চেনা মুখের ভিড়ে আমিও ছিলাম
আমার জীবন আমার দর্শন:
আমি আজ অনেক অনেক দূরে
চলে এসেছি। অথবা সমাজ-প্রশাসনিক কারণেই এই দূরত্ব। মনে পড়ছে ২০০৮ সালের ডিসেম্বর
মাসের একটা দিন। সেদিন টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক হিসাবে কালীঘাট গিয়েছি। মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে কভারেজ করতে। দিনটা ২৫ ডিসেম্বরের আগে অথবা পরে ছিল। অথবা
ওইদিন ২৫ ডিসেম্বর ছিল। আমার ঠিক মনে নেই। দিদির ঘরের বাইরে কর্মীদের অফিস। তার
বাইরে বারান্দায় আরও অনেক সাংবাদিক, চিত্রসাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে অপেক্ষা করছি।
তৃণমূল নেত্রী আমাদের ডাকবেন, তখন যাব। প্রায় আধ ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর দিদি
আমাদের ডাকলেন। ছোট ঘর। সবার বসার ঠিক মতো জায়গা হয় না। সেই ঘরেই আমরা যেমন যেমন
পারলাম বসলাম। কিছুক্ষণ পর কেক কাঁটা হল। দিদি নিজে হাতে কাটলেন। পরে সিঙ্গারা
এলো। চা যে লোকটি আনতে যাচ্ছিল তাঁকে মমতাদি বললেন, ‘চা পরে আনবে। বাইরে অফিসে কথা
বলে তারপর আনবে।’
আমরা কিছুক্ষণ বসলাম। তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে
সেইদিন পর্যন্ত কাজের সুবাদে যারা ঘনিষ্ঠ, দিদি তাঁদের সঙ্গে গল্প করছিলেন। পুরনো
দিনের গান নিয়ে কথা হচ্ছিল। প্রসঙ্গ উঠল হৈমন্তী শুক্লা এবং পিন্টু ভট্টাচার্যকে
নিয়ে। ওই বিখ্যাত দুই শিল্পীর কম বয়সের কিছু গল্প সেদিন দিদির মুখ থেকে শুনেছিলাম।
সেই
প্রসঙ্গ আজ থাক। আজ ৫ জানুয়ারি। তৃণমূল নেত্রী তথা বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মদিন।
২০০৮
সালের ওইদিন দিদি হঠাত বললেন, ‘এই তোমরা চপ মুড়ি খাবে?’
উপস্থিত
সকলে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে চপ মুড়ি এলো। আমরা চপ মুড়ি খেতে খেতেই
সকলের জন্য দামি দোকানের সন্দেশ এলো। বড় একটা কাঁচের প্লেটে সন্দেশ রাখা ছিল। চপ
মুড়ি খাওয়ার পর যারা ওই অফিসে অভ্যস্ত তাঁরা টপাটপ সন্দেশ তুলে নিল। আমার তখনও
‘বাবু কলকাতা’-র ভাষা রপ্ত হয়নি। ‘নাগরিক সাংবাদিক’-দের সভায় আমি আজও লজ্জাবনত।
আমার কোথায় একটা দ্বিধা কাজ করে। অচেনার দ্বিধা হোক অথবা অনেক কিছু চিনে যাওয়ার
দ্বিধা। অথবা সুশিক্ষিত সচেতন বড় মানুষদের কাছাকছি এসে যে সংস্কৃতি চিনেছি। সেই
সংস্কৃতির ভাষা দিয়ে, শব্দ দিয়ে, জীবনের মূল্যবোধ গড়ে তুলতে চেয়েছি। ‘সামগ্রিক
জীবন’-কে গড়ে তুলতে চেয়েছি। কিছুটা আবেগ প্রবণ হয়ে পরলাম। সেদিন দিদি একটা সন্দেশ
তুলে নিয়ে আমাকে বললেন, ‘কি হল? তুমি সন্দেশ খাও না? আমি আজ এই সন্দেশটা তোমার
জন্যই আনিয়েছি।’
স্বভাবে
আমি গ্রাম সভ্যতার ধুলোউড়ি সহজিয়া আউল বাউল। তাই লজ্জা পেলাম। পরিচিত কেউ কেউ
ঠাট্টা জুড়ে দিল। আমি বুঝলাম দিদি নিজের ভাইকে যেভাবে আপ্যায়ন করেন ঠিক সেই ভাবে
আমাকে বললেন। এই ধরণের ব্যক্তিগত কিছু মুহূর্ত আমারো রয়েছে তৃণমূল নেত্রী মমতা
বন্দ্যপাধ্যায়ের সঙ্গে। সেসব সুযোগ এলে কোনদিন লেখা যাবে। সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের
খুনের প্রতিবাদে কলকাতা প্রেস ক্লাবের আহ্বানে যে মিছিল হয়েছিল সেই মিছিলেও ‘দিদি’
আমাকে পাশে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অতি উৎসাহী কিছু মানুষ সেটা আটকে দিয়েছিলেন।
দিদির নিরপত্তা বলয়ের অফিসার কর্মীরা আমাকে তার পাশে ছ’বছর পর পৌঁছে দিয়েছিলেন।
বুঝেছিলাম মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল। কৌশল ছিল আমাকে পাশে নিয়ে হাঁটার। সেই মিছিল
ছিল প্রতিবাদের। মিছিল ছিল মানবতার পক্ষে। তাই কে কার পাশে হাটলাম সেটা বিষয় নয়।
পদাতিকের ভাষায় একটু পা চালিয়ে ভাই।
আজ
৫ জানুয়ারি মমতা বন্দ্যোপাধযায়ের জন্মদিন। প্রায় চারশো শব্দ লিখে ফেললাম, আমি
একবারের জন্যও ‘মুখ্যমন্ত্রী’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিনি। কারণ যারা
গঠনমূলক সামাজিকতায় বিশ্বাস করে তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘দিদি’ হিসাবে চেনে।
গ্রামের দেহাতি মানুষ কিংবা ‘কন্যাশ্রী যোদ্ধা’-এর দল ‘দিদি’ বলতেই অভ্যস্ত।
‘দেশবন্ধু’ পদবী যেমন অর্জন করতে হয় তেমনি সর্বজনীন ‘দিদি’ শব্দটিও অনেক মূল্য
দিয়ে অর্জন করতে হয়।
আমি
যে অঞ্চলে থাকি আজ সকালে একজন খেটে খাওয়া অবাঙ্গালি বন্ধু বলছিল, ‘দাদা বাংলায়
২০২১ সালে কি হবে বলে আপনার মনে হচ্ছে?’
আমি
বললাম, ‘তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিকল্প বর্তমান বাংলায় কে? বাংলার
উন্নয়নের জন্য যে ভাববে। যে দল দায়িত্ব নেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বেচ্ছায় তাঁকে
বা তার দলকে ছেড়ে দিয়ে সমাজ সেবায় চলে যাবেন।’
ভদ্রলোক
আরও জানতে চাইলেন, ‘বিজেপি বা বামফ্রন্ট এলে আপনি কি বলবেন?’
আমি
বললাম, ‘ সংসদীয় গণতন্ত্রে আমার একটা মাত্র ভোট। তাও উনিশ বছর আমার পরিচয়পত্র ছিল
না। সেই কারণে ভোট দিতে পারিনি। আমার ব্যক্তিগত মতামতে গণতন্ত্র অপেক্ষা করবে না।
সাধারন মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে জানে। তারাই বলে দেবে কে থাকবে আর কে থাকবে না।’
আরও
বললাম, ‘সমালোচনা যতই হোক আমাদের রাজ্যে ‘কন্যাশ্রী’ নামক প্রকল্পের কাজ অনেক আগে
থেকে করা উচিত ছিল। নারী, শিশু তথা মানব পাচার সভ্যতার অভিশাপ। সেই নারী পাচার
বন্ধ করতে রাজ্য সরকারের এই ধরণের উল্লেখযোগ্য প্রস্তুতি অনেক আগে থেকে নেওয়া উচিত
ছিল।’
আজকের
দিনে সেরকম কোনও বিষয় আলোচনা না করাটাই সৌজন্য খুব সম্ভবত। এটা গণতান্ত্রিক সৌজন্য
বলতে পারি। বলতে পারি সংসদীয় গণতন্ত্র। পারিবারিক গণতন্ত্র। এবং অবশ্যই সামাজিক
গণতন্ত্র। আগামীদিনে পৃথকভাবে গঠনমূলক আলোচনায় যাব। দিদি আপনি ভালো থাকুন। সুস্থ
থাকুন। অগ্নিগর্ভ বাংলা আজ অনেক অনেক শান্ত। গঙ্গার জলের ঢেউ নিজের আলপনায় আলাপন
করতে চাইছে। বা করতে পারছে। পাহাড়ের সাদা মেঘেদের ভাঁজে ভাঁজে সাদা বরফের গুঞ্জন।
পরিযায়ী পাখিদের কলরবে বাংলার সংস্কৃতি আজ মুখরিত। ‘রূপসী বাংলা’র সাদা বকেদের দল
অগ্রাহায়ণের আমন্ত্রণ নিয়ে ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে’ গুঞ্জনে গুঞ্জরিত। ‘নির্মল
বাংলা’-এর ঘরে ঘরে উজ্জ্বল প্রদীপ জ্বলুক। আমরা দীপ্তিমান থাকি। গর্বের সঙ্গে বলি
‘এগিয়ে বাংলা’। ১ ডিসেম্বর তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় টুইট করেছিলেন,
‘’দলের কর্মীরাই আমাদের সম্পদ। মা-মাটি-মানুষের কাছে আমরা দায়বদ্ধ।’
ওইদিন
তৃণমূল দলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সি বলেন, ‘’কেন্দ্রের সাম্প্রদায়িক শাসক দলের
বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কন্ঠ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সেই প্রতিবাদের লড়াই বাংলা
ছাড়িয়ে ভারতের প্রান্তে প্রান্তে পৌঁছতে শুরু করেছে। আমরা চাই, ওই সাম্প্রদায়িক
শক্তির উৎখাতে আমাদের নেত্রীই নেতৃত্ব দিন। মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ে সাহায্য
করুন।‘’
আমরা
জানি আপনার জীবনই আপনার দর্শন।
No comments:
Post a Comment