Wednesday 1 February 2017

আগুন পাখির উড়ান

আগুন পাখির উড়ান:

আচ্ছা ‘মিলন মেলা’ প্রাঙ্গণটা যেন কোথায়? সেই গানটা পুরোটা মনেও আসছে না। ‘তুমি কি দেখেছ কভু? জীবনের পরাজয়?/............ তিলে তিলে তার ক্ষয়/তিলে তিলে তার ক্ষয়!’ সময়-অসময়ের গল্প পড়তে পড়তে এখন ‘গল্পদাদু’ হয়ে স্মৃতির সঙ্গে পাঞ্জা কষছি। মান থাকলেই না সম্মান থাকে। সম্মান থাকলে তবেই না অপমান বোধ অনুভূত হয়। যারা আজও পর্যাপ্ত আস্থায় সংগঠিত পেড নারীপুরুষ নিয়ে বেসাতি করে, তাঁদের কাছে সম্মান বিনিময় আশা করা বাতুলতা। পৌষ-মাঘ এর মাঘী মেলা কলকাতায়। কলকাতা বই মেলা। কাদের মেলা? কোন দলের? কোন কোন বই ওয়ালাদের? কোন পক্ষের? আমি আজও বলি ‘বসন্ত দীর্ঘজীবী’ হোক। বলতে চাইলেই কি বলা যায়? বই পাড়া মানে কলকাতা এই কথা জানলাম আশির দশকে গ্রন্থাগার আন্দোলনে নাম লেখানোর পরে। পরের পর পথটা ট্রাম লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে এক একদিন বই মেলা পৌঁছে যেতাম। কারণটা হাঁটতে ভালো লাগে বলার মত জ্যাঠামি থাকত। আসল কারণ পকেট ফাঁকা। সস্তার কচুরি খেতে হবে। সকালের জলখাবার। মেসের পাঁচ টাকার মিল।  বিড়ি খেতে হবে। লিটল ম্যাগাজিন কিনতে হবে। তারপর বই কেনা। সবটাই কলকাতা জীবনের ‘ক্যলকেশিয়ান’ না হতে পারার গ্লানি। তাই আজও বলি বসন্ত তুমি এখন আর চুপি চুপি আসতে পারনা কেন? সব কিছু খোলা খোলা। হৈ হৈ-হৈ চৈ পড়া বইয়ের কলকাতা, ঘাটা বইয়ের কলকাতা। পাঠাগারের কলকাতা। বনেদী বাড়ির বাবুদের হাতে বেল ফুল জরানো সন্ধ্যের কলকাতা।  টানা রিক্সার কলকাতা। আজ সব ধূসর লাগে। কাকে বলব? মামা-কাকার দল অক্লান্ত হয়েও নিজেদের দর্শনে দার্শনিক। ফাটা তবলা নিকলা গায়ক। ছেঁড়া খাতা নিকলা কবি। ব্যাঙ্কমে রুপিয়া নিকলা সাংবাদিক। কেউ কেউ জলচর কবি, জলচর লেখক, জলচর গায়ক, জলচর সাংবাদিক। এবং জলচর সংস্কৃতি। একুশ শতকে আবার নতুন মূল্যায়ন হবে। নোট বাতিলের হামলায় যেন বর্গী এলো বাংলায়। কে বা কারা হবে জলচর? আর কে বা কারা কারা হবে অচল পয়সা। অচল টাকার বসন্ত বিলাপ শেষে? বসন্তের মেলা বইমেলা নিয়ে আজ আমরা গাইছি ‘আজ এই বসন্তে কত ফুল ফোটে/ কত পাখি গায়....../আহা আজই এই বসন্তে।’
ফুটি ফাটা পকেট নিয়ে সেদিনও ‘বইমেলা’ গেছিলাম। জানি প্রবেশের জন্য কোনও আমন্ত্রণপত্র লাগবে না। এখন টিকিট কাটতে হয় না। কিন্তু এই বছর বইমেলার কাছে যেতেই হুতোমের পাল্লায় পড়লাম। হুতোম জানতে চাইল,
‘একচোখ নিয়ে বইমেলায় এলি যে বড়?’
বললাম, আমি সেই আশির দশক থেকে আসি।
হুতোম আবার প্রশ্ন করল, ‘আঁধার কার্ড এনেছিস?’
কেন আঁধার কার্ড আনতে যাব কেন?
উত্তরে হুতোম বলল, ‘বই কেনার টাকা তোর কাছে নেই আমি জানি। বইমেলায় প্লাস্টিক কার্ড থাকলে বই কেনা যাচ্ছে। আঁধার কার্ডওতো প্লাস্টিক কার্ড।’
হুতোমের হেঁয়ালি বুঝতে পেরে আমি আর বইমেলায় ঢুকলাম না। আশির দশকে এক কাকার সঙ্গে মাঝে মাঝে বই মেলায় গেছি। মনের দুঃখ মনে রেখে কাকার জন্য কেনা বই ব্যাগে করে বয়ে দিতাম। ঘটকবাবুদের বাড়ির শ্রদ্ধেয় দিদির বই কেনার টিমে একবার দু’বার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। তারপর ওই যে বললাম ফুটিফাটা পকেট নিয়ে বইমেলায় যেতাম। চাকরি খুঁজছি। সবাই যেমন খোঁজে। চক্কর কাটছি। বিপ্লবী বাংলার বুকে এঁকে দেব রক্ত টিকা। এই মন্ত্রগুপ্তির ব্যপ্তিতে আমরা তখন আবৃত্তি করছি কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্যের কবিতা ‘বেকারের চিঠি’। ‘আমার বয়স যখন একুশ পূর্ণ হোলো—/ ভোট দিলাম।/দিতীয়বার যখন চটের পর্দা-ঢাকা খোপরিতে ঢুকে/ প্রগতিশীল প্রতীক চিহ্নে ছাপ মারছি তখন আমি ছাব্বিশ। উনত্রিশ বছর বয়সেও............... গণতন্ত্র রক্ষার জন্য/ আমার প্রাণ আকুল হয়ে উঠেছিলো।/কিন্তু এ বছর ভোটের দিন সারাদুপুর তক্তপোষে শুয়ে/ বেড়ার ফোকর দিয়ে পতাকা-ওড়ানো রিকসার যাতায়াত দেখেছি/ কিন্তু ভোট দিতে যাইনি।/ না, আমি ভোট বয়কট করিনি/ভোট আমাকে বয়কট করেছে।/কারণ আমার বয়স একত্রিশ/তিরিশের পর সরকারি চাকরি পাওয়া যায় না। (প্রাচ্যের সন্ন্যাসী, পৃষ্ঠা- ৩২, কথাশিল্প, ১৯৮৩)
৩৪ বছর পর আজ আর এই কবিতা আমাদের দর্শনের সঙ্গে মেলে না। সময়ের বিবর্তনে কত নকশাল সাদা হাতিদের দলে নাম লিখিয়েছে?  সময়ের বিবর্তনে তাঁরা নিজেদের মত করে স্বঘোষিত দার্শনিক হয়েছেন। আমার বা আমাদের আপত্তি করার কি আছে? আপত্তি করতেই বা যাব কেন? ভারত নামক বৃহত্তর গণতন্ত্রে সবার অধিকার আছে। আর্থিকভাবে সফল হবার। এবং বিদ্যাজীবী হলেও চলে না হলেও চলে যায়। দাদা ঠাকুরের গান আছে না? ‘মাছ কাটলে মুড়া দিব/ধান ভানলে কুঁড়োদিব/কালো গরুর দুধ দিব/দুধ খাইবার বাটি দিব।’ এই গান লেখার জন্য কে বা কারা ভাবতে যাবে বলুনতো। তাঁর থেকে গতিশীল সমাজে গতিজ্যাড্যের সামাজিকতায় সাফল্য আসে। সেখানে সততার বুলি কপচানোর জন্য কেউ আগাম বায়না ধরে না। সমাজসেবার দায়বদ্ধতা বিষয়টা কিছুটা আপেক্ষিক সম্ভবত। ডাঃ বিনায়ক সেন সাড়ে চার দশক আগে ভেলোরের ক্রিশ্চিয়ান মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করেন। সিদ্ধান্ত নেন তৎকালীন মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের রায়পুরে থাকবেন। সঙ্গে থাকেন তাঁর স্ত্রী সমাজতত্তববিদ ইলিনা সেন। তিন দশক ধরে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করেন। এটাও সময়ের বিবর্তন বলেই জানি। ছিলাম বইমেলায় এলাম খই ভাজতে।
১৯৮৭ সালে বসুমতীর সম্পাদক রণজিৎ রায় আমাকে ‘কলকাতা পুস্তক মেলা’ কভারেজ করতে বলেন। আমার কভারেজ করা লেখা ৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশ হয়। লেখার কিছুটা উল্লেখ করছি, ‘’দেড়মাসের ব্যাবধানে তিনটে বইমেলা। রবীন্দ্রমেলা, সরকারী উদ্যোগে গ্রন্থমেলা ও কলকাতা পুস্তক মেলা।............... পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদের সেলস ইনচার্জ অতীন দত্ত জানালেনঃ সরকারী উদ্যোগে এমন কিছু বই প্রকাশ করা হয়েছে যা বাজারে দুষ্প্রাপ্য। যেমন- (১) বাংলা রঙ্গালয়ের ইতিহাসের উপাদান। (২) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী।‘’ স্মরণে রাখার মত বইমেলার গল্প আরও অনেক আছে। তবু উল্লেখ করারমত বিষয়গুলি এই লেখায় থাক। সালটা ১৯৯৪। কানোরিয়া জুট শ্রমিকদের পাঁচ মাস ব্যাপী মরণপণ লড়াই পশ্চিমবাংলার রাজনীতিতে লম্বা এবং দীর্ঘ ছায়া ফেলেছিল। মনে আছে ১৯৯৫ সালের বইমেলায় কানোরিয়া জুট শ্রমিকদের লড়াইয়ের উত্তাপ আমরা পেয়েছি। ‘কানোরিয়া জুট অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রীজ লিমিটেডের সংগ্রামী শ্রমিক ইউনিয়ন’ ‘কানোরিয়া’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এই পুস্তিকার লেখক তালিকায় নাম আছে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। এই মেলায় সে বছর দেখা হয়েছিল ডাঃ দেবাশিষ বক্সি, ডাঃ চন্দনা মিত্র, কুশল দেবনাথ, আলপনাদি, কল্যাণ, শ্যামলীর সঙ্গে। প্রায় ১৩ বছর পর ওদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। এদের সঙ্গে আমি ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত ‘ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিস স্মৃতিরক্ষা কমিটি’তে ছিলাম। সেইদিন কানোরিয়া জুট শ্রমিকদের কল্যাণে ৩০০ টাকা চাঁদা দিয়েছিলামকুশলদা আর আলপনাদির আবেদনে সাড়া দিয়ে  
আজ মাঘ মাসের শ্রী পঞ্চমী। সরস্বতী পুজো। বাসন্তী, হলুদ রঙের শাড়িতে কিশোরীরা সরস্বতী বন্দনায় মাতোয়ারা হবে। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে মাঘ মাসের শ্রী পঞ্চমীর দিনে মা সরস্বতীর সামনে আমার হাতেখড়ি হয়েছিল। আমার অন্নপ্রাশন হয়নি। কিন্তু হাতেখড়ি হয়েছে। হাতেখড়ির আগে বা পরে সরস্বতীমন্ত্র আবৃত্তি করতে হয়েছিল। আমাদের গৃহ পুরোহিত সুনীলদার সঙ্গে।  
নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাংদেহি নমোহস্তুতে।।
জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
তারপর কলেজের প্রথম বছর পর্যন্ত প্রতি বছর সুনীলদার সঙ্গে সরস্বতী পুজোরদিন সরস্বতী মন্ত্র এবং  পুস্পাঞ্জলী মন্ত্র উচ্চারণ করতাম।  =================
ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীনারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমহস্তুতে।।
নমঃভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ।।
এস স-চন্দন পুষ্পবিল্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।
গত চল্লিশ একচল্লিশ বছর এই মন্ত্র আর উচারণ করতে হয়নি। কিন্তু সরস্বতী পুজোর পরের দিন খাগের কলমে বেল পাতায় দুধ গঙ্গা জলের মিশ্রিত কালীতে লিখতাম ‘শ্রী শ্রী দুর্গা সহায় নমঃ, শ্রী শ্রী সরস্বতৈয় নমঃ। এবং প্রসাদ পেতাম দহিকর্মা। পাঁচ বছর বয়সে যে খাগের কলম ধরেছিলাম আজকের শ্রী পঞ্চমীর দিনেও সেই খাগের কলম নিয়েই সারস্বত সাধনায় নিমগ্ন আছি। উত্থান পতন, জেগে থাকা, বেঁচে থাকা সবকিছুর আলো ওই খাগের কলম। বাবা বলতেন, ঞ্জানের  আলো হয় সমৃদ্ধ করবে, না হলে ঝলসে দেবে। ২০১০ সালে আমি ‘প্রাত্যহিক খবর’ নামে একটি প্রথম শ্রেণীর দৈনিকে সাংবাদিকতা করতাম। ২০০১১ সালের বইমেলা সংক্রান্ত সমস্ত খবর করার দায়িত্ব সম্পাদক আমাকে দিয়েছিলেন। ২০১১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আমার ‘বাই লাইন’ খবর প্রকাশ হয়। শিরোনাম ছিল ‘বইমেলায় বামপন্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে তৃণমূল ও কংগ্রেস’খবরের কিছুটা অংশ। ‘’প্রতি বছরের মতো এবছরও বইমেলায় বাম ঘরানার ছড়াছড়ি। এতগুলি স্টলের সঙ্গে ২০১১ সালের বইমেলায় পাল্লা দিয়ে লড়ছে তৃণমূল কংগ্রেসের ‘জাগো বাংলা’র স্টল। জাগো বাংলার বই বলতে মূলত তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বিভিন্ন বিষয়ের ২৩টি বই........................ পাশাপাশি কংগ্রেসের ‘ভারতবার্তা’ স্টলে হইহই করে বিক্রি হচ্ছে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তথা কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘জাতীয় কংগ্রেসের কথা’। এছাড়া পাবনা প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংকলন। বিক্রি হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের বই ‘ফিরে দেখা’ ‘জাতীয় কংগ্রেসের ১২৫ বছর’। স্টলের বাইরের দেওয়ালে বড় ফ্লেক্সের উপর অতীত এবং বর্তমানকে মেলানোর চেষ্টা হয়েছে। .....................তুলনায় বামপন্থীদের স্টল যদি ধরি মূল ধারার ‘গণশক্তি’, এনবিএ, ছাত্রশক্তি, লোকমত ছাড়াও এবছর সংযোজন সিটুর স্টল।‘’
মিলন মেলা। নামের মধ্যেই রয়েছে বাংলার আউল-বাউল সংস্কৃতির আলাপন। ধুলোউড়ির মাঠ। নীল, সাদা, লাল, সবুজ, মেরুন কতনা রঙের বাহারি শৈশব হাসছে। ছদ্ম মুখোশের ভিড়েও ওদের নোট অচল হয় না একুশ শতাব্দীর নিয়নের আলোয় আলোয় হাতে হাত মিলিয়ে আমার আপনার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দাঁড়িয়ে আছে মিলন মেলার প্রাঙ্গণে। তাঁদের কে জিগ্যেস করবে? তুমি কাদের লোক? ২০১১ সালের মাঘ মাসের ওই বইমেলার পর আমি দু’পা ঘরে নিয়ে বসে আছি। খাগের কলম নিয়ে মাঠ ঘাটের চাষাদের জন্য আশায় আশায় বসে আছি। ‘আমার সকল নিয়ে বসে আছি............’                                                                                         


No comments:

Post a Comment