করব লড়ব পড়বরে:
স্লোগানটা খুব চেনা চেনা লাগছে? তাইনা? কিন্তু না এটা কোনও ফুটবল দলের
স্লোগান নয়। আমি যখন আমন্ত্রণ পত্রে এই স্লোগান দেখি তখন ঠিক বিশ্বাস করতে
পারছিলাম না। জাতীয় যুব দিবস পালনের জন্য কোনও একটি সংস্থা এতটা শক্তিশালী স্লোগান
বেছে নিতে পারে। এই স্লোগানের জোড় বুঝতে পারলাম। শুক্রবার সাত সকালে প্রায় ৬০০
স্কুলের ছাত্র ছাত্রীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে। অনুস্থানটা ছিল ‘জাতীয় যুব দিবস’। ১২
জানুয়ারী স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিন। কলকাতা সহ সমস্ত রাজ্যে পৃথক পৃথকভাবে
জাতীয় দিবস পালন হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস সরকারি দল হিসাবে আলাদাভাবে বর্ণাঢ
শোভাযাত্রা সহ স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৬তম জন্ম জয়ন্তি পালন করেছে। বিজেপি সারা
রাজ্যে নিজেদের দলীয় ঘরানার মানদন্ডে শোভাযাত্রাসহ ‘জাতীয় যুব দিবস’ পালন করেছে।
কিন্তু শুক্রবারে আমি যে অনুষ্ঠান থেকে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম সেটা ছিল কিছুটা
ব্যতিক্রমী। স্বামী বিবেকানন্দ আহ্বান করেছিলেন তরুণ প্রজন্মকে। তার উদাত্ত কণ্ঠে
তিনি বলেছিলেন জাতীর দায়িত্ব নিতে পারে একমাত্র যুব সমাজ। সেই উজ্জ্বল প্রমাণ
পেলাম শীতের সকালে কুয়াশাচ্ছন্ন নীল আকাশের নীচে। ঝা চক চকে কলকাতার শান্ত শহরের
বড় রাস্তার মিঠে রোদ্দুরে ভিজতে ভিজতে। অনুষ্ঠান আয়োজ করেছিল ‘লাইনস ক্লাব অব
ডিস্ট্রিক্ট ৩২২ বি ২। লাইন্স ক্লাব রবীন্দ্র সরোবর সহ ২৭টা ক্লাব যৌথভাবে এই
অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। অনুষ্ঠানের ইংরেজি শ্লোগান ছিল
‘ওয়াক ফর এডুকেশন’। এবং ‘এ স্টেপ
টুওয়ার্ডস এডুকেটেড টুমরো।’ শিক্ষার জন্য পদযাত্রা। স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে।
কাকভোরে বেরিয়ে সকাল সাড়ে সাতটায় মিন্টোপার্কে পৌছেছিলাম। লাইন্স ক্লাবের
আভিজাত্যের আতিথিয়তায় শরত বসুর রোডের মানুষ সকালের শীতবস্ত্র গায়ে চড়িয়ে পদযাত্রার
ওম নিতে নেমে এসেছে। এতটাই বর্ণাঢ ছিল সেদিনের বিবেকানন্দের জন্ম জয়ন্তি সমারোহ।
লাইন্স ক্লাবের লোগো মুদ্রিত হলুদ টি সার্ট এবং হলুদ টুপি পড়ে সোনালী রোদের সঙ্গে
সোনালী শিশু, য়ুবক যুবতি, পৌঢ় পৌঢ়া
একাকার। প্রায় এক হাজার সোনালি মানুষ সোনালি আদর্শ, মানে শিক্ষার জন্য
রাস্তায় স্লোগান দিতে দিতে হাঁটছে। ‘করব লড়ব পড়বরে’। মিন্টো পার্ক থেকে পদযাত্রা রওয়ানা দিয়ে শেষ হল
দেশপ্রিয় পার্কের চিলডেন্স পার্কে।
এর পরেও চমক অপেক্ষা করছিল। লাইন্স ক্লাবের
উদ্যোগে গড়ে তোলা চিলড্রেন্স পার্কে শিশুদের খেলার জন্য যেমন ব্যবস্থা রয়েছে।
পাশাপাশি রয়েছে সুসজ্জিত সভাঘর। সকাল তখন সাড়ে দশটা। সোনালি শিশুদের কোনও ক্লান্তি
নেই। ওরা সবুজ মাঠে সোনালি সকালে সোনালি টি সার্ট পড়ে আগামীকে আহ্বান করছে।
নিজেদের স্বতঃস্ফূর্ত বিবেক চেতনায়। ওরা শিক্ষার আলো পেয়েছে। ওরা জগতের অচেনার
আনন্দকে খুঁজতে বেড়িয়েছে। নীল আকাশের নীচে সোনালি রোদে পাখিদের আলিঙ্গন বলে দিচ্ছে শিক্ষার কোনও জাত
হয় না। শিক্ষার কোনও ধর্ম হয় না। কিন্তু ওই দিনের জন্য চমক অপেক্ষা করছিল আরও।
সকালের জলযোগের পরে ছিল সেমিনার। একদল নবযৌবনা উচ্চ শিক্ষিত তরুণ তরুণী তখন ব্যস্ত
লাইন্স ক্লাবের সভাঘরে ‘সেমিনার’-এর আয়োজন নিয়ে। এদিনের পুরো অনুষ্ঠানের দায়িত্ব
ছিল সহেলি চক্রবর্তী নামে একজন সদাহাস্য উচ্চ শিক্ষিত এবং বনেদী কলকাতার তরুণীর।
রাস্তায় হাঁটার সময় আমার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। সেমিনার শুরু হওয়ার আগে সভাঘরে
সকৌতুকে ওদের কর্মব্যস্ততা দেখছিলাম। সহেলি একসময় ওর টিমের সদস্যদের বলল, ‘এখন
থেকে মোবাইল সবাই ‘সাইলেন্ট’ মুডে রাখবে। ফোন করে বলবে না, ‘মাম্মি আজ এই মুভিটা
দেখলাম।’ সহেলির কাছ থেকে ইভেন্ট ম্যনেজমেন্টের প্রশিক্ষণ নেওয়া যায়। অনুষ্ঠান
শুরু হল একটি জনপ্রিয় হিন্দি গানের সঙ্গে তিনজন তরুণ নৃত্য শিল্পীর অনবদ্য আবেদন
দিয়ে। এরপর সহেলি তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে আমাদের মনে করিয়ে দিলেন, ‘’আমরা মানুষ,
আমাদের প্রত্যেককে প্রত্যেকের প্রতি সম্মান জানানো উচিত। পরস্পরের প্রতি পরস্পরের
সম্মান জানানো উচিত। এটাই প্রকৃত শিক্ষার মর্যাদা এনে দেয়। ‘দিজ ইজ কল ফর দ্য
ইয়ুথ, বাই দ্য ইয়ুথ অ্যান্ড অব দ্য ইয়ুথ’।‘’ জাতীয় যুব দিবসের যুবদের আহ্বান।
বক্তা ছিলেন ডাঃ ফুয়াদ হালিম। তিনি বলেন, ‘’মানব
সভ্যতার ক্ষেত্রে বিবেকানন্দের চিন্তার ব্যপক প্রভাব আছে। প্রত্যেক ধর্মের রিচুয়াল
আছে। আত্মত্যাগ আছে। দর্শন আছে। ভৌগলিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সব ধর্মের প্রয়োজন
আছে। সিভিল সোসাইটিকে এই দায়িত্ব নেওয়ার কথা স্বামী বিবেকানন্দ বলে গেছেন
সামাজিকীকরণের জন্য।‘’ বক্তা ছিলেন উৎপল চ্যাটার্জী। লাইন্স ক্লাব আন্দোলনের
প্রবীণ সদস্য। উচ্চ শিক্ষিত। সর্বজন শ্রদ্ধেহ। তিনি প্রথমেই উল্লেখ করেন সমাজকর্মী
এবং খ্যাতনামা নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়ের নাম। উৎপলবাবু বলেন, ‘’অলকানন্দা যে কাজ করছেন সেটাই স্বামী
বিবেকানন্দ আমাদের করার জন্য আহ্বান করেছেন। অন্ধকার থেকে মানুষকে আলোয় নিয়ে আসার
কাজ অলকানন্দা করছেন। সংশোধনাগারের বন্দিদের তিনি আলোয় নিয়ে এসে প্রমাণ করেছেন। মানুষের পাশে কি ভাবে আমরা দাঁড়াতে পারি।‘’
বক্তা ছিলেন সায়রা শাহ হালিম। তিনি বলেন, ‘’অলকাদি
অনুপ্রেরণা দেওয়া নারী। কেন স্বামী বিবেকানন্দ? কেন অন্য কেউ নয়? এই দেশে ১৫-২০
বছর আগে যুব সম্প্রদায়ের ট্রেন্ড ছিল আমেরিকা যাব। উচ্চ শিক্ষিত হয়ে ডলার উপার্জন
করে দেশে ফিরব। শিক্ষা আমাদের কতটা উচ্চতা এনে দিতে পারে এটাই একটা উদাহারণ।
স্বামী বিবেকানন্দ কখনও একজন ব্যক্তির সত্তায় বিশ্বাস করতেন না। শিক্ষা কোনও
বক্তৃতা নয়। শিশুকে শিক্ষায় আনতে হবে। ‘এ চাইল্ড ইজ দ্য ফাদার অব দ্য ম্যান’।
স্বামী বিবেকানন্দ এটাই বলেছেন। সামাজিক পরিবর্তনের অন্যতম হাতিয়ার শিক্ষা।‘’
অলকানন্দা রায় বলেন, ‘’আমি শিশুদের কথা বলব। আমি
শিশুদের জন্য গর্বিত। ওরা কি করতে পারে না? আমি গর্বিত আমাদের রাজ্যের
সংশোধনাগারের বন্দিদের জন্য। জেলের আসামীদের শিশুদের কথা ভাবতে হবে আমাদের। ওদের
শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের যুবকরা আমাদের ভবিষ্যৎ। ওরাই পারে এই দায়িত্ব
নিতে। শিশুকন্যাদের জন্য আমাদের বিশেষ করে ভাবেত হবে। সমস্ত স্তরের শিশু কন্যাদের
সমাজের মূল ধারায় আনাটাই আমাদের কাজ। এটাই প্রকৃত শিক্ষা। যে শিক্ষার কথা স্বামী
বিবেকানন্দ আমাদের বলে গেছেন। আরও একটা কথা সমাজে এখনও ‘বন্ডেড লেবার’ আছে। তার চেহারা
হয়ত বদলেছে। তবে আছে। আমি এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এই ব্যবস্থার অবসান তখনই সম্ভব।
যখন আমরা দেশের একশো শতাংশ মানুষকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারব।‘’
লাইন্স ক্লাবের এই অনুষ্ঠানের পরে আমার বিকেলে আরও
একটা আমন্ত্রণ ছিল। সাংবাদিক হিসাবে। প্রদেশ কংগ্রেসের সংখ্যালঘু শাখার উদ্যোগে
ছিল অন্য একটি পদযাত্রা। ‘সম্প্রীতি পদযাত্রা’। হাজী মহম্মদ মহসীন স্কোয়ার থেকে। কংগ্রেসের সংখ্যালঘু শাখার নব নির্বাচিত সভাপতি
মিল্টন রশিদ। আমাদের জেলা বীরভূমের হাঁসন কেন্দ্রের বিধায়ক। আমার পূর্ব পরিচিত। তাই তার আমন্ত্রণে খবরের জন্য গিয়েছিলাম। স্থানীয় পুরনো কংগ্রেসী পরিবারের
লোকেদের আক্ষেপ, কংগ্রেস অফিসটা যতদিন হাজী মহম্মদ মহসীন স্কোয়ারে ছিল আমরা আমাদের
অভিযোগ, আবেদন নিয়ে চট জলদি যেতে পারতাম। এদিনের কংগ্রেসের ‘সম্প্রীতি যাত্রায়’
ভিড় ছিল নজর কাড়ার মতো। কংগ্রেস এদিনের স্লোগান বেছে নিয়েছিল বিবেকানন্দের উধৃতি থেকে।
বিবেকানন্দ বলছেন, ‘’আমাদের মাতৃভূমির উন্নতি সাধনার দুটি মহৎ ধারার মিলন- হিন্দু
ধর্ম এবং ইসলাম। বৈদান্তিক বুদ্ধি এবং মুসলিম শরীর- এই হল একমাত্র আশা।‘’
No comments:
Post a Comment