Thursday 19 January 2017

গণতন্ত্র উচ্ছন্নে গেলে আমার কি?

গণতন্ত্র উচ্ছন্নে গেলে আমার কি?:  

পশ্চিমবঙ্গের আর্থ-সামাজিক উন্নতির কি আর কোনও প্রয়োজন নেই? রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি কি ভাবছে? গত মঙ্গলবার (১৭ জানুয়ারি, ২০১৭) রাজ্যের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার ভাঙড়ে ‘পাওয়ার গ্রিড’ এর জন্য জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। যার পরিণতি অতি সাধারণ দু’জন নিরীহ গ্রামবাসী তথা তরতাজা তরুণের মৃত্যু। সংঘর্ষে পুলিশের কয়েকজন আহত। পুলিশের ৩০-৪০টি গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। চার পাঁচজন নিরস্ত্র মহিলা পুলিশকর্মীকে গ্রামের মহিলারা আশ্রয় দেয়। পরে তাঁদের নিরাপদে গ্রাম থেকে বেড়িয়ে যেতে সাহায্য করে আক্রান্ত গ্রামবাসী। সংবাদ মাধ্যম লিখছে ভাঙড়ে এই ঘটনার প্রস্তুতি তিন মাস আগে থেকে। আমাদের কাছে যে খবর আছে সেটা তিন মাসের নয়। আরও অনেক অনেক আগের। ভাঙড়ে গড়ে ওঠা ‘পাওয়ার গ্রিড’ এবং পরে প্রস্তাবিত ‘তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র’ কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক পরিসর দখলের লড়াই শুরু হয়েছে বছর কয়েক আগে থেকেই। যে খবর রাজ্যের পুলিশ প্রশাসন জানলেও সম্ভবত চুপ করে ছিলেন। এবং গোয়েন্দা বিভাগের কাছে ঠিকঠাক খবর ছিলনা। এমনটা বিশ্বাস করার কোনও কারণ নেই উল্লেখ করা যাক মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাঙড়ের ঘটনা নিয়ে বৈঠক। মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তর নবান্নে বসেই বৈঠক করলেন। ওই বৈঠকের পরে সরকারিভাবে সংবাদ মাধ্যমকে জনানানো হয়, (১) ‘পাওয়ার গ্রিড’ প্রকল্প স্থগিত রাখা হল। (২) এলাকার কৃষি জমির চরিত্র বদল করা যাবে না। (৩) পুলীশকে আরও বেশি সংযত থাকতে হবে।
অথচ বুধবার তিনি বাড়ি থেকে বেড়িয়ে নবান্ন যাওয়ার পথে বেলা বারোটা নাগাদ ভবানী ভবন চলে যান। সংবাদ মাধ্যম লিখছে, ‘’মুখ্যমন্ত্রী সোজা চলে যান চারতলায়, সিআইডি-র এডিজি রাজেশকুমারের ঘরে। খবর পেয়ে তড়িঘড়ি চলে আসেন রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ কর পুরকায়স্থ, কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমার এবং এডিজি (আইন- শৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা। ভবানী ভবন থেকে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য জানান, বৈঠক ছিল একদমই ‘রুটিন’।‘’ বৈঠক ‘রুটিন’ ছিল মুখ্যমন্ত্রীকে বলতেই হবে। কিন্তু খুব সাধারণভাবে একটি কথা মনে আসে মুখ্যমন্ত্রী হঠাৎ পুলিশের হেড কোয়ার্টারে বৈঠক করতে এলেন কেন? প্রশাসনের কোথাও কি ছিদ্র হয়েছে? মাত্র কয়েক মাস আগে একাই ২১১ বলে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয় দফার জন্য দায়িত্ব নিলেন, তাঁর প্রশাসনের বাসর ঘরে কি কাল সাপ ঢুকে পড়ল?
এই লেখাটি লেখার আগে আমার পূর্ব পরিচিত দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা কংগ্রেসের (গ্রামীণ) সভাপতি অর্ণব রায়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বললাম। তিনি বললেন, ‘’আমরা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীর সঙ্গে ঘটনা স্থলে যাই। নিহত দুই পরিবার এবং আক্রান্ত পরিবারগুলির বাড়িতে যাই। খুব খারাপ লাগছিল গ্রামবাসীদের কথা শুনে। গ্রামের কয়েকজন জানাল, এই ঘটনা দু’ই নেতার গোষ্ঠী সংঘর্ষের কারণে হয়েছে। এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। পুলিশের ভয়ে অনেকে সেদিন গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। প্রার্থনা বাড়িতেও গ্রামবাসী আশ্রয় নিয়েছিল। সেইসব প্রার্থনা বাড়িতেও পুলিশ তল্লাশি চালায়।‘’
ভাঙ্গরে অপপ্রচার যে হয়েছে। অর্ণব বাবুর কথা থেকে পরিষ্কার। ভদ্রলোক যে হেতু দীর্ঘদিন রাজনীতি করছেন তাই ওই অঞ্চলের নাড়ীনক্ষত্র তিনি জানেন। রাজনৈতিক এবং সামাজিক কারণে তিনি আমার কাছে বিস্তারিত বলতে চাইলেন না। 
অর্ণববাবু আরও জানান, ভাঙড়ের ঘটনার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এই অঞ্চলের ৭০০ বিঘে জমি নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কম দামে কিনে রেখেছেন। শাসক দলের অনেকেই অনেক কিছু জানলেও চুপ করে আছেন। ভাঙড়ে শাসক দলের নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব আছে। পুরো বিষয়টা মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে আনা উচিত।‘’ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বুধবার ভাঙড়ে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘’তৃণমূলের  লোকজন পুলিশের পোশাক পরে গুলি চালিয়েছে।‘’
বুধবার সিপিএমের এক প্রতিনিধি দল ভাঙ্গরে যান। পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের নেতৃত্বে এক বাম প্রতিনিধি দল ওইদিন ভাঙ্গরে যান। প্রতিনিধি দলে সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার সম্পাদক শমীক লাহিড়িও ছিলেন। বুধবার সিপিএমের উত্তর ২৪ পরগনার জেলার উদ্যোগে যে সমাবেশ হয়, সেই সমাবেশে রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র বলেন, ‘’চোখ রাঙিয়ে প্রতিবাদ বন্ধ করে দেওয়ার দিন শেষ! আমরা আগের বারের চেয়েও বেশি লোক নিয়ে এবার নবান্নে যাব।‘’
পাশাপাশি কলকাতায় ভাঙ্গড়ের ঘটনার প্রতিবাদে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (APDR) ওইদিন মিছিল করে।   
সাংবাদিকতা করার সুবাদে ভাঙড় অঞ্চলে একাধিকবার গেছি। ভাঙড় বিধানভার কিছুটা অংশ জয়নগর সংসদীয় ক্ষেত্রের আওতায় পড়ে। কিছুটা অংশ যাদবপুর সংসদীয় কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে। মনে পড়ছে ২০০৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে প্রাক্তন সাংসদ কৃষ্ণা বসুর সঙ্গে ওইসব  অঞ্চলে কভার করতে যেতাম। ‘জি নিউজের’ প্রতিনিধি হয়ে। সেই সময় ওই অঞ্চলের গ্রামগুলি দুর্গম ছিল। গ্রামের বেশির ভাগ বাড়িতে বিদ্যুৎ প্রায় ছিল না বললেই চলে। রাস্তার অবস্থা আরও খারাপ ছিল। একমাত্র বাসন্তি রোডকে কেন্দ্র করে ভাঙড় মোড় কিছুটা জমজমাট ছিলসেই সময় যে হেতু বাম জমানা তাই গোষ্ঠী লড়াই, মাসল ম্যান, মস্তানদের উপদ্রব খুব কিছু কম ছিল না। প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি ছিল সাধারণ ব্যাপার। এই সময় কৃষ্ণাদি বলেছিলেন, ‘’মজার গল্প শুনেছি, স্বাধীনতার আগেও নেতৃবৃন্দ মাসলম্যান না হোক, নিজস্ব সমর্থক বাহিনী, বলা যায় চিয়ারলিডার পুষতেন। নেতার বক্তৃতা শেষ হলে তাঁরা পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলত, ‘আভি ক্যায়া? তালিয়া? ইয়া ছেম ছেম?’ হাততালি দেবে কখন বা শেম শেম বলবে কখন, তা বুঝে উঠতে পারত না। এককালে মাসলম্যানরা নেতাদের অধীন ছিল। এখন অনেক ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন সৃষ্টি হওয়ার ফলে তাদের উপর কারও নিয়ত্রণ নেই। এদের প্রবল প্রতাপ বন্ধ হওয়া জরুরী।‘’ আমার খেরোর খাতা থেকে লেখাটি তুলে দিলাম। গত বছর এপ্রিল মাসে কৃষ্ণাদি কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি বাংলা দৈনিকে উত্তর সম্পাদকীয় কলমে প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন।                      

‘পাওয়ার গ্রিড’ যে অঞ্চলে হচ্ছে ভাঙড়ের মাত্র ৭-৮ টা গ্রাম এই আওতায় আসছে। বাকি সমস্ত এলাকা নিউ টাউন-রাজারহাট সন্নিহিত। সূত্রের খবর রাজনৈতিক জমি দখলের লড়াটাই মূল লড়াই। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে রাজ্যের উন্নয়ন কোন রাজনৈতিক দল চায় না? সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম ট্রাজিক রাজনীতির পরে উন্নয়ন নিয়ে কোন দল আহাম্মকের মত ঝুঁকি নিতে যাবে? বাংলার অভিঞ্জ বামপন্থী নেতৃত্ব ‘ঘর পোড়া গরু’। তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলে তাঁরা জানেন তাঁদের কি করতে হবে।
অতীত অভিঞ্জতা থেকে বলা যায় বর্তমান পুঁজি নির্ভর শিল্পে অদক্ষ চাষীদের নিয়গের সম্ভবনা খুবই কম। উদাহারণ হলদিয়া পেট্রকেমিক্যালস। একটি তথ্য বলছে, ২০০২ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এই রাজ্যে ১ লক্ষ ২৩ হাজার একর কৃষি জমি লুপ্ত হয়েছে। ওইসব জমিতে গড়ে প্রতি একরে ১১ কুইন্টাল চাল উৎপন্ন হত। আনুমানিক ৭ লক্ষ মানুষের এক বছরের খাবারের যোগান দিত। প্রশ্ন ঠিক এই জায়গা থেকেই। সিঙ্গুরের পরিণতি আমরা দেখলাম। জমি অধিগ্রহণ না হলে শিল্পায়ন হবে কি করে? রাস্তা প্রশস্ত না হলে শিল্পায়নের শর্ত পূরণ করবে কে? ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ রাজ্যের মুখ্যসচিবদের নিয়ে প্রথম বাৎসরিক সম্মেলন করেন। সেই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য রাখেন সেই বক্তব্যের পুরো অংশটা পুস্তিকা আকারে ভারতীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক প্রকাশ করে। ওই পুস্তিকা থেকে দু’টি বিষয় উল্লেখ করছি।
Inclusive Growth is Essence of Development Process
‘’AS you are all well aware, inclusive growth is the centre-piece of our development process. Fast economic growth has little meaning if it does not lead to the well being of the poor and the disadvantaged, of our farmers, workers, our children, students and women. The benefits of the development process have to percolate to every part of our country and to every section of our society if we want to progress in the true sense of the term and be a strong and cohesive nation. The Central Government has attached the highest importance to our growth being inclusive in nature. But India lives in States. Unless the States move ahead and move forward at a pace that is adequate to the challenges that we face, I think we cannot claim that we have delivered inclusive growth. The inclusive growth that we talk about is reflected in the launching of schemes like the Mahatma Gandhi National Rural Employment Programme……………’’ Page- 3
Rule of Law is Prime Responsibility
‘’It is one of the primary responsibility of any government to ensure the rule of law. In addition, an atmosphere of peace and communal harmony is also a pre-requisite for rapid economic growth. The law and order machinery has to be sensitized to the key security concerns that affect us. Terrorism, insurgency and extremism need to be tackled with a firm but effective and sensitive hand. You have to be aware not only of local and regional happenings but also of pan-India and trans-boarder developments. It is my hope that this conference will help you in getting a better perspective on some of these issues. ‘’ Page- 4/5
পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক মানচিত্রে এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ৮ নভেম্বর, ২০১৬, কালো টাকা চিহ্নিত করতে যে অভিযান হয়েছে সেটা নিয়ে বিরোধীদের আপত্তি রয়েছে। আপত্তি রয়েছে ‘নোট বাতিল’ করার সিদ্ধান্ত তথা সময় নিয়েও। শীতকালীন অধিবেশন চলাকালীন বিরোধীরা কংগ্রেস সহ সভাপতি রাহুল গাঁধির নেতৃত্বে একজোট হয়ে সংসদের ভেতরে এবং বাইরে আন্দোলন করে। সেই আন্দোলনে তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদরাও ছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সময় নিজেও দিল্লী গিয়েছিলেন। এর পরে বিজেপি শিবির থেকে বলা হয়, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিএম এবং তৃণমূল কংগ্রেস এক সুরে এক মঞ্চে কি ভাবে রাজনীতি করে আমরাও দেখছি।
খুব ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন তুলছি, খড়গপুর, ভাঙড় এবং বাকড়াহাটের রসপুঞ্জের ঘটনার পর রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলির অবস্থান কি হবে? কারণ পঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের পরে কংগ্রেসের সহ সভাপতি রাহুল গাঁধির নেতৃত্বে কংগ্রেস তুলনামূলকভাবে  ভালো অবস্থানে থাকবে। উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী পার্টীর সঙ্গে কংগ্রেসের জোট গড়ে ওঠা আমাদের সেই বার্তা দিচ্ছে। দেশে এবং আমাদের রাজ্যে বিরোধীদের কাছে রাজনৈতিক পরিসর তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছেবিষয়টা তাই গণতন্ত্র উচ্ছন্নে গেলে আমার কি এসে যায় এমনটা নয়। দেশের সাধারণ নাগরিক আমরা। তাই ‘Liberal democratic bargain’ বা উদার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করব না?                       
                                             

No comments:

Post a Comment