Saturday 1 October 2016

আদি কংগ্রেস বনাম বাংলা কংগ্রেস

আদি কংগ্রেস বনাম বাংলা কংগ্রেস

লড়াইটা কতদিনের? সেই ষাটের দশক থেকে সম্ভবত শুরু। অজয় মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে। এই কথা ভাবতে ভাবতে এদিন বিধান সভার দক্ষিণ দিকের প্রধান ফটক টপকে আসছিলাম। কত স্মৃতি এই বিধানসভার মেহগনি কাঠের ভারী ভারী আসবাবে, প্রাচীন গাছের শিকড়ে শিকড়ে। বিভিন্ন সভাকক্ষের অর্ধবৃত্ত ডেস্কের কোনায় কোনায়। বার্নিশ করা অভিজাত ডেস্কে আজও পুরনো চায়ের দাগ লেগে রয়েছে। কোনও দামি কাঠের চেয়ারের হাতলে পোড়া সিগারেটের ছেঁকা। কয়েক দশকের বাধ্য অবাধ্য দলীয় নেতাদের সংসদীয় অসংসদীয় সুচতুর বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ। বিধানসভার সদর ঘরে অবাধ্য সূর্যের আলো, বিদ্যুতের আলোর থেকেও জোড়াল শক্তিতে জানান দেয় ‘সত্য মেব জয়তে’ এর শক্তি। ভারত নামক একটি শিশু গণতন্ত্রের কিশলয় রচনার টানাপড়েন। এই কথা ভাবতে ভাবতে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে শরতের আগমনী শুনতে পাচ্ছি। ঘন সবুজ ধুলটে প্রাচীন গাছের পাতাগুলো শরতের শিশির সিক্ত অভিভাবকের ভাষায় কিছু বলতে চাইছে। কোথাও মাকড়সার ভাঙ্গা সংসার। পুরনো আঠাযুক্ত জালে ছোট কোনও এক পাখির পালক ঝুলছে। বিধানসভার অধিবেশন না থাকলে কি হবে। পাখিদের কলরব ভাবতে বাধ্য করছে। ‘পাখিদের ওই পাঠশালাতে কোকিল গুরু শেখায় গান/ ময়না ভালো গান শিখেছে, শুনলে পড়ে জুড়ায় প্রাণ।’  যেমন ভাবা ঠিক তেমনি এসে হাজির। একটা গাছে বসে আছে হুতোম। আমাকে দেখেই বলল, ‘’বামফ্রন্টের মানসপুত্র আদি কংগ্রেসে ফিরে এল।‘’
বললাম, ‘আদি কংগ্রেস কেন হবে? ওটা তৃণমূল কংগ্রেস।‘
হুতোম আবার বলল,  ‘’এটিম, বিটিম, বাংলাটিম, সিটিম, কত কংগ্রেস আছে তোদের বাঙলায়?’’
বললাম, ‘এসব কথার কথাদল নতুন হোক পুরনো হোক। দল থাকলেই নেতা আসবে, নেত্রী আসবে। তারা সংসদীয় রীতি নীতি মেনেই আসে।‘’
আজ হুতোম একটু রেগেই আছে। উত্তর দিল ব্যঙ্গাত্বকভাবে। ‘’ন্যাতাদের কথা বলছিস। উপ-নেতাদের কথা কেন বলছিস না? ভাগের বাবা গঙ্গা পায়। অনেকেই জানে না। চল শুভনাম ধরে ডাকি। ‘জয় বাবা গঙ্গাবাবার জয়। জয় বাবা বাংলাবাবার জয়‘’
আমার খুব খারাপ লাগল। বললাম, ‘এ আবার কি? গঙ্গাবাবা বলছ কেন? আমরা ভারতীয়রা ‘মা গঙ্গা’ বলে জানি। বাংলাবাবা আবার কে?’
হুতোম আরও চরমে উত্তর দিল, ‘’এই পুণ্য বাড়িতে বাংলার খ্যাতনামা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিরা এসেছেন। আমার বাংলার জন্য কত উন্নয়ন করেছেন। আর দু’চারজন স্বঘোষিত ‘বাংলাবাবা’ নাক উঁচু করে ‘বাবু উপত্যকায়’ বসে ‘তথাস্তু’ বচন নিয়ে স্মিত হাস্যে উঁকি মেরে চলে যায়। কবি শক্তি যখন বাংলা মদ খায় তখন তোরা আপত্তি করিস না। ওই গড়িবের বন্ধু। সিনেমার গল্প করে যে বাংলার দুঃখ কষ্ট বলত। সেই ঋত্বিক বাংলা খেলে তোদের কত আদিখ্যেতা। আর আমি ‘বাংলাবাবা’ বললে আপত্তি? আমাদের জাতের হাঁসকে যেমন কেউ ভুলতে পারে না,  তোদের তেমনি আছে ইতিহাস। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা। বেশি কথা বলব না। চিৎ হয়ে শুয়ে থুথু ফেল্লে নিজের গায়ে পড়ে।  জিরো আওয়ারে অধ্যক্ষ আমাকে সময় দিয়েছেন প্রশ্ন তোলার। যারা দল বদল করলেন, ওঁদের নিয়ে প্রশ্ন তোলার। আমি এখন চল্লাম।‘’ 
মানসবাবু আপনি ‘বার ভুঁইয়া’র এক ভুঁইয়া। বাংলা কংগ্রেস থেকে ‘আদি কংগ্রেস’ তথা আসল কংগ্রেসে(আপনার দাবি মত) ফিরলেন প্রদেশ কংগ্রেসের আপনার বারজন অনুগামীকে নিয়ে। তৃণমূলের মহাসাচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘’ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এলো।‘’ বিতর্ক জারী থাকুক কারণ আপনি আরও বলেছেন, ‘’রাজনীতি নদীর স্রোতের মতো! সোজা পথে আর চলে কোথায়!’’ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গীয় রাজনীতির বাস্তবতায় মানসবাবু আপনি যখন আকাশের দিকে মুখ তুলে আপনার শ্রদ্ধেয় পিতৃদেবকে উদ্দেশ্য করে টিভি ক্যামেরার সামনে আপনার বক্তব্য শুরু করলেন, টিভির দক্ষ ক্যামেরা পার্সন দক্ষহাতে ক্যামেরা প্যান করে আপনার ক্লান্ত মুখটা ধরল। আমরা দেখলাম আপনার ৪৬ বছরের ‘বাংলা কংগ্রেস’ নয় আদি কংগ্রেস রাজনীতি করার অভিঞ্জ মুখটা। যন্ত্রণাদীর্ণ, ক্লান্ত, শ্রান্ত মুখটা। মুখের ম্লান হাসিটা দক্ষ নেতার মতই লুকতে চেষ্টা করলেন। সম্ভবত পারলেন না। আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার মেধাকে কুর্ণিশ জানাই। আমার মত একজন শ্রমজীবী সাংবাদিকের ডেস্ক থেকে। কেন জানেন? আপনি প্রথম কংগ্রেস ঘরানার এক প্রথম সারির নেতা যিনি কংগ্রেস দল ছাড়লেন, আলাদা কোনও দল বা মঞ্চ গঠন না করে। সত্তর দশক থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যেসব শীর্ষ নেতা প্রদেশ কংগ্রেস বা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ছেড়েছেন তারা হয় আলাদা দল গঠন করেছিলেন অথবা সাময়িক গোষ্ঠী গঠন করে রাজনীতিতে স্বতন্ত্র ঘরানা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। একবাক্যে বলা যায় প্রায় সবাই ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যতিক্রম একমাত্র তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
 উত্তর বিহারে একটা কথা খুব প্রচলিত আছে। সেটা হচ্ছে, ‘’রোম পোপ কা। মাধে পুরা গোপকা’’। এই অধিকার কখন তৈরি হয় আমরা জানি। সবটা ঘরানা। কিছুদিন আগে উচ্চশিক্ষিত এক প্রবীণ সাংবাদিক প্রেস ক্লাবে বলছিলেন, ‘’বাংলা কংগ্রেস থেকে যারা এক সময় আদি কংগ্রেসে এসেছিলেন তাঁদের কেউ কেউ কংগ্রেসের আদি ঘরানা ভেঙ্গে ফেলতে চেয়েছেনদলকে এই শতাব্দীর দাবিতে আধুনিক করে নেওয়াটা ভুল নয়। কিন্তু কোনও শকুনি মামার কাছে যদি কূটনীতি শিখতে হয় তাহলে সেই নৃপতি ‘শাহ থেকে ফকির’ হতে বাধ্য।‘’ এই সূত্রে পুনরায় উচ্চারণ করি ‘রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়/ উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।      
প্রাসঙ্গিক হবে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃঢ়তার তুলনা করা। কারণ এটা তখনই সম্ভব যখন দলগতভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে। ২০১৬ সালের জনাদেশ সেই রায় তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্ভবত দিয়েছে। ইতিহাসবিদদের পর্যবেক্ষণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ভারত নামক একটি রাষ্ট্রে জওহরলাল নেহরুর ক্ষমতা ছিল অপ্রতিহতইতিহাসবিদ তপন রায় চৌধুরীর ভাষায় ‘’ওঁর একছত্র ক্ষমতাকে কেউ কেউ ম্যান্ডেটরি ডিক্টেটরশিপ বলে বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ নির্বাচনের মারফৎ জনগণ ওঁর হাতে অপ্রতিহত ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন। ১৯৬২ সালের ভারত-চিন যুদ্ধের সময় অবধি ওকে বাঁধা দেওয়ার শক্তি কারও ছিল না‘’ প্রায় সকলেই একমত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রক্তে কংগ্রেসের ‘ডিএনএ’ রয়েছে। তাই ১৯৯৮ সালে তিনি যখন অজিত পাঁজা, পঙ্কজ বন্দ্যোপাধ্যায়, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় সহ একঝাক কংগ্রেস শীর্ষ নেতাকে নিয়ে কংগ্রেস দল ছাড়লেন তখনই ভাগ্যের লিখন ঠিক হয়ে গিয়েছিল বাংলার নতুন এক গাঁধিবাদী নেত্রীর। গাঁধির আলোচকরা বলছেন, ‘’গান্ধীমতে, ব্যক্তির ভূমিকা সংগঠনের চেয়েও বড়। সমাজতন্ত্রবাদে ব্যক্তির ভূমিকা খুবই সামান্য, সাধারণ গণতন্ত্রে ব্যক্তির কেবল একটা ভোটই আছে লড়বার পক্ষে। আর কিছু নেই। কিন্তু গান্ধীর স্বপ্নের ভারতে অথবা বিশ্বে, ব্যক্তির ভূমিকা কখনই কমে না। সাধারণত ব্যক্তিরা প্রায়ই খুব সুবিধাবাদী, যদি পারে তারা রাষ্ট্রের উপর, দলের উপর  নির্ভর হয়ে নিজ নিজ দায় দায়িত্ব থেকে মুক্ত হতে চান।‘’                           
১৯৯৮ সাল থেকে সাময়িকভাবে সারাদেশে আর্থ-সামাজিকভাবে যে টালমাটাল পরিস্থিতির উদবভব হয়, পশ্চিমবঙ্গও তাঁর থেকে বাদ যায়নি। সেই সময়কাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত আমাদের রাজ্যে নব্য পুঁজিপতি এবং পেটি বুর্জোয়াদের দাপট আমরা দেখেছি। রাজ্যে তথা আমাদের দেশে সরকারি পুঁজি এবং বৃহৎ পুঁজির অভাবে মুৎসুদ্দি পুঁজির দাপটে সুস্থ সামাজিক ভারসাম্যটাই ভেঙ্গে পড়েছিল। কারণ ওইসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগুলি হঠাৎ করে বড়লোক হয়ে ওঠে। এইসব সাধারন পুঁজিপতিরা ‘শিল্প (Industry)’ থেকে উদ্বৃত্ত পুঁজির মালিক কেউ নন। অথবা ধ্রুপদী ঘরানার কৃষক বাড়ির অর্থেও নতুন ‘শিল্প’ (Industry) গড়ে তোলেননি। তাই এঁদের যারা গড়ে তুললেন তাঁরা সামন্ত্রতন্ত্রের অবশেষ ভাঙ্গতে পারেননি। হয়ত সেই কারণে ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ স্লোগানেই আটকে থাকল। এবং এই কারণেই সম্ভবত আমাদের রাজ্যে ২০০৯ থেকে ২০১৩ এক অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিলসামাজিক ঔদ্ধত্যের ‘ব্যক্তি ঝোঁক’টাই যেন বাংলার সামাজিক সংস্কৃতি হয়ে গেছিল।
এইসব নব্য উচ্চশিক্ষিত ধনিক শ্রেনীর ব্যক্তিদের তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরোগ্য নিকেতন’, ‘হাসুলি বাঁকের উপকথা’ এবং আশাপূরণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রতি’ পড়ার জন্য পরামর্শ দিতে পারেন তাঁদের সামাজিক কারিগরেরা এবং সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘জলসা ঘর’ ছবি দেখার কথাও বলতে পারেন তাঁরা। সামন্ত্র সংস্কৃতি থেকে শিল্পায়ন সংস্কৃতির ঘরানা চিনতে সাহায্য করতে পারে। প্রখ্যাত চিনা সাহিত্যিক লু শুনের ভাষায় ‘ওলড টেলস রিটোল্ড’।          
ভারসাম্যহীন সময়টাকে আগাম আঁচ করে কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রথম সারির অভিজাত বাংলা পাক্ষিক পত্রিকা একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে। ২০০৫ সালের ৩০ জানুয়ারি। বিষয় ছিল খুব সম্ভবত ‘’ ‘নির্বিরোধী’ এ রাজ্যে গণতন্ত্রের অন্তর্জলি’’? বক্তা ছিলেন সিপিএমের সাংসদ কমরেড মহম্মদ সেলিম, তৃণমূলের প্রাক্তণ সাংসদ কৃষ্ণা বসু, কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী, সাংবাদিক সুমিত মিত্র, অধ্যাপক সুনন্দ সান্যাল এবং সঞ্চালক ছিলেন অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য। আমি ব্যক্তিগতভাবে সেই সভায় উপস্থিত ছিলাম একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার সাংবাদিক হিসাবে। গোপনে দূত মারফৎ আমাকে আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়েছিলেন কমরেড অনিল বিশ্বাস। নোটবুকে রয়েছে, সঞ্চালক অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য আলোচনার শুরুতেই মনে করিয়ে দিলেন, পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্র মুমূর্ষু, বিরোধীশুন্য। কমরেড সেলিম প্রথম বক্তা হিসাবে একথা মেনে নিয়ে বললেন, ‘’এই রাজ্যে বিরোধী রাজনীতির সুবর্ণ সুযোগ আছে। কিন্তু এখানকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো অন্তঃসারশূন্য। ফলে রাজনীতির নামে তাঁরা যা করে তা নিজেদেরই বিরোধিতা। নেতৃত্বের প্রতি বিরোধিতা। দলের প্রতি বিরধীতা। অথচ সরকারের বিরোধিতা করার যে সুস্থ-রাজনীতি, তার থেকে এঁরা অনেক দূরে দাঁড়িয়ে আছেন। বহুমাত্রিক বিরোধিতা করার সুযোগ থাকা সত্বেও, গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিরোধিতা করার লোকের অভাব এখানে ভীষণ প্রকট।‘’ এরপর কমরেড সেলিম টার্গেট করেন কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীকে। তিনি বলেন, ‘অস্ত্র দিয়ে হোক, অস্ত্র সংবরণ করে হোক অধীরবাবু জেলা পরিষদ দখল করেছেন।‘’
বামফ্রন্টের সন্ত্রাসের প্রসঙ্গ টেনে সেদিন কংগ্রেসের সাংসদ অধীর চৌধুরী বলেছিলেন, ‘’পুলিশ ও প্রশাসন দলের অঙ্গুলিহেলনে কীভাবে ভোট করতে দেয় না তা আমি নিজের জীবন দিয়ে দেখেছি। ভোট এখন প্রহসন। তা না হলে পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিশ হাজার আসনে তারা জেতে কী ভাবে? নির্বাচনে যদি বিরোধীদের অংশ নিতেই না দেওয়া হয় তো গণতন্ত্রের অন্তর্জলি হবেই।‘’
তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসু বিরোধী রাজনীতির জন্য স্পেস চেয়ে সেদিন আবেদন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘’বামফ্রন্ট আমলে রাজ্যের মানুষ হয়ত স্টেবিলিটি পেয়েছেন, কিন্তু স্টেগনেশনের বদ্ধ জলায় আবদ্ধ হয়েছে তাঁদের ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ। আমাদের সুযোগ দিন। আমরাও কাজ করে দেখাতে পারি।‘’
সেদিনের প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসুর আবেদন সম্ভবত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর কানে পৌঁছেছিল। সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো কারখানাকে কেন্দ্র করে সরকার পক্ষ এবং বিরোধী পক্ষের মধ্যে যে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছিল সেই বিতর্কিত পরিসর ভাঙ্গতে চেয়েছিলেন তৎকালীন ভারতীয় কমিউনিস্টদের পিতামহ ভীস্ম জ্যোতি বসু। নিজের বাড়ি ‘ইন্দিরা ভবনে’ বিরোধী দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বৈঠক করে সমাধান সূত্র বের করেছিলেন। পরে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনও করেন। সেই সম্মেলনে আমি নিজেও ‘কলকাতা টিভি’ এর সাংবাদিক হিসাবে হাজির ছিলাম। আমার একসময়ের সহকর্মী ‘জি নিউজ’এর সাংবাদিক চয়ন কুণ্ডু আমাকে বলেছিল, দীপেন্দুদা আপনি, আমি, আমরা আজ এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সঙ্গে জড়িয়ে গেলাম। চয়ন আমাকে আপনি বলেই কথা বলত।
এটাও বাস্তব সত্য ১৯৯৮ সালের পর তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আর রাজ্যপাটে মন বসছিল না। তিনি তখন দীর্ঘ যাত্রাপথে ক্লান্ত, অবসন্ন এক নেতা। তাই অত্যন্ত দূরদৃষ্টি থেকে বামফ্রন্টের তথা নিজের দলের সংসদীয় নেতা মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ঠিক করে গিয়েছিলেন। সাহায্য পেয়েছিলেন তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক কমরেড অনিল বিশ্বাসের। পাশাপাশি ডাঃ বিধান রায়ের মতই বিরোধী দলনেত্রীর প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছিলেন। যদি কখনও তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে রাজ্যপাট সামলাবেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে জ্যোতিবাবুর সাফল্য এবং ব্যর্থতা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু একথা মানতেই হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারটা কোনও একদিনের জন্য ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ নয়। যে কথা তৃণমূল কংগ্রেসের নীতি-নিরধারণ কমিটির সভায় তৃণমূল নেত্রী তাঁর দলের শীর্ষ নেতাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘’কেউ ঔদ্ধত্য দেখাবেন না। দল এটা মেনে নেবে না। সতর্ক করার পরেও যদি কেউ এমনটা করেন পরেরবার টিকিট পেতে অসুবিধা হবে। কেউ ‘মানবতা’ ভুলে যাবেন না।‘’
মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ার হোক অথবা সিপিএম সহ বামফ্রন্টের অন্যান্য দলের রাজ্য সম্পাদকের চেয়ার। দল এবং সমাজের দায়িত্ব নিতে পারবেন এমন নেতাকেই বাছা হয়ে থাকে। সম্প্রতি যেমনটা হয়েছে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্রের ক্ষেত্রে।  
তৃণমূলের প্রসঙ্গ ছিল মানস ভুঁইয়ার দল বদলের। তাঁর নিজের ভাষায় ‘দলবদলু’। কেউ কেউ টিভির ‘টকশোতে’ প্রশ্ন তুলছেন বামফ্রন্ট জামানায় ‘দলবদলু’র সংস্কৃতি ছিল না। উত্তর আসছে বামফ্রন্ট তথা সিপিএমের পরিশীলিত এজেন্ডা ছিল বিরোধীদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সিপিএমের ‘বামফ্রন্ট’ গঠনের সিদ্ধান্তই ছিল যুগান্তকারী। পাশাপাশি বিরোধী দলের নেতাদের সাদা পাঞ্জাবীর দলে টেনে নিতেও ছিল সিপিএমের ব্যতিক্রমী পারদর্শিতা। এই কারণে এই রাজ্যের সংবাদ মাধ্যমের শব্দ ভান্ডারে যুক্ত হয়েছে ‘তরমুজ’ নামক শব্দ। নির্দিষ্ট এককের জন্য নয়। বামফ্রন্টের জামানায় এই ধরণের শব্দ বিরোধী দলের অনেকের জন্যই বরাদ্দ ছিল।  বর্তমান সময়ে মসৃণ বুদ্ধিদীপ্ত রাজনীতির উচ্চারণ সম্ভবত নেই। তাই ‘দলবদলু’র মত পরিবেশ মেনে নিতে হচ্ছে। আইনের ফাঁকফোকর খুঁজে নিতে অসুবিধা হচ্ছেনা সরকারি দলের। ১৯৮৫ সালে ভারতীয় সংসদ আমাদের দলত্যাগ বিরোধী আইন উপহার দিয়েছিল। ৩১ বছর পর উপলব্ধি হচ্ছে সেই আইন নিস্তরঙ্গ নয়। পুরসভা, পঞ্চায়েতর ক্ষেত্রে এই আইনের কোনও ভূমিকা নেই বলেই আইন বিশেষঞ্জরা বলছেন। সম্ভবত সেই ফাঁকফোকরকে কাজে লাগাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস দলের ডাকসাইটে নেতারা। যেটা সম্ভবত পপুলার রাজনীতির ভাষায় ‘বদলা’ নয় ‘বদল’ বলছেন তাঁরাএই পরিভাষাই শেষ কথা নয়। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, কংগ্রেসের তিনজন এবং বামফ্রন্টের একজন এ পর্যন্ত তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। তাঁদের বিধায়ক পদ খারিজের আবেদন অধ্যক্ষের বিবেচনার জন্য পড়ে রয়েছে। যে হেতু বামফ্রন্টের গায়ে আঁচড় পড়েছে তাই নতুন কিছু আশা করা যায়। ভারতীয় গণতন্ত্রে জাতীয় কংগ্রেসও নতুন ভাষার অভিধান আমাদের ধারাবাহিকভাবে অনুমোদন করেছে। সূত্রের খবর রাজ্য কংগ্রেসের পরিষদিয় দলনেতা আব্দুল মান্নান দিল্লি গিয়েছিলেন। শীর্ষ আদালতে দলত্যাগ-বিরোধী আইনের কার্যকারিতা বাড়ানোর আর্জি জানিয়ে একটি মামলা করার জন্য। সংবাদ সংস্থার খবর সুপ্রিম কোর্টে আরও একটি মামলা হতে পারে। যেটা সম্ভবত হবে জনস্বার্থের মামলা। সেই মামালার আবেদনে জানতে চাওয়া হবে কোনও দলের নির্বাচিত বিধায়ক দল বদল করলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণার দায়ে কেন তার বিধায়ক পদ খারিজ হবে না? বিষয়টি সময় সাপেক্ষ বিষয়। আমরা অপেক্ষায় থাকব উন্নত গণতন্ত্রের পদচারণের জন্য।   
রাজনীতি সম্ভবনার শিল্প হিসাবে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে একটা নির্বাচনী স্লোগান বিজেপি বাজারে এনেছিল ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’। সেটা কি আদৌ সম্ভব? তেমনি বর্তমানে কেউ যদি ‘কংগ্রেস মুক্ত বাংলা’ ভাবেন এটাও কি সম্ভব? অথবা বাংলা তথা ভারতে সিপিএম তথা বামপন্থীদের কোনও স্থান নেই ভেবে নেওয়া হয়। এই ভাবনাকে  অনুমোদন করা আদৌ সম্ভব নয়। আমাদের মত নিরপেক্ষ তথা ধর্ম নিরপেক্ষ সাংবাদিক, লেখক, সমাজকর্মীদের ভাষায় গণতন্ত্রের সহজ পাঠ আছে বলেই পশ্চিমবঙ্গে ‘বিজেপি’ এবছরের বিধানসভা ভোটে তিনটে আসন পেয়েছেভারতীয় গণতান্ত্রিক দল বলেই বিজেপি তার দলের কর্মসূচি সংসদীয় গণতন্ত্রের সভ্যতা মেনেই প্রসারিত করবে। এমনটা আমরা আশা করতেই পারি। যে সব লেখকদের কব্জিতে নিরপেক্ষ এবং গণতন্ত্রের ধাগা বাঁধা আছে তাঁরাই একথা বলতে পারে। কারণ তাঁরা কব্জির জোরে খায়।
এই সূত্রে আমরা মনে করতে পারি জওহরলাল নেহরুর চিন্তা, কাজ সবকিছুকে এক কথায় নাকচ করে দেওয়ার চেষ্টা। সেই প্রসঙ্গকে সামনে রেখে ২৬ অগস্ট, ২০১৬ তারিখে দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, ‘’নেহরুকে ‘জেন্টল কলোসাস’ আখ্যা কোনও মোসাহেব দেননাই, দিয়াছিলেন এক বিরোধী বামপন্থী নেতা, হীরেন মুখোপাধ্যায়।‘’.........সম্পাদকীয়র প্রথম স্তম্ভে লেখা হয়েছে, ‘’আরও এক প্রধানমন্ত্রী বর্তমানের নিকট কৃতঞ্জতা দাবি করিতে পারেন। তাঁহার চিন্তা ও চেষ্টায় অনেক ভুল ভ্রান্তি ছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু একবিংশ শতকের বিশ্ব অর্থনীতির চেহারা কী হইবে, এবং সেই মঞ্চে নিজের আসন করিয়া লইতে হইলে ভারতকে কোন পথে হাঁটিতে হইবে, তাহা দেখিবার একটি উদ্যোগ তিনি করিয়াছিলেন। রাজনীতিতে ‘বহিরাগত’ ছিলেন বলিয়াই হয়তো আর এক বহিরাগত স্যাম পিত্রোদার হাতে টেলিকম বিপ্লবের গুরুদায়িত্ব সঁপিয়া দিতে পারিয়াছিলেন। যে তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিকমিউনিকেশনের জোড়া ঘোড়া ভারতীয় অর্থনীতির রথ টানিয়া লইয়া যাইতেছে, উভয়ের পিছনেই রাজীব গাঁধির ভূমিকা অনস্বীকার্য, তাঁহার এই অবদানের উল্লেখ হয় না বলিলেই চলে। কংগ্রেসও এই রাজীবকে ভুলিয়াছে।‘’ 
আমরা গ্রীক নাটকের দর্শনের কথা মনে রাখতে পারি। গ্রীক নাটকের লক্ষণীয় দিক হল, যুদ্ধে সব নায়ক হেরে যায়। কিন্তু হেরে যাওয়া পর্যন্ত সে লড়াই থেকে পিছিয়ে আসে না। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক একটি ঘটনায় ভারতীয় গণতন্ত্রের সর্বদলীয় ঐকতান আমদের সেই সত্যের সামনে এনে দাঁড় করিয়ে  দিল।                                  

No comments:

Post a Comment