Friday 25 March 2016

শুধু কাঠা দুই


‘‘শুধু বিঘে-দুই ছিল মোর ভুঁই, আর সবই গেছে ঋণে।/ বাবু বলিলেন, ‘বুঝেছ উপেন? এ জমি লইব কিনে’।’’ 
এই নিবন্ধের চরিত্র ‘উপেন’ নয়। এই উত্তর কলোনিয়াল দেশে রবিবাবুর ‘উপেনদে’র সময় আমরা পেরিয়ে এসেছিআধুনিক বহুতল বাড়ির বাস্তবতায়। কিন্তু সময় গড়িয়ে গেলেও এই যুগের ‘উপেন’রা থেকে যায়। তাঁদের কখনও দেখা যায়। আবার কখনও দেখা যায় না। সেদিন বেহালা গেছিলাম নেমত্রণ  খেতে। হাতে কোনও ‘বেহালা’ ছিল না। সুর আমার কোনওদিন আসে না। এতগুলি বছর ঞ্জাণ-অঞ্জাণে কাটিয়ে দিলাম। নিম্নত্রণ পেতে পারি এই বিশ্বাস প্রায় সতীর্থ বান্ধবজনকে বন্ধক রেখে বলতে পারি,  হারিয়ে ফেলেছি। ‘জিহ্বার’ অনুভূতি থাকলে কি হবে? আক্ষেপ, একদল মানুষ আজকাল ‘ফটোক’ তোলে। আমি ‘ছোট’ ‘ছোট’ খাবার বড় বড় হা করে খাই। ওরা ‘ফোটো’ তোলে। ‘ছবি’ তোলে। তারপর বড় বড় রং বে রঙের সাজানো ঘরে বসে দামি মদের গ্লাস হাতে হাসি মস্করা করে। ব্যং-বিদ্রুপ করে। বাম দিকের আকাশে অচেনা পাখিরা ডানা ঝাপটায়। বামদিকের আকাশটাতেই কেন জানি না ফ্যাকাসে মেঘেদের ইতিউতি আনাগোনা। এটাই হয়ত সভ্যতার অস্ফুট উচ্চারণ। সেটা আমি জানি। তাতে আমার কি এসে যায়? হুতোমেরই বা কি এসে যায়? ওদের ‘বণিক’ সভ্যতায়, সমাজ-সংস্কৃতিতে অঢেল সময়! বহুতল বাড়ির ‘একান্নবর্তী’ পরিবারের স্পর্শকাতর অনুভূতির স্বপ্ন দেখা আর ‘সাংস্কৃতিক দূষণ’ নিয়ে হা হুতাশ করা প্রায় একই নকশী কাঁথার এপিঠ ওপিঠ। গত কয়েক বছরের দুঃসাহসিক নীরবতা এবং একা হয়ে যাওয়ার অনুভূতি ‘নির্মম’ প্রাচুর্যে আমাদের চর্চিত ভাষার ক্লান্তি পথ রচনা করে হয়ত। আমার এসব থাকতে নেই। সেদিন সযত্ন আমন্ত্রণ মেনে সবান্ধব ফিরছিলাম। দেখ কাণ্ড ‘হুতোম’ তখন এসে হাজির। ‘নেতাজি’ স্টেশন থেকে মেট্রো রেল ধরে বাড়ি ফিরব। নসিরউদ্দিন মোল্লার মেজাজে ফিরছি। আত্মসম্মানের থেকে মানবজীবনে বড় আর কিছু কি আছে? হে আমার হারিয়ে যাওয়া পরম আত্মীয়রা আমার ভেতর জাগ্রত কর বেঁচে থাকার স্বসভ্রম তাগিদ। “খাঁচার ভেতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়?”
 ঠিক সেই সময় ‘আতেরবেলার’ পাখিটা এসে হাজির। মাথার উপর দিয়ে চলতে চলতে হুতোম বলল , ‘‘তুই সেদিন তোর লেখায় ‘চল পানসি মহাকরণ’ লিখলি কেন? ওটা হবে ‘চল পানসি বেলঘড়িয়া’। এক নামজাদা কবির কবিতার লাইন।” আমি বললাম ঠিক আছে ঠিক করে দেব। হুতোম আবার বলল, “কাল তোর ছোট বেলার বন্ধু কমল তোদের বাসা বাড়িতে যাবে।” আমি প্রশ্ন করার আগেই হুতোম ‘আঁধারবেলার’ সাথিদের কাছে ফিরে গেল।
‘ব্জ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো’ জীবনে তেল আর তেতোর ফারাক বোঝার সময় চলে গেছে। পরের দিন কমল এলো না। আধুনিক গণতন্ত্রের ধারাপাতের ‘অ-আ-ক-খ’ পড়ছি চল্লিশ চল্লিশ বছর। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ তারও অনেক আগে। অবিশ্রান্ত বাক চাতুরির ভাষা একবার রপ্ত হয়ে গেলে ‘লাঙ্গল যার জমি তাঁর’ শ্লোগান আর খায় না। ‘তেভাগা’, বর্গ হিসাব করে করে বর্গাদারি আন্দোলন ‘জমি জিরেতের’ আন্দোলন শেষে ‘শিল্প শপথের’ সিঙ্গুর পেলাম। আধুনিক বাংলার নতুন কথা বলার ‘বার ভুঁইয়ার’ একুশ শতাব্দীর নতুন অধ্যায়। ধুতি তুলে কোনও এক ‘ভুঁইয়া’ আল ধরে ছুটলেও এটাই এই বাংলা মায়ের বাস্তবতা।
২০০৬-২০০৭ সালের ‘সাংবাদিক’ দায় বদ্ধতার পুরনো নোটবুকগুলো ঘেটে দেখছি সেদিন। ‘নেই কাজতো খই ভাজ।’ কমল এসে হাজির। বেল বাজাতেই অচেনা লোকের সঙ্গে যেমনটা ব্যবহার করি, তেমনটাই করলাম। ও বলল, “গেট খোল আমি কমল।’’ কমলকে চিনতে পারছিলাম না। সধারণ লুঙ্গি আর হাফ হাতা খদ্দরের ফতুয়া। আমি এই নিয়ে প্রশ্ন করিনি। কমলকে প্রায় ১৬ বছর আগে দেখেছিলাম মধ্য কলকাতার কলেজ পাড়ায়। দাড়িগোঁফ সব সময় পরিষ্কার। ক্লিন সেভন। পায়ে প্লাস্টিকের চটি। কমল আমার ১৯৭৫ সালের উচ্চমাধ্যমিকের ব্যাচমেট। ১৯৬৪-৬৫তে প্রাথমিক স্কুলে আমরা সহপাঠী।  
কমল ভেতরে এলো। আমি বসতে বললাম। কমল বলল, “তোর রান্না ঘরটা কোথায়?’’
আমি বললাম কেনো?
“হাতটা ধুয়ে দু কাপ চা করব।”
আমি বললাম, তুই বোস আমি করছি।
ছোট বেলার, কিশোর বেলার বিভিন্ন কথা হল। কমল বেশিক্ষণ বসতে চাইল না। শুধু একটা জমির গল্প বলে চলে গেল। কমলরা এগারো ভাই বোন। ও সবার ছোট। কমল বলছে, “জানিস আমার, সেজদা আর সোনাদার নামে বাবা যে দু’কাঠা জমি দিয়ে গেছিল সেই জমি অন্যায়ভাবে সোনাদার কাছ থেকে আমার সেজদা কিনে নিল।”
আমি বললাম, অন্যায়ভাবে কেন?
সোনাদার আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তুই জানিস। তারপর কর্কট রোগে ধরল। ১৯৯৫ সাল। আমি তখন দেশে মানে গ্রামে নেই। সোনাদার চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার। সোনাদা কি করবে? সেজদাকে বলল দু’তিন হাজার টাকা দিতে। সেজদার সটান প্রস্তাব, তোর ভাগের অংশটা আমাকে লিখে দে। আমি তোকে দু হাজার টাকা দিচ্ছি। সরল, সহজ মানুষ সোনাদার  তখন টাকার দরকার। নিজের অংশের বাজার দরটাও জানে না। বাধ্য হয়ে নিজের অংশটা লিখে দিল। তখন ওই জমির বাজার দর ছিল ৫০ হাজার টাকা।’’
জানতে চাইলাম, তুই ফিরে এসে কিছু বললি না?
“কি বলব বল? ফিরে এসে শুনলাম সোনাদা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে। কবিদের ভাষায় কালো কাকেদের চাপে সাদা কবুতরদের সঙ্গে আকাশ পাখিদের বাসায় ফিরে গেছে।’’
এই গল্প শোনার পর প্রখর গ্রীস্মের দুপুরে পাঠক চলুন ফিরে যাই আর একবার সিঙ্গুর আন্দোলনে। ২০০৬ ‘ফুড ফার্স্ট ইনফরমেশন অ্যান্ড নেট ওয়ার্ক’ তথা ‘ফিয়ান’ এর সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব হালিম একটি সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেন, “জল, জমি, জঙ্গল সরকার বা শিল্পপতিদের হাতে। সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ ঠিক না ভুল সেটা মহামান্য আদালতের বিচার্য বিষয়। কিন্তু সিঙ্গুরকে কেন্দ্র করে মানুষকে খাদ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমরা হুগলীর জেলা শাসক বিনোদ কুমারকে চিঠি দিয়ে ২১ দফা প্রশ্ন করেছি। জমি অধিগ্রহণের তথ্য সংক্রান্ত আইনে। হাইকোর্টে আবেদন করা হয়েছে ‘সিঙ্গুর’ সংক্রান্ত তথ্য ‘ফিয়ান’ কে জানানো হোক। কৃষকরা কি ক্ষতিপূরণ পাবেন সেটাই জানার বিষয়।”
ওই মামলায় হাই কোর্টের বিচারপতি প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় সিঙ্গুরের জমি এবং চাষিদের যেসব তথ্য রয়েছে সেগুলি কোর্ট এবং ফিয়ান-কে জানাতে হবে বলে রায় দেয়এবং বিচারপতি চট্টোপাধ্যায় রায়ে এটাও উল্লেখ করেন, যে সমস্ত তথ্য জানাতে পারবেন না তার কারণ জানাতে হবে। কেন তাঁরা জানাতে পারছেন না। এটা তথ্য জানার অধিকার আইনের ৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী দাবি করা যায়। ১৮৯৪ সালের জমি অধিগ্রহণ আইন মোতাবেক সরকার বিঞ্জপ্তি দিয়েছিল। এবং সিঙ্গুরের চাষিরা ওই একই আইনে আপত্তি জানিয়েছিল। ফিয়ান এবং সিঙ্গুরের আরও কয়েকজন জমির মালিকের রিট আবেদনের ভিত্তিতে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় তৎকালীন রাজ্য তথ্য কমিশনার অরুণ ভট্টাচার্যের উপর একটি অন্তর্বর্তী আদেশ জারি করে বলেন, ১১ জুলাই, ২০০৬ এ হুগলীর জেলা শাসকের কাছে মামলাকারীরা আবেদন পত্রে যে ২১ দফা তথ্যের দাবি করেছিলেন তা দু সপ্তাহের মধ্যে মামলাকারীদের জানাতে হবে লিখিতভাবে। এবং যে তথ্য জানাতে পারবেন না তার কারণও জানাতে হবে তথ্যের অধিকার আইন অনুযায়ী। উল্লেখ করা যায় মামলাকারীরা রিট আবেদনে অভিযোগ করেন যে, নিম্নলিখিত তথ্য না জানালে আপত্তি জানার প্রক্রিয়াটা প্রহসনে পরিণত হবে। ১০৩৫ জন জমির মালিক আপত্তি জানিয়েছে। আবেদনে বলা হয়েছিল, ৪০০০ জনের সরাসরি জমি চলে যাবে। ২৫০০০ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া ২০০০ জন কৃষি শ্রমিক, ৩০০ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ৫০টি পাওয়ার টিলার, ১০০০ জন পরিযায়ী শ্রমিক এঁরা সকলেই ক্ষতিগ্রস্ত। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় মামলা সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে আপত্তি আছে। দু’টি বিষয় একসঙ্গে রাখার জন্য আপত্তি। (১) জমি অধিগ্রহণ (২) তথ্য জানার অধিকার।
সে বছর দুর্গাপুজোর পরে শুনানি হওয়ার কথা ছিল। পরে কি হয়েছে আমার জানা নেই।
এই সিঙ্গুর কে কেন্দ্র করেই  ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের বাংলায় ‘জমি আন্দোলন’ এর এক নতুন অধ্যায় লেখা হয়েছে। যার প্রভাব আমাদের দেশে আজও। ‘জমি অধিগ্রহণ’ কে কেন্দ্র করে বিতর্ক এখনও অব্যাহত। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘জমি অধিগ্রহণ’ বিল হাত পা ছড়িয়ে সরকারী খরচায় ঠাণ্ডা ঘরে। ২০১১ সালে যেহেতু ৩৪ বছর পরে রাজ্যে এক নতুন দিশা আনতে চেয়েছিল এই বাংলার ‘বিদ্যাজীবী’, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মানুষ। বামপন্থীদের একটা অংশ। আমার মনে আছে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও বলেছিলেন, “আমাদের মানুষের দাবি মেনে নিতে হবে। প্রয়োজনে ‘বিরোধী বেঞ্চে’ বসতে হবে।’’ এটাই ছিল সেদিনের ‘দূরদৃষ্টি’ বা গঠনমূলক উপলব্ধি। ২০১১ সালের ‘পরিবর্তন’ শব্দটাকে যদি আমরা আরও কিছুটা গভীর থেকে দেখি তাহলে এই লাইনটা অবশ্যই আসবে ‘বদলা নয় বদল চাই’। এই দু’টি শ্লোগান বর্তমান রাজ্য সরকারী দলের ছিল। দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২০১৪ সালে এলেন সিংহ গর্জনে, ‘অচ্ছে দিন আনেওয়ালা হৈ’। আমেরিকার ছিল ‘মেক আমেরিকা গ্রেট আগেন’। তাহলে কেন নয় ‘মেক বাংলা’ তথা ‘মেক ইন্ডিয়া’ আগেন’?
গণতন্ত্রে প্রতিযোগিতা হবে। কিন্তু কথা বলার স্বাধীনতা কেন কেড়ে নেওয়া হবে? গণতান্ত্রিক দেশে সব স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার আছে। নিরপেক্ষ, সংবেদনশীল, গঠনমূলক আলোচক, লেখক, শিল্পী, সাংবাদিকদের একঘরে করে রেখে কতদিন রাজ্য শাসন করা যায়? ভেসে থাকা কালো মেঘ কাল বৈশাখীর ঝড়ে উড়ে যেতে বাধ্য। প্রখর খরায় গাছে গাছে নব পল্লব, নব পত্রের ‘কিশলয়’ আহবান আমাদের মেনে নিতে হয়। মেনে নিতে হবে। যৌবনের কোনও রঙ হয় না। শিল্পীর তুলিতে আঁকা বন্ধ  কলকারখানার  শ্রমিকের যন্ত্রণা, ‘সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম’ এর দীর্ঘশ্বাস ভুলে ‘নতুন বাংলা’ গড়ে তোলার শপথ হোক আগামীর ‘আগুন্তক’ এর মাঙ্গলিক ঘট।

প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ৮৮ বছরের বরফ শীতল সম্পর্কের ‘শীত ঘুম’ ভুলে ‘কিউবা’ যেতে পারেন। বৈঠক করতে পারেন সে দেশের প্রেসিডেন্ট কমরেড রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে। যৌথ আহবান করেন। বিশ্বে শান্তি আনার জন্য পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা কূটনীতির উচ্চমারগে নিয়ে যাওয়া হবে। তাহলে এই বাংলায় যে কোনও দলের অশুভ শক্তির সঙ্গে লড়তে ‘মানুষের জোট’ হলে ‘গেল গেল’ রব তোলার কি আছে?                                                            

No comments:

Post a Comment