Friday 17 March 2017

মানুষ গড়ার কারিগর

মানুষ গড়ার কারিগর:   

সেদিন সারা দেশের মানুষ সাত সকাল থেকে বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে টিভির সামনে বসে। নাগরিক ভারত, রাজনীতি সচেতন তরুণ ভারত সেদিন সুসজ্জিত আধুনিক ড্রয়িং রুমের ডিজিটাল টিভিতে নিউজ চ্যানেল খুলে বসে আছে। ভোট পাঁচটা রাজ্যে হলেও তামাম ভারতবাসির নজর উত্তরপ্রদেশ। সাংবাদিকদের ভাষায় উল্টাপ্রদেশ। সাংবাদিকদের ভাষাটাই ১১ মার্চ, ২০১৭ তে প্রমাণ হয়ে গেল। যে সম্ভাবনার জন্ম হয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া এবং বৈদ্যুতিন মাধ্যম সেই সম্ভাবনাকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। আমরা আশা এবং পাহারপ্রমান উচাশা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলাম কংগ্রেস-সপা জোট এবার উত্তরপ্রদেশ দখল করবে। দুই দলের দুই নেতা যথাক্রমে কংগ্রেসের রাহুল গাঁধি এবং সমাজবাদী পার্টীর অখিলেশ যাদব পরিশীলিত সংলাপে পাতার পর পাতা নতুন ভাষায় তরুণ ভারতের গণতন্ত্র তৈরি করছিলেন। শিক্ষিত ভারতীয় নাগরিক, দেশ বিদেশের সাংবাদিক, আলোচক, সমালোচক দুই যুবনেতাকে দেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি হিসাবে দেখতে চেয়েছে। কিন্তু ১১ মার্চ যে খবর ইথারবাবুদের মাধ্যমে তরঙ্গবাহিত হয়ে আমাদের কাছে এল সেটা আমাদের মত সচেতন নাগরিকের কাছে একদম প্রত্যাশিত ছিল না। আজ সারা ভারত জেনে গেছে বিজেপি দলের এক এবং একমাত্র নেতা বিকাশ পুরুষ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উত্তরপ্রদেশে নিজের আধিপত্য বজায় রেখেছেন। উত্তরপ্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড দুটি রাজ্যে বিপুল ভোট পেয়ে সরকার গঠন করছে বিজেপি। দলের দুই কাণ্ডারি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি সভাপতি   অমিত শাহ নিঃশব্দে নীরবে কাজ করে এই জয় এনে দিতে পেরেছেন এমনটাই দাবি উত্তরপ্রদেশ সহ সমস্ত দেশের বিজেপি কর্মকর্তা এবং সাধারণ সমর্থকদের। উত্তরপ্রদেশে ভোটের ফলাফল হয়েছে, বিজেপি+ ৩২৫, এসপি- ৪৭, কংগ্রেস- ৭, বিএসপি- ১৯ এবং অন্যান্য-৫। মোট ৪০৩ আসন। পাঁচটি রাজ্যে ফলাফল প্রকাশের পর পরই অনেকের সুর বদলে গেছে। বা বদলে যাচ্ছে। মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের গুজরাট আর আজকের ভারত এক নয়। তৎকালীন এনডিএ সরকারের সুবক্তা এবং কোয়ালিশন রাজনীতির নীরব কারিগর প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ‘রাজধর্ম’ পালনের কথা বলেছিলেন। সেই কথা মনে রেখেই সম্ভবত তিনি দলিত এবং ওবিসি গোষ্ঠীভুক্ত মানুষদের হিন্দুত্বের ছাতার নিচে নিয়ে এসে এসপি এবং বিএসপি ভোট ব্যঙ্কে থাবা বসিয়েছেন। মোদী নিজে ধনিকশ্রেণির প্রতিনিধি নন এই বিশ্বাস গরিব দলিত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। সেই বিশ্বাস বাস্তবের সঙ্গে মেলাতে নরেন্দ্র মোদী বাল্মীকি মন্দিরে পুজো দিয়েছেন। এর পরেই দক্ষকারিগরের মত ‘উন্নয়ন’ নামক এক বিশ্বায়ন সংশ্লিষ্ট ধারণাকে নিজের ফর্মুলায় হিন্দুত্বের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নতুন শ্লোগান ২০২২ সালের মধ্যে ‘নতুন ভারত নির্মাণ’। আলোচ্য দশকে সেই বিজেপি নেতা উত্তর প্রদেশ ভোটে সংখ্যালঘুদের ১০ শতাংশ ভোট পেয়েই সিংহ গর্জনে দলের সমস্ত রাশ নিজের হাতে নিয়েছেন। উত্তর প্রদেশে বিধাসভা ভোটে বিজেপির মুসলিম ভোট পাওয়া নিয়ে যে উচ্চতায় আলোচনা হছে সেটা কতটা সঠিক? ভবিষ্যৎ বলবে সমাজ বিঞ্জানের ভাষায়। ‘তিন তালাক’ নামক এক বিতর্কিত সামাজিক বিষয়ে বিজেপির অবস্থান কে দু’হাত তুলে সমর্থন করেছে আজকের শিক্ষিত মুসলিম সমাজ। যার প্রভাব উত্তরপ্রদেশে পড়েছে। বিশেষত শিক্ষিত মুসলিম মহিলাদের ভোট পেয়েছে বিজেপি প্রার্থীরা অথচ রাজ্যের ভোটে বিজেপি দলের কোনও মুসলিম প্রার্থী ছিল না। মেরুকরণ ভেঙ্গে এবছরের উত্তর প্রদেশ নির্বাচন আধুনিক ভারতের সীমানা ভাঙতে চাইছে। এই বিশ্বাস আমদের গড়ে দিয়েছে। পাশাপাশি উল্টোদিকটাও রয়েছে। উত্তরপ্রদেশ বিধানসভায় মুসলিম প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল ৬৯কমে হয়েছে ২৪। এবছরের ভোটের পর রাজ্যের ১৯ শতাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব ৬ শতাংশে নেমে এল। একটি সূত্র দাবি করছে অতীতে বিজেপি দেওবন্দ থেকে দু’বার বিধানসভায় প্রার্থী পাঠিয়েছে। ১৯৯৩ সালে শশিবালা পুন্দির এবং ১৯৯৬ সালে সুখবির সিংহ পুন্দির মুসলিম অধ্যুষিত ‘দেওবন্দ’ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ভোটে জয়ী হয়। ১৯৯২ সালে রামমন্দির ইস্যুকে কেন্দ্র করে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তার পরবর্তী নির্বাচনে ওই ১৯৯৩ সালেই দেওবন্দ কেন্দ্র থেকে দক্ষিণপন্থী প্রার্থী জয়ী হয়।
জাতপাতের সমস্যা আছে এমন এক জটিল মেরুকরণের রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ নীরবে জাঠেদের ভোট টানতে ব্যবহার করেছেন সংখ্যালঘু তাস। বিজেপি সভাপতি ছুটেছেন কুমহার, কুর্মি, মাল্লার, লোধ, বাল্মিকি, ধোবি, কোরি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কাছে। নিম্নবর্ণের হিন্দু ভোট পকেটে পুড়েছেন বিশ্বায়ন সংশ্লিষ্ট ‘উন্নয়ন’এর কথা বলে ওইসব নিম্নবর্ণের মানুষদের বঞ্চনার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আগামী ভবিষ্যতে আর্থিক এবং সামাজিক সম্মান এনে দেওয়ার। বিজেপি সুত্রে খবর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গুরুত্ব দিয়েছিলেন ‘লিডার্স ইন কমিউনিটি’ যারা ছিলেন তাঁদের। তথাকথিত ‘কমিউনিটি লিডার’দের বিজেপি রথের সারথি নরেন্দ্র মোদী পাশে সরিয়ে রেখেছিলেন। সুকৌশলে সংখ্যালঘু ভোটব্যঙ্ককেও ব্যবহার করতে পেরছেন একজনও সংখ্যালঘু প্রার্থী না রেখে। কোন ম্যাজিকে এটা সম্ভব?        
কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা মণিশঙ্কর আয়ার এনডিটিভি ওয়েব পেজে ১৬ মার্চ, ২০১৭ উত্তরপ্রদেশ ভোটে মুসলিম ভোট নিয়ে কি লিখেছেন একবার পড়ে নিতে চাইছি।
 ‘’As I found myself through most of last Saturday being battered in TV studios by the election results as they inexorably poured in, there was one illuminating moment when I suddenly understood what this election was about. Asked why the BJP had not found one candidate to contest any of 403 seats in UP, Swapan Dasgupta replied that it was perhaps because they were not able to find any Muslim who "adhered" to their programme
Amazing! Of 40 million Muslims in UP, who constitute about a quarter of the population of the state, the BJP were unable to find even one Muslim to field who, adhering to their programme, could win a seat for them. Yet, the BJP won 324 seats of 403. All those who did field Muslims lost badly, and those who won did so because they wrapped all Hindu communities into a single Hindu saffron flag. That was Savarkar's "idea of India" - the marginalization of the minorities to promote the unity of Hindu India. The UP outcome is the first major political triumph in nearly a century of the Hindutva Idea of the Indian nation. It is that which we have to fight. This moment of disaster is not, therefore, the moment to surrender. We have to remain in the contest. But how?’’   
উদাহারণ হিসাবে আমরা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যক্তিত্ব মোহনদাস পাইয়ের লেখা একবার পড়ে নিতে পারি। উত্তরপ্রদেশে ২০১৭ সালে বিধানসভা ‘নতুন ভারত’এর যে দিকচিহ্নের নতুন পাথর আমাদের সামনে এনে দিয়েছে সেই ভারতশীলা সনাতন ভারতকে আধুনিক থেকে উত্তর আধুনিক ভারতে উত্তরণ করবেএই দূরদর্শিতা ভারতীয় সমস্ত দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিদের আছে আশা করতেই পারি। যে কথা পণ্ডিত নেহরু কংগ্রেসের সাংগঠনিক বিষয়ক সমস্যাকে সামনে রেখে কংগ্রেস কর্মীদের মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। আগে স্বাধীনতা তারপরে আধুনিক ভারত। একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বিজেপির ঝড় তোলা রথের গতি জানতে তাই মোহনদাস পাইয়ের বক্তব্য আমাদের জানা প্রয়োজন। ১৩ মার্চ, ২০১৭, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যক্তিত্ব মোহনদাস এনডিটিভি ব্লগে লিখছেন,
‘’The massive victory of the BJP in UP has many lessons for India's political parties. A great majority of the voters are below the age of 40 and their world view is largely shaped by the heady growth in GDP of 8.4% in $ terms per annum over 25 years. They want growth, development and jobs, not caste politics, Mulayam and Lalu's brand of crony socialism, or religious conflict. Women seem to have voted largely for PM Modi as they felt that he would protect them and ensure respect and economic opportunities, not the Goonda Raj of the SP’’ .

অতীতকে মনে রেখেই ভোটের পর দিল্লি রোড শো এবং হোলি মিলনের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী দলের নেতা কর্মীদের মনে করিয়ে দিয়েছেন দায়িত্বের কথা। উদাহারণ দিয়েছেন গাছের। তাঁর কথায় ফল এলে গাছ যেমন ঝুঁকে যায়, এই ভোটের ফলের পরে দলকে আরও নম্র হতে হবে। সরকার সকলের যাঁরা দলকে ভোট দেননি তাঁদেরওওই সভায় মোদী ২০১৪ সালের ইস্তাহার প্রকাশের সময় বলা তাঁর সেই ঐতিহাসিক বক্তব্যকে টেনে এনে বলেছেন, ‘’তখন আমার কথার অন্য মানে করা হয়েছিল। তবুও সাহস আছে বলেই ফের বলছি, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কোনও কাজ করব না।‘’
মোদীজির ২০২২ সালের মধ্যে ‘নতুন ভারত নির্মাণ’ প্রসঙ্গে কংগ্রেস নেতা রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা নিজের ব্লগে লিখেছেন,
 ‘’Abduction, defection, inducement, intimidation and polarization characterize the vision for “New India” under Mr. Modi.’’
১১ মার্চ আমিও আমার দু কামরার সাধারণ ঘরে একজন শ্রমজীবী সাংবাদিক এবং সাধারণ মানের ব্লগার হিসাবে খবর শুনছিলাম। শুধু শুনছিলাম বলব কেন? বৈদ্যুতিন মাধ্যম যখন অতি উৎসাহে খবর দেখছিলাম বলাই ভালো। একটি সর্বভারতীয় ইংরেজি চ্যালেলের অত্যন্ত দক্ষ মাঝবয়সি এক সাংবাদিক উত্তর প্রদেশের বিজেপি সভাপতি কেশবপ্রসাদ মৌর্যের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেনসাংবাদিক প্রশ্ন ছুড়লেন, আব হামারা আখরি সওয়াল। আভি উত্তর প্রদেশ সরকার আপকি হোগি। রামমন্দির ইস্যু ফির সামনে আয়েগা? আপকা বিরোধী দল ইয়ে বাতচিত কর রহে হ্যায়।
সাংবাদিক মহাশয়ের কথা একরকম ছিনতাই করে নিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি কেশবপ্রসাদ মৌর্য বললেন, ‘’ইয়ে একদম বকওয়াস হ্যায়। হামারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীজি উন্নয়নকে বারে সোচতে হ্যায়। দলিত ওবিসি প্রমূখ শ্রেণীকে লিয়ে বহুত কাম করনা হ্যায়। আভি বিজেপি উন্নয়নকে লিয়ে সোচতা হ্যায়স্রিফ উন্নয়ন। আগে দেখিয়ে না কেয়া হোতা হ্যায়‘’             
উত্তরপ্রদেশ আজও যেহেতু ভারতের ভাগ্যবিধাতার অনেকটা হ্রদয়জুড়ে তাই ৪০৩ আসন পাওয়াটা যেমন বিজেপির ক্ষমতা অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে। সে সাংগঠনিক হোক বা প্রশাসনিক। এইসব নিয়ে ইতিমধ্যে চর্চা শুরু হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই কংগ্রেস সহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলির চিন্তা করার সময় এসেছে। ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে আমনে সামনে লড়াই করার মত সংগঠন প্রয়োজন। প্রয়োজন ওই মাপের এবং উচ্চতায় নেতা ঠিক করা। কে বা কোন দল এই দায়িত্ব নেবে? সম্প্রতি রুপা প্রকাশনী এবং ডঃ আম্বেদকর ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল ইকনমি-এর যৌথ উদ্যোগে একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ‘’The political structure of one man one vote, one vote one value can’t sustain till we achiuve one man= one vote.
ওই দিনের বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম, এনসিপি নেতা এবং প্রাক্তন কেন্দ্রীয়মন্ত্রী শরদ পাওয়ার এবং আরও অনেকে। অনুষ্ঠানের পরে ইয়েচুরি তার বক্তব্য ওই দিন ট্যুইটও করেন। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক যে দর্শনের কথা বলেছেন সেটা থেকে ২০১৯ সালের বিরোধী জোটের গন্ধ আমরা পাচ্ছি। কিভাবে সেই জোট গড়ে উঠবে? কোন দল এই গুরু দায়িত্ব সামলাতে পারবেন? আলোচনা শুরু হয়েছে। আমাদের সামনে ভারতের সব থেকে বড় দল হিসাবে রয়েছে কংগ্রেস। এই দলটি একাধিক উত্থান পতনের মধ্যে থেকে দলকে যেমন সামনের সারিতে আনতে সক্ষম হয়েছে পাশাপাশি দেশের জটিল সময়েও কংগ্রেস নামক এই দলটি মুশকিল আসান হয়ে ভারতীয় আম আদমির দায়িত্ব পালন করেছে।  ‘ইনক্লুসিভ কংগ্রেস’ পার্টী থেকে ‘ইনক্লুসিভ ইন্ডিয়া’ এই ধারণায় কংগ্রেস দলের উত্তরণ প্রয়োজন রয়েছে আবারও। ১৯৯৮ সালের ‘পাঁচমারি চিন্তন শিবির’ এর সিদ্ধান্ত থেকে বেরিয়ে এসে ২০০৪ সালে  কংগ্রেস সভাপতি সনিয়া  গাঁধির নেতৃত্বে ঝঞ্জা বিদ্ধস্ত, দিশাহীন কংগ্রেসকে আমরা ভারতবাসি ঘুরে দাঁড়াতে দেখেছি। ইউপিএ সরকারের মিশ্র অর্থনীতি এবং সামাজিক ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত এনে দিয়েছিল কংগ্রেসের নেতৃত্ব পরে কিছু ক্ষেত্রে বিতর্ক দেখা দেয়। তা সত্বেও বলা যায়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ, সনিয়া গাঁধি, এ কে অ্যান্টনি সহ কয়েকজন শীর্ষ নেতৃত্বের ঔজ্জবল্য একটুও কমে না। আজকের বাস্তবতায় উদাহারণ হিসাবে আবার উত্তর আধুনিক ভারতে অন্যতম চর্চার বিষয়।        
কংগ্রেস সহ সভাপতি রাহুল গাঁধিও কাঁধে জোয়াল নিয়ে কংগ্রেস দলটাকে যেমন আধুনিক ঘরানায় নীরবে গড়ে তুলছেন। কংগ্রেস সহ সভাপতি মেনে নিচ্ছেন দলকে আধুনিক ঘরানায় গড়ে নিতে না পারলে বিজেপির মত সংঘ পরিবার নির্ভর দলের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব হবে না। পাঁচ রাজ্যের ভোটের পর ১৪ মার্চ রাহুল গাঁধি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘’বিজেপির সঙ্গে আদর্শগত লড়াই জারি থাকবে। উত্তর প্রদেশে দলের ফল খারাপ হয়েছে। দু’টি রাজ্যে হারলেও তিন রাজ্যে কংগ্রেস এগিয়ে। এটাই বাস্তব যে, কংগ্রেসের কাঠামো ও সংগঠনের পরিবর্তন ঘটাতে হবে।‘’    
‘ইনক্লুসিভ ইন্ডিয়া’ মনে রেখেই কংগ্রেস সহ সভাপতি রাহু গাঁধি সরব ভারতীয় নীতিনিষ্ঠ জোটের সন্ধানে আছেন।  অখিলেশ যাদব, সীতারাম ইয়েচুরি, ওমর আব্দুল্লা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীতিশ কুমার, বিজু পট্টনায়ক মায়াবতী, লালুপ্রসাদ যাদব সহ বিভিন্ন রাজ্যের একাধিক নেতৃত্বের সঙ্গেও তিনি গঠনমূলক আলোচনা শুরু করতে চলেছেন বলেই আমাদের কাছে খবর আছে। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা মণীশঙ্কর আয়ারও মনে করেন, উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের ভোটের পর যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এই মাহেন্দ্রক্ষণে কংগ্রেস দলের এককভাবে বিজেপির মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। দরকার একটি সুচিন্তিত এবং শক্তিশালী নেতৃত্বের জোট। এই প্রসঙ্গে এনডিটিভি ব্লগে একই তারিখে মণিশঙ্কর আয়ার পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর উদাহারণ টেনে লিখছেন,
‘’Even more important than promoting the composite alliance is for the Congress to put its own house in order. What Congressmen and women need to do is hark back to a long-forgotten Presidential Address by Jawaharlal Nehru to the Lucknow Congress in 1936: 

"We have largely lost touch with the masses and, deprived of the life-giving energy that flows from them, we dry up and weaken, and our organization shrinks and loses the power it had."
তিনি আরও লিখছেন, 
‘’Meanwhile, there are elections to be fought and the nation won urgently back to the inclusive path. For that, Nehru's analysis of 1936 needs to be combined with Sonia Gandhi's pragmatism of 2004. We must needs move in the present context from being a "party of inclusion" to becoming once again a "coalition of inclusion".


উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের ভোট পরবর্তী পরিস্থিতির প্রভাব আমাদের পশ্চিমবঙ্গে ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। এই বাংলায় আরএসএস পরিচালিত স্কুল নিয়ে নতুন করে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। কিছুদিন আগে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত একটি খবরে জানা যায়, কম খরচে অথবা নিখরচায় আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে স্কুল গড়তে চলেছে। এইসব বিদ্যালয়ে আরএসএস সব শিশুকে আধুনিক এবং মূল্যবোধসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়া হবে জানান তাঁদের প্রতিনিধি এই খবরের পরেই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় হুশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, রাজ্য সরকার ধর্মের ভিত্তিতে স্কুল চালাতে দেবেনা। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে খবর আরএসএস পরিচালিত ১২৫টি স্কুলের বিষয়ে খোঁজ নেয় শিক্ষা দফতর। অনুসন্ধানের পর দেখা যায় ৯৬টি স্কুলই অনুমোদনহীন। ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট ছাড়াই স্কুলগুলি চলছে। রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ১০ মার্চ বলেন, ‘’ওইসব স্কুলগুলিকে চিঠি দিয়ে জানতে চাওয়া হবে, তারা রাজ্য সরকারের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট ছাড়া কী ভাবে স্কুল চালাচ্ছে? কয়েকটি স্কুলকে ইতিমধ্যে চিঠি পাঠিয়েও দেওয়া হয়েছে।‘’ পার্থবাবুর এই বার্তার পরেই সংবাদ মাধ্যম সূত্রে খবর, সংঘের স্কুলপাঠ্য থেকে রামায়ণ, মহাভারত তুলে দিতে হবে। এই মর্মে পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা দফতর নির্দেশ দিয়েছে। রাজ্য শিক্ষা দফতরের এই নির্দেশকে কেন্দ্র করে রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় সরস্বতী শিশু মন্দির, বিবেকানন্দ শিশু মন্দির, সারদা শিশুতীর্থের মতো বিদ্যালয়ে শিক্ষক, শিক্ষিকা এবং পরিচালন সমিতির কর্মকর্তারা প্রতিবাদ কর্মসূচী নিচ্ছেন। বিজেপি সূত্রে খবর সারা দেশে ওইসব বিদ্যালয়ের প্রায় ২০ হাজার শাখা রয়েছে।
বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাহুল সিনহা ফোনে জানিয়েছেন, ৫০ বছর ধরে ওইসব স্কুল চলছে। এটা নতুন কিছু নয়। সাংবাদিকরা হয়ত নতুন খবর হিসাবে প্রকাশ করেছে। সংঘ পরিবার পরিচালিত বিদ্যাবিকাশ পরিষদ একটি ট্রাস্ট। রাহুলবাবু বলেন, ‘’এই ট্রাস্টের মাধ্যমে যেসব স্কুল পরিচালিত হয় সেইসব স্কুলে নির্দিষ্ট রাজ্যের পঠন পাঠনের কর্মসূচী মেনে এই শিক্ষাদান করা হয়। রাজ্য সরকারের নয়া ফতোয়ায় কি আছে খোজ নিয়ে দেখতে হবে।‘’
এই সপ্তাহে রাজের একটি প্রথম শ্রেণির বাংলা দৈনিকে এক সাক্ষাৎকারে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ বলেছেন, ‘’বিজেপির সঙ্গে আরএসএসের ঘনিষ্ঠ সমন্বয় আছে। উত্তরপ্রদেশেও ছিল, পশ্চিমবঙ্গেও আছে। সেখানে জেলায় জেলায় আরএসএসের সংগঠন দারুণ কাজ করছে। ওদের কাজকর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষ রাজনীতিকে মেলাবেন না। ওরা সমাজসেবায় নিয়োজিত। বিজেপি এই সমাজসেবায় বিশ্বাস করে।‘’       
প্রদেশ কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা দেবীপ্রসাদ রায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম রাজ্যে আরএসএসের এই ধরণের আগ্রাসী ভূমিকার সঙ্গে কংগ্রেস কিভাবে লড়বে? ডিপি রায় বলেন, ‘’অতীতে কংগ্রেসের ভাবাদর্শ প্রচারের জন্য স্কুল ছিল। যেমন ‘বাপু সদভাবনা ট্রাস্ট’। আমি তখন এআইসিসি সচিব ছিলাম। নির্মলা দেশপান্ডেকে মাথায় রেখে নতুন করে এই স্কুলের কথা ভাবা হয়েছিল। দিল্লিতে মধুবনে ডঃ কামরা যে স্কুল চালাতেন সেই মডেল সামনে রেখে কেন্দ্রীয়ভাবে করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলামবিক্ষিপ্তভাবে গাঁধিয়ান ব্যক্তিরা যেসব স্কুল চালাতেনএছাড়াও ছিল শিশুকিশোর ভাবনাকে সামনে রেখে ‘বালসেবাদল’, সব পেয়েছির আসর, মৌমাছি, মণিমেলা, ক্লাবব্যান্ড ইত্যাদিএইসব প্রতিষ্ঠানে মুক্তমনের কিশোর বাহিনী গড়ে তোলা হত। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ৪০ এর নীচে ৬৫ শতাংশ যুব সম্প্রদায়। ২৫ এর নীচে ৪০ শতাংশ। ১০-১৯ বছর বয়সী ২৩০ মিলিয়ন। এদের কাছে কংগ্রেস পৌঁছতে না পারলে গাঁন্ধিজি এবং পণ্ডিত নেহরুর স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে। ‘সবলা’ নামে যে প্রকল্প ইউপিএ সরকার এনেছে সেটা খুবই ভালো প্রকল্প। এইসব প্রকল্পের অভিমুখ ঠিক করা দরকার ছিল। বেসরকারি গাঁধিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলিকে সমর্থন করা এবং সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। যেটা করা হয়নি। এখনও সময় আছে যদি আমরা নতুন করে ভাবতে চাই।‘’
পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বললেন, ‘’আরএসএসের জন্মলগ্ন থেকে আমরা বিরোধী। নেহরু বিরোধিতা করেছিলেন। ইন্দিরা গাঁধি ব্যান করেদিয়েছিলেন। লড়াই চলবে। তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির নৌকায় পা দিয়ে চলছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক মূল্যবোধেরও পরিবর্তন হয়েছে। তাই নতুন সংস্কৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া করেই আমাদের আরএসএসের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। কংগ্রেসের সংস্কৃতিকে মাথায় রেখে।‘’
মান্নান সাহেব আরও বলেন, ‘’উত্তরপ্রদেশে যে রসায়ন কাজ করেছে, পশ্চিমবঙ্গের ধর্মনিরপেক্ষ মাটিতে তা করবে না। রাজ্যের মানুষ বিজেপি-তৃণমূলের গোপন আঁতাত বুঝতে পেরে কংগ্রেসের দিকেই আসবেন।‘’     
আরএসএসের স্কুল প্রসঙ্গে সিপিএম কি ভাবছে? সিপিএম দলগতভাবে কোনওদিন স্কুল চালিয়েছে এমনটা কেউ মনে করতে পারছেন না। তবে মার্কসবাদী পাঠচক্র ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও ছিল পরেও বিভিন্ন কমিউনে এইসব পাঠচক্র চালাতেন বামপন্থী ঘরানার উচ্চশিক্ষিত সংগঠকরা। কিন্তু সরকারিভাবে এই ধরণের বিদ্যালয় পরিচালনার বিরোধী সিপিএম। দলের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সম্পাদক শমীক লাহিড়ী বললেন, ‘’আমাদের দল ওই ধরণের কোনও বিদ্যালয় করে না। আমাদের দলের কর্মসূচীতে সে কথা বলা আছে। আপনার প্রশ্নের উত্তরে জানাই, দিল্লিতে কমরেড হরকিষেণ সিংহ সুরজিতের নামে যে প্রতিষ্ঠান হয়েছে সেখানে দলের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। আরএসএসের মতো কোনও বিদ্যালয় করার পরিকল্পনা আমাদের দলে নেই। আমাদের দল ওই ঘরানায় বিশ্বাস করে না।‘’
২০০৯ সালের পর পশ্চিমবঙ্গের আর্থসামাজিক চিত্রপটে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন সমাজ বিঞ্জানীদের নজরে আসে। সেইসব অতীত থেকে পাওয়া ক্ষতচিহ্ন আমদের রাজ্যের সাধারণ মানুষের সামাজিক জীবনকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়ে গেছে। বাঙালির যে মূল্যবোধ সেই মূল্যবোধে অচেনা এক শক্তি আমাদের সবলে ধাক্কা মেরেছে। অবক্ষয়ের পাহার প্রমাণ সমস্যার মধ্যে ছিল স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু পাচার, নারী পাচার, কালো টাকা প্রভৃতি। দ্বিতীয় দফায় রাজ্যের দায়িত্ব নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শক্ত হাতে দক্ষ প্রশাসকের মত বিষয়গুলিতে নজর দিয়েছেন। রাজ্যের অতীতের কথা আমি সম্প্রতি পড়লাম প্রাক্তণ মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কলমে।
‘ফিরে দেখা’ দ্বিতীয় পর্ব বইয়ে প্রাক্তণ মুখ্যমন্ত্রী লিখছেন, ‘’.........বাঁচার উপায় নেই। খাদ্যে ন্যুনতম ক্যালরির অভাব। বাসস্থান, রাস্তাঘাট, শিক্ষা, পানীয় জল, স্বাস্থ্যের ভগ্নদশা এই গ্রামগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট। এখানেই সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে দারিদ্র দূরীকরণের কাজ চাইনির্দিষ্ট, স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘস্থায়ী কর্মসূচীর ভিত্তিতে। এই গ্রামগুলিতেই গরিবদের জন্য নামমাত্র মূল্যে ২ টাকা কেজি দরে চাল ও গম রেশনে দেওয়া শুরু হয়। স্কুলের শিক্ষা অবৈতনিক, দুপুরে খাওয়া এবং ছাত্রীদের বিনামূল্যে সাইকেল দেওয়া শুরু হয়েছিল। একবার গ্রামাঞ্চলে থাকাকালীন শুনলাম এখানে সবে মিড-ডে মিলের কাজ শুরু হয়েছে। লাল মাটির রাস্তার শেষে প্রাথমিক স্কুলের বাড়ি। একতলা। পর পর ৬টা ঘর। সবকটায় ভর্তি ছাত্রছাত্রী। এখন ৯৯ ভাগ ছেল-মেয়ে স্কুলে আসছে। মাস্টারমশাইদের বসার ঘর নেই। পেছনে একটা টিউবওয়েল। খোলা জায়গায় পর্দা টাঙিয়ে সবে ভাত হয়েছে। ডাল আগেই হয়েছে। আর আছে কুমড়ো, আলু, পিঁয়াজ। বাচ্চারা ছোটাছুটি করে খেতে বসেছে। মহা আনন্দেকারণ পেটে ক্ষুধা। এই ক্ষুধা না মিটিয়ে কিসের পড়াশুনো? মাস্টার মশাইরা বললেন, ‘খাবার পরে পড়াশোনায় মনযোগ বেড়েছে।’
আমি সুন্দরবনের স্কুলের মেয়েদের সরকারের দেওয়া সাইকেল হাতে নিয়ে মুখ-চোখ দেখেছি। তাঁরা বিশ্বাস করতে পারেনি। এবার কষ্ট করেও পড়াশোনা শেখা চলবে। আত্মমর্যাদা নিয়ে। আমার মনে হলো এটাতো আগেই প্রাপ্য ছিল- কেন দেরি করলাম? এইসব কর্মসূচী রুপায়নের জন্য দুটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছি। প্রথমে, সরকারের কর্মীবাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সাক্ষাৎ প্রয়োজন, এরপর সরকারি সিদ্ধান্তগুলির ব্যাখ্যা করতে হবে।‘’ পৃষ্ঠা- ১৬
শেষপর্বে ফিরে আসা যাক ‘ইনক্লুসিভ কোয়ালিশন’ নামক বাক্য বন্ধে। দেশের স্বার্থে সকলের প্রয়োজনে এবং মানবতার দাবিতে পশ্চিমবঙ্গে ডাঃ বিধানন্দ্র রায়ের আমলেও বিরোধী এবং সরকারের একসাথে চলার কথা পড়লাম অশোক কুমার বাগচির লেখা ডঃ বিধানচন্দ্র রায় ‘এ জুয়েল অব ইন্ডিয়া’ (এশিয়াটিক সোসাইটি, জুন, ২০০৪) বইটিতে। অশোকবাবু তাঁর বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে ‘শ্রী জ্যোতি বসু অ্যান্ড ডঃ রায়’ পরিচ্ছদে লিখছেন।
‘’………….’Once Dr. Ray called me and expressed the concern of refugees from East Bengal after the partition of India. He angrily criticized the neglect of the center on East Bengal refuges. I am bound to admit that he criticized the Central Government plainly without any expression of anger or disrespect.’
Sri Jyoti Basu admired the formation of the Bengal Relief Team during the Second World War by Dr. Ray. He and Comrade Muzaffar Ahmed signed the paper. He was concerned with the proper looking after jailed prisoners.
Dr. Ray tried his utmost to make a settlement with the MLAs of opposition legislators and the Congress MLAs.
He introduced the use of microphone during the Indian conflict with China, in favour of the opposition.

During the agitation by school teachers of West Bengal, the government ordered for the arrest and confinement of Jyoti Basu. Dr. Ray prevented his arrest while Sri Basu took refugee in the assembly house.’’ P- 44/45.                    

Saturday 4 March 2017

আমরা মর্মাহত

আমরা মর্মাহত

কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটা পড়লাম অতি সামান্য ঞ্জান নিয়েও ঠিক মেলাতে পারছিলাম না। বাংলাদেশের শিশু পাঠ্যসূচি থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এস ওয়াজেদ আলি, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বাদ পড়েছে। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে এমনটাই খবর। আমি এই খবর পাওয়ার পর কলকাতায় আমার পরিচিত কয়েকজন বাঙালি বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের এই সিদ্ধান্ত ঠিক মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের বক্তব্যের সারমর্ম ‘আমরা আন্তরিকভাবে মর্মাহত’। বাংলাভাষার জন্য যে দেশ আত্মিকভাবে সারা বিশ্বের আপামর বাঙালির কাছে শ্রদ্ধা, স্নেহ-মায়া, ভলোবাসা এবং আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধেন, সেই বাংলাদেশ সরকার এমন একটা সিদ্ধান্ত নিল? সম্প্রতি একটি সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকাশ বর্তমান বিশ্বে ১৩০ কোটি মানুষ জাতীয় সংগীত গান বাংলা ভাষায়। ১২৫ কোটি চিনা মানুষ জাতীয় সংগীত গান চিনা ভাষায়। মাত্র ৯৪ কোটি মানুষ ইংরেজি ভাষায় জাতীয় সংগীত গান। পুনরাবৃত্তি করলে কি অতিকথন হবে? আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আমাদের মাতৃভাষা আপন গরিমায় সম্মান অর্জন করেছে।  
সম্প্রতি কলকাতায় একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের  মানবাধিকার আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা শাহরিয়ার কবীর মন্তব্য করেন, ভাষার কোনও ধর্ম নেই। একুশে ফেব্রুয়ারির মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বাহান্নয় মাতৃভাষার স্বীকৃতির জন্য যে বাংলাদেশকে রক্ত ঝরাতে হয়েছে, সেই দেশ এখন নতুন আক্রমণের মুখে। এই আক্রমণকারীরাও শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন, কিন্তু চিন্তা চেতনায় তাঁরা তথাকথিত গ্রামীণ মূল্যবোধে অভ্যস্ত। বাংলাদেশের পাঠ্যবই থেকে তাঁরা অমুসলিম লেখকদের লেখা বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতাও সম্পাদনার স্পর্ধা দেখাচ্ছেন বর্তমান সরকার মুক্তবুদ্ধির মানুষের পাশে রয়েছে। কিন্তু কখনও কখনও তারাও মাথা নত করে ফেলছে। পাঠ্যসূচি সংস্কারের নামে তারা মুক্তচিন্তার বিপক্ষে আছেন যারা তাঁদের কিছু দাবি মেনে নিয়ে লজ্জাজনক উদাহারণ তৈরি করছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমাজ কর্মী বলেন, ‘’একুশে মাথা নত না-করার শপথ শিখিয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে। জয় তাঁদের হবেই।‘’ এই বক্তব্য যে অনুষ্ঠানে শাহরিয়ার কবীর বলেন সেই অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম না। ২২ ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকে এই খবর প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দলের বাংলাদেশ সরকার কি আধুনিক আর্থসামাজিক পরিস্থিতির মানদন্ডে সংস্কৃতির গড়াপেটা করছেন? ভারতীয় উপমহাদেশের একটি অনুন্নত দেশ গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ। গত কয়েক দশকে এই দেশে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে এবং হচ্ছেপেট্রো ডলার যেমন আসছে। আসছে ভারতীয় টাকা। আসছে ইউরোপ আমেরিকার ডলার। পিছিয়ে নেই এশিয়ার চিন এবং জাপান। এতগুলি দেশ মুক্ত বাণিজ্যের সুযোগে নিজেদের দেশের পণ্য বাংলাদেশে রফতানি করতে পারছে। বাংলাদেশে গিয়ে পণ্য তৈরি করে সেই পণ্য ভিন দেশে পাঠিয়েও সম্ভবত বৃহৎ বাণিজ্য হচ্ছে। পুঁজির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশে আর্থসামাজিক এবং আর্থসাংস্কৃতিক কাঠামো, পরিকাঠামো এবং উপরিকাঠামোর পরিবর্তন হয়। সমাজবিঞ্জানীদের ব্যাখ্যাতেও সেই পরিভাষা আমরা পাই। পণ্য সংস্কৃতির হাত ধরেই উন্নত দেশে এবং উন্নয়নশীল দেশে ছোট ছোট বাজার বা হাটের পরিবর্তে আমরা ‘মল’ নামক এক ছাদের তলায় বাজার করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি।
গতিশীল সমাজের সঙ্গে তালমিল রেখে স্বদেশের সভ্যতাকেই গড়ে নিতে চাইছে সেইসব দেশের আধুনিক মনস্ক সরকার এবং আধুনিক নাগরিক। কালের নিয়মেই সম্ভবত এই ব্যবস্থা আমদের টেনে নিয়ে যায়। দ্বান্দিক বিকাশের পরম্পরা মেনে। লড়াইটা সেই শুরুর বিন্দু থেকে। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক সংস্কৃতি বিকাশের অধিকার নিয়ে হাজির হয়। সেই সময়টার সঙ্গে কতটা সমঝোতা করে একটা দেশ নিজেদের ঐতিহ্য কতটা রাখবে কতটা বর্জন করবে নির্ভর করছে সেই দেশের চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীদের উপর। পুঁজিবাদী কতৃত্ব কায়েমের সঙ্গে সঙ্গে ওই ঘরানার সংস্কৃতি ‘স্বাধীনতা’ দিতে চায় মানুষকে। কথা বলার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি। এই স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সৃজনশীলতার অনেকটা সময় ওই সংস্কৃতি আমাদের টেনে নিয়ে যায় ভোগবাদের চরমতম সীমায়। যারা যত বেশী ওই সংস্কৃতির সঙ্গে সমঝোতা করব ততই অচেনা সভ্যতার আলোকছটায় ভাসিয়ে দিতে থাকব নিজেদেরকিন্তু যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন সৃষ্টির তাগিদে নিজেদের ধ্রুপদী তাল লয় চিনতে চাইবে তাঁদের হয়ত আগামীতে ব্যর্থ হিসাবে চিহ্নিত করবে চলতি সমাজ ব্যবস্থা ভোগবাদী সমাজের গণ্যমান্য প্রতিনিধিরা।  নবীন প্রজন্মের কাছে প্রচারের অভাবে ওইসব সৃষ্টিশীল মানুষদের বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়। তবু লড়াইটা কি থামে? সম্ভবত দ্বান্দিক বিকাশের ধারবাহিক নিয়ম মেনেই ধ্রুপদী সাহিত্য, শিল্প, চিত্র, সংগীত সমাজকে মনে করিয়ে দেয় যা কিছু পুরনো সবটা কি পণ্য সংস্কৃতি গ্রাস করতে পারে? ওনেকটা ভাষা শিক্ষার মত। মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ। বাংলাভাষা জানা একজন মানুষ যদি ভিন্ন ভাষা শিখে বাংলা ভাষায় কম কথা বলেন তাহলে যেমন ‘গুরুচন্ডালি’ দোষ নজরে পড়ে। অনেকটা চম্পট শব্দের ভাষা-চম্পট ভাষার কোলাজ-এর মত।  ভারতে বর্তমান প্রজন্ম যেমনভাবে কথা বলছে। ভিনদেশের বা ভিন রাজ্যের ভাষা জানায় কোনও আপত্তি থাকাতে পারে না। ‘দেশে বিদেশে’-এর লেখক সৈয়দ মুজতবা আলি কতগুলি ভাষা জানতেন? উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে এই লেখায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ওঁরাও জনগোষ্ঠীর ভাষাকে স্বীকৃতি দিল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার। ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘’আমরা নেপালি, গুরমুখী, অলচিকি ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছি। একইভাবে কুরুখ ভাষাকেও বেছে নিয়েছি। কারণ, এই ভাষা অবলুপ্তির পথে। মাত্র ১৬ লক্ষ মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন।‘’ মুখ্যমন্ত্রী ওই অনুষ্ঠানে আরও জানান, রাজবংশীদের কামতাপুরি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একটি কমিটি গড়া হয়েছে।   
পণ্য সংস্কৃতির দাপটের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সভ্যতাও অতীত থেকেই ধ্রুপদী ধারা বয়ে আনতে আগ্রহী। কয়েকদিন আগে শান্তিনিকেতন সূত্রে খবর পেলাম, বিশ্বভারতীর উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের গানকে গ্রামাঞ্চলে আরও জনপ্রিয় করতে প্রশিক্ষণ শিবির করা হবে। সেই সব প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রথমদিকে ডেকে নেওয়া হবে শান্তিনিকেতনের আশপাশের গ্রামগুলির আগ্রহী ছেলেমেয়েদের। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রশিক্ষণ শিবিরে গান শেখাবেন এপার বাংলার জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত আচার্য, শ্রাবণী সেন এবং স্বপন বসু২৪ ফেব্রুয়ারি ইতিমধ্যে ‘ইন্সটিটিউট অব রুরাল রিকন্সট্রাকশন ইন শ্রীনিকেতন নামে এই সংস্থা একটি ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছে। আগামী কয়েক মাসে এই ধরনের আরও প্রশিক্ষণ শিবির আয়োজন করা হবে। বিশ্বভারতী সূত্রে আমরা খবর পেয়েছি ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রশিক্ষণ শিবির প্রথম আয়োজন করেন। এবং ওই বছরেই কবিগুরু ‘ইন্সটিটিউট অব রুরাল রিকন্সট্রাকশন ইন শ্রীনিকেতন’ গড়ে তোলেন গ্রামের তরুণ প্রজন্মকে সংগীত প্রশিক্ষণ সহ একাধিক ভোকেশনাল শিক্ষায় শিক্ষিত করতে।
  আলোচ্য নিবন্ধের বিষয় ছিল বাংলাদেশের শিশু পাঠ্যসূচি থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এস ওয়াজেদ আলি, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বাদ পড়েছে। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে এমনটাই খবর। কি খবর ছিল? আসুন পুরো খবরটা আমরা পড়ে দেখি।
বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র      
‘’কলকাতা: কট্টরপন্থী মুসলিম সংগঠনগুলির চাপের কাছে নতিস্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দিল বাংলাদেশ। এমনকী রবীন্দ্রনাথের কবিতা আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতেও বাদ পড়েছে ষষ্ঠ শ্রেণির সিলেবাস থেকে। পাঠ্যক্রমে রদবদল আনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু মুসলিম গোষ্ঠীগুলির দাবি, এই কবিতাটি হিন্দু দেবীর উদ্দেশে লেখা হয়েছে। সে কারণে এটি পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
এছাড়াও বাদ পড়েছে ১৬টি অন্যান্য কবিতা ও গল্প। শরৎচন্দ্রের ছোট গল্প লালু, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণ কাহিনী পালামৌ, এস ওয়াজেদ আলির রাঁচি ভ্রমণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাঁকোটা দুলছে ও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছেলেদের রামায়ণ। তবে রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী রয়ে গিয়েছে সিলেবাসে।
কলকাতায় বাংলাদেশি ডেপুটি হাই কমিশন এই পাঠ্যক্রম বদলকে রুটিন আখ্যা দিলেও বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমের দাবি, মুসলিম গোষ্ঠী হেফাজত-এ-ইসলামের দাবি মেনে এভাবে পাঠ্যক্রম থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে এই সব সাহিত্য। যাতে ছোট ছেলেমেয়েদের মন মৌলবাদী ও কট্টরপন্থীদের ল্যাবরেটরি হয়ে উঠতে পারে ও কট্টরপন্থীরা তাদের চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণার বীজ বুনতে পারে তাদের মধ্যে।
তবে কলকাতাস্থ বাংলাদেশি এক কূটনীতিকের দাবি, সিলেবাস বদলানোর সিদ্ধান্ত সরকারের, হেফাজত-এ-ইসলাম বা অন্য কোনও গোষ্ঠীর চাপে এ কাজ করেনি তারা। বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা করে, তাঁকে মুছে ফেলার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। যদি এই পদক্ষেপে কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন, তবে সরকারের দ্বারস্থ হতে পারেন তিনি।
শেখ হাসিনা সরকারের এই পদক্ষেপে আহত এ দেশের বাংলা সাহিত্যিকরা। এক সংবাদপত্রে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার ওপর ধর্মীয় চিন্তাভাবনা চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। তাঁর আশা, বাংলাদেশি নাগরিকরা ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ধর্মের সঙ্গে সাহিত্যকে গুলিয়ে ফেলেননি। শ্রীজাত জানিয়েছেন, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কবিতাটি সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে জেনে তিনি বিস্মিত। যখনই তিনি ঢাকা গিয়েছেন, দেখেছেন, কত সম্মানের সঙ্গে এটি গাওয়া হয়। সরকার অবশ্যই সিলেবাস বদলাতে পারে। কিন্তু তা যদি কোনও কট্টরপন্থী গোষ্ঠীর দাবি মেনে নিয়ে করা হয়, তবে তা দুর্ভাগ্যজনক।
একইভাবে প্রতিবাদ করেছে বাংলাদেশি সাহিত্য সমাজ। বাংলাদেশি-মার্কিন সাহিত্যিক শর্বরী জোহরা আহমেদ মন্তব্য করেছেন, এভাবেই ধর্মীয় কট্টরপন্থা জাঁকিয়ে বসে, মুছে ফেলে দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে। এভাবে যদি চলতে থাকে, তবে এক প্রজন্মের মধ্যে নিজেদের ঐতিহ্য ও মিলিত সংস্কৃতি ভুলে স্রেফ একটি নির্দিষ্ঠ গোষ্ঠীর মধ্যে বদ্ধ হয়ে যাবে বাংলাদেশ।
এছাড়াও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়েছে হুমায়ুন আজাদের লেখা কবিতা বই। তাতে ছাত্রছাত্রীদের এমন বই পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে, যা তাদের ভালবাসতে ও স্বপ্ন দেখতে শেখায়, এমন কিছু নয়, যা মনের মধ্যে ভয়ের বীজ বোনে, অন্ধ করে দেয়। প্রয়াত সাহিত্যিকের পুত্র, দেশ থেকে নির্বাসিত ব্লগার অনন্য আজাদ মন্তব্য করেছেন, যেভাবে শিক্ষানীতি নিয়ে বাংলাদেশ আপসের পথে হাঁটল, তার একদিন বিরাট মূল্য চোকাতে হবে।‘’  সূত্রের খবর ABP Ananda, Facebook
শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য অপূর্ণ থেকে যায়। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’ আজও সমসাময়িক মনে হয় আমাদের কাছে। ‘দেনা পাওনা’ উপন্যাসে আমরা পড়েছি ষোড়শীকে জীবনানন্দ অত্যাচার করলেও ষোড়শী কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে তাঁর স্বামীকে বাঁচাচ্ছে পুলিশের হাত থেকে। সেই সময়ের পল্লীসমাজ গ্রামের বধূদের ধর্ম শিক্ষা অথবা সামাজিক শিক্ষা দিয়েছিল। বিবাহিত মেয়েদের স্বামীর অমঙ্গল ঘটাতে নেই। শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজের তথা গ্রামের কম শিক্ষিত মেয়েরা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেখাপড়া জানতেন না সেই সময়ের আমাদের মা বোনেরা। কিন্তু বাংলার কৃষ্টি, রিচুয়াল থেকে তাঁদের টেনে এনে ফেলে দিতে পারেনি ব্রিটিশ সভ্যতার সওদাগরদের এগিয়ে থাকা মূল্যবোধ। বর্তমানের সঙ্গে অতীতের সংঘাত যতই থাক।
অভিযোগ শুধু বাংলাদেশ নিয়ে নয়। আমাদের দেশ ভারত কি করল? এ কোন সংস্কৃতি? বা কি ধরণের অসহিস্নুতা? আমাদের দেশের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হল সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির কবি, লেখক, সাহিত্যিকদের সাহিত্য সম্মেলন। ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি ধরে চলা চারদিনের ওই সম্মেলনে আমন্ত্রিত ছিলেন সার্কগোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির প্রতিনিধিরা। আমন্ত্রণ জানানো হয়নি পাকিস্তানের বিদ্যাজীবী তথা বুদ্ধীজীবীদের। ‘ফাউন্ডেশন অব সার্ক রাইটার্স অ্যান্ড লিটারেচার’-এর পক্ষ থেকে সংবাদ মাধ্যমকে জানানো হয়েছে পাকিস্তানের লেখকদের আমন্ত্রণে নিষেধাঞ্জা জারি করেছে বিদেশ এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মত বিনিময়ের এমন ধ্রুপদী প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগানোর সুযোগ আমরা হারালাম রাষ্ট্রনায়কদের সিদ্ধান্তে। এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অপর এক রাষ্ট্রের টান টান মর্যাদার লড়াই আমাদের আন্তর্জাতিক অনুভবে আঘাত করে। পাশাপাশি অন্য গল্পও পড়ে ফেলতে পারি।
১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা দেশের প্রখ্যাত লেখিকা সেলিনা হোসেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকের ‘রবিবাসরীয়’ পাতায় ‘রক্তফুলের বরণডালা’ শিরোনামে যে লেখাটি লেখেন সেটাকে কি বলব? প্রতিবেদন? ছোট গল্প? রিপোর্টাজ? যে অংশটা উল্লেখ করলে এই নিবন্ধের প্রাচুর্য বাড়তে পারে আমি সেই অংশটা তুলে নিচ্ছি। ‘’..................রাশেদ দু’দিন আগে দিল্লির সার্ক রাইটার্স ফাউন্ডেশন থেকে সাহিত্য উৎসবে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ পেয়েছে। .............................. চায়ের কাপ নিয়ে টেবিলে বসলে পাশের টেবিল থেকে পাকিস্তানের কবি হামিদ বলে, ‘আপনি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ আমি রাশেদ মুস্তাফা। কবিতা লিখি।’
‘আমিও কবিতা লিখি। আমার নাম হামিদ আলি। আপনি কি আগে এই সম্মেলনে এসেছেন?’
‘না, এবারই প্রথম।’
‘আমি আরও তিনবার এসেছি। এই লিটারারি ফেস্টিভ্যাল আমি খুব এনজয় করি।’
কথা বলতে বলতে হামিদ আলি রাশেদের মখোমুখি এসে বসে। কাপের বাকি চা এক চুমুকে শেষ করে। দু’হাত টেবিলের উপর রেখে বলে, ‘কাল ছাব্বিশে মার্চ। আপনাদের স্বাধীনতা দিবস। ওপেনিং সেশনে আমাকে কিছু বলতে বলা হয়েছে। আমি ঠিক করেছি, বাংলাদেশের লেখকদের স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাব। বক্তৃতা শেষে পাকিস্তান সরকারকে আহ্বান জানাব বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাইতে।’
‘তাই?’ রাশেদ দু’চোখ বিস্ফারিত করে তাকায়।
‘হ্যাঁ, আমি নিজের দেশেও একথা বলি। আমি ইসলামাবাদে একটি দৈনিক পত্রিকায় কাজ করি। আমি বিশ্বাস করি, কবিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়।’
‘তুমি আমার বন্ধু।’
হামিদের হাত জড়িয়ে ধরে রাশেদ। দুজনে চা শেষ করে গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়।
ভাষার টান। সাহিত্যের সম্পর্ক চিরায়ত। আমাদের শৈশব ঠিক করে দেয় আমরা ভাষা, সাহিত্য নিয়ে কতদূর এগতে চাই। এবং কতটা পথ পার হতে পারি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ বইয়ের ‘বাংলা শিক্ষার’ অবসান পরিচ্ছদে লিখছেন, ‘’মূল্য বুঝিতে পারিয়াছি। ছেলেবেলায় বাংলা পড়িতেছিলাম বলিয়াই সমস্ত মনটার চালনা সম্ভব হইয়াছিল। শিক্ষা জিনিসটা যথাসম্ভব আহার-ব্যাপারের মতো হওয়া উচিত। খাদ্যদ্রব্যে প্রথম কামড়টা দিবামাত্রেই তাহার স্বাদের সুখ আরম্ভ হয়, পেট ভরিবার পূর্ব হইতেই পেটটি খুশি হইয়া জাগিয়া উঠে— তাহাতে তাহার জারক রসগুলির আলস্য দূর হইয়া যায়। বাঙালির পক্ষে ইংরেজি শিক্ষায় এটি হইবার জো নাই। তাহার প্রথম কামড়েই দুইপাটি দাঁত আগাগোড়া নড়িয়া উঠে— মুখবিবরের মধ্যে একটা ছোটোখাটো ভূমিকম্পের অবতারণা হয়। তার পরে, সেটা যে লোস্ট্রজাতীয় পদার্থ নহে, সেটা যে রসে-পাক-করা মোদকবস্তু, তাহা বুঝিতে-বুঝিতেই বয়স অর্ধেক পার হইয়া যায়। বানানে ব্যকরণে বিষম লাগিয়া নাক-চোখ দিয়া যখন অজস্র জলধারা বহিয়া যাইতেছে, অন্তরটা তখন একেবারেই উপবাসী হইয়া আছেঅবশেষে বহুকষ্টে অনেক দেরিতে খাবারের সঙ্গে যখন পরিচয় ঘটে তখন ক্ষুদাটাই যায় মরিয়া। প্রথম হইতেই মনটাকে চালনা করিবার সুযোগ না পাইলে মনের চলৎশক্তিতেই মন্দা পড়িয়া যায়। যখন চারি দিকে খুব কষিয়া ইংরেজি পড়াইবার ধুম পড়িয়া গিয়াছে, তখন যিনি সাহস করিয়া আমাদিগকে দীর্ঘকাল বাংলা শিখাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, সেই আমার স্বর্গগত সেজদাদার উদ্দেশে সকৃতঞ্জ প্রণাম নিবেদন করিতেছি।‘’ (পৃষ্ঠা- ৪১, বিশ্বভারতী, ১৩৮০, ইংরেজি- ১৮৯৫)      
বাংলাদেশ সরকারের সিধান্তের কথা আমি নাট্য ব্যক্তিত্ব এবং পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য অ্যাকেডেমির সভপতি শাঁওলী মিত্রকে জানালে তিনি প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘’গত সপ্তাহে আমি ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ এবং ‘কালী ও কলম’ পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সিলেট সাহিত্য উৎসবে গিয়েছিলাম। প্রত্যেক বক্তা তাঁদের বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথকে উল্লেখ না করে পারেননি। আমাদের দেশের হোক অথবা বাংলাদেশের প্রত্যেকের বক্তব্য থেকে আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজনীয়তা এবং তার উপস্থিতি ধ্রুপদী মাত্রায় উপলব্ধি করলাম। তাই এই সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতে পারছি না। শরৎচন্দ্রের লেখা ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’ আমার স্মৃতিতে আজও রয়ে গেছে। ছোটবেলায় শরৎচন্দ্রের লেখা আমাদের ভীষণ প্রভাবিত করেছে। আমরা শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ পড়ে বড় হয়েছি। তাই বলছি রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র আজও প্রাসঙ্গিক।‘’
শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহাররের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর প্রতিক্রিয়া। তিনি এসএমএস করে জানিয়েছেন, ‘’আমি কিছু না জেনে ভিন্ন দেশ সম্পর্কে মতামত দিতে আগ্রহী নই।’’ ভারতীয় চলচিত্রের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা, কবি এবং স্বনামধন্য নাট্য ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় টেলিফোনে বললেন, ‘’আমি অসুস্থভালো করে খোঁজ খবর না নিয়ে মন্তব্য করতে পারব না। তবে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আমরা বাঙালিরা পথ চলব কি করে?
খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী এবং বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য যোগেন চৌধুরী বললেন, ‘’আমি আন্তরিকভাবে মর্মাহত। যারা বাংলাভাষা নিয়ে এত কাজ করছে, যে দেশ বাংলাভাষাকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে নিয়ে গেছে সেই দেশে এমনটা হতে পারে ভাবতে পারছি না। রবীন্দ্রনাথতো সমস্ত বিশ্বের কবি। সেই কবিকে পাঠ্যসূচী থেকে বাংলাদেশ সরকার বাদ দেবে মেলাতে পারছি না। এবং শরৎচন্দ্র? তাঁর ‘মহেশ’ গল্পের কথা আমাদের বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় সবসময় আসেসত্যিইতো তিনি অমর কথাশিল্পী। বাংলাদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, বুদ্ধিজীবী এবং আপামর মানুষ কী মেনে নেবে এই সিদ্ধান্ত?’’
‘গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা/ দু’ই চোখে দু’ই জলের ধারা মেঘনা যমুনা’ওপার বাংলার সুখে যেমন এপারের পাখিরা আনন্দের গান করেও পারের দুঃখে আমরা কষ্ট পাই। আলোকিত বাংলাদেশের উন্নয়ন আমাদের কাছে আজ বিস্ময়। একুশ শতাব্দীর বাংলাদেশ এখন উচ্চ শিক্ষিত সমাজ সচেতন টগবগে যুব সমাজের বাংলাদেশ। এই দেশকে এতটা উচ্চতায় নিয়ে এলেন যিনি তিনি বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আ মরি বাংলা ভাষা’-এই দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, বাংলা ভাষাকে তুলে যেমন ধরতে হবে পাশাপশি বাঙালি মুসলমানের ঐতিহ্যবাহি নিজস্বতাকে ধরে রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার শহিদ মিনারে সেদিন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘’বাংলাভাসী মুসলিমদের আলাদা সাংস্কৃতিক গ্রহণশীলতা আছে। সামাজিক সহনশীলতার ঐতিহ্য আমাদের মনে রাখতে হবে।‘’ তাঁর সময়োচিত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা পথ চলতে চাইছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাংস্কৃতিক ঘরানার আলোয়।                               
      


ইমেজ ভাঙ্গার ডাক

ইমেজ ভাঙ্গার ডাক :

কয়েকটা দিন আগের কথা। অভিজাত কলকাতার সদ্য পরিচিত কয়েকজন সহ নাগরিকের সঙ্গে গঙ্গাবক্ষে চারঘন্টা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা কাটালাম। আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম আগেই। সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় নিয়েছিলাম এই যা। সেদিনের অভিঞ্জতা অবশ্যই অভিনব। নৌকাবিহার বললেও অতিরিক্ত কিছু প্রকাশ করা হবে না। কথামত বিকেল সাড়ে তিনটের সময় ফেয়ারলি ঘাটে পৌঁছে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি একটি ২৮-৩০ বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে আমাদের পরিচিত একটি সংগঠনের নাম লেখা কাগজ। আমি যেতেই সামনে এগিয়ে এসে আলাপ করল। আমার নাম জেনে নিয়ে বলল, ‘’কাকু আসুন আমার সঙ্গে।‘’  
ছেলেটির সঙ্গে জেটির কাছাকাছি যেতেই দেখি কমল জেটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বলল, ‘’এই নুনুটো কখন এলে বটেক?’’ কমল আমার ছোট বেলার বন্ধু। ওর কথা শুনে আমি মুচকে হাসলাম। আমি জানি কমল দক্ষিণ বীরভূমের কথা বলে আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে। দক্ষিণ বীরভূমের দুবরাজপুর, খয়রাশোল অঞ্চলে এই ধরণের কথার প্রচলন আছে। বড়রা ছোটদের আসতে দেখলে এইভাবে প্রশ্ন করে। উত্তর আমি দেওয়ার আগেই আমার সঙ্গে থাকা ছেলেটি উত্তর দিল, ‘’এই পথে পথে এলুম কাকু।‘’ ছেলেটির কথা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম। পরে জানলাম ছেলেটিও খয়রাশোল থানার একটি গ্রামের ছেলে। কলকাতায় থাকে। লঞ্চের দোতলায় উঠতেই দেখলাম লঞ্ছ প্রায় ভর্তি। ছোট একটা স্টেজ করা হয়েছে। আমার পরিচিত সহ নাগরিকরাও রয়েছেন। লঞ্চ ছেড়ে দিল। সঙ্গীত সন্ধ্যাও শুরু হয়ে গেল। বিখ্যাত গায়ক গায়িকাদের মধ্যে ছিলেন অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবারতি সোম এবং গৌতম মিত্র
আমি কমলের পাশে বসলাম। কমলকে জিগ্যেস করলাম, ‘তুই এখানে ঠিক বুঝলাম না।’
কমল বলল, ‘’একজনের আমন্ত্রণে চলে এলাম। উসব এখন বাদ দিং কথা বল। ওই দেখ শুশুক যেছে। খবরে বুলছে শুশুক আবার ফিরছে।‘’
রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর গানে আমরা তখন স্মৃতির মহাকাশ মন্থন করছি। হঠাৎ কমল বলল, ‘’আরে উটা কিরে? কুমির মনে হছে?’’
আমি বললাম, ‘না ওটা কুমির নয়। অন্য কিছু হবে।’
কমল আবার বলল, ‘’আমাদের জেলার ওই কালাপাহাড়দের মত দেখতে। ভালো করি দেখ ক্যানে।‘’
এই হচ্ছে কমল ওর কথার কোনও মাথা মুন্ডু থাকে না। বিরক্ত প্রকাশ করে বললাম, ‘’হচ্ছে কুমিরের কথা। তুই চলে যাচ্ছিস মোঘলযুগে।  
‘’আমাদের সময়টোকে সবাই ধ্বংসের যুগ কেন বলে? তা হলে ওরা কি করলে? নকশাল বাড়ির লাইন ভুল ছিল। প্রমোদ সেন গুপ্তের ‘বিপ্লব কোন পথে’ বই থেকে লাইন তুলে কত নেতা ভাষণ দিয়াছে। সত্তর-আশি, নব্বই, নতুন শতকের বছর গুলানের কথা ভাব একবার। দু’তিনটো কালাপাহাড় না জেলার জন্য কিছু করলে না বাংলার জন্য।‘’
কমলকে বললাম, ‘এখানে এসব বলার কোনও প্রয়োজন আছে?’
‘’ ক্যানে বুলব না ক্যানে? প্রমোদ সেনগুপ্তের বইটোর ভূমিকার ওই লাইনগুলা আমার পুরা মনে আছে। আমি বলে যেছি শুন, ‘প্রকৃত মার্কসবাদী পার্টি না থাকলে বিপ্লব যে সফল হয় না, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ১৯৬৭ সালের ফরাসী দেশের বিপ্লবী অভ্যুত্থান। ফ্রান্সের সমস্ত কলকারখানা, রেল, বন্দর, সরকারী বেসরকারী অফিস, ব্যাঙ্ক, আদালত, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বিপ্লবীরা সবই দখল করে ফেলেছিল, কিন্তু বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি না থাকার ফলে এই বিরাট অভ্যুত্থান মুহূর্তের মধ্যে ব্যর্থ হয়ে গেল।’
লঞ্চের নীচের ডেকিতে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছিলাম। তবু আমার বিরক্ত লাগছিল কমলের কথা শুনে। সেই রামও নেই বিপ্লবের পরিস্থিতিও নেই। তবে এসব আলোচনার কি প্রয়োজন? বিরক্তি প্রকাশ করেই বললাম, ‘তুই কি এখনও এসব নিয়ে ভাবিস? বিপ্লব বিপ্লব না ভেবে মানুষের জন্য কিছু কাজ কর। সামাজিক হওয়ার অনেক পথ খোলা আছে।’        

এই লে ইবার কাছিমের মত খোলে ঢুকি যেছি। আচ্ছা ঠিক আছে উসব আর লয়। ভাঙড় লিং কি হবে বুল? আবার নন্দীগ্রাম? বিপ্লবের বাণী কে শুনবে আর কাকে শুনাব বল ধিনি?’’
কমলের প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ‘না না প্রশাসন অতি সহজভাবে বিষয়টা দেখছে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বলা যায়। আমি ভাঙড় নিয়ে আমার লেখা কমলকে শোনালাম।
সূত্রের খবর অবশেষে রাজ্য সরকার ভাঙড় নিয়ে কিছুটা মচকেছেবিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ভাঙড়ের পরিস্থিতি নিয়ে এলাকার ৪০ জন বিধায়কের সঙ্গে তিনি বৈঠক করবেন। দলমত নির্বিশেষে বিদ্যুৎমন্ত্রী সকলের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। অঞ্চলে পাওয়ার গ্রিডের কাজ যেমন হয়েছে, সেই গ্রিডের তার পরিবহণের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করা দরকার। কিছুদিন আগে আমি ‘ফেসবুকে’ এই প্রস্তাব দিয়েছিলাম। রাজ্যে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক পরিসর দখলের লড়াই হোক। কিন্তু বাংলার স্বার্থে, বাংলার উন্নয়নের জন্য দলমত নির্বিশেষে আসুন ‘জমিদারি মানসিকতা’ এবং জুলুমবাজির বিরোধিতা করি। কমলকে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যটাও শোনালাম।
বিধানসভায় বাজেট অধিবেশনের প্রথমদিন থেকেই সরব ছিলেন বিরোধীরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য শুনতে চাইছিলেন বিরোধী দলের বিধায়করা। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, ৮ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় বলেন, ‘’ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিডের জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি। সমস্যা হয়েছে অন্য। মানুষকে পাওয়ার গ্রিড প্রকল্প নিয়ে ভুল বোঝানো হয়েহে। অবৈঞ্জানিক কথা গ্রামবাসীদের মাথায় ঢুকিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। ভাঙরের মানুষকে বোঝাতে চাইছি জোর জবরদস্তির ব্যাপার নেই। গ্রামের মানুষ চাইলে (পাওয়ার গ্রিডের) কাজ হবে, না চাইলে হবে না।‘’         
কমল আট বছর জেল খেটেছে তাই ওর আতঙ্ক যে দু’জন সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছে তাঁদের কতদিন জেলে থাকতে হয়। কমল আমাকে ফিস ফিস করে বলল, ‘’সিপিএমতো বুলছে ইউএপিএ-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। সত্যি সত্যি করবে রে? আমাদের দেশভক্তির সেই ছেলে ভুলানো আবেগ আর নাইখো। টান টান শুখা বাস্তব। ঘোড়ার খুরের মত বুল?’’
বললাম এটাও ইমেজ ভাঙ্গার রাজনীতি। বর্তমান সময়ে ইমেজ ভাঙ্গার রাজনীতি আমাদের দেখতে হবে। গান শুনতে শুনতে আমাদের কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছিল। তখন গান হচ্ছে ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও বাঁধ ভেঙ্গে দাও ভাও ঙ্গো....../ জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক/ যাক ভেসে যাক ........./ আমরা শুনেছি ওই/ মা ভৈ মা ভৈ মা ভৈ। 
আমরা লঞ্চের একতলায় চলে এসেছি। অতীত ঘেটে কমলকে বললাম, ‘আমি কয়েকদিন আগে একটা পুস্তিকা পেয়েছি। রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি বিষয়ে। বইটার প্রকাশক ভানু সরকার। ডিএল ২৩১/৪, সল্টলেক, সেক্টর-২, কলকাতা-৯১ থেকে প্রকাশিত। পুস্তিকাটা আমার ব্যাগে আছে। আমি বইটা থেকে কিছুটা অংশ তোকে পড়ে শোনাচ্ছি।
‘’নিঃশর্তে রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির প্রশ্নে কোনো মতবিরোধ নেই। নীতিগতভাবে সবাই একমত। তাহলে বিরোধ হচ্ছে কোথায়? পদ্ধতিগত প্রশ্নে। তথ্য বিকৃতির প্রশ্নে। আন্দোলনের বিশেষ ঝোঁক। প্রবণতার প্রশ্নে। ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে বর্তমানের তুলনার প্রশ্নে। বাস্তব পরিস্থিতিকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করার বা না করার প্রশ্নে।
১৯৭৭ সালে বামপন্থী ফ্রন্ট রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির জন্য কোনো কমিটি তৈরি করেনি?- তথ্য সে কথা বলেনা। একথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করে সরকার; নিঃশর্তে রাজবন্দীদের মুক্তি ঘোষণা করে ২১শে জুন, ১৯৭৭ সালে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে। এটুকু বলে বাকী তথ্য চেপে গেলে অর্ধ সত্য বলা হয়। বন্দীমুক্তির জন্য চারজনের সাব কমিটি তৈরি হয়েছিল; সদস্যরা সবাই ছিলেন মন্ত্রীসভার সদস্য। তৎকালীন সমবায়মন্ত্রী ভক্তিভূষণ মণ্ডল, কারামন্ত্রী দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিচারমন্ত্রী হাসিম আব্দুল হালিম এবং মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু স্বয়ং। (সূত্রঃ দেবাশিস ভট্টাচার্য, বামপন্থীরা মহাকরণে মন্ত্রী হয়ে যা করছেন। কলকাতা, ১৯৮৩, পৃষ্ঠাঃ ৫৩)‘’ এই বিষয়টা আমার মনে হয় তুই আমি সবাই জানি। পুস্তিকায় ইংরেজিতে দু’টি উল্লেখ রয়েছে।
‘’ঢালাও মুক্তির আদেশ কী রাজবন্দীদের মুক্তির প্রক্রিয়াকে ত্বরানিবত করেছিল? বা সরকারের টালবাহানা ছিল না?
নাগরিক অধিকার আন্দোলনের উপর পথিকৃৎ গবেষক নীলাঞ্জন দত্ত কেন্দ্রের জনতা সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী ফ্রন্ট সরকারের টালবাহানার আচরণ (‘’dilly-dally attitude’’) নিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘’In March 1978, one year after ‘’the restoration of democracy’’, there were still 124 convicted and 48 under trial political prisoners in West Bengal. It took another couple of years to get them all released and that could have never been done. But consistent pressure brought upon the government by the prisoners re-lease movement’’ (i)
 ১৯৭৮ সালের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বাৎসরিক রিপোর্টেও এই একই প্রলম্বিত প্রক্রিয়ার কথা বলা হলঃ ‘’The state government gave assurance that it hoped that all political prisoners in the state would be released by April 1978 and political prisoners continued to be released during the visit of the delegates [ from 31 Dec, 1977 to Jan, 1978]. In late March 1978 official statistics showed that 199 Naxalites prisoners were still held.’’ (ii), page2/3 (i) ‘’Violation of democratic Rights in West Bengal’’ (C.G. Shah Memorial Trust Publication, 13, 1985, New Delhi) (ii) London, 1979, P. 159
তবে সমস্যা হচ্ছে গণ আন্দোলন আর বিপ্লবী আন্দোলনের ফারাকটা বুঝতে হবে এবং বোঝাতে হবে। একদল উন্নাসিক নেতার কথায় কিছু করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে? ভারতীয় সংবিধান আন্দোলনের অধিকার দিয়েছে। অবশ্যই সশস্ত্র নয়।
কমল বলল, ‘’সেসব আমি আট বছর জেল খেটে ইঁদুরের কাছে শিখাছি। লে চল গানা শেষ। লঞ্চ ফেয়ারলিঘাটে ভিড়ছে। আমি এখন চাদরটো গায়ে জড়াই’’ বলেই কমল কাধের ব্যাগ থেকে একটা শাল বের করে গায়ে জড়িয়ে নিল।
আমি বললাম, ‘শীত কোথায়? তুই শাল গায়ে দিচ্ছিস?’
কমল বলল, ‘’শীত বেশি নায়। তবে কি জানিস এই শালটো আমাদের বিয়ের সময় শাশুড়ি দিয়াছিল। গত তিরিশ বছর ট্রাঙ্কে ছিল। আজ সুযোগ পেয়াছি। শহরের বাবুদের সামনে একটো শাল গায়ে চড়ানোড় সাধ ছিল বহুত দিনের। সবকিছু ছিন্তাই হুং যেলছে রেমান ইজ্জৎ, সম্পদ, সোনা-গয়না। এই শালটো খালি আছে। আমি ভারতীয়। ইটো আমার পোশাক।‘’
আমি বললাম, ‘আজ তুই নিজেও ইমেজ বদলে ফেললি।’ কমল হাসতে হাসতে চলে গেল। ক্লান্ত শরীর, চনমনে মন ওর। ৬০ বছর ধরে কঠোর কঠিন শক্ত মাটিতে হাটছে। ব্যক্তিগত কুৎসা, অমানসিক অত্যাচার আজও কমলকে সহ্য করতে হয়।তবুও  কিন্তু ও সব সময় মজা করে হাসতে হাসতে সময় পার করে দিচ্ছে।
মানতে দ্বিধা নেই সত্তর দশক জুড়ে সম্মিলিত এবং সংগঠিত বাম নেতৃত্বের হাত ধরে ভারতে তথা বাংলায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু হয়েছিল, আশির দশকে সেই লড়াই মুখ থুবড়ে পড়ল। ১৯৮৭ সালের তৃতীয় বামফ্রন্ট আমলে আমরা গ্রাম-গঞ্জের পঞ্চায়েতের মাধ্যমে নতুন ঘরানার উন্নয়ন যেমন দেখলাম, সেই উন্নয়নের হাত ধরেই উত্থান হল নতুন এক অচেনা মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এই বিষয়ে গুণীজনেরা একাধিকবার আলোচনা করেছেন। পরেও করবেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সুযোগ সন্ধানী ‘নব্যবাবু’ এই পরিচয়ে গ্রাম-গঞ্জের নবগঠিত নাট মন্দির, শহর-শহরতলীর পাড়ার ক্লাব, সর্বজনীন দুর্গা পূজোর মণ্ডপ, সর্বত্র এই নব্য ধনিক শ্রেণীর দখলে চলে গেল। পরে প্রোমোটিং নামক এক দৈত্য সংগঠিত আকারে ‘সিন্ডিকেট’ ঘরানায় ইমেজ বদলে ফেলল। ইমেজ বদলের গল্প-কথায় বামফ্রন্ট জমানার নাম আসবে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র, আশির দশকের তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী, পঞ্চায়েতমন্ত্রী বিনয় চৌধুরী। বুদ্ধদেববাবু বলেছিলেন, ‘’চোরেদের সরকারে তিনি থাকবেন না।‘’ বিনয়বাবু বলেছিলেন, ‘’বামফ্রন্টের সরকার ঠিকাদারদের সরকার।‘’
বুদ্ধদেববাবু এখানেই থামলেন না। আবার মন্ত্রিসভায় ফিরলেন এবং মুখ্যমন্ত্রী হলেন। ইমেজ আরও বদলে ফেলেছেন ততদিনে। সরকারের ভিমরুলে ঢিল ছুঁড়লেন। বললেন, ‘ডু ইট নাউ’। ইমেজ বদলে ফেলছেন বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আরও এগিয়ে এলেন সঙ্গে শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। ‘শিল্পায়ন’ না করলে রাজ্যের সমূহ ক্ষতি হয়ে যাবে। বেকার ছেলে মেয়েরা চাকরি পাবে না। বুঝেছিলেন তিনি শ্লোগান তৈরি করেছিলেন ‘কৃষি আমদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। নতুন ঘরানায় ভারতীয় বামপন্থীদের গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিলেন সিপিএমের প্রাক্তণ পলিটব্যুরো সদস্য এবং রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নয়া ঘরানার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই সম্ভবত সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েই দলকে আধুনিক ভারতীয় ঘরানায় গড়ে তুলতে চাইছেন কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি। ভারতীয় কৃষ্টি, ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় বহুত্ববাদকে স্বীকৃতি দিয়ে দেশের বৃহৎ বামপন্থী দলটিকে বিশ্বায়ন উত্তর মূল্যবোধের মিছিলে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সঙ্গে আছেন বাংলা, কেরল, অন্ধ্র, ত্রিপুরা সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নতুন ইমেজের নেতৃত্ব। সূত্রের খবর সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের নিদান ‘সেলফি’ তুলে কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্ট করতে পারবেন না। বামপন্থী দলের শৃঙ্খলা সবাইকে মানতে হবে।   
রাজনীতির ময়দানে গণতন্ত্রের শপথ নিয়ে একদল আসে একদল যায়। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৩৪ বছরের ‘বামফ্রন্ট’ শাসনের অবসান ঘটিয়ে যখন এলেন তখন ইমেজ ছিল ‘ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও’, ‘বামফ্রন্টের অপশাসন আমরা মানছি না মানব না’। কিন্তু তৃণমূল নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এসেই জনপ্রিয় করে তুললেন ‘বদলা নয় বদল চাই’, বাংলার উন্নয়ন চাই। বাংলার উন্নয়নের জন্য যে কোনও দেশে তিনি যেতে রাজি। যে কোনও দলের নেতাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করতে রাজি। যখন ক্ষমতার অলিন্দে তিনি প্রবেশ করেছিলেন তখন জানতেন কি করে প্রবেশ করতে হয়। জানতেন না রাজ্য প্রশাসনকে কিভাবে স্বক্রিয় রাখতে হয়। বাংলার একাই ২১১। দ্বিতীয় দফায় আর নতুন মুখ্যমন্ত্রী ননঅনেকদিন আগেই পুরনো বাড়ি ‘মহাকরণের’ মোহ ছেড়ে চলে এসেছেন ঝা ঝা চক চকে কর্পোরেটলুক বাড়িতে। ‘নবান্ন’ এখন বাংলার নতুন ইমেজ। যেখান থেকে শিল্পায়নের নতুন বর্ণচ্ছটায় বাংলার মেধাবী আধিকারিকরা বাংলার ইমেজ বদল করতে চাইছেন। সম্প্রতি স্বাস্থ দপ্তরের উদ্যোগে ‘টাউন হল’ প্রেক্ষাগৃহে বেসরকারি হাসপাতালের উচ্চপদস্থ কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বৈঠকে আধুনিক বাংলার পরিশীলিত সংস্কৃতির আহ্বানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কর্পোরেট স্বাস্থ্যের পরিচালকদের দিকে আঙ্গুল তুলে মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিলেন মানুষের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা কখনও ‘পণ্য’ হতে পারে না। নতুন দিশার কথা শুনল রাজ্যের আপামর বাঙালি। তবে তৃণমূলের বহুধাবিভক্ত গোষ্ঠী রাজনীতির প্রভাব আমাদের ব্যথিত করছে। সদ্য গড়ে ওঠা ‘দাদা’ সংস্কৃতির ইমেজ অনেকটাই আধুনিক ভারতের ধ্যান ধারণার সঙ্গে মেলেনা।
উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী দলের তরুণ নেতা মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবও ‘সামন্ত ইমেজ’ ভেঙ্গে নতুন ইমেজ গড়তে চাইছেন। তিনি বলছেন, বিরোধী নেতৃত্বকে ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়।       
আমরা যদি অতীত ভারতের দিকে তাকাই দেখব গান্ধিজী ঘোষণা করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর জওহরলাল নেহরু হবেন তাঁর উত্তরাধিকারী। মৃত্যুর আগেই পন্ডিত নেহরুকে করে দিয়েছিলেন বড়লাটের শাসন পরিষদের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। আসলে প্রধানমন্ত্রী। গান্ধিজী যে ইমেজ গড়ে দিয়ে গেলেন। সেই ইমেজকে আরও আধুনিক চিন্তায় আধুনিক অবয়বে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু আমাদের সামনে এনে দিয়েছিলেন। নতুন ইমেজে। সোশিয়ালিজমের কথা বলেও তিনি থামলেন না। প্রধানমন্ত্রী নেহরু নতুন ঘরানার ইমেজ গড়লেন। চালু করলেন মিশ্র অর্থনীতি। পাব্লিক সেক্টর আর প্রাইভেট সেক্টরের যৌথ প্রয়াস। ব্রিটেনের ছাপ ছিল সেই পরিকল্পনায়।
কংগ্রেসের সহ সভাপতি রাহুল গাঁধিকে আমরা পাচ্ছি আধুনিক ভারতের নতুন ভাষায়। তিনি বলছেন তাঁর দলের তরুণ সদস্য সমর্থকদের কেউ মোদীজিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করবেন না। সম্প্রতি রাহুল গাঁধি সংবাদ মাধ্যমকে ১০ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, ‘’সমালোচনায় আমি বাড়তি কাজের তাগিদ পাই। কিন্তু ‘আমেঠি’তে ফুডপার্ক যে ভাবে আটকে দিলেন মোদীজী, তাতে আমি ব্যথিত।‘’ রাহুল গাঁধি নিজেকে যেভাবে গড়ে তুলছেন সেখানে তাঁর ইমেজ গড়ে তোলার কথা বার বার আসে। উত্তর প্রদেশে নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি লেখায় আমি লিখেছিলাম ২০১৫ সালে ইলাহাবাদের জি বি পন্থ সোশ্যাল সায়েন্স ইন্সটিটিউটের সমাজ বিঞ্জানের শিক্ষক বদ্রী নারায়ণের এক লেখায় পড়েছি, ‘’২০০১১ সালে এক বার উত্তর প্রদেশের দলিত ইন্টেলেকচুয়ালদের সঙ্গে এক মিটিং করেন তিনি। মিটিং শেষ হলে জনৈক ব্যক্তি বলেন, ‘আপনিইতো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী।’ সঙ্গে সঙ্গে রাহুলের অসহিষ্ণু প্রশ্ন, ‘কেন? আপনি কেন চান যে আমি প্রধানমন্ত্রী হই? আমি ইন্দিরা গাঁধির নাতি আর রাজীব গাঁধির ছেলে বলে? আমি তো আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাই, কাজ করতে চাই তাতে যেটুকু আমি বলতে পারি কিংবা সাহায্য করতে পারি, সেটুকুই তো আমি চাইছি।’’  বদ্রী নারায়ণের লেখায় আরও পড়েছি, ‘’মনে পড়ে, এক বার একটি সেমিনারে রাহুল যাবেন বলে এসপিজি তাঁর গার্ডদের জন্য আয়োজকদের কাছ থেকে একটা অতিরিক্ত গাড়ি চায়। আয়োজকরা একটি ‘নন-এসি’, বেশ ছেঁড়া-ছেঁড়া সিট-ওয়ালা গাড়ি পাঠান। গাড়িটি দেখেই রাহুল একলাফে চড়ে বসেন। অন্যান্য নেতারাও আর কী করেন, বাধ্য হয়ে নিজেদের ভাল ভাল বিলাসবহুল গাড়ি ছেড়ে রাহুলের সঙ্গে সেই পুরনো গাড়িতেই চড়ে পড়েন। সেমিনারে পৌঁছে রাহুলের মুখে সেই পরিচিত প্রসন্ন হাসি।‘’        
 সুশিক্ষিত কংগ্রেস ঘরানার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং সনিয়া গাঁধির প্রভাব কি আমরা রাহুল গাঁধির মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না?
এনডিএ সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কার ইমেজ ভাঙ্গছেন? আধুনিক ভারতে কর্পোরেট সংস্কৃতির ঘরানায় কখনও কখনও তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। ইমেজ ভাঙ্গতে চাইলেও পারছেন না। অদৃশ্য এক সামন্তপ্রভু তাঁকে দিগভ্রান্ত করে অন্য পথে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি রাজধর্ম পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন কি? প্রশ্ন তুলছে আধুনিক ভারত অত্যাধুনিক ইন্ডিয়া। ইমেজ গড়লেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। বিদেশের মাটিতে যে কোনও অনাবসী ভারতীয় বিপদে পড়লে বিদেশমন্ত্রীর আসনে বসে সুষমা স্বরাজ তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।           
আমরা যদি বিদেশের দিকে নজর ফেরাই তবে দেখব আধুনিক ব্রিটেনকে। ব্রেক্সিট উত্তর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেন ডেভিড ক্যামরন। কারণ তিনি ব্রেক্সিট নীতির বিপক্ষে ছিলেন। পরাজয় মেনে নিয়েই তিনি পদত্যাগ করেছেন। একদম ব্যতিক্রমী ঘটনা। ক্যামেরন সাহেবের দল কঞ্জারভেটিভ পার্টীর আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমাদের কোনও আগ্রহ নেই। আমরা তাঁর এবং তাঁর দলের এই সিন্ধান্তকে কুর্ণিশ করব। এই শতাব্দীর অন্যতম উদাহরণ হয়ে থাকল এই ঘটনা।
প্রশাসনের শীর্ষপদে বসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিবর্তিত আমেরিকার নতুন ইমেজ গড়তে চাইছেন। অনেক ভাঙ্গা গড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। অবশ্য বিশেষঞ্জরা বলছেন, বিদেশনীতিতে এপর্যন্ত তিনি তাঁর পূর্বসূরি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার হেটে আসা পথ মানচিত্র ধরেই এগোচ্ছেন। সম্প্রতি আমেরিকার সংবাদ মাধ্যমে একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ছবিতে দেখানো হয়েছে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হাসি মুখে চেয়ারে বসে আছেনপ্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে দেখানো হয়েছে দীর্ঘকায় অবয়বে। পাশের ছবিতে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছোট অবয়বের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন তাঁর পূর্বসূরির দিকে। ছবির নীচে লেখা,
‘Tiny Trump: like Trump, but less so’. ছবির নীচে  Tiny President’ শিরোনামে দু’ কলমের খবর। Feb. 18: US president Donald Trump is, its fair to say, prone to the occasional bit of self-aggrandisement— and he’s not known for his ability to laugh at himself. For a man so concerned about how the public perceives his stature, one wonders what the 45th President of the United States would make of Tiny Trumps, a new online craze for photo shopping pictures of the Donald to make him look smaller.
The meme has now spawned its owned subreddit, where Web users have been sharing doctored pictures of Trump looking tiny.’’ (The Daily Telegraph, in India, The Telegraph, 19 February, 2017)
 প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম যে বক্তব্য রাখলেন তাতে তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতিমত ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এই নীতিকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে রেখেও ইমেজ বদল করলেন। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর (১ মার্চ, ২০১৭) তিনি এক ঘণ্টার বক্তব্যে বলেছেন, দেশের নিরাপত্তা এবং আর্থিক বৃদ্ধিই আপাতত তাঁর প্রধান কর্মসূচী।  উল্লেখ করেছেন মুক্ত বাণিজ্যের কথাও। জানিয়েছেন তিনি মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে। সেক্ষেত্রে তাঁর মত তিনি ন্যায্য বানিজ্যও চান। তবে তিনি অভিবাসন নীতি বদলের কথা বলে ভিন্ন রাষ্ট্রের বিনিয়োগকারিদের আমেরিকায় ব্যবসা করার ক্ষেত্রে যেসব নিশেধাঞ্জার কথা বলেছিলেন সেখান থেকে কি সরে এলেন? এদিন তিনি বলেন, ‘’এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে বিদেশী সংস্থা সহজেই এখানে ব্যবসা করতে পারে। এতটাই সহজে, যেন পরে তাদের এই দেশ ছাড়াটাই কঠিন হয়ে যায়।‘’ সংবাদ সংস্থা