Friday 22 September 2017

মনের জানলা খুলে দেখুন 'কিশলয়' আলো দেবে

মনের জানলা খুলে দেখুন ‘কিশলয়’ আলো দেবে: 
শারদ শুভেচ্ছা শেষ হতেই। শুভ বিজয়া। এই ছিল চেনা সংস্কৃতি। এই ধারাবাহিকতায় বাংলার দুর্গা পুজো আমরা দেখে আসছি। বাঙালির সেরা উৎসবের এটাই ছিল চিরাচরিত প্রবাহমান অনুভূতি। এবছর ‘বিসর্জন’ বিতর্ক বাংলায় আবার একটা ভিন্ন মাত্রা জুড়ে দিতে চাইছে। গণতান্ত্রিক দেশে সমাজ নামক বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান বর্তমান ভারতীয় গণতন্ত্রে আপনার আমার দাদু-ঠাকুর্দার উত্তর কলকাতা বা মধ্য কলকাতার সম্পত্তি নয়। সর্বজনে হিতায় বলব আর সমাজের প্রাতিষ্ঠানিকতা মানব না? সে কালে রাজা ছিল,বাবু ছিল/ একালে বাবুমশায় খুলে দিল/ দেশ আগে,সমাজ আগে/একথা মানতে হবে/বাংলার সামাজিক বন্ধন চিরায়ত তবে!
আমরা প্রসঙ্গ খুলে দিতে চাই না। মনের জানলা খুলে দেখতে চাইছি আরও বৃহতকে। সুদূরের আগত পিয়াসিকে। ভোরের কিশলয় বলি আর শিউলি বলি চিনতে আপনাকে আমাকেই হবে। বাংলার দুর্গা পুজোয় সাকুল্যে বাজেট কত? শাপলা, পদ্মফুল হাতে প্রাক্তন খাজাঞ্ছিরা তাঁদের সময়ের কথা বলতে পারবেন। বর্তমানের অর্থ বিশারদদের কাছে জানতে বড় ইচ্ছা করে। উৎসব হোক। আমরা আনন্দ করিআড়াল থেকে অন্তর্যামী সব কিছু দেখছেন। অনুষ্ঠানের শর্ত মেনে আয়োজকদের কেউ কেউ পথশিশুদের নতুন বস্ত্র দেবার ব্যবস্থা করেফল মিষ্টি দেয়। কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান আবার পথ শিশুদের জন্য বাস-ট্রাম ভাড়া করে। বিভিন্ন পুজো মণ্ডপ ঘুরিয়ে দেখায়। আম আঁটির ভেঁপুর শিশুর দল অবাক নয়নে আপ্লুত হয়ে চেয়ে থাকে। অচেনা সুগন্ধিমাখা বাবুদের পানে। এরা এতদিন কোথায় ছিল? মনে মনে বলে। আমরাও জানি এসব অস্থায়ী। শুভকাজ করলে আলোচনা হবে সমালোচনা হবে। কিন্তু কাজটা আপনাকে বা আমাকে করতেই হবে। এই কাজ করার তাগিদ আছে বলেই প্রয়োজন আছে। কিন্তু বাস্তব যেটা নগর সভ্যতার এই নতুন অজনপ্রিয় এজেন্ডার সঙ্গে নাগরিক সমাজ কতটা পরিচিত? সোস্যাল মিডিয়ায় স্বনিযুক্ত ‘ক্যামেরাম্যান’ পাওয়া যায়। স্বঘোষিত প্রতিবেদক পাওয়া যায়। ব্যক্তির প্রচার হোক বা সংস্থার প্রচার। সবকিছুই সমাজের অংশ। কোথাও থাকে আত্মপ্রচার কোথাও থাকে সমাজ এবং সামাজাকিতার প্রয়োজনে। এই ধরণের কাজে অর্থ আসে কিনা আমার জানা নেই। অর্থ না নিয়েও বহু চিত্র সাংবাদিক বা সাবেক ক্যামেরাম্যান কাজ করে। প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিককে উদ্বৃত্ত করে রাখলেও সেই সাংবাদিককূল সামাজিক দায়বদ্ধতা ভুলে যায় না। কারণ সমাজ একটা প্রতিষ্ঠান। মনের জানলা খুলে রাখুন ‘কিশলয়’ আলো একদিন আমাদের আলোকিত করবে।      
আমি আমার নিজের সাংবাদিকতার অভিঞ্জতার কথা দিয়ে শুরু করি। নতুন শতাব্দীর দ্বিতীয় বছর। আমি একটি টিভি চ্যানেলের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে ১০ মিনিটের তথ্যচিত্র করি। কারণ ওই চানেলে ১৫ মিনিটের একটি এপিসোড চলত। সেই সুবাদে আমাকে নিত্য নতুন গল্প খুঁজে এনে ‘ইন্ট্রো’, ‘ভয়েস ওভার’ লিখে এডিট করে দু তিনটে এপিসোড রেডি করে রাখতে হত।
একুশ শতাব্দীর দ্বিতীয় বছরের দুর্গা পুজোটা আমার মনে গভীর দাগ কেটে রয়েছে। সে বছর পুজোর ঠিক আগে আগে এক এনজিও কর্মকর্তার সঙ্গে আমার আলাপ হল। তিনি আমাকে বললেন, ‘’আমি আপনাকে হাওড়া স্টেশনের শৈশব দেখাব। কি অকল্পনীয়ভাবে হাওড়া স্টেশনের শিশুরা জীবন যাপন করে।‘’ উল্লেখিত কর্মকর্তার দিন এবং সময় মতো আমি ক্যামেরাম্যান সঙ্গে নিয়ে হাওড়া স্টেশনে হাজির হলাম। আমাদের অনুমতি পত্র আগেই করা ছিল। স্টেশনের বিভিন্ন দোকানের আড়াল, আবডালে, প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে, মালগুদাম, গোডাউন সংলগ্ন এলাকায় ১০ থেকে ১৪ বছরের শিশু কিশোরের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। জরাজীর্ণ হার জিরজিরে চেহারা। কেউ কেউ একধরণের অ্যাডেসিভ পুরনো কাপড় বা রুমালে লাগিয়ে মুখ দিয়ে টানছে। মুখের উপরের অংশ, দুটো ঠোঁটে দগে দগে ঘা হয়ে গেছে। পুলিশ তাড়া করে। পালিয়ে যায়। আবার ফিরে আসে। আমরা অনুসন্ধান করে জানতে পেরেছিলাম এইসব ছেলেরা সাধারণত আসে বিভিন্ন নিষিদ্ধ পল্লী এবং বস্তি থেকে। গ্রামের সাধারণ গরিব ঘরের ছেলেরাও এই দলে ভিরে যায় নেশার টানে। এরা নেশা করার অর্থ যোগার করে পুরনো (প্যাসেঞ্জাররা যে সব জলের বোতল ব্যাবহার করে ফেলে দেয়) প্ল্যাস্টিক বোতল কুড়িয়ে বিক্রি করে।
কেউ কেউ অবৈধভাবে কুলির কাজ করে। কেউ কেউ কেপমারি এবং পকেট মারের কাজ করেও টাকা পায়। যে এনজিওটির আধিকারিক আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন তার নির্দেশ মতো আমরা ছেলেগুলোকে কোনও কথা জিগ্যেস করিনি। ‘বাইট’ নিইনি। কারণ আমরা আক্রান্ত হতে পারতাম। ওই এনজিও সংস্থাটি যে কয়েকজনকে উদ্ধার করে পুনর্বাসনের জন্য নিজেদের হেফাজতে রেখেছে। আমরা সেই আস্তানায় গেলাম। দোতলা একটি বাড়ির উপর নীচে ছ’টা ঘর। প্রতিটি ঘরে চারটে করে চৌকি আর একটা করে টেবিল আছে। এদের থাকা খাওয়া, চিকিৎসা, জামা, কাপড় সমস্ত কিছুর দায়িত্ব স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির। ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রে আমরা তিন চারজন ছেলের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। কয়েকজন অ্যাডেসিভের পুরনো টিউব ব্যবহার করে কি ভাবে ওরা নেশা করে সেই দৃশ্য আমাদের অভিনয় করে দেখিয়েছিল। আমরা ক্যামেরায় ছবি তুলে নিয়ে এসেছিলাম। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিকদের কাছে জানতে পেরেছিলাম এইসব ছেলেদের বেশিরভাগের পিতৃ পরিচয় জানা নেইকেউ কেউ মায়ের পরিচয় জানে। ১০ জনকে উদ্ধার করে আনলে চার থেকে পাঁচজন থেকে যায়বাকিরা পালিয়ে যায়। কিছুদিন অন্য অঞ্চলে গিয়ে নেশা করে। কয়েকদিন বাদে আবার হাওড়া স্টেশনে ফিরে আসে। হাওড়া স্টেশনে পুলিশের নজরদারি যখন বেশি থাকে এইসব ছেলেরা ধর্মতলা, বাবুঘাট, ফেয়ারলি প্লেস, শিয়ালদহ অঞ্চলকে বেছে নেয়। ‘কলকাতা’ রেলে স্টেশন হওয়ার পর সেখানেও এই সব ছেলেরা আশ্রয় নিয়েছে। তবে সংখ্যায় কম।  ওই বছর হাওড়া স্টেশনের জিআরপির এক আইসি আমাকে থানার ক্রাইম বোর্ড দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাদের এই বোর্ডে, চোর, ছিনতাইবাজ সহ দাগী আসামীদের নাম থাকত। নতুন শতাব্দীতে নতুন সংযোজন ‘ড্রাগস অ্যাডিক্টেড চিলড্রেনস’আমি আপনাকে বলছি আগামী দশ বছরে দেখবেন এই ধরণের ক্রাইম আরও বাড়বে।’
প্রায় পনের বছর পেরিয়ে এলাম। দেশ কোথায় দাঁড়িয়ে আছে? একটা তথ্য হাতের কাছে আছে। পুনরাবৃত্তি করি। ঢাক ঢোল পিটিয়ে দেশের স্বাধীনতার সত্তর বছর উদযাপন হল। স্বাধীনতার পচাত্তর বছর উদযাপনের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু ঘরের সব জানলা কি খোলা আছে? দেশের সব মানুষ কি ভরপেট খেতে পায়? বছর চারেক আগের একটি তথ্য বলছে, পৃথিবীর প্রায় ৮৭ কোটি মানুষের (১২.৫ শতাংশ) অর্ধাহার বা অনাহারে দিন কাটে। বিশ্বের উন্নত গণতন্ত্রের দেশ। গর্বিত গণতন্ত্রের দেশ আমেরিকাতেও প্রায় ৫ কোটি মানুষের (১৬ শতাংশ) বছরভর ভরপেট্টা খাবার জোটেনা। যে সূত্র থেকে এই তথ্য পেলাম সেই সূত্র বলছে, বিশ্বের গর্বিত গণতন্ত্রের দেশ বলি যে সব দেশকে আমরা, সেই শিল্পোন্নত দেশগুলি সব থেকে বেশি খাবার নষ্ট করে। মার্কিন দেশের নাগরিকরা যে খাবার কেনে তার ২৫ শতাংশ নষ্ট বা অপচয় করে। ব্রিটেনের নাগরিকরা যে খাবার কেনে তার ১/৩ ময়লা ফেলার বাক্সে ফেলে দেয়। ইউরোপ এবং আমেরিকায় বছরে মাথা পিছু ২৮০-৩০০ কেজি (Avoid Future Famine-UNDP report.) খাবার অপচয় হয়।  যদিও উল্লেখ করতেই হয় শিল্পোন্নত দেশ আমেরিকা এবং ইউরোপে নতুন আন্দোলন শুরু হয়েছে। খাবার নষ্ট না করার আন্দোলন। বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পাব কতৃপক্ষ, ছোট ছোট বোর্ড, মেনু কার্ডে লিখে রাখছে ‘খাবার নষ্ট করবেন না। যতটা খেতে পারবেন সেই পরিমাণ নেবেন।’ কোনও কোনও দেশে খাবার নষ্ট করলে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
কয়েক বছর আগে পর্যন্ত আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার খাদ্যশস্য ঠিক ঠাক সংরক্ষণ না করার কারণে নষ্ট হয়ে যেত। আমাদের কাছে আরও একটি হিসাব আছে। ২০০২ সালে ফসল রাখার পর্যাপ্ত গোডাউন বা গোলা না থাকার কারণে ১.৫ কোটি টন খাদ্যশস্য বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক অনেক কম দামে বিদেশের বাজারে বিক্রি করে দিতে হয়েছিল ভারতের বর্তমান আর্থ-সামাজিক চিত্র ব্যাখ্যা করলে কতটা আমরা এগতে পেরেছি? শিশুরাই দেশের কথিত এবং অকথিত ভবিষ্যৎ। চরমতম দারিদ্র এবং অবহেলিত শৈশব, অভইভাবকহীন শৈশব ‘ফুটপাথ’ বেছে নিতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ বাবা মায়ের সঙ্গে ঝুপড়িতে থাকে। কেউ কেউ সারাদিন এখানে সেখানে কাটিয়ে রাতটা আশ্রয় নেয় বড়লোক বাবুর গাড়ি বারন্দা, ঠেলা গাড়ির নীচে। এই শিশুরা একটু বড় হলে ‘শিশু শ্রমিক’ হিসাবে কাজ করে। (ভারতে আইনত শিশুশ্রম নিষিদ্ধআমাদের দেশে শিশু শ্রমিক নিরোধক আইন, ১৯৮৬ আছে। ‘Child labor-prohibition and regulation Act. 1986)
কেউ কেউ অপরাধ জগতে আশ্রয় নেয়। শহর সভ্যতার ছবি আজ থেকে কয়েক বছর আগে যা ছিল আজ কতটা বদল হয়েছে?
আট বছর আগের একটি তথ্য থেকে জানা যায়, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থা (আই এ এল ও) এর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন- ‘বিশ্বে নারীর কর্মসংস্থানের গতি’ (Global Employment Trends for women ) এর কয়েকটি মন্তব্য বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার ব্যাখ্যা ছিল এইরকম, ‘’পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোন পরিবারে যারা গৃহ পরিচারিকা/ পরিচারকের কাজ করে তাঁদের বলা হয় ‘গার্হস্থ শ্রমিক’’। (A domestic worker is someone who carries out household work in a private house hold in return for wages.) সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী ভারতের গৃহ পরিচারিকা/ পরিচারকের সংখ্যা ৯ কোটির বেশি। এদের ২০ শতাংশের বেশি ১৪ বছরের কম বয়সের শিশু। মূলত কন্যাশিশু। এই তথ্য বছর কয়েক আগের হলে বর্তমান ভারতে এই সংখ্যার হার নিশ্চয় আরও বেড়েছে। কলকাতা সহ ভারতের বিভিন্ন মেট্রোপলিটন শহরের পরিচারিকারা মূলত আসে রাস্তার ধারের ঝুপড়ি বা ফুটপাথ থেকে। দেশের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে দেশের ফুটপাথগুলিও উন্নত হচ্ছে। তা হলে ওইসব ফুটপাথবাসীদের কি হবে? বিশেষত যারা ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে কখন কোথায় হারিয়ে যায়? বিশেষ করে গৃহহীন অভিভাবকহীন  ফুটপাথ শিশুদের নিরাপত্তা এবং পুনর্বাসন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার কি ভাবছে? বিভিন্ন রাজ্য সরকারই বা কি ভাবছে? আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে কিছুটা কাজ শুরু হয়েছে। রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর সূত্রে খবর, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সমীক্ষায় প্রকাশ কলকাতা এবং হাওড়ায় অন্তত বাইশ হাজার পথশিশুর খোঁজ পাওয়া গেছে। এছাড়াও রাজ্যে শিলিগুড়ি, মালদহ, আসানসোল এবং খড়গপুরে পথশিশু গণনা চলছে। সূত্রের আরও খবর সমস্ত রাজ্যের হিসাব ধরলে পথশিশুদের সংখ্যা এক লক্ষের বেশি হবে।
রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণমন্ত্রী শশী পাঁজা ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যেও জানালেন, ‘’এই বিষয়ে পুজোর ছুটির পর যা বলার বলব। তবে সমীক্ষা শুরু হয়েছে এটুকু আমি জানি।‘’                                                                             

         

No comments:

Post a Comment