Monday 18 September 2017

গদ্যের প্রজাপতি তোমাদের পাড়ায় ছেড়ে দিলাম।

গদ্যের প্রজাপতি তোমাদের পাড়ায় ছেড়ে দিলাম। : 
বর্ষার ছন্দ এবার কেন যেন শারদ প্রভাতের আগেই ছুটি দিয়ে গেল। অফুরন্ত প্রাণের আবর্তিত পেঁজা পেঁজা মেঘেদের ইতি উতি আনাগোনা। কেউ বলে বৃষ্টি তোমাকে আরও দেওয়ার ছিল। তুমি কোথায় গেলে? ফিরে এসো ফিরে এসো। ‘ওলি বার বার ফিরে আসে, ওলি বার বার ফিরে যায়’। সে আরও বলে আবার মেঘমন্দ্রিত সুরের রঙে আর ভাসব না। নাই বা থাকল মেঘলা আকাশ। ভিজেছি ওই সেদিন যেদিন প্রথম বললাম, গদ্যের প্রজাপতি তোমাদের পারায় ছেড়ে দিলাম। আগেও চিনতাম না। আজ আর চিনেই বা কি করব? শরৎবাবু সাধারণ প্রজাপতি খুঁজতেন। রবীবাবু তাই হয়ত বলেছিলেন, শরৎবাবু একটা সাধারণ প্রজাপতি থুড়ি একটা সাধারন মেয়ের গল্প লেখ। শরৎবাবু তার সময়কালে যতগুলি সাধারণ মেয়ের গল্প লিখেছেন আর কোনও কথাশিল্পী কি সেই গল্প লিখেছেন বা লিখতে পেরেছেন? যৌথ পরিবারের মূল্যবোধ। মূল্যবোধ ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা। পরিবার বিচ্ছিন্নতা। ভাইয়ের সঙ্গে দাদার সম্পর্ক টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া। ব্রাহ্মসমাজের গভীরতা, ব্যপ্তি। পুরনো সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে নতুনের সমাজ ব্যস্থার দ্বন্দ। উচ্চ শিক্ষার কারণে সাংস্কৃতিক উদ্যানে নতুন মূল্যবোধের প্রেরণা। এইসব নিয়েই না শরৎচন্দ্র।      
পরিবার ভেঙ্গে যাওয়া, সামাজিক পারিবারিক উত্থানপতনের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। সবস্থানে মোর ঘর আছে বলে শরৎচন্দ্র এই দেশ সেই দেশ, এই পাড়া ওই পাড়া আফিং আর গাঁজার নেশায় ঘুরেছেন। মানুষ দেখেছেন। মানুষের কথা শুনেছেন। মানুষকে চিনেছেন। সমাজ দেখেছেন, সমাজের টানাপড়েন নিয়ে গভীরভাবে ভেবেছেন। তাই তিনি ব্যর্থ প্রেমের উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’ লিখেছেন। প্রতিটি পর্বে তিনি গদ্যের প্রজাপতি নিয়ে ঘুরেছেন। ‘রাজলক্ষ্মী’, ‘অভয়া’, ‘কমললতা’ কালো ভ্রমর হাতে আমাদের পদ্যের ছন্দ চেনাতে চেয়েছে। কিন্তু আপনভোলা শ্রীকান্ত নিজের ছন্দে গদ্যের রাস্তায় কঠোর বাস্তবকে চিনিয়েছেন। গদ্যের প্রজাপতি আপন ডানায় ভর করে গদ্যের পাড়া খুঁজে আমাদের সামাজিক টানাপড়েন চিনিয়েছে। সাহিত্য সমালোচকরা অনেকেই শরৎচন্দ্রের গল্প- উপন্যাসকে শিল্পের মর্যাদা দিতে চান না। তিনি নাকি বস্তা পচা সব বটতলার গল্প লিখে গেছেন। তা বেশ করেছেন। তাতে আপনাদের কি এসে গেল? বাংলা তথা ভারতে ‘ঘর-সংসার’ করা সে যুগের বাবু বিবিদের কাছে সাহিত্যের ‘পীঠে- পায়েস’ ছিল শরৎচন্দ্রের গল্প উপন্যাস শরৎচন্দ্রে এতটাই আপ্লুত ছিলাম আমার মনে পড়ছে কলকাতা শহরে আশির দশকে অভিনেত্রী মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যখন দেখা হয় আমি গড় হয়ে প্রণাম করেছিলাম। খুব লাজুকভাবে বিস্ময়ে চেয়েছিলাম। মনে মনে বলেছিলাম। বিরাজ বৌয়ের মাধবী। বিন্দুর ছেলের বিন্দু। আমাদের ঘরের ‘দিদি’। আমাদের যৌথ পরিবারের বৌদি। ২০০২ সালে এবং তারপরে  যতবার ওনার সঙ্গে দেখা হয়েছে আমি প্রণাম করেছি। মাধবীদি একদিন জানতে চাইলেন ‘তুমি বারে বারে প্রণাম কর কেন? যতদূর জানি তুমি এসব মান না।’ আমি লাজুক হেসে বলেছিলাম, ‘আপনি আমাদের শরৎচন্দ্রের বিরাজ বৌ, বিন্দু। তাই আপনাকে প্রণাম করি। আমি বড়দের সম্মান করি। আমার মা শিখিয়েছিলেন স্কুলের শিক্ষক যে জাতের হোক বা ধর্মের হোক প্রণাম করবে। আপনিও আমাদের শিক্ষক।’ সামনে ছিলেন সাংবাদিক সুদেব রায় রায় চৌধুরী। সুদেবদা বলেছিলেন, ‘’দীপেন্দু টপাটপ কথা বলে। ওকে কেঊ কেউ মাথা তোলার  স্বাধীনতা দিচ্ছেনা।‘’ মাধবীদির সঙ্গে দেখা হলে আমার কাজ ছিল ওনার জন্য পান এনে দেওয়া। টাকা মাধবীদি নিজে দেবেনগদ্যের প্রজাপতি আমাদের এভাবেই সমাজ পরিবারে আজও অবস্থান করছে।     
যৌথ পরিবার কাকে বলে বুঝেছিলাম খুব ছেলেবেলায়। আমরা নলহাটির বিদুপাড়ায় প্রথম যে ভাড়া বাড়িতে থাকতাম সেটা ছিল টিনের চাল। অবশ্য গরম অতটা লাগত না কারণ পুরনো দিনের বাড়ির মতো আমাদের ভাড়ার বাড়িটাও ছিল দোতলা। বাঁশ, কাঠ দিয়ে তৈরি একটি মাচার মতো দোতলা করা ছিল। বাঁশ এবং কাঠের কড়ি বরগা এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল একতলা বা দোতলা থেকে খুব একটা বোঝা যেত না। তার কারণ একতলা সিলিং এবং দোতলার ছাদ মাটি, চুন, সুড়কির মিশ্রণে এমন ভাবে লেপা ছিল যেটা সিমেন্টের মতো শক্ত হয়ে গিয়েছিল। উপর নীচ নিয়ে আমাদের তিনটে ঘর ছিল। আমরা পাঁচ ভাই বোন বাবা মায়ের সঙ্গে ওই বাড়িতে ছিলাম। পায়খানা, বাথরুম, রান্নাঘর আলাদা ছিল। আমাদের যৌথ পরিবার এতো ছোট ছিল না। আমাদের বাড়ির পিছনের দিকে ছোট একটা মাঠ পেরিয়ে আরও একটা বাড়ি ছিল। ওই মাঠের সংলগ্ন আমাদের বাড়ির দেওয়ালে একটা বড় বেল গাছ ছিলো। আমাদের বলা হয়েছিল ওই বেল গাছে ‘ব্রহ্মদৈত্য’ থাকে। ছোট বেলায় আমরা ওই মাঠ পাড় হওয়ার সময় তিন বার ‘রাম রাম, রাম রাম রাম রাম’ করে তবে এবাড়ি অন্যবাড়িতে যাতায়াত করতাম।  
পেছন দিকের বাড়িটা দালান বাড়ি মানে পাকা বাড়ি। একতলা-দোতলা মিলিয়ে পাঁচটা স্বচ্ছল পরিবার বাস করত ওই বাড়িতেওই পরিবারগুলির তুলনায় আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল ছিল। সেটা আমি ক্লাস এইট পর্যন্ত টের পাইনি। এমনই বন্ধন ছিল ওই পরিবারগুলির সঙ্গে। ছটা পরিবারে কম বেশি ২৫ জন ছেলে মেয়ে। আমরা স্কুল যাওয়ার সময় ‘চড়ুইভাতি’ মেজাজে ২৫ জন ছেলমেয়ে সারিবদ্ধভাবে ভাত খেতে বসতাম। বরাদ্দ ছিল ভাত, এক চামচ ঘি, আলুসেদ্ধ সঙ্গে এক হাতা করে ভাতের ফ্যানসেইভাত অমৃতের মতো লাগত। এই সময়কালে যে ছাত্র প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হতো তাকে আর বই কিনতে হত না। সামনে কেউ না কেউ থাকত। তার কেনা বই ব্যবহার করা যেত। আমাদের এই ২৫ জনের টিমকে সমস্ত পাড়া সম্ভ্রমের চোখে দেখত। একটু বড় হয়ে মায়ের নির্দেশ মেনে যখন সাহিত্য পড়তে শুরু করি প্রথমেই ভালো লেগেছিল শরৎচন্দ্র।
বাঙাল ঘটির অনুপাতে আমরা তিনটে পরিবার ছিলাম বাঙাল। অন্য তিনটে পরিবার ছিল ঘটি। প্রতি বছর দুর্গা পুজার সময় ওই তিনটে ঘটি পরিবার গ্রামের বাড়িতে পুজো দেখতে যেতগ্রাম থেকে টোপর দেওয়া গরুর গাড়ি আসত। টোপরের উপরের দিকে এবং ভেতরে দিকটা দামি কাপড় দিয়ে মোড়া থাকত। যে পরিবারে যত বেশি জমি তাঁদের গরুর গাড়ির সাজসজ্জা ততটাই অভিজাত। দু’টো তিনটে গরুর গাড়ি করে ওরা গ্রামের বাড়ি চলে যেত বাড়ির পূজো দেখতে। ভাগচাষি, রাখাল-বাগাল, গাড়োয়ান, বাড়ির কাজের লোক সবার জন্য জামাকাপড় কেনা হত। আমি শিশির ভেজা শৈশব চিনে চিনে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকতাম। আর মনে মনে বলতাম গদ্যের প্রজাপতি কাদের পাড়ায় ছাড়ব? আমাদের গঞ্জ শহরে তখন চারটে দুর্গা পুজো হতো। রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলো টিম টিম করে জ্বলত। কেউ কেউ প্রদীপ বা মোমবাতি দিয়ে ঝাড়লন্ঠন বানিয়ে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেড়িয়ে পড়ত। আমি ক্লাস এইটের পর পুজোর চারটে দিন বন্ধুদের গ্রামের বাড়িতে সকাল থেকে পুজো দেখতে যেতাম। কোনদিন আলপথ ভেঙ্গে। যৌবনবতী সোনালী ধানের শীষ ছুঁয়ে দেখতাম। গর্ভে কতটা দুধ আছে। একটা দু’টো শীষ মুখে দিয়ে দেখতাম। কুমারী মেয়ের স্তনের আঠাল স্তনের মত মনে হত। কোন কোনদিন সরু বুক চিতিয়ে শুয়ে থাকা গরম পিচরাস্তা, মাটি আর মোড়াম মেশানো কাঁচা রাস্তার ধুলো মেখে কৈশোর চিনতে যেতাম। থর থর ঠোঁট কাপা নারীর উষ্ণতা পেতে চাইতাম। পাইকপাড়া গ্রামের এক নারী ক্লাস নাইনে হাঁটুর নীচে নীল পাড় শাড়ি পড়ে স্কুলে যেত। তার আমাকে মনে ধরেছিল। সে মেয়ে শুনেছি বিঞ্জানী হয়ে আমেরিকায় আছে। সেই মেয়ের আমাকে মনে ধরলেও আসতে দেয়নি আমাদের পাড়ায় আর এক মেয়ে। এই সেই মেয়ে যে আমাকে কুরুশ কাটার অপূর্ব এক গেঞ্জি বুনে দিয়েছিল। ‘ওলি বার বর ফিরে আসে’। সেকথা আজ থাক। প্রজাপতি ও প্রজাপতি— তুমি বারে বারে পাখনা মেল। আজ গদ্যের প্রজাপতি।
বাংলা গদ্য সাহিত্যের প্রকৃত স্রষ্টা রাজা রামমোহন রায়। রাজা রামমোহন রায়ের আগের যুগে গদ্য সাহিত্য কতটা সামাজিক ছিলো? কেরি সাহেব, ফোরট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিতজনেরা ছিলেন। তারাও উপেক্ষিত ছিলেন বলেই অনেক বিশেষঞ্জের অভিমত। কেউ কেউ বলেন আঠার শতক নাকি চিহ্নিত হয়েছিল বন্ধ্যাকাল বলে। এটা মানতেই আমাদের দেশীয় অভিজাত শ্রেণীর কাছে বাংলা গদ্যের কোনও গ্রহণযোগ্যাতা ছিল না। ইতিহাসবেত্তারা বলেন, উনিশ শতকের তৃতীয় দশকের আগে পর্যন্ত আমাদের বাংলা ‘বাংলাগদ্য’ চিনতে পারেনি। সংস্কৃত ভাষার দাপটে বাংলাগদ্য ‘গদ্যছন্দ’ খুঁজছিল। এই শারদ বেলায় ভাষা সাহিত্য আমাদের বিষয় নয়। নিপবিথী বনে আমরা ফিরছি গদ্যের প্রজাপতির খোঁজে।              
শরতের সেই শিউলি সকালে কত প্রজাপতি নীল আকাশের নীচ দেখেছি। সেই প্রজাপতিগুলি ছিল কবিতার প্রজাপতি। ওদের ভাষা সেদিনও বুঝিনি আজও বুঝি না। আজ রবাহুতের ন্যায় এই কলম লিখতে বসে মনে পড়ছে একজনের কথা। তিনি ভাগ্যকাকু। ভাগ্যকাকু করতেন কি পূজোর চারটে দিন একটা খদ্দরের শান্তিনিকেতনী ব্যাগে করে ফুল নিয়ে যেতেন। সকালের অঞ্জলি হয়ে গেলে সেই ফুল ব্যাগ থেকে বের করে যারা দাঁড়িয়ে থাকতেন তাঁদের দিতেন অঞ্জলি দেওয়ার জন্য। বিভিন্ন রকমের ফুল থাকত ভাগ্য কাকুর ব্যাগে। জবা, শিউলি, টগর, শাপলা, পদ্ম, বেলফুল, বেলপাতা, আরও যেসব ফুল অঞ্জলি দেওয়ার জন্য লাগে তিনি সেইসব ফুল আমাদের মতো কম বয়সীদের হাতে দিতেন। অঞ্জলি হয়ে গেলে একটি ছেলের ব্যাগ থেকে কাঁচের বয়েম বের করে নারকেলের নাড়ু আর তিলের নাড়ু দিতেন প্রায় সবাইকে। ছেলেটি ভাগ্যকাকুর সঙ্গেই আসত। কম বয়সী ছেলে ওর নাম রাখাল। ভাগ্যকাকু খাদির পায়জামা আর ফতুয়া পড়তেন। সঙ্গের ছেলেটারও একই পোশাক। পরে জেনেছিলাম ভাগ্যকাকু ওই ছেলেটিকে রাস্তার থেকে ধরে এনে পড়াচ্ছেন। অনাথ ছেলে। ভাগ্যকাকু থাকতেন নলহাটি শহরের পশ্চিমদিকে বিবেকানন্দ বিদ্যাপীঠের কাছে একটি আশ্রমে। আমাদের পাড়ার পরে একটা চালকল ছিল। তারপর ছিল আশ্রমটা।  আশ্রমটার নাম ‘সর্বোদয়’ আশ্রম।            
 সর্বোদয় আশ্রমের আমরা অনেকবার গেছি। ভাগ্যকাকুর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পরে ঘনঘন যেতাম। তার কারণ ছিল গেলেই কিছু না কিছু খাবার পাওয়া যেত। এই আশ্রমে চরকা কাঁটা হতো। গুটিপোকা সেদ্ধ করে সিল্ক তসরের সুতো তৈরি হতো। আশ্রমে গুটিপোকার চাষ হতো। তার জন্য তুত গাছের চাষও করা হতো। আশ্রমের সবজি বাগান আলাদা ছিল। গোয়াল ঘর ছিল। গোয়ালে আট দশটা গরু থাকত। বছরভর দুধ দিত এইসব গরু। সেই দুধের দুধ দিয়ে নারকেলের নাড়ু তৈরি করতেন ভাগ্যকাকু আর তার আশ্রমিকরা। তিলের নাড়ুও আশ্রমে তৈরি হতো। আমরা জানতাম ভাগ্যকাকু স্বদেশী ছিলেন। আমার মনে আছে প্রথমদিন আমি যেদিন আশ্রমে যাই আমার এক বন্ধু সঙ্গে ছিল। তখন আমরা ক্লাস ফাইভে পড়ি। তার আগে আশ্রমে গিয়েছি কিন্তু ভেতরে ভয়ে যাইনি। যেদিন ভেতরে যাওয়ার সুযোগ এলো ভাগ্যকাকু তার ঘরে নিয়ে গেলেন। আশ্রমের সব ঘরের দেওয়াল পাকা হলেও চাল ছিল টিনের ছাউনি। ভাগ্যকাকুর ঘর ছিল অতি সাধারণ। কাঠের চৌকির বিছানায় একটা শতরঞ্চির উপর সাদা ধবধবে চাদরপাতা। বালিশও সাদা ওয়ার। চৌকির পাশে একটা টেবিলের উপর বিভিন্ন ব্যক্তির লেখা বই। গাঁধিজি,রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, জহরলাল নেহরু, সুভাষ বসু সহ আরও অনেকের। ভাগ্যকাকুর ঘরের দেওয়ালে ছিল ওইসব ব্যক্তিত্বদের ছবি। ছবিগুলি বেশিরভাগই ক্যালেন্ডার কেটে বাঁধিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভাগ্যকাকু সেদিন আমাকে আর আমার বন্ধুকে কাঁসার গ্লাসে একগ্লাস করে ভর্তি ঘন গরুর দুধ খেতে দিয়েছিলেন। আমরা দুজনেই লক্ষ্য করেছিলাম ভাগ্য কাকুর ঘরের পাশেই ছিল রান্নাঘর। জানলা দিয়ে দেখেছিলাম বড় বড় দুটো কাঁসার গামলায় দুধ গরম করে ঢেকে রাখা আছে।
পরের ঘটনা না লিখলে এইপর্বটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ওই রান্নাঘরেও ছিল একটা বড় জানলা। আমরা জানতাম দুপুরের সময় ভাগ্যকাকু আশ্রমে থাকেন না। জন সংযোগ করতে বেরিয়ে পড়েন। ফেরেন সন্ধ্যের সময়। আমরা তিন বন্ধু ঘন খাঁটি দুধের লোভে মাঝে মাঝে আশ্রমে গিয়ে চুরি করে দুধ খেতামরান্নাঘর বন্ধ অবস্থায় কি করে সম্ভব ছিল দুধ খাওয়া? আমাদের এক বন্ধু ছিল চতুর বুদ্ধির উদাহারণ। এসব বিষয়ে ওর মাথা থেকে বেরতো দুষ্টু   বুদ্ধি। গোপনীয়তার কারণেই কোনও বন্ধুর নাম উল্লেখ করছি না। দুষ্টু বুদ্ধির বন্ধুটি প্রস্তাব দিল রান্নাঘরে বড় তালা দেওয়া। কিন্তু জানলা খোলা। জানলায় মোটা তারের জালি। বিড়াল যাতে ঢুকতে না পারে। জানলার পাল্লা খোলা রাখা হোত হাওয়া বাতাস আসবে সেই কারণে। দুধ, রান্নাকরা খাবার যাতে নষ্ট না হয়। দুধ ঢাকা থাকত ভারি ভারি দুটো কাঁসার রেকাবি দিয়ে। তাহলে কি করা যায়? প্রথমে লোহার জালি একটা মোটা স্ক্রিউ ড্রাইভার দিয়ে বড় করে নেওয়া হয়েছিল। পেঁপে গাছের ডাল ভেঙ্গে পাতা ছাড়িয়ে পাইপ করে নেওয়া হল। পেঁপে গাছের ডাঁটা ব্যবহার করে অনেক কসরত করার পর একটা পাত্রের ঢাকনা কিছুটা ফাঁক করা গেল। তারপর আমাদের আর কে পায়? ‘চিচিং ফাঁক’। আমরা তিন জনে ওই পাইপ ব্যবহার করে অনেকটা দুধ খেয়ে ফেললাম। বেশিদিন পারিনি। কারণ কয়েকদিন এটা করার পর একদিন দেখি আমাদের পেছনে ভাগ্য কাকু দাঁড়িয়ে আছেনমুচকে মুচকে হাসছেন। আমরা ছুটে পালাতে যাচ্ছিলাম। ভাগ্যকাকু বললেন, ‘আহা পালাচ্ছ কেন? লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এই বয়সে এরকম সবাই করে । এসো আমার সঙ্গে এসো আমরা তাঁকে অনুসরণ করলাম। তিনি আমদের একটা লাইব্রেরি ঘরে নিয়ে গেলেন লাইব্রেরি ঘরের বড় জানলা থেকে ফুলের বাগান, সবজি বাগান দেখা যায়। পদ্যের প্রজাপতির দল সেখানে বাঁধা বন্ধনহীনভাবে ঘুরে ঘুরে ফুলের মধু খাচ্ছে। পাঠাগারের দেওয়ালে দেখলাম কয়েকটা লাইন লেটার প্রেসের মোটা হরফে লিখে ছাপানো হয়েছে। সেই লেখা কাঠের ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা রয়েছে। পণ্ডিত জহরলাল নেহরুর একটা উধৃতি। ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় নেহরু বলেছিলেন, ‘’যে যে ধর্মের মানুষ হই না কেন, আমরা সবাই সমানভাবে ভারতের সন্তান, আমাদের প্রত্যেকের সমান অধিকার, সমান সুযোগ ও সমান দায়িত্ব আছে।‘’ সম্প্রতি একটি বাংলা দৈনিকে ইতিহাসবিদ এবং সাংসদ সুগত বসু ১৯৪৭ সালের ১৪-১৫ অগস্ট মধ্যরাত্রিতে পণ্ডিত নেহরুর বক্তব্যের অংশটি উল্লেখ করেছেন। সেদিন ভাগ্যকাকু আমাদের ওই উধৃতি দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘’তোমাদের যখন দুধ খেতে ইচ্ছে করবে চলে আসবে। আমি না থাকলে রাখালকে বলবে রাখাল তোমাদের দুধ দেবে। আমাদের আশ্রমের দুধ বিক্রি করা হয়না। আমরা খাই। আশ্রমে যারা কাজ করে তাঁরা খায়। আর অতিথি এলে তাঁদের দেওয়া হয়। দুধের সড় দিয়ে ঘি করা হয়। সেই ঘি একই রকমভাবে আমরা সবাই খাই। যৌথভাবে সমাজবদ্ধ জীবন যাপন না করলে আমরা মানুষ পাব কোথায়?’’
সেদিন থেকেই আমাদের মূল্যবোধ গড়ে উঠেছিল? পাঁচ-ছটা পরিবারের ছেলমেয়েদের বড় হয়ে ওঠার যূথবদ্ধ জীবনযাপন ছিল সর্বজনীন নাটমন্দিরের মতো। সেই নাটমন্দিরের কারিগরেরা আজ আর কেউ বেঁচে নেই সম্ভবত দু-একজন থাকলেও বয়সের ভারে তাঁদের আজ অনেক সীমাবদ্ধতা। তারাই আমাদের গড়ে দিয়ে গেছেন। কত রকমভাবে আমাদের শৈশব কৈশোর সেই অভিভাবকেরা গড়ে দিয়ে গেছেন। সেই ভিতের উপরে দাড়িয়েই আজ খাটি মানুষ খুঁজি। আসল মানুষ খুঁজি। শিক্ষিত মানুষের শিক্ষিত বিবেক খুঁজি। আরও অন্যদের মতো তারাও বলে গেছেন, ইস্ট দেবতা তোমার হ্রদয়ে বাস করছে। তাঁকে খুঁজে নিতে হবে শিক্ষায়, জনশিক্ষায়, ঞ্জানে, সামাজিক বন্ধনে।                                            


No comments:

Post a Comment