Sunday 30 December 2018

স্বেচ্ছাচারী



দীপেন্দু চৌধুরী
এখানে বরফ পড়ে না। পড়ার কথাও নয়। আমরা উত্তরের বাসিন্দা নই। আমরা দক্ষিণের জানলা খুলে চেয়ে থাকি। শুনি উত্তরে ঝির ঝির করে বরফ পড়ছে। ঢেকে ফেলেছে উত্তরের পাহাড়ের জনবস্তির ছাদ, চা বাগানের ঠিকে শ্রমিকের ঝুপড়ি। গাছের পাতায় বরফ, দেশে নগরায়ন হয়েছে। নতুন বাড়ি, নতুন গাড়ির ছাদে বরফ। পুরনো কাঠের বাড়ির চালে তির তির করে বরফ পড়ছে। পাহাড় ডাকছে আয় আমার কোলে আয়। সারল্য আর একঝাঁক সাদা বকেদের সঙ্গে পাহাড়ি বোনেদের গান শুনবি। সাত পাহাড়ের গান শুনবি। বাঁশি শুনবি। আয় আমার কোলে আয়। আমার স্পর্শের ওম নিয়ে যা। আয় ঘুম। ঘুম ছুটেছে। ঘুম ছুটছে আঁকা বাঁকা রেল, পাকদন্ডি রাস্তার উঁচু নীচু বাঁকে। পাহাড় আমায় ডাক দিয়েছে। কিন্তু আমি কোন পাহাড়ের কাছে যাব? আমার পাহাড় হারিয়ে গেছে। সভ্যতার পাছায় চুম্বন দিয়ে কে যেন বলছে তোমার পাহাড় হারিয়ে গেছে। জাত পাতের বজ্জাতি দেখতে গিয়ে নতুন জাতের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। আমার পাহাড় তাঁরা গ্রাস করে নিল।
মাত্র ১০ থেকে ১৫ ফুটের উচ্চতা। লাল টকটকে বাঁক খাওয়া সূর্যের আলো এসে যখন ঠিকরে পড়ত ছোট্ট টুকরো টুকরো পাহাড়ের পাথরে, লাল পাথর জানান দিতে চায়হিস হিস করে স্বাধীন বিষধর সাপেরা পৌষের শীতে ঘুমের ঘরে আশ্রয় নিত। আয় ঘুম আয়। আতা গাছে কি এই সময় আতা হয়? ভুলে গেলাম। ভুলে গেছি। আমার পাহাড় হারিয়ে গেছে। আমি দারুন স্বেচ্ছাচারী। তখন আমার পাহাড়ে ওঠার রাস্তা ছিল না। সে সময় চাঁদ এসে উঁকি দিলে ডাহুক পাখি ঝর্ণার জলে সান্ধ্য স্নান করে কোথায় আবার হারিয়ে যেত। ওদের শীত করে না। ওদের শীতঘুমও নেই। কিন্তু আজ ওরাও কোথায় হারিয়ে গেছে। পাহাড় থেকে বিষধর সাপেরাও হারিয়ে গেছে। আমার ঝর্ণাটাও কেড়ে নিয়েছ! কেন এসব হয়? গত দু’তিনটে মাস আমাদের আশেপাশে ঘুঘু ডাকছে। জানান দিচ্ছে দুপুরের স্মৃতি। ভোরের ভোরবেলা। আমার তোমার ছেলেবেলা।
সভ্যতার পাছায় চুম্বন খেতে খেতে কে যেন বলে গেল পাহাড় কখনও হারায় না। পাহাড় কখনও ঘুমোয় না। এইতো আজকের কাগজেও আছে ৭২ বছর পরে ফিরে পেলেন এক নারী তাঁর স্বামীকে। তাঁর কৈশোরবেলার বন্ধুকে। আবেগে দু’জনের দু’চোখে তির তির করে চিরযৌবনের বরফ, শিশির পড়ছে। অনুভূতির ওম ওদের ৭২টা অদেখা বসন্ত ছুঁইয়ে দিল। বরফবেলায় ৭২ বছরের প্রেম! একজন ৯৩য়ের যুবক দ্বিতীয়জন ৮৯ বছরের অভিমানী যুবতী। প্রেম! কে চেনে? কারা চেনে? পাহাড় তুমি হারিয়ে যেও না। পাহাড় তুমি আর সকলের থেকে আলাদা। তোমার একদিকে মন্দিরে ঘণ্টা বাজে। পূবদিকে পিরের দরগা। আমার পাহাড়ে আছে একটা নীম গাছ। পশ্চিমপাড়ে মিঠে নীম পাতা। পূবদিকে তেতো নীম পাতাএইতো আমার পাহাড়। পাহাড় কি হারিয়ে যায়? পাহাড় ঘুমিয়ে থাকে। ঘুমিয়ে থাকা পাহাড়ে হুতোম আসে। যে পাহাড়ে যাই সেই পাহাড়ে হতোম থাকে। গাজনের সময় থাকে। দুগগি পুজোয় হুতোম আসবেই। ইদের নামাজে হুতোমকে চেনা যায়। বড় দিনে বড় পাহাড়ে এসে হুতোম বড় ঘণ্টা বাজায়। হুতোম সান্টাক্লজের বন্ধু। আমি ওকে না মানলে কি হবে? হুতোম না থাকলে পাহাড়ও আর আমায় ডাকবে না। নদীও হারিয়ে যাবে। পাহাড় নদী না থাকলে সভ্যতা কোথায় পাব? সেদিন যেমন হুতোম না থাকলে আমি বন্ধু কোথায় পেতুম?
পার্কস্ট্রীট থেকে চৌরঙ্গীতে এসে মেয়ো রোড না ধরে চৌরঙ্গী মানে জহরলাল নেহরু রোড ধরে হাঁটছিযাব প্রেসক্লাববা দিকে বড় রাস্তার উপর সার দিয়ে পাহাড়ের মত থুরি পয়সাওয়ালা বড়লোকদের বাড়ির মতো বড় বড় বাস দাঁড়িয়ে। ফুটপাথ গোড়ালিভেজা ইউরিয়া জলে ভর্তি। হুসুর জল আর কি?  সভ্যতার পাছায় চুম্বন খাওয়ার কথা আমাকে হুতোম শিখিয়েছে। ফুটপাথ ধরে হাঁটতে পারছি না। বড় রাস্তার বা দিকে সারি সারি নাগরিক বাস দাঁড়িয়ে। শীতের বেলা। আমজনতা ভীড় করে জটলা করছে। করবেই। বাসের আড়ালে যুবক-যুবতির আড়াল খোঁজা আলিঙ্গন। আমার পেছন থেকে একটা হর্নের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। আমার পেছনে কেউ চুম্বন দিতে চাইছে। দেখুন ঠিক সেই সময় আমার ডান দিকের কানের ভেতরটা সুর সুর করল। আমি কানে আঙ্গুল দিয়ে কানটা চুলকে নিচ্ছিলাম। আঃ কি আরাম। না হল না। আমার সামনে বাঘের কায়দায় এক মোটরবাইক আরোহী সামনের একটা থাবা দিয়ে রাস্তা আটকে দাঁড়াল। বাইকের সামনে চাকাটা বড়বাবুদের বাসে ঠেকিয়ে আমাকে হাজতে পোড়ার মতো করে দাঁড়াল। অথবা আমি ৪৫ নম্বর রুটের  বাস ড্রাইভারের মতো ট্রাফিক নিয়ম ভেঙ্গেছি। ভদ্রলোক আমাকে জিঙ্গেস করল ‘’আপনি কানে আঙ্গুল দিয়ে রাস্তায় হাঁটেন?’’ আমি বললাম ‘আমার কানটা একটু সুর সুর করছিল।’ ভদ্রলোক আমাকে হঠাত বললেন, ‘’আমিও তাহলে এভাবে থাকি।‘’ ততক্ষণে আমি দেখে নিয়েছি। ভদ্রলোকের বাইকের হেড লাইটের কভারে পাহাড়ের মত করে না থুরি আইনের শব্দে লেখা ‘পুলিশ’। বুঝলাম ট্রাফিক পুলিশ। রাস্তার ব্যামো আছে এঁদের। ভীষণ রাগ। পুলিশ বলে কথা। আমি জানতে চাইলাম আমার অন্যায়টা কি? ট্রাফিক পুলিশ আমাকে টনিক না দিয়ে ভয় দেখাচ্ছে। মাথার উপর থেকে হুতোম বলল, ‘স্যার কিছু মনে করবেন না। ‘ম্যাচ’ করে গেছে। আপনার পাহাড়ি বাইক আর আমার কানের সুর সুরি ম্যাচ করে গেছে।’ হুতোমের কথা রাস্তার ব্যামো সারানোর ট্রাফিক পুলিশ শুনতে পাবে না। তাই আমি কথাগুলো বললাম। মনে হল কাজ হয়েছে। সঙ্গে বললাম ‘আমি কিছু অন্যায় করিনি বড় বড় বাবুদের  এই বড় ছোট বাসগুলো ধর্মতলারমতো বড়রাস্তায় রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন? দাঁড়িয়ে থাকে কেন? এটা অন্যায় নয়? ফুটপাথে গাছ লাগিয়ে দিন, ইউরিয়া লাগবে না। এটা কি? লিন্ডসে স্ট্রীটের উল্টোদিকের রাস্তা? না চেতলা যাবার গলতা? তিলোত্তমা কলকাতার মলমূত্র ত্যাগ করার এটা জায়গা?’ হুতোম ফুট কাটল ‘স্যার বর্ষবরণের আর তিনদিন বাকী। ‘ম্যাচ’ ফিটিংস? না ‘ম্যাচ’ করে গেছে? আপনার দাপুটে এবং স্বাধীন বাইকের হর্নের শব্দ আর আমার কানের সুরসুরি। আপনার কোন নার্সিং হোমে জন্ম স্যার?’ আমি এই কথাটা আর উচ্চারণ করলাম না। বড় বড় থাবাওয়ালা রাস্তার ব্যামো সারানো পুলিশস্যার কিছুটা এগিয়ে আমাকে পরখ করতে লাগল। আমি কোনদিকে যাই।                  
হুতোম আমাকে প্রেস ক্লাব পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে সতর্ক করে দিলে। ‘আজ মদ খাস না। পাহারে চলে যা। মহুল ফুলের রস পাবি। কালো গরুর দুধ পাবি। পাহাড়ের বুকের ওম পাবি।’ পাহাড়কে জাগিয়ে তুলতে হয়। পাহাড় আমাকে নদীর কাছে যেতে বলেছিলপাহাড় আমাকে নাগরিক শহরে আসতে বলেছিল। আজ সকালে যেমন হল। একটু আগে হ্যাঁ আবার শুনতে পেলাম। ঘুঘুটা ডাকছে। এটা বলতে চাইনি। আজ সকালে হাঁটতে বেড়িয়েছিলাম। কারও বাড়িতে এফ এম রেডিওতে বাজছে মান্না দের গলায় সেই গানটা। ‘তুনি কি সেই আগের মতই আছ’? আচ্ছা পাহাড়ের লিঙ্গ কী? পাহাড় তুমি কি পুরুষ? তোমার তেজোদীপ্ত ব্যক্তিত্ব, দৃপ্ত পেশী, তবু তুমি নিশ্চল, নিশ্চুপ নীরবএমনতর ব্যক্তিত্ব বলেই কি তুমি পুরুষ? কিন্তু সযত্নলালিত তোমার বুকে তির তির করে বয়ে যাওয়া পিয়ানোর সুরের মতো ঝর্ণা, সরু নদী, কালো কালো গাছের পাতা, চিরসবুজ হলে তবেই না পাতার রঙে ওমন জলপাই গহন কালো সবুজ রঙ আসে। রঙ বহুরঙের প্রজাপতি, হলুদ পাখি, বৌ কথা কও, সাত ভাই চ্চম্পা সাত পাহাড়ের বুকের কাছে টেনে নিয়ে যায়। জোনাক জ্বলা সন্ধ্যায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। পাহাড়ি বুকের উষ্ণতা চুপি চুপি বলে আমি নারী। আজ আমি নদীর কাছে যাব না। আজ তির তির করে বরফ পড়ছে। আজ ঝির ঝির করে শিশির পড়ছে।  আমাকে পাহাড়ের কাছে থাকতে দাও। আমি পাহাড়ের পুরুষালী ঘ্রাণ পাচ্ছি। কিন্তু নদীও যে আমায় ডাকে। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘’তীরে কি প্রচন্ড কলরব/ ‘জলে ভেসে যায় কার শব/ কোথা ছিলো বাড়ি?/ রাতের কল্লোল শুধু বলে যায়- ‘আমি স্বেচ্ছাচারী’ (কবিতা, আমি স্বেচ্ছাচারী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়)                          

No comments:

Post a Comment