Monday 19 December 2016

সম্পাদক এবং রাজনীতি

সম্পাদক এবং রাজনীতি: 

দীপেন্দু চৌধুরী 
শীতের কলকাতায় ইতি উতি নানা অনুষ্ঠান। কোথাও সাংস্কৃতিক, কোথাও অ-সাংস্কৃতিক, কেউ কেউ সেমিনার করছেন। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি। কিন্তু সেদিন ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৬ সন্ধে সাড়ে পাঁচটায় ‘ভারতীয় সংগ্রহালয় কলকাতা এবং ‘অনুষ্টুপ’ ’ এর নিবেদন ছিল ‘সমর সেন শতবর্ষ স্মারক বক্তৃতা ২০১৬’সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘরানার এক অনুষ্ঠান। মানসিকভাবে কিছুটা সয়ে উঠতে পেরেছি বুঝে সেদিনের অনুষ্ঠানে চলে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে অনুষ্টুপ পত্রিকার সম্পাদক অনিল আচার্যকে একটা ফোন করে নিয়েছিলাম পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে। সেদিনের অনুষ্ঠানের মূল বক্তা ছিলেন খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ, লেখক ও লরেন্স এ. কিম্পটন ডিসটিংগুইসড সার্ভিস অধ্যাপক, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র-এর দীপেশ চক্রবর্তী। বিশেষ অতিথি ছিলেন শঙ্খ ঘোষ এবং অনুষ্ঠানের সভামুখ্য ছিলেন নির্দেশক, সেন্টার ফর স্টাডিস ইন সোসাল সায়েন্সেস (কলকাতা) এর তপতী গুহঠাকুরতা। এদিনে বক্তব্যের বিষয় ছিল মানবিকতা, অ-মানবিকতা।
অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু সাদা চোখে ‘Humanism-in humanism’ বলেই মনে হয়েছিল আমাদের মত কম লেখা পড়া জানা আনপোড় বঙ্গজদের। অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী বলছেন, ‘’ মানবিকতা- যে চিন্তার কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ। আর অমানবিকতার কেন্দ্রেও রয়েছে মানুষ। সুনীল জানার ছবি মানবিক। দুর্ভিক্ষের সময় মৃত মানুষের দেহে মাংস নেই তবু খাচ্ছে একটা কুকুর। কুকুরটার দেহেও মাংস নেই।‘’ দীপেশবাবু আমাদের খুব কম কথায় ‘মানবিকতা এবং অমানবিকতা’ বুঝিয়ে দিলেন।
শুরুতেই ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকার বর্তমান সম্পাদক তিমির বসু আমাদের মনে করিয়ে দিলেন সম্পাদক সমর সেনের হার না মানা লড়াইয়ের কথা। তিনি বললেন, ‘’বিপ্লব যখন নেই তখন ফ্রন্টিয়ার প্রকাশ করে কি হবে? এরকম মতামত আজও আছে। ফ্রন্টিয়ার কোনও ধারাবাহিক নিয়ম মেনে চলেনি। কেউ কেউ পড়ত। বিভিন্ন লেখা থেকে আমরা জানি তিনি কি কষ্টে পত্রিকা চালাতেন।‘’
আমার নিজের অভিঞ্জতাই বলতে পারি আমি দু’তিনবার আশির দশকে ‘ফ্রন্টিয়ার’ অফিস থেকে পত্রিকা নিয়ে এসেছি। দূর থেকে সমর বাবুকে দেখার সুযোগ হয়েছে। নিবিড় কৌতূহল থেকেই দেখতাম। সেই সময় অতি বামপন্থীদের কাছে সমর সেন খুব সম্ভবত কমিউনিস্ট এবং বিপ্লবী ছিলেন না। তাই তৎকালীন আমাদের বামপন্থী অভিভাবকদের নিষেধ ছিল ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকা পড়া। যদিও সেইসব নেতৃত্ব আমাদের আড়ালে সম্পাদক সমর সেন কি লিখলেন সেটা তাঁরা পড়ে নিতেন।
মনে পড়ে ১৯৮৭ সাল। তখন বিভিন্ন গণসংগঠন এবং সাংবাদিকতা করার সুবাদে বামপন্থীদের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সেই বছর খুব সম্ভবত লোকসভা এবং বিধানসভার নির্বাচন ছিল। আমি আমাদের নলহাটির বাড়িতে ছিলাম। একদিন কমরেড কানু সান্যাল আমাদের বাড়িতে এলেন। সারাদিন ছিলেন। মায়ের হাতের রান্না খেতে তিনি খুব ভালোবাসতেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল। আমার পড়ার টেবিলে ফ্রন্টিয়ার দেখে জানতে চাইলেন, তুমি ফ্রন্টিয়ার পড়? আমি খুব ভয়ে ভয়ে বলেছিলাম, নিয়মিত নয়। তা ছাড়া আমি ইংরেজি ভালো বুঝিও না।
কানুদা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পরে বলেছিলেন, ‘’একজন যোগ্য সম্পাদকের কাগজ ‘ফ্রন্টিয়ার’‘’ এই কথার প্রতিধ্বনি পেলাম অনুষ্টুপ পত্রিকার সমপাদকের বক্তব্যেঅনিল আচার্য বললেন, ‘’সমর সেনের মত একজন মানুষ ছিলেন বলেই আমরা উৎসাহ পেতাম। সমরবাবু বেঁচে থাকাকালীন শেষ পাঁচ সাত বছর ওনার বাড়িতে যেতাম। তখন কিভাবে পত্রিকা চালাতেন সেসব দেখেছি। সমরবাবু বলতেন, ‘আমি ভাবিনি মাছের তেলে মাছ ভাজতে পারব।’ ফ্রন্টিয়ার এতটাই জনপ্রিয় ছিল। অনেকের কাছে প্রশ্ন ছিল তিনি কি কমিউনিস্ট? তার উত্তর ছিল সম্পাদককে মার্ক্সবাদী হতে হয়না। নিজেকে কমিউনিস্ট হিসাবে গড়ে তুলতে হয়।‘’
অনিলদার কথার সূত্রে মনে পড়ছে সম্পাদক সমর সেনের সাংবাদিক এবং সম্পাদক হিসাবে ক্ষমতা   এবং উচ্চতার বিষয় বা তাঁর ঘরানা। কংগ্রেস এআইসিসির একটি বৈঠকে জওহরলাল লাল নেহরুর বক্তব্যের কিছুটা অংশ তিনি সংবাদ হিসাবে প্রকাশ করেছিলেন। সম্প্রতি ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য স্টেটম্যান’ পত্রিকায় ১৩ নভেম্বর তারিখে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয় তার কিছুটা অংশ এখানে উল্লেখ করলাম। সমর সেন কতটা সম্পাদক এবং সাংবাদিক ছিলেন?
‘’The autumn issue of Frontier, of which Samar Sen was the founder-editor, has appropriately been devoted to his centenary as a mark of profound respect for the man. 
The story goes that when Samar Sen was the Night Chief Sub-Editor of  The Statesman some time in the Fifties, the formidable Editor, George Arthur Johnson, had called up to be briefed on the day’s top stories. “I’m too busy,” was the almost astonishingly blunt retort from the gentleman in charge of the desk, marking an abrupt end to the Editor’s “night call”... during peak hour. When Johnson recounted his experience at next morning’s editorial conference, Lindsay Emerson immediately left the high table  and  drove down to Sen’s residence... to congratulate him on how he had cut the Editor off.                      
The autumn issue of Frontier, of which Samar Sen was the founder-editor, has appropriately been devoted to his centenary as a mark of profound respect for the man. Sad to reflect though, it has somehow missed such anecdotes as when he had hacked Jawaharlal Nehru’s address to the AICC session to one paragraph. It was a truly extraordinary career as poet, journalist — with AIR, The Statesman, Hindusthan Standard, and then as editor of  Now — not to forget his career as translator in Moscow and eloquent sympathies  for the Left radicals. The striking feature of his working life being that it was a brief stint wherever he went, including an advertising agency.  A brilliant student, he had distinguished himself as a poet, though it remains a mystery to this day as to why he gave up writing poems.  It is a  mystery that the contributors to the centenary edition — notably Sumanta Banerjee — have not been able to fathom for Sen reserved the right not to answer  the puzzling question — Why? Overall, his career both as a journalist and more importantly as poet is testament to his somewhat restless and non-conformist temperament, preferring to live and work on his terms, abjuring the conventional and the populist. His poems were extraordinary, of a calibre that many writers would be proud of, but few able to claim.  This is the fine print of the commemorative issue — he had distinguished himself and in a remarkably self-effacing manner long before “lit fests” ,  book fairs and book “launches”  became sales-promotion programmes and fashionable diversions for the urbanite.’

অনুষ্টু স্ম্র সেন সংখ্যায়, ১৯৮৮ তে প্রকাশিত সুম্নত বন্দ্যোপাধ্যায় 'সিমান্ত পেরিয়ে' শিরোনামে লিখছেন, 

''আনন্দবাজা‌রের' পাতায় তখন দৈ‌নিক দেশপ্রে‌মিকতার বাণী বার হ‌চ্ছে; উৎকট স্বা‌দে‌শিকতার আগুন ঝর‌ছে l একদিন সমরবাবু প‌ত্রিকার তৎকালীন মা‌লিক অশোক সরকা‌রের ঘ‌রে গি‌য়ে বই-এর তাক থে‌কে Dictionary of Quotation-এর ক‌পি বার ক‌রে পড়‌ছেন l অশোকবাবু জি‌জ্ঞেস কর‌লেন--"‌কি ব্যাপার সমরবাবু? কি খঁুজ‌ছেন?" নি‌র্বিকার মু‌খে সমরবাবু জবাব দি‌লেন--"‌দেখ‌তে এসে‌ছিলাম Dr. Johnson আস‌লে কি লি‌খে‌ছি‌লেন-- Patriotism is last resort of Scoundrels, না first resort of Scoundrels."
- সুমন্ত ব‌ন্দোপাধ্যায় , 'সীমান্ত পে‌রি‌য়ে' , অনুষ্টুপ , সমর সেন সংখ্যা,১৯৮৮


অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী খুব সম্ভবত এই প্রাসঙ্গিকতা মনে রেখেই সেদিন বললেন, ‘’আমি সাহিত্যের মানুষ নই। সমর সেনের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করি সেই সামর্থ আমার নেই। সমর সেনের কবিতা আমরা বন্ধুরা ন্যাশন্যাল লাইব্রেরি থেকে ফেরার পথে আবৃত্তি করতাম। আজ মনে হচ্ছে ওর বাড়ির সেদিনের আড্ডাগুলিতে যদি আমি থাকতে পারতাম। অথবা ওর বাড়ির আড্ডাটা এই সেমিনারে যদি নিয়ে আসতে পারতাম। যে অবস্থান থেকে লেখার ফলে সরোজ দত্তের সঙ্গে ওর মুখোমুখি আলোচনা হয়েছে‘’ দীপেশ আমাদের মনে করিয়ে দেন বিদেশে থাকার জন্য তাঁকেও ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ হয়ে গেছেন এমনটা শুনতে হয়। কিন্তু তবু অধ্যাপক দীপেশ চক্রবর্তী বলেন ‘’কলকাতা আমার আত্মা। আমি চল্লিশ বছর সাদাদের দেশে আছি। কিন্তু কলকাতায় এলে আমার ঝগড়া হয়। আত্মীয়-ঞ্জাতি ছাড়াতো ঝগড়া হয় নাতাই কলকাতা আমার আত্মা। বাংলা আমার আত্মীয়। তবু শুনতে হয় দীপেশ এখন প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেছে। গদ্যের প্রকরণ এবং গদ্যের চরিত্রের জন্যই আপামর স্থানিক একটা ব্যপার থেকে যাবে। যেটা গায়ত্রী স্পীভাকের বইয়ে আমরা পেয়েছি। যারা ভাবেন তাঁরা আত্মজীবনীর বাইরে সমাজের কথা বলতে চান।‘’
তিনি তার অ-অনুকরণীয় ভাষায় বলেন, ‘’সমরদা জানতে চাইলে একটা গল্প বলতাম। বিশ্বায়নের গল্প। বিশ্ব উষ্ণায়নের গল্প। কিয়োটো চুক্তির কথা বলতাম। তখন আমেরিকা রাজি হয়নি। এই উষ্ণায়ণ বিষয়গুলিকে ধনতন্ত্রের সংকট বলেই ধরা হয়। মাত্র কয়েকটি দেশ গ্রীন হাউস গ্যাসের জন্য দায়ি। মানুষের জন্য যে সাহায্য করে তার একটা ধান্দা আছে। এই চিন্তায় ‘ফুকো’ মার্কস সাহায্য করে। ‘New Temple of Modernization’- নেহরু, নাসেররা ভাবতেন। বাঁধ তৈরি। ষাটের দশকে আলোচনা হত এরপর কি হবে? যদি প্রাপ্তি শেষ হয়। ১৯৭৮-৮১ তে ফুকো বলছেন, কান্ট মানুষ এবং পৃথিবীকে পর্যাপ্ত দিয়েছেন ঠিকইকিন্তু এগুলি রাজনীতির বিষয়। ফুকো বলছেন ‘বাইয়ো পলিটিক্স’ ‘’

সেদিন অন্য কাজ থাকাই আমি শেষ পর্যন্ত সভাঘরে থাকতে পারিনি। যে বিষয় নিয়ে দীপেশবাবু বলছিলেন সেই বিষয়ে একটি প্রবন্ধ আমরা আগে পড়েছি। ‘বারোমাস’ পত্রিকার বড়দিন ২০১৪ সংখ্যায় তাঁর তাত্তবিক প্রবন্ধ ‘মানুষের যুগঃ অ্যানথ্রোপোসিন’ সম্ভবত এই বিষয়গুলি ছুঁয়ে যায়।                   

No comments:

Post a Comment