দুই মেরু একদেহে
হল লীনঃ
নুন আনতে পান্তা ফুরোয় যার সংসারে তারও বই পড়তে ইচ্ছে জাগে। মঙ্গলবার (৩০
জানুয়ারি) ৪২তম বই মেলার উদ্বোধনের দিন আমন্ত্রণ ছিল একটি বিদেশি দূতাবাসের
তরফে। ওই দূতাবাসের অনুষ্ঠানের একটু আগে পোঁছে গিয়েছিলাম বই মেলায়। গেটে ঢোকার সময়
নির্ধারিত সমাজ প্রশাসনিক নিয়ম মেনে খানা তল্লাসি হল। আমার পরিচয় দিতেই একজন সিভিক
ভলেন্টিয়ার আমাকে বললেন, ‘আপনার কার্ডটা দেখালেই ঝামেলা মিটে যেত।’ মনে মনে
হাসলাম। পুলিশের এক প্রবীণ অফিসার আমার সামনে এসে বললেন, ‘দীপেন্দুদা ভাল আছেন?
আমি বললাম, হ্যা। আমাকে আর বেশি হ্যাপা পোহাতে হয়নি। কিন্তু আমার পাশে অতি সাধারণ এক যুবকের কাধের ঝোলা
পরীক্ষা করা হচ্ছিল। সেই যুবকের ব্যাগ থেকে বেড়লো একটি গামছা, একটি লুঙ্গি, সাবান,
টুথ পেস্ট, একটি খাতা আর একটি বই। বইটার নাম স্বাধীনতা সংগ্রাম, লেখক বিপান
চন্দ্র।
আমি আর অপেক্ষা না করে মেলা প্রাঞ্জনে ঢুকে এলাম। কাঠ, প্লাই বোর্ডের
মিস্ত্রিদের দল ‘কাটুম কুটুম’ শিল্পের কাজ করছে। নামজাদা শহরে নামহীন শ্রমীকের দল,
রঙ মিস্ত্রিরা প্রাইমার রঙ, ডিসটেম্পার দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষার ভিত রচনা করছে। বহু
বর্ণের ‘আঁকিবুঁকি’। ভারতের তথা বাংলার বৈচিত্রের অন্যতম মুখ বাংলার মুখ। গড়ে উঠছে
কলকাতা বইমেলা। ৪২তম কলকাতা বইমেলার ঘর সংসার নিয়ে বাস্তু উদবাস্তুদের দল তখন
ব্যস্ত। মেলা প্রাঞ্জনে পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। মুখ্যমন্ত্রী আসবেন। আমি উদবোধনী অনুষ্ঠান
মঞ্চে পৌঁছে গেলাম। এক সময় নিজের খুব গর্ব হচ্ছিল। আমি তখন বাংলার অন্যতম
ব্যক্তিত্ব চলচ্চিত্র অভিনেতা, সত্যজিৎ রায়ের ‘অপু’র পাশে দাঁড়িয়ে। সৌমিত্রদার বার
কয়েক সাক্ষাৎকার নিয়েছি। প্রেস ক্লাবের ‘মুখোমুখি সৌমিত্র’ অনুস্থানেও অনেক রাত
পর্যন্ত ছিলাম। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আজ ভীষণ উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। মধ্য আশির একজন
যুবক মনে হচ্ছিল। সত্যি সত্যি তাঁকে ‘ফেলুদা’ নয় মাধবী, সাবিত্রী, শর্মীলা, অপর্ণা
এবং সুচিত্রা সেনের নায়ক মনে হচ্ছিল। আমার সামনে তখন বিখ্যাত ফরাসিবিদ অধ্যপক
চিন্ময় গুহ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরাপত্তা বলয়ের এক মহিলা অফিসার
আমাকে এসে অনুরোধ করলেন, আপনি একটি জায়গায় বসে যান। সামনে ভিআইপিদের আসনে আমাকে
বসার জন্য আরও একজন নিরাপত্তা অফিসার অনুরোধ করলেন। আমি উত্তর না দিয়ে পিছনের
সংবাদ মাধ্যমের লোকেদের জন্য বসার যে জায়গা ছিল সেখানে বসে পড়লাম। কেউ আপত্তি করল
না। হুতোম থাকলে বলত। ওলি বার বার ফিরে আসে। ফিরে এসো ফিরে এসো। ওলি বার বার ফিরে যায়।
অনুষ্ঠান শুরু হল। প্রথমেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে উত্তরীয় নয় উপহার দিয়ে
বরণ করে নেওয়া হল। পরে এক একজন করে সকলকে উত্তরীয় দিয়ে বরণ করে নেওয়ার পালা। সঞ্চালক বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় এক সময় বললেন, স্বাস্থ্য ও কারিগরী দপ্তরের
মন্ত্রী সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়কে উত্তরীয় পড়িয়ে বরণ করে নেবেন......। সুব্রতবাবু হাসলেন। মঞ্চে তাঁর সহকর্মীরাও ভুল
শুনেছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে যে
উত্তরীয় এবং উপহার দেওয়া হল তিনি উত্তরীয়টা সুধাংশু শেখর দের গলায় পড়িয়ে দিলেন।
উপহার সামগ্রীর ব্যগটা ত্রিদিব চট্টপাধ্যায়ের হাতে তুলে দিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের ভাষায় ‘বাংলার
আপন জন’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ৪২ বার হাতুড়ি পিটিয়ে মেলার উদ্বোধন করলেন। বাংলায়
আজ ‘সব পথ এসে মিলে গেল শেষে’। দুই মেরু একদেহে হল লীন। মঞ্চে তখন একঝাঁক রাজ্যের মন্ত্রী আমলা। এবং অতিথি
দেশের কবি সাহিত্যিকরা। বসে আছেন দিল্লিতে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত
আলেকজান্দর জিগলার।
ফরাসি রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘বাংলাকে একদা ভারতের ফ্রান্স বলা হত। মুক্ত
চিন্তা করার জন্য’। আমার আগের লেখায় উল্লেখ ছিল, ভারতীয় ভাষায় সেরা অনুবাদের জন্য
এ বছর থেকে রোমাঁ রোল্যা পুরষ্কার চালু করেছে ফ্রান্স। এ বছর সেই পুরষ্কার যাচ্ছে
হিন্দি ভাষার অনুবাদকের হাতে। ফরাসি রাষ্ট্রদূত এই প্রসঙ্গে বলেন, ‘’আমি আশা করব
বাংলার কোনও অনুবাদক পরের বারই এই পুরষ্কার পাবেন।‘’
রাজ্যের
মুখ্যমন্ত্রী বাংলার আতিথেয়তা জানেন। তাঁর ভাষায় তিনি বললেন, ‘’ফ্রান্স বিশ্বের
সাংস্কৃতিক রাজ্য
আর কলকাতা ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী।‘’ এদিন
বুকসেলার্স অ্যান্ড গিল্ডের কর্তা ত্রিদিবকুমা চট্টোপাধ্যায়ের কথায়
জানা গেল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বইয়ের সংখ্যা এখন ৮০ থেকে ৮৫টি মত। এ বছরের ৪২তম
বই মেলায় নিজের কবিতার অনুবাদের কথা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী নিজে। হিন্দি ও
সাঁওতালিতে তাঁর বইয়ের অনুবাদের কথা শোনালেন তিনি। মূল অডিটোরিয়ামে শেষ পর্যন্ত
থাকতে পারিনি। এক দূতাবাসের আমন্ত্রণে সাত
বছর পর কলকাতা বই মেলার হাতুড়ির আওয়াজ শুনতে গিয়েছিলাম। বুকের ভেতর তোলপাড় করছিল।
এই বইমেলার কত স্মৃতি। আগ্যন পাখির গল্প। সেই দূতাবাসের অনুষ্ঠান শেষে বেড়িয়ে এসে কিছুটা
আঁকা বাঁকা পথে ঠুক ঠাক অক্ষর পুরুষদের কাজ দেখতে পেলাম। আপাদ মস্তক ছিম ছাম এবং ছন্ন
ছাড়া মানুষের ভিড়ে দেখলাম বিধাননগর করুণাময়ীর ২ নম্বর গেটে যে যুবকটিকে দেখেছিলাম
সে একটি বুকস্টলের প্লাইউড লাগাচ্ছে। হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠুকছে। কৌতূহল সামলাতে পারলাম না। এগিয়ে গিয়ে বললাম,
‘আপনি এই কাজের জন্য এসেছেন?’ একটুও লজ্জা না পেয়ে আমাকে বলল, ‘আপনি আমাকে চিনতে
পেরেছেন? আমি সস্তার বারমুডা পড়ে কাজ করছি। তাও চিনে ফেললেন?’
উত্তর
দিতে খারপ লাগছিল তবু বললাম, ‘’আপনার ব্যাগ থেকে একটা বই পড়ে গিয়েছিল। বইটা ছিল
বিপিন চন্দ্রের লেখা স্বাধীনতা সংগ্রাম।‘’
‘’হ্যা
বই পড়তে ভালো লাগে। বিশেষত ইতিহাসের বই। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের বই। আমি ক্লাস
ইলেভেন পর্যন্ত পড়ে এই কাজ করছি। কিছু একটা কাজ করতে হবেতো। বাড়িতে টাকা দিতে হয়।
নিজের পেট চালাতে হয়। আমার এক আর্টিস্ট বন্ধু আছে ওর সঙ্গে থাকি। ও কাজের ব্যবস্থা
করে। বলতে খারাপ লাগছে। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় যার সংসারে তারও বই পড়তে ইচ্ছে
জাগে।‘’
আমি
আর কথা না বলে বাড়ি ফেরার বাসে বসে ডাইরি খুলে রবি ঠাকুরের উদ্ধৃতি পড়ে নিলাম।
‘’বঙ্কিম আনলেন সাত সমুদ্র পারের রাজপুত্রকে। আমাদের সাহিত্য রাজকন্যার পালঙ্কের
শিয়রে। ......যারা মনুষত্বের চেয়ে কৌলীন্যকে বড়ো করে মানে তাঁরা বলবে ঐ রাজপুত্রটা
যে বিদেশী। তাঁরা এখনও বলে, এ সমস্তই ভুয়ো, বস্তুতন্ত্র যদি কিছু থাকে তো সে ঐ
কবিকঙ্কন চন্ডি, কেননা এ আমাদের খাটি মাল। তাদের কথাই যদি সত্য হয় তাহলে এ কথা
বলতেই হবে, নিছক খাঁটি বস্তুতন্ত্রকে মানুষ পছন্দ করে না। মানুষ তাকেই চায় যা
বস্তু হয়ে বাস্তু গেড়ে বসে না। যা তার প্রাণের সঙ্গে চলে, যা তাকে মুক্তির স্বাদ
দেয়।‘’
No comments:
Post a Comment