Sunday 31 December 2017

জয়নগর থেকে পালিয়ে

‘পাবলিক রিলেসনস সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’, কলকাতা চ্যাপ্টারের উদ্যোগে রোটারিসদনে একটি অনুষ্ঠান দেখে ফিরছিলাম। দিনটা ছিল ১৩ ডিসেম্বর। শীতের বিকেলবেলা। ক্লান্ত সূর্য লাল আভা ছড়িয়ে পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। আমি ‘বাবু কলকাতা’-এর ফুটপাথ ধরে হাঁটছি। আমারতো কোনদিনওদিন বন্ধন ছিল না। সম্ভবত আজও নেই। শিব্রাম চক্রবর্তীর ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ উপন্যাসের চরিত্রের মতো। পরে ঋত্বিক ঘটক সিনেমাও করেছেন। সেদিন আমি ব্যস্ততার সঙ্গেই হাঁটছিলাম। ‘বাবু কলকাতা’-এর ফুটপাথ বরাবর। পাশে ‘সেন্টপলস চার্চ’। পরে বিড়লা প্ল্যাটিনাম। হঠাৎ একটি বার তেরো বছরের ছেলে আমাকে জিগ্যেস করল, ‘রবীন্দ্রসদনটা কোথায়?’
আমি ভালো করে দেখিয়ে দিতেই ওর সঙ্গে ছিল আরও দু’জন। তাঁদের মধ্যে থেকে একজন বলল, ‘রবীন্দ্রসদনের মাঠে ফুটবল খেলা হচ্ছে, আমরা সেখানে নাম লেখাব।’
আমি প্রথমটাই চমকে উঠেছিলাম। আমি জানতে চাইলাম, ‘তোমরা ঠিক যাবে কোথায়? রবীন্দ্র সদনে কোনও খেলার মাঠ নেই। রবীন্দ্র সরোবরে খেলার মাঠ আছে।’ তিন বন্ধুর চোখে ‘দেহাতি গ্রামের’ সারল্য। সহজিয়া চাহনি। তিন বন্ধুর বয়স তেরো থেকে চৌদ্দ বছরএকজন বলল, ‘হ্যা আমরা রবীন্দ্র সরোবর যাব। একজন আমাদের এদিকে আসতে বলল।’
‘এখান থেকে অনেক দূর তোমাদের বাস ধরে যেতে হবে।’ আমার উত্তর শুনে একজন বলল, ‘আচ্ছা শিয়ালদহ কতদূরে হবে? এখান থেকে বাস পাওয়া যাবে?’
জানতে চাইলাম, ‘তোমাদের বাড়ি কোথায়?’ উত্তর পেলাম, ‘জয়নগর’। আমি মুচকে মুচকে হাসছি। আমার মনে মনে ‘ফাইট কোনি, ফাইট’। ওরা জয়নগর থেকে এসেছে। ‘ফুটবলার’ হবে বলে। শহর থেকে পালিয়ে। কাঊকে না জানিয়ে। আমিও একদিন শহর থেকে পালিয়ে এসেছিলাম। আমার শহর ‘নলহাটি’ থেকেসাংবাদিক হব বলে। লেখক হব বলে। তারপর? লাল সূর্য নিজের অহংকারে হাসছে। আর একটু পরেই ফিরে যাবে ঘরে। পরের সকালে ফিরে আসবে। ফিরে সে আসবেই। 
সেদিন ওদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘কি করবে বাড়ি যাবে? না ফুটবল ক্লাবে নাম লেখাবে?’ তিনজনেই আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে ছিল। বিস্ময়! অথবা ব্যর্থতার গ্লানি এবং অচেনাকে না চেনার কৌতূহল? তিনজনেই একমত হল, ওরা শিয়ালদহ যাবে। আমি আবার পিছনের দিকে গিয়ে ‘নাট্য একাদেমী’-এর সামনে থেকে ওদের বাস ধরিয়ে দিলাম। বাস আসার আগে একজন বলল, ‘তোর কাছে টাকা আছে?’ সে বলল, ‘না নেই।’ আর একজন বলল, ‘তবে কি হবে?’
আমি ফিরে গেলাম আমাদের ‘হয়ে গেছে’ বলার সময়ে। আশির দশকে। ওদের শিখিয়ে দিলাম, ‘দুটো টিকিট কাটবে। আর একটা চাইলে বলবে হয়ে গেছে। কন্ড্রাকটার বেশি কথা বললে বলবে আমরা স্টুডেন্ট আমাদের টিকিট লাগে না।’
তিনজনকে ‘নবান্ন-নিউটাউন’ রুটের শিয়ালদহগামী একটি বাসে তুলে দিলাম। আমি ‘নাগরিক কলকাতা’-এর ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলাম। বাসটা আমার পাশ দিয়ে যাচ্ছে। ওরা তিনজন বাসের ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে বলল, ‘কাকু হ্যাপি নিউ ইয়ার’।
আমিও ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার আউরালাম। সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘ভাঙা হাটে ভাঙা ভাষা/ নতুন বছরে ভাঙা ভাঙা প্রত্যাশা’  

Happy New Year 2018              

Saturday 23 December 2017

ওরা ওদের মতো, সহানুভূতি নয় আসুন ওদের পাশে থাকি

ওরা ওদের মতো, সহানুভূতি নয়
আসুন ওদের পাশে থাকি: 
বিংশ শতাব্দীর সত্তর দশকের শেষ দিকের ঘটনা। আমাদের শহর নলহাটিতে নতুন একজন সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক এলেন। সংক্ষেপে বিডিও বলে থাকি আমরা। ভদ্রলোক নিজে অত্যন্ত ভদ্র এবং সুদর্শন। পরিবারের সদস্যদের দেখলে বোঝা যেতো তাঁরা কঠোর সংগ্রামের মধ্যে কাটিয়েছেন। পরে জানতে পেরেছিলাম সেই নতুন বিডিও যিনি এসেছিলেন তাঁর বাবা ধোপার কাজ করে ছেলেকে ‘ডবলুই বিসিএস’ পাশ করিয়েছিলেন। চাণক্য নামক কোনও দার্শনিক বা নেতা তাঁকে ধরতে হয়নি ছেলেক বিডিও করার জন্য চাণক্যবাবুদের ধুতি, পাঞ্জাবি, শাল পিটিয়ে পিটিয়ে ছেলেকে বিডিও করেছেন। বিডিও সাহেবের বাবাকে দেখলেই তাঁর লড়াই বোঝা যেত। বাবা এবং ছেলে তাঁরা নমস্য ব্যক্তি ছিলেন। ভদ্রলোক বিডিও হওয়ার পরে আমাদের শহরে তাঁর প্রথম পোস্টিং হয়েছিল। নতুন ব্লক আধিকারিক হয়েও তিনি এতটাই ভারসাম্য রেখেছিলেন সে কথা আজও মনে করা যায়। কারণ দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করে ‘নাগরিক জীবনে’ আসার পরেও কোনরকম দেখনদারি ছিল না। আবার জিরাফের মতো গলা তুলে লড়াইয়ের কথাও কোনদিন বলেননি। সংযম মেনে চলতেন। এই প্রতিবেদনে ভদ্রলোকের নাম লিখছি না। আমাদের অঞ্চলে সকলে তাঁকে ‘দাদা’ বা অমুকদা বলে ডাকলেও আমি ‘স্যার’ বলতাম।
আমাদের পাড়ায় সমষ্টি উন্নয়ন দপ্তরের একটি খেলার মাঠ আছে। সম্ভবত আজও আছে। আমাদের খেলার মাঠে এক ঠিকাদার একদিন মাঠের এক প্রান্তে কয়েকশো ইট সাজিয়ে রেখে দিয়েছিল। ব্লক অফিসের বড়বাবুকে অভিযোগ করেও ইট সরাতে পারিনি। আমাদের খেলতে অসুবিধা হত। শীতের সকালে একদিন আমরা ইট সরানোর জন্য প্রত্যেকে দুটো করে ইট নিয়ে সরাচ্ছিলাম। আট দশজন ছেলে আমরা ছিলাম। হঠাত বিডিও সাহেব এসে হাজির। তিনি ডাই করা ইটের বোঝার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের পর পর দাঁড়াতে বললেন। তিনি নিজে পর পর সাজিয়ে রেখে দেওয়া ইটের কাছে দাঁড়ালেন। তাঁর হাত থেকে আমরা ইট নিয়ে সরাতে থাকলাম। প্রত্যেকে হাতে হাতে একঘণ্টার লড়াইয়ের পর ইট সরিয়ে ফেললাম। বিডিও সাহেবের কাছে সেই প্রথমবার ‘সবে মিলি করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ’ আপ্তবাক্য রপ্ত করেছিলাম।  
বিডিও অফিসের পাশের বাড়িটা ছিল পশু হাসপাতাল। সেই একই বছরে পশু হাসপাতালে এক ভদ্রলোক পশু চিকিৎসক হয়ে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। একদিন হাসপাতালে বসে আছি এক ভদ্রলোক একটা সাদা পেঁচা নিয়ে এলেন। শিক্ষিত সমাজ সচেতন লোক। এসেই বললেন ‘ডাক্তারবাবু এই পেঁচাটা আমার বাড়ির সামনে পরে ছিল। কতকগুলো কাক ওকে তাড়া করছিল। দিনেরবেলায় ওরাতো দেখতে পায় না। দেখুন পেঁচাটা আহত। ওর ডানায় লেগেছে।’
পেঁচাটাকে যত্ন করে দেখলেন ডাক্তারবাবু। ডানায় ওষুধ দিয়ে ‘ফার্স্টএইড’ চিকিৎসা করে দিলেন। প্রায় চল্লিশ বছর আগে সেদিন ওই শীতের সকালে আমার বন্ধু হুতোম বসে ছিল। হাসপাতালের ছাদে। আমার সঙ্গে ওর পরিচয় আমাদের বাড়িতে, সেই সম্পর্ক আজও থেকে গেছে। সেদিন হুতোম আমাকে বলেছিল, ‘আমার বন্ধুটাকে দিনের আলোয় সুযোগ বুঝে ওরা মারল। আমি মারব না। ওদের রাতের অন্ধকারে পেলেও মারব না। আমি তোদের গান্ধিবাদী দর্শন জানিআমি বাবুকে বললাম বাবু ডাক্তারের কাছে নিয় এলো। হুতোমের বাবু তাঁর পর থেকে আহত পাখি পেলেই পশু হাসপাতালে নিয়ে আসত। পরে আহত মানুষদের জন্যও হুতোমের কথা শুনে নলহাটি, রামপুরহাট, সিউড়ি, বর্ধমান এবং কলকাতার বড় বড় হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য চাঁদা তুলে নিয়ে আসতেন ভদ্রলোক  
সম্প্রতি ‘পাবলিক রিলেসনস সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’, কলকাতা চ্যাপ্টারের উদ্যোগে রোটারি সদনে একটি অনুষ্ঠান হয়ে গেল। অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘ডিজি এবিলিটি’ এম্পাওয়ারিং দ্য ডিফারেন্টলি- এবল্ড। সংস্থার নামের মধ্যেই আমাদের শিরোনাম লুকিয়ে রয়েছে। সংগঠনের কলকাতা চ্যাপ্টারের চেয়ারম্যান সৌমজিৎ মহাপাত্রের সঙ্গে আগে থেকেই আলাপ আছে। সাংবাদিকতা করার সুবাদে। তিনি আমন্ত্রণ জানানোর সময় বলেছিলেন, সহানুভূতি নয় আমাদের পাশে থাকুন। আমন্ত্রণ পেয়ে ১৩ ডিসেম্বর গিয়েছিলাম রোটারি সদনের অনুষ্ঠানে। ‘অসাধারণ’ বললে খুব কম বলা হয়। একটি ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান সেদিন দেখেছি। অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল কলকাতার ‘মনোবিকাশ’ কেন্দ্রের জনা দশেক প্রতিবন্ধী শিল্পীর ‘জ্যাজ মিউজিক’ বাজনা দিয়েএকজন প্রতিবন্ধী মেয়ে তবলা এবং ড্রাম বাজালেন। যে উচ্চ ঘরানায় বাজালেন অনেককেই চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন। দশজন শিল্পী কেউ বাঁশি, কেউ বেহালা, কেউ গিটার, কেউ ভারতীয় ঘরানার বিভিন্ন খোল বাজিয়ে আমাদের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। সামনে থেকে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না এঁদের কি যোগ্যতা আছে। ওরা ভারতীয় সঙ্গীত ঘরানাকে যে শিল্প সুষমায় পরিবেশন করলেন, সংগঠনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে সত্যিই বলতে হয় ‘Empowering the Differently- Abled’ পরের পর চমক সেদিন আমদের জন্য অপেক্ষা করছিল।
সামাজিক ন্যায় এবং ক্ষমতা প্রদানকারী মন্ত্রকের অধীনস্থ কেন্দ্রীয় দিব্যঞ্জান নির্দেশক বোর্ডের অভিঞ্জ সদস্য পঙ্কজ মারু বক্তব্য রাখেন। তিনি তাঁর ভিডিও স্লাইডের মাধ্যমে দেশের প্রতিবন্ধীদের প্রকৃত তথ্য তুলে ধরলেন। তাঁর বক্তব্য থেকে জানতে পারলাম ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত শারীরিকভাবে এবং মানসিকভাবে অক্ষম ব্যক্তিদের জন্য ভারতে কোনও আইন ছিল না। এই আইন ১৯৯৫ সালে তৈরি হয়। সেই আইন ২০১৬ সালে সংশোধিত এবং পরিবর্তিত হয়ে ‘The Rights of persons with Disability act, 2016’ নামে নতুন আইন হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারে সামাজিক ন্যায় এবং ক্ষমতা প্রদানকারী মন্ত্রকের মন্ত্রকের ওয়েবসাইট লিখছে, ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী ২.৬৮ কোটি মানুষ প্রতিবন্ধী। দেশের আনুমানিক ১৩০ কোটি মানুষের শতকরা হিসাবে ২.২১ শতাংশ।   
‘’The Department of Empowerment of Persons with Disabilities in the Ministry of Social Justice & Empowerment facilitates empowerment of the persons with disabilities, who as per Census 2011 are 2.68 crore and are 2.21 percent of the total population of the Country. These include persons with Seeing, Hearing, Speech, Movement, Mental Retardation, Mental Illness, Multiple Disability and any other disabilities.’’
এই হিসাব ধরে পঙ্কজ মারু আরও উল্লেখ করেন, দেশে মাত্র ২ লক্ষ ৭৩ হাজারের কিছু বেশি ইউডিআইডি (UDID)  কার্ড প্রতিবন্ধী মানুষকে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এটা সারা দেশের হিসেব। দেশের জনসংখ্যার ২.৬৮ কোটি ব্যক্তি প্রতিবন্ধী। অথচ সারা দেশে এপর্যন্ত কার্ড দেওয়া সম্ভব হয়েছে মাত্র ২ লক্ষ ৭৩ জনকে। পশ্চিমবঙ্গে একটিও UDID কার্ড এপর্যন্ত দেওয়া হয়নি। এই বিষয়ে রাজ্যের নারী শিশু এবং সমাজ কল্যাণ দপ্তরের মন্ত্রী শশী পাঁজার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম। তিনি বললেন, ‘’আমি ঠিক জানি না। আমাকে বিস্তারিত খবর নিয়ে জেনে বলতে হবে।‘’
SWAVLAMBAN CARD
About Unique Disability ID
‘’Unique ID for Persons with Disabilities’’ project is being implemented with a view of creating a National database for PwDs, and to issue a Unique Disability identity Card to each person with disabilities. The project will not only encourage transparency, efficiency and ease of delivering the government benefits to the person with disabilities, but also ensure uniformity. The project will also help in stream-lining the tracking of physical and financial progress of beneficiary at all levels of hierarchy of implementation- from village level, block level, District level, state level and National level. 
পাবলিক রিলেসনস সোসাইটি অব ইন্ডিয়া, কলকাতা চ্যাপ্টারের অনুষ্ঠানে প্রকাশিত ‘সুভিনিয়র’ থেকে একটি তথ্য পাচ্ছি।
Disabled Population by type of Disability of West Bengal
Visually Impaired: 424473
Hearing                 :  315192
In Speech              : 147336
Locomotors           : 322945
Mental Retardation: 136523
Mental Illness           : 71515
Multiple Disability    : 196501
Any Other (CP/Austin): 402921
Total number of
disabled persons           : 2017406
The scenario, through slow rising awareness, especially dedicated efforts of people working towards the cause, has been changing. But the number is increasing too, turning the challenges ahead tougher. Kolkata and other towns are a tad better in comparison of the suffering populace in semi-urban or mufassal areas, villages and near-remote localities. Trained manpower and care giver in deaf-blind, multiple disability, developmental therapy, sign language interpretation, mobility science, developmental rehabilitation, early intervention and rehabilitation management etc is the need of the to deal with this huge number. This will enable our mainstream education to include them, which in turn open new frontiers for their empowerment.
এদিনের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন পদ্মশ্রী সুধা কাউল। তাঁর তথ্য সম্বলিত স্লাইডশো থেকেও প্রতিবন্ধী পরিবার সম্পর্কে অনেক কিছু জানা গেল। ‘প্রেমশ্রী’ নামে প্রতিবন্ধীদের একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর প্রযোজনা আমরা দেখলামপাশাপাশি দর্শকদের জন্য ছিল ‘রিদম ডিভাইন পোয়েটস’ নামে অন্য একটি ভিন্নধর্মী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানঅসাধারণ অনুষ্ঠান। অনিন্দ্য সুন্দর সেই অনুষ্ঠানের বর্ণনা করা যায় না। চোখে না দেখে বা কানে না শুনে লেখায় আমরা কতটা আনতে পারি? চারজনের একটি দল। একজন শিক্ষিত তরুণ গিটার বাজিয়ে বাংলা, ইংরেজি গান করে। সে অন্ধ। তাঁকে কেন্দ্র করেই একাঙ্ক নাটক আবর্তিত হয়। অসাধারন সেই দৃশ্যকল্প। এদিনের অনুষ্ঠানে অন্যান্য যারা উপস্থিত ছিলেন, মুকেশ জৈন, সিইও, ন্যাশনাল ট্রাস্ট, এলিজাবেথ নেউভিলে, ডাইরেক্টর, কিস্টোন ইন্সটিটিউট, ‘শিশুর সেবায়’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মিচেল হারিসন।
অনুষ্ঠান দেখে রোটারি সদনের বাইরে দাঁড়িয়ে একজনের সঙ্গে কথা বলছি, গাছের উপরে বুড়ো হুতোম বসে আছে। আমাকে দেখেই বলে উঠল, ‘অভিনয় দেখে অভিনেতা হয়ে যাস না। মানুষের জন্য যারা কাজ করে তাঁদের মানবিকতা থাকতে হয়। ৪১ বছর আগে যা বলেছিলাম আজও বলছি। অপমান, হেনস্থা, ঘৃণা যারা করার করবে। ওদের থেকে দূরতব রেখেই মানবিক কাজ করতে হয়।’
মনে মনে বললাম ঞ্জানবুড়ো শীতবেলায় গরম গরম বুলি কপচাচ্ছে। আমি সেদিন কোনও উত্তর না দিয়ে চলে এসেছিলাম।  
  

Thursday 21 December 2017

উনবিংশ শতাব্দীর নাগরিক মূল্যবোধের আজও প্রয়োজন রয়েছে

উনবিংশ শতাব্দীর নাগরিক মূল্যবোধের
আজও প্রয়োজন রয়েছে: 
গুজরাট বিধান সভা ভোটে মাত্র ৭ ভোটে জিতে বিজেপি হিন্দু রাষ্ট্র গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আরও জোড় দিতে চাইছে। সংবাদ মাধ্যমে এমনই খবর প্রকাশ হয়েছে। বিজেপি একটি গণতান্ত্রিক দেশের বৃহত্তম দল। দলটি উন্নয়ন এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের ককটেল বানিয়ে দেশের মাটিতে রাজনীতি করে। কংগ্রেস বামপন্থী সহ বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির বক্তব্য বা অভিযোগ আমরা যাই বলি। দাও ফিরে সে হিন্দুত্ব। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে খবর, সঙ্ঘ পরিবারের শাখা সংগঠনগুলিকে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে সংগঠিত করতে চাইছে বিজেপি।   রামমন্দির নির্মাণের ইস্যুকে কেন্দ্র করে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচী নেওয়ার জন্য আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ সহ একগুচ্ছ বিজেপি নেতা বৈঠক করবেন। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে আরও খবর বিজেপি নাকি বলছে, ‘’হিন্দুত্ব আমাদের কোর ইস্যু। বিকাশ-উন্নয়ন করতে হবে। কিন্তু ওটা ভোটের প্রচারের প্রধান অস্ত্র হয় না।‘’
বিজেপির এই চেনা অস্ত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহল আছে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলি। সম্প্রতি সমাজ সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘পাশে আছি’ নামের উদ্যোগে কলকাতায় অনুষ্ঠিত হল ‘রোকেয়া উৎসব’। বিধান নগরের পূর্বাঞ্চলীয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ঐকতান সভাগৃহে ১৮ ডিসেম্বর এই অনুষ্ঠান হয়। সাহিত্যিক দেবেশ রায় অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেই আমাদের মনে করিয়ে দিতে চাইলেন উনবিংশ শতাব্দীর অবিভক্ত বাংলার মনীষীদের ভূমিকা। তাঁর কথায় বিদ্যাসাগরের মতো বেগম রোকেয়াও ভারতীয় নারীর মুক্তি আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। শব্দটা দেবেশবাবু ব্যবহার করছেন ‘ভারতীয় নারী’-এর প্রসঙ্গে। ভারতীয় নারী মুক্তির কথা তিনি উল্লেখ করছেন। মুসলিম নারী মুক্তির কথা তিনি বলছেন না। দেবেশবাবুর কথায় রোকেয়া বেগম মুসলমান নারীদের শিক্ষার জন্য তাঁর সমস্ত উৎসাহ, উদ্যোগ, অর্থ দান করে গিয়েছেন। তিনি প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি কিন্তু আমরা তাঁকে স্মরণ করি না। ১৮৫৬ সালের যে আন্দোলন সেই আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ রয়েছে বেগম রোকেয়ার। বিধবা বিবাহ আন্দোলন তখনকার দিনে করা সহজ ছিল না। শাস্ত্রের সব অনুশাসন না মানা মানে  বিদ্রোহ করা নয় বলছেন প্রবীণ সাহিত্যিক। দেবেশবাবু আরও বলছেন, বেগম রোকেয়াকে সংকীর্ণ জায়গায় রাখবেন না। তিনি একজন মহৎ ভারতীয়। তাঁর আন্দোলন উনিশ শতকের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। উনিশ শতকের আন্দোলনের রেনেসাঁ আন্দোলনের সঙ্গেই তাঁর নাম উচ্চারণ হওয়া উচিত।‘’
শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার বলেন, ‘’হিন্দু ধর্মের মধ্যে অনেক স্ববিরোধ আছে। উনবিংশ শতাব্দীতে আন্দোলনের কথা আপনারা শুনলেন। সত্যি সত্যি দেশভাগের আগে মুসলমানরা সমাজের জন্য যে কাজ করেছেন সেটা আমাদের মনে রাখতে হবে। শুধুমাত্র অবিভক্ত বাংলায় নয়। দেশভাগের পরেও এই বাংলায় সামাজিক উন্নয়নে মুসলমানরা অনেক কাজ করেছেন।‘’ আনন্দ পুরষ্কার প্রাপ্ত কবি সুধীর দত্ত সোচ্চারে প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন, ‘’রোকেয়া জানি। কিন্তু খুব কম জানি। কেন আমরা কম জানি? এই বাংলার বুদ্ধীজীবীদের দেউলিয়াপনা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।‘’ কবি সৈয়দ হাসমত জালাল আমাদের মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না। তিনি তাঁর বক্তব্যে প্রথমেই উল্লেখ করলেন, ১৩৭ বছর আগে যে নারীর জন্ম, তিনি অবিভক্ত ভারতে একটি প্রবল পর্দানশীন রক্ষণশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন। হাসমত জালাল বলেন, ‘’সে যুগে নারীশিক্ষার কোনও সহজলভ্য সুযোগ ছিল না। তবু রোকেয়া সমস্ত বাঁধা অতিক্রম করে তাঁর দাদার কাছে হ্যারিকেনের আলোয় পড়াশোনা করেছেন। পরে সেই আলো বিচ্ছুরিত করেছেন ভারতীয় নারীমুক্তি আন্দোলনের মাঠে ময়দানে। তাঁর আবেদন ভোলার নয়। সামাজিক আন্দোলনের তিনি পথিকৃৎ। উনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁর সঙ্গেই রোকেয়ার আন্দোলনের যোগ।
তিন তালাক প্রসঙ্গে বলেন অধ্যাপক আফ্রোজা খাতুন। আফ্রোজা বলেন, ‘’তালাক বিষয়টা জন্মসূত্রে মুসলিম পুরুষদের। ১৯০২ সালে রোকেয়ার লেখা উপন্যাস ‘পদ্মরাগ’। ১৯২৪ সালে প্রকাশ হয়। তালাক নিয়ে আমরা যে আন্দোলন করছি সেটা মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে নয়। পদ্মরাগ উপন্যাসটা পড়লে আমরা আরও ভালোভাবে জানতে পারব। এই আন্দোলন মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন।‘’
দেশপ্রেমিক রোকেয়া বিষয়ে বলেন, শিক্ষাবিদ এবং লেখিকা মীরাতুন নাহার। ব্যক্তি মীরাতুন নাহার সম্পর্কে  বাংলার মানুষের কাছে নতুন করে বলার নেই। ধর্মনিরপেক্ষতার উজ্জ্বল উদাহারণ তিনি এই বাংলার মানুষের কাছে যে কোনও বিপদে অন্যতম সহায় এবং আশ্রয়ের নাম মীরাতুন নাহার। তিনি এদিন বলেন, ‘’ বেগম শব্দটা রোকেয়া পছন্দ করতেন না। কেন এই শব্দটা জড়ীয়ে গেল তাঁর নামের সঙ্গে সেটা সময়ের অভাবে এখন বলছি না। প্রধান ভুল আন্তর্জাতিক স্তরে চলে গেছে। তাঁর জীবনের কাজ ছিল সৃষ্টিশীল লেখা এবং সমাজসেবা। কেউ কেউ বলে থাকে রোকেয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছেন সবটাই মুসলিম মহিলাদের জন্য। আমি বলব এটা ভুল ধারণা। রামমোহন বিদ্যাসাগর উত্তর সমাজে রোকেয়া আলো দেখিয়েছিলেন। সমাজ সংস্কারক হিসাবে। সেই আলো সমস্ত মানবজাতির জন্য ছিল। পুরুষের পাশাপাশি, রামমোহন বিদ্যাসাগরের পাশাপাশি আমাদের দেশ স্বীকৃতি দেয়নি।‘’
মীরাতুন নাহার আরও বলেন, ‘’মাত্র ২৮ বছর বয়সে রোকেয়া বিধবা হলেন। পরমা সুন্দরী ছিলেন। মুসলিম পরিবারে যে নিয়ম নীতি আছে সেই অনুশাসন মেনে তিনি আবার বিয়ে করতে পারতেন। আমরা রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিত’ উপন্যাসে এই ধরণের একটি চরিত্র পাই। কিন্তু তিনি সে পথে গেলেন না। তিনি বর্তমান সময়ের এনজিও ( বেসরকারি সংস্থা) ধাঁচের সংগঠন করে সমাজের কাজ করেছিলেন। পর্দা পরে বিভিন্ন পাড়ায় পাড়ায় গিয়ে গরিব মেয়েদের নিজের স্কুলে নিয়ে আসতেন। ভারতীয় নারীদের স্ত্রী শিক্ষায় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছিলেন বলেই রোকেয়া ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাস লিখেছিলেন। বর্তমান সময়ের মানদণ্ডে আমাদের দুই বাংলার মানুষের কাছে রোকেয়ার বড় বেশি করে প্রয়োজন অনুভব করি।‘’
এদিনের অনুষ্ঠানে রোকেয়া সমাজ সম্মান দেওয়া হয় ‘প্রতিবাদী নারী’ ইসরাত জাহানকে। রোকেয়া সাহিত্য সম্মান দেওয়া হয় তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অনুষ্ঠানে আমি নিজে উপস্থিত থাকতে পেরে গর্ব অনুভব করছি। রোকেয়া উৎসবের দু’দিন আগে কলকাতার ‘ইরান সোসাইটি’ সভাঘরে আরও একটি সম্প্রতির অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। ১৮ ডিসেম্বরের ‘জাস্টিস কে এম ইউসুফ মেমোরিয়াল লেকচার’ অনুষ্ঠানে আয়োজক সংস্থা ছিল ইরান সোসাইটি। এবছরের আলোচ্য বিষয় ছিল, ‘’মাইনরিটি রাইটস ইন প্রেসেন্ট ইন্ডিয়ান সিচুয়েশনঃ প্রব্লেমস, অ্যাপ্রেহেনসিঅনস অ্যান্ড ওয়ে ফরোয়ার্ড’’ (Minority Rights in present Indian situation: Problems, Apprehensions and Way Forward’’)প্রধান বক্তা ছিলেন সিপিআইএম নেতা তথা সাংসদ মহঃ সেলিম। এদিনের অনুষ্ঠানে আরও অনেক বক্তার পাশাপাশি সভঘরের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জামীর উদ্দিন শাহ। তিনি আলীগড় মুসলিম বিশ্ব বিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য। সভাঘরে আলোচনার মূল সুরটা বেঁধে দিয়েছিলেন জামীর উদ্দিন শাহ সাহেব। তিনি জোরের সঙ্গে দাবি করেন, মুসলিম সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। বিঞ্জানসম্মত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। তিনি বলেন, ‘’মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রয়োজন সেকুলার স্কুল এবং কলেজ। ইউরোপ আমেরিকার মতো আমাদের নামী দামী স্কুলের প্রয়োজন নেই। আমরা ছেলেবেলায় ‘সেকুলার স্কুলে’ পড়েছি। সেই স্কুল কলেজে যে বন্ধুত্ব হয়েছিল সেই ‘দোস্তি’ আজও টিকে আছে। বচপনের ‘দোস্তি’ চিরস্থায়ী হয়। জয়হিন্দ।‘’
মূল বক্তা মহঃ সেলিম শুরুটাই করলেন ১৯৭১ সালের ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। তাঁর কথায় ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী ফৌজ ভারতীয় সেনাদের কাছে ঠিক আজকের দিনে আত্মসমর্পণ করেছিলেন। আজ ১৬ ডিসেম্বর। ভারত নামক একটা দেশ তিনটে টুকরো হয়ে গেল। আমরা কি এটা চেয়েছিলাম? ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। অথচ আমরা এখনও সেই সামন্তযুগের মূল্যবোধে আটকে রয়েছি। নাগরিক মূল্যবোধের জন্য আলাদা অধিকার প্রয়োজন। সেদিনও ছিল আজও আছে। ভারত নামক একটি দেশ বিভিন্ন ভাষা, জাতি, বর্ণ, গোষ্ঠী তারই মধ্যে বিবিধের মাঝে মিলন মহান। আমাদের বৈচিত্রে মাঝে ঐক্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবন দর্শনে এই মিলনের জয়গান গেয়ে গেছেন।  
মহঃ সেলিম বলেন, ‘’২৫ বছর আগে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে দেওয়া হল। আফগানিস্তানে ‘বামিয়ান’ মূর্তি ভাঙার পরে নরম ইসলামের জমানা শেষ হয়ে গেল। আফগানিস্তানের সমাজ ভেঙে পড়ল। নরমপন্থী ইসলামের জায়গায় চরমপন্থী ইসলাম আফগানিস্তান দখল করল। ‘চুনৌতি’ মসজিদ-মন্দিরের নয়। নতুন ধারণা গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এই ধারণায় আমাদের পিছনের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সমাজে ধর্ম সব সময় থাকে কিন্তু রাষ্ট্র কেন ধর্ম নিয়ে নীতি আচরণ করবে? ভারত একটি ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ। আজ নেহরুর দর্শনও আক্রান্ত। নেহরুর অর্থনীতি, সামাজিক দর্শনকে আক্রমণ করা হচ্ছে। আজকের বাস্তবতায় আমরা সংখ্যালঘুরা বলব ‘আমার সম্পত্তি লাগবে না। আমার ঘরে যেন আগুন লাগানো না হয়’‘’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি লেখায় লিখছেন, ‘’আমাদের দেশে কল্যণশক্তি সমাজের মধ্যে। তাহা ধর্মরুপে আমাদের সমাজের সর্বত্র ব্যাপ্ত হইয়া আছে। সেই জন্যই এতকাল ধর্মকে সমাজকে বাঁচানোই ভারতবর্ষ একমাত্র  আত্মরক্ষার উপায় বলিয়া জানিয়া আসিয়াছে। রাজত্বের দিকে তাকায় নাই, সমাজের দিকেই দৃষ্টি রাখিয়াছে। এই জন্য সমাজের স্বাধীনতাই যথার্থভাবে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। কারণ, মঙ্গল করিবার স্বাধীনতাই স্বাধীনতা, ধর্মরক্ষার স্বাধীনতাই স্বাধীনতা।‘’ (আত্মশক্তি, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ৩য় খন্ড, পৃষ্ঠাঃ ৫৫৩)

মহঃ সেলিমের মতো সিপিএম নেতা, দেবেশ রায়, সুধীর দত্ত, মীরাতুন নাহার সহ একঝাঁক বুদ্ধিজীবী বাংলা তথা ভারতের অগ্রগতির যে ‘পরিপন্থী শক্তি’ সেই শক্তিকে আমাদের চিনিয়ে দিতে ভিন্ন ভিন্ন মঞ্চে উপস্থিত হচ্ছেন। সময়ের দাবিতে এই প্রয়োজন আছে। সমগ্র ভারতবাসী জানে কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা দেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের দায়িত্ব দেশের সমস্ত স্তরের নাগরিককে মনে করিয়ে দিয়েছে। সিপিএম নেতা বি টি রণদিভে একটি প্রবন্ধে লিখছেন, ‘’জওহরলাল নেহরুর আধুনিক ও ধর্ম-নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি সত্বেও, গান্ধীবাদী দৃষ্টিভঙ্গিই জাতীয় আন্দোলনে প্রাধান্য স্থাপন করেছিলো। সমালোচকরা এই প্রগতি বিরোধী মানসিকতাতেই ভ্রান্তভাবে জাত-পাতগত চাপের সামনে একমাত্র আত্মসমর্পণ ব’লে বিবেচনা করেছেন, এবং উচ্চবর্ণের জাতীয় নেতাদের জাত-পাতের মনোভাবের ফলেই কেবল এটা গড়ে উঠেছে ব’লে মনে করেছেন। দেশীয় সামন্ততান্ত্রিক ভূমি-সম্পর্কের কাছে আধুনিক বুদ্ধিজীবীদের মৌলিক আত্মসমর্পণই কিন্তু জাত-পাত ব্যবস্থাকে জিইয়ে রেখেছে। আত্মগতভাবে জাত-পাত মনস্কতা যে এব্যাপারে কোনো ভূমিকা নেয় নি তা নয়, কিন্তু অন্যান্য কৃষি-কাঠামোকে মৌলিক ভাবে মেনে নিলে সেটা নিতান্তই অনিবার্য হয়ে পড়ে।‘’ (‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’ পত্রিকায় ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ, অনীক, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৮৬ সংখ্যা থেকে প্রকাশিত)                                                                                                                                                                                                                                                   

Wednesday 20 December 2017

সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভাবছে প্রেস কাউন্সিল?

সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভাবছে
প্রেস কাউন্সিল? :
কলকাতা প্রেস ক্লাবকে ধন্যবাদ। ২০০১৭ সালে নতুন কমিটি গত কয়েক বছরের ক্লাবের ক্লান্তি কাটিয়ে একটার পর একটা সামাজিক অনুষ্ঠান করে ‘সাংবাদিক’-দের আপন ভুবন চেনাচ্ছে। কলকাতা তথা রাজ্যের সাংবাদিকরা আরও স্বাধীনতা নিয়ে নিজেদের ভাষায় কথা বলতে পারছে। নতুন প্রজন্ম গড়ে তুলতে সংবাদ মাধ্যমের এই দায়িত্ব প্রেস ক্লাব, কলকাতা-র পরিচালন কমিটি সভাপতি স্নেহাশিস শূরের নেতৃত্বে সুচারুভাবে নিয়েছে বলা যেতে পারে। এবং সুনিয়ন্ত্রিত কর্পোরেট সংস্কৃতির ছোঁয়ায় রাজ্যের সংবাদ মাধ্যম পরিণত হতে চাইছে। একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষ বেলায়। ঝা চক চকে কলকাতা শহরের আলোকিত ছন্দে। যে কথা প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান সি কে প্রসাদ সম্প্রতি তাঁর কলকাতা সফরে উল্লেখ করেছেন। একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে প্রেস ক্লাব যে শুধুমাত্র সন্ধ্যাকালীন বিনোদনের জন্য নয়। আরও বৃহত্তর প্রেক্ষাপট রয়েছে, সীমাবদ্ধ বৃত্তে সাংবাদিকরা আটকে থাকে না, সেই ভাষা আমাদের চিনতে সাহায্য করছে ক্লাবের বর্তমান কমিটি। সাংবাদিকদেরও অনেক অনেক বড় আকাশ আছে সংকীর্ণ কলাম লেখার জন্য সাংবাদিকরা জন্মায় না। জাত, বর্ণ, ভাষা, ধর্ম সব কিছুর উর্ধে উঠে সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরা আমন্ত্রণী মঞ্চে নয় নিজেদের ‘নোটবুক’-এ গঠনমূলক মুচলেকা দিতে পারে। সকল সাংবাদিকের মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে। সব ভাষার সংবাদ মাধ্যমের ঐকতান হয়ে যায় একদেহে লীন। সাংবাদিকদের কোনও জাত হয় না। সাংবাদিকদের কোনও সীমান্ত হয় না। তাঁরা যেমন সমালোচনা করতে জানে। সত্যের জন্য সমালোচনা মেনে নিতেও পারে। গত কয়েক মাসের ক্লাবের কর্মসূচী এই বার্তা আমাদের দিচ্ছে। আগামীতে আরও গঠনমূলক সাংস্কৃতিক ভাষাবৃত্তে আমাদের নিয়ে যাবে কলকাতা প্রেসক্লাব।    
Press Club, Kolkata, deeply mourns the sad demise of veteran journalist Sukharanjan Sengupta, who passed away in Kolkata this evening after a brief age related ailments. He was around 85 years and has been in the profession of journalism for more than 60 years. 
 He was one of the last generation of dhoti clad inquisitive political reporters, who had direct access to senior politicians as well as bureaucrats. He served in Lok Sevak, Jana Sevak, Jugantar and Anandabazar Patrika. He covered Bangladesh liberation war extensively and authored several books. 
He is survived by his wife, son and daughter. His last rites will be performed tomorrow, 10 December 2017.’  
৯ ডিসেম্বর প্রেসক্লাব থেকে এই মেল পাওয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। কলকাতার নাগরিক সাংবাদিকদের মধ্যে সুখরঞ্জনদা ছিলেন আলোর রেখা। তরুণ, নিঃসঙ্গ, দলছুট, বেতনছুট, কর্মচ্যুত সাংবাদিকদের প্রেরণা ছিলেন তিনি। নির্ভীক, সাহসী, উদার জীবনবোধে, সামাজিক মূল্যবোধে এবং জাতীয়তাবাদের এক অনন্য উদাহারণ ছিলেন সকলের প্রিয় সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত। আমি মাত্র কয়েকটা বছর সামনে থেকে তাঁকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। ওই অল্প সময়ের মধ্যে আমি তাঁর কাছ থেকে যেটুকু নেওয়া যায় সেটা নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আটপৌরে পোশাকে নিজেকে এতটাই ব্যস্ত রাখতেন অসততা নামক অদৃশ্য ‘ভাষা’ তাঁর কাছে ভিড় করতে ভয় পেত। ‘সমঝোতা’ নামক দুর্বল শব্দ ছয় দশক সাংবাদিকতা করা সাংবাদিকের কাছে পথ হারিয়ে ফেলত। এমনই দাপট ছিল তাঁর। সেই সাংবাদকিকের আবছায়া দীর্ঘ আরও দীর্ঘ হোক আমাদের চলার পথে। ন্যায় আর সততা কখনও হারিয়ে যায় না। হারিয়ে যেতে পারে না। শিশির পড়ার আওয়াজের সঙ্গে শব্দেরো নিজস্ব আওয়াজ আঁচে। সেই আওয়াজ আমাদের খুঁজে নিতে হয়। ভালোবাসা এবং নিষ্ঠার আগুন কক্ষে।   
বিধানচন্দ্র রায়, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, জ্যোতি বসু, বুদ্ধেদব ভট্টাচার্য ছুঁয়ে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সময়  পর্যন্ত তিনি কাজ করেছেন।  আজ ( ২০ ডিসেম্বর) প্রেস ক্লাবে এক সিনিয়র সাংবাদিক বলছিলেন, সুখরঞ্জনদা বলতেন, ‘তুই কখনো রাজনীতিবিদদের ফোন করবি না। অপেক্ষায় থাকবি। জানবি যে সাংবাদিককে রাজনীতিবিদ এবং সরকারি আধিকারিক ফোন করে সেই হল সংবাদ মাধ্যমের আসল এবং প্রকৃত প্রতিনিধি।’         
আজ ২০ ডিসেম্বর প্রেস ক্লাব আয়োজন করেছিল সেই কিংবদন্তী সাংবাদিকের স্মরণসভা। সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্তকে নতুন করে কাউকে চিনিয়ে দিতে হয় না। হাঁটুর উপর ধুতি, গায়ে একটা সাধারণ জামা। আইএএস, আইপিএস আধিকারিকদের ঘরে সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের অনায়াস বিচরণ ছিল। ওইসব আধিকারিকদের ঘরে যাওয়ার জন্য সাংবাদিক সুখরঞ্জনকে কখনও আগাম অনুমতি নিতে হয়নি। এবং তাঁর সময়কালে রাজ্যের আমলারা তাঁর কাছে পরামর্শ নিয়েছেন। দপ্তরের কাজ কি ভাবে আরও ভালোভাবে করা যায়। আজকের ওই স্বর্ণ সময়ের ডালি সাজিয়ে দিলেন তাঁর সময়ের সমসাময়িক প্রবীণ সাংবাদিকরা। আমরা শুনলাম। সকলের কাছে আক্ষেপ থেকে গেল সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের স্মরণসভায় সাংবাদিকদের উপস্থিতির হার নিয়ে। মাত্র তিরিশ-পয়ত্রিশ জন সাংবাদিক আমরা আজকের স্মরণসভায় হাজির ছিলাম। এটা সংবাদ মাধ্যমের কাছে ভাঙা হাটের বার্তা দিত চাইলেও প্রবীণ সাংবাদিকরা তাঁদের স্মৃতিসুধায় আমাদের সৃষ্টিশীল সাংবাদিকতার মিছিলে পৌঁছে দিয়েছেন।  দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকার সাংবাদিক মানস ঘোষ দু’টি প্রস্তাব দিলেন প্রেসক্লাবের বর্তমান  কমিটিকে।  তাঁর প্রস্তাব সুখরঞ্জনদার কর্মজীবন নিয়ে একটি পুস্তিকা করে বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এবং সম্ভব হলে তাঁর নামাঙ্কিত একটি পুরষ্কার চালু করা। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব। প্রেস ক্লাবের বর্তমান সম্পাদক কিংশুক প্রামানিক। দায়িত্বের সঙ্গে বললেন, ‘আমরা এই প্রস্তাব কমিটিতে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’
মেঠো সাংবাদিকদের নগর কলকাতা চেনানোর সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের স্মরণ সভার আগে আমরা আরও এক নবীন সাংবাদিকের কথা শুনেছি মাত্র দু’দিন আগে। সোমবার ১৮ ডিসেম্বর প্রেসক্লাব আয়োজন করেছিল প্রয়াত সাংবাদিক সুমিত সেন স্মারক বক্তৃতা।  ওই দিনের অনুষ্ঠানে আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম। এদিনের বিষয় ছিল, ‘’সংবাদমাধ্যমের নৈতিকতা ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলী।‘’ এদিনের স্মারক বক্তৃতার মূল বক্তা ছিলেন ‘প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া’-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি সি কে প্রসাদ। সোমবার কলকাতায় সুমিত সেন স্মারক বক্তৃতায় বিচারপতি প্রসাদ বলেন, ‘’সংবাদমাধ্যমগুলির ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতার সমস্যার যদি সমাধান করা যায়, তা হলে অন্য সব জট কেটে যাবে।‘’ চলতি বছরে অগস্ট মাসে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের একটি সমীক্ষা রিপোর্টের বিষয়ে উল্লেখ করেন তিনি। সেই রিপোর্টে আছে, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বিশ্বের মধ্যে বিশ্বাসযোগ্যতার অভাবের সূচকে দ্বিতীয়স্থানে রয়েছে। বিচারপতি প্রসাদ বলেন, ‘’আমি এই রিপোর্টের সঙ্গে পুরোপুরি এক মত পোষণ না করলেও, তা নস্যাৎ করতেও পারছি না। এ ক্ষেত্রে রাস্তা একটাই। সেটা হল, সঠিক এবং সত্যনিষ্ঠ ভাবে সংবাদ পরিবেশন করা।’
সত্যের পথে হাঁটা আমাদের অগ্রগণ্য পথিকৃৎ সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের জীবনালেখ্যের সঙ্গে কোথাও একটা মিল খুঁজে পাচ্ছি আমরা। প্রেস ক্লাবের সভাপতি স্নেহাশিস শূর এদিন বলেন, ‘নীতিনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় সুমিতের অবদানের কথা স্মরণে রেখে এই বক্তৃতার আয়োজন করা হয়েছে।’
অন্ধকার যতই থাক বিন্দু বিন্দু আলোর সীমানা আমরা খুঁজে পাই সুমিত সেনের সাংবাদিকতার সীমানাহীন স্বপ্নে। বিচারপতি প্রসাদ এদিনের বক্তব্যে গৌরি লঙ্কেশ এবং ত্রিপুরার সাংবাদিক হত্যার নিন্দা করেন। সমস্ত দেশে হরিজন সাংবাদিকদের নিয়ে ভাবতে সংবাদ মাধ্যমের নামীদামী এডিটর সহ ম্যানেজমেন্ট সম্ভবত ভুলে যায়। রাজনীতির পচা পাঁকে ওইসব সাংবাদিক একদিন সত্যমিথ্যা সমস্ত দায় মাথায় নিয়েও অত্যন্ত কম পারিশ্রমিকে আদর্শ সাংবাদিকের অবস্থান থেকে কাজ করে যায়। নিজেদের ‘শ্রমজীবী’ সাংবাদিক বলতে অভ্যস্ত হয়ে যায় এই সব সাংবাদিকের দল। কাজের খোঁজে ‘পরিযায়ী সাংবাদিক’-এর মতো এই আকাশ ওই আকাশ ঘুরে সংবাদ মাধ্যমকে আঁকড়ে বেছে থাকতে চায়! ১৮ নভেম্বর প্রেস ক্লাব কলকাতার মঞ্চে বিচারপতি প্রসাদ এই বিষয়টি ভুলে যাননি। তিনি বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এবং সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি বলেন, ‘’সাংবাদিকদের বাইরের সমস্যা থেকে ভিতরের সমস্যা অনেক বেশি। একজন সাংবাদিকের যদি আর্থিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিত থাকে তাহলে সে আরও মন খুলে কাজ করতে পারে।‘’
প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া-কে আরও একটি বিষয় ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ করব। সাংবাদিক পরিচয়ে কেন কোনও সাংবাদিক ব্যাঙ্কের ‘ক্রেডিট কার্ড’ পাবে না? সাংবাদিক সংগঠিত সংবাদ মাধ্যমের কর্মী হোক অথবা অসংগঠিত সংবাদ মাধ্যমের কর্মী হোক। কর্পোরেট সংস্থাগুলি কেন সাংবাদিকদের জীবীকাকে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী নয়? আশা করি এই অভিঞ্জতা সব সাংবাদিকের আছে। ব্যাঙ্কের ঋণ পাওয়ার সময় সাংবাদিকদের বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিকতার প্যারাগ্রাফ টপকে তবেই কোয়ালিফাই করতে হয়। সেগুলি অনেক সময় নৈতিক অবস্থান থেকে মেনে নেওয়াটাও কঠিন হয়ে দেখা দেয়। প্রাসঙ্গিক হবে এদিনের তাঁর দীর্ঘ বৈঠকে সাংবাদিকদের কল্যাণে কোনও প্রকল্প করা যায় কিনা সে বিষয়ে প্রেস কাউন্সিল ভাবন চিন্তা করছে বলে জানান সংস্থার চেয়ারমযান। দেশের চতুর্থ স্তম্ভের মর্যাদা যেমন সাংবাদিকরা রক্ষা করবে পাশাপাশি রাষ্ট্রকেও ভাবতে হবে সৎ, সাহসী, গোষ্ঠী নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের কথা। রাজনীতির উর্ধে উঠে তাঁদের পাশে রাষ্ট্র না দাড়ালে, আইনসভা, বিচারসভা, না দাঁড়ালে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম কোনওদিনই সাবালক হতে পারবে কি?           
                                        

Saturday 9 December 2017

তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ ভারতে উত্তর সনিয়া গাঁধি কংগ্রেস

তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ ভারতে উত্তর সনিয়া গাঁধি কংগ্রেস......: 

আজকের এই দিনে গুজরাট নামক ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে প্রথম দফার ভোট। প্রায় ২৭ বছর পর কংগ্রেসের ওই রাজ্যে সরকার গড়ে তোলার সম্ভবানা দেখা দিয়েছে। সংবাদ মাধ্যম বলছে ‘হার্দিকের হাত কংগ্রেসের সাথ’। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের সময় কংগ্রেসের শ্লোগান ছিল ‘কংগ্রেসের হাত আম আদমি কে সাথ’। বিজেপির ‘বিকাশ পুরুষ’ তথা ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যে কংগ্রেস আলোচনায় উঠে এসেছে। গত কয়েক বছরের মানদণ্ডে কংগ্রেস দলটিকে ক্ষয়িষ্ণু দল হিসাবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সমাজ বিঞ্জানীরা চিহ্নিত করে বসেছিলেন। একসময়ের একচ্ছত্র ক্ষমতা ভোগ করা ভারতের একমাত্র দলটি সময় এবং কালের নিয়মেই এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। নব্বইয়ের দশকে টালমাটাল বিশ্বে ভারতেও আর্থ-সামাজিক টানাপড়েন দেখা দেয়। আয়ারাম গয়ারাম রাজনীতিবিদ এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে ভারতীয় নাগরিকরা দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধির মৃত্যুর পর কংগ্রেস নামক দলটি অভিভাবকহীনতায় ভুগছিল। বিজেপি নামক দলটি তখনও এতটা শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। ফলে ভারতে আর্থ রাজনৈতিক এবং আর্থ সামাজিক অস্থিরতা দীর্ঘদিন আমরা পরিলক্ষিত করেছি। উদার অর্থনিতির রাস্তায় গিয়েও ভারতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল স্বাভাবিক বিষয়। যদিও বর্তমান ভারতবর্ষে বিজেপি দলটির সাংগঠনিক শক্তি বাড়লেও আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিয়ে সমালোচকরা প্রশ্ন তুলতে চাইছে। আধুনিক গণতন্ত্রের আধুনিক দল বলে বিজেপি নেতৃত্ব দাবি করলেও বিজেপি দলেও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিশেষত আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রে। বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিজিপিকে রাজনৈতিকভাবেই সামলাতে হবে কংগ্রেসকে। পাশাপাশি বিজেপিকেও সামলাতে হবে কংগ্রেসকে। এটাইতো একটি গণতান্ত্রিক দেশের পরম্পরা। তর্ক, বিতর্ক এবং গঠনমূলক সমালোচনা একটি গণতান্ত্রিক দলের সংবিধানে প্রাথমিক পাঠ্যসূচি হওয়া উচিত।    
১৯৯৯ সালের আগে স্থায়ী সরকারের চরিত্র কেমন যেন ঘোলাটে দেখাচ্ছিল। সর্বকালের সেরা তথা বিশ্বের অন্যতম অর্থনীতিবিদ এবং নব্বইয়ের দশকের সফল অর্থমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ তখনও রাজনীতিতে দক্ষ হয়ে ওঠেননি। অথবা হয়ে উঠতে চাননি। ভারতে তথ্যপ্রযুক্তির ভগীরথ রাজীব গাঁধির মৃত্যুর পর কংগ্রেস যে নেতৃত্বহীনতায় ভুগছিল সেই শুন্যস্থান ভরিয়ে তুলতে এগিয়ে এলেন সনিয়া গাঁধি। আজ ৯ নভেম্বর সনিয়া গাঁধির জন্মদিন। আজই আগামীর আলো দেখা ভোরের আশায় কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ সভাপতি রাহুল গাঁধি গুজরাট ভোটে প্রচারে ব্যস্ত। গুজরাট বিধানসভা ভোটকে ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে সেমিফাইনাল বলছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ঘটনা যেমন কাকতালীয় আবার মানতে হবেই সনিয়া গাঁধির গঠনমূলক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আভিজাত্যকে। আজকের দিনে তিনি কোনরকম আড়ম্বর করতে নিষেধ করে দিয়েছেন। কংগ্রেস সূত্রে খবর এমনটাই। দলের প্রধান নেত্রীর জন্মদিনকে সব গণতান্ত্রিক দেশেই যে কোনও রাজনৈতিক দল সাড়ম্বরে উদযাপন করে। কিন্তু শুধু এই বছর নয় গত কয়েক বছর সনিয়া গাঁধি নিজের জন্মদিনে সবিনয়ে আড়ালে থাকছেন। এবছর সনিয়া গাঁধি ৭১ বছরে পা দিয়ে সতীর্থ নেতাদের বলেছেন, ‘’এবার আর কথায় কথায় ১০ জনপথ নয়। এখন থেকে গন্তব্য ১২ তুঘলক লেন।‘’
 আভিজাত্যের সংস্কৃতি আমাদের চিনে নিতে বলছেন সম্ভবত। অথবা পরবর্তী প্রজন্মের রাজনীতিকদের কাছে বার্তা দিতে চাইছেন হয়তবা, দল আগে ব্যক্তি নয়।
কংগ্রেসের অভ্যন্তরে একটা কথা চালু আছে। ঠিক বেঠিক কিনা বলতে পারব না। কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধি একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে দশ বছর সময় নিতে পারেন। ঘটনাটা যে অনেকটা সত্য সেই উদাহারন আমরা রাহুল গাঁধির ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি। ২০০৪ থেকে ২০১৪ রাহুল গাঁধিকে আরালে রেখে গড়ে তুললেন। ২০০৪ সালের জানুয়ারি মাসে রাহুল গাঁধি রাজনীতিতে এসেছিলেন। ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালে ধীর লয়ে রাহুল গাঁধিকে নেতৃত্বে তুলে আনতে চেষ্টা করে চলেছেন। ধাপে ধাপে সাধারণ সম্পাদক, উপাধাক্ষ্য। আগামীতে রাহুল গাঁধি হবেন সভাপতি। পিছনের দিকে যদি একটু ফিরে তাকাই দেখব তিন বছর আগে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল, ‘তবে কি গাঁধি পরিবারের মহিমার দিন শেষ?’ কিন্তু কংগ্রেসের পোড় খাওয়া নেতারা মনে করেন দলটাকে একজোট করে রাখা এবং চাঙ্গা করে রাখতে এই পরিবারের বিকল্প নেই। ইন্দিরা গাঁধি উত্তর কংগ্রেসের হাল যেমন রাজীব গাঁধি ধরেছিলেন। রাজীব গাঁধির অবর্তমানে শুধুমাত্র কংগ্রেস দলটাই নয়। ভারত নামক একটি সামন্ত মূল্যবোধের দেশকেও সামনের সারিতে নিয়ে আসতে চেষ্টা করেছেন সনিয়া গাঁধি। ২০১৫ সাল থেকেই সনিয়া গাঁধি অতি সক্রিয় ভূমিকায় নেমে গঠনমূলক বিরোধী দলের স্বীকৃতি আদায় করে এনেছেন। ওই বছরে ১৯ এপ্রিল জমি অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে কৃষক সভার মঞ্চ থেকে আমরা আরও একবার সনিয়া গাঁধি নামক এক প্রাণবন্ত নেত্রীকে দেখেছিলাম। একজন যোগ্য গণতান্ত্রিক নেত্রীকে আবার ফিরে পেল ভারত নামক তথ্য প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা একটি দেশ। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক শীর্ষ সারির নেতা সেদিন বলেছিলেন, ‘’আসলে জমি নীতির বিরোধীতা উপলক্ষ মাত্র। সনিয়ার কাছে উনিশের সভার গুরুত্ব অন্য। আসল কথা হল, সর্বভারতীয় রাজনীতিতে গাঁধি পরিবারের মাহাত্ম্য ধরে রাখার লক্ষেই ওই সভার ডাক দিয়েছেন সনিয়া। কারণ, তিনিও বুঝতে পারছেন, ওই মহিমা টিকে থাকলে তবেই কংগ্রেস টিকে থাকবে। রাহুল গাঁধির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও সুনিশ্চিত হবে। নইলে কংগ্রেসটাই টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।‘’
১৯ এপ্রিল জমি অধ্যাদেশের পরে ৩ নভেম্বর সনিয়া গাঁধি পথে নেমেছিলেন অসহিষ্ণুতার পরিবেশ গড়ে তোলার প্রতিবাদে। ৩ নভেম্বরের ওই সভায় কংগ্রেস সভাপতির শরীরী ভাষা বলে দিচ্ছিল তাঁর নীরবে একান্ত পরিকল্পনা এবং দীর্ঘ প্রতীক্ষা আজ সফল হয়েছে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং দলের অন্যান্য নেতা সাংসদদের নিয়ে সেদিন বিকেলে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে যান স্মারকলিপি জমা দিতে। সঙ্গে ছিলেন রাহুল গাঁধিও। স্মারকলিপি পেশ করে বেরিয়ে সনিয়া সেদিন বলেছিলেন, ‘’গোটা দেশে ভয়, হুমকি ও অসহিষ্ণুতার পরিবেশ কায়েম হয়েছে। নেপথ্যে রয়েছে সরকার ও তাদের মতাদর্শের কিছু লোক। ছক কষেই এ সব করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যে রকম নীরব, তাতেই পরিষ্কার যে এ ব্যাপারে তাঁর সম্মতি রয়েছে।‘’ এই ঘটনার পরে খুব সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অসহিষ্ণুতা নিয়ে বিবৃতি দিয়েছিলেন।             
দলের হাল ধরার পর আমার ব্যক্তিগত ধারণা সনিয়া গাঁধি ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস মনযোগ দিয়ে পড়েছেন। এবং চেষ্টা করেছেন বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই অভিঞ্জতা মিলিয়ে দিতেকখনো সাফল্য এসেছে কখনো ব্যর্থতা। সংসদীয় গণতন্ত্রে এটাই দস্তুর। একটি লেখায় পড়েছি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংসদীয় গণতন্ত্রের মন্ত্রী পারিষদরা যদি অসৎ হয়ে যান। রাজস্ব নয় ছয় করেন, কিংবা কোনও কাজ করতে না পারেন। জাল ভোটে জয়ী হয়ে যদি ক্ষমতা ভোগ করেন। সেক্ষেত্রে কি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত? ব্রিটিশদের দেখে এই প্রসঙ্গ মাথায় আসে গাঁধিজীর। তিনি স্থীর করেন আইন সভার সদস্য তথা মন্ত্রীদের মাথার উপরে একটি অভিভাবকমণ্ডলী বা উপদেষ্টামণ্ডলী রাখবেন। তাঁরা নির্বাচনে নামবেন না, কিন্তু যারা দলের জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতায় অংশ নেবেন তাঁদের টিকিট দেবেন। এবং মন্ত্রীসভা গঠন করলে সেই মন্ত্রীসভায় কারা মন্ত্রী হবেন সেই সিদ্ধান্ত উপদেষ্টামণ্ডলী নেবে। ইউপিএ আমলে গঠিত বহু বিতর্কিত ‘ঝোলাওয়ালা’ রাজনীতি বা সংস্কৃতির কথা আমরা মনে করতে পারি। তৎকালীন ইউপিএ-র চেয়ারপার্সন সনিয়া গাঁধির বলয়ে বাঘা বাঘা অর্থনীতিবিদ, সমাজকর্মী, ইতিহাবিদরা ছিলেন। সেই দলের মাথা থেকেই আজকের সফল এমএনরেগা বা ১০০ দিনের কাজের মতো জনপ্রিয় প্রকল্প দেশে চালু হয়েছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথমে সমালোচনা করলেও তাঁর নেতৃত্বে প্রকল্পের ২০১৭-১৮ সালে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। আমরা কি গাঁধিজীর পরিকল্পিত ক্যানভাসকে ইউপিএর সরকারের মাথার উপরে থাকা কমিটির সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারি না?
আর মাত্র কয়েকটা দিন তারপর সনিয়া গাঁধি একজন অভিঞ্জ অভিভাবকের মতই আড়ালে থেকে কাজ করবেন। সামনে এগিয়ে দিয়েছেন নিজের সন্তান রাহুল গাঁধিকে। কংগ্রেস দলটি প্রায় ১৩০ বছরের দল। বিভিন্ন ঘটনার স্বাক্ষী আমাদের দেশের সব থেকে প্রাচীন এই দলটি। সামন্ততান্ত্রিক ভারত নামক একটি দেশে কংগ্রেস আড়েবহরে যত বেড়েছিল ঠিক ততটাই বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। দলে আভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র নিয়ে প্রথম দিকে বামপন্থীরা প্রশ্ন তুলত। পরে জনসংঘ আরও পরে বিজেপির নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী বিরোধী দলের উত্থান হলে তাঁরা একই প্রশ্ন তুলতে থাকে। গুজরাট ভোট প্রস্তুতির মধ্যে মঞ্চের ভাষা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন মতামত আমাদের নজরে আসে। কিন্তু সম্প্রতি কংগ্রেসের বুদ্ধিজীবী নেতা মনিশঙ্কর আয়ারের একটি আল টপকা মন্তব্যকে লুফে নেয় বিজেপির বিকাশ পুরুষ নামক দক্ষ নেতা মোদীকংগ্রেস নামক দলে মনিশঙ্কর আয়ারের পরিচিতি গাঁধি পরিবারের অত্যন্ত কাছের লোক হিসাবে। এছাড়া তিনি রাজীব গাঁধির ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের অন্যতম। মনিশঙ্করের মোদীকে নিয়ে শব্দ চয়ন এবং সেই শব্দ প্রয়োগ করাকে কেন্দ্র করে বিজেপি তাঁদের সংবাদ মাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে। গুজরাট ভোটের আগে ব্রহ্মাস্ত্র পেয়ে যায় বিজেপি। নিরপেক্ষ সংবাদ মাধ্যমও মনিশঙ্কর আয়ারকে সমালোচনা করলে কংগ্রেসের ভবিষ্যত সভাপতি রাহুল গাঁধি দলের কোর কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রবীণ নেতাকে ক্ষমা চাইতে বলেন। এবং সংবাদ মাধ্যম সূত্রে খবর মনিশঙ্কর আয়ারজিকে কিছুদিনের জন্য কংগ্রেস থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছে।
তথ্য প্রযুক্তি সমৃদ্ধ ভারত তথা উত্তর বিশ্বায়ন সংস্কৃতির ভাষা এবং মূল্যবোধে অভ্যস্ত আধুনিক ইন্ডিয়া নামক দেশটিকে আরও সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কংগ্রেস দলে রাহুল গাঁধির মতো নেতার প্রয়োজন রয়েছে। উত্তর সনিয়া গাঁধি কংগ্রেস দলে যেমন ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশে প্রচলিত দলীয় গণতন্ত্র প্রয়োজন। প্রয়োজন মানবাধিকার সংক্রান্ত মানসিক উদারতা এবং গঠনশৈলী। যে সংস্কৃতি সনিয়া গাঁধি আমাদের চিনতে সাহায্য করেছেনএকজন গণতান্ত্রিক নেতা ভুল এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যই তিনি মানুষ। তাই প্রাক্তন কংগ্রেস নেত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধির পথেই সনিয়া গাঁধি কংগ্রেসকে আরও গণতান্ত্রিক করতে চেয়েছেন। সম্প্রতি একটি বাংলা পাক্ষিক পত্রিকায় প্রাক্তন সাংসদ অধ্যাপক কৃষ্ণা বসু লিখছেন, ‘’............সাধারণত, রাজনৈতিক নেতারা অ্যাকাডেমিক কাজকর্মে বিশেষ উৎসাহী হন না, কিন্তু ইন্দিরা শুধু ব্যক্তিগত কারণে নয়, ত্রিশের দশকের ইউরোপ নিয়ে কাজ করছি জেনে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।‘’ সনিয়া গাঁধির বলয়ে কাজ করতেন এবং এখনও কাজ করেন এমন কতজন অ্যাকাডেমিশিয়ান আছেন? উত্তর আমাদের খুঁজে নিতে হবে। তাঁর ৭১ বছরের জন্মদিনে আমাদের শুভেছা রইল। এই লেখায় আমি তাঁকে শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানাই। 

Wednesday 6 December 2017

সতৃষ্ণ আলো দেখার সতীর্থদের পথে

সতৃষ্ণ আলো দেখার সতীর্থদের পথে: 
ক্লান্ত মেঘেদের দেশ থেকে যারা বেরিয়ে গেছে তাঁরা আমাকেও ডেকে নিয়ে যেতে চায়। চাপ চাপ কালো মেঘ এই বছর কম দেখেছি। বর্ষা ছিল তবে সেতো যে সব মানুষ কোনোদিন বর্ষায় ভেজেন না। তাঁদের জন্য। আমরা ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে ধান দেব মেপে’ বলতে বলতে আজও সতৃষ্ণ আলো খুঁজছি।  ছুটি শব্দটি ব্যস্ততম মানুষের আলো দেখার উৎসব। কর্মব্যস্ত মানুষ সপ্তাহ শেষে আনন্দ করবেন। জীবনকে উপভোগ করবেন। পরিবারকে গঠনমূলক সময় দেবেন। সময়ের দাবি মেনে। সমাজ কাজের, অফিস কাছারির পালোয়ানী যুদ্ধ টপকে নিজেকে হাজির করবেন উৎসবের সভাঘরে। সভ্যতার সতৃষ্ণ আলো দেখার সতীর্থদের পথে।
সেই উৎসবে সামিল হতে কে না চায়? সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকার পড়লাম। বলিউডের অন্যতম চরিত্র অভিনেতা সৌরভ শুক্লা সময় উত্তীর্ণ সময়ের কথা বলেছেনতিনি বলেছেন গত ৩৪ বছর আমি ছুটি কাটাচ্ছি। জীবন কত গভীর থেকে দেখলে এই আশাবাদের কথা বলা যায়। নাটকে অভিনয়, চিত্রনাট্য লেখার কাজ, সিনেমায় অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত থেকেও সৌরভ শুক্লা বলছেন তিনি আরও কাজ চান। আরও ব্যস্ত হতে চান। তাঁর কোনও প্রয়োজন নেই কোনও নির্জন দ্বীপে ব্যক্তিগত মালিকানার ‘ফার্ম হাউস’ বা বাগান বাড়ির। অর্থাৎ অর্থের প্রাচুর্য নয়। সৃষ্টিশীল কাজের ব্যস্ততা চাইছেন জীবনমুখী শিল্পী।
কতকাল কতদিন পর একটা মাসকে অনেক অনেক দীর্ঘতায় দেখলাম। অনেক অনেক স্পষ্টতায় অনুভব করলাম। একটা শহরকে আবার কত বছর পর আরও কাছ থেকে দেখলাম। গত কয়েক বছরের একবগগা আলিঙ্গনে আমি এবং আমার ‘আমিত্ব’ চেনা রাস্তাগুলোতে হেটেও আমাকে চিনতে চাইছিল না। রাস্তার নাম, পাখিদের রঙ, পাড়ার নাম, বাসের নম্বর, অলি গলির পথে নেমেও ‘সলেমন’-এর মায়ের মুখটা মনে করতে পারছিলাম না। বদলে যাওয়া কলকাতার ভাষা চিনতে পারছি। আলো দেখতে পাচ্ছি না। স্মৃতি ঠোক্কর খাচ্ছে বয়সের চৌকাঠে। শত্রু মিত্রদের ঘৃণা আর আলিঙ্গনের দাবির অহংকারে ওদের ঠুনকো কাঁচের ঝন ঝন আওয়াজ কতবার কতদিন শুনেছি। বিমুখ সমাজের চাবুকের শব্দ শুনতে শুনতে মন-মানসী সম্মিলিত চোখের খোঁজে থাকে। চোখের ভাষার আলতো ছোঁওয়া পদাতিক সংস্কৃতির অনুভূতি হবে ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ, জ্বেলে দিবস জ্বেলে করব নিবেদন/ আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন’নাগরিক কলকাতায় হারিয়ে যাওয়া যৌবন, পৌঢ়ত্বে এসে মঞ্চ খুঁজে পায়। অথবা ফিরে পেতে চাইছে জীবনমুখী গণতন্ত্রে, সৃষ্টিশীল ভাষায়। নীলকণ্ঠ পাখির ডানায় চড়ে সাগর পাড়ের ঝা চক চকে ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে বেহালার করুণ সুর শুনতে চেয়েছিলাম। স্মৃতির মূর্ছনা ফিরিয়ে দেবে আমার সামাজিক বন্ধন।
নভেম্বর মাসটায় কারা যেন চুপি চুপি সেই পথে ডেকে নিয়ে যেতে চাইছে। কি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ১১ নভেম্বর দেখলাম হলিউডের ছবি Julie & Julia. একজন কর্পোরেট কর্মী জুলি নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে আত্মপ্রকাশ করার মাধ্যম খুঁজে পায়। সে ব্লগ লিখতে শুরু করে। তাঁর এতটাই নাম ডাক হয় একটা সময় জুলির সাক্ষাৎকার নিতে আসে আমেরিকার নাম করা প্রথম শ্রেণির সংবাদ মাধ্যম। পরে তাঁর ব্লগের লেখাগুলি নিয়ে বই প্রকাশ হয়। ব্লগ লেখার বিষয় রান্না হতে পারে, আসলে এই রন্ধনশৈলীর মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানব দর্শনের পথ। ছবিটি প্রসঙ্গে একটি ইংরেজি লেখা তুলে দিলাম।
‘’Yesterday afternoon, a girlfriend and I slipped away to catch the first showing of Julie and Julia.  Julie and Julia is a delightful film following the legendary American cook, Julia Child, becoming Julia, and a woman trying to find herself who decides to cook each of Julia’s 500+ recipes in 365 days and blog about it.  If you’re in the mood for a good movie (that makes you hungry), I would definitely recommend Julie and Julia.
Near the end of the Julie and Julia film, Julie cooks the final dish on the 365th day and has a dinner party to celebrate her success.  As soon as I saw the darling white dress she wore, I knew immediately that I would be sharing it with you.’’ (Courtesy: Cable Car Couture)
পরের ছবিটি ১৮ নভেম্বর দেখলাম। ছবিটি ছিল ‘The Intern’ এই ছবিটিতেও আমার এবং আমাদের মত মানুষদের জন্য বর্তমান সময়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একটি ফ্যাশন সংস্থা তাঁদের কোম্পানির জন্য ‘’senior interns’’ পদে কর্মী চাইছে। উল্লখিত সংস্থা এবং সেই সংস্থার সিইও জুলস ওস্টিন এবং ৭০ বছরের প্রবীণ ইন্টার্ন বিনকে নিয়ে একটি টানটান চলচ্চিত্র। ছবির গল্প আমাদের মননকে নিয়ে যায় পেশাদার বেসরকারি অফিস সংস্কৃতি থেকে মার্কিন উচ্চবিত্ত পরিবারের ঘরোয়া জীবনের টানাপোড়েনেএবং সেই উচ্চবিত্ত পরিবারের সামাজিক জীবনকেও আমরা উঁকি দিয়ে দেখে নিতে পারি জুলস এবং বিনের ব্যতক্রমী অভিনয়ের ঘরানায়। অবশ্যই গঠনমূলক ছবি। যে ছবি ছুঁয়ে যায় বর্তমান সময়ের সোশ্যাল মিডিয়া তথা ‘ফেসবুক’ মাধ্যমকে। কলকাতা প্রেক্ষাগৃহে বসে দ্য ইন্টার্ন ছবি দেখতে দেখতে মনে হয় আমার নিজের জীবনের গল্প পরদায় দেখছি। ছবিটির ইংরেজি আলোচনা কিছুটা অংশ উল্লেখ করলাম।
            ‘’Following in the beautifully shod footsteps of Eli Wallach (“The Holiday”), Diane Keaton (“Something’s Gotta Give”), and Meryl Streep (“It’s Complicated”) comes Robert De Niro, with infinite charm and grace in a role he seldom gets to take: an ordinary guy.
De Niro plays Ben, 70 years old, living in Brooklyn, a widower after a long, happy marriage, retired, and looking for something to do. He has traveled, visited his grandchildren, taken classes. There is a single woman his age (Linda Lavin) who would love to date him. But he wants something more. “The nowhere to be thing hit me like a ton of bricks.”
And then he sees a flier. A local start-up is looking for “senior interns,” for no other reason than to make a cute movie plot, but okay. It’s an online sales company, selling fashion with some special ability to make sure the items fit properly), and he still uses a flip phone, but Ben decides to apply. And he is undaunted that applicants, instead of submitting a resume, are asked to upload a video about themselves. “I want to be challenged,” he explains, “and needed.”
He gets the job and is assigned to the start-up’s visionary but harried CEO, Jules Ostin (Anne Hathaway). Is the name supposed to make us think of Jane Austen? Could be. She has an only-in-movies adorably precocious moppet and a shaggy (in a cute, artisanal, Brooklyn way) devoted stay-at-home-dad of a husband. And, guess what? They live in an exquisitely decorated brownstone with a couple of legos and a backpack sprinkled around for relatability. Plus, she is played by Anne Hathaway, so she is stunningly beautiful in a we’d-totally-be-best-friends-if-she ever-met-me sort of way. She gets to channel her “Devil Wears Prada” co-star Meryl Streep as the boss who can be terrifying, but she knows and we know she’s there to be loveable, not scary. And he is endlessly calm and resourceful, whether cleaning up the office junk pile, crunching data, giving dating advice, or retrieving a disastrously mis-sent email.’’ (Courtesy: Warner Brothers) 
এই ধারাবাহিকতায় হঠাত করে সুযোগ এসে গেল নিউইয়র্ক শহর আর শান্তনিকেতনে একসঙ্গে ঘুরে আসার। এবছরের ৪ ডিসেম্বরটা সম্ভবত সেই সুযোগটা করে দিয়েছিল। বড়দিনের সংযমী হুল্লোর এবং পৌষ মেলার উদাসী বাউলের খ্যাপামো। কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের লিঙ্কন সভাঘরে ৪ ডিসেম্বর ছিল একটি সঙ্গীত সন্ধ্যা অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘নিউ ইয়র্ক মিটস কলকাতা’। গান এবং ‘জাজ মিউজিক’ শুরুর আগে আমেরিকান সেন্টারের বর্তমান জনসংযোগ অফিসার (পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার) জেমী ড্রাগন অনুষ্ঠানের সূচনায় বললেন, ‘’আমি কলকাতায় মাত্র তিনমাস এসেছি। আমি হায়দারাবাদে ছিলাম। আমার মনে হচ্ছে মাত্র তিনদিন এসেছি। এর আগে ১৯৯৮ সালে আমি কলকাতায় ছিলাম। এবছর সুযোগ আসতেই আমি বললাম, আমি কলকাতায় যেতে চাই। আজ সভাঘরে একটিও আসন খালি নেই। কলকাতা মানেই সঙ্গীত, ফুটবল। সঙ্গীতপ্রেমী কলকাতার শ্রোতারা এসেছেন। আসুন আমরা সঙ্গীত উপভোগ করি।‘’ 
আনুষ্ঠানিক বক্তব্য রাখতে এসে বড় ব্যক্তিগত হয়ে গেলেন কলকাতার আমেরিকান দূতাবাসের কনসুলেট জেনারেল ক্রেগ এল হল। তিনি এবছরের অগস্ট মাসে ইউ এস কনস্যুলেট জেনারেল হিসেবে কলকাতার দায়িত্ব নিয়েছেন। ক্রেগ বললেন, ‘’ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের চুক্তি এই বছর ৭০ (সততর) বছর পূর্ণ হল। আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক একশো বছর থাকুক আমরা চাইছি। আজকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশ তথা কলকাতা শহরে হচ্ছে। দুই দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আমরা সেটা মনে রেখেছি।‘’
ক্রেগ উল্লেখ করেন, আজকের এই সভাঘরে কলকাতার বিদগ্ধ মানুষেরা এসেছেন দুই দেশের শিল্পীদের গান শুনতে। আমরা আশা করব আগামী দিনেও আরও এই ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন আমরা করতে পারব।
অনুষ্ঠানে শুরুতেই মঞ্চে প্রথমে গাইলেন ‘নিউ ইয়র্ক’ শহরের বিখ্যাত ব্যান্ড ‘অরি রোল্যান্ড’-এর চারজন শিল্পী। অরি নিজে এই দলের স্বনামধন্য মিউজিক কম্পোজার। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন শিল্পী। বিশেষ করে বলতে হয় স্যাক্সোফোন শিল্পী এবং গায়কের কথা। দক্ষতা এবং কৌতুক মেশানো আন্তরিকতায় কলকাতার উচ্চশিক্ষিত সুধী শ্রোতার দল উব্দেলিত হয়ে আনন্দ লুটে নিলেন সেদিন। মেধাবী চোখ হ্রদেয়র আহ্বান শুনে গঙ্গা-আটলান্টায় অবগাহন করতে চাইছিল। স্পর্শকাতর স্নায়ু অরি রোল্যান্ডের রসিকতায় নিউ ইয়র্ক এবং কলকাতা শহরকে ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্রের দুই পরম্পরা মনে করিয়ে দিচ্ছিল দুই শহরের বড় কাছাকাছি থাকার যে ঐতিহ্য সেই স্মৃতি আমাদের আগামীর আহ্বান শুনিয়ে গেল। গান, স্যাক্সো ফোন, ড্রাম, গিটারের আন্দোলিত সুর ভাষার ব্যবধানকে অনায়সে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। ভালো থেক নিউ ইয়র্ক। তোমার আমন্ত্রণ কলকাতা সবিনয়ে গ্রহণ করছে।
ভালো আছে কলকাতা। গঙ্গার ঢেউয়ের প্লাবনের মতো আমাদের সামনে এলেন বাংলা নাটক ডট কমের শিল্পীরা। দলের মুখ্য গায়িকা এবং পরিচালক দেবলীনা তাঁর কণ্ঠের জাদুতে আমাদের কখনো নিয়ে গেলেন বৃন্দাবন, নবদ্বীপে। আবার বাংলাদেশের নদী মাঠ ঘাটের সুরে তিনি আরও আন্তর্জাতিক হয়ে উঠলেন তাঁর সুরেলা এবং অভিজাত কন্ঠের প্রেক্ষপনে। পাশে ছিলেন গিরিশ বাউল। উদাসী সুরে বাউলের ছন্দে ভবা পাগলা আর লালনের ঘর করা গিরিশকে আমাদের মনে রাখতেই হবে। কিছুমাত্র কম ছিলেন না দেবলীনার দলের দ্বিতীয় গায়িকা। নাম মনে রাখতে না পারলেও তাঁর গলায় এই বাংলার ঝুমুর গান ঝুম ঝুম নূপুরের শব্দের মতো আমরা শুনলাম। রিম ঝিম সন্ধ্যায় আমাদের বাংলার তাল লয় ছন্দে আন্দোলিত হল কলকাতা শহরের এক অভিজাত কক্ষ। বাংলা নাটক ডট কমের তিন শিল্পী সঙ্গে নিউ ইয়র্ক শহরের অরি রোলান্ডের দলের যৌথ পরিবেশনা মনে করিয়ে দিল পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার। ভোর ভর হল দোর খোল নগরবাসী। আমি প্রাণবন্ত সভাঘরে বসে আমার মলিন নামহীন প্যাডে লিখলাম, হারিয়ে যাওয়া কার্তিক অগ্রাহায়ন মাসে/ হ্রদয় নিয়ে বসে আছি/ মন মেঘেরা যদি আসে।