Wednesday 3 October 2018

ওরা মানবতার ছবি করতে চায় লিঙ্গ বৈষম্যের নয়



দীপেন্দু চৌধুরী
অন্যান্যদের কথা বলতে পারব না। নিজের কথা জানি। কলেজে পড়ার সময় সেটা ১৯৭৬-৭৭ সাল, তখন চা গরম জলে দিয়ে কি করে চা বানাতে হয় শিখেছিলাম। হ্যা ওই একই সময় চায়ের পাতা ব্রাউন প্যাকেটে ভরে ১০০গ্রাম, ২০০ গ্রাম, ২৫০ গ্রাম ৫০০ গ্রামের প্যাকেটে করে বিক্রি করতে শিখেছিলাম। বড় বড় দু’টো চটের ব্যাগে চায়ের প্যাকেট ভরে নিতাম। সাইকেলে ব্যাগ দু’টোকে ঝুলিয়ে নিয়ে খুব সকালে চায়ের পাতা বিক্রি করতে শিখেছিলাম। মাঠের রাখাল বালকদের মত। শিখতে হয় না হলে পিছিয়ে পড়তে হয়। আমাদের নিজেদের কথা বলার জন্য কাউকে আমন্ত্রণ জানানো যায়? আমরা জানতে গিয়েছিলাম। নতুন সভ্যতায়, নতুন ভাষায়, মাত্র দেড় থেকে দু’মনিটে একটা ছোট গল্প কি করে বলা যায়? টাটকা টাটকা পান্ডুলিপি অথবা চিত্রনাট্য থেকে জীবনের টুকরো টুকরো অংশ জুড়ে দিলে ‘পথের পাঁচালী’ লেখা হয়। ছোট ছোট গল্প লেখা হতে পারে। ছবি তৈরি হতে পারে।
১৯৫৯ সালের একটি প্রবন্ধে সত্যজিৎ রায় আক্ষেপ করে লিখেছিলেন ‘চলচ্চিত্র শিল্প কিনা তা নিয়ে এখনও বিতর্ক ওঠে।’ (সত্যজিৎ রায়, ‘চলচ্চিত্র-রচনা’ঃ ‘আঙ্গিক ভাষা ও ভঙ্গি’ [‘বিষয় চলচ্চিত্র’, প্রথম সংস্করণ, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৭৬, পৃষ্ঠা- ১৮] সত্যজিৎ রায় প্রশ্নটি তুলছেন ‘ব্যাটলশিপ পোটেমকিন’ (১৯২৫) ছবিটি তৈরি হওয়ার ৩৪ বছর পর। বিশ্ববরেণ্য ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় প্রশ্নটি তোলার আট নয় বছর পরে একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল। ১৯৬৭-৬৮ সালে সেই সমীক্ষা করা হয়েছিল নতুন দিল্লির উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষদের মধ্যে। এই দর্শক সমীক্ষায় প্রতি দশজনের মধ্যে মাত্র তিনজন দর্শক শিল্প হিসেবে চলচ্চিত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ফরাসি বিপ্লবের ঢেউ আছড়ে পড়েছে ভারতে। আমাদের দেশের ছাত্র সমাজ উথাল পাথাল ঢেউয়ে দুলছে। আমাদের এই বাংলায় ছবি করছেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন সহ আরও অনেকে। হারিয়ে যাওয়া নামের চলচ্চিত্র পরিচালক তাঁরা। গত শতাব্দীতেই সিনেমা ‘শিল্প’-এর মর্যাদা পেয়েছে। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা বিভিন্ন দেশের স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালকদের দল আমাদের সামনে কালজয়ী সব চলচ্চিত্র পরিবেশন করেছেন। চলচ্চিত্রকে শিল্পের উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। এবং হলিউডের দেশ আমেরিকার বিভিন্ন বরেণ্য পরিচালক প্রমাণ করেছেন চলচ্চিত্র শিল্পের ডিটেলিং কোন উচ্চতায় পৌঁছতে পারে। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি যে প্রশ্ন সত্যজিৎ তুলেছিলেন বর্তমান শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আজকের সভ্যতা অনেক অনেক এগিয়ে। ওয়েবক্যাম বা ছোট ক্যামেরায় তোলা তথ্যচিত্র, কাহিনিচিত্র অথবা ছবি আমরা গত শতাব্দীতেই পেয়েছি। সভ্যতা আরও কয়েকধাপ এগিয়ে এসেছে। ইন্টারনেট, ইউটিউব, স্মার্টফোন হাতের মুঠোয় এসে যাওয়ায়।
গতমাসে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, কলকাতা ছোট ছোট ছবির একটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিল। মাত্র দেড় ঘণ্টায় পাঁচটা ছবি। এক ঘন্টা মতবিনিময়। ২৮ সেপ্টেম্বর দুপুর দু’টো থেকে পাঁচটা পর্যন্ত আমরা দেখলাম ২৪টা ছবি বা সিনেমা। ভাবা যায়? ‘Ending Gender-Based Violence One Story at a Time’ শিরোনামের এদিনের ঠাসবুনোট চলচ্চিত্র উৎসবের যৌথভাবে আয়োজন করেছিল ইউ এস কনস্যুলেট জেনারেল, কলকাতা, ক্যালিফর্নিয়ার  অলাভজনক ছবি তৈরির একটি সংস্থা এবং কলকাতার বাংলানাটক ডট কম নামে একটি সংস্থা। অনুষ্ঠানের যে ব্রসিয়ার আমাদের হাতে এসেছেGender-Based Violence শিরোনামে লেখা হচ্ছে, ‘’Gender-based violence (GBV) is a general term used to capture violence that occurs as a result of the normative role expectations associated with each gender, along with the unequal power relationships between the two genders within the context of a specific society.
Many countries have incorporated women’s rights and gender equality as a matter of policy, but gender-based violence, targeting women and girls in particular, continues unabated. The violence is perpetrated both at home and in public and has its roots in gender stereotyping, unequal norms and imbalanced power dynamics in societies. Addressing the social and structural causes behind this violence is, therefore, the need of the hour.  
ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল প্রসঙ্গে ‘About the Film Festival’ শিরোনামে  লেখা হয়েছে, ‘’Contact base (www.banglanatak.com) is working in collaboration with the American Center in Kolkata to create a youth network that champions the cause of stopping GBV and changing attitudes and behavior. The main objective of the entire initiative is to empower youth leaders across borders to identify and speak up against gender issues. It is also a part of our effort to strengthen the advocacy skills of next-generation leaders in the Indo-Pacific region.
In April 2018, Contact Base, in partnership with the American Center, Kolkata, and Story Centre, USA, organized a workshop on digital storytelling. The workshop was conducted by Amy Lenita Hill from storyCenter, an organization supporting individuals and groups to use storytelling and participatory media for reflection, education, and social change. Storytelling is traditionally the most attractive and popular format of communication that can sensitize people, build awareness, forge solidarity and shape public opinion about various issues concerning the society and the individual. Digital storytelling is the most potent and popular new age tool for communication.
The 24 participants from India (Assam, JharKhand, Nagaland and West Bengal) and Bangladesh developed short films on ending gender-based violence. Each of the films reflected individual experiences. As a follow-up action after the workshop each of the four zonal teams from Bangladesh, Jharkhand, Northeast and West Bengal made two more films.
ছবিগুলি দেখার পরেও উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে কোনও ক্লান্তি আমাদের নজরে পড়েনি। দু’ই থেকে তিন মিনিট সময়ে তৈরি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে পারিবারিক এবং সামাজিক ছবি আমরা টান টান উত্তেজনায় দেখতে থাকি। ডিজিটাল ক্যামেরায় তোলা ছবিগুলির পরিচালকরা ছবি করার সময় কতটা মনযোগ দিতে চেয়েছেন সেটা বোঝা যায়, ছবি দেখার পরে দর্শকদের সঙ্গে মতবিনিময় সময়ে। প্রত্যেকে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছেন। ছবিগুলি তৈরি সময় প্রত্যেক পরিচালক আলাদা আলাদা করে পাঁচদিন সময় নিয়েছেন। পাঁচদিনে নিজেদের ছবির চিত্রনাট্য তৈরি করেছেন তাঁরা। চিত্রনাট্য লিখেছেন ইংরেজি, হিন্দি এবং অসমিয়া ভাষায়। প্রতিটি ছবির সঙ্গে আছে পরিভাষা বা ইংরেজিতে সাব টাইটেল। সারা বিশ্বের দর্শকদের ছবি দেখার সুবিধার জন্য। কোনও কোনও ছবিতে নেপথ্যে ভয়েস ওভার ব্যবহার করে ছবির গল্প দর্শকদের বোঝাতে চেয়েছেন পরিচালক। বাংলাদেশের পাঁচটা ছবির মধ্যে তিনটে ছবির কথা উল্লেখ করতেই হবে। প্রথমটা পরিচালক মারুফ ওয়ালির ‘ইটস নট ওকে’, দ্বিতীয়টা পরিচালক মুনিফ খানের ‘সিঁদুর’ এবং তৃতীয়টা প্রিয়াঙ্কা বোস পরিচালিত ‘আমি সেই মেয়ে’ (Me Too) বিশেষ নজর কাড়ে প্রিয়াঙ্কার ‘আমি সেই মেয়ে’ ছবিটি। বাংলাদেশের মত আর্থসামাজিক সমাজ কাঠামোয় বর্তমান সময়ে ওই দেশের উচ্চশিক্ষিত মেয়েদের সামজিক জীবনের টানাপড়েনের গল্প বলেছেন প্রিয়াঙ্কা।     ঝাড়খন্ড থেকে চারটে ছবি ছিল। ঝাড়খন্ডের চারটে ছবির মধ্যে পরিচালক শুভজিৎ ঘোষের ছবি ‘দ্য ডে হোয়েন এভরিথিং কেম টু অ্যান এন্ড’। শুভজিৎ দেড়-দু মিনিটে আমাদের ভারতীয় নারীর দু’টো দিক দেখালেন। একদিকে আমরা দেবী দুর্গার কথা বলছি। অন্যদিকে বাড়ির সাধারণ স্ত্রী মেয়েদের উপর অত্যাচার করছি। একটি পরিবারের এক যুবক তাঁর উচ্চ শিক্ষিত কাকার পরিবারের কথা বলছে। স্বচ্ছল পরিবারযুবকটির কাকা তাঁর স্ত্রীর প্রতি কি ধরণের ব্যবহার করছে সেই চির পরিচিত গল্প আমরা আবার দেখলাম। কাকিমার প্রতি অবিচার সেই যুবকটি মেনে নিতে পারেনি প্রতিবাদ করেছিল।
ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চল (অসম এবং নাগাল্যান্ড) থেকে ছিল চারটে ছবি। রেখা শর্মার ‘অপরাজিতা’ ছবিটি আমাদের মনে দাগ কাটে। ভীষণ কাব্যিক ছবি বলতে হবে। কলকাতা থেকে ছিল ন’টি ছবি। কলকাতা থেকে সংযুক্তা সরকারের পরিচালিত ছবিটি এককভাবে প্রথম পুরষ্কার পায়। এই ছবিটির গল্প বাড়ির মেয়েদের পাতে অর্ধেক ডিম দেওয়া হয়। পুরুষরা খায় গোটা একটা ডিম। একটি মেয়ের মামাবাড়ির প্রেক্ষাপটে সংযুক্তার চিত্রনাট্যে দর্শকরা ‘ডিম’- এর গল্প শোনে। সেরা আঞ্চলিক ছবির পুরষ্কার জিতে নেয় ‘পিঙ্ক অ্যান্ড ব্লু’ (Pink & Blue)ছবির গল্প এই রকম, আমাদের সমাজে কম বয়সের ছেলেদের বা বলা ভালো বালক শিশুদের হাতে দেওয়া হয় নীল রঙের বেলুন। আর বালিকা শিশুদের হাতে দেওয়া হয় ‘গোলাপী’ বেলুন। এটাও ভারতীয় সমাজের একটা টানাপড়েন। অন্তরা রায় চৌধুরী, মন্দিরা ব্যানার্জি, অলিভিয়া মণ্ডল, পলক চোখানী, রাহুল গোস্বামী এবং শান্তনু ব্যানার্জি এই ছ’জনের যৌথ চিত্রনাট্য এবং পরিচালনায় নির্মাণ হয়েছে ‘পিঙ্ক অ্যান্ড ব্লু’ ছবিটি।
২৯ সেপ্টেম্বরের ছবিগুলির বিষয় ছিল ১) Domestic violence, 2) Sexual harassment, 3) Discrimination in terms of career choice, 4) Gender stereotyping, 5) Unsafe public spaces
জুড়ি প্যানেলে ছিলেন বলিউডের অভিনেতা এবং পরিচালক বিনয় পাঠক, বাংলা ছবির অভিনেত্রী চূর্ণী গাঙ্গুলী এবং বাংলা ছবির পরিচালক অনিন্দিতা অধিকারী। ছবি শেষে বিজয়ী পরিচালকদের হাতে পুরষ্কার তুলে দেন চলচ্চিত্র পরিচালক সুদেষ্ণা রায় এবং আমেরিকান কনস্যুলেট জেনারেল, কলকাতা প্যাট্রেসিয়া হফম্যান। এদিনের অনুষ্ঠানে প্যাট্রিসিয়া হফম্যান বলেন, ‘’আমি কলকাতার সংস্কৃতির ভক্ত। বাংলার শিক্ষার মান, মনন, সঙ্গীত, সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহকে আমি সম্মান করি। এই বছর বাংলার দুর্গা পুজো দেখার সুযোগ আমার হবে। বাঙ্গালি জীবনের যে উৎসব সব থেকে বড় উৎসবআমি সেই উৎসবে অংশ নেব।‘’
মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেল আরও বলেন, ‘’This is a meeting point of great minds across the borders. The directors are brave agents of change.’’  ছবিগুলি কি সব বিষয় কে ছাপিয়ে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে আক্রমণের ছবি? ভারতীয় উপ মহাদেশের সামাজিক কাঠামোর কিছুটা উন্নতি হলেও মূল্যবোধ কতটা আধুনিক হয়েছে? উচ্চশিক্ষিত, চাকুরে মহিলাদের দ্বারা ভারতীয় পুরুষরা আক্রান্ত নয়? যে বিষয় নিয়ে কিছুদিন আগে ভারতের সুপ্রীম কোর্টে একটি মামলার শুনানী হয়ে গেছে। দর্শক-শ্রোতারা এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। মঞ্চে হাজির ১৩ জন তরুণ পরিচালক বললেন, আমরা পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে ছবি করতে চাইছিনা। আমরা মানবতার পক্ষে ছবি বানাতে চাইছি।
এই প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ ছবির চিত্রনাট্য থেকে কিছুটা অংশ তুলে দিতে চাইছি। মেয়েদের মন নিয়ে সত্যজিৎ ঠিক কি বুঝতেন? তাঁর আবেদন কি ছিল?
অরিন্দমঃ পর পর তিনটি ছবি মার খেলেই কিন্তু আমিও ওজগতে ফিরে যেতে পারি।
অদিতিঃ তা হবে না। নিশ্চয়ই হবে না। আপনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকবেন। অনেকদিন। আপনার বাজার ঠিকই থাকবে।
অরিন্দম মৃদু হাসে।
অদিতির ব্যাগ খোলাই ছিল, সে তাঁর ভিতর থেকে একতাড়া কাগজ বার করে।
অদিতিঃ আপনার ইন্টারভিউ ...
অদিতি কাগজগুলো একসঙ্গে কুন্ডলী পাকিয়ে সামনে রাখা জলের গেলাসের ভিতর গুঁজে দেয়।
অরিন্দমঃ ওকি! আপনি কি মন থেকে লিখবেন নাকি?
অদিতিঃ মনে রেখে দেব। চলি।                                                          

No comments:

Post a Comment