Sunday 9 December 2018

বন্যা হয় হোক আমাদের ‘নদী’ ফিরিয়ে দিন।





দীপেন্দু চৌধুরী
অরন্যের ‘আরন্যক’ পশুপাখি না মানুষ? গত কয়েক দশক ধরে বন্যপ্রাণী শিকারের মধ্যে এই প্রশ্ন এখন বার বার উঠছে। গভীর জঙ্গলে বন্যপ্রাণী কতটা নিরাপদ? চোরা শিকারী আর বন্য পশুর হাড়, মাংস মজ্জার চোরা ব্যবসায়ীদের সমঝোতায় জঙ্গলের নিরাপত্তা এখন আনুষ্ঠানিকতা হয়ে গেছে। তবুও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রাজ্য সরকার সচেষ্ট বাদাবন আর বন্যপ্রাণী রক্ষায়। ভারতবর্ষের মোট বাদাবনের এলাকা ৬, ৭৪০ বর্গ কি মি। যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনে এই বনভূমির বর্তমান আয়তন ৪, ২৬৩ বর্গ কি মি বা শতকরা ৬৩ ভাগ। সুন্দরবন বনাঞ্চলকে প্রধান দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প অঞ্চল এবং ব্যাঘ্র প্রকল্প বহির্ভূত সুরক্ষিত বনাঞ্চল। এই অঞ্চলের বনভূমির এলাকা ৫৫ শতাংশ। এবং জলাভূমি ৪৫ শতাংশ, সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প রয়েছে ২৫৮৫ বর্গ কি মি জুড়ে। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের কোর এলাকা বা সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান ১৩৩০ বর্গ কি মি। সজনেখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারন্য ৩৬২ বর্গ কি মি। বাফার বনাঞ্চল বা সীমিত ব্যবহার যোগ্য বনাঞ্চল ৮৯৩ বর্গ কি মি।  
সুন্দরবন এলাকার প্রধান নদী কালিন্দী, রায়মঙ্গল, ঝিলা, গোসাবা, বিদ্যাধরি, মাতলা, ঠাকুরান প্রভৃতি। সুন্দরবনের বাদাবনে ও খাড়িতে রয়েছে অনেক অবলুপ্তপ্রায় প্রাণীর আবাসস্থল। যেমন রয়েল বেঙ্গল টাইগার, নোনা জলের কুমির, ছোট গোসাপ, শুশুক প্রভৃতি। পরিবেশগত কারণে ইতিমধ্যেই শুশুকের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। বাঘের সংখ্যাও কম বলে সূত্রের খবর। বনাঞ্চল ছোট হয়ে আসার কারণে গভীর জঙ্গলের বাঘ লোকালয়ে এসে পড়ছে। সুন্দরবন কলকাতা থেকে ১২০ কি মি দক্ষিণে।  
২০০৯ সালে ‘আয়লা’ নামক এক বিদ্ধংসী ঝড় সুন্দরবনের গঠনশৈলী অনেকটাই তোলপাড় করে দিয়েছে। যে লোকটার ক্ষেতে নোনাজল ঢুকছে সে কি করবে? সুন্দরবনের ১৫ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অন্যত্র চলে গেছে। সুন্দরবন দিনের পর দিন কলকাতার দিকে এগিয়ে আসছে। শেষ পাঁচ দশকে ‘ঘোড়ামারা’ দ্বীপ অর্ধেকের বেশি জলের তলায় চলে গেছেবিষেষঞ্জরা বলছেন সুন্দরবনের অস্তিত্ব না থাকলে কলকাতার অস্তিত্ব থাকবে না। পরিসংখ্যান বলছে কলকাতা ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম নগরী। বিশ্বে ৪০টি শহরের মধ্যে কলকাতায় গ্রীণ হাউস গ্যাস নিষ্কাশন সব থেকে বেশি। কলকাতায় প্রতি দশ জনের মধ্যে ৭ জন শ্বাসজনিত অসুখে ভোগেন। প্রতি তৃতীয় ব্যক্তি কলকাতার বস্তিতে থাকেন। অর্থাৎ এক তৃতীয়াংশ ব্যক্তি বস্তিতে থাকেন।
এই নিবন্ধ সুন্দরবন বিষয়ক কোনও রোমান্টিক বিষয় নয়। বিশ্বের শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত মানুষ আজও কতটা উদাসীন সেটা পরিসংখ্যাগুলির দিকে নজর দিলে বুঝতে পারব। পরিবেশ বিষয়ক জলবায়ু সম্মেলন ২০১৩ সালে প্যারিস শহরে হয়েছিল। প্যারিস সম্মেলনের ঘোষণা ছিল যৌথভাবে কাজ করতে হবে পৃথিবীর তাপমাত্রা কমিয়ে আনার জন্য। প্যারিস প্রস্তাবে পাঁচটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ১) বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখা। ২) তাপমাত্রার বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রিতে নামিয়ে আনাই পাখির চোখ ছিল। ৩) গ্রিন হাউস গ্যাস নিয়ন্ত্রণের মূল্যায়নে পাঁচ বছর অন্তর আলোচনা। ৪) ২০২০ সালের মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার বরাদ্দ। ৫) ২০২৫ সালে ফের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা।
এই ঘোষণা অনুযায়ী এ বছর ৪ ডিসেম্বর থেকে পোল্যান্ডের কাতোভিৎসায় শুরু হয়েছে জলবায়ু বিষয়ক শীর্ষ সম্মেলন। ১৯৯৭ সালে জাপানে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য কিয়োটো প্রোটোকল অনুমোদন করা হয়েছিল। এই চুক্তির ভিত্তিতেই সারা বিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ চলছে। কিয়োটো চুক্তির খসড়া অনুযায়ী উন্নত দেশগুলিকে কার্বন নির্গমন কমানোর জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলিকে আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে সাহায্য করতে হবে। কিয়োটো সম্মেলনে ১৯৪টি দেশের প্রতিনিধিরা যোগ দিয়েছিলেন। ভারত থেকে এই সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন তৎকালীন পরিবেশমন্ত্রী জয়রাম রমেশ। এই সম্মেলনে বাকী অন্যান্য বিষয়ে একমত হলেও সব দেশ কার্বন কমানো এবং জলবায়ু পরিবর্তন রোখার ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্যের জন্য ঐক্যমতে পৌঁছতে পারেনি। বর্তমান সময়ের পরিসংখ্যান বলছে ভারতে গড়পড়তা ৫০০ মানুষের মৃত্যু হয় তাপপ্রবাহের কারণে।  
প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে ১৯৬টি দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ১৩দিন ধরে আলোচনা করে ওই প্রতিনিধিরা ঠিক করে চূড়ান্ত খসড়া। সেই খসড়ায় আছে পৃথিবীর তাপমাত্রা যেন ২ ডিগ্রির বেশি না বাড়ে। এটা বিশ্বের মানবতাবাদী রাজনৈতিক নেতৃত্বকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। যদি সম্ভব হয় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার শিল্প বিপ্লবের আগের সময়ে নিয়ে যাওয়াটা হবে অন্যতম কাজ। অর্থাৎ উষ্ণায়নকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমায় বেঁধে রাখা। এই কথা মনে রেখে উন্নয়নশীল দেশগুলিকে উপযুক্ত অনুদান ও পাঁচ বছর অন্তর উষ্ণায়নের পরিস্থিতির পর্যালোচনার কথা উল্লেখ করা আছে প্যারিস চুক্তির খসড়ায়। প্যারিস চুক্তির খসড়ার গাইড লাইন মেনে এ বছর ৪ ডিসেম্বর থেকে কাতোভিৎসায় সম্মেলন হচ্ছে।
পরিবেশ সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি
কাতোভিৎসার সম্মেলনের বিষয়ে আলোচনা করার আগে আমরা দেখে নেব ভারতের বিভিন্ন ভাষার সংবাদ মাধ্যম কতটা সচেতন পরিবেশ এবং বিশ্বের জলবায়ু প্রসঙ্গে? সম্প্রতি প্রসঙ্গটি আলোচনা হল পরিবেশ বিষয়ক একটি কর্মশালায়। ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে আলাদা আলাদা বিভিন্ন ‘বিট’ থাকলেও ‘পরিবেশ’ বিষয়ক আলাদা কোনও বিটের জন্য সাংবাদিকদের কতটা সুযোগ দেয়? পরিবেশ বিট বলে কোনও বিভাগ বা বিটের কথা আমাদের জানা নেই। বলছিলেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিকের সাংবাদিক জয়ন্ত বসু। জয়ন্ত গত দশ বছর একটানা পরিবেশকে বিষয় করে সাংবাদিকতা করছেন। ২৮ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর কলকাতা প্রেসক্লাব, দ্য থার্ডপোল এবং কলকাতার জার্মান কনসাল জেনারেল যৌথভাবে কলকাতার সাংবাদিকদের জন্য পরিবেশ বিষয়ক একটি কর্মশালার আয়োজন করে। ২৯ নভেম্বর ছিল সকাল আটটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ এবং আলোচনা। এই কর্মশালায় উঠে এল বিভিন্ন বিষয়। দূষণ, পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, জলদূষণ এবং আর্সেনিক ইত্যাদি বিষয় পরিবেশ নিয়ে ভারতে কাজ করছে ‘দ্যা থার্ডপোল’ নামে একটি সংস্থা। এই সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক জয়দীপ গুপ্ত বলেন, ‘’পরিবেশ বিষয়ক প্রত্যেকটি খবরই রাজনৈতিক খবর। অচিরাচরিত (সোলার এবং উইন্ড) বিদ্যুৎ সারা দেশের চাহিদার মাত্র ২৮% পূরণ  করে। ভারতে পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকতার পরিসর বাড়ানোর প্রয়োজন আছে।‘’   
এই কর্মশালা সূত্রেই জানা গেল জার্মান কনসাল জেনারেল কলকাতার জন্য ২০১৭ সাল থেকে একটি প্রকল্প শুরু করেছে। প্রকল্পের নাম ‘’Greener, Cleaner World-Environment & Climate Change’’,  বর্তমান জার্মান কনসাল জেনারেল ডঃ মাইকেল ফেনার বলেন, ‘’ জার্মানি এবং ভারত দুটি দেশের সরকার যৌথভাবে পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকতার কাজ করতে চাইছে১৯, ০০০ বিঞ্জানী পরিবেশ রক্ষার কাজে এগিয়ে এসেছেন। এই দলে কয়েকজন নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত বিঞ্জানীও আছেন। জার্মানির মানুষ বায়ুদূষণের বিষয়ে বিশেষভাবে সচেতন। গত ২৫ বছরে ৭৫% প্রাকৃতিক ভারসাম্যের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেছে আমাদের দেশ। আমরা উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে ‘ইকোলজি’ বিষয়ে সচেতন আছি।‘’
ডঃ ফেনারের বক্তব্যের সূত্র মাথায় রেখে বলতে হয় বিশ্ব নেতৃত্বের সবুজ বিনিময়ের হার আরও বাড়াতে হবে। ৪ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছে ‘কপ২৪’ শিরনামে এক সম্মেলন। পোল্যান্ডের কাতোভিৎসায় অনুষ্ঠিত সম্মেলন চলবে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বিশ্বের তাপমাত্রা কমানোর ক্ষেত্রে প্যারিস চুক্তি অনুসারে আর্থিক সহায়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। দরিদ্র দেশগুলির জন্য এই আর্থিক সহায়তা ভীষণভাবে প্রয়োজন। ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইন্সটিটিউট সূত্রে জানা যাচ্ছে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের তিন বছর পরে কাতোভিৎসার সম্মেলন হচ্ছে। বিশ্ব নেতৃত্ব তিনটে বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে এই জলবায়ু সম্মেলনে আলোচনা করছে। তিনটে বিষয় হচ্ছে জাতীয় বিপর্যয়ের জন্য আরও দায়বদ্ধতা প্রয়োজন। প্রয়োজন জলবায়ু বিষয়ক সমস্যা সমাধানের আরও বিনিয়োগ। এবং প্যারিস চুক্তির নিয়মাবলী ঠিক করা এবং প্রয়োগ করাও অন্যতম কাজ। এই সূত্র থেকে আরও জানা যাচ্ছে আলোচনার মঞ্চ দখল করে রাখবে তিনটে বিষয় ১) ফান্ড ২) রুলস এবং ৩) গোল। ২৪ ডিসেম্বরের পরে আমরা জানতে পারব কি সিদ্ধান্ত হল রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রত্যক্ষ অভিভাবকত্বে ১০-১১ দিনের এই জলবায়ু বিষয়ক পর্যালোচনা সম্মেলনে।
মনে পড়ছে ভারতে পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিক জয়ন্ত বসুর কথা। নভেম্বরের তিনদিনের কর্মশালায় নিজের অভিঞ্জতার কথা বলছিলেন তিনি। সিঙ্গুরে পরিবেশ দূষণ নিয়ে বামফ্রন্ট আমলে খবর করতে গিয়ে মার খেয়েছেন তিনি। একদল সমাজবিরোধী আক্রমণ করে তাঁদের। আবার উল্টো অভিঞ্জতার কথা বলেন তিনি। জয়ন্তের কথায়, কয়েক বছর আগে বন্যার পর তাঁরা উত্তর বঙ্গের কোনও একটি জেলায় পরিবেশ বিষয়ক খবর করতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে শোনেন বন্যার কারণে একটি নদী গ্রাম থেকে হারিয়ে গেছে। গ্রামের মানুষ নদী  ফেরৎ চায়। জয়ন্ত বলেন, ‘’আমরা গ্রামের মানুষদের বললাম নদী থাকলে বন্যা হবে। আপনারা নদী চাইছেন কেন? গ্রামের মানুষ চিৎকার করে বলছেন আমাদের নদী ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। নদী থাকলে আমাদের গ্রাম ছেড়ে বাইরে যেতে হবে না। নদী আমাদের জীবন। নদী আমাদের জীবিকা। নদী আমাদের মরণ। আমাদের নদী ফিরিয়ে দিন।‘’
ঠিক এই দাবিই উঠে এল কাতোভিৎসায়। গ্রেটা থুনবার্গ নামে ১৫ বছরের এক কিশোরী কাতোভিৎসায় গিয়ে বলছে, আমরা আমাদের রক্ষার জন্য বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে ভিক্ষে চাইছি না। আমরা তাঁদের জানাতে এসেছি ‘পরিবর্তন’ আসছে। গ্রেটা আরও বলেন, ‘’নিয়মের বেড়াজালের মধ্যে থেকেই আমরা অপেক্ষা করব, কারণ বিশ্ব জলবায়ু রক্ষার নিয়ম সবাইকে মানতে হবে।‘’                     
 

1 comment: