Saturday 1 December 2018

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহেবরা জঙ্গল বাঁচাতে গ্রামের মানুষকে ছবি আঁকতে বলতেন

দীপেন্দু চৌধুরী
অচেনা এক জংলি ফুলের ডাল। গাছ নয় ফুল এবং ডাল। যেটা একধরণের ফুল গাছের ছবি। লিফলেটে ছোট ছোট শব্দে রোমান হরফে  লেখা অষ্টাদশ শতাব্দীর ভারতের প্রকৃতি বিষয়ক এবং জন্তু-জানোয়ার, পাখির পেন্টিংয়ের প্রদর্শনী। দাবি করা হচ্ছে এটা একটা যৌথ প্রকল্পের শুরুয়াত।
কোম্পানী আমলের পেন্টিং বলে পরিচিত অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্বে আমাদের অখন্ড ভারতের অখন্ড বাংলার তিনজন বাঙালি শিল্পী এইসব ছবি এঁকেছিলেন। তিনজন চিত্রকর হচ্ছেন ভবানী দাস, রাম দাস এবং শেখ জাইন-আল-দিন (Shaikh Zayn – al - Din)উল্লেখিত তিনজন শিল্পী জলরঙে কিছু ছবি আঁকেন। অখন্ড ভারতের ব্রিটিশ যুগে আঁকা সেইসব ছবিকে চিত্র-সমালোচক এবং চিত্র-ঐতিহাসিকরা কোম্পানী আমলের ছবি বলে আখ্যায়িত করেছে। ভারতের জীবজন্তু বিষয়ক ২১০ খানা জলরঙে আঁকা ছবির সম্ভার এবং অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দীতে আঁকা দেশীয় জীবজন্তুর ছবি (সংগৃহীত) প্রদর্শনীর জন্য সম্প্রতি একটি মৌ স্বাক্ষরিত হল কলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়া হল এবং ব্রিটেনের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে। এই সমঝোতাপত্রে সই করেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সচিব-কিউরেটর জয়ন্ত সেনগুপ্ত এবং ব্রিটেনের এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর স্টিভ স্মিথ। আমাদের রাজ্যে ‘ভিক্টোরিয়া’ বলতে আমরা জানি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হলের সংগ্রহশালা। অ্যালবার্ট হল, মানে এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিক্টোরিয়ার স্বামীর নামে যে সংস্থা আছে। অর্থাৎ রয়্যাল অ্যালবার্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম (RAMM)
তৎকালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শল্য-চিকিৎসক এবং প্রকৃতিপ্রেমী সংগ্রাহক জন ফ্লেমিংয়ের হেফাজতে ছবিগুলি রাখা ছিল। সে সব ছবি এখন কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সংগ্রহশালায় রয়েছে। পাশাপাশি এক্সিটারে অ্যালবার্ট স্মৃতি সংগ্রহশালায় রয়েছে রিচার্ড ক্রেসওয়েলের সংগ্রহ করা সমসাময়িক সময়ের প্রকৃতি বিষয়ক গাছপালার ছবি। ‘রয়াল অ্যালবার্ট মেমোরিয়াল মিউজিয়াম (RAMM) সূত্রে জানা যাচ্ছে, সেই সময় কোম্পানীর কর্মরত আধিকারিকরা দেখেন গভীর জঙ্গল ঘেরা প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ গাছ এবং ফুলের নির্যাস দিয়ে জলরঙে ছবি আঁকছে। আবার কিছু মানুষ জঙ্গলের গাছ কেটে বাড়িতে শুকিয়ে রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছেন শিল্পরসিক কোম্পানীর সাহেবরা জঙ্গল বাঁচাতে গ্রামের মানুষকে ছবি আঁকতে বলতেন। ব্রিটিশদের সেই সময়ের শ্লোগান ছিল, ‘প্রকৃতিকে হয় বাঁচিয়ে রাখতে হবে না হলে পেন্টিং রাখতে হবে।’
সমঝোতাপত্র সই হওয়ার পরে কিছু কাজ বাকী থাকে। সেই সব প্রশাসনিক কাজ শেষ হলে ২০২০ সাল নাগাদ শীতের দুপুর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত একটা নতুন ঘরানার ‘মিনিয়েচার’ প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পাবে কলকাতা সহ রাজ্যের শিল্পরসিক মানুষ। এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়্যাল অ্যালবার্ট মিউজিয়ামের অধিকর্তা হলি মর্গেন রথ বলছিলেন, ‘’কোম্পানী আমল এবং ব্রিটিশ শাসনকাল সময়ে ভারতের রাজ-রাজাদের সংগ্রহে দেশীয় শিল্পীদের আঁকা অনেক ছবি ছিল। ছবিগুলি উন্নতমানের এবং ভীষণ গুরুত্ব রয়েছে। দুটি ক্ষেত্রেই জীববৈচিত্র বিষয়ক এবং শৈল্পিক বিষয়ে উন্নত মানের ছিল। সেই সব ছবি একুশ শতাব্দীতেও শিল্পবেত্তাদের কাছে সমান জনপ্রিয়।‘’
ওই বিশ্ববিদ্যলয়ের ইতিহাসের শিক্ষক নন্দিনী মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘’শেখ যায়ান-আল-দিন ছিলেন মুঘল আমলের শিল্পী। আপনারা জানলে খুশি হবেন তিনি ছিলেন মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। তাই তাঁর পেন্টিংকে মুঘল আমলের পেন্টিং হিসেবে আমরা বিবেচনা করি।‘’
 স্লাইডে একটি ছবি দেখিয়ে নন্দিনী আরও বলেন, ‘’যেমন এই ছবিটা দেখছেন। এই ছবিতে পারসি ভাষায় লেখা রয়েছে। ‘নীল কন্ঠ পাখি পিপল গাছে’আমরা ছবির ঐতিহ্যের উপর কাজ করছি। আরও পরিকল্পনা আমাদের আছে।‘’
আমি জানতে চেয়েছিলাম ‘পটচিত্র’ নিয়ে কোনও পরিকল্পনা আছে কিনা? উত্তরে নন্দিনী বলেন, ‘’হ্যাঁ অবশ্যই। আমরা বীরভূম, মুর্শিদাবাদের ‘পটচিত্র’ বিষয়ে গবেষণা কিছুদিনের মধ্যে শুরু করব। এই মাধ্যমেও ভালো ছবি পাওয়া যাবে। পটচিত্রের ইতিহাসও মুঘল যুগের।‘’
এক্সিটার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক অ্যান্ড্রু রাডরা বলছিলেন, তাঁর বক্তব্যের শিরোনাম ছিল, ব্লু প্ল্যান্ট- II , ‘’বন জঙ্গলে হিংস্র পশুরাজ অনেকটা মানব শিশুর মতো যদি আমরা আমাদের অনুভব দিয়ে দেখি।‘’ তিনি স্লাইডে দেখান ডঃ উইলিয়াম রক্সবার্গ (১৭৫১-১৮৫১) এর ছবি। ১৭৮৭ সালের শিবপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনের ছবি আমরা দেখলাম স্লাইডের পর্দায়।
এক্সিটারের ভাইস- চ্যান্সেলর স্টিভ স্মিথ শুরুতেই বলেন, ‘’ব্রিটেন বর্তমান সময়ে নতুন বন্ধু খুঁজছে। ইউরোপের বাইরে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে এর উজ্জ্বল স্মভাবনা রয়েছে।‘’
জয়ন্তবাবু বলেন, ‘’এই যৌথ উদ্যোগ আমাদের নতুন পথ চিনতে সাহায্য করবে। পেন্টিংয়ের ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করছি। বিদেশের প্রথমসারির কোনও বিশ্ব বিদ্যালয়ের সঙ্গে আমরা এই ধরণের কাজ আগে করিনি।‘’
সংযোজনঃ এই লেখাটি ২ ডিসেম্বর, ২০১৮ রবিবারের বাংলা জনপ্রিয় দৈনিক ‘আজকাল’ পত্রিকার রবিবাসরের তৃতীয় পাতায় প্রকাশ হয়েছে। আজ আমি গর্ব অনুভব করছি। সাংবাদিকতার মূল ধারায় ১৯৮৪ সালে যোগ দেওয়ার কথা ছিল আজকাল পত্রিকায়। ১৯৮৪ সালে সাহিত্যিক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আমাকে তৎকালীন সম্পাদক পূষণ গুপ্তের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। পূষণবাবুর সঙ্গে পাকা কথাও হয়ে যায়। আমি আজকাল পত্রিকার বিনোদনের পাতায় জয়েন করব। কিন্তু না কোনও এক অদৃশ্য কারণে আমার চাকরিটা হল না। তারপর ৩৪ বছর পর কত চেনা পথ, অচেনা ফুটপাথ টপকে আজ সেই আশির দশকের স্বপ্নের কাগজের হাত ধরলাম। যারা পাশে এসে দাঁড়ালেন তাঁদের শুভেছা জানাই।                                                 
 


No comments:

Post a Comment