Monday 26 November 2018

প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দুই জীবনশিল্পীর সেতু




দীপেন্দু চৌধুরী 
উনবিংশ শতাব্দীর ভারতে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের উৎস ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ কলোনী অধ্যুষিত সভ্যতাএবং সেই সভ্যতা নির্ভর বাংলা থেকে পাশ্চাত্য ভাবধারার জীবনশৈলীর খোঁজে ঝাঁকে ঝাঁকে লেখক, শিল্পী, সমাজকর্মী, বুদ্ধিজীবীর দল আমাদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছেন। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতৃত্বে ‘’নবজাগরণ’’ নামে পরিচিত চিরায়ত সেই আন্দোলনের ভিত্তি ছিল আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, স্বচ্ছ ভাবাদর্শ, যুক্তি নির্ভর বস্তুবাদী জীবনদর্শন, সুগভীর মানবতাবোধ এবং আন্তর্জাতিকতায় বিশ্বাস রাখা। এই আন্দোলনের প্রথম সারির ঋত্বিক তথা সামজিক মহানয়ক ছিলেন রামমোহন রায়, বিদ্যসাগর থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত একধিক প্রথমসারির বিদ্বজ্জন বিংশ শতাব্দীতে এসে উনবিংশ শতাব্দীর জ্ঞানের আলোয় বিচ্ছুরিত মনন, লেখনী, মানবতার আবেদন রবীন্দ্রনাথ আমাদের দিতে থাকলেন। তাঁর আকাশ ছোঁওয়া সীমাহীন ব্যক্তিত্বের স্পর্শে। বাঙালি তথা ভারতের অনুন্নত সাংস্কৃতিক সমাজ সমৃদ্ধ হতে থাকল।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের শেষ দিকে অর্থাৎ ১৯১৯ সালের ২৪ জুন কবিগুরুর হাতে এসে পৌঁছল একটি চিঠি। না সেটা ‘রাশিয়ার চিঠি’ নয়। বা ব্রিটেনের রানীর চিঠি নয়। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর চিঠিও নয়। চিঠিটা পাঠিয়েছিলেন বিশিষ্ট ফরাসী ঔপন্যাসিক, জীবনের গদ্যশিল্পী, মানবতাবাদী ভাবুক, দার্শনিক রম্যাঁ রলাঁ। তিনি রবীন্দ্রনাথকে আবেদন করেছিলেন ‘মুক্তমনের স্বাক্ষরপত্র’-তে সই করার মানবিক আবেদন নিয়ে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, ‘ছেলেটা’, ‘সাধারণ মেয়ের’ কবি, ‘গোরা’, ‘ঘরেবাইরে’ উপন্যাসের জীবনশিল্পী বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সই  করে দিয়েছিলেন সেই ‘মুক্তমনের স্বাক্ষরপত্র’-তে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দু’ই জীবনশিল্পী সেতু রচনা করলেন। মানবিক বিশ্বের সেতু। শুরু হল এক ধ্বংসোন্মুখ পৃথিবীকে বাঁচানোর ‘পটকথা’। যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা দুই মানবতাবাদী ভাবুকের কথোপকথন। ঘুমিয়ে থাকা বিশৃঙ্খল একমেরুর ঝঞ্জা থেকে বিশ্বমানবতাকে বাঁচানোর দায় দায়িত্ব তুলে নিলেন তাঁরা দুজনে। ভারতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফ্রান্সে রঁম্যা রলাঁ। অধ্যাপক, কবি ফরাসি ভাষাবিদ চিন্ময় গুহ বলছিলেন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের দুই ‘নিখিলেশ’-এর দেখা হল। মিলন হল। বিশ্ব পেল আরও স্বচ্ছ কাঁচের পেয়ালা ভর্তি মানবতার আলো। বন্ধনহীন, সীমহীন সঙ্গীতের মূর্ছনা।  
যদিও রবীন্দ্রনাথ তখন ভীষণ ক্লান্ত। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে কবি ‘নাইটহুড’ খেতাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি তখন ক্ষুব্ধ, বিষণ্ণ, অবসন্ন। সেই সময় পেলেন আন্তর্জাতিক মানবতার রক্ষার দাবিপত্র। পাঠিয়েছেন নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক, রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের জীবনীকার রম্যাঁ রলাঁ। আমরা এতটা জানতে পারলাম একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে। ২২ নভেম্বর আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ সভাঘরে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হল অধ্যপক চিন্ময় গুহ সম্পাদিত ‘ব্রিজিং ইষ্ট অ্যান্ড ওয়েস্টঃ রবীন্দ্রনাথ টেগোর অ্যান্ড রম্যাঁ রলাঁ করেসপন্ডেস’ ১৯১৯-১৯৪০ গ্রন্থটি। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে। বইটি উদ্বোধন করেন চলচ্চিত্র এবং নাট্য ব্যাক্তিত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধায়। ১৪৯ পাতার বইয়ে দুই মানবতাবাদী বিশ্বপথিকের মোট ৫৬টি চিঠি এবং ৩টি সংলাপ আছেসৌমেন্দ্রনাঠ ঠাকুরের বিস্ফোরক চিঠি আছে (১৯১৯-১৯৪০)। গাঁধি বিষয়ে চিন্ময় গুহ জানাচ্ছিলেন, দু-দু’টো বিশ্বযুদ্ধের সময়ের অস্থির বিশ্বের ছবি ধরা আছে এইসব চিঠির ছত্রে ছত্রে।
চিন্ময় গুহ বললেন, ‘’রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘হে আমার অতি প্রিয় বন্ধু’, কবির ভাষায় ‘আমি তো মহাত্মা গাঁধির হাতে হাত রাখতে চাই, যাতে জনসাধারণ খুশি হয়। কিন্তু আমি তো বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারব না যে আমাদের সত্যানুসন্ধান ও ভাবনা সম্পূর্ণ আলাদা।’ আবার তাঁর উত্তরে ১৯২৫ সালে রলাঁ লিখছেন, ‘আমরা যে ঘর বেঁধেছি অনন্ত বৃক্ষের উপর।’ লক্ষ করুণ রবীন্দ্রনাথ ‘হে আমার অতি প্রিয় বন্ধু’ সম্বোধন করে চিঠি লিখছেন। বিশ্বকবি কতজনকে এই সম্বোধনে চিঠি লিখেছেন? খুব পরিষ্কার ছবি আমাদের সামনে নেই।‘’
চিন্ময় গুহ আবেগ প্রবণ হয়ে বলে চলেন, জীবন এবং চলচ্চিত্রকে একটা বন্ধনে বেঁধেছেন সৌমিত্রদা। তিনি এখানে আছেন। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। স্মৃতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং ধর্মীয় বিষয় নিয়ে রলাঁর বক্তব্য। ঘুমের দরজাকে উপেক্ষা করে আমার বক্তব্য নয়। রম্যাঁ রলাঁ বলছেন। ১৯১৪ সালে কোনও নোবেল পুরষ্কার ছিল না। যুদ্ধের কারণে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ পুরস্কার পান। ১৯১৫ সালে রম্যাঁ রলাঁ পেলেন নোবেল পুরস্কার। তাঁরা দু’জনে এক তরঙ্গ লহমায় থাকেন পরস্পরকে না দেখেও। পাশ্চাত্যের ‘নিখিলেশ’-এর চরিত্র তিনি এঁকেছেন। সংগীতের সমন্বয় বিষয় নিয়ে দু’জনে কথা বলেছেন। সংস্কৃতির ঐতিহ্য আলো। জ্বলে উঠল আলো ঐ নীল দিগন্তে। আনন্দের জ্বলন্ত শিখা হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন নাটকীয়তাকে আমি ঘৃণা করি।
এই বইয়ে চিন্ময় গুহ মূল ফরাসি থেকে রলাঁর চিঠিগুলির নতুন করে অনুবাদ করেছেন। সম্পূর্ণ পত্রাবলি সম্পাদনা করে দীর্ঘ এক ভূমিকা এবং টীকা লিখেছেন অধ্যাপক গুহ। যে কাজ বর্তমান সময়ের মানদন্ডে চিরকালীন হয়ে থাকবে। এই বইয়ে আছে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের ঋষিতুল্য মানবতাবাদী দু’ই লেখকের টেলিগ্রাম, রথীন্দ্রনাথের চিঠি। মুসোলিনি-বিতর্ক। এই বিতর্ক প্রসঙ্গে অধ্যাপক গুহ তাঁর সমৃদ্ধ মেধার মাধ্যমে আমাদের শোনালেন রবীন্দ্রনাথের দৃঢ় ব্যক্তিত্বের কথা। ইংরেজিতে লেখা বইটিতে আরও আছে দু’জনের সম্পর্কিত ঘটনাবলি, গাঁধি-রবীন্দ্রনাথ-রলাঁর সম্পর্ক বিষয়ক লেখা এবং তথ্য। এই বিষয়ে পাশ্চাত্যের সমকালীন বিশিষ্টজনদের চিঠিপত্রের উধৃতি।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘’চিন্ময় সেতু তৈরি করছে নতুন ভাষায় নতুন আঙ্গিকে। প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের দু’জন মহান শিল্পীর সম্পর্কে আমাদের সামনে আরও তথ্য চিন্ময় তুলে ধরেছে। ভারতীয় হিসেবে ফ্রান্সের সঙ্গে চিন্ময়ের  দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। একই সঙ্গে উল্লেখ করতে হয় রম্যাঁ রলাঁও আমাদের দেশকে জেনেছেন, বূঝেছেন একজন বিশ্বনাগরিক হিসেবে। আর রবীন্দ্রনাথ? তিনি আমাদের নীল আকাশ যেমন চিনিয়েছেন, চিনিয়েছেন সাগর পারের আমন্ত্রণের ভাষা। নদীর ঘাটের খেয়া টানার গান। সেই দু’ই মহান ব্যক্তির সংলাপ চিন্ময় নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরেছে। রম্যাঁ রলাঁ রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দের জীবনীও লিখেছেন।‘’
এদিনের আলোচনা থেকে অধ্যাপক চিন্ময় গুহের বক্তব্যে আরও পাওয়া গেল, রলাঁ বলছেন, আমরা একই চিন্তা করেছি। ওদের নয়, আমাদের নয়, সবার। অনেক বামপন্থীরা ভেবেছিলেন রলাঁ বামপন্থী। কিন্তু তিনি মানে রম্যাঁ রলাঁ বলছেন ‘আমি সম্পূর্ণ মুক্ত মানুষ।’ রলাঁ র‍্যাডিক্যাল ছিলেন। সনাতন ভারতকে তিনি বুঝতে চেষ্টা করেছেন। মানুষের মধ্যে খুঁজছেন সীমাহীন এক পৃথিবী। রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে তাঁর কথায় উঠে এল, রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘আমার সঙ্গে যত মানুষের দেখা হয়েছে তাঁদের মধ্যে রলাঁ আমার সব থেকে কাছের মানুষ। আমরা দু’জনেই স্বদেশী এবং জাতীয়তাবাদী।‘’ অচেতনভাবে রবীন্দ্রনাথ বলছেন আমাদের জয় হবেই আমরা করব জয়।
অধ্যাপক গুহ আরও বলেন, ‘’রবীন্দ্রনাথ স্ত্রোত্র পাঠ করেছিলেন। মন্ত্র পাঠ করেছিলেন। সেটা সংগীতকে ছাপিয়ে যায়। যেন প্রাচীন মনের মৌচাক। আনন্দের জ্বলন্ত শিখা হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ। পৃথিবীর ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথের জাপান সফরের বক্তব্য সারা বিশ্বের কাছে একটা বাঁক। যে বক্তব্য রবীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন সেই বক্তব্যে তিনি মানবধিকারের কথা বলেছিলেন, যেমনটা তিনি করেছিলেন জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার প্রতিবাদে। রলাঁর এক বান্ধবী রলাঁকে বলছেন রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ পড়তে এই বইয়ের কবিতা গান নয়, গানের উপরের স্তরের  আরও উচ্চতায়, আরও বাঙময়।‘’
ধ্যানমগ্ন ঋষির অন্তর থেকে প্রস্ফুটিত শব্দের ডালি। ‘গানের ঝর্ণাতলায় তুমি সাঁঝের বেলায়/ এলে ঝর্ণাতলায় ......যে সুর গোপন গুহা হতে/ ছুটে আসে আপন স্রোতে’ রবিন্দ্রনাথের অশ্রু মিশে গেল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে।
কলকাতায় ফ্রান্সের কনসাল জেনারেল ভার্জিন কর্টিভেল (Virginie Coteval) বলেন,  ‘’গত শতাব্দীর দুটো দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে দু’জন শ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী লেখকের আলোচনার বিষয় আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন অধ্যাপক চিন্ময় গুহ। ফ্রান্স সরকারের কাছেও এই কাজ সম্মানজনক বিষয়। বাংলা, ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় দক্ষ চিন্ময় গুহ। বর্তমান শতাব্দীতেও এই বইয়ের বিষয় দু’টো গণতান্ত্রিক দেশের মধ্যে সেতু রচনা করবে।‘’
এদিনের সন্ধ্যায় ফরাসি ভাষায় লেখা রম্যাঁ রলাঁর চিঠি পড়েন আলিয়াঁস ফ্রাঁসেজ কলকাতার ডিরেক্টর ফ্যাব্রিস প্যাল্কন এবং গ্রন্থগারিক সন্ধিয়া ভাসিউর। রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে বাংলায় কবিতা পাঠ করেন মৃন্ময়ী ধর।                                                             

No comments:

Post a Comment