Tuesday 18 October 2016

শারদীয়ার মিলনবেলা

শারদীয়ার মিলনবেলা  
উৎসব মানেই আনন্দ। উৎসব মানেই বন্ধু মিলন, আত্মীয় মিলন। উৎসব মানেই কেনা কাটা। বাণিজ্য। বাণিজ্যক প্রতিযোগিতা। সামাজিক প্রতিযোগিতা। প্রেম প্রেম হুল্লোর। একটি দু’টি সত্যি প্রেমের গল্প। প্রবাসী বাঙালির কনে দেখার গল্প। অনাবাসী বাঙ্গালির ঘরে ফেরার আবেগ। অনেক অনেকগুলি মিথ্যে প্রেমের গল্প। বেশ কিছু আবেগ প্লাবিত ব্যর্থ প্রেমের বিংশ শতাব্দীর চিত্রনাট্য। কাশ ফুলের প্রতিযোগিতা। এবারের  দুর্গা পুজোতে ‘মেঘাসুর’ দাপিয়ে বেড়িয়েছে। থোড়াই পরোয়া! কে কার পরোয়া করে? বৃষ্টি নয় শরতের মেঘ বালিকার অপটু নৃত্য। আয় বৃষ্টি আয়। ঝেপে ঝেপে আয়। কেঁপে কেঁপে আয়। ভিজব আর গাইব ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে আইসক্রিম খাবনা মেপে। ওষুধ দেব তোকে, মেপে মেপে।’ এবছর এই প্রজন্মের ছিল অস্ফুট স্লোগান। ‘বৃষ্টি’ কবিতায় অমিয় চক্রবর্তী লিখছেন, ‘’স্রোতঃস্বনা মৃত্তিকার সত্তা স্মৃতিহীনা/ প্রশস্ত প্রাচীন নামে নিবিড় সন্ধ্যায়/ এক আদ্র চৈতন্যের স্তব্ধ তটে। ভেসে মুছে ধুয়ে ঢাকা সৃষ্টির আকাশ দৃষ্টিলোক/ কী বিহ্বল মাটি, গাছ, মানুষ দাঁড়ানো দরজায়/ গুহার আঁধারে চিত্র, ঝড়ে উতরোল/ বারে-বারে পাওয়া, হাওয়া/ হারানো নিরন্ত ফিরে—ফিরে—‘’
আমারও যেন ফিরে পাওয়ার দিন ছিল। অব্যক্ত অকথিত সম্মেলন হয়ত বা। ঠাকুর দেখা কলা বেচা এই দু’টোর সংস্কৃতি থেকে আমি একশো যোজন দূরে থাকি। আমার ব্যক্তিক নিষেধাঞ্জায়। যেদিন থেকে বড় দিদি নিজের সংসারে ব্যস্ত হল। বড় জামাইবাবু সামাজিক জটিলতায় আর লড়াই করতে পারলেন   না। বড়দাদা আরও আরও জটিল বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে নিজেকে জড়িয়ে ফেলল। দু’হাত তুলে তুলে দু’গগা, দু’গগা বলে পালিয়ে এলাম। আজও পালিয়ে পালিয়ে ছুটছি। সামাজিক টানাপড়েন চিনে এবং অবশ্যই না চিনে। মনে পড়ছে। এবছর এপ্রিলের এক গ্রীস্মের সন্ধ্যেয় ‘কমিউন’ নামে এক অতিথিশালায় বাবুদের সভায় গিয়েছিলাম। সেদিন চৈত্রমাস ছিলনা ঠিকই। কিন্তু সেদিন সামাজিক অনুশাসন উপেক্ষা করে প্রায় আটবছর পর আমি মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম। আবদ্ধ জীবন থেকে পশ্চিমের ডাকে সেদিন মুক্তি পেয়েছিলাম। চেনা পথঘাটগুলো সেদিন কেমন অচেনা লাগছিল। অত উজ্জ্বল আলোকস্তম্ভ আমাকে আগমনী বারতা দিয়েছিল। কতদিন কলকাতা শহর তোমাকে আদর করিনি। দু’চোখে দেখতে ভুলে গেছি আজ কত বছর? কলরব মুখরিত কল্লোলিনী কলকাতা। তুমি বাঙ্গালির গর্ব। তুমি আমার শহর। আমাদের শহর। আজ ভাবি সেইসব দিনের ব্যস্ততা
উপকণ্ঠের উপকথা ভেঙ্গে ভেঙ্গে কোনওদিন দশ ঘণ্টা ডিউটি করছি, কোনওদিন আঠের ঘণ্টা। আবার চব্বিশ ঘণ্টা। আটচল্লিশ ঘণ্টা। এইভাবে আমি এবং আরও দু’একজন সাংবাদিক, চিত্র সাংবাদিক কাজ করেছি। চ্যানেলটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম। তারপর সপ্তাহ শেষে কাজের পর প্রতি শনিবার প্রেসক্লাবে যেতাম। দু’পাত্র হুইস্কি খেয়ে ‘গোষ্ঠগোপাল’দের সঙ্গে বাড়ি ফিরতাম। সেসব আজ ঝাপসা। এবছর আড়ালে আপনি বা আপনারা কে আছেন? বাতাসে বারুদের গন্ধ নয়। বাতাসে নিম পাতার তেতো হাওয়া নয়। নিম গাছের সামাজিক হাওয়া। সমাজের ডাক। সামাজিকতার হাতছানি পাচ্ছি। বেঁচে থাকার শিউলি পরশ। কাঁঠালিচাঁপা, হাসনুহানা ফুলের সুতীব্র আহ্বান। ফুল ফুটছে আজ এই শরতে।
সেদিনের সেই গ্রীষ্মের সন্ধ্যেয় ‘কমিউন’ সভা ঘরে নতুন মানুষ সবাই। উজ্জ্বল আলো। উজ্জ্বল ভাষা। বাবু কলকাতার কৌতূহল। ভাস্বর, ভাব গম্ভীর অচেনা সভাঘরে ভাস্বতী সন্ধ্যা। অবাধ্যের মত   অবিক্ষিপ্ত, অপর্যাপ্ত অবিশ্রান্ত কথা বলেছিলাম। একজন দু’জন আমাকে চিনতে পেরেছিল। সেদিন কেউ কেউ কেউ ভেবেছিল আমি সুস্থ স্বাভাবিক নই। হয়ত হেসেওছিল ওরা আড়ালে নাগরিক সৌজন্যেহাসতেই পারে। গত চারদশক ধরে এই হাসি আমি চিনি। সেদিন একজন দু’জন চিনে ফেলে আমাকে। আমার গ্রাম্যতা আমার আভিজাত্য। টানা মানসিক অত্যাচারের পর ওই ভাস্বর ভাস্বতী সন্ধ্যেয় উচ্চ শিক্ষিত শিক্ষক, ডাক্তার বেসরকারি সংস্থার আমলা, অধ্যাপকরা আমায় নিয়ে ভেবেছিলেন। সেদিন যে বা যারা আমাকে আন্তরিক প্রশ্রয় দিয়েছেন তাদের কাছে আমি কৃতঞ্জ। এবছর (২০১৬) দুর্গা পুজোর মাত্র ছ’মাস আগে আমার মুক্তি হল।
তৃতীয়ার দিনে এক প্রবীণ সাংবাদিক বন্ধু আমাকে ডেকে নিয়েছিলেন। প্রেসক্লাবে নয়। মধ্য কলকাতার একটি গেস্ট হাউসে। দামি স্কচের নিমগ্নতায় আমরা তিনজন ছিলাম সেদিন। টানা আড্ডা। মাত্র তিন ঘণ্টা। টান টান উত্তেজনা আর বাড়ির কড়া হুকুম। আমরা বাড়ি ফিরেছিলাম রাত দশটার মধ্যে। বাড়ির বাধ্য ছেলেমেয়েদের সময়সীমা মেনে। সেদিন রাজনীতি, সমাজনীতি, বাংলা কবিতা, উর্দু কবিতা, সাহিত্য সিনেমা কত কিছুর উচ্চারণ ছিল নীরব শান্ত সমাহিত সমস্ত দল, ধর্মের উর্ধে আমরা ছিলাম সমাজ সাধক। ওই প্রবীণ সাংবাদিক তাঁর উচ্চশিক্ষা, সৌজন্যবোধ, সংস্কৃতি চেতনা সব কিছুর সমন্বয়ে তিনি নজর টানেনতিনি আমার উপর এতটাই যত্নশীল, মনে হয় যেন আমার নিজের দাদা আমার সমস্ত দায়িত্ব নিতে চাইছেনকিন্তু তারও সীমাবদ্ধতা আছে। আবার সেদিন যে নতুন এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ হল তিনিও শিক্ষক কাম সাংবাদিক। তিনিও উচ্চ শিক্ষিত এবং সংস্কৃতি সম্পন্ন। পারিবারিক আভিজাত্যের মানদণ্ডের বাইরে তিনি থাকেন না।
নবমীর সন্ধ্যেয় পেলাম আমার গত পনের বছরের অকথিত, অগ্রন্থিত স্থানীয় অভিভাবককে যে আমার ভাই কাম বন্ধু ছিল। কখন যেন পারিবারিক বন্ধু হয়ে গেছে। সমস্ত ভয়, দ্বিধা, সঙ্কোচ সব কিছুকে উপেক্ষা করে সেই বন্ধু সেদিন এল। একটা হুইস্কির পাঁইট হাতে। আমরা বৈঠকি আড্ডায় বসার সঙ্গে সঙ্গে নামল মুষলধারায় বৃষ্টি। উমা বাপের বাড়ি এসেছেন একথা সেদিন ইন্দ্র ভুলে গেল। অথবা গাঁজা খোর শিবকে জানান দিল তুমি একা ‘ জাতে মাতাল তালে ঠিক, নও’ বাবা। আমরাও নূপূর বাজাতে জানি। চল বৃষ্টিতে নন্দন যাইস্মৃতির নৌকো ভাসাই বলে আমিও গুলাম আলি চালিয়ে সন্ধ্যে মজলিসে বসে পড়লাম। তৃতীয়া আর নবমী হ্রদয়ে আল্পনা এঁকে দিয়ে গেল। আমার বন্ধন মুক্তি হল। কত কত বছর পর আমাকে সমাজ বলল তুমি মুক্ত তুমি সুরা দিয়ে স্নান কর। তুমি ফুলের পাঁপড়ির সুগন্ধ মেখে ঘুমিয়ে পড়। সমাজ তোমাকে চিনতে চাইছে। এখনও তোমার বন্ধু আছে। ভালো বন্ধু আছে। সুবন্ধু আছে। তুমি জীবনে ফিরে এসো। ফিরে এসো চাকা। সমাজে ফিরে এসো। পাখিরা ডাকছে। ভ্রমর ডাকছে। কাঠি পোকা আত্মরক্ষা শিখিয়ে দিল সেদিন। তোমার হুতোম ডাকছে। ফিরে এসো ফিরে এসো চাকা।
এবছর নজর করে দেখলে উপলব্ধী করা যায়, বাংলা সংবাদ মাধ্যম তুলনামুলকভাবে অন্যান্য বারের তুলনায় এবছর শারদ উৎসবকে অনেক অনেক ব্যপ্তিতে দেখেছে। মা দুর্গার ভাসান এবং মহরম পিঠোপিঠি থাকার কারণে রাজ্য প্রশাসন অনেক সতর্ক ছিল। কিন্তু এগিয়ে এলেন সব সম্প্রদায়ের মানুষ। হাতে হাত মিলিয়ে পুরনো আটচালার বাংলায় আমাদের নিয়ে গেলেন। ‘বাংলা আমরা মা, বাংলা আমার অহংকার’ এই বার্তা আবার আমাদের মনে করিয়ে দিল।
শ্রীক্ষিতিমোহন সেন আজ থেকে সত্তরবছর আগে ‘ভারতে ধর্মের উদারতা’ নামক এক প্রবন্ধে লিখছেন, ‘’.........এই মহাপুরুষ রজ্জবজী ছিলেন দাদুর শিষ্য। জয়পুরের কাছেই তাঁদের স্থান। জয়পুর তিন শতাধিক পূর্বে তাঁদের চরণপাতে পবিত্র হয়েছে।
রজ্জবের গুরু ছিলেন দাদু তাঁরও গুরু পরম্পরায় আদি গুরু কবীর। তাঁরই বাণীতে দেখি যখন সব সঙ্কীর্ণমনা লোকেরা হিন্দু-মুসলমানের ভেদই দেখছিল তখন তিনি বললেন, ‘রাম কহিয়া মরে হিন্দু, খোদা কহিয়া মরে মুসলমান।’ কবীর বলেন, ‘সেইতো জীবন্ত যে এই দুই কোটি(Extreme)- তে না প্রবেশ করে’ (কবীর E Nagari Procharini নাগরী প্রচারিণী Editor Madhi Anga7) কবীর আরও বললেন, ‘আমি পূজাও করি না নামাজও করি না, হ্রদয়ের মধ্যে এক নিরাকার দেবতাকে নমস্কার করি। (pada 338) ‘যেখানে ভক্তি সেখানে ভেখ নাই সেখানে দলাদলি ও সম্প্রদায় বিচার নাই।’ (দেশ ৭ ডিসেম্বর ১৯৪৬)                                  
কেউ বলছে বিশ্বায়ন সংস্কৃতির প্রভাবে দেহ-নট আজ অন্য কিছু চায় অন্য কথা বলে। শরতের মেঘের মতই কাব্যিক আজকের চেনা মুখ। অচেনা মুখোশ। যখন মুখ কথা বলে অনেকে চিনতে চায়না। কিন্তু মুখোশ কথা বললে সকলে আপ্যায়ন করে। এমনই সাগরের ঢেউয়ের মত প্রভাব তার। এই প্রভাবের কারণে সামনের সপ্তাহ থেকে বারোয়ারী পুজো কমিটিগুলির বিভিন্ন কর্মকর্তা ব্যস্ত হয়ে পড়বে। আগামী বছরের প্যান্ডেলের থিম কি হবে? কোন শিল্পী কাজ করবে? ইত্যাদি সব। এর সঙ্গে আপনাদের বিরধীতা আছে? থাকবেই বা কেন? এসব খবর আমরা জানতেও পারিনা। আপনারা জানতেও চান না। বাঙালির পুজোকে কেন্দ্র করে গ্রাম বাংলার শিল্পীরা যদি এক বছরের জন্য কাজ পায় সেটাই বা কম কিসের?         

No comments:

Post a Comment