Saturday 2 September 2017

প্রতিষ্ঠান ছাড়া গণতন্ত্র হয়না অবহেলিত শৈশব কি আমাদের দলছুট গণতন্ত্র চেনায়?

প্রতিষ্ঠান ছাড়া গণতন্ত্র হয়না অবহেলিত শৈশব কি
আমাদের দলছুট গণতন্ত্র চেনায়?: 
সময়টা আশির দশক। সত্তর দশকের শিক্ষা, সংস্কৃতির মুক্ত হাওয়ার মূল্যবোধ তখনও টাটকা। আমরা যারা অবহেলিত শৈশব কৈশোর চিনে আল টপকে, রেল লাইন টপকে, আঁকাবাঁকা ট্রাম লাইনের পথরেখা চিনে এই কলকাতা শহরের ভাঙাচোরা রাস্তায় নাগরিক চিনছি। তখন সদ্য গড়ে ওঠার নগর সভ্যতার মাঝেও মানবিক কলকাতার আন্তরিক পদচারণা একাধিকবার দেখেছি। বা বলা যায় দেকেচিএই শহর আধুনিক নাগরিক সভ্যতায় ততটা অভ্যস্ত ছিল না। মেট্রোরেল, ইন্টারনেট সভ্যতার গতি তখনও কলকাতায় মানবতাকে আক্রমণ করতে পারেনিবিশ্বায়ন নামক দৈত্য, আধুনিক সভ্যতার ‘মল’ নামক ‘ফার্স্ট লাইফ’-এই কলকাতাকে গ্রাস করতে পারেনি। আশির দশকে সামাজিক সংগঠনে কাজ করার সুবাধে দেখেছি ‘বৌ বাজার’-এর মোড়ে, ‘ব্যঙ্ক অফ ইন্ডিয়া’-এর (আমহারট স্ট্রীটে) সংযোগ স্থলে দিনের বেলায় কোলে কাঁখে শিশু সন্তান নিয়ে ‘বারবণিতা’ বাবু বা খদ্দের ধরার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। শিশুর নাক দিয়ে পোটা ঝড়ে পড়ছে। মুখে আঙ্গুল, মা মুখ থেকে আঙ্গুল টেনে বার করে দিচ্ছে। নাকের জল মুছে দিচ্ছে। আমার এক বন্ধু কৌতূহল মেটাতে এক যৌনকর্মীর কাছে জানতে চেয়েছিল। সে যদি ওর ঘরে যায় কত নেবে? টাকার অঙ্ক নিয়ে দরাদরি করার পর বন্ধুটি কোলের বাচ্চাটার কথা জানতে চেয়েছিল। সে যখন ঘরে যাবে বাচ্চাটি কোথায় থাকবে? উত্তরে মধ্যতিরিশের মহিলা বলেছিল, ‘আমার ছেলে আমার ঘরে থাকবে। খেলা করবে। আমাদের চৌকিটা তারে কাপড় চাদর দিয়ে ঘেরা আছে।’ এই হচ্ছে মা। এই সেই মানবতা। রাস্তার ঝুপড়িতে যা আজও পাওয়া যায়। পাওয়া যায় রেল লাইনের ধার বরাবর হাঁটলে। ভারতের মেট্রোপলিটন, নন মেট্রোপলিটন যে শহর সভ্যতায় হাঁটলে। মাতৃত্বের একঘর এক উঠোন সংসারে তুলসিতলার পিদিম জ্বেলে বসে থাকার চিরসত্য খুঁজে পাই আমরা। খুঁজে পাব শহর ছাড়িয়ে যে কোনও গাঁ গঞ্জে গেলে। মায়ের আকুল হয়ে সন্তানের প্রতীক্ষায় বসে থাকা। সব কিছুর মূল্যে মায়ের কাছে তাঁর কোলের শিশু আগে। ঈশ্বর পাটানির সেই অমোঘ শব্দ ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’।       
একটু পরে আসছি আজ কেন এই প্রসঙ্গ টানলাম সেটা একটু পরেই আমি বলতে চাইব। সমাজে জীবনের গতিময়তা যত বাড়ছে সভ্যতা কি ভুলে যাচ্ছে শিশুর দায়িত্বের কথা? আজকের শিশুইতো আগামী দিনের জাতির ভবিষ্যৎ।    
আশির দশকের ‘বিবেক দংশন’-এর সময়টা আমি কলকাতার বৃহত্তম পাইকারি সবজি বাজার ‘কোলে মার্কেট’ নামক বাড়িটির ‘মেসে’ দু’দফায় প্রায় চার বছর ছিলাম। মাননীয় বাবলু কোলে আপনার সঙ্গে আমার বার দু’তিনেক দেখা হয়েছে। আপনি ভুলে যেতে পারেন। আমার মনে আছে, আমার মতো অনামী এক যুবককে   আপনার প্রয়োজন হয়েছিল কোনও একটা সাহাজ্যের জন্য। এবং আমার সাহায্যে আপনার কাজটাও হয়েছিল। আপনি খুশি হয়ে গণেশ মারফৎ তপনবাবুর ঘরে বড় এক প্যাকেট মিস্টি পাঠিয়েছিলেন। পরে আপনার বাজারে চন্দ্র, গণেশ, তপনবাবু এবং অন্যান্যদের মাধ্যমে অনেক অনেক পচা সব্জির জল বয়ে গেছে। কলকাতা বদলে গেল। কলকাতা বদলে গেছে। আমরা নতুন বৃত্তে এলাম। আমাদের মূল্যবোধ বদলে গেছে। আমরা বদলে গেছি। কেউ ‘চিটিং বাজ’ শব্দে এখন পরিচিত হয়। বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর গল্পগাছা বৈধ অবৈধ অর্থ-সংস্কৃতির সুবাদে আপনাদের কর্ণগোচর হয়ে থাকতে পারেএকা মানুষকে সবাই আক্রমণ করতে চায়। পরিকল্পিতভাবে ‘অন্যায়’ যখন সভ্যতার রাশ ধরে ‘প্রতিবাদীর দল’ সংখ্যায় কমে যায় এবং তাঁকে একা পেয়ে ঠেলতে ঠেলতে মিথ্যার চোরা গলিতে নিয়ে যায়। সংগঠিত প্রচারমাধ্যম সংগঠিতভাবেই প্রচার করে। সভ্যতা ধংসের অভিভাবক হয়ে উঠতে সক্রিয় থাকে। এই প্রক্রিয়া চলার সময় চাঁদ সূর্য পশ্চিম উত্তর দিক ঠিক করে চলে কি? আপনার আমার বা দিকে যেটা দেখি ডান দিকেও একই সভ্যতার আবছা আলোয় সে পৃষ্ঠার হাবিজাবি নজরে পড়ে।  কিন্তু পৃথিবী কখনও কি ধবংসের কাছে আত্মসমর্পণ করে? ন্যায় এবং সত্য সমস্ত অন্ধকার ছাপিয়ে ধ্রুবতারা হয়েই উজ্জ্বল হয়।
যারা আপনাদের বাজার কাম মেস, আমার কথায় ‘কোলেদের বাড়ি’। ওই বাজারে সেই দশকে মাত্র পাঁচ টাকায় দিন এবং রাতের খাবার (মাসে মাত্র দেড়শো টাকা) খেয়েছে তাঁরা আপনাদের জনসেবার কথা কি কোনোদিন ভুলতে পারে? দিনের খাবার পাওয়া যেত মাছভাত আড়াই টাকায় বিভিন্ন রকমের মাছ পৃথক পৃথক দিনে।  রবিবার মাছ এবং মাংস। রাতে রুটি, ডাল, দু’টো সবজি। পুজোর সময় বিশেষ মেনু। আপনার ওই বাড়ির মেসে রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলার মেধাবী ছাত্ররা থাকার সুযোগ পেয়েছে। এর কারণ আপনাদের বনেদি পরিবার ছিল জাতীয়তাবাদী এবং অবশ্যই কংগ্রেসি ঘরানার। আপনার ওই বাড়িতে থাকার লড়াই আমাকে সারা জীবনের জন্য কলকাতা শহরে হাঁটতে শিখিয়েছে। এই লেখায় সেই সময়ের এক রাতের অভিঞ্জতা দিয়ে এই লেখা লিখতে চাইছি। তার আগে আমার সেই সময়ের রোজ নামচার খাতা থেকে একটা লেখা তুলে দিচ্ছি।
১-১১-৮৩, ছেলেটাকে পেলাম ঘর খুলতেই। না না ঘরে সে ছিল না। এলো। আগে এই লাইব্রেরিতে ও দশমাস থেকে গেছে। ভালো লাগল। কি অদ্ভুত কথা বলে, রাজনীতি একদম ভাবে না। ‘নোটা’ জাতীয় কিছু একটা নিয়ে ভাবে। রাজনীতিকদের উপর খুব রাগ। আমি ওকে বললাম, ‘এভাবে দু’টো জিনিস হতে পারে না। পরস্পর বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি কারো থাকতে পারে না।’ কিছুটা বুঝল। ছাত্রবেলার স্বতঃস্ফূর্ততা রয়েছে ওর মধ্যে।
ওঁচা সংস্কৃতির মধ্যে যারা আজ আর্ত মানুষ, দুঃস্থ শিশুদের জন্য কিছু কাজ করার কথা ভাবছে তাঁরা আজ আর   পাঁচজনের তুলনায় এগিয়ে। এদিন সুনু নামের ছেলেটিকে ঠিক তাই মনে হল। কথা বলার ভঙ্গিমায় আবৃত্তির ঢঙ। ভালকরে নজর দিলে অনেকের কাছে ধরা পড়ে। পরে সম্ভবত ও প্রকাশও করে। যা আমাকে করল। তবু ভালো লাগল। ঐ বয়সটা আমি ছুটে পেড়তে চেয়েছিলাম। পারিনি। ধাক্কা খেয়েছি। বারে বারে ধাক্কা খেয়েছি। আরও বাস্তবকে চিনেছি।
এই লাইব্রেরি যেমন আমার কাছে এখন বাস্তব। এখানে আসার আগে কল্পনা ছিল এইরকম- (১) দু’টো ঘর, (২) আলো-বাতাস থাকবে, (৩) ঘরের সঙ্গে লাগোয়া পায়খানা, বাথরুম পাব। (৪) এবং দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় সব কিছু পাব। কি হল? সব উলটে গেল। ঘরের সমস্যা যদিও খুব একটা নয়। তবে দিনে সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত হতে হয়। বাড়িওয়ালা দিনে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখে। পায়খানায় লাইন। স্নান করতেও লাইন। আমাদের বাড়িটা পাঁচতলা। লাইব্রেরিটা দুতলায়। নীচে বিরাট পাইকারি সবজি বাজার। অন্যান্য কিছু জিনিষও পাওয়া যায়। সকাল ছ’টা থেকে রাত্রি তিনটে পর্যন্ত খোলা। ব্যবসাদাররা সব সময় ব্যস্ত। নীচ থেকে সম্মিলিত গলার আওয়াজ। বড় বড় ট্রাকে করে সবজি যেমন আসে আবার ছোট ছোট টেম্পু, ঠেলা করে সবজি কলকাতা সহ বিভিন্ন শহরতলীতে চলে যায়। কত রকমের মানুষ এই সময়টায় দেখতে পাওয়া যায়। বাঙালি হিন্দি ভাষায় কথা বলে। অবাঙালি দোখনো ভাশায় কথা বলে। প্রায় অভ্যস্ত হয়ে আসছে। তবে পচা সব্জির গন্ধ সয়ে সয়ে দেহ মন সবজিময় হয়ে থাকে। বাজারের বাইরে কোথাও থাকলে কখনও কখনও মনে হয় সব্জির গন্ধটা গায়ে লেপ্টে আছে।                       
তখন রাতের কলকাতা দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। কারণ আমি ওই বাড়িটার যে ঘরটায় থাকতাম সেটা একটা পাঠাগার ছিল। দিনে সূর্যের আলো ঢুকত না। রাতে একটা বাল্ব জবালিয়ে আমি রাত দশটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত পড়তাম। তারপর ঘুমতে যেতাম। সকাল সাড়ে ন’টা থেকে দশটার মধ্যে ঘুম থেকে উঠে পড়তে হত। কারণ সকাল দশটার পর পুরসভার জল আর পাওয়া যাবে না। তাই বড় বাড়ির কাজ সেরে ফেলা এবং স্নান করে নিতে হবে দশটার মধ্যে। জানি না এই লড়াইয়ের কথা আমার বন্ধুস্বজনদের কতটা মনে আছে। তাঁরা আজ সুপ্রতিষ্ঠিত। এমন একটা রাতের কথা। এক মায়ের কথা। মধ্যরাতের সন্তানদের কাছে শপথ নেওয়ার ভাষায় আমি দেশের কথা দশের কথা শিশুদের কথা পড়ছি।  রাত সাড়ে দশটা হবে। ভদ্র শিক্ষিত মধবিত্ত কলকাতা তখন বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছে। রাতের কলকাতা একটু একটু করে জাগছে। পার্কস্ট্রীট, ফ্রীস্কুল স্ট্রীট, কালীঘাট, বাবুঘাট, হাড়কাঁটা লেন, সোনাগাছি, কোলে মার্কেট, বৈঠকখানা মার্কেট একটু একটু করে জেগে উঠছে। আমি কোলে মার্কেটে বসে বসে সেই তাপ উত্তাপ পেতাম। সিগারেট শেষ হয়ে গেলে নীচে গিয়ে সিগারেট কিনে আনতাম। ক্লান্ত চোখকে জাগিয়ে রাখতে কখনও কখনও চা খেতে নীচে নামতাম। কত বিচিত্র সব ঘটনা। কত বিচিত্র সব নারীপুরুষ দেখেছি। সেই রাতে খুব সন্তর্পণে চন্দ্র আমার ঘরে এল। ঘরে ছিটকেনি, দরজার খিল সবই ছিল কিন্তু সেসব দেওয়ার প্রয়োজন হত না। আমার ঘরের পাশেই কোলেবাবুদের নিরাপত্তা কর্মীদের ব্যারাক। চন্দ্র এসেই বলল, ‘তপনবাবুর এক আত্মীয় খুব বিপদে পড়েছে। তোমার একটু সাহায্য চায়। আমার মনে হয় তুমি এটা করবে।’
বিষয়টা কি জানতে চাইলাম। চন্দ্র বলল, ‘আমি ওনাদের ডেকে দিচ্ছি। তপনবাবুর ঘর তিন তলায়। আমাদেরটা দোতলায়, তাই ঝোলা বারান্দা থেকে ওদের ডেকে নেওয়া হল। যা শুনলাম। তপনবাবুর এক আত্মীয়ের স্ত্রী নীল রতন সরকার হাসপাতালে প্রসূতি বিভাগে ভর্তি আছেন গত কয়েকদিন আগে থেকে। সন্তান সম্ভবা। কিন্তু পরিস্থিতি জটিল। ডাক্তার নার্স কেউ কোনও সাহায্য করছে না। আমি শুনেই ছুটলাম। হাসপাতালে পৌঁছে দেখলাম অসংখ্য রুগীর সঙ্গে ভদ্রমহিলা বারান্দায় মেঝেতে শুয়ে আছেন। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। আমি আমার কথার জোরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে নিরাপত্তা কর্মীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করলাম। তাঁর সাহায্যে রাতের দায়িত্বে আছেন সেই নার্স ইনচার্জের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি বললেন, ‘হ্যা আমরা ওকে লেবার রুমে নিয়ে যাব। এখন হাউস স্টাফদের ডিউটি পরিবর্তনের সময়। হাউস স্টাফ ডাঃ নবদ্বীপ সেন আছেন। উনি আসলেই আমরা কাজ শুরু করব। মহিলার অবস্থা ভালো নয়। আমি সব কথা বলতে পারব না।’
আমি জানতে চাইলাম, ‘আচ্ছা সিস্টার ডাঃ সেনের কি বীরভূমের নলহাটি বাড়ি?’ সিস্টার হ্যা বলতে বলতেই নবদ্বীপ চলে এলো। আমাকে দেখেই নবদ্বীপ বলল, ‘তুমি এখানে?’ আমার উত্তর শুনে ছেলেবেলার বন্ধু আমাকে বলল, ‘তুমি একটা কাজ করো আমাদের হস্টেলে ডাঃ রামচন্দ্র ডোম আছে। ও বীরভূমের ছেলেআমি পেশেন্ট দেখছি। আমার সিনিয়রকে আমি ডেকে নিচ্ছি আমার নিজের রেফারেন্স দিয়ে। তুমি রামকে গিয়ে আমার পরিচয় দিয়ে সবটা বল।’
রাত তখন সারে বারটা। বহু কষ্টে স্টুডেন্ট হস্টেলের ভেতরে যেতে পারলাম। ডাঃ রামচন্দ্র ডোম আমার কথা শুনেই একটা সাধারণ জামা পড়ে আমাদের সঙ্গে বেড়িয়ে এলেন। ততক্ষণে সময় অনেকটা চলে গেছে। আমরা প্রসূতি ওয়ার্ডের বাইরে অপেক্ষায় বসে থাকলাম। ডাঃ সেন আমাকে আলাদা করে ডেকে নিয়ে বলল, ‘ভদ্র মহিলার জন্ডিস হয়েছে। ওনার স্বামী এবং তোমার বন্ধুদের আগে বলা হয়েছিল। কেউ কিছু করেনি। এখনই তিন চার বোতল রক্ত লাগবে। আমরা এক দু’বোতল ব্যবস্থা করছি।’
আমরা ছুটলাম সেন্ট্রাল ব্লাড ব্যাঙ্ক। আমার ডাক্তারদের সঙ্গে পরিচয়ের সুবাদে মাত্র এক বোতল রক্ত নিয়ে ফিরলাম। সময় তখন দু’ঘণ্টা কেটে গেছে। পেশেন্টের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। ভদ্রমহিলার স্বামী, আমি আর একজন কেউ পেশেন্টের কাছে গেলাম। সমস্ত শরীর নীল হয়ে গেছে। দু’চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ছে। কাতর স্বরে স্বামীর হাত দু’টো টেনে নিয়ে অস্পষ্ট ভাষায় যা বলল, বুঝলাম তাঁর সন্তানটিকে যেন স্বামী দেখে। এরপর ভদ্রমহিলা মারা যান। আমি এই ঘটনা আজও মনে রেখেছি। মৃত্যুমুখী মায়ের অস্পস্ট স্পন্দন আজও আমাকে ভারতীয় নারীর চিরন্তন আবেদনের কথা শুনতে বলে। যতদূর জানি পুত্রসন্তানটিকে একটি অনাথ আশ্রমে রেখে ভদ্রমহিলার স্বামী বড় করেছেন। শৈশবকে হারিয়ে যেতে দিতে নেই। একুশ দিনের শৈশবকে আমার এক বন্ধুর মা এবং সেই বন্ধু পথ, পরিবার, সমাজ, সভ্যতা চিনতে শিখিয়েছে। একুশ দিন বয়সে শিশুটির মা মারা গিয়েছিল। সেই  সন্তানের বয়স আজ ৩৭ বছর। ওই সন্তানের পিতা দ্বিতীয় বিয়ে করে মহাপুরুষের মতো আজও স্বার্থপর পিতৃত্বের আসনে বসে আছে। 
বিংশ শতাব্দীর আশির দশকের এক রাতের গল্পকথা দিয়ে আলো অন্ধকারের ঠাসবুনোট মানব সভ্যতা আমরা দেখলাম। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের এই ২০১৭- এর শুরুটাই হয়েছিল আমাদের রাজ্যে একটার পর একটা শিশু পাচারের মতো হিংস্রতম গল্পগাছার খবর দিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে দুঃসাহসিক কাজ করেছেন সেটা অবশ্যই সরকারী নথিতে যেমন লেখা থাকবে লেখা থাকবে মানুষের মনে। যে কথা লেখার ইচ্ছে থাকলেও সাহস পাইনি। গত কয়েক বছরের নীরব মানসিক এবং সংগঠিত সামাজিক অত্যাচার আজ আমাকেও বলছে মূক হয়ে থাক। গত কয়েক বছর অকারণে আমাকে এই শহরে হেনস্থা করা হচ্ছে। অপমান করা হচ্ছে। সংগঠিত হেনস্থা।  কিন্তু চেতনার আঘাত থাকলে আঘাত হানলে আমাকে বলতেই হবে, সভ্যতা কি আমাদের মূক হয়ে থাকতে দেবে? মানব সভ্যতা আমাদের বার বারে বলে ‘আমার শিশু তোমার বারান্দায়’বারান্দায় রোদ্দুর আছে। বারন্দায় চাঁদের আলো আছে। শিশুর কোনও জাত হয় না। ওর কোনও ধর্ম হয় না। ওর কোনও সম্প্রদায় হয় না। তবুও উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, দক্ষিণভারত, (সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর গুরু গুরমিত সিংহ রাম রহিম ইনসানের আশ্রমে ৫-১৫ বছরের ৩৫ জন শিশু কিশোরকে পুলিশ উদ্ধার করেছে।) দেশের সংবাদ মাধ্যম গত কয়েক বছরে আরও দায়িত্ব নিতে এগিয়ে আসছে। এই সময়ের সাংবাদিক বন্ধুরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অনেক সাহসী খবর করছেন। যেটার প্রয়োজন অনেক আগে থেকেই ছিল। পশ্চিমবঙ্গ সহ একাধিক রাজ্যে আমরা শিশুদেরকে হয় পণ্য করছি না হলে অনাদরে অবহেলায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছি। এর দায় কে নেবে?
কেন ভারত নামক ‘পোস্ট ট্রুথ’ বাস্তবতার একটি দেশ একুশ শতাব্দীতে দাড়িয়েও শিশুদের নিয়ে রাজনীতি করছে? একবার ভাবুন এই রাজ্যের স্কুলের শিশুরা ‘এক ভারত’ দেশ ব্যাগে নিয়ে স্কুলে যায় কেন? বিতর্ক, মামলা মকদ্দমা চলছে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশক থেকে? পশ্চিমবঙ্গ রাজনৈতিক এবং সংস্কৃতি সচেতন প্রগতি ধারার রাজ্য। সেই রাজ্যে পশ্চিম নিয়ে গর্ব করার লোকের অভাব নেই। কিন্তু তাঁরা পারেননি এই সমস্যা পশ্চিমের উন্নত দেশগুলির মডেলে সমাধান করতে। কোনও রাজনৈতিক দলের গণসংগঠন সামাজিক সচেতনতার আন্দোলন গড়ে তোলার দায়িত্ব হয় নিতে চায়নি না হলে বিতর্ক এবং ভোট ব্যাঙ্কের কথা ভেবে এগিয়ে আসতে পারেনি। বর্তমান রাজ্য সরকার একটা চেষ্টা করছে বলেই মনে হয়। প্রতিষ্ঠান ছাড়া গণতন্ত্র হয় না। অবহেলিত শৈশব কি আমাদের দলছুট গণতন্ত্র চেনাচ্ছে?                                                       

No comments:

Post a Comment