Tuesday 8 December 2015

বাউল্মন

কিছুদিনের জন্য মাত্র এক দশক হবে হয়ত! এই এক দশকের পরম্পরায় যারা চাঁদ সদাগরের নৌবহর থেকে ছুঁড়ে দিয়েছিল তাঁরা কি জান্ত? এই প্রজন্মের একজন লক্ষ্মীন্দর আধুনিক হয়েছিল জয়দেবের অজয়ের নদে। মকড় সংক্রান্তির বালুচরে। লক্ষ্মীন্দরের বাসরে ছিদ্র করে দিলেও সরস্বতীর আশীর্বাদ আউল- বাউল চিনিয়ে দিল। ফিরে পেলাম বিদযার বাণিজয তরী। সাহিতয- সংসকৃতির ময়দানে বিশাল-বিপুল সাগ্রে ভাসতে ভাসতে কানে এসেছিল, ''আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান/ প্রাণেরও আশা ছেড়ে সপেছি প্রাণ।'' কতবার বহর-নৌবহর থেকে তোমরা নামিয়ে দিলে। নামিয়ে দিচছ। এসব নকল নিয়মের আঁকি-বুকি! কে ভালো কে মন্দ সব বোঝা যায়। বোঝা যায় বাউলের আখড়ায়। তোমাদের মুচকি হাসি দেখ। দেখ দেখ। দেখতে পাচছ? কৃতিরমতায়। মানবিক-অমানবিক অভিন্যে। আজ তোমরা অন্তর-বাইরে ক্লান্ত। আমার পৃথিবী সারস্বত প্রাথনায় 'জয়দেব মেলা' তে শিশির ভেজা ধুলো উড়িতে আমায় ডাকছে। নলহাটির 'শ্যামচাঁদের মেলা' কেও স্মৃতির কোঠাঘর থেকে, চিলে কোঠা থেকে ফিরে দেখতে ইচ্ছে করে। ৩৯ বছরের ব্যর্থ উথথান, সফল পতন দেখতে দেখতে দীর্ঘ এক মানবতার কযানভাস থেকে আবার ফিরে যাই জয়দেবের মেলায়। আউল-বাউলের মেলায় ১০০ গ্রাম থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের রসগোল্লা। দড়িতে ঝুলছে। বড় বড় জিলেপি। গাঁ-গঞ্জের জোয়ান মরদদের জন্য। মেয়ে-বিবিরাও সব হজম করে ফেলতে পারে। সস্তার রঙ দেওয়া বিভিন্ন রসের মিঠাই। একটার প্র একটা দুকানে বিকছছে।
সঙ্গে থাকে সিদ্দি, গাঁজা, ভান,। আহা বড় শীতের সংক্রান্তি। মাঘের ৬-৭ ডিগ্রি তাপমাত্রার শিশির ভেজা রাত। অচেনা নারী পুরুষের ওম। এই আখড়া ওই আখড়া। খড়ের বিছানা। কলান্ত শরীর। দেহের সমস্ত আদ্রতা শুষে নিয়েছে ভেজা চাঁদের আদ্র। গায়ের চামড়ার সাদাটে আঁচর জানান দিচ্ছে। তুমি জয়দেব মেলায় এসেছ।
হযা জয়দেব মেলা। তখন বেসরকারি ভাবে চলত। পাঁচড়া গ্রামে আমার বড়দির বাড়ি। আমার বড় প্রিয় দিদি ছিলেন তিনি। আর ছিলেন আমার রসিক জামাইবাবু। দুজনেই এখন ছিলেন হয়ে গেছেন। এই দিদি-জামাইবাবু আমার সব হাত খরচ দিতেন। কেন্দুলির মেলায় যাবার জন্য। পাঁচড়া থেকে দুব্রাজপুর হয়ে কেন্দুলির মেলা। আবার 'ক্লাখোলার' মেলা নামেও পরিচিত ছিল একটা সময়। চন্দননগর তথা হুগলী থেকে ৩০০-৪০০ কলা ব্যাপারীরা আসত। অজয়ের চোরাস্রোত জলে মকড় সংক্রান্তির স্নান সেরে জয়দেবের মন্দিরে ভক্তজনের ভিড়। স্কাল থেকেই মাঘের নরম রোদ গায়ে মেখে মেলার গৌরচন্দ্রিকা সেরে ফেলা যায়। তবু আশির দশক থেকে মেলার আউল-বাউলের উচ্চকিত আয়োজন। ওই আশির দশক থেকেই ,বাউল-ফকিরদের আদিমতা যথার্থ অরথে বললে সাধক বাউলদের আমরা চিনতে ভুলে গেলাম। আশির দশকে মনে পড়ছে কোঁকড়ানো চুলের এক রোগা দোহারা চেহারার বাউল এ আখড়া থেকে সে আখড়া গেয়ে বেড়াচ্ছে। 'খেজুর গাছে হাঁড়ি......।'' পবন্দাস বাউল। পবনের সঙ্গে শহর সভ্যতার একদল যুবক। জিন্সের চোঙ্গা প্যান্ট, গায়ে দামি পাঞ্জাবি, কাঁধে চামড়ার বযাগ্, মুখে গাঁজা ভরা সিগারেট নিয়ে কলকাতার একদল রাগী যুবক বযস্ত। বর্তমানে লব্ধ প্রতিসঠিত এক সাহিতিযক এই দলের নেতা ছিলেন। তখনও জয়দেব মেলা চিরন্তন বৈষ্ণব আখড়ার ঐতিহয নিয়ে চলতে চাইছে। বীরভূমের হারিয়ে যাওয়া দীপেন ১৪ জানুয়ারি, ১৯৭৯ সালে 'চনডীদাস' পত্রিকায় লিখছে, ''.........আউল-বাউলদের নিয়ে এই কেন্দুলি মেলা বিখযাত। কিন্তু সেই প্রাচীন ঐতিহযম্নডিত এই মেলা বর্তমানে আধুনিকতায় প্রিপূরণ। মেলায় এসে প্রথমটায় হতাশ হলেও পরে ঠাকুর হরিদাস আশ্রমে 'বীরভূম সাহিতয পরিষদে'র সভায় অংশ নিতে পেরে মনটা তৃপ্ত হ্ল। ঐতিহযের কিছুটা ইঙ্গিত পেলাম।'' আবার ১৯৮৭ সালে 'দৈনিক বসুমতি' পত্রিকার প্রতিনিধি হয়ে ১৯ জানুয়ারি প্রতিবেদনে লিখলাম, ''......জেলা শাস্ক শুভেন্দু রায়ের সঙ্গে কথা বলছিলাম 'বাউল মঞ্চে' বসে। তখন বেলা পৌনে চারটা। শুভেন্দু রায় বললেন, .........সরকারের পরিচালনায় মেলা সাত বছর চলছে। .........আর একটা অসুবিধা মেলার রাস্তা নিয়ে।''
আশা করা যায় মেলা আরও আধুনিক হয়েছে। প্রিকাঠামোও নিশ্চ্যই উন্নত হয়েছে। রাজ্য তথা জেলার হাত ধরে। আমরা জানি জ্যদেব-কেন্দুলি মেলার আদিরস বাউল-ফকিরের গানে। গ্রামীণ সভ্যতার বাঁধন একদা নির্ভর করত বৈষ্ণব পদাব্লীর চ্রণে।
নিরন্ন ঘর থেকে বা 'চাল বাড়ন্ত ঘর থেকে' জনপদের বাউল-ফকিররা পদব্রজে এক সাঁই থেকে অন্য সাঁইয়ের  আশ্রয়ে নাম লেখাত। তাইতে কি ওই সব অমর গান আজও প্রচলিত? আজও মন ছুটে যায় লাল মাটির রুক্ষতার ওম নিতে। শ্রদধেয় সুধীর চক্রবর্তী সম্পাদিত 'ধুরবপদ' বার্ষিক সংকলন ১৯৯৭ সংখ্যায় রমাকান্ত চক্রবর্তী তাঁর প্রবন্ধে লিখছেন, ''......ব্রাহ্মণরাও বাউলদের খোঁজ রাখেননি। .........কিন্তু ব্রাহ্মণরা কিছুতেই আউল বাউল সহজিয়া অঘোরীদের ধর্ম সাধনাকে সবীকৃতি দিলেন না।'' তিনি আরও লিখছেন, ''আধুনিক গবেষণায় এটা স্পষ্ট যে, বাউল্রা নানা কারণে ব্রাহ্মণ্য সংসকৃতি মানেন্নি। কিন্তু তাঁরাও তো অত্যন্ত রক্ষণশীল। বাউল গুরুরা রক্ষণশীল। বাউল-ধ্রমের প্রচলিত ঐতিহয থেকে এক পাও তাঁরা সরে আসতে চান না। ছোটখাট মতবিরোধ স্তবেও বাউলদের ধ্রমাভযাসের একটা সাধারণ রুপ আছে। এই সাধারণ রুপের কোনও পরিবর্তন করা চলেনা। বাউলদের এইরুপ রক্ষণশীলতা সম্বন্ধে বৈচারিক মূলযায়ন করা হয় না।''                                        

No comments:

Post a Comment