Saturday 4 March 2017

আমরা মর্মাহত

আমরা মর্মাহত

কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় খবরটা পড়লাম অতি সামান্য ঞ্জান নিয়েও ঠিক মেলাতে পারছিলাম না। বাংলাদেশের শিশু পাঠ্যসূচি থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এস ওয়াজেদ আলি, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বাদ পড়েছে। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে এমনটাই খবর। আমি এই খবর পাওয়ার পর কলকাতায় আমার পরিচিত কয়েকজন বাঙালি বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে কথা বলি। তাঁরা বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রকের এই সিদ্ধান্ত ঠিক মেনে নিতে পারছেন না। তাঁদের বক্তব্যের সারমর্ম ‘আমরা আন্তরিকভাবে মর্মাহত’। বাংলাভাষার জন্য যে দেশ আত্মিকভাবে সারা বিশ্বের আপামর বাঙালির কাছে শ্রদ্ধা, স্নেহ-মায়া, ভলোবাসা এবং আত্মীয়তার বন্ধনে বাঁধেন, সেই বাংলাদেশ সরকার এমন একটা সিদ্ধান্ত নিল? সম্প্রতি একটি সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকাশ বর্তমান বিশ্বে ১৩০ কোটি মানুষ জাতীয় সংগীত গান বাংলা ভাষায়। ১২৫ কোটি চিনা মানুষ জাতীয় সংগীত গান চিনা ভাষায়। মাত্র ৯৪ কোটি মানুষ ইংরেজি ভাষায় জাতীয় সংগীত গান। পুনরাবৃত্তি করলে কি অতিকথন হবে? আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আমাদের মাতৃভাষা আপন গরিমায় সম্মান অর্জন করেছে।  
সম্প্রতি কলকাতায় একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের  মানবাধিকার আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা শাহরিয়ার কবীর মন্তব্য করেন, ভাষার কোনও ধর্ম নেই। একুশে ফেব্রুয়ারির মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বাহান্নয় মাতৃভাষার স্বীকৃতির জন্য যে বাংলাদেশকে রক্ত ঝরাতে হয়েছে, সেই দেশ এখন নতুন আক্রমণের মুখে। এই আক্রমণকারীরাও শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন, কিন্তু চিন্তা চেতনায় তাঁরা তথাকথিত গ্রামীণ মূল্যবোধে অভ্যস্ত। বাংলাদেশের পাঠ্যবই থেকে তাঁরা অমুসলিম লেখকদের লেখা বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতাও সম্পাদনার স্পর্ধা দেখাচ্ছেন বর্তমান সরকার মুক্তবুদ্ধির মানুষের পাশে রয়েছে। কিন্তু কখনও কখনও তারাও মাথা নত করে ফেলছে। পাঠ্যসূচি সংস্কারের নামে তারা মুক্তচিন্তার বিপক্ষে আছেন যারা তাঁদের কিছু দাবি মেনে নিয়ে লজ্জাজনক উদাহারণ তৈরি করছে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট সমাজ কর্মী বলেন, ‘’একুশে মাথা নত না-করার শপথ শিখিয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে। জয় তাঁদের হবেই।‘’ এই বক্তব্য যে অনুষ্ঠানে শাহরিয়ার কবীর বলেন সেই অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত ছিলাম না। ২২ ফেব্রুয়ারি কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি বহুল প্রচারিত বাংলা দৈনিকে এই খবর প্রকাশিত হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দলের বাংলাদেশ সরকার কি আধুনিক আর্থসামাজিক পরিস্থিতির মানদন্ডে সংস্কৃতির গড়াপেটা করছেন? ভারতীয় উপমহাদেশের একটি অনুন্নত দেশ গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ। গত কয়েক দশকে এই দেশে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজি বিনিয়োগ হয়েছে এবং হচ্ছেপেট্রো ডলার যেমন আসছে। আসছে ভারতীয় টাকা। আসছে ইউরোপ আমেরিকার ডলার। পিছিয়ে নেই এশিয়ার চিন এবং জাপান। এতগুলি দেশ মুক্ত বাণিজ্যের সুযোগে নিজেদের দেশের পণ্য বাংলাদেশে রফতানি করতে পারছে। বাংলাদেশে গিয়ে পণ্য তৈরি করে সেই পণ্য ভিন দেশে পাঠিয়েও সম্ভবত বৃহৎ বাণিজ্য হচ্ছে। পুঁজির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশে আর্থসামাজিক এবং আর্থসাংস্কৃতিক কাঠামো, পরিকাঠামো এবং উপরিকাঠামোর পরিবর্তন হয়। সমাজবিঞ্জানীদের ব্যাখ্যাতেও সেই পরিভাষা আমরা পাই। পণ্য সংস্কৃতির হাত ধরেই উন্নত দেশে এবং উন্নয়নশীল দেশে ছোট ছোট বাজার বা হাটের পরিবর্তে আমরা ‘মল’ নামক এক ছাদের তলায় বাজার করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি।
গতিশীল সমাজের সঙ্গে তালমিল রেখে স্বদেশের সভ্যতাকেই গড়ে নিতে চাইছে সেইসব দেশের আধুনিক মনস্ক সরকার এবং আধুনিক নাগরিক। কালের নিয়মেই সম্ভবত এই ব্যবস্থা আমদের টেনে নিয়ে যায়। দ্বান্দিক বিকাশের পরম্পরা মেনে। লড়াইটা সেই শুরুর বিন্দু থেকে। সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক সংস্কৃতি বিকাশের অধিকার নিয়ে হাজির হয়। সেই সময়টার সঙ্গে কতটা সমঝোতা করে একটা দেশ নিজেদের ঐতিহ্য কতটা রাখবে কতটা বর্জন করবে নির্ভর করছে সেই দেশের চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীদের উপর। পুঁজিবাদী কতৃত্ব কায়েমের সঙ্গে সঙ্গে ওই ঘরানার সংস্কৃতি ‘স্বাধীনতা’ দিতে চায় মানুষকে। কথা বলার স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ইত্যাদি। এই স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সৃজনশীলতার অনেকটা সময় ওই সংস্কৃতি আমাদের টেনে নিয়ে যায় ভোগবাদের চরমতম সীমায়। যারা যত বেশী ওই সংস্কৃতির সঙ্গে সমঝোতা করব ততই অচেনা সভ্যতার আলোকছটায় ভাসিয়ে দিতে থাকব নিজেদেরকিন্তু যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন সৃষ্টির তাগিদে নিজেদের ধ্রুপদী তাল লয় চিনতে চাইবে তাঁদের হয়ত আগামীতে ব্যর্থ হিসাবে চিহ্নিত করবে চলতি সমাজ ব্যবস্থা ভোগবাদী সমাজের গণ্যমান্য প্রতিনিধিরা।  নবীন প্রজন্মের কাছে প্রচারের অভাবে ওইসব সৃষ্টিশীল মানুষদের বাতিলের খাতায় ফেলে দেওয়া হয়। তবু লড়াইটা কি থামে? সম্ভবত দ্বান্দিক বিকাশের ধারবাহিক নিয়ম মেনেই ধ্রুপদী সাহিত্য, শিল্প, চিত্র, সংগীত সমাজকে মনে করিয়ে দেয় যা কিছু পুরনো সবটা কি পণ্য সংস্কৃতি গ্রাস করতে পারে? ওনেকটা ভাষা শিক্ষার মত। মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ। বাংলাভাষা জানা একজন মানুষ যদি ভিন্ন ভাষা শিখে বাংলা ভাষায় কম কথা বলেন তাহলে যেমন ‘গুরুচন্ডালি’ দোষ নজরে পড়ে। অনেকটা চম্পট শব্দের ভাষা-চম্পট ভাষার কোলাজ-এর মত।  ভারতে বর্তমান প্রজন্ম যেমনভাবে কথা বলছে। ভিনদেশের বা ভিন রাজ্যের ভাষা জানায় কোনও আপত্তি থাকাতে পারে না। ‘দেশে বিদেশে’-এর লেখক সৈয়দ মুজতবা আলি কতগুলি ভাষা জানতেন? উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে এই লেখায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ওঁরাও জনগোষ্ঠীর ভাষাকে স্বীকৃতি দিল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার। ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘’আমরা নেপালি, গুরমুখী, অলচিকি ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছি। একইভাবে কুরুখ ভাষাকেও বেছে নিয়েছি। কারণ, এই ভাষা অবলুপ্তির পথে। মাত্র ১৬ লক্ষ মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন।‘’ মুখ্যমন্ত্রী ওই অনুষ্ঠানে আরও জানান, রাজবংশীদের কামতাপুরি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য একটি কমিটি গড়া হয়েছে।   
পণ্য সংস্কৃতির দাপটের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমান সভ্যতাও অতীত থেকেই ধ্রুপদী ধারা বয়ে আনতে আগ্রহী। কয়েকদিন আগে শান্তিনিকেতন সূত্রে খবর পেলাম, বিশ্বভারতীর উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের গানকে গ্রামাঞ্চলে আরও জনপ্রিয় করতে প্রশিক্ষণ শিবির করা হবে। সেই সব প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রথমদিকে ডেকে নেওয়া হবে শান্তিনিকেতনের আশপাশের গ্রামগুলির আগ্রহী ছেলেমেয়েদের। রবীন্দ্রনাথের গানের প্রশিক্ষণ শিবিরে গান শেখাবেন এপার বাংলার জনপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত আচার্য, শ্রাবণী সেন এবং স্বপন বসু২৪ ফেব্রুয়ারি ইতিমধ্যে ‘ইন্সটিটিউট অব রুরাল রিকন্সট্রাকশন ইন শ্রীনিকেতন নামে এই সংস্থা একটি ওয়ার্কশপের আয়োজন করেছে। আগামী কয়েক মাসে এই ধরনের আরও প্রশিক্ষণ শিবির আয়োজন করা হবে। বিশ্বভারতী সূত্রে আমরা খবর পেয়েছি ১৯২২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই প্রশিক্ষণ শিবির প্রথম আয়োজন করেন। এবং ওই বছরেই কবিগুরু ‘ইন্সটিটিউট অব রুরাল রিকন্সট্রাকশন ইন শ্রীনিকেতন’ গড়ে তোলেন গ্রামের তরুণ প্রজন্মকে সংগীত প্রশিক্ষণ সহ একাধিক ভোকেশনাল শিক্ষায় শিক্ষিত করতে।
  আলোচ্য নিবন্ধের বিষয় ছিল বাংলাদেশের শিশু পাঠ্যসূচি থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এস ওয়াজেদ আলি, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা বাদ পড়েছে। সংবাদ মাধ্যম সূত্রে এমনটাই খবর। কি খবর ছিল? আসুন পুরো খবরটা আমরা পড়ে দেখি।
বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র      
‘’কলকাতা: কট্টরপন্থী মুসলিম সংগঠনগুলির চাপের কাছে নতিস্বীকার করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্য স্কুলের পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দিল বাংলাদেশ। এমনকী রবীন্দ্রনাথের কবিতা আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতেও বাদ পড়েছে ষষ্ঠ শ্রেণির সিলেবাস থেকে। পাঠ্যক্রমে রদবদল আনা নতুন কিছু নয়। কিন্তু মুসলিম গোষ্ঠীগুলির দাবি, এই কবিতাটি হিন্দু দেবীর উদ্দেশে লেখা হয়েছে। সে কারণে এটি পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ।
এছাড়াও বাদ পড়েছে ১৬টি অন্যান্য কবিতা ও গল্প। শরৎচন্দ্রের ছোট গল্প লালু, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ভ্রমণ কাহিনী পালামৌ, এস ওয়াজেদ আলির রাঁচি ভ্রমণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাঁকোটা দুলছে ও উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছেলেদের রামায়ণ। তবে রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী রয়ে গিয়েছে সিলেবাসে।
কলকাতায় বাংলাদেশি ডেপুটি হাই কমিশন এই পাঠ্যক্রম বদলকে রুটিন আখ্যা দিলেও বাংলাদেশি সংবাদমাধ্যমের দাবি, মুসলিম গোষ্ঠী হেফাজত-এ-ইসলামের দাবি মেনে এভাবে পাঠ্যক্রম থেকে ছেঁটে ফেলা হয়েছে এই সব সাহিত্য। যাতে ছোট ছেলেমেয়েদের মন মৌলবাদী ও কট্টরপন্থীদের ল্যাবরেটরি হয়ে উঠতে পারে ও কট্টরপন্থীরা তাদের চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণার বীজ বুনতে পারে তাদের মধ্যে।
তবে কলকাতাস্থ বাংলাদেশি এক কূটনীতিকের দাবি, সিলেবাস বদলানোর সিদ্ধান্ত সরকারের, হেফাজত-এ-ইসলাম বা অন্য কোনও গোষ্ঠীর চাপে এ কাজ করেনি তারা। বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা করে, তাঁকে মুছে ফেলার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। যদি এই পদক্ষেপে কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন, তবে সরকারের দ্বারস্থ হতে পারেন তিনি।
শেখ হাসিনা সরকারের এই পদক্ষেপে আহত এ দেশের বাংলা সাহিত্যিকরা। এক সংবাদপত্রে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার ওপর ধর্মীয় চিন্তাভাবনা চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। তাঁর আশা, বাংলাদেশি নাগরিকরা ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ধর্মের সঙ্গে সাহিত্যকে গুলিয়ে ফেলেননি। শ্রীজাত জানিয়েছেন, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কবিতাটি সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে জেনে তিনি বিস্মিত। যখনই তিনি ঢাকা গিয়েছেন, দেখেছেন, কত সম্মানের সঙ্গে এটি গাওয়া হয়। সরকার অবশ্যই সিলেবাস বদলাতে পারে। কিন্তু তা যদি কোনও কট্টরপন্থী গোষ্ঠীর দাবি মেনে নিয়ে করা হয়, তবে তা দুর্ভাগ্যজনক।
একইভাবে প্রতিবাদ করেছে বাংলাদেশি সাহিত্য সমাজ। বাংলাদেশি-মার্কিন সাহিত্যিক শর্বরী জোহরা আহমেদ মন্তব্য করেছেন, এভাবেই ধর্মীয় কট্টরপন্থা জাঁকিয়ে বসে, মুছে ফেলে দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ইতিহাসকে। এভাবে যদি চলতে থাকে, তবে এক প্রজন্মের মধ্যে নিজেদের ঐতিহ্য ও মিলিত সংস্কৃতি ভুলে স্রেফ একটি নির্দিষ্ঠ গোষ্ঠীর মধ্যে বদ্ধ হয়ে যাবে বাংলাদেশ।
এছাড়াও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যক্রম থেকে বাদ পড়েছে হুমায়ুন আজাদের লেখা কবিতা বই। তাতে ছাত্রছাত্রীদের এমন বই পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে, যা তাদের ভালবাসতে ও স্বপ্ন দেখতে শেখায়, এমন কিছু নয়, যা মনের মধ্যে ভয়ের বীজ বোনে, অন্ধ করে দেয়। প্রয়াত সাহিত্যিকের পুত্র, দেশ থেকে নির্বাসিত ব্লগার অনন্য আজাদ মন্তব্য করেছেন, যেভাবে শিক্ষানীতি নিয়ে বাংলাদেশ আপসের পথে হাঁটল, তার একদিন বিরাট মূল্য চোকাতে হবে।‘’  সূত্রের খবর ABP Ananda, Facebook
শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাদ দিয়ে বাংলা সাহিত্য অপূর্ণ থেকে যায়। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’ আজও সমসাময়িক মনে হয় আমাদের কাছে। ‘দেনা পাওনা’ উপন্যাসে আমরা পড়েছি ষোড়শীকে জীবনানন্দ অত্যাচার করলেও ষোড়শী কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে তাঁর স্বামীকে বাঁচাচ্ছে পুলিশের হাত থেকে। সেই সময়ের পল্লীসমাজ গ্রামের বধূদের ধর্ম শিক্ষা অথবা সামাজিক শিক্ষা দিয়েছিল। বিবাহিত মেয়েদের স্বামীর অমঙ্গল ঘটাতে নেই। শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজের তথা গ্রামের কম শিক্ষিত মেয়েরা এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে লেখাপড়া জানতেন না সেই সময়ের আমাদের মা বোনেরা। কিন্তু বাংলার কৃষ্টি, রিচুয়াল থেকে তাঁদের টেনে এনে ফেলে দিতে পারেনি ব্রিটিশ সভ্যতার সওদাগরদের এগিয়ে থাকা মূল্যবোধ। বর্তমানের সঙ্গে অতীতের সংঘাত যতই থাক।
অভিযোগ শুধু বাংলাদেশ নিয়ে নয়। আমাদের দেশ ভারত কি করল? এ কোন সংস্কৃতি? বা কি ধরণের অসহিস্নুতা? আমাদের দেশের রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হল সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির কবি, লেখক, সাহিত্যিকদের সাহিত্য সম্মেলন। ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি ধরে চলা চারদিনের ওই সম্মেলনে আমন্ত্রিত ছিলেন সার্কগোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির প্রতিনিধিরা। আমন্ত্রণ জানানো হয়নি পাকিস্তানের বিদ্যাজীবী তথা বুদ্ধীজীবীদের। ‘ফাউন্ডেশন অব সার্ক রাইটার্স অ্যান্ড লিটারেচার’-এর পক্ষ থেকে সংবাদ মাধ্যমকে জানানো হয়েছে পাকিস্তানের লেখকদের আমন্ত্রণে নিষেধাঞ্জা জারি করেছে বিদেশ এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। মত বিনিময়ের এমন ধ্রুপদী প্রেক্ষাপটকে কাজে লাগানোর সুযোগ আমরা হারালাম রাষ্ট্রনায়কদের সিদ্ধান্তে। এক রাষ্ট্রের সঙ্গে অপর এক রাষ্ট্রের টান টান মর্যাদার লড়াই আমাদের আন্তর্জাতিক অনুভবে আঘাত করে। পাশাপাশি অন্য গল্পও পড়ে ফেলতে পারি।
১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা দেশের প্রখ্যাত লেখিকা সেলিনা হোসেন কলকাতা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকের ‘রবিবাসরীয়’ পাতায় ‘রক্তফুলের বরণডালা’ শিরোনামে যে লেখাটি লেখেন সেটাকে কি বলব? প্রতিবেদন? ছোট গল্প? রিপোর্টাজ? যে অংশটা উল্লেখ করলে এই নিবন্ধের প্রাচুর্য বাড়তে পারে আমি সেই অংশটা তুলে নিচ্ছি। ‘’..................রাশেদ দু’দিন আগে দিল্লির সার্ক রাইটার্স ফাউন্ডেশন থেকে সাহিত্য উৎসবে অংশগ্রহণ করার আমন্ত্রণ পেয়েছে। .............................. চায়ের কাপ নিয়ে টেবিলে বসলে পাশের টেবিল থেকে পাকিস্তানের কবি হামিদ বলে, ‘আপনি কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ আমি রাশেদ মুস্তাফা। কবিতা লিখি।’
‘আমিও কবিতা লিখি। আমার নাম হামিদ আলি। আপনি কি আগে এই সম্মেলনে এসেছেন?’
‘না, এবারই প্রথম।’
‘আমি আরও তিনবার এসেছি। এই লিটারারি ফেস্টিভ্যাল আমি খুব এনজয় করি।’
কথা বলতে বলতে হামিদ আলি রাশেদের মখোমুখি এসে বসে। কাপের বাকি চা এক চুমুকে শেষ করে। দু’হাত টেবিলের উপর রেখে বলে, ‘কাল ছাব্বিশে মার্চ। আপনাদের স্বাধীনতা দিবস। ওপেনিং সেশনে আমাকে কিছু বলতে বলা হয়েছে। আমি ঠিক করেছি, বাংলাদেশের লেখকদের স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানাব। বক্তৃতা শেষে পাকিস্তান সরকারকে আহ্বান জানাব বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য ক্ষমা চাইতে।’
‘তাই?’ রাশেদ দু’চোখ বিস্ফারিত করে তাকায়।
‘হ্যাঁ, আমি নিজের দেশেও একথা বলি। আমি ইসলামাবাদে একটি দৈনিক পত্রিকায় কাজ করি। আমি বিশ্বাস করি, কবিদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়।’
‘তুমি আমার বন্ধু।’
হামিদের হাত জড়িয়ে ধরে রাশেদ। দুজনে চা শেষ করে গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়।
ভাষার টান। সাহিত্যের সম্পর্ক চিরায়ত। আমাদের শৈশব ঠিক করে দেয় আমরা ভাষা, সাহিত্য নিয়ে কতদূর এগতে চাই। এবং কতটা পথ পার হতে পারি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’ বইয়ের ‘বাংলা শিক্ষার’ অবসান পরিচ্ছদে লিখছেন, ‘’মূল্য বুঝিতে পারিয়াছি। ছেলেবেলায় বাংলা পড়িতেছিলাম বলিয়াই সমস্ত মনটার চালনা সম্ভব হইয়াছিল। শিক্ষা জিনিসটা যথাসম্ভব আহার-ব্যাপারের মতো হওয়া উচিত। খাদ্যদ্রব্যে প্রথম কামড়টা দিবামাত্রেই তাহার স্বাদের সুখ আরম্ভ হয়, পেট ভরিবার পূর্ব হইতেই পেটটি খুশি হইয়া জাগিয়া উঠে— তাহাতে তাহার জারক রসগুলির আলস্য দূর হইয়া যায়। বাঙালির পক্ষে ইংরেজি শিক্ষায় এটি হইবার জো নাই। তাহার প্রথম কামড়েই দুইপাটি দাঁত আগাগোড়া নড়িয়া উঠে— মুখবিবরের মধ্যে একটা ছোটোখাটো ভূমিকম্পের অবতারণা হয়। তার পরে, সেটা যে লোস্ট্রজাতীয় পদার্থ নহে, সেটা যে রসে-পাক-করা মোদকবস্তু, তাহা বুঝিতে-বুঝিতেই বয়স অর্ধেক পার হইয়া যায়। বানানে ব্যকরণে বিষম লাগিয়া নাক-চোখ দিয়া যখন অজস্র জলধারা বহিয়া যাইতেছে, অন্তরটা তখন একেবারেই উপবাসী হইয়া আছেঅবশেষে বহুকষ্টে অনেক দেরিতে খাবারের সঙ্গে যখন পরিচয় ঘটে তখন ক্ষুদাটাই যায় মরিয়া। প্রথম হইতেই মনটাকে চালনা করিবার সুযোগ না পাইলে মনের চলৎশক্তিতেই মন্দা পড়িয়া যায়। যখন চারি দিকে খুব কষিয়া ইংরেজি পড়াইবার ধুম পড়িয়া গিয়াছে, তখন যিনি সাহস করিয়া আমাদিগকে দীর্ঘকাল বাংলা শিখাইবার ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, সেই আমার স্বর্গগত সেজদাদার উদ্দেশে সকৃতঞ্জ প্রণাম নিবেদন করিতেছি।‘’ (পৃষ্ঠা- ৪১, বিশ্বভারতী, ১৩৮০, ইংরেজি- ১৮৯৫)      
বাংলাদেশ সরকারের সিধান্তের কথা আমি নাট্য ব্যক্তিত্ব এবং পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য অ্যাকেডেমির সভপতি শাঁওলী মিত্রকে জানালে তিনি প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘’গত সপ্তাহে আমি ‘বেঙ্গল ফাউন্ডেশন’ এবং ‘কালী ও কলম’ পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত সিলেট সাহিত্য উৎসবে গিয়েছিলাম। প্রত্যেক বক্তা তাঁদের বক্তব্যে রবীন্দ্রনাথকে উল্লেখ না করে পারেননি। আমাদের দেশের হোক অথবা বাংলাদেশের প্রত্যেকের বক্তব্য থেকে আমরা রবীন্দ্রনাথের প্রয়োজনীয়তা এবং তার উপস্থিতি ধ্রুপদী মাত্রায় উপলব্ধি করলাম। তাই এই সিদ্ধান্ত আমি মেনে নিতে পারছি না। শরৎচন্দ্রের লেখা ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’ আমার স্মৃতিতে আজও রয়ে গেছে। ছোটবেলায় শরৎচন্দ্রের লেখা আমাদের ভীষণ প্রভাবিত করেছে। আমরা শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ পড়ে বড় হয়েছি। তাই বলছি রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্র আজও প্রাসঙ্গিক।‘’
শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহাররের কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাঁর প্রতিক্রিয়া। তিনি এসএমএস করে জানিয়েছেন, ‘’আমি কিছু না জেনে ভিন্ন দেশ সম্পর্কে মতামত দিতে আগ্রহী নই।’’ ভারতীয় চলচিত্রের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, অভিনেতা, কবি এবং স্বনামধন্য নাট্য ব্যক্তিত্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় টেলিফোনে বললেন, ‘’আমি অসুস্থভালো করে খোঁজ খবর না নিয়ে মন্তব্য করতে পারব না। তবে রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে আমরা বাঙালিরা পথ চলব কি করে?
খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী এবং বর্তমানে তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য যোগেন চৌধুরী বললেন, ‘’আমি আন্তরিকভাবে মর্মাহত। যারা বাংলাভাষা নিয়ে এত কাজ করছে, যে দেশ বাংলাভাষাকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে নিয়ে গেছে সেই দেশে এমনটা হতে পারে ভাবতে পারছি না। রবীন্দ্রনাথতো সমস্ত বিশ্বের কবি। সেই কবিকে পাঠ্যসূচী থেকে বাংলাদেশ সরকার বাদ দেবে মেলাতে পারছি না। এবং শরৎচন্দ্র? তাঁর ‘মহেশ’ গল্পের কথা আমাদের বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় সবসময় আসেসত্যিইতো তিনি অমর কথাশিল্পী। বাংলাদেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, বুদ্ধিজীবী এবং আপামর মানুষ কী মেনে নেবে এই সিদ্ধান্ত?’’
‘গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা/ দু’ই চোখে দু’ই জলের ধারা মেঘনা যমুনা’ওপার বাংলার সুখে যেমন এপারের পাখিরা আনন্দের গান করেও পারের দুঃখে আমরা কষ্ট পাই। আলোকিত বাংলাদেশের উন্নয়ন আমাদের কাছে আজ বিস্ময়। একুশ শতাব্দীর বাংলাদেশ এখন উচ্চ শিক্ষিত সমাজ সচেতন টগবগে যুব সমাজের বাংলাদেশ। এই দেশকে এতটা উচ্চতায় নিয়ে এলেন যিনি তিনি বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘আ মরি বাংলা ভাষা’-এই দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, বাংলা ভাষাকে তুলে যেমন ধরতে হবে পাশাপশি বাঙালি মুসলমানের ঐতিহ্যবাহি নিজস্বতাকে ধরে রাখতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার শহিদ মিনারে সেদিন তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘’বাংলাভাসী মুসলিমদের আলাদা সাংস্কৃতিক গ্রহণশীলতা আছে। সামাজিক সহনশীলতার ঐতিহ্য আমাদের মনে রাখতে হবে।‘’ তাঁর সময়োচিত সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা পথ চলতে চাইছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাংস্কৃতিক ঘরানার আলোয়।                               
      


No comments:

Post a Comment