Saturday 4 March 2017

ইমেজ ভাঙ্গার ডাক

ইমেজ ভাঙ্গার ডাক :

কয়েকটা দিন আগের কথা। অভিজাত কলকাতার সদ্য পরিচিত কয়েকজন সহ নাগরিকের সঙ্গে গঙ্গাবক্ষে চারঘন্টা সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা কাটালাম। আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম আগেই। সিদ্ধান্ত নিতে একটু সময় নিয়েছিলাম এই যা। সেদিনের অভিঞ্জতা অবশ্যই অভিনব। নৌকাবিহার বললেও অতিরিক্ত কিছু প্রকাশ করা হবে না। কথামত বিকেল সাড়ে তিনটের সময় ফেয়ারলি ঘাটে পৌঁছে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি একটি ২৮-৩০ বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে আমাদের পরিচিত একটি সংগঠনের নাম লেখা কাগজ। আমি যেতেই সামনে এগিয়ে এসে আলাপ করল। আমার নাম জেনে নিয়ে বলল, ‘’কাকু আসুন আমার সঙ্গে।‘’  
ছেলেটির সঙ্গে জেটির কাছাকাছি যেতেই দেখি কমল জেটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বলল, ‘’এই নুনুটো কখন এলে বটেক?’’ কমল আমার ছোট বেলার বন্ধু। ওর কথা শুনে আমি মুচকে হাসলাম। আমি জানি কমল দক্ষিণ বীরভূমের কথা বলে আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছে। দক্ষিণ বীরভূমের দুবরাজপুর, খয়রাশোল অঞ্চলে এই ধরণের কথার প্রচলন আছে। বড়রা ছোটদের আসতে দেখলে এইভাবে প্রশ্ন করে। উত্তর আমি দেওয়ার আগেই আমার সঙ্গে থাকা ছেলেটি উত্তর দিল, ‘’এই পথে পথে এলুম কাকু।‘’ ছেলেটির কথা শুনে আমি বেশ অবাক হলাম। পরে জানলাম ছেলেটিও খয়রাশোল থানার একটি গ্রামের ছেলে। কলকাতায় থাকে। লঞ্চের দোতলায় উঠতেই দেখলাম লঞ্ছ প্রায় ভর্তি। ছোট একটা স্টেজ করা হয়েছে। আমার পরিচিত সহ নাগরিকরাও রয়েছেন। লঞ্চ ছেড়ে দিল। সঙ্গীত সন্ধ্যাও শুরু হয়ে গেল। বিখ্যাত গায়ক গায়িকাদের মধ্যে ছিলেন অগ্নিভ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবারতি সোম এবং গৌতম মিত্র
আমি কমলের পাশে বসলাম। কমলকে জিগ্যেস করলাম, ‘তুই এখানে ঠিক বুঝলাম না।’
কমল বলল, ‘’একজনের আমন্ত্রণে চলে এলাম। উসব এখন বাদ দিং কথা বল। ওই দেখ শুশুক যেছে। খবরে বুলছে শুশুক আবার ফিরছে।‘’
রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর গানে আমরা তখন স্মৃতির মহাকাশ মন্থন করছি। হঠাৎ কমল বলল, ‘’আরে উটা কিরে? কুমির মনে হছে?’’
আমি বললাম, ‘না ওটা কুমির নয়। অন্য কিছু হবে।’
কমল আবার বলল, ‘’আমাদের জেলার ওই কালাপাহাড়দের মত দেখতে। ভালো করি দেখ ক্যানে।‘’
এই হচ্ছে কমল ওর কথার কোনও মাথা মুন্ডু থাকে না। বিরক্ত প্রকাশ করে বললাম, ‘’হচ্ছে কুমিরের কথা। তুই চলে যাচ্ছিস মোঘলযুগে।  
‘’আমাদের সময়টোকে সবাই ধ্বংসের যুগ কেন বলে? তা হলে ওরা কি করলে? নকশাল বাড়ির লাইন ভুল ছিল। প্রমোদ সেন গুপ্তের ‘বিপ্লব কোন পথে’ বই থেকে লাইন তুলে কত নেতা ভাষণ দিয়াছে। সত্তর-আশি, নব্বই, নতুন শতকের বছর গুলানের কথা ভাব একবার। দু’তিনটো কালাপাহাড় না জেলার জন্য কিছু করলে না বাংলার জন্য।‘’
কমলকে বললাম, ‘এখানে এসব বলার কোনও প্রয়োজন আছে?’
‘’ ক্যানে বুলব না ক্যানে? প্রমোদ সেনগুপ্তের বইটোর ভূমিকার ওই লাইনগুলা আমার পুরা মনে আছে। আমি বলে যেছি শুন, ‘প্রকৃত মার্কসবাদী পার্টি না থাকলে বিপ্লব যে সফল হয় না, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ১৯৬৭ সালের ফরাসী দেশের বিপ্লবী অভ্যুত্থান। ফ্রান্সের সমস্ত কলকারখানা, রেল, বন্দর, সরকারী বেসরকারী অফিস, ব্যাঙ্ক, আদালত, স্কুল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বিপ্লবীরা সবই দখল করে ফেলেছিল, কিন্তু বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি না থাকার ফলে এই বিরাট অভ্যুত্থান মুহূর্তের মধ্যে ব্যর্থ হয়ে গেল।’
লঞ্চের নীচের ডেকিতে দাঁড়িয়ে আমরা কথা বলছিলাম। তবু আমার বিরক্ত লাগছিল কমলের কথা শুনে। সেই রামও নেই বিপ্লবের পরিস্থিতিও নেই। তবে এসব আলোচনার কি প্রয়োজন? বিরক্তি প্রকাশ করেই বললাম, ‘তুই কি এখনও এসব নিয়ে ভাবিস? বিপ্লব বিপ্লব না ভেবে মানুষের জন্য কিছু কাজ কর। সামাজিক হওয়ার অনেক পথ খোলা আছে।’        

এই লে ইবার কাছিমের মত খোলে ঢুকি যেছি। আচ্ছা ঠিক আছে উসব আর লয়। ভাঙড় লিং কি হবে বুল? আবার নন্দীগ্রাম? বিপ্লবের বাণী কে শুনবে আর কাকে শুনাব বল ধিনি?’’
কমলের প্রশ্নের উত্তরে বললাম, ‘না না প্রশাসন অতি সহজভাবে বিষয়টা দেখছে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বলা যায়। আমি ভাঙড় নিয়ে আমার লেখা কমলকে শোনালাম।
সূত্রের খবর অবশেষে রাজ্য সরকার ভাঙড় নিয়ে কিছুটা মচকেছেবিদ্যুৎমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ভাঙড়ের পরিস্থিতি নিয়ে এলাকার ৪০ জন বিধায়কের সঙ্গে তিনি বৈঠক করবেন। দলমত নির্বিশেষে বিদ্যুৎমন্ত্রী সকলের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। অঞ্চলে পাওয়ার গ্রিডের কাজ যেমন হয়েছে, সেই গ্রিডের তার পরিবহণের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করা দরকার। কিছুদিন আগে আমি ‘ফেসবুকে’ এই প্রস্তাব দিয়েছিলাম। রাজ্যে বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক পরিসর দখলের লড়াই হোক। কিন্তু বাংলার স্বার্থে, বাংলার উন্নয়নের জন্য দলমত নির্বিশেষে আসুন ‘জমিদারি মানসিকতা’ এবং জুলুমবাজির বিরোধিতা করি। কমলকে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যটাও শোনালাম।
বিধানসভায় বাজেট অধিবেশনের প্রথমদিন থেকেই সরব ছিলেন বিরোধীরা। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য শুনতে চাইছিলেন বিরোধী দলের বিধায়করা। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর, ৮ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় বলেন, ‘’ভাঙড়ে পাওয়ার গ্রিডের জন্য জমি অধিগ্রহণ নিয়ে কোনও সমস্যা হয়নি। সমস্যা হয়েছে অন্য। মানুষকে পাওয়ার গ্রিড প্রকল্প নিয়ে ভুল বোঝানো হয়েহে। অবৈঞ্জানিক কথা গ্রামবাসীদের মাথায় ঢুকিয়ে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। ভাঙরের মানুষকে বোঝাতে চাইছি জোর জবরদস্তির ব্যাপার নেই। গ্রামের মানুষ চাইলে (পাওয়ার গ্রিডের) কাজ হবে, না চাইলে হবে না।‘’         
কমল আট বছর জেল খেটেছে তাই ওর আতঙ্ক যে দু’জন সম্প্রতি গ্রেপ্তার হয়েছে তাঁদের কতদিন জেলে থাকতে হয়। কমল আমাকে ফিস ফিস করে বলল, ‘’সিপিএমতো বুলছে ইউএপিএ-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। সত্যি সত্যি করবে রে? আমাদের দেশভক্তির সেই ছেলে ভুলানো আবেগ আর নাইখো। টান টান শুখা বাস্তব। ঘোড়ার খুরের মত বুল?’’
বললাম এটাও ইমেজ ভাঙ্গার রাজনীতি। বর্তমান সময়ে ইমেজ ভাঙ্গার রাজনীতি আমাদের দেখতে হবে। গান শুনতে শুনতে আমাদের কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছিল। তখন গান হচ্ছে ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও বাঁধ ভেঙ্গে দাও ভাও ঙ্গো....../ জীর্ণ পুরাতন যাক ভেসে যাক/ যাক ভেসে যাক ........./ আমরা শুনেছি ওই/ মা ভৈ মা ভৈ মা ভৈ। 
আমরা লঞ্চের একতলায় চলে এসেছি। অতীত ঘেটে কমলকে বললাম, ‘আমি কয়েকদিন আগে একটা পুস্তিকা পেয়েছি। রাজনৈতিক বন্দীমুক্তি বিষয়ে। বইটার প্রকাশক ভানু সরকার। ডিএল ২৩১/৪, সল্টলেক, সেক্টর-২, কলকাতা-৯১ থেকে প্রকাশিত। পুস্তিকাটা আমার ব্যাগে আছে। আমি বইটা থেকে কিছুটা অংশ তোকে পড়ে শোনাচ্ছি।
‘’নিঃশর্তে রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির প্রশ্নে কোনো মতবিরোধ নেই। নীতিগতভাবে সবাই একমত। তাহলে বিরোধ হচ্ছে কোথায়? পদ্ধতিগত প্রশ্নে। তথ্য বিকৃতির প্রশ্নে। আন্দোলনের বিশেষ ঝোঁক। প্রবণতার প্রশ্নে। ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে বর্তমানের তুলনার প্রশ্নে। বাস্তব পরিস্থিতিকে নির্মোহভাবে বিশ্লেষণ করার বা না করার প্রশ্নে।
১৯৭৭ সালে বামপন্থী ফ্রন্ট রাজনৈতিক বন্দীমুক্তির জন্য কোনো কমিটি তৈরি করেনি?- তথ্য সে কথা বলেনা। একথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পালন করে সরকার; নিঃশর্তে রাজবন্দীদের মুক্তি ঘোষণা করে ২১শে জুন, ১৯৭৭ সালে মন্ত্রীসভার প্রথম বৈঠকে। এটুকু বলে বাকী তথ্য চেপে গেলে অর্ধ সত্য বলা হয়। বন্দীমুক্তির জন্য চারজনের সাব কমিটি তৈরি হয়েছিল; সদস্যরা সবাই ছিলেন মন্ত্রীসভার সদস্য। তৎকালীন সমবায়মন্ত্রী ভক্তিভূষণ মণ্ডল, কারামন্ত্রী দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, বিচারমন্ত্রী হাসিম আব্দুল হালিম এবং মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু স্বয়ং। (সূত্রঃ দেবাশিস ভট্টাচার্য, বামপন্থীরা মহাকরণে মন্ত্রী হয়ে যা করছেন। কলকাতা, ১৯৮৩, পৃষ্ঠাঃ ৫৩)‘’ এই বিষয়টা আমার মনে হয় তুই আমি সবাই জানি। পুস্তিকায় ইংরেজিতে দু’টি উল্লেখ রয়েছে।
‘’ঢালাও মুক্তির আদেশ কী রাজবন্দীদের মুক্তির প্রক্রিয়াকে ত্বরানিবত করেছিল? বা সরকারের টালবাহানা ছিল না?
নাগরিক অধিকার আন্দোলনের উপর পথিকৃৎ গবেষক নীলাঞ্জন দত্ত কেন্দ্রের জনতা সরকার ও পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থী ফ্রন্ট সরকারের টালবাহানার আচরণ (‘’dilly-dally attitude’’) নিয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘’In March 1978, one year after ‘’the restoration of democracy’’, there were still 124 convicted and 48 under trial political prisoners in West Bengal. It took another couple of years to get them all released and that could have never been done. But consistent pressure brought upon the government by the prisoners re-lease movement’’ (i)
 ১৯৭৮ সালের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বাৎসরিক রিপোর্টেও এই একই প্রলম্বিত প্রক্রিয়ার কথা বলা হলঃ ‘’The state government gave assurance that it hoped that all political prisoners in the state would be released by April 1978 and political prisoners continued to be released during the visit of the delegates [ from 31 Dec, 1977 to Jan, 1978]. In late March 1978 official statistics showed that 199 Naxalites prisoners were still held.’’ (ii), page2/3 (i) ‘’Violation of democratic Rights in West Bengal’’ (C.G. Shah Memorial Trust Publication, 13, 1985, New Delhi) (ii) London, 1979, P. 159
তবে সমস্যা হচ্ছে গণ আন্দোলন আর বিপ্লবী আন্দোলনের ফারাকটা বুঝতে হবে এবং বোঝাতে হবে। একদল উন্নাসিক নেতার কথায় কিছু করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে? ভারতীয় সংবিধান আন্দোলনের অধিকার দিয়েছে। অবশ্যই সশস্ত্র নয়।
কমল বলল, ‘’সেসব আমি আট বছর জেল খেটে ইঁদুরের কাছে শিখাছি। লে চল গানা শেষ। লঞ্চ ফেয়ারলিঘাটে ভিড়ছে। আমি এখন চাদরটো গায়ে জড়াই’’ বলেই কমল কাধের ব্যাগ থেকে একটা শাল বের করে গায়ে জড়িয়ে নিল।
আমি বললাম, ‘শীত কোথায়? তুই শাল গায়ে দিচ্ছিস?’
কমল বলল, ‘’শীত বেশি নায়। তবে কি জানিস এই শালটো আমাদের বিয়ের সময় শাশুড়ি দিয়াছিল। গত তিরিশ বছর ট্রাঙ্কে ছিল। আজ সুযোগ পেয়াছি। শহরের বাবুদের সামনে একটো শাল গায়ে চড়ানোড় সাধ ছিল বহুত দিনের। সবকিছু ছিন্তাই হুং যেলছে রেমান ইজ্জৎ, সম্পদ, সোনা-গয়না। এই শালটো খালি আছে। আমি ভারতীয়। ইটো আমার পোশাক।‘’
আমি বললাম, ‘আজ তুই নিজেও ইমেজ বদলে ফেললি।’ কমল হাসতে হাসতে চলে গেল। ক্লান্ত শরীর, চনমনে মন ওর। ৬০ বছর ধরে কঠোর কঠিন শক্ত মাটিতে হাটছে। ব্যক্তিগত কুৎসা, অমানসিক অত্যাচার আজও কমলকে সহ্য করতে হয়।তবুও  কিন্তু ও সব সময় মজা করে হাসতে হাসতে সময় পার করে দিচ্ছে।
মানতে দ্বিধা নেই সত্তর দশক জুড়ে সম্মিলিত এবং সংগঠিত বাম নেতৃত্বের হাত ধরে ভারতে তথা বাংলায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু হয়েছিল, আশির দশকে সেই লড়াই মুখ থুবড়ে পড়ল। ১৯৮৭ সালের তৃতীয় বামফ্রন্ট আমলে আমরা গ্রাম-গঞ্জের পঞ্চায়েতের মাধ্যমে নতুন ঘরানার উন্নয়ন যেমন দেখলাম, সেই উন্নয়নের হাত ধরেই উত্থান হল নতুন এক অচেনা মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। এই বিষয়ে গুণীজনেরা একাধিকবার আলোচনা করেছেন। পরেও করবেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সুযোগ সন্ধানী ‘নব্যবাবু’ এই পরিচয়ে গ্রাম-গঞ্জের নবগঠিত নাট মন্দির, শহর-শহরতলীর পাড়ার ক্লাব, সর্বজনীন দুর্গা পূজোর মণ্ডপ, সর্বত্র এই নব্য ধনিক শ্রেণীর দখলে চলে গেল। পরে প্রোমোটিং নামক এক দৈত্য সংগঠিত আকারে ‘সিন্ডিকেট’ ঘরানায় ইমেজ বদলে ফেলল। ইমেজ বদলের গল্প-কথায় বামফ্রন্ট জমানার নাম আসবে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র, আশির দশকের তৎকালীন তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, পূর্তমন্ত্রী যতীন চক্রবর্তী, পঞ্চায়েতমন্ত্রী বিনয় চৌধুরী। বুদ্ধদেববাবু বলেছিলেন, ‘’চোরেদের সরকারে তিনি থাকবেন না।‘’ বিনয়বাবু বলেছিলেন, ‘’বামফ্রন্টের সরকার ঠিকাদারদের সরকার।‘’
বুদ্ধদেববাবু এখানেই থামলেন না। আবার মন্ত্রিসভায় ফিরলেন এবং মুখ্যমন্ত্রী হলেন। ইমেজ আরও বদলে ফেলেছেন ততদিনে। সরকারের ভিমরুলে ঢিল ছুঁড়লেন। বললেন, ‘ডু ইট নাউ’। ইমেজ বদলে ফেলছেন বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আরও এগিয়ে এলেন সঙ্গে শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। ‘শিল্পায়ন’ না করলে রাজ্যের সমূহ ক্ষতি হয়ে যাবে। বেকার ছেলে মেয়েরা চাকরি পাবে না। বুঝেছিলেন তিনি শ্লোগান তৈরি করেছিলেন ‘কৃষি আমদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’। নতুন ঘরানায় ভারতীয় বামপন্থীদের গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিলেন সিপিএমের প্রাক্তণ পলিটব্যুরো সদস্য এবং রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের নয়া ঘরানার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই সম্ভবত সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়েই দলকে আধুনিক ভারতীয় ঘরানায় গড়ে তুলতে চাইছেন কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি। ভারতীয় কৃষ্টি, ভারতীয় সংস্কৃতি, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় বহুত্ববাদকে স্বীকৃতি দিয়ে দেশের বৃহৎ বামপন্থী দলটিকে বিশ্বায়ন উত্তর মূল্যবোধের মিছিলে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। সঙ্গে আছেন বাংলা, কেরল, অন্ধ্র, ত্রিপুরা সহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের নতুন ইমেজের নেতৃত্ব। সূত্রের খবর সিপিএমের সাধারণ সম্পাদকের নিদান ‘সেলফি’ তুলে কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্ট করতে পারবেন না। বামপন্থী দলের শৃঙ্খলা সবাইকে মানতে হবে।   
রাজনীতির ময়দানে গণতন্ত্রের শপথ নিয়ে একদল আসে একদল যায়। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ৩৪ বছরের ‘বামফ্রন্ট’ শাসনের অবসান ঘটিয়ে যখন এলেন তখন ইমেজ ছিল ‘ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও’, ‘বামফ্রন্টের অপশাসন আমরা মানছি না মানব না’। কিন্তু তৃণমূল নেত্রী মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এসেই জনপ্রিয় করে তুললেন ‘বদলা নয় বদল চাই’, বাংলার উন্নয়ন চাই। বাংলার উন্নয়নের জন্য যে কোনও দেশে তিনি যেতে রাজি। যে কোনও দলের নেতাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করতে রাজি। যখন ক্ষমতার অলিন্দে তিনি প্রবেশ করেছিলেন তখন জানতেন কি করে প্রবেশ করতে হয়। জানতেন না রাজ্য প্রশাসনকে কিভাবে স্বক্রিয় রাখতে হয়। বাংলার একাই ২১১। দ্বিতীয় দফায় আর নতুন মুখ্যমন্ত্রী ননঅনেকদিন আগেই পুরনো বাড়ি ‘মহাকরণের’ মোহ ছেড়ে চলে এসেছেন ঝা ঝা চক চকে কর্পোরেটলুক বাড়িতে। ‘নবান্ন’ এখন বাংলার নতুন ইমেজ। যেখান থেকে শিল্পায়নের নতুন বর্ণচ্ছটায় বাংলার মেধাবী আধিকারিকরা বাংলার ইমেজ বদল করতে চাইছেন। সম্প্রতি স্বাস্থ দপ্তরের উদ্যোগে ‘টাউন হল’ প্রেক্ষাগৃহে বেসরকারি হাসপাতালের উচ্চপদস্থ কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই বৈঠকে আধুনিক বাংলার পরিশীলিত সংস্কৃতির আহ্বানকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কর্পোরেট স্বাস্থ্যের পরিচালকদের দিকে আঙ্গুল তুলে মুখ্যমন্ত্রী বুঝিয়ে দিলেন মানুষের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবা কখনও ‘পণ্য’ হতে পারে না। নতুন দিশার কথা শুনল রাজ্যের আপামর বাঙালি। তবে তৃণমূলের বহুধাবিভক্ত গোষ্ঠী রাজনীতির প্রভাব আমাদের ব্যথিত করছে। সদ্য গড়ে ওঠা ‘দাদা’ সংস্কৃতির ইমেজ অনেকটাই আধুনিক ভারতের ধ্যান ধারণার সঙ্গে মেলেনা।
উত্তর প্রদেশের সমাজবাদী দলের তরুণ নেতা মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদবও ‘সামন্ত ইমেজ’ ভেঙ্গে নতুন ইমেজ গড়তে চাইছেন। তিনি বলছেন, বিরোধী নেতৃত্বকে ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়।       
আমরা যদি অতীত ভারতের দিকে তাকাই দেখব গান্ধিজী ঘোষণা করেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর জওহরলাল নেহরু হবেন তাঁর উত্তরাধিকারী। মৃত্যুর আগেই পন্ডিত নেহরুকে করে দিয়েছিলেন বড়লাটের শাসন পরিষদের ভাইস-প্রেসিডেন্ট। আসলে প্রধানমন্ত্রী। গান্ধিজী যে ইমেজ গড়ে দিয়ে গেলেন। সেই ইমেজকে আরও আধুনিক চিন্তায় আধুনিক অবয়বে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু আমাদের সামনে এনে দিয়েছিলেন। নতুন ইমেজে। সোশিয়ালিজমের কথা বলেও তিনি থামলেন না। প্রধানমন্ত্রী নেহরু নতুন ঘরানার ইমেজ গড়লেন। চালু করলেন মিশ্র অর্থনীতি। পাব্লিক সেক্টর আর প্রাইভেট সেক্টরের যৌথ প্রয়াস। ব্রিটেনের ছাপ ছিল সেই পরিকল্পনায়।
কংগ্রেসের সহ সভাপতি রাহুল গাঁধিকে আমরা পাচ্ছি আধুনিক ভারতের নতুন ভাষায়। তিনি বলছেন তাঁর দলের তরুণ সদস্য সমর্থকদের কেউ মোদীজিকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করবেন না। সম্প্রতি রাহুল গাঁধি সংবাদ মাধ্যমকে ১০ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, ‘’সমালোচনায় আমি বাড়তি কাজের তাগিদ পাই। কিন্তু ‘আমেঠি’তে ফুডপার্ক যে ভাবে আটকে দিলেন মোদীজী, তাতে আমি ব্যথিত।‘’ রাহুল গাঁধি নিজেকে যেভাবে গড়ে তুলছেন সেখানে তাঁর ইমেজ গড়ে তোলার কথা বার বার আসে। উত্তর প্রদেশে নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি লেখায় আমি লিখেছিলাম ২০১৫ সালে ইলাহাবাদের জি বি পন্থ সোশ্যাল সায়েন্স ইন্সটিটিউটের সমাজ বিঞ্জানের শিক্ষক বদ্রী নারায়ণের এক লেখায় পড়েছি, ‘’২০০১১ সালে এক বার উত্তর প্রদেশের দলিত ইন্টেলেকচুয়ালদের সঙ্গে এক মিটিং করেন তিনি। মিটিং শেষ হলে জনৈক ব্যক্তি বলেন, ‘আপনিইতো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী।’ সঙ্গে সঙ্গে রাহুলের অসহিষ্ণু প্রশ্ন, ‘কেন? আপনি কেন চান যে আমি প্রধানমন্ত্রী হই? আমি ইন্দিরা গাঁধির নাতি আর রাজীব গাঁধির ছেলে বলে? আমি তো আপনাদের সঙ্গে থাকতে চাই, কাজ করতে চাই তাতে যেটুকু আমি বলতে পারি কিংবা সাহায্য করতে পারি, সেটুকুই তো আমি চাইছি।’’  বদ্রী নারায়ণের লেখায় আরও পড়েছি, ‘’মনে পড়ে, এক বার একটি সেমিনারে রাহুল যাবেন বলে এসপিজি তাঁর গার্ডদের জন্য আয়োজকদের কাছ থেকে একটা অতিরিক্ত গাড়ি চায়। আয়োজকরা একটি ‘নন-এসি’, বেশ ছেঁড়া-ছেঁড়া সিট-ওয়ালা গাড়ি পাঠান। গাড়িটি দেখেই রাহুল একলাফে চড়ে বসেন। অন্যান্য নেতারাও আর কী করেন, বাধ্য হয়ে নিজেদের ভাল ভাল বিলাসবহুল গাড়ি ছেড়ে রাহুলের সঙ্গে সেই পুরনো গাড়িতেই চড়ে পড়েন। সেমিনারে পৌঁছে রাহুলের মুখে সেই পরিচিত প্রসন্ন হাসি।‘’        
 সুশিক্ষিত কংগ্রেস ঘরানার কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং সনিয়া গাঁধির প্রভাব কি আমরা রাহুল গাঁধির মধ্যে দেখতে পাচ্ছি না?
এনডিএ সরকারের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী কার ইমেজ ভাঙ্গছেন? আধুনিক ভারতে কর্পোরেট সংস্কৃতির ঘরানায় কখনও কখনও তিনি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। ইমেজ ভাঙ্গতে চাইলেও পারছেন না। অদৃশ্য এক সামন্তপ্রভু তাঁকে দিগভ্রান্ত করে অন্য পথে নিয়ে যাচ্ছে। তিনি রাজধর্ম পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন কি? প্রশ্ন তুলছে আধুনিক ভারত অত্যাধুনিক ইন্ডিয়া। ইমেজ গড়লেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। বিদেশের মাটিতে যে কোনও অনাবসী ভারতীয় বিপদে পড়লে বিদেশমন্ত্রীর আসনে বসে সুষমা স্বরাজ তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।           
আমরা যদি বিদেশের দিকে নজর ফেরাই তবে দেখব আধুনিক ব্রিটেনকে। ব্রেক্সিট উত্তর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেন ডেভিড ক্যামরন। কারণ তিনি ব্রেক্সিট নীতির বিপক্ষে ছিলেন। পরাজয় মেনে নিয়েই তিনি পদত্যাগ করেছেন। একদম ব্যতিক্রমী ঘটনা। ক্যামেরন সাহেবের দল কঞ্জারভেটিভ পার্টীর আভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমাদের কোনও আগ্রহ নেই। আমরা তাঁর এবং তাঁর দলের এই সিন্ধান্তকে কুর্ণিশ করব। এই শতাব্দীর অন্যতম উদাহরণ হয়ে থাকল এই ঘটনা।
প্রশাসনের শীর্ষপদে বসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরিবর্তিত আমেরিকার নতুন ইমেজ গড়তে চাইছেন। অনেক ভাঙ্গা গড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। অবশ্য বিশেষঞ্জরা বলছেন, বিদেশনীতিতে এপর্যন্ত তিনি তাঁর পূর্বসূরি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার হেটে আসা পথ মানচিত্র ধরেই এগোচ্ছেন। সম্প্রতি আমেরিকার সংবাদ মাধ্যমে একটি ছবি প্রকাশিত হয়েছে। ছবিতে দেখানো হয়েছে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা হাসি মুখে চেয়ারে বসে আছেনপ্রাক্তন প্রেসিডেন্টকে দেখানো হয়েছে দীর্ঘকায় অবয়বে। পাশের ছবিতে আমেরিকার বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছোট অবয়বের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন তাঁর পূর্বসূরির দিকে। ছবির নীচে লেখা,
‘Tiny Trump: like Trump, but less so’. ছবির নীচে  Tiny President’ শিরোনামে দু’ কলমের খবর। Feb. 18: US president Donald Trump is, its fair to say, prone to the occasional bit of self-aggrandisement— and he’s not known for his ability to laugh at himself. For a man so concerned about how the public perceives his stature, one wonders what the 45th President of the United States would make of Tiny Trumps, a new online craze for photo shopping pictures of the Donald to make him look smaller.
The meme has now spawned its owned subreddit, where Web users have been sharing doctored pictures of Trump looking tiny.’’ (The Daily Telegraph, in India, The Telegraph, 19 February, 2017)
 প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম যে বক্তব্য রাখলেন তাতে তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতিমত ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এই নীতিকে আরও কয়েক কদম এগিয়ে রেখেও ইমেজ বদল করলেন। সংবাদ সংস্থা সূত্রে খবর (১ মার্চ, ২০১৭) তিনি এক ঘণ্টার বক্তব্যে বলেছেন, দেশের নিরাপত্তা এবং আর্থিক বৃদ্ধিই আপাতত তাঁর প্রধান কর্মসূচী।  উল্লেখ করেছেন মুক্ত বাণিজ্যের কথাও। জানিয়েছেন তিনি মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে। সেক্ষেত্রে তাঁর মত তিনি ন্যায্য বানিজ্যও চান। তবে তিনি অভিবাসন নীতি বদলের কথা বলে ভিন্ন রাষ্ট্রের বিনিয়োগকারিদের আমেরিকায় ব্যবসা করার ক্ষেত্রে যেসব নিশেধাঞ্জার কথা বলেছিলেন সেখান থেকে কি সরে এলেন? এদিন তিনি বলেন, ‘’এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যাতে বিদেশী সংস্থা সহজেই এখানে ব্যবসা করতে পারে। এতটাই সহজে, যেন পরে তাদের এই দেশ ছাড়াটাই কঠিন হয়ে যায়।‘’ সংবাদ সংস্থা       
                        

          

No comments:

Post a Comment