Tuesday 13 December 2016

বাংলার মাটি বাংলার মেধা

বাংলার মাটি বাংলার মেধা

দীপেন্দু চৌধুরী 

এই লেখাটি লেখার জন্য প্রাক প্রস্ততি ছিল না। একদম হঠাত লিখতে বসা। কিছুটা নিজের সীমাবদ্ধতা টপকে। কলকাতা প্রেস ক্লাবের বাঞ্ছিত সদস্য না হয়েও বর্তমানে সাংবাদিক সম্মানে মেল পাই আমার বিতর্কিত ই-মেলের ঠিকানায়। আজ (১৩ ডিসেম্বর ১৬) সকালেও এমনি একটি চিঠি বা আমন্ত্রণ লিপি দেখে এই লেখার সূচনা। প্রেস ক্লাবের বর্তমান সম্পাদকের আমন্ত্রণি মেলের ভাষা ছিল ‘’This is to inform you that the U.S. Ambassador to India Mr. Richard Verma will participate at a meet the press programme at the press club, Kolkata, on 14 December 2016, (Wednesday) at 4 P.M.
I would like to request you to kindly attend the program.’’ 
প্রথমেই মনে করা যাক খুব সম্ভবত বছর তিন চার পর আবার কলকাতা আসছেন ভারতে নিযুক্ত কোনও মার্কিন রাষ্ট্রদূত। যদিও ২০১১ সালে তৃণমূল প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টন মহাকরণে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।  আপনাকে অভিনন্দন মাননীয় রিচার্ড বর্মা সাহেব। আপনি আসছেন নির্দিষ্ট এজেন্ডা এবং পরিকল্পনা নিয়ে। এমন একটা সময়ে আপনি কলকাতায় আসছেন যখন ভারতে ‘এফডিআই’ বিতর্ক শেষে ‘জিএসটি’ বিতর্ক বিদ্যমান। ভারতীয় অর্থনীতির সংস্কারে যেটা আবশ্যিকভাবেই প্রয়োজন। ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ-এর পথ নির্দেশিকা মেনে আধুনিক ভারত আজ আরও আধুনিক হওয়ার দাবি নিয়ে বিশ্বের দরজায় কড়া নাড়ছে। যার সূচনা করেছিলেন কংগ্রেস শাসনাধীন আরও এক প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। রাজীব গাঁধির হাত ধরেই আমরা ভারতে আধুনিক ‘টেলিকম প্রযুক্তি’ চিনি।
বর্তমানে কালো অর্থনীতির বোলবোলা বন্ধ করতে নেওয়া হয়েছে নোট বাতিলের মত সাহসী এক পদক্ষেপ। ‘ক্যাশলেস ইন্ডিয়া’ নিয়ে খুব বেশি বিতর্ক না থাকলেও ‘ক্যাশলেস ভারত’ নিয়ে রয়েছে বিস্তর চাপানউতোর। বিশেষত সময়কাল সঠিকভাবে নির্ধারণ না হওয়া নিয়ে বিতর্ক। এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের হয়রানি নিয়েও সংবাদ মাধ্যমে চলছে আলোচনা। সংসদের চলতি অধিবেশন শুরুই হয়েছে টানটান উত্তেজনা দিয়ে। বিশেষঞ্জদের অভিমত ‘ডিজিটাল ভারত’ হোক। এসব নিয়ে আপত্তি নেই কিন্তু প্রস্তুতি ছাড়া এই রকম সিদ্ধান্ত কিছুটা তাড়াহুড়ো হয়ে গেল না? প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা খ্যাতনামা ভারতীয় অর্থনীতিবিদ ডঃ মনমোহন সিংহ বলেছেন, এই সিদ্ধান্তের জন্য আমাদের খেসারত দিতে হবে। এই বিষয়টা যদি জাতীয় হয় আন্তর্জাতিক সময়টা নিয়েও ভাবার প্রয়োজন রয়েছে। আপনার নিজের দেশে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। নতুন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে শিল্পপতি। তাই আশা করা যায় গত কয়েক দশক আর্থসামাজিকভাবে অবহেলিত পশ্চিমবঙ্গ সহ উত্তর পূর্ব ভারতকে তিনি গুরুত্ব দেবেন। ঠিক বিদায়ী প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যে দূরদৃষ্টি নিয়ে ভারতকে দেখেছেন আমরা জানি আমাদের দেশে ইউপিএ সরকার কলকাতাকে কেন্দ্র করে ‘লুকইস্ট পলিসি’ তৈরি করেছিল। সেই নীতির বর্ধিত পলিসি বর্তমান এনডিএ সরকারের ‘অ্যাক্টইস্ট’ পলিসি।
আধুনিক ভারত উত্তর আধুনিক হয়ে উঠছে। সারা বিশ্বের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনায় আমরা বিশ্বাসের সঙ্গে উচ্চারণ করতে পারি আমাদের তরুণ প্রজন্ম তৈরি নতুন ভারতের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। যে কথা ১৮ জানুয়ারি ২০১৩ তে আমাদের মনে রাখার কথা বলেছিলেন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধি। তিনি বলেছিলেন, ‘’নতুন, পরিবর্তিত ভারতকে চিনতে হবে। যে ভারতে নবীন প্রজন্মের সংখ্যা বাড়ছে। তুলনায় যাঁরা আগের থেকে অনেক বেশি শিক্ষিত। সামাজিক পরিবর্তনের জন্য তাঁদের আকাঙ্খা, অসহিস্নুতা এবং চাহিদাও তাই বেশি।‘’
কংগ্রেস সভানেত্রী সময়টা বেছে নিয়েছিলেন ২০১৩ সালে কংগ্রেসের চিন্তন শিবিরের উদ্বোধন মঞ্চএই চিন্তন শিবির থেকেই ভারতীয় তরুণ প্রজন্মের কাছে রাহুল গান্ধিকে তুলে ধরা হচ্ছে। রাহুল গান্ধিকে সহ-সভাপতি করে আনুষ্ঠানিক সিলমোহর দেওয়া হয় ওই মঞ্চে।
এশিয়া মহাদেশে ভারতের গুরুত্ব অপরিসিম। বিশেষত চিন নামক একটি দেশের আধুনিক বাজার অর্থনীতির সঙ্গে তুলনায়। মার্কিন বিদেশ নীতির তাত্ত্বিক খাতায় ইতিপূর্বে বিষয়টি নিশ্চয়ই গুরুত্ব সহকারে আলোচনা হয়েছে। ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে পুনঃ প্রকাশিত New York  Times, News Service এর Jonathan Weisman এর লেখা খবরে ছিল, ‘’Experts say that is giving rise to a more chaotic global shift, especially toward China, which even Obama administration officially worry is extending its economic influence in Asia and elsewhere without following the higher standards for environmental protection, worker rights and business transparency that have become the norms among western institutions.
…………………President Obama told ‘’The fastest-growing markets, the most populous markets, are going to be in Asia, and if we do not help to shape the rules so that our business and our workers can compete in those markets, then China will set up the rule that advantage Chinese workers and Chinese businesses.’’
ভারতের গুজরাট নামক একটি অঙ্গরাজ্য উদার অর্থনীতির সুযোগকে ধারাবাহিকভাবে কাজে লাগিয়ে ২০১৫ সালে ‘ভাইব্রান্ট গুজরাট’ বা ‘চনমনে গুজরাট’ শিরোনামে একটি মহা সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। দীর্ঘ ২০ বছর ধরে প্রস্তুতির পরে গুজরাট নামক রাজ্যটি দেশের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে তুলনায় শিল্পায়নে এগিয়ে থাকলেও সমাজ উন্নয়নে সমানতালে এগতে পারেনি এমনটাই দাবি বিরোধী দল, সংবাদ মাধ্যম এবং সমাজ কর্মীদের।  
সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর ২০১৫ সালের সম্মেলনে ১২টি সহযোগী দেশের রাষ্ট্রনেতা ও ১০০টি দেশের শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গুজরাটের ভূমিপুত্র নরেন্দ্র মোদী বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রধান জিম ইয়ং কিমকে মনে করিয়ে দিয়ে  বলেছিলেন, ‘’শেষ বার নয়াদিল্লি সফরে এসে আপনি জানিয়েছিলেন এ দেশে লগ্নির প্রক্রিয়া সরল করতে হবে। সরলীকরণের ক্ষেত্রে ভারত এখন ১৫০ –এর ও নীচে। তার উন্নতি দরকার।‘’ পরে প্রধানমন্ত্রী যোগ করেন, ‘’আমি কথা দিচ্ছি , পুরনো জমানা শেষ। এ বার আপনারা এক কদম এগোলে আমরা দু’কদম এগিয়ে আসব। আসুন এদেশে বিনিয়োগ করুন।‘’
গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, কর্ণাটক, কেরল রাজ্যের সঙ্গে পশিমবঙ্গের তুলনা  চলে না। কারণ সেই পুরনো কাসুন্দি। অবহেলিত পূর্ব ভারতের প্রধান রাজ্য আমাদের বাংলা। এই বাংলার মাটিতে সবুজ শস্য ফলে। বাংলার নরমমাটি, বাংলার জলবায়ু সৃষ্ট প্রকৃতি অতিথি বাৎসল্য। ফুলে ফলে আমরা উন্নতি করলেও ‘শিল্পায়ন’ নামক শব্দটি আমাদের কাছে অপরিচিত ছিল। ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়ের জমানার পর থেকে। বামফ্রন্ট সরকার তাঁদের শাসনকালের শেষ পাঁচ বছর ‘শিল্পায়ন’-এর জন্য উদ্যোগ নিলেও বিভিন্ন বিতর্কে সেই প্রচেষ্টা আটকে যায়। বর্তমান তৃণমূল সরকার মাত্র তিন বছর ‘শিল্প সম্মেলন’ করছে। রাজ্য সরকার সূত্রে খবর গত দু’বছরে রাজ্যে প্রস্তাবিত বিনিয়োগ আনুমানিক ৫ লক্ষ হাজার কোটি টাকা মাত্র। এমন একটা সময়ে আমাদের রাজ্যে ভারতে নিযুক্ত আমেরিকার বর্তমান রাষ্ট্রদূত রিচার্ড বর্মা আসছেন। আপনাকে নতুন করে মনে করিয়ে দেব আমাদের এই বাংলা শিল্পে পিছিয়ে থাকলেও রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র,রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ রায়, রামকিঙ্কর, অমর্ত্য সেন এবং মাদার টেরেজার বাংলায় মেধার অভাব নেইবরেণ্য ব্যক্তিত্ব জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, মেঘনাথ সাহা যে বাংলার ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন আমরা আজও সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছি। এই বাংলার মাটি এই বাংলার মেধা আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
আমরা জানি প্রতিরক্ষা, বিমান, ওষুধ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ সহ খুচরো ব্যবসার ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির দরজা কার্যত খুলে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় শর্তও তুলে দেওয়া হয়েছে। এইসব কারণে ‘অ্যাপল’ সহ একাধিক সংস্থা নিজস্ব বিপণি খুলতে পারবে। এছাড়া ভারতে তাঁদের পণ্য তৈরি করতে পারবে। আধুনিক ভারতের এই মানচিত্রে বর্মা সাহেব পশ্চিমবঙ্গ থাকবে আশা করি। কারণ ১ জুলাই, ২০১৬, সালের প্রভাতি সংবাদ মাধ্যমে খবর ছিল, ‘’কলকাতা শহরের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক বহু দিনের। ভৌগলিক অবস্থানের বিচারে এ রাজ্যের গুরুত্ব তাঁদের কাছে অনেক। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর আতিথেয়তায় তাঁরা মুগ্ধ। সুতরাং এ রাজ্য এবং রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে ধারাবাহিক ভাবে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার বার্তা দিয়ে গেলেন মার্কিন বিদেশ দফতরের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি থমাস এ শ্যানন।‘’
সেদিনের সকালের দৈনিক খবরের কাগজে আরও ছিল। নবান্নে এক ঘণ্টার বৈঠক শেষে শ্যানন বলেন,  ‘’ভারত মার্কিন সম্পর্ক এখন শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে। কলকাতা নিয়েও মার্কিন প্রশাসনের দারুণ আগ্রহ রয়েছে। ১৭৯২ সালে এই শহরে প্রথম মার্কিন দূতাবাস তৈরি হয়েছিল।‘’
ঔপনিবেশিক ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে আমেরিকার সঙ্গে আমাদের এই বাংলার নিবিড় আর্থ-সামাজিক সম্পর্ক আছেউচ্চশিক্ষিত বাঘা বাঘা সব বাঙালি আমেরিকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে আছেন। তাঁদের সান্নিধ্যে আমাদের এই বাংলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্র সহ নারী এবং শিশুদের কল্যাণে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়ার জন্য বাংলার আপামর মানুষ আপনাদের পথ চেয়ে বসে আছে। আপনারা স্মার্ট সিটি গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিন। পাশাপাশি উত্তর আধুনিক বাংলা গড়ে তুলতে আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে আপনাদের একান্ত প্রতিবেশি রাজ্যটির মনন গড়তে সাহায্য করুন ভারতে নিযুক্ত বর্তমান মাননীয় মার্কিন রাষ্ট্রদূত রিচার্ড বর্মা মহাশয়, এই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আপনাকে এবং নতুন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প মহাশয়কে অনুরোধ জানাচ্ছি।                                                                              

    

No comments:

Post a Comment