Wednesday 18 October 2017

স্পর্শকাতর সামাজিকতায় আলোর মুক্তি

স্পর্শকাতর সামাজিকতায় আলোর মুক্তি: 
দুর্গা পুজোর চারদিনের মধ্যে একদিন বিনা আমন্ত্রণে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। সময়ের নিয়ম নেই। বন্ধন নেই। উৎসবের সামাজিকতা নেই। আত্মীয়দের আত্মা এই কলকাতায় থাকলেও তাঁদের সীমান্ত বেড়া টপকানোর আমার অনুমতি নেই। যে অঞ্চলে থাকি সেই অঞ্চলের বড় রাস্তায় গত আট বছরে কতদিন হাঁটার সুযোগ হয়েছে? হুতোমকে জিগ্যেস করলে বলে দিতে পারে। এতটাই নিয়ন্ত্রিত সামাজিক আকাশ। কাঁধে সস্তার ঝোলা, খোলা আকাশ, মুক্ত মন নিয়ে আমি বেড়িয়েছিলাম। সামাজিক আলোর মুক্তির খোঁজে। কেউ বলে কাদের বন্ধনে বাইরে ঘোরেন? হুতোম বলে, ‘চাল নেই চুলো নেই যার সে গাজন সন্ন্যাসী সাজতে পারে না।’ সে তুমি আখড়ায় যাও, মঠে যাও, আশ্রমে থাক, কোথাও বন্ধন নেই। মরুতীর্থ হিংলাজে গেলেও কি মুক্তি আছে? কাঠ পোকার নিরাপত্তাও নেই আমার! প্রকৃতি যে মানব সত্তা চেনা এবং আপন সত্তার জন্য নিরাপত্তার শক্তি দেয়। আমি সেই সামাজিক কৌশল কবে কোন অগোচরে হারিয়ে ফেলেছি। নিজেই কি জানি? সল্টলেকের দিকটা কিছুটা ফাঁকা বলে চলে গিয়ে ছিলাম। গত বছরের মত নয়। প্যান্ট পাঞ্জাবিও নয়। পায়জামা পাঞ্জাবি ভাবতেও পারি না। নতুন জামার গন্ধ নিতে ভুলে গেছি, যেদিন আমার মাকে গভীর রাতের গঙ্গায় রেখে এলাম। মায়ের চিতায় শেষ জল কে দিয়েছিল? মনে নেই। বিন্দু বিন্দু সেই জল দেখে জঙ্গিপুর গঙ্গার জল আমার বুকে আজও ছলাৎ ছল, ছলাৎ ছল জলের আলোর ঢেউ হয়ে দুলতে থাকে। ওই গভীর রাতের শশ্মানের গঙ্গায় আলোর ঢেউ মায়ের সাদা থানের আচলের ঢেউয়ের মত ছিল। মা তুমি চলে গেছ। একবুক যন্ত্রণা আর অভিমান নিয়ে। আমরা আজও হেঁটে চলেছি লম্বা লম্বা পায়ে। আলুর ক্ষেত ধরে। ধান ক্ষেতের আল ধরে। সাদা খই, অচল পয়সার উপর দিয়ে হেঁটে চলেছি।  আমাদের নলহাটির বাড়ি, জবা, শিউলি, টগর, বেলি, রজনী গন্ধ্যা ফুলের ঘ্রাণ আমার চেতনায় আছে মা। পাতি লেবু, গন্ধরাজ লেবুর স্মৃতি বাবার ফেলে যাওয়া বিড়ির কৌটো, পিতলের লাইটার আজও নলহাটি গেলে খুঁজতে ইচ্ছে করে। হ্যা এইমাত্র আমি পেট্রোলের গন্ধ পেলাম। বাবা পিতলের লাইটারে তুলো গুজে পেট্রোল দিতেন। যতক্ষণ তুলো ভিজে থাকবে ততক্ষণ লাইটার জ্বলবে। আজও সেই অঘ্রানের ঘ্রাণ আমায় ছুটিয়ে নিয়ে যায়। আমায় প্রশ্ন করে আমার পিতৃ পুরুষেরা। আমাদের ‘কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি’ কোথায় গেল? কার জন্য হারিয়ে গেছে? চৌধুরী বাড়ির ঐতিহ্য? দীপকবাবু আপনি কি ফিরিয়ে দেবেন? আমাদের কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি? আনুমানিক ১৫০-২০০ বছরেরে পুরনো পিঁড়ি। আজও কি মাটি কাদায় হাবু ডাবু খাচ্ছে সেই পিঁড়ি? কত বই আমার ওই বাড়িতে রয়ে গেল। লিটিল ম্যাগ। কত লেখার খাতা! কত বন্ধু-আত্মীয়ের চিঠি। সব কিছু খন্ডহর হয়ে গেছে। কে খুঁজে দেবে? শরৎচন্দ্রের পেনসিল স্কেচ, চন্দ্রের আঁকা অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট। কোন ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিকতায় ফেলে এলাম? কে ফিরিয়ে দেবে আমার শৈশব, আমার কৈশোর, আমার যৌবন, আমার নস্টালজিয়া। আমার মা চলে গেছেন। আমার শাশুড়ী মা চলে গেছেন। কুড়ি কুড়ি বছর আত্মার আত্মীয়রা হারিয়ে গেছে। এক মিথ্যের ‘মিনার’ গড়ে ওরা আমাকে একা করে দিতে পেরেছে! ওদের হাতে সমাজ ছিল। ওদের হাতে সংবাদ মাধ্যম ছিল। ওদের হাতে বৈধ অবৈধ অর্থ আছে। ওদের ষড়যন্ত্রের নিবিড় জালে আমি কবে আটকে গেছিলাম আমি নিজেও জানতাম কি? আমার আত্মার আত্মীয়রা সব সেই ষড়যন্ত্রের রশি টানতে টানতে আজ সম্ভবত ক্লান্ত। কর্দমাক্ত গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে ওরা এখনও অপেক্ষায় আছে আবার কবে কোথায় কিভাবে সুযোগ নেওয়া যায়।        
মা যেদিন তোমার প্রাণহীন দেহটা আমার সামনে খুলে দেওয়া হল আমি চমকে উঠেছিলাম। কলকাতা গঙ্গার জলে তুমি স্নান করে কেন জঙ্গিপুর গেলে? তোমার কঙ্কালসার দেহটা দেখে আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম। এটা কে? আমার মা নয়? ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলাম। আক্ষেপ হচ্ছিল আমি পারিনি। পারিনি মায়ের চিকিৎসা করাতে। পারিনি পেট ভরে খাবার দিতে। মা তুমি উব্দাস্তু হয়ে এই দেশে এসেছিলে। আপন শক্তিতে আপন গরিমায় এদেশের বৈধ নাগরিক হয়েছিলে। কত বিনিদ্র রাত তুমি কাটিয়েছ আমাদের সামাজিক করতে। আমি সেই ঘরানা মনে রেখে তোমার গড়ে দেওয়া মঞ্চে আমাদের পরিবারকে এনেছিলাম। কিন্তু তারপর কাদের শক্তি আজ সব  টুকরো টুকরো করে দিল। মান নেই, সম্মান নেই, ঘর নেই, বন্ধন নেই, একটা দেহ বয়ে চলেছি তোমার বংশজ হয়ে। আজ থেকে ন’বছর আগে তোমার মৃত্যুর দিন জঙ্গিপুরে আমার পাশে ছিল আমাদের বংশের চেনা এবং স্বার্থপর আবেগহীন মানুষের মিছিল ওরা আজও আছে ওদের পরিমণ্ডলে। তুমি চলে গেলে। চলে গেছ। চলে গেছেন আমার আরও এক আপনজন। তুমি কুড়ি বছর আগে যেদিন কলকাতার গঙ্গায়, দক্ষিণেশ্বরের গঙ্গায় স্নান সেরে আমাদের ছেড়ে চলে গেলে তার পাঁচ বছর পর আমার শাশুড়ী ঠাকরুন মারা যান। সেই বছর থেকে ধরলে গত কুড়ি কুড়ি বছর আমাদের আত্মীয় নেই। স্বজন নেই। আমন্ত্রণ নেই। আবাহন নেই। তোমরা দুই মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছ। আমরা স্বজনহীন মানবতার উঠোন আঙিনায় বেঁচে আছি। গত কুড়ি কুড়ি বছর প্রতিদিন আমাবস্যার গহন রাতে জেগে থাকি। যখন ঘুম আসে, স্বপ্নে তুমি এসে দাঁড়াও। গায়ে হাত দিয়ে বল, কিরে ওঠ। চা করব? তুই ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? তুই এরকম আগে ছিলিনাতো? তোর মনের জোরেই যে সবাই বেঁচে আছে। তোকে আবার ঘুরে দাঁড়াতে হবে। এই বেলা দশটাতেও পাখি ডাকছে। কাঠবিড়ালি আমাদের প্রাচীরে কুমড়ো গাছের ডালের  উপর খেলা করছে। পেয়ারা গাছে টিয়ার দল এত বেলাতেও শান্ত হয়ে পেয়ারা খাচ্ছে। এবার উঠে পড় বাবা।                
মায়ের অভিমান সব ছেলেমেয়েই চেনে। বড় বড় নামজাদা বাবুরা মা-বাবার নামে স্মৃতি সৌধ করে। তৈলচিত্র করে বনেদি ড্রয়িং রুমের দেওয়ালে অথবা ইজেলে সাজিয়ে রাখেন। অন্ধকার ঢেকে যায় উজ্জ্বল দামি আলোর ঝাড় লন্ঠনে। আমার আমাদের ঘর নেই। সেই কবে একদিন আমার বাবা-মা ‘উদ্বাস্তু’ হয়ে এসেছিলেন। তাঁরা চলে গেছেন। আমার ঘরও নেই। তৈলচিত্রের দেওয়াল কোথায় পাব? তবে ইচ্ছের ইজেল আছে। সেই ইজেলে আমার মা আছেন।
এবার পুজোর সময় মা তোমার তোমাদের অবিভক্ত বাংলার সৌজন্য আমাদের চিনিয়ে নিয়ে গেল। ঐতিহ্যের বাংলায়। সহিষ্ণু বাংলায়। আমার শহর, আমার গ্রাম নলহাটী যে ভাষা আমাকে দিয়েছে। আমার মা, আমার পরিবার যে সংস্কৃতি আমাকে দিয়েছে। সেই ভাষা চিনতে বেড়িয়েছিলাম। যাদবপুর-বাঘাযতীন-নেতাজী নগর অঞ্চলের উব্দাস্তু কলোনি ঘুরে দেখছিলাম। উৎসবের আঙিনায় সবাই ব্যস্ত। দুর্গা ঠাকরুন চলে যাবেন তার প্রস্তুতি চলছে। আমি কলোনিগুলিতে আগেও ঘুরেছি। তবে এদিন নতুন করে চিনলাম। আমাদের রাজ্যে এবছর বিজয়া দশমী এবং মহরম পরপর দু’দিন ছিল। বিসর্জন নিয়ে আইন আদালত। প্রশাসনিক হেলদোল। এসবের পরেও ‘সবার উপর মানুষ সত্য’। পিঠোপিঠি বেঁচে থাকা দুই সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেরাই শান্তি বজয় রাখা এবং সহিষ্ণু সমাজের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিলেন। শুধু আমাদের রাজ্য কেন? প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশও সম্প্রীতির নতুন বার্তা দিয়েছে। এবছর (২০১৭) বাংলাদেশের বহু দুর্গাপুজো কমিটি তাঁদের পুজোর বাজেট কমিয়ে ত্রাণ তহবিল গড়েছিল। পুজোর আলো, প্যান্ডেল প্রভৃতি সমারোহের খরচ কমিয়ে ত্রাণ তহবিলে জমা করা অর্থ অসহায়, দেশছুট, সভ্যতাছুট ‘রোহিঙ্গা’ উদবাস্তুদের জন্য ব্যয় করা হয়েছে। বাংলাদেশের সম্প্রীতি বাতাবরণের উদাহারণ হয়ে থাকল। মনে পড়ছে ২০১৬ সালে দুর্গা পুজোর সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার।’ এই আহবানের মধ্যেই নিহীত আছে ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক বন্ধনের দৃঢ়তার সংস্কৃতি। সহিষ্ণু পরিবারের একাগ্রতা। প্রখ্যাত সাংবাদিক এডগার স্নো তার ‘গান্ধীবাদের নির্যাস ও অন্যান্য’ বইয়ের ‘গান্ধী ও নেহরু’ পরিচ্ছদে লিখছেন, ‘’গান্ধীজী রাজনীতিকে ধর্মের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে একটা অপ্রয়োজনীয় বিভ্রমের জন্ম দিয়েছিলেন। কেননা ধর্ম হচ্ছে অপ্রয়োজনীয় শিল্প। রাজনৈতিক স্থিতাবস্থা আর বিপ্লবী রাজনীতিতে অসম্ভবের শিল্পচর্চা— আমার মাথায় ঢোকে না। অথচ তাঁর সত্যানুসন্ধিৎসায় গান্ধীজী এই দুটোকে মেলাতে চেয়ে তাঁর প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। আমি এ ব্যাপারে গান্ধীজীকে প্রশ্ন করলে তিনি আমাকে ‘আরও কিছুটা পড়াশুনা করার’ পরামর্শ দেন।‘’ পৃষ্ঠা- ১৩, প্রকাশক- চর্যা প্রকাশনী      

যাদবপুর-বাঘাযতীন-নেতাজী নগর কলোনি অঞ্চলে উৎসব সময়ের বামপন্থী দলের বইয়ের স্টলে দাঁড়িয়ে উদ্বাস্তু নিয়ে লেখা একটি বইয়েয় অনেকটা অংশ পড়ে ফেললাম। বইটি ছিল ‘হ্রদয়ের টুকরোয় গাঁথা/ দেশভাগ ও একাত্তরের স্মৃতি’এটি একটি সংকলন। বইটি সম্পাদনা করেছেন ঝর্ণা বসু। বইটির শেষ লেখাটি একজন অধ্যাপকের। অধ্যাপক হৃষিকেশ হালদার লিখছেন, ‘একজন উদ্বাস্তুর দেশ হারানোর দুঃখ আশ্রয় নেওয়া দেশের মানুষ বুঝতে চায় না, বুঝতে পারে না। পূর্ববঙ্গের ভদ্রলোক উদ্বাস্তুরা কলকাতা শহর বা অন্যান্য শহরাঞ্চলগুলিতে নিজেদের ঠাঁই করে নিতে পেরেছে। সেই সব জায়গায় বা কলোনিগুলিতে নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের ঠাঁই মেলেনি।’ এই সত্য আমি গত ষাট বছর ধরে চিনতে চেষ্টা করছি। সম্প্রতি ‘রোহিঙ্গা উদবাস্তু’দের নিয়ে একই কথা বলা যায় সম্ভবত। যার দেশ নেই তাঁর আত্মীয় নেই। তাঁর সমাজ নেই। তাঁর ঘর নেই। বাড়ি নেই। তাঁদের মা আছেন। আমার মা আছেন।                      

No comments:

Post a Comment