Tuesday 27 November 2018

সুন্দর বাগান হাসে ইতিহাসে



দীপেন্দু চৌধুরী
একটা সমাপতন খুঁজে পেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ পর পর কয়েকটাদিন ব্রিটিশ ভারত আমাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই নিবন্ধেও উনবিংশ শতাব্দীর কলকাতা এসে পড়ল। নবজাগরণের বাংলা, নবজাগরণের কলকাতা উঁকি দিতে চাইছে। ঔপনিবেশিক কলকাতা শহরকে যখন ব্রিটিশ শাসকরা সাজিয়ে তুলছিলেন তখন তাঁদের নজর পরিবেশের দিকেও ছিল। পরিবেশ দূষণ রুখতে ঘোড়ায় টানা ট্রামের ব্যবহারের কথা আমরা জানি। পরে বিদ্যুৎ চালিত ট্রাম চালু করে ব্রিটিশ প্রশাসকরা। যেটা আজও এই শহরে একমাত্র দূষণহীন যানবাহন। যদিও আমাদের নিবন্ধ পরিবেশ বিষয়ক নয়। পরিবেশ এসে গেল একটি সূত্রের খোঁজে। কলকাতা শহরের উত্তরে ১৮৮৯ সালে ‘মোহনবাগান’ নামে একটি সুন্দর বাগান তৈরি হয়েছিল। এই বাগান তৈরি করেছিলেন তৎকালের কলকাতার প্রথম সারির বাঙালি ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক এবং সমাজ কর্মীরা। সেই ক্লাব পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৯০৪ সালে ‘ফুটবল ক্লাব’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সেই সময় সারা রাজ্যে এবং কলকাতায় বাঙালিদের দ্বারা পরিচালিত মাত্র গুটিকয়েক ফুটবল ক্লাব ছিল।
‘গোরা’-দের ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফুটবল খেলতে শুরু করে তৎকালীন মোহনবাগান ক্লাবের ফুটবলাররাতাই সাহেবরা মোহনবাগান ক্লাব সম্পর্কে প্রচার শুরু করে এই বলে যে ‘ব্যাঙ্গাচি’ হয়ে আকাশ ধরতে এসেছে বাঙালিদের এই ফুটবল ক্লাব। সাহেবদের বিরুদ্ধে ফুটবল খেলে ১৯১১ সালে প্রথম পরাধীন ভারতে মোহনবাগান জয় ছিনিয়ে আনে। যেন সেই বছরই ভারত স্বাধীনতা পেল। আবার বলতে হয় হ্যাঁ সমাপতন। কারণ মোহনবাগান গোরা সাহেবদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয়বার জয় ছিনিয়ে নেয় ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্টের আগে। এই ইতিহাস আমরা শুনলাম একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে। ২৪ নভেম্বর কলকাতায় অক্সফোর্ড বুকস্টোরে ‘সোনায় লেখা ইতিহাসে মোহনবাগান’ নামে বইটি প্রকাশ অনুষ্ঠানে কথাগুলি বলছিলেন সঞ্চালক দেবাশিষ মুখোপাধ্যায়। দেবাশিষবাবু বাঙালির ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন। মোহনবাগান বিষয়ক বইটি লিখেছেন সুবীর মুখোপাধ্যায়। মুখবন্ধ লিখেছেন ভারতীয় ফুটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি বদ্রু ব্যানার্জী। ৪৩২ পাতার বইটির প্রকাশক নব্জাতক প্রকাশনী।
বইটির পরিকল্পনায় প্রথম থেকে যুক্ত আছেন অভীক দত্ত। তিনি বলছিলেন, ‘’সুবীর সহ আরও সাত-আটজন এবং পরিসংখ্যানবিদ নারায়ণ দাশগুপ্তের সাহায্য নিতে হয়েছে এই ঐতিহাসিক বইটি লেখার জন্য। ১৯১১ সালে আমরা মোহনবাগানের ইতিহাস জানি। কিন্তু ফুটবলের টুর্নামেন্টে আমাদের ক্লাব এ পর্যন্ত ২৫০টা ট্রফি পেয়েছে। এই তথ্য কতজন জানেন? মোহনবাগান ক্লাবের ক্রিকেট এবং হকিতেও উল্লেখযোগ্য সাফাল্য আছে। সেই সব কথা এই বইয়ে পাওয়া যাবে।‘’
বইটির কভার পেজের দ্বিতীয় পৃষ্ঠার লেখা থেকে জানা যাচ্ছে ‘সোনায় লেখা ইতিহাসে মোহনবাগান’ বইটি ক্লাবের ইতিহাস সম্পর্কিত একটি তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ। এই গ্রন্থটির প্রথম অংশে একশো উনত্রিশ বছরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান মোহনবাগান ক্লাবের জন্মলগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ফুটবলের গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। পঁচিশটি পরিচ্ছেদের মাধ্যমে। ক্রিকেট এবং হকিতে মোহনবাগানের সাফল্যের কথা তুলে ধরার জন্য সংযোজিত হয়েছে আরও দু’টি পরিচ্ছেদ। মোহনবাগান ক্লাবের প্রতিষ্ঠা, ঐতিহাসিক শিল্ড বিজয়ের কাহিনী, বাঙালির চিরন্তন ‘ডার্বি’-এর বহু অজানা ইতিহাস। বইটির দ্বিতীয় অংশটি পরিসংখ্যান ভিত্তিক। মোহনবাগান যে সমস্ত ট্রফি জিতেছে তাঁর প্রায় প্রতিটিরই বিস্তারিত পরিসংখ্যান এই অংশে দেওয়া হয়েছে।
প্রকাশক বুলবুল ইসলামের কথায় ‘সোনায় লেখা ইতিহাসে মোহনবাগান’ বইটি মোহনবাগান ক্লাবের একটি মিনি এনসাইক্লোপিডিয়া।
প্রকাশকের কাছ থেকে আরও জানা যাচ্ছে মোহনবাগান ক্লাবের কিছু সদস্য-সমর্থকের সহযোগিতায় এই বই প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে। এই ধরণের বই লেখা বা প্রকাশ করা ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে আগে হয়নি। বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করেন বদ্রু ব্যানার্জী। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তিনি ফুটবল খেলেছেন। ১৯৫৩ সালে তিনি মোহনবাগান দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন। ভারতীয় অলিম্পিক ফুটবলের ক্যাপ্টেন হয়ে বদ্রু ব্যনার্জী শিল্ড এবং কাপ নিয়ে আসেন। তাঁর সময়কালের কথা বলেনতিনি যে কথা আলোচ্য বইয়ে লিখেছেননিজেদের সময়ের ফুটবলের কথা বলেন যথাক্রমে শ্যামল ব্যানার্জী, প্রশান্ত ব্যনার্জী, ক্রম্পটন দত্ত, সত্যজিৎ চ্যাটার্জী এবং বিদেশ বসু। বিদেশ বসু আক্ষেপ করেন মোহনবাগান, ইষ্টবেঙ্গলসহ প্রথম সারির দলে বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রসঙ্গ তুলে। বিদেশ বসু বলেন, ‘’এখনকার দলগুলিতে কজন বাঙালি ফুটবলার আছে? কেন নেই? আমাদের ব্যর্থতা বলতে হবে। আমি নিজে বর্ধমান জেলার কালনা থেকে আট মাইল দূরের গ্রাম থেকে কলকাতায় খেলতে আসতাম। আমি গর্বিত আমি মোহনবাগান দলের হয়ে খেলার জন্য। কিন্তু ভারতীয় ফুটবলে বাঙালি ফুটবলারের সংখ্যা এত কম কেন? সেই বিষয়ে আমাদের ভাবার সময় এসেছে। সব দলের উচিৎ গ্রাম থেকে ফুটবলার তুলে আনা।‘’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মোহনবাগান ক্লাবের অন্যতম সম্মানীয় সদস্য এবং আইনজীবী গীতানাথ গাঙ্গুলী। তিনি বলেন, ‘’এই বইটি আমি পড়েছি। প্রাথমিক পরিসংখ্যান আছে। যারা রেডিও টিভিতে ধারাবিবরণীর কাজ করেন তাঁদের খুব সাহায্য করবে। তবে হকি বিষয়ে কম লেখা হয়েছে। ক্লাবের অন্যান্য বিভাগের খেলা প্রসঙ্গেও কম লেখা হয়েছে। ক্রীকেট, অ্যাথলেটিক্স বিষয়ে বিস্তারিত থাকা উচিৎ ছিল।‘’
মোহনবাগান ক্লাবের অর্থসচিব এবং অন্যতম কর্মকর্তা দেবাশিষ দত্ত বলেন,  ‘’মোহনবাগান একটা ইতিহাস। কেন বলছি আমরা? ১৯১১ সালে সাহেবদের হারিয়ে পরাধীন ভারতে শিল্ড জিতেছিল সেইজন্য আমরা বলছি। ওই বছর ভারটীয় ফুটবলের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু আমি বলছি মোহনবাগান বর্তমান এবং মোহনবাগান ভবিষ্যৎ। এই বইটি লিখে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন সুবীর এবং তাঁর সহযোগীরা। কেউ কেউ বলছেন মোহনবাগান আইএসএল খেলবে। আমরা বলছি আইএসএল খেলাটা আমাদের ফোকাস নয়। আই লীগ কেন এত জনপ্রিয়? মোহনবাগান ফুটবল দল যে লীগে খেলেছে সেই লীগ প্রথমসারির লীগ হয়েছে।‘’
ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বইটির লেখক সুবীর ব্যানার্জী বলেন, ‘’কিছু ত্রুটি আছে। আমাদের পরিকল্পনা আছে বইটার সঙ্গে একটা সংযোজনী জুড়ে দেওয়ারদ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময় আমরা আরও যত্ন নেব। কারণ বইটি অনলাইনে বিপুল সাড়া পেয়েছে। প্রচুর বিক্রি হছে।''                                                                                                                                                      




                                    

No comments:

Post a Comment