিরিয়ে আনার। বিদ্যালয় ছুট ছেলেমেয়েদের সামাজিক কারণগুলি বিদ্যাজীবী তথা সমাজসেবীদের কাছে চিহ্নিত। আমরা ভারতীয় নাগরিকরা ইতিমধ্যে ‘শিক্ষার অধিকার’ নামক একটি আইনও পেয়েছি।
দেশের স্বাধীনতা লাভের পর ৬২ বছর লেগে গেছে ভারতে ‘রাইট টু এডুকেশন’  অ্যাক্ট’ (২০০৯) পেতে। আমরা আর একবার ফিরে দেখি শিক্ষা বিষয়ে গান্ধীজীর দৃষ্টিভঙ্গি। জানতে পারব তিনি ঔপনিবেশিক শিক্ষার পরিবর্তে মৌলিক শিক্ষার উপর জোড় দিয়েছিলেন। যেটার উদ্দেশ্য ছিল সরকারি চাকুরে বা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ‘কেরানি’ তৈরি না করে সার্বিক মানুষ তৈরি করা। গান্ধীজীর প্রথম এবং আন্তরিক প্রস্তাব ছিল ৭ থেকে ১৪ বছরের শিশুদের জন্য বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা চালু করা। অবশ্যই শিশুদের বিদ্যালয়ের জন্য সব রকমের পরিকাঠামো থাকার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি ভাবতেন এবং বলতেন। এরপরেও ভারত নামক একটি দেশের শহরের বস্তী থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সাধারণ খেটে খাওয়া পরিবারগুলির শিশুরা ‘শিক্ষার অধিকার’ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রশ্ন তোলাই যায়। আজও বাস্তব ছবি এটাই যে প্রাথমিক শিক্ষার পরিকাঠামো দেশের ‘উন্নয়ন’ নামক আর্থিক পরিভাষার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি সম্ভবত। ২০০৫ সালের বিশ্বব্যঙ্কের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষকদের গড় পড়তা হিসাবে ২৫ শতাংশ শিক্ষক নিয়মিত স্কুলেই আসেন না। এই ২০১৬ সালে এসেও পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হয়েছে?     
বছর ১৫ আগে সাংবাদিকতার সুবাদে হাওড়ার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্ধার শিবিরে খবর করতে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখতে পেয়েছিলাম ৬ থেকে ১৪-১৫ বছরের শিশু কিশোরদের চিকিৎসা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে শিক্ষার ব্যবস্থাও আছে। এইসব শিশুরা  হাওড়া স্টেশনে প্ল্যাস্টিক বোতল সহ পরিত্যাক্ত সামগ্রী কুড়িয়ে জীবন ধারণ করত। পেটের খাবার জুটুক না জুটুক একধরণের রাসায়নিক আঠা রুমাল বা ময়লা কাপড়ে লাগিয়ে নাক, মুখ দিয়ে গন্ধ শুঁকে নেশা করে ওরা। এর ফলে ওইসব শিশুদের ঠোট ফুলে ঘা হয়ে রয়েছে। সেদিন ওরা আমাদের অভিনয় করে দেখিয়েছিল কি করে ওরা নেশা করত। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে একজন উচ্চপদস্থ কর্মী আমাদের হাওড়া স্টেশনে নিয়ে গিয়ে ওঁদের মত আরও ড্রাগ আক্রান্ত শিশুদের দেখিয়েছিল। যাদের ওই সংস্থা তখনও পর্যন্ত উদ্ধার করতে পারেনি। সেদিন যতদূর জানতে পেরেছিলাম এইসব অবহেলিত নেশাগ্রস্ত ছেলেরা মূলত পরিত্যাক্ত সন্তান। যারা মাকে চিনলেও বাবার পরিচয় জানে না।
২০০২ সালে হাওড়া জিআরপি থানার অফিসার ইনচার্জ আমাকে একটা ক্রাইম বোর্ড দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘’এই বোর্ডে দু’টো বিষয় নতুন যুক্ত হয়েছে। হয়েছে মানে আমাদের করতে হয়েছে। একটা ড্রাগস এডিক্টেড এবং রিলেটেড ক্রাইম আর দ্বিতীয় বিষয়টা নারী-শিশু পাচার। দু’টো বিষয়ই পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। আমার অনুমান আগামী দিনে আমাদের এই দু’টো বিষয়ে অনেক বেশি নজর দিতে হবে। এবং সেই সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে আরও বেশী করে টেনে আনতে হবে এই ফিল্ডে কাজ করার জন্য।‘’ ভদ্রলোকের কথায় কতটা গুরুত্ব ছিল বর্তমান সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে ন্যয্যতা খুঁজে পাওয়া যায়।
২০০৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উন্নয়ন ও পরিকল্পনা দপ্তর থেকে প্রকাশিত ‘পশ্চিমবঙ্গ মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন’ এ লেখা হয়েছে, ‘’সাক্ষরতায় এবং শিক্ষায় অগ্রগতির বিষয়টি শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়া এবং অন্তত প্রাথমিক স্তরে শিক্ষা সম্পূর্ণ করার স্বাভাবিক প্রবণতার ওপরে নির্ভরশীল। তাই অনেক সময় দেখা যায়, বাবা-মা শিক্ষিত না হওয়ায় তাঁদের দিক থেকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য শিশুদের উৎসাহ দেওয়ার ব্যপারে ঘাটতি আছে। সেক্ষেত্রে সাক্ষরতায় এবং শিক্ষায় অগ্রগতি ব্যহত হয় নিজে থেকেই। একথা সবাই জানেন যে, কোনো পরিবারের প্রাপ্ত বয়স্কদের শিক্ষার স্তরের সঙ্গে সেই পরিবারের শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নাম নথিভুক্তিকরণের জোরালো সম্পর্ক আছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও র প্রমাণ পাওয়া গেছে। সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চল এবং শহরাঞ্চল উভয় ক্ষেত্রেই বাবা-মায়ের সাক্ষরতা এবং তাঁদের শিক্ষার স্তরের (প্রাথমিক ও তার বেশি বা মাধ্যমিক ও তার বেশি) সঙ্গে শিশুদের বিদ্যলয়ে নাম নথিভুক্তিকরণ এবং উপস্থিতির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে।
তবে বিদ্যালয়ে নাম নথিভুক্তিকরণ সংক্রান্ত তথ্যে নানা কারণে সঠিক হিসাব থাকে না। সাধারণত বিদ্যালয়ের নথির ভিত্তিতে তৈরি সরকারী তথ্যে ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়। কারণ, বিদ্যালয় কতৃপক্ষের ওপর ছাত্রছাত্রীদের নাম নথীভুক্তিকরণের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানোর জন্য চাপ থাকে। তাছাড়াও বিশেষত প্রথম শ্রেণিতে কতজন ছাত্রছাত্রী ভর্তি হলো, সেই সংখ্যাকে বিদ্যালয় কতৃপক্ষের ভূমিকা মূল্যায়নে প্রাথমিক সূচক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। একই কারণে বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত উপস্থিতিকে বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়।‘’ সরকারী প্রতিবেদনে ১২ বছর আগে রাজ্যের বাস্তব ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করার জন্য আমরা                      স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উপর নির্ভর করে থাকি। কিন্তু সেখানেও বামফ্রন্ট সময়কালে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল।
যেমন, ১৬ মে ২০০৪ সালে সংবাদ মাধ্যমে একটি বিতর্কসভার খবর প্রকাশিত হয়। ‘’রাজ্যে নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষার কাজ ঠিকভাবে হচ্ছে কিনা সে প্রশ্নে কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে রাজ্যের বিচারমন্ত্রীর বিতর্ক প্রায় বাগযুদ্ধের চেহারা নিল। শনিবার কলকাতায় রাজ্য মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত এক আলোচনা চক্রে রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি অশোক কুমার মাথুরের সমালোচনার উত্তরে আগাগোড়াই আক্রমণাত্বক ছিলেন বিচারমন্ত্রী নিশীথ অধিকারী। .................. প্রধান বিচারপতির বক্তব্য, নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষায় কাগজে কলমে বহু ব্যবস্থা থাকলেও তার প্রয়োগ হচ্ছে খুব কমই। উত্তরে বিচারমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন, বইপড়া ঞ্জান নিয়ে তিনি অবস্থার বিচার করেন না। তিনি খুব কাছ থেকে সাধারণ মানুষকে দেখার সুবাদেই দাবি করছেন, অবস্থা বদলাচ্ছে এবং তা বিচারপতিদের জন্য বদলাচ্ছেনা, বদলাচ্ছে আন্দোলনের জন্য। প্রধান বিচারপতি বলেন, আইন রয়েছে, আদালত রয়েছে। তারপরেও মানুষ অনেক ক্ষেত্রে সুবিচার পাচ্ছেন না। সেটা অত্যন্ত হতাশাজনক। তিনি বলেন, শুধু আইন করে দিলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তার প্রয়োগ হচ্ছে কিনা সেটাও দেখা দরকার। প্রতি বছর মহিলা ও শিশুদের জন্য নির্দিষ্ট হোমগুলির পিছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে রাজ্য সরকার। কিন্তু তারপরেও সেগুলির অধিকাংশ এক একটি দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছেএ প্রসঙ্গে বেসরকারী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অর্থাৎ ‘এনজিও’ গুলির ভূমিকারও কড়া সমালোচনা করেন তিনি। তাঁর মতে বেশ কয়েকটি এন জি ও স্রেফ নিজেদের মুনাফার জন্য অসহায় মানুষকে নানাভাবে ব্যবহার করে চলেছে। এই ধরণের ‘এন জি ও’ গুলির জন্য অন্য ‘এন জি ও’ গুলিরও বদনাম হয়ে যাচ্ছে।‘’
আজ থেকে বার বছর আগে প্রধান বিচারপতি মাথুর আমাদের যে কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই বক্তব্যের সঙ্গে রাজ্যের কয়েকটি হোমের বর্তমান পরিস্থিতি তুলনামূলক বিচার করলে বস্তুগত ফারাক খুব কিছু কি পাওয়া যাবে? আমাদের দেশের পাঁচ বছরের কম বয়স যে সব শিশুর তাদের শতকরা ৪৩ জনই অপুষ্টিতে ভোগে। শিশুদের বয়সের তুলনায় শারীরিক মাপের (BMI) যে অনুপাত, তার ভিত্তিতে এই হিসাব পাওয়া গেছে। ২০০৫-০৬ সালে ‘ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে ( NFHS) এর তৃতীয় পর্যায়ের যে সমীক্ষা হয় সেই সমীক্ষায় এই তথ্য পাওয়া যায়। ভারতে শিশুদের শারীরিক এবং সামগ্রিক মান উন্নয়নের জন্য ১৯৭৫ সালের ২ অক্টোবর ‘সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্প’ (আইসিডিএস) চালু করা হয়। এই প্রকল্প বিশ্বের সর্ব বৃহৎ পুষ্টি প্রকল্প। এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৬টি পরিষেবা দেওয়া হয়ে থাকে। সেগুলি হল যথাক্রমে পুষ্টিকর খাবার বিলি, প্রতিষেধক বিতরণ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, শিশুদের প্রথাগত প্রাক প্রাথমিক শিক্ষাদান, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য শিক্ষাদান এবং জাতীয় পরিষেবা। পাশাপাশি আর একটি প্রকল্প হল ‘অ্যাক্টিভেটেড সোশ্যাল হেলথ অ্যাক্টিভেস্ট’ (এ এস এইচ এ) বা আশা প্রকল্প। এই প্রকল্পে শিশু ও তার মায়ের স্বাস্থ্য নজর রাখা হয়।
দু’টি প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা কিরকম? ২০০০ সালে সুপ্রীম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছিল ২০১২ সালের মধ্যে আই সি ডি এস প্রকল্পকে সকলের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে এই প্রকল্পগুলির সুবিধাগুলি ঠিকমত কাজে লাগানো হয়নি বা হচ্ছে না। এই অভিঞ্জতার মানদণ্ডে রাজ্য সরকার ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প এনেছেন। এই প্রকল্পের সাফল্য নিয়ে ইতইমধ্যেই হৈচৈ শুরু হয়েছে। যদিও বিতর্ক আছে। রাজ্যের প্রাথমিক স্কুলগুলির শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য মাত্র তিন কোটি টাকা এক বছরে খরচ করে রাজ্য সরকার উল্টোদিকে রাজের প্রাথমিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলির জন্য রাজ্য সরকারের বাৎসরিক ব্যয় ছ’কোটি টাকা। বিতর্ক থাকবে। সম্ভবত রাজ্য সরকার এইখানেই থেমে থাকতে চায় না। ২০১৪ সালে তফসিলি জাতি এবং উপজাতি ছাত্রছাত্রীদের জন্য আরও একটি প্রকল্প চালু করেছে রাজ্য সরকার। ৮০০ টাকা করে দেওয়া হছে এই ‘শিক্ষাশ্রী’ নামক নতুন প্রকল্পে। আলোচ্য বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বলা যায় ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প চালু হওয়ার পর রাজ্যে তুলনা মূলকভাবে নারী পাচার কমছে। যদিও আশানুরূপ নয়।
রাজ্যে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন চলাকালীন নোবেলজয়ী ভারতীয় সমাজকর্মী কৈলাস সত্যার্থী নব নির্বাচিত রাজ্য সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব জমা দিয়েছিলেন। প্রেসক্লাবে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন তিনি রাজ্য সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে সভ্যতার অভিশাপ শিশুশ্রমিক প্রথা বিলোপ এবং নারী পাচার প্রতিরোধ কর্মসূচিতে কাজ করতে আগ্রহী। ওই সাংবাদিক সম্মেলনে আমিও উপস্থিত ছিলাম।
তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘’We have been speaking to the central government and many other state governments on developing a more comprehensive policy for the protection of our children. We have also written to the Hon’ble Chief Minister of West Bengal and seek to launch a joint effort in the state against child labor and trafficking. We are hopeful that together we can eradicate this problem in our life time.’’
সূত্রের খবর, কৈলাস সত্যার্থীর প্রস্তাব নিয়ে রাজ্য সরকার ভাবনা চিন্তা শুরু করেছে। খুব সম্ভবত উৎসবের মরশুম শেষে আমরা এর বাস্তব প্রতিফলন দেখতে পাব।
সম্প্রতি Rotary India Literacy Mission ‘আশাকিরণ’ নামে একটি প্রকল্পের কাজ কলকাতা থেকে শুরু করেছে। Rotary district 3291 সেপ্টেম্বর ১৮, ২০১৬ তারিখে গোর্কি সদনে ‘Samutthan, The Great Rising, District Literary Meet’ শিরোনামে একটি সেমিনারের আয়জন করে। উলেখিত সেমিনারে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমি উপস্থিত থাকতে পেরে গর্বিত হয়েছি। সংস্থার মূল উদ্দেশ্য ঘোষণা করা হয়, সকলের জন্য ‘সর্বাঙ্গীন এবং উন্নত মানের শিক্ষা’ (Total Literacy & Quality Education) সুসজ্জিত প্রচারপত্রে ‘RILM’ ঘোষণা করছে,
‘’Rotary South Asia Society for Development and cooperation has strategized the Rotary  India Literacy Mission (RILM) to achieve ‘Total Literacy and Quality Education’. RILM has set out its T-E-A-C-H program designed to fulfill the total literacy goal.
In this mammoth endeavor, RILM has joined hands  with a wide range of stakeholders, including the state and central governments, sister organizations of the Rotary family like the Association of Inner Wheel Clubs of India. Rotaractors, Interactors Rotary community Corps, Corporate and non-government organizations......................
The Child development program of RILM is to bring/send out of school children back to school. The objective is to facilitate these children’s access to mainstream state funded primary elementary schools. The project is called ‘’Asha Kiran…a ray of hope’’. The program is currently being implemented in 8 states in India in partnership with various NGOs and will spread to the other states soon.
Asha Kiran Children are:
1.       Child (7 to 14 Yrs)
2.       Who has never been to school or
3.       Not attending school for more than 45 days without any information to school and
4.       Laggard in comparison to his/her age and class.
               As of June 2016
           RILM has entered into an agreement with 24 NGOs spread over 8 states of India to send
             32,867 out-of-school and drop out children.
          সভ্যতার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে আমরা নিজেদের চেতনার মান অনেক অনেক যোজন টেনে      আনতে পারলেও কোথাও একটা থমকে যেতে হচ্ছে। তা না হলে ‘শিক্ষার অধিকার আইন’ আমরা পেয়েছি। সভ্যতার অভিশাপ ‘শিশু শ্রমিক প্রথা’ বিলোপ আইন আমরা পেয়েছি। তবু কেন দেশের তথা এই রাজ্যের পথশিশু, প্রত্যন্ত গ্রাম ভারতের স্কুলছুট শিশুদের আমরা মূলস্রোতে ফেরাতে ব্যর্থ হচ্ছি? সভ্যতার অভিশাপ শিশুশ্রম বিষয়ে সমাজ এত উদাসীন কেন? সমাজের অন্যান্য আলোকিত বিষয়ে আমরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি হয়ত বাতাই আবার নতুন নতুন আঙ্গিকে মনে মনে অঙ্গিকার করতে হয় এই বিষয়গুলির দায় ও দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে।
২০১৩ সালের জুলাই মাসে একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের কাছে গণতন্ত্র নিয়ে এক ছাত্রের প্রশ্ন ছিল, ‘’একদিকে ভারতে মাথাপিছু আয় বেড়েছে। অথচ সার্বজনীন শিক্ষা, স্বাস্থ্যে আমরা পিছিয়ে। এটা কি গণতন্ত্রের ব্যর্থতা নয়?’’
অধ্যাপক সেনের উত্তর ছিল, ‘’অম্বেডকর বলেছিলেন, এডুকেট, অর্গানাইজ অ্যান্ড অ্যাজিটেট। আমরা যদি সেই শিক্ষাদান, সংগঠিত করার কাজই করে উঠতে না পারি, সেটি গণতন্ত্রের দোষ হবে কেন?......তাই নীতির অভাব আছে, বলা যায় না। বরং ন্যায্যতার অভাব আছে।‘’                    

           

Saturday 1 October 2016

আদি কংগ্রেস বনাম বাংলা কংগ্রেস

আদি কংগ্রেস বনাম বাংলা কংগ্রেস

লড়াইটা কতদিনের? সেই ষাটের দশক থেকে সম্ভবত শুরু। অজয় মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। এই কথা ভাবতে ভাবতে এদিন বিধান সভার দক্ষিণ দিকের প্রধান ফটক টপকে আসছিলাম। কত স্মৃতি এই বিধানসভার মেহগনি কাঠের ভারী ভারী আসবাবে, প্রাচীন গাছের শিকড়ে শিকড়ে। বিভিন্ন সভাকক্ষের অর্ধবৃত্ত ডেস্কের কোনায় কোনায়। বার্নিশ করা অভিজাত ডেস্কে আজও পুরনো চায়ের দাগ লেগে রয়েছে। কোনও দামি কাঠের চেয়ারের হাতলে পোড়া সিগারেটের ছেঁকা। কয়েক দশকের বাধ্য অবাধ্য দলীয় নেতাদের সংসদীয় অসংসদীয় সুচতুর বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ। বিধানসভার সদর ঘরে অবাধ্য সূর্যের আলো, বিদ্যুতের আলোর থেকেও জোড়াল শক্তিতে জানান দেয় ‘সত্য মেব জয়তে’ এর শক্তি। ভারত নামক একটি শিশু গণতন্ত্রের কিশলয় রচনার টানাপড়েন। এই কথা ভাবতে ভাবতে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে শরতের আগমনী শুনতে পাচ্ছি। ঘন সবুজ ধুলটে প্রাচীন গাছের পাতাগুলো শরতের শিশির সিক্ত অভিভাবকের ভাষায় কিছু বলতে চাইছে। কোথাও মাকড়সার ভাঙ্গা সংসার। পুরনো আঠাযুক্ত জালে ছোট কোনও এক পাখির পালক ঝুলছে। বিধানসভার অধিবেশন না থাকলে কি হবে। পাখিদের কলরব ভাবতে বাধ্য করছে। ‘পাখিদের ওই পাঠশালাতে কোকিল গুরু শেখায় গান/ ময়না ভালো গান শিখেছে, শুনলে পড়ে জুড়ায় প্রাণ।’  যেমন ভাবা ঠিক তেমনি এসে হাজির। একটা গাছে বসে আছে হুতোম। আমাকে দেখেই বলল, ‘’বামফ্রন্টের মানসপুত্র আদি কংগ্রেসে ফিরে এল।‘’
বললাম, ‘আদি কংগ্রেস কেন হবে? ওটা তৃণমূল কংগ্রেস।‘
হুতোম আবার বলল,  ‘’এটিম, বিটিম, বাংলাটিম, সিটিম, কত কংগ্রেস আছে তোদের বাঙলায়?’’
বললাম, ‘এসব কথার কথাদল নতুন হোক পুরনো হোক। দল থাকলেই নেতা আসবে, নেত্রী আসবে। তারা সংসদীয় রীতি নীতি মেনেই আসে।‘’
আজ হুতোম একটু রেগেই আছে। উত্তর দিল ব্যঙ্গাত্বকভাবে। ‘’ন্যাতাদের কথা বলছিস। উপ-নেতাদের কথা কেন বলছিস না? ভাগের বাবা গঙ্গা পায়। অনেকেই জানে না। চল শুভনাম ধরে ডাকি। ‘জয় বাবা গঙ্গাবাবার জয়। জয় বাবা বাংলাবাবার জয়‘’
আমার খুব খারাপ লাগল। বললাম, ‘এ আবার কি? গঙ্গাবাবা বলছ কেন? আমরা ভারতীয়রা ‘মা গঙ্গা’ বলে জানি। বাংলাবাবা আবার কে?’
হুতোম আরও চরমে উত্তর দিল, ‘’এই পুণ্য বাড়িতে বাংলার খ্যাতনামা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা এসেছেন। আমার বাংলার জন্য কত উন্নয়ন করেছেন। আর দু’চারজন স্বঘোষিত ‘বাংলাবাবা’ নাক উঁচু করে ‘বাবু উপত্যকায়’ বসে ‘তথাস্তু’ বচন নিয়ে স্মিত হাস্যে উঁকি মেরে চলে যায়। কবি শক্তি যখন বাংলা মদ খায় তখন তোরা আপত্তি করিস না। ওই গড়িবের বন্ধু। সিনেমার গল্প করে যে বাংলার দুঃখ কষ্ট বলত। সেই ঋত্বিক বাংলা খেলে তোদের কত আদিখ্যেতা। আর আমি ‘বাংলাবাবা’ বললে আপত্তি? আমাদের জাতের হাঁসকে যেমন কেউ ভুলতে পারে না,  তোদের তেমনি আছে ইতিহাস। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা। বেশি কথা বলব না। চিৎ হয়ে শুয়ে থুথু ফেল্লে নিজের গায়ে পড়ে।  জিরো আওয়ারে অধ্যক্ষ আমাকে সময় দিয়েছেন প্রশ্ন তোলার। যারা দল বদল করলেন, ওঁদের নিয়ে প্রশ্ন তোলার। আমি এখন চল্লাম।‘’ 
মানসবাবু আপনি ‘বার ভুঁইয়া’র এক ভুঁইয়া। বাংলা কংগ্রেস থেকে ‘আদি কংগ্রেস’ তথা আসল কংগ্রেসে(আপনার দাবি মত) ফিরলেন প্রদেশ কংগ্রেসের আপনার বারজন অনুগামীকে নিয়ে। তৃণমূলের মহাসাচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘’ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলো।‘’ বিতর্ক জারী থাকুক কারণ আপনি আরও বলেছেন, ‘’রাজনীতি নদীর স্রোতের মতো! সোজা পথে আর চলে কোথায়!’’ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতির বাস্তবতায় মানসবাবু আপনি যখন আকাশের দিকে মুখ তুলে আপনার শ্রদ্ধেয় পিতৃদেবকে উদ্দেশ্য করে টিভি ক্যামেরার সামনে আপনার বক্তব্য শুরু করলেন, টিভির দক্ষ ক্যামেরা পার্সন দক্ষহাতে ক্যামেরা প্যান করে আপনার ক্লান্ত মুখটা ধরল। আমরা দেখলাম আপনার ৪৬ বছরের ‘বাংলা কংগ্রেস’ নয় আদি কংগ্রেস রাজনীতি করার অভিঞ্জ মুখটা। যন্ত্রণাদীর্ণ, ক্লান্ত, শ্রান্ত মুখটা। মুখের ম্লান হাসিটা দক্ষ নেতার মতই লুকতে চেষ্টা করলেন। সম্ভবত পারলেন না। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার মেধাকে কুর্ণিশ জানাই। আমার মত একজন শ্রমজীবী সাংবাদিকের ডেস্ক থেকে। কেন জানেন? আপনি প্রথম কংগ্রেস ঘরানার এক প্রথম সারির নেতা যিনি কংগ্রেস দল ছাড়লেন, আলাদা কোনও দল বা মঞ্চ গঠন না করে। সত্তর দশক থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যেসব শীর্ষ নেতা প্রদেশ কংগ্রেস বা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ছেড়েছেন তারা হয় আলাদা দল গঠন করেছিলেন অথবা সাময়িক গোষ্ঠী গঠন করে রাজনীতিতে স্বতন্ত্র ঘরানা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। একবাক্যে বলা যায় প্রায় সবাই ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যতিক্রম একমাত্র তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
 উত্তর বিহারে একটা কথা খুব প্রচলিত আছে। সেটা হচ্ছে, ‘’রোম পোপ কা। মাধে পুরা গোপকা’’। এই অধিকার কখন তৈরি হয় আমরা জানি। সবটা ঘরানা। কিছুদিন আগে উচ্চশিক্ষিত এক প্রবীণ সাংবাদিক প্রেস ক্লাবে বলছিলেন, ‘’বাংলা কংগ্রেস থেকে যারা এক সময় আদি কংগ্রেসে এসেছিলেন তাঁদের কেউ কেউ কংগ্রেসের আদি ঘরানা ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছেনদলকে এই শতাব্দীর দাবিতে আধুনিক করে নেওয়াটা ভুল নয়। কিন্তু কোনও শকুনি মামার কাছে যদি কূটনীতি শিখতে হয় তাহলে সেই নৃপতি ‘শাহ থেকে ফকির’ হতে বাধ্য।‘’ এই সূত্রে পুনরায় উচ্চারণ করি ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়/ উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।      
প্রাসঙ্গিক হবে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃঢ়তার তুলনা করা। কারণ এটা তখনই সম্ভব যখন দলগতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে। ২০১৬ সালের জনাদেশ সেই রায় তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্ভবত দিয়েছে। ইতিহাসবিদদের পর্যবেক্ষণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ভারত নামক একটি রাষ্ট্রে জওহরলাল নেহরুর ক্ষমতা ছিল অপ্রতিহতইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরীর ভাষায় ‘’ওঁর একছত্র ক্ষমতাকে কেউ কেউ ম্যান্ডেটরি ডিক্টেটরশিপ বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ নির্বাচনের মারফৎ জনগণ ওঁর হাতে অপ্রতিহত ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের সময় অবধি ওকে বাঁধা দেওয়ার শক্তি কারও ছিল না‘’ প্রায় সকলেই একমত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রক্তে কংগ্রেসের ‘ডিএনএ’ রয়েছে। তাই ১৯৯৮ সালে তিনি যখন অজিত পাঁজা, পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় সহ একঝাক কংগ্রেস শীর্ষ নেতাকে নিয়ে কংগ্রেস দল ছাড়লেন তখনই ভাগ্যের লিখন ঠিক হয়ে গিয়েছিল বাংলার নতুন এক গাঁধিবাদী নেত্রীর। গাঁধির আলোচকরা বলছেন, ‘’গান্ধীমতে, ব্যক্তির ভূমিকা সংগঠনের চেয়েও বড়। সমাজতন্ত্রবাদে ব্যক্তির ভূমিকা খুবই সামান্য, সাধারণ গণতন্ত্রে ব্যক্তির কেবল একটা ভোটই আছে লড়বার পক্ষে। আর কিছু নেই। কিন্তু গান্ধীর স্বপ্নের ভারতে অথবা বিশ্বে, ব্যক্তির ভূমিকা কখনই কমে না। সাধারণত ব্যক্তিরা প্রায়ই খুব সুবিধাবাদী, যদি পারে তারা রাষ্ট্রের উপর, দলের উপর  নির্ভর হয়ে নিজ নিজ দায় দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে চান।‘’                           
১৯৯৮ সাল থেকে সাময়িকভাবে সারাদেশে আর্থ-সামাজিকভাবে যে টালমাটাল পরিস্থিতির উদবভব হয়, পশ্চিমবঙ্গও তাঁর থেকে বাদ যায়নি। সেই সময়কাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আমাদের রাজ্যে নব্য পুঁজিপতি এবং পেটি বুর্জোয়াদের দাপট আমরা দেখেছি। রাজ্যে তথা আমাদের দেশে সরকারি পুঁজি এবং বৃহৎ পুঁজির অভাবে মুৎসুদ্দি পুঁজির দাপটে সুস্থ সামাজিক ভারসাম্যটাই ভেঙ্গে পড়েছিল। কারণ ওইসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগুলি হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে ওঠে। এইসব সাধারন পুঁজিপতিরা ‘শিল্প (Industry)’ থেকে উদ্বৃত্ত পুঁজির মালিক কেউ নন। অথবা ধ্রুপদী ঘরানার কৃষক বাড়ির অর্থেও নতুন ‘শিল্প’ (Industry) গড়ে তোলেননি। তাই এঁদের যারা গড়ে তুললেন তাঁরা সামন্ত্রতন্ত্রের অবশেষ ভাঙ্গতে পারেননি। হয়ত সেই কারণে ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ স্লোগানেই আটকে থাকল। এবং এই কারণেই সম্ভবত আমাদের রাজ্যে ২০০৯ থেকে ২০১৩ এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিলসামাজিক ঔদ্ধত্যের ‘ব্যক্তি ঝোঁক’টাই যেন বাংলার সামাজিক সংস্কৃতি হয়ে গেছিল।
এইসব নব্য উচ্চশিক্ষিত ধনিক শ্রেনীর ব্যক্তিদের তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘হাসুলি বাঁকের উপকথা’ এবং আশাপূরণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রতি’ পড়ার জন্য পরামর্শ দিতে পারেন তাঁদের সামাজিক কারিগরেরা এবং সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘জলসা ঘর’ ছবি দেখার কথাও বলতে পারেন তাঁরা। সামন্ত্র সংস্কৃতি থেকে শিল্পায়ন সংস্কৃতির ঘরানা চিনতে সাহায্য করতে পারে। প্রখ্যাত চিনা সাহিত্যিক লু শুনের ভাষায় ‘ওলড টেলস রিটোল্ড’।          
ভারসাম্যহীন সময়টাকে আগাম আঁচ করে কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রথম সারির অভিজাত বাংলা পাক্ষিক পত্রিকা একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। ২০০৫ সালের ৩০ জানুয়ারি। বিষয় ছিল খুব সম্ভবত ‘’ ‘নির্বিরোধী’ এ রাজ্যে গণতন্ত্রের অন্তর্জলি’’? বক্তা ছিলেন সিপিএমের সাংসদ কমরেড মহম্মদ সেলিম, তৃণমূলের প্রাক্তণ সাংসদ কৃষ্ণা বসু, কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী, সাংবাদিক সুমিত মিত্র, অধ্যাপক সুনন্দ সান্যাল এবং সঞ্চালক ছিলেন অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই সভায় উপস্থিত ছিলাম একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সাংবাদিক হিসাবে। গোপনে দূত মারফৎ আমাকে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলেন কমরেড অনিল বিশ্বাস। নোটবুকে রয়েছে, সঞ্চালক অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য আলোচনার শুরুতেই মনে করিয়ে দিলেন, পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্র মুমূর্ষু, বিরোধীশুন্য। কমরেড সেলিম প্রথম বক্তা হিসাবে একথা মেনে নিয়ে বললেন, ‘’এই রাজ্যে বিরোধী রাজনীতির সুবর্ণ সুযোগ আছে। কিন্তু এখানকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অন্তঃসারশূন্য। ফলে রাজনীতির নামে তাঁরা যা করে তা নিজেদেরই বিরোধিতা। নেতৃত্বের প্রতি বিরোধিতা। দলের প্রতি বিরধীতা। অথচ সরকারের বিরোধিতা করার যে সুস্থ-রাজনীতি, তার থেকে এঁরা অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। বহুমাত্রিক বিরোধিতা করার সুযোগ থাকা সত্বেও, গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিরোধিতা করার লোকের অভাব এখানে ভীষণ প্রকট।‘’ এরপর কমরেড সেলিম টার্গেট করেন কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীকে। তিনি বলেন, ‘অস্ত্র দিয়ে হোক, অস্ত্র সংবরণ করে হোক অধীরবাবু জেলা পরিষদ দখল করেছেন।‘’
বামফ্রন্টের সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ টেনে সেদিন কংগ্রেসের সাংসদ অধীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘’পুলিশ ও প্রশাসন দলের অঙ্গুলিহেলনে কীভাবে ভোট করতে দেয় না তা আমি নিজের জীবন দিয়ে দেখেছি। ভোট এখন প্রহসন। তা না হলে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিশ হাজার আসনে তারা জেতে কী ভাবে? নির্বাচনে যদি বিরোধীদের অংশ নিতেই না দেওয়া হয় তো গণতন্ত্রের অন্তর্জলি হবেই।‘’
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসু বিরোধী রাজনীতির জন্য স্পেস চেয়ে সেদিন আবেদন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘’বামফ্রন্ট আমলে রাজ্যের মানুষ হয়ত স্টেবিলিটি পেয়েছেন, কিন্তু স্টেগনেশনের বদ্ধ জলায় আবদ্ধ হয়েছে তাঁদের ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ। আমাদের সুযোগ দিন। আমরাও কাজ করে দেখাতে পারি।‘’
সেদিনের প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসুর আবেদন সম্ভবত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কানে পৌঁছেছিল। সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো কারখানাকে কেন্দ্র করে সরকার পক্ষ এবং বিরোধী পক্ষের মধ্যে যে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল সেই বিতর্কিত পরিসর ভাঙ্গতে চেয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় কমিউনিস্টদের পিতামহ ভীস্ম জ্যোতি বসু। নিজের বাড়ি ‘ইন্দিরা ভবনে’ বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করে সমাধান সূত্র বের করেছিলেন। পরে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনও করেন। সেই সম্মেলনে আমি নিজেও ‘কলকাতা টিভি’ এর সাংবাদিক হিসাবে হাজির ছিলাম। আমার একসময়ের সহকর্মী ‘জি নিউজ’এর সাংবাদিক চয়ন কুণ্ডু আমাকে বলেছিল, দীপেন্দুদা আপনি, আমি, আমরা আজ এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। চয়ন আমাকে আপনি বলেই কথা বলত।
এটাও বাস্তব সত্য ১৯৯৮ সালের পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আর রাজ্যপাটে মন বসছিল না। তিনি তখন দীর্ঘ যাত্রাপথে ক্লান্ত, অবসন্ন এক নেতা। তাই অত্যন্ত দূরদৃষ্টি থেকে বামফ্রন্টের তথা নিজের দলের সংসদীয় নেতা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ঠিক করে গিয়েছিলেন। সাহায্য পেয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক কমরেড অনিল বিশ্বাসের। পাশাপাশি ডাঃ বিধান রায়ের মতই বিরোধী দলনেত্রীর প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছিলেন। যদি কখনও তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে রাজ্যপাট সামলাবেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে জ্যোতিবাবুর সাফল্য এবং ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু একথা মানতেই হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারটা কোনও একদিনের জন্য ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ নয়। যে কথা তৃণমূল কংগ্রেসের নীতি-নিরধারণ কমিটির সভায় তৃণমূল নেত্রী তাঁর দলের শীর্ষ নেতাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘’কেউ ঔদ্ধত্য দেখাবেন না। দল এটা মেনে নেবে না। সতর্ক করার পরেও যদি কেউ এমনটা করেন পরেরবার টিকিট পেতে অসুবিধা হবে। কেউ ‘মানবতা’ ভুলে যাবেন না।‘’
মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার হোক অথবা সিপিএম সহ বামফ্রন্টের অন্যান্য দলের রাজ্য সম্পাদকের চেয়ার। দল এবং সমাজের দায়িত্ব নিতে পারবেন এমন নেতাকেই বাছা হয়ে থাকে। সম্প্রতি যেমনটা হয়েছে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্রের ক্ষেত্রে।  
তৃণমূলের প্রসঙ্গ ছিল মানস ভুঁইয়ার দল বদলের। তাঁর নিজের ভাষায় ‘দলবদলু’। কেউ কেউ টিভির ‘টকশোতে’ প্রশ্ন তুলছেন বামফ্রন্ট জামানায় ‘দলবদলু’র সংস্কৃতি ছিল না। উত্তর আসছে বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের পরিশীলিত এজেন্ডা ছিল বিরোধীদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সিপিএমের ‘বামফ্রন্ট’ গঠনের সিদ্ধান্তই ছিল যুগান্তকারী। পাশাপাশি বিরোধী দলের নেতাদের সাদা পাঞ্জাবীর দলে টেনে নিতেও ছিল সিপিএমের ব্যতিক্রমী পারদর্শিতা। এই কারণে এই রাজ্যের সংবাদ মাধ্যমের শব্দ ভান্ডারে যুক্ত হয়েছে ‘তরমুজ’ নামক শব্দ। নির্দিষ্ট এককের জন্য নয়। বামফ্রন্টের জামানায় এই ধরণের শব্দ বিরোধী দলের অনেকের জন্যই বরাদ্দ ছিল।  বর্তমান সময়ে মসৃণ বুদ্ধিদীপ্ত রাজনীতির উচ্চারণ সম্ভবত নেই। তাই ‘দলবদলু’র মত পরিবেশ মেনে নিতে হচ্ছে। আইনের ফাঁকফোকর খুঁজে নিতে অসুবিধা হচ্ছেনা সরকারি দলের। ১৯৮৫ সালে ভারতীয় সংসদ আমাদের দলত্যাগ বিরোধী আইন উপহার দিয়েছিল। ৩১ বছর পর উপলব্ধি হচ্ছে সেই আইন নিস্তরঙ্গ নয়। পুরসভা, পঞ্চায়েতর ক্ষেত্রে এই আইনের কোনও ভূমিকা নেই বলেই আইন বিশেষঞ্জরা বলছেন। সম্ভবত সেই ফাঁকফোকরকে কাজে লাগাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস দলের ডাকসাইটে নেতারা। যেটা সম্ভবত পপুলার রাজনীতির ভাষায় ‘বদলা’ নয় ‘বদল’ বলছেন তাঁরাএই পরিভাষাই শেষ কথা নয়। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, কংগ্রেসের তিনজন এবং বামফ্রন্টের একজন এ পর্যন্ত তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের বিধায়ক পদ খারিজের আবেদন অধ্যক্ষের বিবেচনার জন্য পড়ে রয়েছে। যে হেতু বামফ্রন্টের গায়ে আঁচড় পড়েছে তাই নতুন কিছু আশা করা যায়। ভারতীয় গণতন্ত্রে জাতীয় কংগ্রেসও নতুন ভাষার অভিধান আমাদের ধারাবাহিকভাবে অনুমোদন করেছে। সূত্রের খবর রাজ্য কংগ্রেসের পরিষদিয় দলনেতা আব্দুল মান্নান দিল্লি গিয়েছিলেন। শীর্ষ আদালতে দলত্যাগ-বিরোধী আইনের কার্যকারিতা বাড়ানোর আর্জি জানিয়ে একটি মামলা করার জন্য। সংবাদ সংস্থার খবর সুপ্রিম কোর্টে আরও একটি মামলা হতে পারে। যেটা সম্ভবত হবে জনস্বার্থের মামলা। সেই মামালার আবেদনে জানতে চাওয়া হবে কোনও দলের নির্বাচিত বিধায়ক দল বদল করলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণার দায়ে কেন তার বিধায়ক পদ খারিজ হবে না? বিষয়টি সময় সাপেক্ষ বিষয়। আমরা অপেক্ষায় থাকব উন্নত গণতন্ত্রের পদচারণের জন্য।   
রাজনীতি সম্ভবনার শিল্প হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে একটা নির্বাচনী স্লোগান বিজেপি বাজারে এনেছিল ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’। সেটা কি আদৌ সম্ভব? তেমনি বর্তমানে কেউ যদি ‘কংগ্রেস মুক্ত বাংলা’ ভাবেন এটাও কি সম্ভব? অথবা বাংলা তথা ভারতে সিপিএম তথা বামপন্থীদের কোনও স্থান নেই ভেবে নেওয়া হয়। এই ভাবনাকে  অনুমোদন করা আদৌ সম্ভব নয়। আমাদের মত নিরপেক্ষ তথা ধর্ম নিরপেক্ষ সাংবাদিক, লেখক, সমাজকর্মীদের ভাষায় গণতন্ত্রের সহজ পাঠ আছে বলেই পশ্চিমবঙ্গে ‘বিজেপি’ এবছরের বিধানসভা ভোটে তিনটে আসন পেয়েছেভারতীয় গণতান্ত্রিক দল বলেই বিজেপি তার দলের কর্মসূচি সংসদীয় গণতন্ত্রের সভ্যতা মেনেই প্রসারিত করবে। এমনটা আমরা আশা করতেই পারি। যে সব লেখকদের কব্জিতে নিরপেক্ষ এবং গণতন্ত্রের ধাগা বাঁধা আছে তাঁরাই একথা বলতে পারে। কারণ তাঁরা কব্জির জোরে খায়।
এই সূত্রে আমরা মনে করতে পারি জওহরলাল নেহরুর চিন্তা, কাজ সবকিছুকে এক কথায় নাকচ করে দেওয়ার চেষ্টা। সেই প্রসঙ্গকে সামনে রেখে ২৬ অগস্ট, ২০১৬ তারিখে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, ‘’নেহরুকে ‘জেন্টল কলোসাস’ আখ্যা কোনও মোসাহেব দেননাই, দিয়াছিলেন এক বিরোধী বামপন্থী নেতা, হীরেন মুখোপাধ্যায়।‘’.........সম্পাদকীয়র প্রথম স্তম্ভে লেখা হয়েছে, ‘’আরও এক প্রধানমন্ত্রী বর্তমানের নিকট কৃতঞ্জতা দাবি করিতে পারেন। তাঁহার চিন্তা ও চেষ্টায় অনেক ভুল ভ্রান্তি ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু একবিংশ শতকের বিশ্ব অর্থনীতির চেহারা কী হইবে, এবং সেই মঞ্চে নিজের আসন করিয়া লইতে হইলে ভারতকে কোন পথে হাঁটিতে হইবে, তাহা দেখিবার একটি উদ্যোগ তিনি করিয়াছিলেন। রাজনীতিতে ‘বহিরাগত’ ছিলেন বলিয়াই হয়তো আর এক বহিরাগত স্যাম পিত্রোদার হাতে টেলিকম বিপ্লবের গুরুদায়িত্ব সঁপিয়া দিতে পারিয়াছিলেন। যে তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকমিউনিকেশনের জোড়া ঘোড়া ভারতীয় অর্থনীতির রথ টানিয়া লইয়া যাইতেছে, উভয়ের পিছনেই রাজীব গাঁধির ভূমিকা অনস্বীকার্য, তাঁহার এই অবদানের উল্লেখ হয় না বলিলেই চলে। কংগ্রেসও এই রাজীবকে ভুলিয়াছে।‘’ 
আমরা গ্রীক নাটকের দর্শনের কথা মনে রাখতে পারি। গ্রীক নাটকের লক্ষণীয় দিক হল, যুদ্ধে সব নায়ক হেরে যায়। কিন্তু হেরে যাওয়া পর্যন্ত সে লড়াই থেকে পিছিয়ে আসে না। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি ঘটনায় ভারতীয় গণতন্ত্রের সর্বদলীয় ঐকতান আমদের সেই সত্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে  দিল।