Thursday 8 February 2018

কলকাতায় নয়া উপনিবেশ নয় ফরাসী সভ্যতার ছায়াপথ

কলকাতায় নয়া উপনিবেশ নয় ফরাসী
সভ্যতার ছায়াপথ: 
প্রবাদটা আজ আবার মনে পড়ছে। রথ দেখা এবং কলা বেচা। গত মাস কয়েক হল আমি কলকাতার ফরাসী সংস্কৃতির ছায়ানট আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে সারস্বত আরাধনায় নিয়মিত যাচ্ছি। ৩০ জানুয়ারি পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্য একটি দেশের উপ দূতাবাসের আমন্ত্রণে কলকাতা বই মেলায় গিয়েছিলাম। কলকাতা বইমেলা নিয়ে ইতিমধ্যে আমার ভিন্ন ভিন্ন দু’টি ব্লগে প্রতিবেদন লিখেছি। কিন্তু তাঁর আগে আমি ২২ জানুয়ারি আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের তরফে ‘কলকাতা কমিউনিকেশন’-এর থেকে ই-মেল পাই। আমন্ত্রণপত্রে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সুদৃশ্য খোলা মঞ্চে (ওএটি)-তে তিনদিনের (৫, ৬ এবং ৭ ফেব্রুয়ারি) নাটক বিষয়ক আলোচনায় অংশ নেওয়া এবং নাটক দেখার আবেদন ছিল। আমি ৫ এবং ৬ ফেব্রুয়ারি বাধ্য শ্রোতা দর্শকের মত হাজির ছিলাম। দু’দিন সীমাবদ্ধ অভিঞ্জতা এবং শেষ বেঞ্চের ছাত্র হিসেবে নাটক দেখেছি। আলোচনা শুনেছিপ্রশ্ন করেছি।
বাউল মন সংস্কৃতির ভাষা চিনতে চিনতে বড় হয়েছি। কিন্তু এদিনের অভিঞ্জতা ছিল ভিন্ন রকমের। আমরা জানি এবছরের কলকাতা বইমেলার ‘থিম দেশ’(‘কান্ট্রি’) ফ্রান্স। ফরাসী দেশে নতুন রাষ্ট্রপতি এমানুয়েল ম্যাক্রন ( Emmanuel Macron) এসেছেন। এবং সেই সুবাদে ভারতে আমরা ফরাসী সভ্যতার ছায়াপথ খুঁজে পাচ্ছি। শীত শেষের উপকণ্ঠে এবং বসন্তের আঙিনায় নাট্য নবান্নে। আর এটাকেই আমার মনে হয়েছে রথ দেখা এবং কলা বেচা। 
এই বছরের বই মেলায় আমার মতো অধমকে স্বসম্মানে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানিয়েছিল আমেরিকান সেন্টারের স্থানীয় কতৃপক্ষ। সেই সুবাদে ৩০ জানুয়ারি কলকাতা বইমেলার অস্থায়ী উদ্বোধনী সভাঘরে উপস্থিত থাকার অভিঞ্জতা আমার হয়। সেখানেই ফরাসী রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দর জিগলার তাঁর দেশের তিনজন সাহিত্যিকের উপস্থিতিতে বলেন, ‘’ফ্রান্স এবং ভারতের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আমি আশা করব বর্তমান সময়ের আর্থসাংস্কৃতিক এবং আর্থরাজনৈতিক গুরুত্ব ভারত এবং ফ্রান্স এই দু’ই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক আরও মসৃণ করতে সহায়ক হবে। বাংলাকে একদা ভারতের ফ্রান্স বলা হত। তাই কলকাতার বই মেলার মঞ্চের গুরুত্বও যথেষ্ট রয়েছে।‘’
সেদিনের কলকাতা বই মেলায় ফ্রান্সের সর্বকালের সুবৃহৎ স্টলের অবস্থান বাইরে থেকে দেখে চমকে উঠেছিলাম। আমি একবার সেদিন ভেতরে যাওয়ার চেষ্টাও করেছিলাম কিন্তু উদ্বোধনের আগে দর্শক পাঠকদের ভেতরে প্রবেশে নিশেধাঞ্জা ছিল। তাই সেদিন ফিরে এসেছিলাম। কিন্তু ৬ ফেব্রুয়ারি ‘থিয়েটার টুডে’-এর অনুষ্ঠানে ফ্রান্সের কলকাতার কনসাল জেনারেল ডমিয়েন সৈয়দ আমাকে অনুরোধ করেন ফ্রান্সের স্টল আর একবার ঘুরে আসার জন্য। আমার ব্লগের লেখায় স্টলের বিষয়টা রাখতে। ৬ ফেব্রুয়ারি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন ফরাসী দেশের একজন জনপ্রিয় লেখক। আলাপ হল। তিনি আমার নাম জানলেন। পরিচয় জানলেন। কিন্তু নিজের নাম বললেন না। তাঁর কাছে জানতে পারলাম কলকাতায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ সাহিত্য সম্মেলন করবে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে এই সম্মেলন হবে। আমাকে উপস্থিত থাকার জন্য আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে কলকাতার ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন।  
বুধবার কলকাতা বইমেলায় আবার গিয়েছিলাম। ফ্রান্সের স্টল, আমাদের প্রেস ক্লাবের স্টল, আমেরিকান সেন্টার এবং বাংলাদেশের স্টলে ঘুরলাম। বইমেলায় এবার প্রাপ্তি হল বিনামূল্যে একটি সুদৃশ্য বাইবেল, একটি কোরান এবং একটি গীতা। বই কেনার যেমন সামর্থ হারিয়েছি বই রাখার মত ব্যবস্থাও ভাড়ার বাড়িতে আর নেই। নতুন আলমারী না আনতে পারলে বই রাখার পাত্রও নেই পাত্রীও নেই। নাগরিক বাউলদের বই এখন খুঁজে পাওয়াও বিরল। আমাদের মত ‘ছন্নছাড়া’, সমাজ বিচ্ছিন্ন, উদ্বৃত্ত এবং উদ্বাস্তু বাউন্ডুলেদের তাই পাঠাগারের উপর নির্ভর করতে হয়।       
আধুনিক প্রযুক্তি এবং ফরাসী ধ্রুপদী মননের মিশ্রণে কলকাতার বই মেলার অন্যতম আকর্ষণ এবছরের ‘বনজৌর ইন্ডিয়া’ (BONJOURIndia) স্টলস্টলের বাইরেই উল্লেখ রয়েছে ‘ইনোভেশন, ক্রিয়েটিভিটি, এবং পার্টনারশিপ’। দূতাবাস সূত্রে জানতে পারছি সারা ভারতে ‘ইন্দো-ফ্রেঞ্চ মোমেন্ট’ শিরোনামে ৩৩টি শহরে ১০০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। ৩০০ ইভেন্ট আছে। ফ্রান্সের প্যাভেলিয়নে এই বিষয়গুলি তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে দর্শকদের কাছে তুলে ধরা হচ্ছে। দূতাবাস সূত্রে বলা হচ্ছে সবুজ প্রকৃতির সঙ্গে চলো। স্মার্ট নাগরিকের গতিশীল জীবনের জন্য প্রয়োজন সবুজ প্রকৃতি। বিশ্ব উষ্ণায়ন থেকে বাঁচতে গাছ লাগাতে হবে। কালো ধোঁওয়া, গ্যাস থেকে মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে হবে। দূষিত গ্যাস নির্গমনের মাত্রা কমাতে গেলে প্রয়োজন নাগরিক সচেতনতা। সেটা করতে গেলে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে ফ্রান্সের উন্নয়নশীল দেশ ভারতকে ভীষণ প্রয়োজন।  Bonjour India provides a platform for enduring partnerships across the themes of Smart Citizen, High Mobility, Go Green.  ফরাসী ভাষা শিখতে ৪,৫০,০০০ মানুষ আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে আসে। প্রচার চিরকুটে লেখা হয়েছে, ‘’Every year, more than 4,50,000 people of all ages come to learn French, at the Alliances francaises,  and more than 6 Million people participate in their cultural activities. We believe in the unfailing link between language and culture.’’ 

At the heart of the Indo-French relationship is the story of how and when we met.
শিরোনামে ‘বনজৌর ইন্ডিয়া’ লিখছে।
 ‘In 1985 Indian performers were cheered at the Trocadero Alley in Paris, and in 1989 French artists enchanted audiences at Marine Drive in Mumbai. Two decades later, Bonjour India came back with a bang in 2009, and by 2013 it grew into more and more collaborations.
Scaling up in its third edition, Bonjour India 2017-18 is a four-month-long mega voyage across India that will celebrate Indo-French partnership as well as shape the next decade of human exchange between the two countries. From November 2017 to February 2018, Bonjour India covers around a 100 programmes and projects in over 30 cities across 20 states & union territories. Bonjour India provides a platform for enduring partnerships across the themes of Smart Citizen, High Mobility, Go Green.
Bonjour India is unprecedented given the ambitious scale of its partnership with India. People at the forefront of their fields will share their inspiring journeys as they change society through their innovation and creativity.
At events collaboratively organised across cities and disciplines, amid performances, debates, seminars and exhibitions, all audiences will find something that captures their imagination.
With Bonjour India 2017-18, India and France will come together to create, innovate and partner towards a progressive and sustainable future.
Bonjour India aims far, Bonjour India supports fair, Bonjour India is fun!’’
For further information please visit www.ifindia.in/bonjour-india

৩০ জানুয়ারির পর ফরাসী নবজাগরণের ধারবাহিকতায় ৫ ফেব্রুয়ারি বনজৌর ইন্ডিয়া (BonjourIndia)-এর থিয়েটার টুডে অনুষ্ঠান। ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল অরিআনে মনৌছোকাইন (Ariane Mnouchkine)-এর নাটক বিষয়ে আলোচনা এবং ত্রিমুখী প্লাটফর্মের নাটক সংগঠনের তরফে দেওয়া ৬ পৃষ্ঠার প্রচারপত্রে লেখা হয়েছে, In the evenings, participants attend a double theater performance, the first- Essay of ‘Seasonal Variation in Santhali Society-Awakens Spectators’ thoughts and senses. The second- ‘Try Me Under Water’- Invites the audience to go deeper in the contemplation and even loose Ground. The Nocturnal wandering at JU Campus concludes with a multi-track video projection in the middle of a pond.   
নাটকের বিষয়বস্তু এবং পরিচালনায় যেমন নতুনত্ব রয়েছে আবার নাটকের আঙ্গিককে খোলা মঞ্চে ব্যবহার করতে চেয়েছেন নাট্য পরিচালক জিয়ান ফ্রেডরিক চেভালিয়ার(Jean- Fre`de`ic Chevallier)  
কিন্তু নাটকের থেকেও আকর্ষক হয়ে উঠেছিল নাটক বিষয়ে মতবিনিময় আলচনাসভা। বক্তা ছিলেন ৭৪ বছরের ফরাসী নাট্যকার এবং নাট্য পরিচালক আরিয়ান মনৌছকাইন (Ariane Mnouchkine)তাঁর ৫৪ বছরের নাটক করার অভিঞ্জতা তিনি এদিন আমাদের সামনে তুলে ধরেন। ১৯৬৪ সালে আরিয়ান ভারতে তথা কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি উল্লেখ করেছেন জওহরলাল নেহরুর কথাবলেছেন তখন নেহরু বেঁচে ছিলেন। উল্লেখ করেছেন দুর্ভিক্ষের প্রসঙ্গ। রাস্তায় মৃতদেহ দেখেও আরিয়ান প্রথমটাই বুঝতে পারেননি মানুষটা মারা গেছে। তিনি ভেবেছিলেন মানুষটা শুয়ে আছে। নাটকের বিষয়ে তাঁর লব্ধ জ্ঞান আলোর বিচ্ছুরণের মত সাদা ফুলের পাঁপড়ি হয়ে ঝড়ে পড়ছিল। আরিয়ান মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেন। ফ্রান্সে নিজের দেশে তিনি সরকারি নাট্যশালায় কাজ করলেও প্রতিষ্ঠান বিরোধী নাটক করেন।
আরিয়ান বলেন, ‘’গ্রীক নাটক, শেকসপিয়ারের পরেই ভারতের নাটকের বিষয় বস্তু, নাট্যকলা ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের সমৃদ্ধ করে। আমরা ভারতীয় নাটকের থেকে অনেক কিছু শিখেছি। জাপানের কাছ থেকেও নাটকের বিষয়ে শেখা যায়। আমি বর্তমান ভারতের নাটক দেখিনি। কিন্তু এটা বলতে পারি পশ্চিমের মত কয়েকটা লোক ভারতে রঙ মেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাটকের চরিত্রে অভিনয় করে না। এই দেশে ‘কথাকলি’-এর মত নাট্যকলা রয়েছে। নেপথ্যে সঙ্গীতের মূর্ছনায় শিল্পীরা নাচের মাধ্যমে অভিনয় করে। এই বিষয়টা আমরা পশ্চিমের নাট্যকার নাট্য পরিচালকরা ভারত থেকে শিখেছি।‘’
দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার এই মতবিনিময়ের আসরে নাগরিক কলকাতার সঙ্গে হাজির ছিল ঝাড়খন্ডের আদিবাসী কিশোর কিশোরীদের দল। এবং কয়েকজন তরুণ তরুণী। তাঁরা নাটকে অভিনয় করেছে আদিবাসী গ্রাম সভ্যতার টুকরো টুকরো অংশে তাঁরা নাটকের পান্ডুলিপির দাবি মেনে অভিনয় করেছে। যাদবপুর বিশ্ব বিদ্যলয়ের বিদগ্ধ অধ্যপকের বাংলা অনুবাদের মাধ্যমে আরিয়ানের অভিঞ্জতাও ওরা শুনল। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র ছাত্রীও এই নাট্যশালায় অংশ নিয়েছিল।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওএট মঞ্চে তিনদিনের অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করে ফ্রান্সের কনসাল জেনারেল ড্যামিয়েন সৈয়দ বাংলায় বলেন, ‘’আমি এখানে এসে খুব খুব খুশি হয়েছি। খুব উৎসাহিত হয়েছি। আপনাদের সঙ্গে থাকতে পেরে আমার ভালো লাগছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় সঠিক জায়গা।‘’ পরে ইংরেজিতে তিনি বলেন, এখানের মানুষ সংস্কৃতি সম্পন্ন। অনন্য। ব্যতিক্রমী, সৃষ্টিশীল। এবং এই বাংলার মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি আছে। আমরা সেই মেধাশক্তিকে কাজে লাগাতে চাই। ভারত এবং ফ্রান্স দু’ই দেশের যৌথ শক্তি পারে নতুন নতুন উদ্ভাবনী মাধ্যমের সন্ধান দিতে।     
                              
             


No comments:

Post a Comment