Wednesday 6 December 2017

সতৃষ্ণ আলো দেখার সতীর্থদের পথে

সতৃষ্ণ আলো দেখার সতীর্থদের পথে: 
ক্লান্ত মেঘেদের দেশ থেকে যারা বেরিয়ে গেছে তাঁরা আমাকেও ডেকে নিয়ে যেতে চায়। চাপ চাপ কালো মেঘ এই বছর কম দেখেছি। বর্ষা ছিল তবে সেতো যে সব মানুষ কোনোদিন বর্ষায় ভেজেন না। তাঁদের জন্য। আমরা ‘আয় বৃষ্টি ঝেপে ধান দেব মেপে’ বলতে বলতে আজও সতৃষ্ণ আলো খুঁজছি।  ছুটি শব্দটি ব্যস্ততম মানুষের আলো দেখার উৎসব। কর্মব্যস্ত মানুষ সপ্তাহ শেষে আনন্দ করবেন। জীবনকে উপভোগ করবেন। পরিবারকে গঠনমূলক সময় দেবেন। সময়ের দাবি মেনে। সমাজ কাজের, অফিস কাছারির পালোয়ানী যুদ্ধ টপকে নিজেকে হাজির করবেন উৎসবের সভাঘরে। সভ্যতার সতৃষ্ণ আলো দেখার সতীর্থদের পথে।
সেই উৎসবে সামিল হতে কে না চায়? সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকার পড়লাম। বলিউডের অন্যতম চরিত্র অভিনেতা সৌরভ শুক্লা সময় উত্তীর্ণ সময়ের কথা বলেছেনতিনি বলেছেন গত ৩৪ বছর আমি ছুটি কাটাচ্ছি। জীবন কত গভীর থেকে দেখলে এই আশাবাদের কথা বলা যায়। নাটকে অভিনয়, চিত্রনাট্য লেখার কাজ, সিনেমায় অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত থেকেও সৌরভ শুক্লা বলছেন তিনি আরও কাজ চান। আরও ব্যস্ত হতে চান। তাঁর কোনও প্রয়োজন নেই কোনও নির্জন দ্বীপে ব্যক্তিগত মালিকানার ‘ফার্ম হাউস’ বা বাগান বাড়ির। অর্থাৎ অর্থের প্রাচুর্য নয়। সৃষ্টিশীল কাজের ব্যস্ততা চাইছেন জীবনমুখী শিল্পী।
কতকাল কতদিন পর একটা মাসকে অনেক অনেক দীর্ঘতায় দেখলাম। অনেক অনেক স্পষ্টতায় অনুভব করলাম। একটা শহরকে আবার কত বছর পর আরও কাছ থেকে দেখলাম। গত কয়েক বছরের একবগগা আলিঙ্গনে আমি এবং আমার ‘আমিত্ব’ চেনা রাস্তাগুলোতে হেটেও আমাকে চিনতে চাইছিল না। রাস্তার নাম, পাখিদের রঙ, পাড়ার নাম, বাসের নম্বর, অলি গলির পথে নেমেও ‘সলেমন’-এর মায়ের মুখটা মনে করতে পারছিলাম না। বদলে যাওয়া কলকাতার ভাষা চিনতে পারছি। আলো দেখতে পাচ্ছি না। স্মৃতি ঠোক্কর খাচ্ছে বয়সের চৌকাঠে। শত্রু মিত্রদের ঘৃণা আর আলিঙ্গনের দাবির অহংকারে ওদের ঠুনকো কাঁচের ঝন ঝন আওয়াজ কতবার কতদিন শুনেছি। বিমুখ সমাজের চাবুকের শব্দ শুনতে শুনতে মন-মানসী সম্মিলিত চোখের খোঁজে থাকে। চোখের ভাষার আলতো ছোঁওয়া পদাতিক সংস্কৃতির অনুভূতি হবে ‘আমার সকল দুঃখের প্রদীপ, জ্বেলে দিবস জ্বেলে করব নিবেদন/ আমার ব্যথার পূজা হয়নি সমাপন’নাগরিক কলকাতায় হারিয়ে যাওয়া যৌবন, পৌঢ়ত্বে এসে মঞ্চ খুঁজে পায়। অথবা ফিরে পেতে চাইছে জীবনমুখী গণতন্ত্রে, সৃষ্টিশীল ভাষায়। নীলকণ্ঠ পাখির ডানায় চড়ে সাগর পাড়ের ঝা চক চকে ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে বেহালার করুণ সুর শুনতে চেয়েছিলাম। স্মৃতির মূর্ছনা ফিরিয়ে দেবে আমার সামাজিক বন্ধন।
নভেম্বর মাসটায় কারা যেন চুপি চুপি সেই পথে ডেকে নিয়ে যেতে চাইছে। কি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। ১১ নভেম্বর দেখলাম হলিউডের ছবি Julie & Julia. একজন কর্পোরেট কর্মী জুলি নিজেকে খুঁজতে খুঁজতে আত্মপ্রকাশ করার মাধ্যম খুঁজে পায়। সে ব্লগ লিখতে শুরু করে। তাঁর এতটাই নাম ডাক হয় একটা সময় জুলির সাক্ষাৎকার নিতে আসে আমেরিকার নাম করা প্রথম শ্রেণির সংবাদ মাধ্যম। পরে তাঁর ব্লগের লেখাগুলি নিয়ে বই প্রকাশ হয়। ব্লগ লেখার বিষয় রান্না হতে পারে, আসলে এই রন্ধনশৈলীর মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানব দর্শনের পথ। ছবিটি প্রসঙ্গে একটি ইংরেজি লেখা তুলে দিলাম।
‘’Yesterday afternoon, a girlfriend and I slipped away to catch the first showing of Julie and Julia.  Julie and Julia is a delightful film following the legendary American cook, Julia Child, becoming Julia, and a woman trying to find herself who decides to cook each of Julia’s 500+ recipes in 365 days and blog about it.  If you’re in the mood for a good movie (that makes you hungry), I would definitely recommend Julie and Julia.
Near the end of the Julie and Julia film, Julie cooks the final dish on the 365th day and has a dinner party to celebrate her success.  As soon as I saw the darling white dress she wore, I knew immediately that I would be sharing it with you.’’ (Courtesy: Cable Car Couture)
পরের ছবিটি ১৮ নভেম্বর দেখলাম। ছবিটি ছিল ‘The Intern’ এই ছবিটিতেও আমার এবং আমাদের মত মানুষদের জন্য বর্তমান সময়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। একটি ফ্যাশন সংস্থা তাঁদের কোম্পানির জন্য ‘’senior interns’’ পদে কর্মী চাইছে। উল্লখিত সংস্থা এবং সেই সংস্থার সিইও জুলস ওস্টিন এবং ৭০ বছরের প্রবীণ ইন্টার্ন বিনকে নিয়ে একটি টানটান চলচ্চিত্র। ছবির গল্প আমাদের মননকে নিয়ে যায় পেশাদার বেসরকারি অফিস সংস্কৃতি থেকে মার্কিন উচ্চবিত্ত পরিবারের ঘরোয়া জীবনের টানাপোড়েনেএবং সেই উচ্চবিত্ত পরিবারের সামাজিক জীবনকেও আমরা উঁকি দিয়ে দেখে নিতে পারি জুলস এবং বিনের ব্যতক্রমী অভিনয়ের ঘরানায়। অবশ্যই গঠনমূলক ছবি। যে ছবি ছুঁয়ে যায় বর্তমান সময়ের সোশ্যাল মিডিয়া তথা ‘ফেসবুক’ মাধ্যমকে। কলকাতা প্রেক্ষাগৃহে বসে দ্য ইন্টার্ন ছবি দেখতে দেখতে মনে হয় আমার নিজের জীবনের গল্প পরদায় দেখছি। ছবিটির ইংরেজি আলোচনা কিছুটা অংশ উল্লেখ করলাম।
            ‘’Following in the beautifully shod footsteps of Eli Wallach (“The Holiday”), Diane Keaton (“Something’s Gotta Give”), and Meryl Streep (“It’s Complicated”) comes Robert De Niro, with infinite charm and grace in a role he seldom gets to take: an ordinary guy.
De Niro plays Ben, 70 years old, living in Brooklyn, a widower after a long, happy marriage, retired, and looking for something to do. He has traveled, visited his grandchildren, taken classes. There is a single woman his age (Linda Lavin) who would love to date him. But he wants something more. “The nowhere to be thing hit me like a ton of bricks.”
And then he sees a flier. A local start-up is looking for “senior interns,” for no other reason than to make a cute movie plot, but okay. It’s an online sales company, selling fashion with some special ability to make sure the items fit properly), and he still uses a flip phone, but Ben decides to apply. And he is undaunted that applicants, instead of submitting a resume, are asked to upload a video about themselves. “I want to be challenged,” he explains, “and needed.”
He gets the job and is assigned to the start-up’s visionary but harried CEO, Jules Ostin (Anne Hathaway). Is the name supposed to make us think of Jane Austen? Could be. She has an only-in-movies adorably precocious moppet and a shaggy (in a cute, artisanal, Brooklyn way) devoted stay-at-home-dad of a husband. And, guess what? They live in an exquisitely decorated brownstone with a couple of legos and a backpack sprinkled around for relatability. Plus, she is played by Anne Hathaway, so she is stunningly beautiful in a we’d-totally-be-best-friends-if-she ever-met-me sort of way. She gets to channel her “Devil Wears Prada” co-star Meryl Streep as the boss who can be terrifying, but she knows and we know she’s there to be loveable, not scary. And he is endlessly calm and resourceful, whether cleaning up the office junk pile, crunching data, giving dating advice, or retrieving a disastrously mis-sent email.’’ (Courtesy: Warner Brothers) 
এই ধারাবাহিকতায় হঠাত করে সুযোগ এসে গেল নিউইয়র্ক শহর আর শান্তনিকেতনে একসঙ্গে ঘুরে আসার। এবছরের ৪ ডিসেম্বরটা সম্ভবত সেই সুযোগটা করে দিয়েছিল। বড়দিনের সংযমী হুল্লোর এবং পৌষ মেলার উদাসী বাউলের খ্যাপামো। কলকাতার আমেরিকান সেন্টারের লিঙ্কন সভাঘরে ৪ ডিসেম্বর ছিল একটি সঙ্গীত সন্ধ্যা অনুষ্ঠানের শিরোনাম ছিল ‘নিউ ইয়র্ক মিটস কলকাতা’। গান এবং ‘জাজ মিউজিক’ শুরুর আগে আমেরিকান সেন্টারের বর্তমান জনসংযোগ অফিসার (পাবলিক অ্যাফেয়ার্স অফিসার) জেমী ড্রাগন অনুষ্ঠানের সূচনায় বললেন, ‘’আমি কলকাতায় মাত্র তিনমাস এসেছি। আমি হায়দারাবাদে ছিলাম। আমার মনে হচ্ছে মাত্র তিনদিন এসেছি। এর আগে ১৯৯৮ সালে আমি কলকাতায় ছিলাম। এবছর সুযোগ আসতেই আমি বললাম, আমি কলকাতায় যেতে চাই। আজ সভাঘরে একটিও আসন খালি নেই। কলকাতা মানেই সঙ্গীত, ফুটবল। সঙ্গীতপ্রেমী কলকাতার শ্রোতারা এসেছেন। আসুন আমরা সঙ্গীত উপভোগ করি।‘’ 
আনুষ্ঠানিক বক্তব্য রাখতে এসে বড় ব্যক্তিগত হয়ে গেলেন কলকাতার আমেরিকান দূতাবাসের কনসুলেট জেনারেল ক্রেগ এল হল। তিনি এবছরের অগস্ট মাসে ইউ এস কনস্যুলেট জেনারেল হিসেবে কলকাতার দায়িত্ব নিয়েছেন। ক্রেগ বললেন, ‘’ভারত এবং আমেরিকার মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের চুক্তি এই বছর ৭০ (সততর) বছর পূর্ণ হল। আমাদের দুই দেশের সম্পর্ক একশো বছর থাকুক আমরা চাইছি। আজকের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দেশ তথা কলকাতা শহরে হচ্ছে। দুই দেশের সাংস্কৃতিক বিনিময়ের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। আমরা সেটা মনে রেখেছি।‘’
ক্রেগ উল্লেখ করেন, আজকের এই সভাঘরে কলকাতার বিদগ্ধ মানুষেরা এসেছেন দুই দেশের শিল্পীদের গান শুনতে। আমরা আশা করব আগামী দিনেও আরও এই ধরণের অনুষ্ঠানের আয়োজন আমরা করতে পারব।
অনুষ্ঠানে শুরুতেই মঞ্চে প্রথমে গাইলেন ‘নিউ ইয়র্ক’ শহরের বিখ্যাত ব্যান্ড ‘অরি রোল্যান্ড’-এর চারজন শিল্পী। অরি নিজে এই দলের স্বনামধন্য মিউজিক কম্পোজার। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও তিনজন শিল্পী। বিশেষ করে বলতে হয় স্যাক্সোফোন শিল্পী এবং গায়কের কথা। দক্ষতা এবং কৌতুক মেশানো আন্তরিকতায় কলকাতার উচ্চশিক্ষিত সুধী শ্রোতার দল উব্দেলিত হয়ে আনন্দ লুটে নিলেন সেদিন। মেধাবী চোখ হ্রদেয়র আহ্বান শুনে গঙ্গা-আটলান্টায় অবগাহন করতে চাইছিল। স্পর্শকাতর স্নায়ু অরি রোল্যান্ডের রসিকতায় নিউ ইয়র্ক এবং কলকাতা শহরকে ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্রের দুই পরম্পরা মনে করিয়ে দিচ্ছিল দুই শহরের বড় কাছাকাছি থাকার যে ঐতিহ্য সেই স্মৃতি আমাদের আগামীর আহ্বান শুনিয়ে গেল। গান, স্যাক্সো ফোন, ড্রাম, গিটারের আন্দোলিত সুর ভাষার ব্যবধানকে অনায়সে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল। ভালো থেক নিউ ইয়র্ক। তোমার আমন্ত্রণ কলকাতা সবিনয়ে গ্রহণ করছে।
ভালো আছে কলকাতা। গঙ্গার ঢেউয়ের প্লাবনের মতো আমাদের সামনে এলেন বাংলা নাটক ডট কমের শিল্পীরা। দলের মুখ্য গায়িকা এবং পরিচালক দেবলীনা তাঁর কণ্ঠের জাদুতে আমাদের কখনো নিয়ে গেলেন বৃন্দাবন, নবদ্বীপে। আবার বাংলাদেশের নদী মাঠ ঘাটের সুরে তিনি আরও আন্তর্জাতিক হয়ে উঠলেন তাঁর সুরেলা এবং অভিজাত কন্ঠের প্রেক্ষপনে। পাশে ছিলেন গিরিশ বাউল। উদাসী সুরে বাউলের ছন্দে ভবা পাগলা আর লালনের ঘর করা গিরিশকে আমাদের মনে রাখতেই হবে। কিছুমাত্র কম ছিলেন না দেবলীনার দলের দ্বিতীয় গায়িকা। নাম মনে রাখতে না পারলেও তাঁর গলায় এই বাংলার ঝুমুর গান ঝুম ঝুম নূপুরের শব্দের মতো আমরা শুনলাম। রিম ঝিম সন্ধ্যায় আমাদের বাংলার তাল লয় ছন্দে আন্দোলিত হল কলকাতা শহরের এক অভিজাত কক্ষ। বাংলা নাটক ডট কমের তিন শিল্পী সঙ্গে নিউ ইয়র্ক শহরের অরি রোলান্ডের দলের যৌথ পরিবেশনা মনে করিয়ে দিল পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার। ভোর ভর হল দোর খোল নগরবাসী। আমি প্রাণবন্ত সভাঘরে বসে আমার মলিন নামহীন প্যাডে লিখলাম, হারিয়ে যাওয়া কার্তিক অগ্রাহায়ন মাসে/ হ্রদয় নিয়ে বসে আছি/ মন মেঘেরা যদি আসে।                

No comments:

Post a Comment