Saturday 15 December 2018

আরও এক ঐতিহ্যের সন্ধানে শ্রীঅরবিন্দের ভিটায়


দীপেন্দু চৌধুরী
গত কয়েক বছর ধরে কলকাতার বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী ভবন সংরক্ষণের দাবিতে শহরের ছাত্র-ছাত্রী, লেখক, বুদ্ধিজীবীরা পথে নেমছেন। ইউ এস কনস্যুলেট জেনারেল, কলকাতা এবং ফ্রান্স কনস্যুলেট জেনারেল, কলকাতা এই ধরণের নাগরিক আন্দোলনের পাশে থেকেছেন এবং থাকছেন। চন্দনগর একসময়ে ফ্রান্সের বাণিজ্যনগরী হিসেবে খাতি ছিল। সেই চন্দননগরের ফরাসি স্থাপত্যের সংরক্ষণের বিষয়ে ফরাসি কনস্যুলেট জেনারেলের কলকাতাস্থ অফিস ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।  কনস্যুলেট অফিস সূত্রে খবর, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় চন্দননগরের ফরাসি সভ্যতার স্মারক হিসেবে বাড়িগুলি অধিগ্রহণ এবং সৌন্দর্যায়নের কাজের সিদ্ধান্তও নিয়েছে কলকাতার ফরাসি কনসাল জেনারেল।
সম্প্রতি মধ্য কলকাতার বই পাড়ায় আরও একটি ঐতিহ্যবাহী বাড়ির খোঁজ পেলাম। আমার এক বন্ধুর আমন্ত্রণে কলকাতায় একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় গিয়েছিলাম। সেখানে আলাপ হয় শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দিরের একজন আধিকারিকের সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে জানতে পারি কলেজ স্ট্রীটের ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বর্তমানে ভগ্নপ্রায় যে বাড়িটি আছে, সেই বাড়িতে শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ আলিপুর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ১৯০৯ সালের মে মাস থেকে ১৯১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত তাঁর মেসোমশায় কৃষ্ণকুমার মিত্রের এই বাড়িতে ছিলেন। আমি ১৫ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দিরের দিলীপ কুমার চ্যাটার্জী সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি প্রথমে কিছু বলতে চাইছিলেন না। পরে আমার পরিচয় পেয়ে আমাকে কয়েকটা চিঠির ফটোকপি দিয়ে বললেন, ‘’আপনি এই চিঠিগুলি থেকে আমাদের বক্তব্য পেয়ে যাবেন। আমি আলাদা করে কোনও কথা বলতে চাইছি না।‘’  
রাজ্য সরকারের হেরিটেজ বিষয়ক বিভিন্ন দফতরে পাঠানো শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দিরের কয়েকটি চিঠির বিষয় থেকে জানা যাচ্ছে, কলেজ স্কোয়ারের পূর্বদিকে ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়ির ইতিহাসবাড়িটির স্মৃতি জড়িয়ে আছে উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত ব্রাহ্মনেতা কৃষ্ণকুমার মিত্রের নামের সঙ্গে। এই বাড়িটি আদতে কৃষ্ণকুমার মিত্রের আদি বাসভবন কৃষ্ণকুমার মিত্র তৎকালীন বিখ্যাত ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকার সম্পাদকও ছিলেন। ইতিহাস বলছে এই ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকা ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম মুখপত্র হয়ে উঠেছিল। যে পত্রিকাকে কেন্দ্র করে কৃষ্ণকুমার স্বদেশী আন্দোলনের প্রথম সারিতে চলে আসেন। যদিও কৃষ্ণকুমার নিজেও একজন স্বদেশী আন্দোলনের নেতা ছিলেন। স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে দীর্ঘদিন তাঁকে কারাবাস করতে হয়।
এই বাড়ির আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই ঐতিহাসিক বাড়িতেই এককালে বসবাস করেছেন বাংলার স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম নেতা শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ। তথ্য বলছে স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অপরাধে যে সমস্ত ছাত্র সরকারি স্কুল-কলেজ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল তাঁদের বিকল্প শিক্ষার জন্য ১৯০৬-এর অগস্ট মাসে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’ সেই প্রতিষ্ঠানই আজকের বিশ্ববন্দিত বিশ্ববিদ্যালয়। যাদপুর বিশ্ববিদ্যালয়। শ্রীঅরবিন্দ বরোদা থেকে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে কলকাতায় আসেন। এর পরের ইতিহাস ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম পরিচ্ছেদ। শ্রীঅরবিন্দ কলকাতায় এসেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বাংলার স্বদেশী আন্দোলনের একটি গোষ্ঠীর প্রধান নেতার দায়িত্বে চলে আসেন। ১৯০৮ সালে শ্রীঅরবিন্দ ‘আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলার’ অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেপ্তার হলেও প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যান। ওঠেন কৃষ্ণকুমার মিত্রের বাড়ি ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়িতে। এই বাড়িতে তিনি ছিলেন ১৯১০ সাল পর্যন্ত। যে তথ্য আমরা প্রথমেই উল্লেখ করেছি।
 ‘ধর্ম’ এবং ‘কর্মযোগিন’ পত্রিকায় ‘উদ্দেশ্যমূলক’ নিবন্ধ প্রকাশের অপরাধে ব্রিটিশ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। শ্রীঅরবিন্দ গ্রেফতার এড়াতে বাগবাজার গঙ্গারঘাট থেকে চন্দননগর পৌঁছান এবং সেখান থেকে পন্ডিচেরি চলে যান। ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়িটি বর্তমানে অন্যের দখলে আছে। শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দির কতৃপক্ষ বড়িটি রাজ্য সরকারের অনুমতিক্রমে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। সেই সিদ্ধান্তমতো শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দির কতৃপক্ষ ২০১২ সালের ২৯ অগস্ট পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারমযান শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্যকে একটি চিঠি লেখে। সেই চিঠিতে শ্রীঅরবিন্দের ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়িটির বিস্তারিত ইতিহাস এবং তথ্য উল্লেখ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারম্যান শুভাপ্রসন্ন ভট্টাচার্য ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১২ তারিখে শ্রীপাঠমন্দির কতৃপক্ষকে উত্তর লেখেন। চিঠির রেফারেন্স নম্বর (570/P-181/WBHC/2012-13) রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের চেয়ারমযান কলকাতা পুরসভার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দির কতৃপক্ষ পরে একটি চিঠি লেখেন কলকাতা পুরসভার কমিশনার খলিল আহমেদকে। পুরকমিশনার সঙ্গে সঙ্গে চিঠিটি পুরসভার পি এম ইউ বিভাগের ডিজি  দেবাশিষ করের কাছে পাঠিয়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে বলেন। ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দির কলকাতা পুরসভাতে দৌড়ঝাপ করার পরে ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ কলকাতা পুরসভার হেরিটেজ  কনভারশন কমিটির বৈঠকে (Memo No. MOA 27.4)নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়িটির বিষয়ে চেয়ারম্যান খলিল আহমেদের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের কমিটি একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছয় যে বাড়িটির দলিল দস্তাবেজ দেখে বাড়িটিকে ‘হেরিটেজ’ তালিকাভুক্ত করা হল। তিনমাস পরে ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ বিধায়ক এবং রাজ্য সরকারের আবাসন বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান তমোনাশ ঘোষ কলকাতা পুরসভার তৎকালীন মেয়র শোভন চ্যাটার্জীকে একটি চিঠি লেখেন। শ্রীঅরবিন্দের স্মৃতি বিজড়িত ৬ নম্বর বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটের বাড়িটির গ্রেড- ১ ঘোষণা করার অনুরোধ জানান তিনি
সম্প্রতি একটি সেমিনারে আমার সঙ্গে দেখা হয় বোম্বে হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আমি বিষয়টা প্রাক্তন প্রধান বিচারপতিকে জানাই। এবং প্রশ্ন করি শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দিরের কি করা উচিৎ। উত্তরে তিনি বলেন ‘’ওদের আর টি আই করে তথ্য বের করে আনতে বল। এবং প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে পারে।‘’
বিধায়ক এবং আবাসন বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান তমোনাশ ঘোষের চিঠির পরে প্রায় দু’বছর কেটে গেলেও কলকাতা পুরসভা এখনও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারল না। সিদ্ধান্ত ঝুলেই রয়েছে। শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দির সূত্রে খবর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে মধ্য কলকাতার অন্যতম শিক্ষায়তন অধ্যুষিত বই পাড়ায় শ্রীঅরবিন্দের স্মৃতি বিজড়িত এই বাড়িটিতে শ্রীঅরবিন্দের নামে একটি গবেষণাহাব বা গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তুলতে আগ্রহী শ্রীঅরবিন্দ পাঠমন্দির কতৃপক্ষ।                   
                  


No comments:

Post a Comment