Wednesday 25 July 2018

একজন ব্যক্তির মানসিক বিকৃতি? না-ক্ষয়িষ্ণু সমাজের অধঃপতনের ইঙ্গিত?




দীপেন্দু চৌধুরী
কলকাতা শহরে কুকুরের সঙ্গে ‘যৌন সংসর্গ’ (সেক্স) করার অপরাধে গ্রেপ্তার এক যুবক। ঘটনাটি ঘটেছে চলতি বছরের জুলাই মাসে বরিষার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার প্রান্তিক চ্যাটার্জী বিষয়টি পুলিশের নজরে আনেন। তার নিজের ভাষায় ‘’Mahato tied the dog’s mouth a rope. The dog’s mouth was tied.’’
‘’আমি যখন হাতেনাতে ধরি তখন কুকুরটির মুখ বাঁধা ছিল।‘’ প্রান্তিকবাবু বলেন। কমলেশ মাহাতো নামে অভিযুক্ত যুবকটি  বিহারের বাসিন্দা কলকাতায় শ্রমিকের কাজ করে একটি পেপার মিলে। পুলিশ সূত্রে খবর সে থাকে লেকটাউন পাতিপুকুর অঞ্চলের শ্রমিক আবাসনে প্রান্তিক চ্যাটার্জীর এক বন্ধু ১৫ জুলাই রাত্রি ৯টার সময়ে ঘটনাটি ঘটতে দেখে। প্রান্তিক বাবুর উদ্যোগে কুকুরটিকে বেলগাছিয়া পশু হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতালের ডাক্তার মাদি কুকুরটির শারিরীক পরীক্ষা করেন। এবং কুকুরটির যে শ্লীলতাহানি করা হয়েছে সেই রিপোর্ট অভিযোগকারী প্রান্তিক চ্যাটার্জীর হাতে তুলে দেন।
ভারতীয় পেনাল কোডের ৩৭৭ ধারায় (A case under section 377 [vouluntarily having carnal intercourse against the order of nature] was registered.) অভিযোগ জানান হয়। পুলিশ সূত্রে খবর কমলেশ তার জবানবন্দিতে স্বীকার করেছে সে আগেও মাদি কুকুরের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছে। পুলিশ সূত্রে আরও খবর, তাঁকে ওইদিন বারাসত কোর্টে তুললে তার দোষ প্রমাণিত হয়। পুলিশ জানায় কমলেশ বিবাহিত। তার তিনটে সন্তান আছে। অভিযুক্ত যুবকটি পুলিশের কাছে বলেছে সে একাধিকবার রাস্তার মাদি কুকুরের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করেছে। পুলিশের অনুসন্ধানে কমলেশের প্রতিবেশিরাও বলেছে যে সে আগেও এই ধরণের কাজ করেছে। কমলেশের দোষ প্রমান হলে তার যাবজ্জীবন কারাদন্ড হতে পারে।                   
 কি বিচিত্র এই দেশ! কুকুরটি যখন তার থেকে উন্নত প্রাণী মানুষের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছিল তখন তার মুখ বাঁধা ছিল। তদন্তে এমনটা উঠে এসেছে। তার মানে কুকুরটা চিৎকার করতে পারেনি। কি নির্মম! মানুষ কি নির্মম হতে পারে! একটি মনুষ্যেতর প্রাণীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ? কতটা বিকারগ্রস্ত হলে এই কাজ করা সম্ভব? প্রশ্ন উঠতেই পারে। কমলেশ নামে যুবকটি বিবাহিত। তিনটে সন্তান আছে। তার মানে সে সামাজিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত। তবু সে এই কাজ করতে পারল? তার রুচিতে আটকাল না? 
ডারউইনের বিবর্তনবাদ নিয়ে লেখার জন্য সমাজ বিঞ্জানীরা আছেন। এই ধরণের অকালপক্ক বাতুলতা দেখাতে চাওয়ার সাহস কতজন অর্জন করতে পারে? কিন্তু সহজ সরল সাধারণ বুদ্ধিতে এটুকু আমরা জানি যে বিবর্তনের সময়কালকে মনে রেখেও যুগ যুগান্তধরে বিভিন্ন কর্মকান্ডের মানুষই একমাত্র প্রাণী যে শুধুমাত্র ইতিহাস সৃষ্টির বা ইতিহাসের উপাদন নয়। ইতিহাস লিখে রাখার, ইতিহাস নির্মাণের অন্যতম কারিগর। বলতে চাইছি অন্য প্রাণীর মতো মানুষও প্রকৃতির নিয়মকানুন মানতে বাধ্য। আবার এটাও ঠিক সেই সব নিয়মকানুনকে নিজের তথা সমাজ বিকাশের প্রয়োজনে প্রয়োগ করার ক্ষমতাও মানুষের থাকে। মানুষ এটা পারে কারণ প্রাজাতিকভাবেই সে উন্নত মস্তিকের অধিকারী। জীবজগতে যেটাকে তুলনাহীন বলা হয়ে থাকে। উন্নত মস্তিস্ক হওয়ার কারণে মানুষ উদ্ভাবনী শক্তির অমিতধিকারী। পাশাপাশি আত্মসচেতনতার কারণে আত্মনির্মাণেও আলোচ্য প্রায়োগিক শক্তি মানুষ কাজে লাগাতে পারে।
কিন্তু সেই আদিম বন্যযুগ থেকে আজও মানুষের মনুষ্যত্বই নিজেদের কাজের ভুল ঠিক নিয়ন্ত্রণ করছে। মনুষ্যত্বের বহুমুখী বিকাশকেও আটকে দিতে চায় মানুষ নামক উন্নত প্রজাতির প্রাণীঈর্ষা, ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা, লোভ, ভয়, মানসিক আলস্য আমাদের সহজাত প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আমাদের সামাজিক সম্পর্ক, সহজাত অনুসন্ধিৎসা, যুক্তিবাদী মন, বিবেক, প্রেম, মানুষকে সুশৃঙ্খল বন্ধনে বেঁধে রাখে। সামাজিক সুরক্ষার চাবিকাঠি হিসেবে এই উন্নত চেতনা আমাদের সাহায্য করে। পাশাপাশি উল্টো দিকটাও রয়েছে, উন্নত প্রাণী হিসেবে মানুষ সহজাত বোধ বুদ্ধি নিয়ে সুস্থ এবং গঠনমূলক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে থাকে। সেই সুস্থ প্রতিযোগিতা একটা সময় দ্বেষ, ঘৃণা, বিদ্বেষ গড়ে তুলতে পরিসর ছেড়ে দেয়। মানুষ নিজের স্বার্থকে বড় করে দেখতে সামাজিক বন্ধন ছিঁড়ে বেড়িয়ে যায়। শুরু হয় বিবেকহীনতার পর্ব যেটাকে বলা হয়ে থাকে ব্যক্তি সংঘর্ষ। এটাই বাড়তে বাড়তে সামাজিক মূল্যবোধ ভাঙতে থাকে। সমাজ নামক প্রতিষ্ঠানের সর্বনাশ অনিবার্য হতে থাকে।
আড়াইশো শব্দের এই প্রেক্ষাপট নির্মাণ করছে একজন মানুষ। করছে নয় করতে বাধ্য হচ্ছে। মাদি কুকুরকে ধর্ষণের খবরটি আমাদের কারও কারও নজরে পড়ে থাকতে পারে। আমাদের রাজ্যে একটি কুকুরকে ধর্ষণ করেছে একটি যুবক!  অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা। উন্নত প্রাণীর একজন জীব তার থেকে হীনতর এক জীবের সঙ্গে যৌনসঙ্গ করে আনন্দ লাভ করছে? আনন্দ উপভোগ করছে? এ কোন সভ্যতায় আমরা বাস করছি? মানুষের রুচি কতটা নিম্নগামী হলে এই ঘটনা ঘটতে পারে? সামাজিক বন্ধনের এ কোন অবক্ষয়! সঙ্গমের সময়ে সেই কুকুরটির কী অবস্থা হয়েছিল? অবলা প্রাণীটি নিজে কী কিছু বলতে পারবে? তার নিজের সম্প্রদায়ের ভাষায়?  কুকুরের আইনজীবীর দায়িত্ব নিয়ে সেই ব্যখ্যা কতটা প্রয়োজন আছে সেটা ভারতীয় আইন বলবে। তবে পুলিশ সূত্রে খবর ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এবং অভিযুক্ত ছেলেটি দোষ স্বীকার করেছে। সে নাকি আগেও এই ধরণের ঘটনা ঘটিয়েছে। ‘ঘটনা’ এবং ‘ঘটিয়েছে’ এই দু’টি শব্দ আমাদের সামনে আছড়ে পড়ল না? আমরা কী সুস্থ সামাজিক উন্নতপ্রাণী হিসেবে এটা ভাবতে পারি? আমাদের মনন, চৈতন্য, বিবেক, শুভবোধ এসব কোথায় হারিয়ে গেলে একটি পশুর সঙ্গে যৌনক্রীয়ায় মাততে পারি? প্রশ্ন কী তোলা যায় না যে ছেলেটি ‘যৌনকর্মী’-দের পাড়া চেনে না? না ওই পাড়ায় যাওয়ার মতো ওর আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই? এটা যারা তদন্ত করছেন তাঁরা বলতে পারবেন। আবারও প্রশ্ন তোলা যায় ছেলেটি বিবাহিত। ওর তিনটে সন্তান আছে। তবু? তবু! এই ভাবে? এই ভাবে? সমাজ বলে কি সে কিছু চেনে না? না চিনতে চায় না? মনঃস্তত্ববিদ, সমাজ বিঞ্জানীরা এই ঘটনার ব্যখ্যা দিতে পারবেন। এটা কোন ধরণের মানসিক বিকৃতি? বিকৃতি বাড়তে বাড়তে আরও কত নীচে আমদের নামতে হবে? কে বলে দেবে? কার কাছে প্রশ্ন করব?
খুব সম্ভবত নব্বইয়ের দশকে বহুল প্রচারিত প্রথমসারির একটি সাপ্তাহিকের শারদীয় সংখ্যায় একটি উপন্যাস লিখেছিলেন বর্তমান সময়ের একজন লেখক। সেই উপন্যাসে ছাগলের সঙ্গে একজনের সঙ্গমের কথা উল্লেখ করেছিলেন সেই লেখক। কয়েক দশক আগে প্রচার মাধ্যমের এতটা রমরমা ছিল না। ফলে গ্রাম-গঞ্জের এই ধরণের খবর খুব একটা বাইরে আসার সুযোগও ছিল না। উপন্যাসটি প্রকাশের পরে বিষয়টি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়। বিভিন্ন ধরণের মত উঠে আসে। যদিও উন্নত প্রাণী হিসেবে মানুষ এই বিষয়টির চর্চা এক সময়ে ছেড়ে দেয়। কেউ কেউ ‘বটতলার সাহিত্য’ বলে উপন্যাসটাকে দেগে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু লেখক তার অভিঞ্জতার মানদণ্ডে একটা খন্ডচিত্র আমাদের সামনে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সঙ্গে তুলে ধরেছিলেন।    
বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে সবার নজরে পড়েনি। কয়েকজনকে বলার পরে তাঁরা সোচ্চারে চিৎকার করে ওঠে। কেউ কেউ বলে, একটা অবলা, নিরীহ, নির্জীব পশুর সঙ্গে কেউ এই ধরণের ব্যবহার করতে পারে? কতটা মানসিক বিকৃতির শিকার হলে এই কাজ করা সম্ভব? ছেলেটি কী ‘ড্রাগস’ নেয়?  তাঁরা প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে ফিরে আসে বর্তমান ভারতে শিশু ধর্ষণের মতো ঘটনায়। তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসে আরও একটি প্রসঙ্গ ‘ছেলেধরা গুজব’-এ মৃত্যু। ভারতে ছেলেধরার গুজবে আক্রান্তের সংখ্যা কত? বিভিন্ন রাজ্যের পরিসংখ্যান যোগ করলে দাঁড়ায় এ পর্যন্ত ৭০ জন মানুষ গণপ্রহারে আক্রান্ত। সম্প্রতি হায়দরাবাদে একজন ট্রান্সজেন্ডার খুন হওয়ার পর পরিসংখ্যান বলছে আমাদের দেশে গণপিটুনিতে গত ১৮ মাসে মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনের। ভারতে গণপিটুনির ঘটনায় সুপ্রীমকোর্ট উদ্বিগ্ন। ১৭ জুলাই দেশের উচ্চ আদালত গণপিটুনির ঘটনাকে তীব্র ভাষায় নিন্দা করেছে। এবং এই ঘটনার মোকাবিলায় সংসদকে বিশেষ আইন আনার পরামর্শ দিয়েছে। ২১ জুলাই কলকাতায় শহীদ দিবসের জনসভায় তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘’গণপিটুনিতে মানুষ মারা যাচ্ছে। মানুষে মানুষে বিভেদ তৈরি হচ্ছে।‘’ লোকসভার বর্ষাকালীন অধিবেশনে ২৩ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বিবৃতি দিয়ে উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন। গণপিটুনির ঘটনায় দোষীদের শাস্তির দাবি জানান কংগ্রেসের মল্লিকার্জুন খড়্গে। সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম বলেন, ‘’গণপিটুনির নায়কদের মালা প্রালে ওই অবস্থাই হবে।‘’     
শিশু অপহরণ এবং শিশু ধর্ষণ সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় সরকারের ন্যাশন্যাল ক্রাইম ব্যুরো (এনসিআরবি) ওই রিপোর্টে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে সারা দেশে অন্যান্য ফৌজদারি অপরাধের তুলনায় শিশু অপহরণের হার অনেক বেড়ে গেছে। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ এই পাঁচ বছরে শিশু অপহরণের হার দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। সাধারণ ক্ষেত্রের অপহরণের হার বাড়লেও এনসিআরবি-র তথ্য বলছে শিশু অপহরণের হার বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। ২০০৬ সালে শিশু অপহরণের হার ছিল ২৩ শতাংশ। ২০১৬ সালে ছিল ৬০ শতাংশ। বৃদ্ধির হার উল্কার গতিতে বাড়ছে। ২০১৮ সালের এনসিআরবি-র সাম্প্রতিক এই তথ্য ক্ষয়িষ্ণু সমাজের চলমান ছবিটা আমাদের সামনে আরও প্রকটভাবে তুলে ধরেছে। রিপোর্টে আছে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে শিশুদের উপর ধর্ষণের ঘটনা ৮২ শতাংশ বেড়েছে। এই ঘটনায় আমাদের যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। কিন্তু উন্নত গণতন্ত্রের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনা দেখুন। ২০ জুলাই, ২০১৮ ইউএসটুডে সূত্রে খবর, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও রাজ্যে ১০০-এর বেশী ছাত্র যৌন নিগ্রহের শিকার। তাঁদের অভিযোগের আঙ্গুল জনৈক প্রাক্তন টিম ডাক্তারের বিরুদ্ধে। উন্নত মানবিক এবং গণতন্ত্রের দেশেও এই অভিঞ্জতার খবরের সঙ্গে আমাদের আলাপ করিয়ে দেয় মার্কিন সংবাদ মাধ্যম।
শুধুমাত্র শিশু অপহরণ, ধর্ষণ নয়। সম্প্রতি কলকাতার উপকন্ঠে একজন মৃত শিশুর চোখ উপড়ে নেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে কলকাতা শহরের একটি সরকারী হাসপাতালেএই খবরও আমরা সংবাদ মাধ্যম এবং এনজিও সূত্রে পাই। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, শিশুটির পরিবার ৮ জুলাই, ২০১৮ বেলঘড়িয়া থানায় এফআইআর করে। ১২ জুলাই ভবানীপুর থানাতেও একটি অভিযোগ দায়ের করেন তারা। তাঁদের অভিযোগ হাসপাতালে শিশুটির মৃত্যুর পরে তাঁদের হাতে যখন দেহ তুলে দেওয়া হয় তখন শিশুটির দু’চোখে মোটা, গোল ব্যান্ডেজ বাঁধা ছিল। এই অভিযোগ পাওয়ার পরে পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। মর্মান্তিক এই ঘটনার জন্য কাকে বা কাদের দায়ী করবেন? এটাও কী মানবতার অবক্ষয় নয়। ক্ষয়িষ্ণু সমাজের অধঃপতনের ইঙ্গিত নয়? কার কাছে কৈফিয়ৎ চাইবেন? কে কাকে উত্তর দেবে? উন্নত মননের, উন্নত চেতনার মানুষের অঞ্জাতসারেই কী এইসব ঘটনা ঘটছে? দেশের বিবেকমান মানুষ আছেন, আইন আছে, আদালত আছে, প্রশাসন আছে তবু মানুষ এত নীচে নামছে? কেন?
সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির বিকাশ হয়। একুশ শতাব্দীতে আমরা পেয়েছি ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ নামক এক শক্তিশালী মাধ্যম। যে মাধ্যমে ‘ ‘পর্ণগ্রাফি’-র যেমন রমরমা পাশাপাশি দেখলে প্রাথমিক শিক্ষার হার কতটা বেড়েছে? সমাজ কতটা সচেতন হয়েছে? কেন কমবয়সী মেয়েরা আজ আক্রান্ত? আধুনিক প্রযুক্তির যেমন আশীর্বাদ হিসেবে আমাদের কাছে আসে আবার অভিশাপের দিকটাও থাকে। একটি উন্নত অর্থনীতির দেশে ‘স্মার্টফোন’ কর্মক্ষেত্রে যতটা প্রয়োজন দাবি করে, উন্নতশীল রাষ্ট্রে কি সেই একই দাবি করা যায়? অনুন্নত দেশের অবস্থা কী হতে পারে? অথচ কম দামের সস্তার ‘স্মার্টফোন’ বাজারে সহজলভ্য। ইন্টারনেট সহযোগে বিভিন্ন পোর্টালের মাধ্যমে কমবয়সী ছেলেমেয়েরা খবরের মোড়কে পণ্য-সংস্কৃতি তথা পর্ণ-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে।       
প্রখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব এবং বর্তমানে বাংলা সাহিত্য অ্যাকডেমির সভাপতি শাঁওলী মিত্র ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে...’ নামে তার একটি বইয়ের প্রথম প্রবন্ধটি লিখেছেন নারী নিগ্রহ এবং কাপুরুষতা বিষয়ে। ‘এরকম ঘটেই থাকে’ শিরোনামে তিনি লিখছেন, ‘’ইতিহাসের যত পিছনেই হঠি না কেন, পৃথিবীর যে দেশেই যাই, তাপসীরা ছিল, থাকে। এ বড় দুর্ভাগ্যের এবং কলঙ্কের ইতিহাস। আর বর্তমান ইঙ্গিত দেয়, তাপসীরা শুধু ছিল নয়, তাপসীরা থাকবে। যে তন্ত্রের ধব্জাধারীই থাকুন না কেন শাসনপ্রক্রিয়ার কান্ডারী, নারীর এ অপমান সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে চলবেই।‘’ (পৃষ্ঠা- ১)
 শাঁওলীদি আরও লিখছেন ‘’.........কাপুরুষদের পৌরুষ দেখাবার সবচেয়ে প্রশস্ত জায়গা যে সত্যিই এইটা তা বিশ্বসুদ্ধ লোক জানেন এবং মানেন। আর সেইমতই ব্যবহার করে থাকেন জীবনে। ইবসেন কবে যেন ডাঃ স্টকমানকে দিয়ে বলিয়েছিলেন, ‘’এ দেশে পুরুষ নেই একটাও, সব কাপুরুষ!’’ তাঁরা এস্টাব্লিশমেন্ট-এর বিপক্ষে গিয়ে ডাক্তারের বৈঞ্জানিক আবিষ্কারের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সমর্থন করতে ভয় পেয়েছিল। আমার কেমন ধারণা হয়, যারা এইরকম পদক্ষেপ নিতে ভয় পান, সাহসে ভর করে সত্যি কথা বলতে ভয় পান, তাঁদেরই নিজ নিজ পৌরুষ সম্বন্ধে এক অদ্ভুত হীনমন্যতা জন্মায়। আর সেই থেকেই বোধহয় অনেক অস্বাভাবিক মানসিকতা তৈরি হয়, যা অনেক সময়ে জন্ম দেয় বিকৃতির। মনোবিঞ্জানী বলতে পারবেন এ অনুমান অমূলক কিনা!’’ (পৃষ্ঠা- ১, প্রকাশক- অর্ঘ, পঞ্চম বৈদিক, ২০০৭)                                                                               

Wednesday 18 July 2018

পিতৃতান্ত্রিক সংসদীয় গণতন্ত্রে রাজনীতির আমলাতন্ত্র




দীপেন্দু চৌধুরী
বিংশ শতাব্দী অথবা উনবিংশ শতাব্দীর ভারতেও একটা সময় মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা আদিবাসী সমাজে প্রকট ছিল। বিংশ শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে আমি আসাম, মেঘালয়ের কয়েকটি পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করেছিলাম। সেই সময় আমার এই বিষয়ে কিছুটা অভিঞ্জতা হয়েছিল। এছাড়া আমাদের বীরভূম জেলা ছোট নাগপুর সংলগ্ন হওয়ার কারণে আমরা ছোট বয়স থেকেই আদিবাসীদের জীবন যাত্রা দেখতে অভ্যস্ত।     ইতিহাসবিদরা এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করতে পারবেন। পাহাড়ি অঞ্চলে এই ব্যবস্থা আজও অনেকটা দেখা যায়। যদিও আমাদের দেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো আধুনিক হয়ে গড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার প্রসার হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রচার মাধ্যমের রমরমার কারণে তথা-কথিত ‘বাবু-সমাজ’-এর প্রভাব প্রত্যন্ত পাহাড়ি অঞ্চলেও পড়েছে। সময়ের নিয়মে সেইসব অঞ্চলেও পিতৃতান্ত্রিক প্রভাব বর্তমানে ব্যপকভাবে লক্ষ করা যায়।
প্রশ্নটা আসছে এইখান থেকেই। ভারতের পিতৃতান্ত্রিক সংসদীয় গণতন্ত্রে মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ নিয়ে সিদ্ধান্ত ঝুলে আছে। কত বছর হবে? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৭১ বছর অতিবাহিত। কিন্তু একটি আধুনিক গণতন্ত্রের আইনসভায় মহিলাদের আসন পুরুষদের সমানুপাতিক নয়। দেশের প্রথম সারির দুটো প্রধান রাজনৈতিক দল পরস্পরকে দোষারোপ করতে ব্যস্ত। বিজেপি আবার অভিযোগ তুলছে দলিত দলগুলির নেতৃত্ব ভোট ব্যাঙ্কের কারণে এই সংরক্ষণ চাইছে না। যদিও কংগ্রেস নিয়ে বিজেপি এই অভিযোগ করতে পারবে না। কারণ ইউ পি এ জামানায় আমরা মহিলা রাষ্ট্রপতি এবং মহিলা অধ্যক্ষ পেয়েছি। মহিলা রাজ্যপালও ওই একই সময়ে আমাদের দেশ পেয়েছে সংসদের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে মহিলা প্রতিনিধি বসতে পেড়েছিলেন, ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের উজ্জবল ব্যক্তিত্ব সনিয়া গাঁধির উদ্যোগেইউপিএ সরকারের তৎকালীন চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধির আন্তরিক উদ্যোগে এটা করা সম্ভব হয়েছিল। কংগ্রেসের দাবি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধি পুরসভা-পঞ্চায়েতে মহিলা সংরক্ষণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। যদিও ভারত এর আগে কংগ্রেস দলের মহিলা প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে।  আইনমন্ত্রক সূত্রে খবর, সম্প্রতি কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ একটি চিঠিতে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধিকে লিখেছেন, ইউপিএ শরিকদের মতান্তরের কারণে ইউপিএ আমলে এই বিলটি সংসদে পাশ হয়নি। বিলটির মেয়াদ শেষ হতে দিয়েছিল কংগ্রেস।
পরের ঘটনাগুলি আমরা উল্লেখ করি। এক শ্রেণীর সামন্তপ্রভুদের রাজনৈতিক বিরোধিতায় ১৪ বছর ধরে আটকে ছিল মহিলা সংরক্ষণ বিল। ১৯৯৬ সালে বিলটি সংসদে প্রথম পাশ হয়। কিন্তু সংসদে বিরোধিতার কারণে তিন তিনবার বিলটির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এবং আটকে যায়। সনিয়া গাঁধির উদ্যোগেই ২০১০ সালে রাজ্যসভায় ওই বিল পুনর্বার পাশ হয়। সেই বছরও বিল পাশের সময় সংসদের উচ্চকক্ষ রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। বিজেপি দলেও এই বিল নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। কারণ ৩৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হলে পরবর্তী নির্বাচনগুলিতে অনেক পুরুষকে প্রার্থীপদ খোয়াতে হবে। তবে বিজেপি সূত্রে খবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সহ কয়েকজন শীর্ষনেতা এই বিল আনার পক্ষে। কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা সনিয়া গাঁধি এটা আঁচ পেয়েই একটি চিঠি লেখেন। এবং কংগ্রেসের মহিলা সেলকে স্বক্রিয় করতে মাঠে নামান। 
২০১৭ সালের শেষের দিকে সনিয়া গাঁধি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে একটি চিঠি লিখে মহিলা বিল পাশ করানোর অনুরোধ করেন। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীকে সনিয়া গাঁধি এই চিঠি লেখার পর সুস্মিতা দেব এবং প্রিয়ঙ্কা চতুর্বেদীর নেতৃত্বে পাঁচজন কংগ্রেস মহিলা নেত্রীকে দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করান। মহিলাকংগ্রেসের যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনের বক্তব্য ছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ‘বেটি বচাও বেটি পড়াও, তিন তালাক, মহিলা প্রতিরক্ষামন্ত্রীর মতো বিষয়গুলি সামনে এনে নারীদরদি ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চাইছেন। যদি সেটা সত্যি হয় তাহলে কেন শীতকালীন অধিবেশনে মহিলা বিল পাশ করানোর কথা ভাবা হচ্ছে না? কারণ এটা সংবিধান সংশোধনী বিল। এই বিলকে কার্যকরী করা এক দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। যদিও ২০১৭ সালের শীত, ২০১৮ সালের গ্রীষ্ম থুরি বাজেট অধিবেশন পেরিয়ে বর্ষা এসে গেল। কিন্তু মহিলা সংরক্ষণ বিল আজও আলোর মুখ দেখতে পেলনা। ২০১৭ সালের মহিলা কংগ্রেসের যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে আরও বক্তব্য ছিল, এই বিল শীতকালীন অধিবেশনে পাশ করাতে না পারলে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটে আইন রুপায়ন করা কঠিন হয়ে পড়বে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে লেখা চিঠিতে সনিয়া গাঁধি লিখেছিলেন, ‘’২০১০ সালে রাজ্যসভায় বিলটি পাশের পর নানা কারণে লোকসভায় পাশ করানো যায়নি। লোকসভায় আপনার সংখ্যা গরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে বিলটি পাশ করান। মহিলাদের ক্ষমতায়নের লক্ষে কংগ্রেস তা পূর্ণ সমর্থন করবে।‘’
পাশাপাশি বিজেপির উপলব্ধি নির্মলা সীতারামনকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী করার পর থেকে বিজেপি দলের মহিলাদের সমর্থন বেড়েছে। এবং মহিলাদের ক্ষমতায়নের পক্ষে বিজেপি নেতৃত্ব এই বারতাও দেওয়া গেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে সেটাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই বিল পাশের পুরো কৃতিত্বও নিতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিজেপির এক সাধারণ সম্পাদক বলেছিলেন, ‘’বিলটি সংসদের পরের অধিবেশনে আনার কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।‘’ তারপরেও গঙ্গা-যমুনা দিয়ে কালো-সাদা জল বয়ে গেল কিন্তু মহিলা সংরক্ষণ বিল যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরে রয়ে গেল।
বিলটি পাশ হলে তা কতটা গুরুত্ব দাবি করতে পারে সেটা কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি আগেই টের পেয়েছিলেন। চলতি বছরের মে মাসে তিনি মহিলা কংগ্রেসকে তৈরি হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এক-তৃতীয়াংশ আসনে মহিলা প্রার্থী বাছাই করতে রাহুল গাঁধি সর্বভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী সুস্মিতা দেবকে বিষয়টি নিয়ে তৃণমূল স্তরে সক্রিয় হওয়ার জন্য বলেন। পরে সুস্মিতা দেব বলেন, ‘’...‘পরছায়া’ প্রার্থী চান না রাহুল গাঁধি। পঞ্চায়েতে ভোটে যেমনটা হয়ে থাকে। আমাদের সভাপতির নির্দেশ বলুন বা তার ইচ্ছে কেউ স্বামী বা দাদার বকলমা হয়ে ভোটে দাঁড়াবেন না। মহিলা কংগ্রেস নেত্রী হিসেবেই সংরক্ষিত আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।‘’
ওইদিন সুস্মিতাদেবী আরও বলেন, ‘’আমাদের দল যাতে হঠাত করে কোনও সঙ্কটে না পড়ে সেই ব্যাপারে মহিলা কংগ্রেস বেশ কিছু পদক্ষেপ করার জন্য তৈরি হচ্ছে। প্রথম পর্বে থাকছে, মহিলা কংগ্রেসের বিভিন্ন উপ-শাখা গঠনে জোর দেওয়ারাজ্যে রাজ্যে গড়ে তোলা হয়েছে মহিলাদের ‘লিগ্যাল সেল’। মহিলা কংগ্রেসের একটি রিসার্চ সেলও তৈরি করা হয়েছে। যুব কংগ্রেসের মতো ‘যুব মহিলা কংগ্রেস’ গঠন করা যায় কিনা তা নিয়েও ভাবনাচিন্তা শুরু করেছি আমরা‘’
সিপিএম দল থেকেও একই দাবি উঠেছে। দলের ২২তম পার্টি কংগ্রেসে হায়দরাবাদে মহিলা বিল সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব আনেন সূর্যকান্ত মিশ্র। এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত এই পার্টি কংগ্রেসে সূর্যকান্ত মিশ্রের আনা প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, আইনসভায় অবিলম্বে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণের বিলকে আইনে পরিণত করতে হবে। পার্টির ২২তম কংগ্রেস এই দাবি জানাচ্ছে। দলগতভাবে আহ্বান জানানো হচ্ছে যে, বিজেপি সরকারকে এই বিল যাতে দিনের আলো দেখতে পায় তার জন্য আইনে পরিণত করতে হবে। এটাকে বাধ্য করানোর জন্য সমস্ত অংশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সোচ্চার হতে হবে। প্রস্তাবটি উত্থাপন করে সূর্যকান্ত মিশ্র আরও বলেছিলেন, ‘’মহিলাদের সমানাধিকার দেওয়ার দাবিটি দীর্ঘদিন ধরে উপেক্ষিত। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বেজিং কনভেনশনে এবিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণের পর সমস্ত রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানানো হয়েছিল, আইনসভায় মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণের। বিশ্বের দু’ই-তৃতীয়াংশ কাজই মহিলারা করে। যদিও তাঁরা ভোগ করে এর খুবই সামান্য অংশ। সিপিএম প্রথম থেকেই ধারাবাহিকভাবে এই প্রস্তাবের পক্ষে লড়াই করে আসছে।‘’
তৃণমূল কংগ্রেস দলগতভাবে কংগ্রেসের ডিএনএ। তারাও সংসদে ৩৩ শতাংশ সংরক্ষণের পক্ষে। চলতি বছরে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতার ধর্মতলায় এক জনসভায় বলেন, ‘’আমরা ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ করেছি। আমাদের নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধি সংখ্যা হচ্ছে ৩৩ শতাংশ। বিল পাশ হওয়ার আগে আমরা করে দেখিয়ে দিয়েছি। তবে আমরাও চাই সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হোক।‘’
চলতি সপ্তাহে সংসদ শুরুর আগে মহিলা বিল নিয়ে সোচ্চার হলেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি। কংগ্রেস সূত্রে খবর, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চিঠি লিখে রাহুল জানতে চেয়েছেন চলতি বর্ষাকালীন অধিবেশনে মহিলা সংরক্ষণ বিল নিয়ে সরকার কী ভাবছে? এই বিল কী পাশ হবে? সভাপতি হিসেবে দলের হাল ধরলেন নিজেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। কংগ্রেসের তরফে ৩২ লক্ষ মহিলার স্বাক্ষর ইতিমধ্যে সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ রাজনীতির উর্ধে  উঠে গণতন্ত্রের পক্ষে কথা রাখা। রাহুল গাঁধি পরে একটি টুইট করেন। টুইটে তিনি বলেন, ‘’প্রধানমন্ত্রী মহিলাদের ক্ষমতায়নের রক্ষাকর্তা বলেন নিজেকে। তিনি বিল পাস করুন, কংগ্রেস নিঃশর্ত সমর্থন করবে।‘’
প্রস্তাবিত বর্ষাকালীন অধিবেশন আজ থেকে শুরু হয়েছে। সোমবার রাহুল গাঁধির লেখা চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে নতুন একটি ‘ডিল’-এর প্রস্তাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, সেই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য চিঠিটি তিনি নিজের ক্যাবিনেটের আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদের কাছে পাঠিয়ে আলোচনার কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কথামত আইনমন্ত্রী রাহুল গাঁধিকে লেখেন ‘’আমি ‘নতুন ডিল’-এর প্রস্তাব দিচ্ছি। কংগ্রেস ও বিজেপি মিলে মহিলা সংরক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তিন তালাক এবং নিকাহ হালালার বিলটিও পাশ করুক। এবং পিছিয়ে পড়া শ্রেণী সংক্রান্ত জাতীয় কমিশনকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়ার বিলটিও পাশ করানো হোক।‘’
টানটান উত্তেজনার মধ্যে থাকবে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এবং রাজনীতি। একঝাঁক নতুন এবং তরুণের নেতৃত্বে একুশ শতাব্দীর ভারতীয় কংগ্রেস দল। রাজনৈতিক আমলাতন্ত্রের উর্ধে উঠে ভারতীয় সংসদ কী ১৪ বছরের পুরনো বিল পাশ করে আধুনিক গণতন্ত্রের স্তম্ভ আরও শক্ত করতে পারবে?                                                                                

Thursday 12 July 2018

আধুনিক শহর - আধুনিক সভ্যতা



দীপেন্দু চৌধুরী  
‘কারো কেউ নইগো আমি/ কেউ আমার নয়।/ কোন নাম নেইকো আমার/ শোন মহাশয়।’ ‘লালকুঠি’ বাংলা ছবিতে  কিশোর কুমারের এই গানটা আমার এক বন্ধুর আট’বছরের মেয়ে আমাদের বাড়িতে আসলেই গুন গুন করে গায়। ওর কাছে জানতে চাইলে বলে, ‘জানো এই গানটা আমাদের স্কুলের গাছের তলায় বসে একটা অনাথ ছেলে দিদিমনিদের শোনায়।
আমরা জানতে চেয়েছিলাম ‘তুমি গানটা গাইছ কেন?’
উত্তর দিয়েছিল, ‘গানটা এখন শুনতে ভালো লাগছে। পরে ভালো নাও লাগতে পারে। তখন গাইব না।’
উত্তরটা সম্ভবত ঠিকই দিয়েছে। মানুষের যখন যেটা ভালো লাগে সেটাই গণতন্ত্র। সেটা প্রাতিষ্ঠানিক হোক বা সামাজিক। আমাদের রাজ্যেও কিছুদিন হল চোখে পড়ার মত দৃশ্যমান কয়েকটি ঘটনা নজর কাড়ছে। এটাকে এতদিন তথাকথিত কিছু উচ্চকিত সমাজ প্রভু ‘গণতন্ত্র’ বলে চালিয়েছে। ইতিহাস ঘেটে ইতিহাসবিদরা অনেক আগেই ‘সামাজিক সেতু’ নিরমাণ করে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বারহ্মণ- ক্ষত্রিয়রা একতরফা সামাজিক সংস্কৃতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেইসব দিনে ‘অন্ত্যজ’, দলিত, নিম্ন বর্ণের মানুষরা উচ্চ বর্ণের সমাজের কাছে কখনও কখনও স্থায়ী ভিত্তিতে কয়েক প্রজন্ম ‘সেবায়ত’ থাকতে বাধ্য হয়েছেন। কখনও নিম্ন বর্ণের প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষেরা ‘সমাজ প্রভুদের’ হুকুমে বাড়ির মেয়েদের ‘দাসী’ হিসাবে বা ‘সেবাদাসী’ শর্তে ধর্মের দোহাই মেনে নিয়েছেন। সামন্ত প্রভুদের এমনতর দাপটের ‘সংস্কৃতি’র উপর গোছা গোছা ‘থিসিস’, বই, গল্প, উপন্যাস, কবিতা লেখা হয়েছে। অনেকেই সিনেমা বানিয়েছেন। নাটক লিখেছেন। সেই নাটক মঞ্চস্থ করেছেন।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে আমাদের দেশে ‘গণতন্ত্রের’ আলো চুঁইয়ে হলেও কিছুটা এ ঘর সে ঘরের দাওয়ায় আসতে শুরু করে। ঘাম-রক্তের মাখা মাখিতে আমরা পাই। রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের কারণে দেশ ‘বিপ্লব’ না পাক, ‘সামাজিক স্বীকৃতি’ আদায় করতে সক্ষম হলেন দলিত আন্দোলনের নেতৃত্ব। শুরু হল প্রতিশোধের রাজনীতি। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সে সব নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকবে। কিন্তু নিম্নবর্ণের দলিত শ্রেণীর কিছু নেতৃত্ব বিভিন্ন সময়ে গরীব দুর্বল ‘ব্রাহ্মণ পরিবার’ এবং ‘ক্ষত্রিয় পরিবার’কে আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বেছে নিয়েছিল। প্রয়োজনে এইসব নেতৃত্ব নিজেদের প্রশিক্ষিত পুরুষ অথবা মহিলা বাহিনী দিয়ে ‘ব্ল্যাকমেল’ করে সামাজিক প্রতিশোধ নিয়েছে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এই ধরণের রাজনীতির প্রকোপ বহুল প্রচলিত ছিল। তার অন্যতম কারণ ছিল ‘সামন্ত্রতান্ত্রিক বাংলাকে’ ‘নয়া গণতান্ত্রিক’ বাংলা হিসাবে গড়ে তোলা। সংসদীয় গণতন্ত্রের দায়বদ্ধতা এবং সীমাবদ্ধতা অনুসরণ করেই ‘প্রান্তিক’ মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে নকশাল বাড়ি আন্দোলনের এক শীর্ষ স্থানীয় ব্রাহ্মণ নেতা আমাকে বিষয়টা বলেছিলেন। উল্লেখ করেছিলেন গরীব ব্রাহ্মণদের সামাজিক মান কতটা পড়ে গেছে সেই বিষয়টি। তথাকথিত দলিত শ্রেণীর  অর্জিত ক্ষমতার কতটা ব্যবহার হয়েছে আর কতটা অপব্যবহার হয়েছে এই সবের বিচার ইতিহাসবেত্তারা করছেন। আমাদের বিষয় ‘আধুনিক শহর আধুনিক সভ্যতা’। এই রাজ্যেও বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে একটি ‘চুক্তি’ কিছু অপ্রয়োজনীয় দর্শনের হাত ধরে ‘সব কিছু পেতে পারি’র রাজ্যে নিয়ে যেতে চায়দেশের রাজধানী ‘হস্তিনাপুরে’ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের সঙ্গে একটি ‘আর্থসামাজিক’ চুক্তি করে একটি বেসরকারি সংস্থা। ‘আরব্য রজনীর’ গল্প কথার উপাখ্যানের যাত্রাপথ মসৃণ হয়ে যায়। শহর কলকাতার তথা এই বাংলার ‘বৈধ-অবৈধ’ সেতু গড়ে ওঠে। সেই সেতু আগেই ভেঙ্গে পড়েছে। ২০১৩ সালে চুক্তি বাতিল হলে তথাকথিত ‘তুঘলকি সংস্কৃতির’ শেষ অধ্যায় আমাদের দেখতে হচ্ছে হয়ত বা। ‘সেতু’ নির্মাণ ভারতীয় একটি মহাকাব্যেও পাই। সেখানে ‘কাঠবিড়ালি’র মত ছোট্ট একটি প্রাণীরও ভূমিকা আমরা জানতে পারি। ‘শুভ শক্তি’ ‘অশুভ শক্তি’র লড়াইয়ে কাঠবিড়ালি তার মত করে শুভ শক্তিকে সাহায্য করে।
আধুনিক সভ্যতায় জনবস্তির এবং জনবসতির ঘনত্ব এতটাই বেড়েছিল ‘শহরের বিকেন্দ্রীয় করণের’ প্রয়োজন ছিল। বিধাননগর, কল্যাণী, দুর্গাপুর এবং হলদিয়া গড়ে তুলে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় তাঁর দূরদৃষ্টির পরিচয় আগেই দিয়েছেন। কিন্তু সেখানে থেমে থাকলে চলে না। কলকাতা শহরের তাই প্রয়োজন হল নতুন করে ‘সুতানটি’ এবং ‘গোবিন্দপুর’কে খুঁজে নেওয়া এবং অবশ্যই আধুনিক সভ্যতার উচ্চতায় গ্রাম দুটিকে নিয়ে যাওয়া। কলকাতায় বিকেন্দ্রীকরণের শুরুয়াত ‘অপারেশন সান শাইন’ দিয়ে। খুব সম্ভবত দুটি নতুন গ্রামকে আধুনিক উচ্চতায় গড়ে তোলা এবং হস্তিনাপুরের ‘ইচ্ছে পূরণের’ চুক্তি  পশ্চিমবঙ্গকে ‘আধুনিক শহর দিলেও’ আধুনিক সভ্যতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যার মূল্য দেওয়ার পালা শুরু হয়েছে। ‘মেট্রোপলিটন’ শহর গড়লেই হয় না। ‘মেট্রোপলিটন’ মন এবং সভ্যতা গড় তুলতে হয়। বিষয়টা আমরা এক বিখ্যাত লেখকের সঙ্গে কিছু সময় পরে ভাগ করে নেব। তার আগে ‘কলকাতা’ শহরকে চিনে নিতে চাই। কলকাতার কি কোনও জন্মদিন আছে? বিষয়টা বিতর্কিত। কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামালা হয়েছিল। যে মামলাটি সম্ভবত ‘সাবর্ণ রায় চৌধুরী’ মামলা নামে পরিচিত। উচ্চ আদালতে সাবর্ণ রায় চৌধুরীরা এই মামলায় জিতে যায়। ২৪ আগস্ট কলকাতার জন্মদিন নয়।  সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের আইনজীবী স্মরজিত রায় চৌধুরীর দাবি ছিল শহরের কোনও জন্মদিন হয় না।
হাইকোর্টের প্রশ্ন ছিল, ১৬৯০ সালে কলকাতার জন্মদিন। এর আগে যোব চারণক তিনবার এলাকা ঘুরে গেছেন। তারপরেই কলকাতাকে বেছে নেন তিনি। ব্রিটিশরা কলকাতার জন্মদিন পালন করেছিল কি? শ্রদ্ধেয় ইতিহাসবিদ নিমাই সাধন বসুর সভাপতিত্বে যে কমিটি হয় সেই কমিটি একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি অশোক মাথুরের ডিভিশন বেঞ্চের কাছে। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, শহরের কোনও জন্মদিন হয় না। শহর নিজস্ব বৈশিস্টে বিকশিত হয়। ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে মামলা চলা কালীন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘’১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট যোব চারণক কলকাতা যখন এলেন, সেইদিনকে ‘মিড ডে হল্ট’ বলা হয়। হুগলী, হিজলী, উলবেড়িয়া প্রভৃতি জায়গায় ঘুরে ‘সুতানটিকে’ ঠিক করলেন।
১৬৮৬ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি এসেছিলেন। ১৬৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে আবার এলেন। কোম্পানির ব্যবসাকে নতুন মোড় দিলেন। চট্টগ্রাম দখল করলেন। ‘সুতানটী’কে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে দুটো কারণ ছিল। কাছাকাছি নদী ছিল। এবং বাণিজ্যিক কারণ। আত্মরক্ষা এবং প্রতি আক্রমণে যেতে পারবেন। এই জন্যই তিনি ১৬৯৮ খ্রীস্টাব্দে যে তিনটি গ্রাম পেলেন। সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের কাছ থেকে। সুতানটী, কলকাতা এবং গোবিন্দপুর। তিনটি গ্রাম নেওয়ার আগে যোব চারণকের জামাই দীর্ঘ আলোচনা করেন। পরে গ্রাম তিনটি হস্তান্তর হয়।‘’
বন্ধু পাঠক আপনারা কলকাতা সংলগ্ন সভ্যতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া জানলেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত যে দুটি আধুনিক গ্রাম কলকাতার উপকণ্ঠে গড়ে উঠল সেখানে কোনও বৃহৎ জমিদার বা সামন্ত্রপ্রভু ছিল না। ‘বর্গা’ আন্দোলনের লাভবান খেটে খাওয়া মানুষরা হঠাৎ আবিষ্কার করলেন। ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ এই শ্লোগান ভুলে যাও। ‘জমি যার কোটি কোটি টাকা তার’হ্যা টাকা কোটি কোটি টাকা।
               শ্রদ্ধেয় বিনয় ঘোষ তাঁর ‘মেট্রোপলিটন মন-মধ্যবিত্ত-বিদ্রোহ’ (ওরিয়েনট লংম্যান প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত।) বইয়ে ‘টাকা আর টাকা আর মন’ (পৃষ্ঠা- ১৩-১৪) পরিচ্ছেদে লিখছেন, ‘’মন! মন আবার কি? টাকা ছাড়া মন কি? টাকা ছাড়া আমাদের মন নাই; টাঁকশালে আমাদের মন ভাঙ্গে গড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের উক্তিধনতান্ত্রিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ দান এই মন যা টাঁকশালে ভাঙ্গে গড়ে।
টাকা স্বর্গ টাকা ধর্ম টাকাই জপ তপ ধ্যান। অটোমোবিল ও স্কাইস্ক্রেপার যুগে মেট্রোপলিটন মহানগরে আর কোন টান মানুষকে টানতে পারে না। এককালে মা ছিলেন স্বর্গাদপি গরীয়সী এবং পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাই ছিলেন পরম তপস্যার বস্তু। তখন মানুষের টানে মানুষ চলত, গরুর টানে গাড়ি চলত মাটির পথে। ইট পাথর লোহার পথ ছিল না, বাড়ি ঘর ছিল না, অটোর মতো যন্ত্র মানুষকে প্রচণ্ড বেগে টানত না। মাটির টানে মানুষের টানে মানুষ চলত। ক্রমে মাটি থেকে দূরে সরে যেতে থাকল মানুষ,...........................শুধু যে জলাশয়ের জল শুকোলো তা নয়, হৃদয় শুকোলো’ (রবীন্দ্রনাথ)। মন হল একমুখী। লোভ ও স্বার্থের সওয়ার হয়ে অর্থের দিকে ধাবিত হল কলকাতা শহরে।‘’  
লোভের টানে স্বার্থের টানে অর্থের টানে গ্রাম থেকে শহরমুখী হল মানুষ ও মানুষের মন। সুতানটীর গঙ্গাতীরে কতকগুলি তাঁবু কুঁড়েঘর ও নৌকো নিয়ে যোব চারনক যখন প্রায় বন্য যাযাবরের মতো বাস করছিলেন তখন তাঁর সপ্তদশ শতকী কল্পনার দিগন্তেও কলকাতার বর্তমান মেট্রোপলিটন মূর্তি ভেসে ওঠেনি। চারনকের মৃত্যু হল ১৬৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে। তার পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে সুতানটি টাউনের দ্রুত সমৃদ্ধি দেখে উল্লসিত হয়ে কোম্পানির ডিরেক্টররা ১৬৯৭ সালে লিখলেনঃ ‘we are glad to hear your town of Chuttanuttee increases so exceedingly’ এবং তার আরো দু’বছর পরে ১৬৯৯ সালে কলকাতার কর্তারা লিখে জানালেন ‘Chuttanuttee very much increased within these 5 years.         সুতানটির গঙ্গার ঘাটে পদার্পণ করার পর যোব চারনক জানান, ’endeavoring to bring the trade down from Hughly to Sootanuttee’ (August 1688) এবং অষ্টাদশ শতকের গোড়াতেই ডিরেক্টররা খুশি হয়ে লেখেন ‘It is enough our cash feels the benefit’ (26 February 1703) 
‘Our Cash feels’- কথাটি কোম্পানির ডিরেক্টরদের বটে কিন্তু মনে হয় যেন কালের ইতিহাসের মর্ম থেকে উৎসারিত। কে ফিল করে? ক্যাশ। জন্তু নয়, মানুষ নয়- ক্যাশ! নবাবকে নগদ ‘ক্যাশ’ দিয়ে লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের বংশধরদের জমিদারি কলকাতা গোবিন্দপুর সুতানটি কোম্পানির নামে কিনতে হয়েছে, সেই জমিদারি টাউন হয়ে গড়ে উঠছে, তার লোক সংখ্যা বাড়ছে, বাণিজ্যের উন্নতি হচ্ছে। কাজেই যে ক্যাশ টাকাটা দিয়ে জমিদারি কেনা হয়েছে সেই টাকাটা অনুভব করছে যে সে উপকৃত। টাকার যে শুধু চক্রগতি আছে তা নয়, তার অনুভূতি আছে হ্রদস্পন্দন আছে। টাকার অনুভূতি এবং মানুষের অনুভূতি একাকার হয়ে মিশে গেল। মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক আর্থিক সম্পর্কে পরিণত হল। কলকাতা শহরের পত্তন হল ক্যাশের উপর এবং ক্যাশ নেক্সাস হল সামন্তধনতান্ত্রিক কলকাতার মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক।                        
   

Wednesday 4 July 2018

রাজ্যের আয়নায় বাংলার মুখ



দীপেন্দু চৌধুরী  
কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারের সাত বছর পূর্ণ হয়েছে। কেন যেন বলতে ইচ্ছে যায় ‘সাতটি ভাই পাহারা দেয় পারুল বোন আমার’। ২০১১ সালের পর থেকে অনেক বার শুনতে হয়েছে এই সরকার  ছ’ মাসের বেশি টিকবে না। পরে হয় এই ‘টার্ম’ শেষ হলেই তৃণমূল কংগ্রেস আর সরকার গঠন করতে পারবে না। সারদা, রোজভ্যালি সহ বিভিন্ন বেসরকারি লাভজনক সংস্থায় দলের নেতা কর্মীদের নামে মামলা চলছে। অতএব হত ইতি গজ। ২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটের আগে সামনে এল ‘নারদ তদন্ত’-এর ভিডিও ফুটেজ। তৃণমূল নেত্রী বললেন ২৯৪ আসনে আমাকে পাহারা দিন। আমাকে ভোট দিন। সাফল্য এল। ঠাকুমার রূপকথার গল্পের মত বলতে হয় ‘সাতটি গ্রাম পাহারা দেয় পারুল বোন আমার’না এরপরেও থামল না। সামন্ত প্রভুদের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত নেতাদের তথাকথিত গোষ্ঠী আওয়াজ তুললেন এই সরকার সাত বছরের বেশি টিঁকবে না।
 প্রণববাবু রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব (২০১২) নিলেই এই সরকার ফেলে দেবে। এমন একটা ধারণা মানুষের মনে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল। আমরা কলাম লিখিয়েরা বিষয়টা সামনে আনতে চেষ্টা করেছিলাম। নিরপেক্ষভাবে। আজও এই কলাম লিখতে চাইছি নিরপেক্ষ ‘কি-বোর্ড’-এর আলতো সতর্ক ছোঁয়ায়। যদি পিছন থেকে আলোচনায় যাই, তবে দেখব ২০১১ সালের জুন মাস থেকে ২০১২ সালের জুন মাস পর্যন্ত ধরলেও এক বছর হয়। কংগ্রেস-তৃণমূল কংগ্রেসের জোট সরকার এর পরেও টিকে ছিল। ‘আইন আইনের পথে চলবে’ এই আপ্তবাক্যকে সামনে রেখে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেসকে অনেক মূল্য চোকাতে হয়েছে। সব মামলা এখনও মিটে যায়নি। বিভিন সময়ে মন্ত্রী বদল করে সরকার আজও চলছে। ২০১৬ সালের দ্বিতীয় দফায় নতুন কিছু মুখ রাজ্য মন্ত্রিসভায়ে এনেছেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘সাতটি ভাই পাহারা দেয় পারুল বোন আমার’। এই প্রসঙ্গে বলতে হয় বিরোধীদলের কয়েকজন নতুন নেতা পুরনো ঘিয়ে হাত ডুবিয়ে ‘ভারতকে’ বিশ্বকাপের ফুটবলের সেমিফাইনালে দেখতে চাইছিলেন। কিন্তু সেটা করতে গেলে দীর্ঘকালীন একটা প্রস্তুতি লাগে। যেমন ধরা যাক স্কুল পরিচালন কমিটিতে সংখ্যা গরিষ্ঠতা। সমবায় সমিতি, সমবায় ব্যাঙ্ক সহ একাধিক গ্রামীণ স্থানীয় প্রশাসনে আগে সাফল্য পেতে হয়। তারপর আছে গ্রামপঞ্চায়েতের ভোটে সংখ্যা গরিষ্ঠতা। এবং রাজ্যের বিভিন্ন পুরসভায় সংখ্যা গরিষ্ঠতা।  ২০১৮ সালের আইনি এবং সন্ত্রাসের অভিযোগের ঝামেলা মিটিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস বহাল তবিয়তে রাজ্যের শাসন পরিচালনায় রয়ে গেল। না আমি তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে ‘আমেরিকার তামাক’ খেয়ে এই লেখা লিখছি না। অথবা তৃণমূল কংগ্রেস দলে ‘বামপন্থী স্রোত’-এর জলে গলা ডুবিয়েও এই লেখা লিখতে বসিনি। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ‘নীল-সাদা’ ব্যানার নিয়ে ছুটতে ছুটতেও আমাদের কলাম লেখা নয়। বন্ধু ভাবতে হয়, না ভাবলে সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে হয়। আমাদের কথা নয়। সময়ের এবং অসময়ের বিদ্দজ্জনেরা এই কথা বলে থাকেন।           
রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কাজের বিষয়ে সুলুক সন্ধান করলে সাফল্য এবং ব্যর্থতার নজির আমরা দেখতে পাব। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের চেয়ারে বসে একটি কর্পোরেট সংস্থার সি ই ও হিসেবে রাজ্য সরকার পরিচালনা করার চেষ্টা করছেন এবং করেছেন। উদাহারণ হিসেবে বলা যায় বিভিন্ন জেলা সদরে প্রশাসনিক বৈঠক। এবং প্রতিটি দপ্তরের কাজ করার ভিত্তিতে নম্বর প্রথা চালু করা।
তৃণমূলের একটি জেলার প্রথমসারির নেতা বলেছেন ‘উন্নয়ন’ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। কথাটা কতটা সত্যি? আলোচকরা আলোচনা করছে। আমরাও দেখি। রাজ্যের উন্নয়ন দপ্তর সূত্রে খবর ২৫ জুন বণিকসভা বেঙ্গল ন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স এক আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। ওই আলোচনাসভার বিষয় ছিল ‘কৃষক ও বাণিজ্যিক সংস্থার চুক্তি’। ওই আলোচনা সভায় উদ্যানমন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা জানান, চাষির হাতে প্রযুক্তি বা পুঁজি কোনোটাই নেই। ঠিক দামে ফসল বিকোবে, এমন নিশ্চয়তাও নেই। এই অবস্থায় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সংস্থা এবং রফতানিকারী সংস্থা এক সঙ্গে কৃষকের সঙ্গে হাত মেলায় তবেই কৃষিপণ্যের ব্যবসা বাড়বে। মন্ত্রী এদিন আরও বলেন, ‘’কৃষকদের নিয়ে ছোট ছোট কৃষিপণ্য উৎপাদক সংস্থা গড়া হয়েছে। আমরা চাইছি কৃষকদের এই সংস্থাগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি চুক্তি করুক। সংস্থাগুলির চাহিদামাফিক চাষিরা পণ্য উৎপাদন করবেন। সংস্থাগুলি বাজারদরে সেই ফসল কিনে নেবে।‘’
আরও একটি খবর, সবুজ পরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে নতুন কী প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায় সেই বিষয়ে খড়গপুর আইআইটি ক্যাম্পাসে গড়ে উঠবে ‘ইন্দো জার্মান সহযোগী গবেষণাকেন্দ্র’। ২৫ জুন এক প্রেস বিবৃতির মাধ্যমে জানিয়েছেন আইআইটি কতৃপক্ষ। এক সপ্তাহ আগে জার্মানির মিউনিখের টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে খড়গপুর আইআইটির মউ সই হয়। আইআইটি সূত্রে আরও খবর, জার্মানির অর্থ সাহায্যে চলবে এই গবেষণা কেন্দ্র। জার্মানির কারিগরি দক্ষতার সঙ্গে ভারতের সফটওয়্যার সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং কাজে লাগিয়ে রাজ্যের ভবিষ্যৎ পরিবহণ ব্যবস্থার নতুন পরিকল্পনার রূপরেখা গড়ে তুলবে যৌথ এই উদ্যোগ।
গুজরাট বিধানসভা ভোটের আগে কেন্দ্রীয় সেন্ট্রাল ব্যুরো অব হেলথ ইন্টেলিজেন্স’-এর এক রিপোর্ট আমাদের সামনে তুলে ধরেছে একটি ছবি। এই রিপোটে বলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলের মানুষকে হাসপাতালে  চিকিৎসা বাবদ যত টাকা খরচ করতে হয় দেশের অন্যান্য রাজ্যে সেই খরচ অনেক বেশি। রাজগুলির নাম এবং খরচ উল্লেখ করা যাক। গুজরাতের গ্রামীণ হাসপাতালে খরচ ৩২৫০৩ টাকা, গোয়ায় খরচ ৩২২১১ টাকা, রাজস্থান ২৯৭৭৯ টাকা, মণিপুর ২২৪৮৬ টাকা এবং আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ১০৪৭৬ টাকা। তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যাচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশ, হিমাচলপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার, অসম, মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের থেকেও পশ্চিমবঙ্গের হাসপাতালে ভর্তির খরচ কম। এবং ওই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে সারা দেশের মধ্যে গুজরাতের গ্রামবাসীদের চিকিৎসার জন্য খরচ সব থেকে বেশি করতে হয়।     
আমরা এতক্ষণ ‘রাজ্যের আয়নায় বাংলার মুখ’ দেখলাম। দ্বিতীয় পর্বে চলে যেতে যাই রাজনীতির ময়দানে। নাম দেওয়া যাক.........
 বাংলার আয়নায় রাজ্যের মুখ
রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকেই ‘ভোট বাংলা’-র দামামা বেজে গেছে। কিছুদিন আগে প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক বলছিলেন, ২০১৮ সালে পঞ্চায়েত, ২০১৯ সালে লোকসভা, ২০২০ সালে কলকাতা পুরসভা এবং ২০২১ সালে রাজ্য বিধানসভা। বিজেপি উত্তর পূর্ব ভারতে আসামে সরকার গঠন করার পর ত্রিপুরায় সরকার গঠন করেছে। কংগ্রেস, তৃণমুল কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা কোণঠাসা। বাংলা দখলের পরিকল্পনা নিয়ে আবারও পশ্চিমবঙ্গ ঘুড়ে গেলেন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। দু’দিনের রাজ্য সফরে এসেছিলেন তিনি। ২৭ জুন কলকাতায় এসেই তিনি রাজ্য নেতৃত্বকে বার্তা দিয়েছেন মমতাকে হারাতে বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। সিপিএমকে হারাতে মমতা যে লড়াই করেছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের সরকারকে হঠাতে সেই রকম বিশ্বাসযোগ্য লড়াই রাজ্য নেতৃত্ব করতে পারছে কি? প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেছেন অমিত শাহ। এবারের সফরে বিজেপি সভাপতি রাজ্যের ১৫ জন নেতার মধ্যে ৩৭টি সাংঠনিক জেলার কাজ ভাগ করে দিয়ে এখন থেকেই কাজে নেমে পড়ার পরামর্শ দিয়ে গেছেন তিনি। অন্তত ২২টি আসন জেতার জন্য সব রকমের পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে বলে বিজেপি সূত্রে খবর। ২৮ জুন বিজেপি সভাপতি পুরুলিয়ার সভায় বলেন, ‘’এত কিছুর পরেও ৬০ হাজার গ্রাম পঞ্চায়েতে বিজেপির পতাকা উড়ছে। ২০১৪ সালে আমরা ছিলাম চতুর্থ দল। পঞ্চায়েত ভোটের পর এখন আমরা দ্বিতীয়। ২০১৯ সালে ২২টার বেশি আসন জিতে আমরা এই রাজ্যে এক নম্বর হব।‘’
বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের এই বক্তব্যকে একদমই খাটো করে দেখছে না তৃণমূল নেতৃত্ব। ওইদিনই রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র বলেন, ‘’বাংলার বাইরে থেকে এসে এক জন এখানে সরকার এবং জননেত্রী সম্পর্কে যে ভাষায় কথা বলেছেন, তাতে বাংলার মানুষ ছেড়ে কথা বলবেন না’’
ভোট বাংলার দামামা বেজে গিয়েছে রথের দড়িতে টান পড়ার সঙ্গে সঙ্গে। ১ জুলাই তৃণমূল কংগ্রেস পুরুলিয়ার শিমুলিয়া মাঠে পাল্টাসভা করে। এদিনের সভায় রাজ্য মন্ত্রিসভার একঝাঁক মন্ত্রী মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। নারী ও শিশু কল্যাণমন্ত্রী শশী পাঁজা, পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এবং পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী সেদিনের মঞ্চে হাজির ছিলেনশশী পাঁজা বলেন, ‘’মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আমাদের দল ৪২টি আসনেই জিতবে। এক ইঞ্চি জমি ছাড়া হবে না।‘’ ফিরহাদ হাকিম বলেন, ‘’ওরা ঝাড়খন্ডের মাওবাদীদের টাকা দিয়ে বাংলায় এনে ভোট করিয়েছে। যখন টাকা পাচ্ছে না, তখন পুরুলিয়ায় ঢুকে খুন করছে। নাম দিচ্ছে তৃণমূলের।‘’
রাজ্যে কংগ্রেস কি করছে? কংগ্রেস সূত্রে খবর ৬ জুলাই কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নেতাদের দিল্লি ডেকে পাঠিয়েছেন। কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পরে রাহুল গাঁধি লোকসভা ভোটের আগে আবার একবার রাজ্যের নেতাদের মতামত নেওয়ার কাজ শুরু করে দিলেন। কারণ সম্প্রতি এআইসিসি আগামী লোকসভা ভোটে জোট মজবুত করতে যে রাজ্যে যে দল শক্তিশালী সেই দলের সঙ্গে জোট করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে। বামদের সঙ্গে ঘর করতে অভ্যস্ত বাংলার প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্ব এই মুহূর্তে কি ভাবছে? সভাপতি অধীর চৌধুরী এআইসিসিকে প্রস্তাব দিয়েছেন, রাজ্যের প্রাক্তন এবং বর্তমান সাংসদ, বিধায়ক, প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতি এবং প্রদেশ কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতাদের বৈঠকে ডাকা হোক। এই তালিকায় আইনজীবী এবং তাত্ত্বিকনেতা অরুনাভ ঘোষ, বর্ষীয়ান তাত্ত্বিকনেতা দেবপ্রসাদ রায় সহ অন্যান্যদের নাম আছেতো? ডাকা হবে তাঁদের? বর্তমান প্রদেশ কংগ্রেসের গোষ্ঠী বিন্যাস কি বলে? বামদের সঙ্গে ঘর করতে অভ্যস্ত বর্তমান প্রদেশ কংগ্রেস কি করবে? সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, অধীরবাবু বলেছেন, পরিবর্তনের হাওয়ায় তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে কংগ্রেস যত আসন জিতেছিল, পরে বামেদের সঙ্গে গিয়ে তার চেয়ে বেশি আসন পেয়েছে।‘’    
রাজ্যের জোট সমীকরণ যতই জটিল হোক ২০০৯ সালে প্রদেশ কংগ্রেসে একজন ‘সোনার ঝিনুক’-এ দুধ খাওয়া নেতার উত্থান হয়েছে। যাকে বাংলা প্রবাদে ‘তোলা দুধের সন্তান’ বলা হয়। মাত্র ৯ বছর আগে রাজনীতিতে অভিষেক হওয়া এইরকম একজন মাঝ বয়সী নেতার মূল্যবোধ নিয়ে কংগ্রেস কর্মী সমর্থকরা সন্দীহান। কিন্তু পারিবারের আকাশচুম্বী আর্থিক স্বচ্ছলতাকে ভয় পাচ্ছে অনেকে। ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রদেশ কংগ্রেস দলটাকে সাইন বোর্ডে পরিণত করার ক্ষেত্রে ওই নেতাটি এবং তার গোষ্ঠীর সদস্যরা সব রকমের কলকাঠি নেড়ে চলেছেন। যদিও রাজ্যে যারা কংগ্রেস পরিবারের সদস্য তাঁরা রাহুল গাঁধির নেতৃত্বে ভরসা করছেন বলেই খবর আছে। তরুণ বাংলার কথা ভেবেই কংগ্রেস হাইকমান্ড সাংসদ গৌরব গগৈকে এ রাজ্যের পর্যবেক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেছেন। তিনি দায়িত্ব নিয়ে কাজও শুরু করে দিয়েছেন। পঞ্চায়েত ভোটের সময় বসিরহাটে যেসব কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁদের সঙ্গে তিনি সম্প্রতি দেখা করেছেন।
রাজত্ব গেলেও রাজ্যে বামেদের একদম বাদ দিলে আখেরে ঠকতে হবে রাজ্যবাসীকে। সমস্ত বিতর্ক মেনে নিয়েই বামেরা ভাবছে চারদশকেরও বেশি পুরনো বামফ্রন্টের চেনা কাঠাম নিয়ে আর কি ফিরে আসা সম্ভব? ফিরতে চাইলেই কি ফেরা যায়? বামফ্রন্টের ভিতরে নিজেরা আত্মসমীক্ষা করেছেন। আত্মসমালোচনা করেছেন। বামেরা অনেকদিন আগে থেকেই বিপিএমও নামে একটি মঞ্চ তৈরি করেছে। এই মঞ্চে সামিল হয়েছে বাম গণতান্ত্রিক শক্তি। পঞ্চায়েত ভোটের পরে বামেদের তৃতীয় স্থানে নেমে আসাটা মেনে নিতে পারছে না ফ্রন্টের নেতারা। তাই দাবি উঠেছে আর ৪০ বছরের বেশী পুরনো মঞ্চ বামফ্রন্ট নয়। লোকসভা ভোটের আগে গড়ে তোলা হোক ‘বাম সংহতি কমিটি’। পরে বামফ্রন্ট ভেঙ্গে গড়ে উঠুক ‘বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’।
সিপিএমের নতুন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী আশাবাদী। দলের ব্যর্থতার মধ্যেও রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছোট ছোট গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠেছে। এটা অস্বীকার করা যাবে না। সংগঠনের কাজে রাজ্য নেতৃত্বের আরও স্বক্রিয় হওয়ার কথা বলছেন রাজ্য সিপিএম নেতৃত্ব। সিপিএম দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র সম্প্রতি বলেছেন, ‘’পুরনো নেতারা বলতেন, গরুর গাড়ির চাকা কাদায় আটকে গেলে শুধু গরুকে খোঁচা মারলে হয় না। গাড়োয়ানকে নেমে কাঁধ দিয়ে চাকা ঠেলতে হয়। এই কাজ উপরের কমিটির নেতাদেরই করতে হবে।‘’

রথ যাত্রার পরে উল্টোরথেরও মেলা হয়। ২০১৯ বলে দেবে উল্টো রথের মেলায় মেলা দেখা এবং কলা বেচা দুটো একসঙ্গে সম্ভব কিনা? এই রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে বামেদের জোট হবে? না ২০০৯ এবং ২০১৪ সালের মত আগামী লোকসভা ভোটেও কংগ্রেস এবং তৃণমূলকংগ্রেস রাজ্যের বৃহত্তর স্বার্থে হাত ধরাধরি করে হাটবে? সময়ের ঘণ্টা শোনার অপেক্ষায় থাকলাম। দু’দিন আগে শোস্যাল মিডিয়ায় একটি লেখা পড়লাম। বিদেশী একজন ইংরেজিতে যেটা লিখেছিলেন তার বাংলায় তর্জমা করলে যেটা হয়, ‘পাভলভ বারের উপর দিয়ে হাঁটছিলেন। সেই সময় ঘণ্টা বাজল। পাভলভ কুকুরকে খেতে দিতে ভুলে গেলেন। তারপর?’