Friday 3 August 2018

একাত্তর বছরের তরুণ ভারতে ভারতীয় জাতি! কে বলে দেবে?



দীপেন্দু চৌধুরী
২০১৮ সালের জুলাই মাস কী ভারতে নতুন বার্তা বয়ে নিয়ে আসতে চাইছে?  না হলে বিতর্কিত একটি বিষয়কে এভাবে সামনে আনতে হচ্ছে কেন? চারদিকে হৈ চৈ পড়ে গেছে। চার লাখ মানুষের ঘর ছিল, বাড়ি ছিল, সংসার ছিল, আত্মীয় ছিল। ধর্মীয় উপাচার ছিল, লক্ষ্মী-নারয়ণের সিংহাসন ছিল, লক্ষ্মীর পাঁচালী ছিল। বিজয়া দশমীর আলিঙ্গন ছিল। মন্দির, মসজিদ ছিল। ভোরের আজান, ঈদ-দুর্গা পুজোর সমাবর্তন উৎসব ছিল। ভাওয়াইয়ার গান ছিল, বাউল-ফকিরের বন্ধন ছিল। রবীন্দ্রনাথ-নজরুল ছিল। বহু রঙের জোব্বা ছিল। সার্বজনীন সামাজিকতা বর্তমানে উদাস আকাশে শ্বেত পায়রা খুঁজছে। একটি সরকারি বিঞ্জপ্তির কারণে চল্লিশলাখ মানুষ ‘নেই ঘর’ আতঙ্কে জবুথবু হয়ে রয়েছে। জুন মাসের ২৬ তারিখ কলকাতায় বরাক উপত্যকার একটি উচ্চশিক্ষিত পরিবারের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। একটি বেসরকারি অতিথি নিবাসে তাঁদের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন আমাদের এক বন্ধু। আমাদের কলকাতার সেই বন্ধুটি একটি অভিজাত প্রকাশনা সংস্থা চালান এবং একটি দ্বিমাসিক পত্রিকার সম্পাদক। তার অনুরোধেই আমি গত মাসের ওইদিন মধ্য কলকাতার ওই অতিথিনিবাসে গিয়েছিলাম। পরিবারটির একটি সাক্ষাৎকার নিতে। সেই পরিবারটি আমাদের সঙ্গে যখন কথা বলছিলেন তাঁদের গলায় আতঙ্ক ঝড়ে পড়ছিল। অভিমান আছড়ে পড়ছিল। বরাক উপত্যকার ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হতে পারে এই আনুমানিক আতঙ্কে! রাষ্ট্রহীন সভ্যতার নাগরিক হিসেবে একটি উচ্চশিক্ষিত পরিবারকে জীবনের বাকী অংশ কাটাতে হবে! চোখে চিক চিক করছিল রূপোলী জলের বিন্দু বিন্দু অশান্ত স্রোত। একে উচ্চশিক্ষিত। মার্জিত।  তারপর আমরা সামনে দু’জন অপরিচিত সাংবাদিক। একজন প্রগতি ধারার প্রকাশনা সংস্থার মালিক। আমাদের তিন জনের সামনে তাই আবেগ চেপে নিলেন মধ্য সত্তরের পৌঢ় দম্পতি। আমরা দেখলাম তাঁদের দ্বিধা, সংকোচ, সজল লজ্জা ওদেরকে টেনে ধরে রাখল। দীর্ঘদিনের চর্চিত ভদ্রলোকের সৌজন্য দু’জনকে আগলে রাখল মানব সভ্যতার উন্নত প্রাণী হিসেবে।        
স্বামী-স্ত্রী দু’জনে নিজেদের সামলে নিয়ে ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন সেদিন আমাদের সামনে। তাঁরা সব বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন। এত দিনের শিক্ষা, পারিবারিক, সামাজিক বন্ধন, ভারতীয় মাটির মায়া, টান, পাহাড় সভ্যতার সারল্য ভেঙে চুরমার। উত্তর পূর্বের শ্যামল সবুজ উপত্যকার অতিথি বৎসল মাধুকরী সংস্কৃতি হারানোর অজানা ব্যাথা তাঁদের গলায় আবেগ, মনন সব, সব কিছু কোন অজান্তে হারিয়ে গেছে তাঁদের আঙিনা, উঠোন-বারান্দা থেকে। মেঘনা, যমুনা গঙ্গার মোহনায় এসে তাঁরা আবার নিজদের খুঁজছেন। তাই রাষ্ট্রের উপর তাঁরা বিশ্বাস হারিয়েছেন। জুন মাসে তাঁদের চোখে,শারীরিক ভাষায় যে আতঙ্ক দেখেছিলাম আজ সেটাই সত্যি হয়ে আমাদের সামনে ‘বাঙালি জাতিসত্তা’ মনে আগুন লাগিয়ে দিতে চাইছে! আমরা কী বলব? ‘’ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়.........!’’ প্রবাদটা মনে পড়ছে না? উদ্বাস্তু না হলে, রাষ্ট্রহীন না হলে শিকড়ের টান ক’জনে আর অনুভব করতে পারে? স্বাভাবিকভাবেই সিরিয়া, মায়ানমারের উদাহারণ আমাদের সামনে আসে। ভুগছে বাংলাদেশ নামক আরও একটি দেশ। মানবিক কারণে সে দেশের সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ শিবির চালাচ্ছেন। রাষ্ট্রসংঘ সহ বিভিন্ন দেশ পাশে আছে। ভারতও সাহায্যের হার বাড়িয়ে দিয়েছে। ভারত, মায়ানমার এবং সিরিয়ায় তাঁদের অস্ফুট যন্ত্রণার স্রোত আরও কত দূর যাবে কে জানে সে কথা?
আমরা কিছুটা পিছনে গিয়ে যদি ফিরে দেখিঅসম নামক একটি রাজ্যে বাঙালি বসতির ভৌগলিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত কী? ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়কালে বিদেশী শাসকরা নিজেদের প্রশাসনিক প্রয়োজনে ইংরেজি শিক্ষার সুযোগের ব্যবস্থা করেছিল। সেই সুযোগ ঐতিহাসিক ভাবেই বেশি পেয়েছিল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতার বাঙালিরা। কারণ ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতাই ছিল ভারতের রাজধানী। ইংরেজি ভাষাকে রপ্ত করার পর ইংরেজি জানা নব্যশিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে একটি নতুন উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণী গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ সরকার ইংরেজি ভাষাঞ্জান সমৃদ্ধ এই নব্য শিক্ষিত ‘বাবু সমাজ’-কে বিভিন্ন দপ্তরে কাজের সুযোগ করে দেয়। উপনিবেশ চালানোর স্বার্থে নতুন গজিয়ে ওঠা ‘বাঙালি বাবু’ শ্রেণীকে ব্রিটীশ সরকার সরকারি অফিস, রেলওয়ে, আইন-আদালতে এবং চা বাগানগুলিতে নিয়োগ শুরু করে। মধ্যবিত্ত বাঙালি বেশি সংখ্যায় উত্তর-পূর্ব ভারতের চা বাগানগুলিতে চাকরি নিয়ে চলে যেতে থাকে। মোটা টাকা উপার্জনের সুযোগকে ক’জন আর হাতছাড়া করতে চায়? কারণ তৎকালে এবং স্বাধীনতা উত্তর ভারতের উত্তরপূর্বে চাকরি বা জীবীকার জন্য কেউ যেতে চাইত না। অনুন্নত পাহাড়ি জনজাতি সমৃদ্ধ অসমও সেই আর্থ-সামাজিক সীমাবদ্ধতার জটিল সংস্কৃতির শিকার ছিল। ব্রিটিশ শাসকরা অসমের চা বাগানগুলির জন্য বাংলা, অবিভক্ত বিহার থেকে ঠিকে শ্রমিক নিয়ে যেত। আমাদের মনে আছে সেই বিখ্যাত গানের কথা। ‘চল মিলি আসাম যাব/ এ দ্যাশে বড় দুঃখ রে/ এ দ্যাশে বড় দুঃখ।’  
বাঙালিদের একটা শ্রেণী নিজেদের আর্থিক প্রয়োজনেই অসম নামক একটি স্বাধীনতা পূর্ব বাংলার অসমে চাকরির সুবাদে স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে থেকে যেতে শুরু করে। এবং এই সময়ে আরও একটি ইতিহাস নির্ভর সত্য আমাদের সামনে এসে যায়। বাঙালি ‘বাবু সমাজ’ ব্রিটিশদের চাটুকার হিসেবে নিজেদের অলিখিত আধিপত্য গড়ে তুলতে সহায়ক হয়। যদিও এর সবটা সত্য নয়। কারণ নবজাগরণের ব্যক্তিক্তদের স্মরণ আমাদের করতেই হবে। তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা আমাদের দিতেই হবে। ব্রিটিশ অধ্যুষিত উত্তর-পূর্ব ভারতে যারা বা যেসব জাতি, সম্প্রদায় কাঠ, চা, তামাক পাতার ব্যবসা করে মোটা টাকার মালিক হতে পেরেছিলেন তাঁরাই ওইসব রাজ্যের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা পেয়েছিলেন। এবং সেই সঙ্গে ক্ষমতা ভোগ করেছেন। এই পর্বে মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী বাঙালিদের কথা এলেও বাঙালি এই সত্য বয়ে বেড়ায়নি। কারণ আমাদের সামনে রয়েছে দেশ ভাগের মত ইতিহাস। পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিয়েছিল আমাদের গর্বিত বাংলাকংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধানচন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে আপামর কংগ্রেস- অকংগ্রেস বাঙালি আতিথিয়তার প্রমাণ দিয়েছিলেন। পূর্ববঙ্গ এবং পাকিস্তানের সব জাতি, সব শ্রেণীর মানুষের জন্য বিভক্ত ভারতের নবীন দেশের সিংহদুয়ার খুলে দিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। গাঁধিজি, রবীন্দ্রনাথ, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, শরৎচন্দ্র বসু সহ আরও বিশিষ্ট ভারতীয়দের সহযোগিতায় পূর্ববঙ্গের ‘নতুন যুগের নতুন মানুষ’ উদ্বাস্তুদের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছিল অতিথিবৎসল পশ্চিম বঙ্গের কলকাতার উপকন্ঠ, মালদহ-মুর্শিদাবাদ, জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ির উপকন্ঠরবীন্দ্রাথের সেই বিখ্যাত উক্তি আজও ঐতিহাসিকদের মনে থাকার কথা। গোয়ালপাড়া প্রসঙ্গে চিনের মরণের ব্যবসার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘’Business of death of China’’, ‘‘অজগড় সাপের ঐক্য নীতি।‘’ কবির উদ্বেগ সত্বেও জয় হয়েছিল বহুত্বের মধ্যে ঐক্যের সংস্কৃতির। সব ধর্মের সব জাতির উদ্বাস্তুদের জন্য উদ্বাস্তু কলোনি সহ সমস্ত সুযোগ ভারত সরকার করে দিয়েছিল। আমাদের এই বাংলায় একটা সময় উদ্বাস্তুদের এই বঞ্চিত শ্রেণীর সাহায্যে বামপন্থীরা রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় আসে। ১৯৭১ সালেও নতুন বাংলাদেশ জন্মের পরে বহু ‘শরণার্থী’ আশ্রয় নেয় বাংলা, অসম তথা ভারতে।            
এটা যদি ইতিহাসের একটা অধ্যায় হয় আধুনিক পরিচ্ছেদে যুক্ত হয়েছে আরও একটি অধ্যায়। সেটি হচ্ছে ‘অসম চুক্তি’ আশির সশকে অসমে ‘আসু’-র ছাত্র আন্দোলনের কথা আমাদের মনে আছে। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন প্রফুল্ল মহান্তি এবং ভৃগু ফুকন। অসমিয়া, বোড়ো, ডিমাছা, মণিপুরি (মৈতে), বিষ্ণুপ্রিয়া, আহোম। কার্বি, কুকি, মার ভাষা গোষ্ঠীর মানুষদের আত্মনিয়ন্ত্রণ সহ একগুচ্ছ দাবি নিয়ে এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। যদিও অসমে আশির দশকের পরে ‘বোড়ো’ এবং অন্যান্য ভাষাগোষ্ঠী পৃথক আন্দোলন শুরু করে। এবং স্বশাসিত অঞ্চল আদায় করে নিয়েছে। অসম আন্দোলন শেষ হয় ১৯৮৫ সালে ‘অসম চুক্তি’ স্বাক্ষর হওয়ার প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের পরে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধির মন্থরগতির বুদ্ধিদীপ্ত কূটনীতি বর্তমান সময়েও সমান মূল্য বহন করে চলেছে। অসম নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের আগে পরে ‘ডি’ শব্দটি নিয়ে বিতর্ক ছিল। সম্ভবত বিতর্ক পরে আরও বাড়তে পারে। ‘ডি ভোটার’ মানে ডাউটফুল ভোটার, ডিটেকশন, ডিটেনশন, ডিপোর্টেশন। ব্রহ্মপুত্র এবং বরাক উপত্যকায় সর্বমোট ১ কোটি ২০ লক্ষেরও বেশি বাংলাভাষী মানুষ থাকেন। তাঁদের থেকে ৪০ লক্ষের সঙ্গে ‘ডি’ শব্দটি জুড়ে দেওয়া হয়েছে সম্ভবত। নাগরিকপঞ্জি তালিকাভুক্ত ৪০ লক্ষ মানুষ নিজদের ভারতীয় নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে তারাও আমাদের দেশে থাকার সুযোগ পাবেন।
ভারত একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। ভারত নামক দেশটি ‘রাষ্ট্র’ হিসেবে মর্যাদা পেলেও ‘ভারতীয় জাতি’ হিসেবে কতটা স্বীকৃতি পেয়েছে? ভারতীয় জাতি হিসেবে স্বীকৃতি পেতে আমাদের কতটা আগ্রহ আছে? সংকীর্ণ সংস্কৃতির উর্ধে উঠে বহু ভাষার এক বর্ণময় সহনশীল জাতির উন্মেষ কবে হবে? ভারতের মত উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে? প্রশ্ন হ্যাঁ প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। আমরা আর কবে তথাকথিত রাজনীতির কচকচানি থেকে বাইরে এসে ভারতীয় জাতিরাষ্ট্রের অহংকার গড়ে তুলতে পারব?       
অসমচুক্তির মূল বিষয় ছিল ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের মধ্যরাত পর্যন্ত যারা বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী হিসেবে অসমে এসেছেন তাঁরা থাকতে পারবেন। ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশ থেকে আসা সমস্ত শরণার্থীকে বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। এবং ১৯৭১ সালকে ভিত্তি বছর ধরে তারপরে যারা এসেছেন তাঁদের ফেরৎ পাঠাতে হবে। এটাই হচ্ছে অসম চুক্তি তথা অসম নাগরিক পঞ্জির মূল কথা। ফরেনার্স ট্রাইবুনাল গঠন করে চিহ্নিতকরণের কাজ শুরু করার কথা বলা হয়েছিল উল্লেখিত চুক্তিতে সেই মোতাবেক ‘ডি ভোটার’ বা ‘ডাউটফুল ভোটার’ চিহ্নিত করা হয়েছে। এমনটাই দাবি অসম নাগরিকপঞ্জি তৈরির কতৃপক্ষের।  
অসমে ‘আসু’-র ছাত্র আন্দোলনের পরে প্রথম অগপ সরকার মোট ২, ৮৭, ৬২৫ জনকে বিদেশী বা ‘ডি ভোটার’ হিসেবে ঘোষণা করে। এবং তাঁদের চিহ্নিত করা হয় ‘ফরেনার্স ট্রাইবুনাল’-এ মামলার ভিত্তিতে। ওই ট্রাইবুনাল মাত্র ৮৬৯ জনকে বিদেশী হিসেবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। পরের ঘটনা আমাদের সামনে জ্বল জ্বল করছে। ১৯৯৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গঙ্গা, পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র দিয়ে দেড় দশক ‘জল-পানি’-এর খরস্রোত ধারা বয়ে চলেছে। ভারতের অসম রাজ্যের অবৈধ নাগরিক নিয়ে আবারও মামলা হয়। ৪, ০৬, ৪৫১ জনকে ‘ডি’ হিসেবে চিহ্নিত করে এই মামলা হয়। ৩০ জুলাই যে রায় আমাদের সামনে এসেছে। চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পরে পরেই দেশহীন, রাষ্ট্রহীন, পরিচয়হীন আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছেন এক বিরাট সংখ্যক অ-নাগরিক। তাঁরা এসেছিলেন অতিথিবৎসল ভারতে। প্রশ্ন উঠছে ভারতের অভিভাসন নীতিটা আসলে কী। যদিও মহামান্য উচ্চ ন্যায়ালয়ের নির্দেশে ভোট দিতে পারবেন বর্তমানে অ-নাগরিক সকলেই। কিন্তু তারপর?  
এই রায় প্রকাশের পরেই অতিথি বৎসল বাংলার দলমত নির্বিশেষে সমস্ত স্তরের নাগরিক নতুন করে সৃষ্ট শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াতে চাইছে। স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন রাজ্যের অতিথিবৎসল অভিভাবক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে পেয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধিকে। সংসদের বর্ষাকালীন অধিবেশন চলছে। স্বাভাবিকভাবেই অসম নাগরিকপঞ্জির উত্তাপ সংসদে গিয়ে পড়েছে।
৩০ জুলাই সকালে এন আর সি দফতরে একটি সাংবাদিক বৈঠক ডাকা হয়েছিল। ওই বৈঠকে হাজির ছিলেন, এনআরসি সমন্বয়রক্ষী প্রতীক হাজেলা, দেশের রেজিস্টার জেনারেল (মহাপঞ্জীয়ক) শৈলেশ এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতরের যুগ্মসচিব সত্যেন্দ্র গর্গ। শৈলেশ বলেন, নাগরিক পঞ্জিতে নাম উঠেছে ২, ৮৯, ৮৩, ৬৭৭ জন আবেদনকারীর। তিনি একথাও উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ পর্যন্ত অসমে থাকা মানুষ এবং তাঁদের বংশধরদের নামই নাগরিক পঞ্জিতে স্থান পেয়েছে। বাদ পড়েছে ৪০, ০৭, ৭০৭ জন। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস বামপন্থী সহ বিরোধীদের চাপে সংসদে মুখ খোলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। তিনি দাবি করেন গোটা বিষয়টাতে কেন্দ্র বা রাজ্যের বিজেপির কোনও হাত নেই।
৩০ জুলাই নবান্নে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘’দেশ বা আন্তর্জাতিক সীমান্ত পেরিয়ে আমাদের ঘরে যদি কেউ আসে, তা হলে তাঁদের উদ্বাস্তু হিসেবে দেখে সাহায্য করতে হবে।‘’
অসমের নাগরিকপঞ্জি প্রকাশের পরে বাংলাদেশ সরকারকেও মুখ খুলতে হয়েছে। কারণ যেহেতু ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’-দের দিকে বেশি করে আঙ্গুল উঠেছে। ৩১ জুলাই বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘’১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময়ে এক কোটি মানুষ ভারতে গিয়েছিলেন। পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতেই ভারত তাঁদের বসবাসের ব্যবস্থা করেছিল। তার পর গত ৪৮ বছরে ভারতের কোনো সরকার এঁদের নিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ জানায়নি।‘’ সংবাদ সংস্থা সূত্রে আরও খবর বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী জানান, অসমের জনজাতির সমস্যাটি শতাব্দী প্রাচীন। এর সঙ্গে বাংলাদেশিদের কোনও যোগ নেই। তিনি আরও বলেন, ‘’এটি পুরোপুরি ভারতের অভ্যন্তরীণ জাতিগত বিষয়। নরেন্দ্র মোদী যথেষ্ট ধর্মনিরপেক্ষ এবং উদার নেতা। তিনি বিষয়টির সুষ্ঠু সমাধান করতে পারবেন বলে আশা রাখি।‘’
৩০ জুলাই কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধি একটি বিবৃতিতে জানান, ‘’১৯৮৫ সালের অসম চুক্তি মেনে মনমোহন সিংহের আমলে নাগরিকপঞ্জির কাজ শুরু হয়েছিল। এনডিএ সরকার এ নিয়ে টালবাহানা করেছে। তালিকায় নাম নেই বহু মানুষের।‘’           
 আমাদের হাতে একটি এলিট বাঙালির নামের তালিকা এসেছে। যাঁদের নাম সম্প্রতি ঘোষিত নাগরিক পঞ্জিতে নেই। তাঁরা কারা? অর্চনা পাল বিজেপি এম এল এর স্ত্রী। কমলাক্ষ বাবু প্রাক্তন এম এল এ। প্রশান্ত চক্রবর্তী কটন কলেজের অধ্যাপক। প্রকৃতিশ বড়ুয়া প্রমথেশ বড়ুয়ার ভাই, গৌরীপুরের মহারাজার ছেলে।
ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। বড়খলার গোবিন্দ দাস নাগরিকত্বের মামলায় ১৯৮৮ এবং ২০১৫ সালে ভারতীয় নাগরিক প্রমাণিত হয়েছেন আদালতেই।
মহম্মদ আজমল হক ৩০ বছর ভারতীয় সেনাবাহিনীতে জওয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
তপোধীর ভট্টাচার্য আসাম বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রাক্তন উপাচার্য এবং ওনার পিতা ছিলেন নির্বাচিত বিধায়ক।
চিন্ময় ভৌমিক হলেন কার্গিল যুদ্ধের ভারতীয় বাঙালি শহীদ।
এরা বা এঁদের মত পরিবারের সদস্যদের নামের তালিকা আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পাচ্ছি। যাঁদের নামও আছে ৪০ লাখের ওই তালিকায়। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্যদের যদি এই অবস্থা হয়যে অভিঞ্জতার কথা আমরা প্রথমেই উল্লেখ করেছিলাম। এক অধ্যাপক দম্পতির উদ্বেগ দেখে। আমাদের উপরের তালিকায় ওই পরিবারের নামও রয়েছে। তাহলে যেসব মানুষ দিন আনে দিন খায় তাঁদের কী পরিস্থিতি হতে পারে আমরা অনুমান করতে পারি যারা নিরক্ষর, কোনওদিন বুঝতে চায়নি, বুঝতে পারে না। তাঁদের নিজেদের জন্য, পরিবারের জন্য, সন্তানদের জন্য একটা পরিচয়পত্র প্রয়োজন তাঁরা আজ কী করবে? কোথায় যাবে?
 যদিও আবার নতুন সময়ের কথা বলা হয়েছে। সামনের বছরের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত উদ্বৃত্ত নাগরিকেরা আবেদন করার সুযোগ পাবেন। সেইদিন পর্যন্ত বাংলা, অসম, উত্তর পূর্বের রাজ্য তথা ভারতের রাজনীতির আকাশে অনেক রঙ, আতসবাজির উল্লম্ফন আমাদের দেখতে হবে। ভরসা বাংলার অতিথি বৎসল মানুষ। হ্যাঁ একমাত্র আমরাই পারি ওদের পাশে দাঁড়াতে।