Wednesday 31 August 2016

বাংলায় সামাজিক পরিবর্তন

বাংলায় সামাজিক পরিবর্তন

দশ বছর পর সিঙ্গুর জমি অধিগ্রহণ মামলার রায় বেরল। মহামান্য উচ্চ আদালতের রায় সিঙ্গুরের জমিহারাদের পক্ষে গেছে। সিঙ্গুরে ইতিমধ্যে বিজয় উৎসবও শুরু হয়ে গেছে। রায় নিয়ে বিস্তারিত এই স্তম্ভে লেখাটা কিছুটা ঔদ্ধত্য হয়ে যাবে হয়ত। কারণ সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম অনেক অনেক তত্পড়তার সঙ্গে আমাদের কাছে খবর পৌচ্ছে দিচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি ২০০৬ সালে সাংবাদিকতার সুবাদে সিঙ্গুর নিয়ে অনেকগুলি খবর করি। ওই বছর আমি কলকাতা হাইকোর্ট কভার করতাম একটি প্রথমসারির বাংলা সংবাদ চ্যনেলের সাংবাদিক হিসাবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে কিছুদিন আগে আমার ব্লগে সিঙ্গুর নিয়ে একটি লেখা লিখেছিলাম আমার পুরনো নোটবুক অনুসরণ করে। লেখাটির কিছুটা অংশ আবার নীচে উল্লেখ করলাম।
 ২০০৬ সালে ‘ফুড ফার্স্ট ইনফরমেশন অ্যান্ড নেট ওয়ার্ক’ তথা ‘ফিয়ান’ এর সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব হালিম একটি সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেন, “জল, জমি, জঙ্গল সরকার বা শিল্পপতিদের হাতে। সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ ঠিক না ভুল সেটা মহামান্য আদালতের বিচার্য বিষয়। কিন্তু সিঙ্গুরকে কেন্দ্র করে মানুষকে খাদ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। আমরা হুগলীর জেলা শাসক বিনোদ কুমারকে চিঠি দিয়ে ২১ দফা প্রশ্ন করেছি। জমি অধিগ্রহণের তথ্য সংক্রান্ত আইনে। হাইকোর্টে আবেদন করা হয়েছে ‘সিঙ্গুর’ সংক্রান্ত তথ্য ‘ফিয়ান’ কে জানানো হোক। কৃষকরা কি ক্ষতিপূরণ পাবেন সেটাই জানার বিষয়।”
ওই মামলায় হাই কোর্টের বিচারপতি প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায় সিঙ্গুরের জমি এবং চাষিদের যেসব তথ্য রয়েছে সেগুলি কোর্ট এবং ফিয়ান-কে জানাতে হবে বলে রায় দেয়
এদিনের (৩১ অগস্ট, ২০১৬) রায়ের পর বাংলার আকাশে নতুন বসন্ত এসেছে বলেই আমরা ভাবতে পারি। ২০০৬ সালে জমি অধিগ্রহণে কোথায় কি ভুল ছিল সেইগুলি মহামান্য আদালত আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেনসিঙ্গুর আন্দোলন এই রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ নামক শব্দের যে প্রাচুর্য আমাদের সামনে এনে দিয়েছে সেটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। এই নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করা বাতুলতা হবে। কারণ তাপসী মালিক সহ যারা শহীদ হয়েছেন বা আন্দোলনের জন্য যাদের মৃত্যু হয়েছে সেটা মর্মান্তিক। এবং কঠোর বাস্তব।   বর্তমান বাংলায় দাঁড়িয়ে ‘এগিয়ে বাংলা’ এই নতুন শ্লোগান হোক আগামী প্রজন্মের আভিধান। কারণ ২০১৬ বিধান সভা নির্বাচনের আগে বামফ্রন্টের নেতৃত্বে ‘শিল্পের জন্য পদযাত্রা’ শ্লোগান সামনে রেখে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, কমরেড বিমান বসু, কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্র ‘সিঙ্গুর থেকে শালবনী’ দীর্ঘ পথ হেঁটেছেন। এই কর্মসূচি বা এজেন্ডার পর আমরা বুঝে নিতে পারি সিপিএম তথা বামফ্রন্ট সেদিনও বৃহৎ শিল্পের পক্ষে ছিল আজও ক্ষয়িষ্ণু দল নিয়েও ‘এগিয়ে বাংলা’ শ্লোগানকে নিজেদের দলীয় মঞ্চ থেকে সমর্থন করছে।
সিপিএম রাজ্যে যতই ছোট হয়ে যাক এখনও একটি সংগঠিত দল। মতাদর্শগত তাত্ত্বিক লড়াই দলে আছে। দলটির সীমাব্দধতাও অনেক। তবু ‘ভারতীয় আলোয়’ দলীয় উচ্চতম নেতৃত্ব দলটিকে আধুনিক করে গড়ে তুলতে চাইছে।
তৃণমূল খুব স্বাভাবিকভাবেই শাসকদল হিসাবে সুপ্রিম কোর্টের যে রায় আমাদের সামনে এসেছে সমস্ত দিক থেকে তার সুফল নেওয়ার জন্য মাঠে নেমে পড়েছে। দলীয়ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস আগামী শুক্রবার (২ সেপ্টেম্বর, ২০১৬) সমস্ত ব্লকে ‘সিঙ্গুর দিবস’ পালনের ডাক দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলন করে উল্লেখযোগ্য কিছু কথা বলেছেন। তারমধ্যে অন্যতম ‘’রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ করার সিধান্ত নেওয়ার পর এই রায় আমাদের কাছে উপহার। বাংলাই শিল্পের শেষ স্তম্ভ।‘’ পাশাপাশি তিনি রাজনৈতিক আক্রমণ করেছেন বিরধীদের। মনে করিয়ে দিয়েছেন এই বলে, ‘’শিল্পের জন্য সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ তৎকালীন সরকারের ঐতিহাসিক ভুল ছিল।''
''সিঙ্গুর কারখানার জমি নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন, এখনো পর্যন্ত সেটি স্পষ্ট নয়। এই রায়ের খুঁটিনাটি পাওয়া যায়নি। জমি অধিগ্রহণ বৈধ না অবৈধ এই নিয়ে দুইবিচারপতি সহমতে আসতে পারেননি। কিন্তু যেহেতু ঐ জমিতে শিল্প হয়নি, তাই তা কৃষকদের ফেরত দেওয়ার পক্ষে রায় দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে যখন তৃণমূল সরকার সিঙ্গুরে জমি ফেরতের কথা বলে, তখনই বামফ্রন্টের তরফে জানানো হয়েছিল যে কৃষকদের জমি ফেরতের ব্যাপারে কোনও বিরোধিতা করা হবে না। কীভাবে জমি ফেরত দেওয়া সম্ভব সেই সংক্রান্ত বিষয়ে সরকারকে সাহায্য করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়। তামিলনাড়ুর জমি অধিগ্রহণ আইনের একটি সংশোধনী সম্পর্কেও সরকারকে জানানো হয়েছিল। আমরা বলেছিলাম, জমি ফেরতের সময় ইচ্ছুক, অনিচ্ছুক জমিদাতাদের মধ্যে বৈষম্য করা যাবে না। কিন্তু সরকারের তরফে সেই কথা শোনা হয়নি। রাজ্য সরকারের আইনের বৈধতা নিয়ে এখনো মামলা চলছে।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় অনুযায়ী কৃষকদের নির্দিষ্ট সময়ে জমি ফেরত দেওয়া ও ক্ষতিপূরণের কথা বলা হলেও নতুন কতগুলি জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে – প্রথমত, যারা ক্ষতিপূরণ নিয়ে জমি দিয়েছেন তাদের কী হবে, যারা ক্ষতিপূরণ নেননি, তাদেরই বা কী হবে? দ্বিতীয়ত, ফেরতযোগ্য জমি কী চাষের উপযোগী? আদালতের রায় অনুযায়ী চাষযোগ্য জমি না হলে পাশাপাশি জমি থেকে ঐ কৃষককে জমি দিতে হবে, কিন্তু সেই জমি দিতে গেলেও অন্য কারো জমি অধিগ্রহণ করেই দিতে হবে।
সিঙ্গুরে ৯০শতাংশ জমির মালিক স্বেচ্ছায় জমি দিয়েছিলেন এবং ক্ষতিপুরণ নিয়েছিলেন। ফলে জোর জমি নেওয়ার অভিযোগ এক্ষেত্রে খাটে না।
আদালতের রায়কে ঠিক কী করে কার্যকরী করবে রাজ্য সরকার তা স্পষ্ট করতে হবে। সি পি আই (এম)-র অবস্থান হলো, কৃষকদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। কৃষকদের কাছে জমি অত্যন্ত সংবেদনশীল ব্যাপার, তাই শিল্প বা পরিকাঠামো উন্নয়নের স্বার্থে তা অধিগ্রহণ করতে হলে কৃষকদের মতামত নিয়ে সম্মতির ভিত্তিতে করতে হবে। কিন্তু শুধুমাত্র কৃষির উপর নির্ভর করে কোনও দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। পৃথিবীর ইতিহাস প্রমাণ করে, কোনও দেশের অগ্রগতির জন্য শিল্পই ভবিষ্যৎ।'' 

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্র সাংবাদিক সম্মেলন করে রায়কে স্বাগত জানিয়ে কতগুলি প্রশ্ন তুলেছেন। বিরোধী দলের শীর্ষনেতা হিসাবে তিনি কিছু প্রশ্ন  তুলবেন সেটাই স্বাভাবিক। তিনি বলেছেন, (৩১অগস্ট, ২০১৬) ''


 তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুর আন্দোলনে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ থেকে কৃষক, শ্রমিক, মজুর সহ যেসব বুদ্ধিজীবী, বিদ্দবজ্জনেরা পাশে ছিলেন তাঁদের স্মরণ করেছেন। সেই সূত্র ধরে বলতে হয় সিঙ্গুর আন্দোলনে কংগ্রেস মুখ্য ভূমিকায় ছিল। বর্তমানে কংগ্রেস রাজ্য বিধানসভায় প্রধান বিরোধী দল। তাই সর্বভারতীয় দল হিসাবে প্রদেশ কংগ্রেসের ঐতিহাসিক দায়িত্ব বর্তায় সিঙ্গুরে বৃহৎ শিল্পের দাবিতে প্রচার কর্মসূচী নেওয়ার। যত ছোট হোক অথবা বড় কলকাতা সহ সারা রাজ্য জুড়ে কংগ্রেসকে এই দায়িত্ব নিতে হবে বাংলার উন্নয়নের স্বার্থে। কারণ ডাঃ বিধান চন্দ্র রায় বাংলার উন্নয়নের জন্য প্রাথমিক ভিত গড়ে দিয়ে গেছেন। যেমন ‘কানু বিনে গীত নায়’ তেমনি বৃহৎ শিল্প ছাড়া আধুনিক সমাজ হয় না।                   

No comments:

Post a Comment