Wednesday 6 April 2016

আধুনিক শহর - আধুনিক সভ্যতা

‘কারো কেউ নইগো আমি/ কেউ আমার নয়।/ কোন নাম নেইকো আমার/ শোন মহাশয়।’ ‘লালকুঠি’ বাংলা ছবিতে  কিশোর কুমারের এই গানটা আমার এক বন্ধুর আট’বছরের মেয়ে আমাদের বাড়িতে আসলেই গুন গুন করে গায়। ওর কাছে জানতে চাইলে বলে, ‘জানো এই গানটা আমাদের স্কুলের গাছের তলায় বসে একটা অনাথ ছেলে দিদিমনিদের শোনায়।
আমরা জানতে চেয়েছিলাম ‘তুমি গানটা গাইছ কেন?’
উত্তর দিয়েছিল, ‘গানটা এখন শুনতে ভালো লাগছে। পরে ভালো নাও লাগতে পারে। তখন গাইব না।’
উত্তরটা সম্ভবত ঠিকই দিয়েছে। মানুষের যখন যেটা ভালো লাগে সেটাই গণতন্ত্র। সেটা প্রাতিষ্ঠানিক হোক বা সামাজিক। আমাদের রাজযেও কিছুদিন হল চোখে পড়ার মত দৃশ্যমান কয়েকটি ঘটনা নজর কাড়ছে। এটাকে এতদিন তথাকথিত কিছু উচ্চকিত সমাজ প্রভু ‘গণতন্ত্র’ বলে চালিয়েছে। ইতিহাস ঘেটে ইতিহাসবিদরা অনেক আগেই ‘সামাজিক সেতু’ নিরমাণ করে আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় বারহ্মণ- ক্ষত্রিয়রা একতরফা সামাজিক সংস্কৃতির নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেইসব দিনে ‘অন্ত্যজ’, দলিত, নিম্ন বর্ণের মানুষরা উচ্চ বর্ণের সমাজের কাছে কখনও কখনও স্থায়ী ভিত্তিতে কয়েক প্রজন্ম ‘সেবায়ত’ থাকতে বাধ্য হয়েছেন। কখনও নিম্ন বর্ণের প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষেরা ‘সমাজ প্রভুদের’ হুকুমে বাড়ির মেয়েদের ‘দাসী’ হিসাবে বা ‘সেবাদাসী’ শর্তে ধর্মের দোহাই মেনে নিয়েছেন। সামন্ত্র প্রভুদের এমনতর দাপটের ‘সংস্কৃতি’র উপর গোছা গোছা ‘থিসিস’, বই, গল্প, উপন্যাস, কবিতা লেখা হয়েছে। অনেকেই সিনেমা বানিয়েছেন। নাটক লিখেছেন। সেই নাটক মঞ্চস্থ করেছেন।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে আমাদের দেশে ‘গণতন্ত্রের’ আলো চুইয়ে হলেও কিছুটা এ ঘর সে ঘরের দাওয়ায় আসতে শুরু করে। ঘাম-রক্তের মাখা মাখিতে আমরা পাই। রাজনৈতিক এবং সামাজিক আন্দোলনের কারণে দেশ ‘বিপ্লব’ না পাক, ‘সামাজিক স্বীকৃতি’ আদায় করতে সক্ষম হলেন দলিত আন্দোলনের নেতৃত্ব। শুরু হল প্রতিশোধের রাজনীতি। কোনটা ঠিক কোনটা ভুল সে সব নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকবে। কিন্তু নিম্ন বর্ণের দলিত শ্রেণীর কিছু নেতৃত্ব বিভিন্ন সময়ে গরীব দুর্বল ‘ব্রাহ্মণ পরিবার’ এবং ‘ক্ষত্রিয় পরিবার’কে আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে বেছে নিয়েছিল। প্রয়োজনে এইসব নেতৃত্ব নিজেদের প্রশিক্ষিত পুরুষ অথবা মহিলা বাহিনী দিয়ে ‘ব্ল্যাকমেল’ করে সামাজিক প্রতিশোধ নিয়েছে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে এই ধরণের রাজনীতির প্রকোপ বহুল প্রচলিত ছিল। তার অন্যতম কারণ ছিল ‘সামন্ত্রতান্ত্রিক বাংলাকে’ ‘নয়া গণতান্ত্রিক’ বাংলা হিসাবে গড়ে তোলা। সংসদীয় গণতন্ত্রের দায়বদ্ধতা এবং সীমাবদ্ধতা অনুসরণ করেই ‘প্রান্তিক’ মানুষের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে নকশাল বাড়ি আন্দোলনের এক শীর্ষ স্থানীয় ব্রাহ্মণ নেতা আমাকে বিষয়টা বলেছিলেন। উল্লেখ করেছিলেন গরীব ব্রাহ্মণদের সামাজিক মান কতটা পড়ে গেছে সেই বিষয়টি। তথাকথিত দলিত শ্রেণীর  অর্জিত ক্ষমতার কতটা ব্যবহার হয়েছে আর কতটা অপব্যবহার হয়েছে এই সবের বিচার ইতিহাসবেত্তারা করছেন। আমাদের বিষয় ‘আধুনিক শহর আধুনিক সভ্যতা’। এই রাজ্যেও বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে একটি ‘চুক্তি’ কিছু অপ্রয়োজনীয় দর্শনের হাত ধরে ‘সব কিছু পেতে পারি’র রাজ্যে নিয়ে যেতে চায়দেশের রাজধানী ‘হস্তিনাপুরে’ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের সঙ্গে একটি ‘আর্থসামাজিক’ চুক্তি করে একটি বেসরকারি সংস্থা। ‘আরব্য রজনীর’ গল্প কথার উপাখ্যানের যাত্রাপথ মসৃণ হয়ে যায়। শহর কলকাতার তথা এই বাংলার ‘বৈধ-অবৈধ’ সেতু গড়ে ওঠে। সেই সেতু আগেই ভেঙ্গে পড়েছে। ২০১৩ সালে চুক্তি বাতিল হলে তথাকথিত ‘তুঘলকি সংস্কৃতির’ শেষ অধ্যায় আমাদের দেখতে হচ্ছে হয়ত বা। ‘সেতু’ নির্মাণ ভারতীয় একটি মহাকাব্যেও পাই। সেখানে ‘কাঠবিড়ালি’র মত ছোট্ট একটি প্রাণীরও ভূমিকা আমরা জানতে পারি। ‘শুভ শক্তি’ ‘অশুভ শক্তি’র লড়াইয়ে কাঠবিড়ালি তার মত করে শুভ শক্তিকে সাহায্য করে।
আধুনিক সভ্যতায় জনবস্তির এবং জনবসতির ঘনত্ব এতটাই বেড়েছিল ‘শহরের বিকেন্দ্রীয় করণের’ প্রয়োজন ছিল। বিধাননগর, কল্যাণী এবং হলদিয়া গড়ে তুলে ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় তাঁর দূরদৃষ্টির পরিচয় আগেই দিয়েছেন। কিন্তু সেখানে থেমে থাকলে চলে না। কলকাতা শহরের তাই প্রয়োজন হল নতুন করে ‘সুতানটি’ এবং ‘গোবিন্দপুর’কে খুঁজে নেওয়া এবং অবশ্যই আধুনিক সভ্যতার উচ্চতায় গ্রাম দুটিকে নিয়ে যাওয়া। কলকাতায় বিকেন্দ্রীকরণের শুরুয়াত ‘অপারেশন সান শাইন’ দিয়ে। খুব সম্ভবত দুটি নতুন গ্রামকে আধুনিক উচ্চতায় গড়ে তোলা এবং হস্তিনাপুরের ‘ইচ্ছে পূরণের’ চুক্তি  পশ্চিমবঙ্গকে ‘আধুনিক শহর দিলেও’ আধুনিক সভ্যতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যার মূল্য দেওয়ার পালা শুরু হয়েছে। ‘মেট্রোপলিটন’ শহর গড়লেই হয় না। ‘মেট্রোপলিটন’ মন এবং সভ্যতা গরে তুলতে হয়। বিষয়টা আমরা এক বিখ্যাত লেখকের সঙ্গে কিছু সময় পরে ভাগ করে নেব। তার আগে ‘কলকাতা’ শহরকে চিনে নিতে চাই। কলকাতার কি কোনও জন্মদিন আছে? বিষয়টা বিতর্কিত। কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামালা হয়েছিল। যে মামলাটি সম্ভবত ‘সাবর্ণ রায় চৌধুরী’ মামলা নামে পরিচিত। উচ্চ আদালতে সাবর্ণ রায় চৌধুরীরা এই মামলায় জিতে যায়। ২৪ আগস্ট কলকাতার জন্মদিন নয়।  সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের আইনজীবী স্মরজিত রায় চৌধুরীর দাবি ছিল শহরের কোনও জন্মদিন হয় না।
হাইকোর্টের প্রশ্ন ছিল, ১৬৯০ সালে কলকাতার জন্মদিন। এর আগে যোব চারণক তিনবার এলাকা ঘুরে গেছেন। তারপরেই কলকাতাকে বেছে নেন তিনি। ব্রিটিশরা কলকাতার জন্মদিন পালন করেছিল কি? শ্রদ্ধেয় ইতিহাসবিদ নিমাই সাধন বসুর সভাপতিত্বে যে কমিটি হয় সেই কমিটি একটি রিপোর্ট জমা দিয়েছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি অশোক মাথুরের ডিভিশন বেঞ্চের কাছে। রিপোর্টে বলা হয়েছিল, শহরের কোনও জন্মদিন হয় না। শহর নিজস্ব বৈশিস্টে বিকশিত হয়। ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে মামলা চলা কালীন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘’১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট যোব চারণক কলকাতা যখন এলেন, সেইদিনকে ‘মিড ডে হল্ট’ বলা হয়। হুগলী, হিজলী, উলবেড়িয়া প্রভৃতি জায়গায় ঘুরে ‘সুতানটিকে’ ঠিক করলেন।
১৬৮৬ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি এসেছিলেন। ১৬৮৭ সালের সেপ্টেম্বরে আবার এলেন। কোম্পানির ব্যবসাকে নতুন মোড় দিলেন। চট্টগ্রাম দখল করলেন। ‘সুতানটী’কে বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে দুটো কারণ ছিল। কাছাকাছি নদী ছিল। এবং বাণিজ্যিক কারণ। আত্মরক্ষা এবং প্রতি আক্রমণে যেতে পারবেন। এই জন্যই তিনি ১৬৯৮ খ্রীস্টাব্দে যে তিনটি গ্রাম পেলেন। সাবর্ণ রায় চৌধুরীদের কাছ থেকে। সুতানটী, কলকাতা এবং গোবিন্দপুর। তিনটি গ্রাম নেওয়ার আগে যোব চারণকের জামাই দীর্ঘ আলোচনা করেন। পরে গ্রাম তিনটি হস্তান্তর হয়।‘’
বন্ধু পাঠক আপনারা কলকাতা সংলগ্ন সভ্যতা গড়ে তোলার প্রক্রিয়া জানলেন। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর আশির দশক থেকে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত যে দুটি আধুনিক গ্রাম কলকাতার উপকণ্ঠে গড়ে উঠল সেখানে কোনও বৃহৎ জমিদার বা সামন্ত্রপ্রভু ছিল না। ‘বর্গা’ আন্দোলনের লাভবান খেটে খাওয়া মানুষরা হঠাৎ আবিষ্কার করলেন। ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ এই শ্লোগান ভুলে যাও। ‘জমি যার কোটি কোটি টাকা তার’হ্যা টাকা কোটি কোটি টাকা।
               শ্রদ্ধেয় বিনয় ঘোষ তাঁর ‘মেট্রোপলিটন মন-মধ্যবিত্ত-বিদ্রোহ’ (ওরিয়েনট লংম্যান প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত।) বইয়ে ‘টাকা আর টাকা আর মন’ (পৃষ্ঠা- ১৩-১৪) পরিচ্ছদে লিখছেন, ‘’মন! মন আবার কি? টাকা ছাড়া মন কি? টাকা ছাড়া আমাদের মন নাই; টাঁকশালে আমাদের মন ভাঙ্গে গড়ে। বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের উক্তিধনতান্ত্রিক সভ্যতার শ্রেষ্ঠ দান এই মন যা টাঁকশালে ভাঙ্গে গড়ে।
টাকা স্বর্গ টাকা ধর্ম টাকাই জপ তপ ধ্যান। অটোমোবিল ও স্কাইস্ক্রেপার যুগে মেট্রোপলিটন মহানগরে আর কোন টান মানুষকে টানতে পারে না। এককালে মা ছিলেন স্বর্গাদপি গরীয়সী এবং পিতা স্বর্গ পিতা ধর্ম পিতাই ছিলেন পরম তপস্যার বস্তু। তখন মানুষের টানে মানুষ চলত, গরুর টানে গাড়ি চলত মাটির পথে। ইট পাথর লোহার পথ ছিল না, বাড়ি ঘর ছিল না, অটোর মতো যন্ত্র মানুষকে প্রচণ্ড বেগে টানত না। মাটির টানে মানুষের টানে মানুষ চলত। ক্রমে মাটি থেকে দূরে সরে যেতে থাকল মানুষ,...........................শুধু যে জলাশয়ের জল শুকোলো তা নয়, হৃদয় শুকোলো’ (রবীন্দ্রনাথ)। মন হল একমুখী। লোভ ও স্বার্থের সওয়ার হয়ে অর্থের দিকে ধাবিত হল কলকাতা শহরে।
লোভের টানে স্বার্থের টানে অর্থের টানে গ্রাম থেকে শহরমুখী হল মানুষ ও মানুষের মন। সুতানটীর গঙ্গাতীরে কতকগুলি তাঁবু কুঁড়েঘর ও নৌকো নিয়ে যোব চারনক যখন প্রায় বন্য যাযাবরের মতো বাস করছিলেন তখন তাঁর সপ্তদশ শতকী কল্পনার দিগন্তেও কলকাতার বর্তমান মেট্রোপলিটন মূর্তি ভেসে ওঠেনি। চারনকের মৃত্যু হল ১৬৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে। তার পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে সুতানটি টাউনের দ্রুত সমৃদ্ধি দেখে উল্লসিত হয়ে কোম্পানির ডিরেক্টররা ১৬৯৭ সালে লিখলেনঃ ‘we are glad to hear your town of Chuttanuttee increases so exceedingly’ এবং তার আরো দু’বছর পরে ১৬৯৯ সালে কলকাতার কর্তারা লিখে জানালেন ‘Chuttanuttee very much increased within these 5 years.         সুতানটির গঙ্গার ঘাটে পদার্পণ করার পর যোব চারনক জানান, ’endeavoring to bring the trade down from Hughly to Sootanuttee’ (August 1688) এবং অষ্টাদশ শতকের গোড়াতেই ডিরেক্টররা খুশি হয়ে লেখেন ‘It is enough our cash feels the benefit’ (26 February 1703) 

‘Our Cash feels’- কথাটি কোম্পানির ডিরেক্টরদের বটে কিন্তু মনে হয় যেন কালের ইতিহাসের মর্ম থেকে উৎসারিত। কে ফিল করে? ক্যাশ। জন্তু নয়, মানুষ নয়- ক্যাশ! নবাবকে নগদ ‘ক্যাশ’ দিয়ে লক্ষ্মীকান্ত মজুমদারের বংশধরদের জমিদারি কলকাতা গোবিন্দপুর সুতানটি কোম্পানির নামে কিনতে হয়েছে, সেই জমিদারি টাউন হয়ে গড়ে উঠছে, তার লোক সংখ্যা বাড়ছে, বাণিজ্যের উন্নতি হচ্ছে। কাজেই যে ক্যাশ টাকাটা দিয়ে জমিদারি কেনা হয়েছে সেই টাকাটা অনুভব করছে যে সে উপকৃত। টাকার যে শুধু চক্রগতি আছে তা নয়, তার অনুভূতি আছে হ্রদস্পন্দন আছে। টাকার অনুভূতি এবং মানুষের অনুভূতি একাকার হয়ে মিশে গেল। মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক আর্থিক সম্পর্কে পরিণত হল। কলকাতা শহরের পত্তন হল ক্যাশের উপর এবং ক্যাশ নেক্সাস হল সামন্তধনতান্ত্রিক কলকাতার মানবিক ও সামাজিক সম্পর্ক।                        

No comments:

Post a Comment