Tuesday 12 April 2016

পাকদণ্ডী সামাজিকতা


লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী (রং-তুলি দিয়ে যারা কাজ করেন) তাঁদের চয়নে যেসব চরিত্ররা উঠে আসেন তাঁরা অবশ্যই সমাজের প্রতিনিধি। এটা নতুন কিছু কথা নয়। বহুবার বহু সৃষ্টিশীল মানুষ ‘নিরপেক্ষ’ থাকার মূল্য চুকিয়েছেন। তথাকথিত কিছু স্ব ঘোষিত সফেদ কুর্তার মানুষ ওই সব বিতর্কিত মিছিলে ছিলেন। আজও থাকেন। নতুন সভ্যতার সংস্কৃতিতে হাত, পা, মাথা পাকিয়েছেন বলে যাঁদের চিহ্নিত করছি তাঁরা সবাই হয়ত নন। কিন্তু সমাজের প্রথম শ্রেণীর তথাকথিত কিছু ব্যক্তি ভারতের মত এক শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশে নিজেদের কেউকেটা ভেবে নিয়ে কল্পনার রসে নিজের মতামতকে জিরিয়ে নিতে চাইছেন। এবং জয়ের এক মিথ্যে মিনার থেকে ‘নিদান’ জারি করেন যারা,  তাঁরা কালের পদধ্বনি হয় শুনতে পান না অথবা শ্রবন গোচর করতে চান না।
প্রারম্ভিক জীবনে প্রাচুর্য পেয়েছেন কিন্তু নিজেকে প্রমাণ করতে বাহ্যিক জীবনের সব কিছু ত্যাগ করেছেন এমন উদাহারণ ভারতীয় মহাকাব্যে যেমন আছে অপরদিকে বাস্তব জীবনেও আছে। রাজা হরিশ্চন্দ্র, ভগবান গৌতমবুদ্ধ, রাজা অশোক নন। স্ম্রাট অশোক।  এইসব মহতদের উত্তাপ থেকে নিজেদের সরিয়ে এনে যদি দেখি তাহলে সরকারি প্রধান চেয়ারে যে ব্যক্তি বসছেন,  তিনি অনেক বাধ্য বাধকতার মধ্যে কাজ করেন। এই রাজ্যে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা তাঁদের দলের বাধ্য বাধকতা মেনেই রাজ্যপাট চালিয়েছেন। রাজধর্ম পালন করেছেন। এখানে কাউকে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু অথবা অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে তুলনা করাটা হবে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রকে মৌন বা নিরবাক রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করা। অথবা নিজেকে ‘কূপমণ্ডূক’ হিসাবে চিহ্নিত করা। আমি সেই চড়ুইভাতিতে থাকতে পারিনি। কবিগুরু যে দর্শন থেকে আমাদের শুনিয়েছেন, ‘’মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক’’। সেই দর্শনের ছাত্র হয়ে নিজেদের প্রমাণ করতে হয়।     
নিরপেক্ষ লেখক শিল্পীদের ‘নিরপেক্ষ’, সততা, নির্ভীক হওয়াটা হয়ত জুলুমের পর্যায়ে পড়ে, সভ্যতার লেপ্টে থাকা অচল কিছু ‘মূল্যবোধের’ বাস্তব দেখার এবং লেখার অপরাধে তাঁদের সামাজিক বয়কটের পাল্লায় হোঁচট খেতে হয়। কোনও অভয় না পেয়ে তথাকথিত পচন ধরা সমাজের ‘ছাইভস্ম’ মাখতে বাধ্য হয়েছেন অনেকেই। যারা লড়াইটা করতে চেয়েছেন এবং পেরেছেন সেইসব স্বনাম ধন্য ব্যক্তিরা আজও সর্ব সমাজে স্ববান্ধব চিরস্মরণীয়। আর যারা ‘আত্মসমর্পণ’ করেছেন বা করেন তাঁরা কালের নিয়মে হারিয়ে যান। আমি এই কৈফয়েৎ দিয়ে নিজেকে আনুষ্ঠানিক মহতের দলে ফেলে অন্যদের ব্যস্ত সময়ে ভাগ বসাতে চাইছি না। অনুগ্রহ করে নিজেদের ‘পরের পৃষ্ঠা’ দেখার জন্য আসুন একটি দু’টি সৎ, সরল মানুষের খোঁজে থাকি। সম্ভবত তাঁরাই হচ্ছেন ‘জোকার’ বা ‘ক্লাউন’ অথবা হরবোলা। জোকারদের যেমন সামাজিক মূল্য যেটাই হোক তাকে সব খেলা জানতে হয়। সবাইকে হাসাতে হয়। জোকার কাঁদলেও সবাই হাসে। পাশাপাশি ‘হরবোলা’ কেও সব সুর জানতে হয়। সব শ্রেনীর শব্দ রপ্ত করতে হয়। সাংবাদিক সুদেবদার (সুদেব রায় চৌধুরী, আনন্দ বাজার পত্রিকা) একটি কথা মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, যারা জন্মেছেন (Inborn)  লেখক, শিল্পী, সাংবাদিক হওয়ার জন্য তাঁদের শিল্পীসত্বা নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা বাতুলতা।

‘যুব-নায়ক বিবেকান্দ’ বইয়ে স্বামী লোকেশ্বরানন্দ লিখছেন, ‘’স্বামী বিবেকানন্দ জানতেন, মানুষে মানুষে প্রভেদ থাকবেই। দৃষ্টিভঙ্গি, স্বভাব, দক্ষতা, যোগ্যতা---এগুলোর পার্থক্য থাকবেই। এই ধরণের পার্থক্য স্বাভাবিক এবং প্রয়োজনও। যদি এসব তফাত মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়, তাহলে ব্যক্তির স্বাভাবিক উন্নতি ব্যহত হবে। প্রতিটি মানুষ তার নিজের মতন করে বড় হয়ে উঠবে, তার সহজাত প্রতিভা অনুযায়ী। ধরা-বাঁধা ছাঁচ ধরে কেউ কখনও বড় হয়ে উঠতে পারে না। স্বাধীনতাই উন্নতির প্রধান শর্ত—স্বামীজী বলতেন। মানুষের সর্বোত্তম অগ্রগতি সম্ভব হয় স্বাধীনতার পরিবেশে। সমাজের কর্তব্য সেই পরিবেশ সৃষ্টি করা। কিন্তু স্বাধীনতার পরিবেশ থাকলেই যে মানুষের অগ্রগতি একই রকম হবে, বা একই গতিতে হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। স্বাধীনতা, সমান সুযোগ--- এগুলো অবশ্যই কাম্য। কিন্তু সকলের পক্ষে এগুলিই যথেষ্ট নয়। এমন লোকও আছে যার সীমাবদ্ধতা অনেক বেশি। যেসব সীমাবদ্ধতা সে একার চেস্টায় অতিক্রম করতে পারবে না। কিংবা সে হয়তো দেরিতে শুরু করেছে বলে অন্যদের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। এরকম লোকের জন্য শুধু সমান সুযোগই নয়, বিশেষ সুযোগের প্রয়োজন।‘’ (পৃষ্ঠাঃ ২৩)                 
শুভ নববর্ষ ১৪২৩ এর শুভেচ্ছা জানাই।                  

No comments:

Post a Comment