গণতন্ত্রের শহরে নামহীন শ্রমিক:
মাত্র বছর খানেক আগের কথা। আমার এক বন্ধুর সাইবার কাফেতে একজন খেটে খাওয়া
দিন মজুর মানুষ এসে বলল, ‘’বাবু আমার আধার কার্ড আবার করে দেওয়া যাবে?’’ বন্ধুটি
জানতে চেয়েছিল, ‘’কেন তুমি এক বছর আগে যে আধার কার্ড করলে? সেটার কি হল?’’
‘’আঞ্জে বাবু ব্যাঙ্কে বলছে আমার হাতের রেখা, আঙ্গুলের রেখা কিছু বোঝা
যাচ্ছে না। আমি বলেছিলাম আমি বড় বাজারে মুটে মজদুরির কাজ করি। ঠেলা টানি। তাই
হাতের রেখা ঘষা খেয়ে খেয়ে উঠে গেছে।‘’
এই কাহিনী বা গল্পটা পুরনো। একই ধরণের তথ্য নির্ভর খবর বাংলা, ইংরেজি সহ
একাধিক খবরের কাগজে প্রকাশ হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এই অভিঞ্জতার খবর আমরা
সংবাদ মাধ্যমের সুবাদে পাচ্ছি। আমার বন্ধুর কাছে শোনা খবরটি যে কতটা গুরুত্ব আছে
সেটা আমি নিজেও আমার পরিবার নিয়ে উপলব্ধি করেছি। কারণ আমার নিজের এবং আমার স্ত্রীর
১৯ বছর কোনও পরিচয় পত্র ছিল না। স্থায়ী ঠিকানাও ছিল না। আর্থ -রাজনৈতিক কারণে
আমাদের মতো মধ্যমেধার ‘ভারতীয় নাগরিক’-দের সঙ্গে অবাধে এবং অবলিলায় একদল
ক্ষমতাধারি লোকজন ‘ব্ল্যাকমেল’ করে গেছে। ওইসব তথাকথিত শিক্ষিত ধূর্ত গণতান্ত্রিক
দেশের জনপ্রতিনিধির দল যদি আমাদের সঙ্গে এই ধরণের আচরণ করতে পারে, তাহলে খেটে
খাওয়া মজদুর, শ্রমিকেরা কোথায় যাবে?
সম্প্রতি স্থায়ী ঠিকানা তথা ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে একটি স্বল্প দৈর্ঘের
কাহিনী চিত্র দেখার সুযোগ হল। কমল কে এম পরিচালিত ছবিটির নাম ‘আই ডি’। ছবিটির গল্প
শুরু হচ্ছে মুম্বাইয়ের অভিজাত আন্ধেরী এলাকার একটি বহুতল বাড়ির ফ্ল্যাট থেকে। সেই
ফ্ল্যাটে একজন উচ্চ শিক্ষিত মহিলা মাস দুয়েক হল এসেছেন। তাঁর নাম চারু। চারুর বয়স
হবে আনুমানিক তিরিশ বছরের মধ্যে। কম বেশিও হতে পারে। চারুর জন্মদিন আছে। তাই
ফ্ল্যাটের একটি ঘরের দেওয়ালে নতুন করে রঙ করতে হবে। চারুর এক বান্ধবীর পরিচয় দিয়ে একজন
রঙের মজদুর আসে। এবং চারুর সঙ্গে কথা বলে শ্রমিকটি রঙের কাজ শুরু করে। ঘরের ভেতর
পরিচালকের ক্যামেরা দর্শকদের হাত ধরে নিয়ে যায়। একজন আধুনিক মেয়ে একা থাকলেও কতটা
সাহসী হতে পারে, সেটা আমরা বুঝতে পারি। চারু নিজের খাবার নিজেই তৈরি করে। ঘন ঘন ফোন
আসছে। অথবা চারু নিজে ফোন করছে। সকালের কফি অথবা চায়ের সঙ্গে নিজের তৈরি বার্গার
খেতে খেতে রঙ মিস্ত্রির কাজ তদারকি করতে থাকে সে।
এক সময় রঙ মিস্ত্রিটা চারুর কাছে জল খেতে চায়। রঙ মিস্ত্রির চরিত্রে যে
অভিনয় করেছে তাঁর নাম আমার জানা হয়নি। ছবিতেও চরিত্রটির কোনও নাম ছিল না। কিন্তু
বলতেই হবে একজন কম বয়সী শ্রমীকের চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছে সে। কখনো কখনো তাঁর
নির্লিপ্ত চাহনি চারুকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল। আমাদের মতো দর্শদেরও মনে হয়েছে রঙ
মিস্ত্রিটির কোনও কুমতলব আছে। কিন্তু ছবি মোড় নিল ব্যতিক্রমী একটি ঘটনায়। মিস্ত্রিটি
জল খাওয়ার সময় চারু আবার নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ফিরে এসে সে মিস্ত্রিটিকে
দেখতে পায় না। উদ্বেগের সঙ্গে ঘরে খুঁজতে থাকে। এ ঘর সে ঘর করে পরে মিস্ত্রিটির
খোঁজ পাওয়া যায়। চারু দেখে রঙ মিস্ত্রিটা একটি সোফার আড়ালে অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে
আছে। ছেলেটির ওই অবস্থা দেখে চারু পাশের ফ্ল্যাটের একজন বয়স্ক মহিলাকে ডেকে আনে।
তারপর আবাসনের নিরাপত্তা কর্মীর মাধ্যমে মিস্ত্রিটিকে একটি নারসিং হোমে নিয়ে যায়। আবাসনে নতুন আসা একজন কম বয়সী মহিলা। রঙ মিস্ত্রিটির প্রাথমিক চিকিৎসার খরচ দিতে
হয় চারুকে। পরে ছেলেটি মারা যায়। চিকিৎসার সমস্ত খরচ বহন করতে হয় চারুকে। কারণ
পরিচয়হীন শ্রমিকটি। তাঁর কোনও ঠিকানা চারুর কাছে ছিল না। চারু বিভিন্ন জায়গা
ঢুঁরেও খুঁজে পায়নি। স্থায়ী ঠিকানাও খুঁজে পায়নি। অস্থায়ী ঠিকানাও খুঁজে পায়নি।
পরিযায়ী শ্রমিকের ঠিকানার খোঁজ কে দেবে? অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের এই সমস্যা
ভারতের সমস্ত ছোট বড় শহরের। গল্পের এক পৃষ্ঠা যদি হয় সামাজিক টানাপড়েন, দ্বিতীয়
পৃষ্ঠা আইনি ঝামেলা এবং শেষ পৃষ্ঠা হচ্ছে নামহীন একজন শ্রমিকের ঠিকানা খুঁজে
ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসতে হয় সমাজ সচেতন বাণিজ্য নগরীর উচ্চ শিক্ষিত এক নারীকে। সে
ফিরে আসে নাগরিক ভিড়ে। পুরুষের ইঙ্গিতবহ চাহনির পরিভাষায়।
৮৩ মিনিটের ছবির প্রায় সত্তর মিনিট চারু খুঁজে ফেরে নামহীন
শ্রমিকটির ঠিকানা। স্থায়ী অথবা অস্থায়ী ঠিকানা এবং তাঁর নাম। নিজের স্মার্টফোনে লাশকাটা
ঘরে মৃত শ্রমিকের মুখের যে ছবি তুলে রেখেছিল কম বয়সী ঝা চক চকে বুদ্ধিমতি চারু।
তাঁর সেই মোবাইলটি ঝুপড়ির একটি কম বয়সী ছেলে ছিনতাই করে পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু
চারু তাঁকে তাড়া করে একসময় ধরেও ফেলে। ছিনতাইবাজ কিশোর ছেলেটির অসতর্কতায় মোবাইল
ফোনটি ময়লা জলের খালে পড়ে যায়। এবং আস্তে আস্তে ফোনটি মুম্বাইয়ের তথা ভারতের কালো
জলের এবং কালো পানির স্রোতে ডুবে যায়। চারুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন গীতাঞ্জলী থাপা।
অসাধারণ অভিনয়। পরিচালক কমল আমাদের বলতে বাধ্য করে ‘ভারতে নামহীন’ শ্রমিক এখনও কত
অগুন্তি রয়েছে।
লেখাটি এখানে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তাঁর আগে আরও একটি স্বল্প দৈর্ঘের
ছবি আমরা দেখেছি। ছবিটির নাম ‘দিজ অর দ্যাট পার্টিকুলার পার্সন’। পরিচালক সুবারসী কৃষ্ণান।
আধার কার্ডকে বিষয় করে ছবি। দু’টি ছবিকে পরপর রাখলে আমাদের দেশে আধার কার্ড নিয়ে যে সব
বিতর্ক উঠে আসছে সেগুলি বুঝতে অনেকটা সহজ হয়। পরিচয়পত্র থাকলেও যে আমার ব্যগতিগত
তথ্যের গোপনীয়তা সুরক্ষিত আছে, সেই বিষয়টা অবশ্যই আমাদের ভাবাচ্ছে। আদৌ কি তথ্য
সুরক্ষিত থাকছে? আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে
একাধিকবার মুখ খুলেছেন। কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকার ‘আধার কার্ড’-এর প্রস্তাবক
হলেও বর্তমান সরকারের ভূমিকা নিয়ে একাধিকবার বিভিন্ন প্রশ্ন তুলেছে। দলের বর্তমান
সভাপতি রাহুল গাঁধি নিজেও আধার কার্ড নিয়ে গঠনমূলক আলোচনার দাবি জানিয়েছে। মিড ডে
মিল খেতে গেলেও মাত্র ৬ বছরের শিশুদের আধার কার্ড আবশ্যিক করেছে বর্তমান
সরকার।
সেদিনের দু’টি সিনেমার মাঝের সময়ে
ছিল মানবাধিকার কর্মী রঞ্জিত সুরের সঙ্গে কথা বলা। অথবা রঞ্জিত সুর আধার কার্ড এবং
আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা বিষয়ে বললেন। তিনি বিভিন্ন উদাহারণ দিয়ে আমাদের
সামনে এনে ফেললেন কিভাবে ভারতে একজন ব্যক্তির একান্ত গোপন তথ্য সরকার এবং কর্পোরেট
সংস্থার হাতে চালান হয়ে যাচ্ছে। রঞ্জিতবাবু আরও উল্লেখ করলেন, সম্প্রতি আধার কার্ড
আইনে একটি সংযোজন হয়েছে। সেই সংযোজনের পরে আধার কতৃপক্ষ সহ কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও
মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, ভিভিআইপি, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রভৃতিদের জন্য ব্যাঙ্ক
বা অন্যান্য সরকারি বেসরকারি সংস্থায় আধার কার্ডের নম্বর নথিভুক্তি করতে হবে না।
সূত্র মারফৎ আমাদের হাতে যে তথ্য এসেছে, ‘’139 A A (I) Every person who
is eligible to obtain Aadhaar number shall, on or after the 1st day
of July, 2017, quote Aadhaar number— (i) in the application from for allotment
of permanent account number.
(ii)
In the return of income
Provided
that where the person does not possess the Aadhaar Number, the Enrolment ID
Aadhaar application form issued of him at the time of enrolment shall be quoted
in the application for permanent account number or, as the case may be, in the
return of income furnished by him.
(2)
Every person who has been allotted permanent account number as on the 1st
day of July, 2017, and who is eligible to obtain Aadhaar number, shall intimate
his Aadhaar number to such authority in such form and manner as may be
prescribed, on or before a date to be notified by the Central Government in the
Official Gazette.
Provided
that in case of failure to intimate the Aadhaar number, the permanent account
number allotted to the person shall be deemed to be invalid and the other
provisions of this Act shall apply, as if the person had not applied for
allotment of permanent account number.
(3)
** The provisions of this section shall not apply to such person or Class or
Classes of persons or any state or part of any state, as may be notified by the
Central Government in this behalf in the Official Gazette.
Explanation—
For the purpose of this section, the expressions—
‘’Aadhaar Number’’,
‘’Enrolment’’ and ‘’Resident’’ shall have the same meanings respectively
assigned to them in Clauses (a), (m) and (v) of section 2 of the Aadhaar
(Targeted Delivery of Financial and other Subsidies, Benefits and Services)
Act, 2016.
আধার কার্ডকে কেন্দ্র করে নাগরিক জীবনের ব্যক্তিগত পরিসর নিয়ে আমরা শহুরে
নাগরিকরা চিন্তিত। কিন্তু নামগোত্রহীন ভারতীয় নাগরিক তাঁরা কি করবে? বিতর্ক কতদূর পৌঁছেছিল? ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ধোনির প্রসঙ্গ তুলে
বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় উদ্বেগ প্রকাশ করে একসময় মন্তব্য করেছিলেন ‘’সরকার
যদিও বারবার বলছে, আধারের সঙ্গে জড়িত সব গোপন তথ্য সুরক্ষিত থাকবে, তবুও আমরা ভারতীয়
ক্রীকেট দলের অধিনায়কের আধার সংক্রান্ত সব তথ্য ফাঁস হয়ে যেতে দেখেছি।‘’
একজন ব্যক্তি যদি এককভাবে থাকে সে ক্ষেত্রে সমাজ
পরিবারের যেমন অসুবিধা আছে আবার একজন ব্যক্তি নাগরিকের যদি পরিচয় পত্র না থাকে
তাহলে ধরে নিতে হবে ভারতের সেই নাগরিকের কোনও সমাজ নেই। কোনও পরিবার নেই। প্রাক্তন
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধি বলেছিলেন, ‘’The Citizenship of India is a
shared citizenship, Danger to even one single Citizen, to whatever Community,
Caste, religion and Linguistic group he may belongs is a danger all of us and
what is worse, it demeans us all.’’
এই লেখায়
চারদিন ধরে প্রদর্শনী মূল্য না নিয়ে যারা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন তাঁদের
সপ্রশংস ধন্যবাদ জানাতে হয়। আয়োজক সংস্থা ‘পিপলস ফিল্ম কালেক্টিভ’ ১৮ থেকে ২১
জানুয়ারি স্বল্প দৈর্ঘের ছবি, তথ্য চিত্র এবং কাহিনী চিত্র মিলিয়ে প্রায় ২৮ টি ছবি
আমাদের দেখিয়েছে। দক্ষিণ কলকাতার যোগেশ মাইম অ্যাকাডেমি সভাঘরে এই প্রদর্শনীর
আয়োজন করা হয়েছিল। অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সৃষ্টিশীল একঝাঁক চলচ্চিত্র
নির্মাতার ছবি বাণিজ্যিক স্বার্থ ছাড়া আমাদের সামনে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁরা। আশা রাখি
আগামী বছর গুলোতেও উদ্যোক্তা সংস্থা কলকাতার মত গণতান্ত্রিক শহরে নামহীন শ্রমিকের
মত আরও ছবি আমাদের সামনে আনবে।
No comments:
Post a Comment