অগভীর জীবনের গভীর সামাজিকতা খুঁজছিঃ
পথের শেষে পথ কোথায়? অত্যন্ত কঠিন এবং দার্শনিক
প্রশ্ন। কে বলে দেবে? কাকেই বা প্রশ্ন করব? প্রায় সব মানুষই জন্মের পর দেহটাকে
টানতে টানতে বয়ে নিয়ে যায়। কেউ রোদন ভরা বসন্তে হেঁটে যায়। কেউ কেউ ক্লান্ত অবসন্ন
বেলার শেষে আলো খোঁজে।
১২ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের ১৫৬তম জন্ম
জয়ন্তীতে একটি পদযাত্রায় ছিলাম। সাত সকালের রোদ তখন জানান দিচ্ছে। উজ্জ্বলতা।
সূর্য সকাল ‘আটটা-৯টায়’ শিশুর মতো হাসে। শিশুর মতো নিষ্পাপ সত্য নিয়ে আমাদের জড়িয়ে
ধরে। সেদিন শরৎ বসু রোড (পুরনো নাম ল্যান্সডাউন) ধরে হাঁটতে হাঁটতে নজর কেড়েছিল
একটি দৃশ্য। পদযাত্রার মিছিল তখন পদ্মপুকুরে দাঁড়িয়ে। আমাদেরও দাঁড়াতে হল। আমার
নিজের কোনও সত্তা কোনওদিন ছিল না। আজও নেই। কত শরৎশশী কাছে এসে ঘুর ঘুর করেছে। আমি
সেইসব দিনে যেমন আনমনে থেকেছি। কারণ আমার কোনও দায় নেই। দায়বদ্ধতা নেই। আনন্দ করার
অধিকার নেই। আমাকে থাকতে হয় অচেনা এক সীমাহীন সীমাবদ্ধতায়। সেখানে আলো আসে ধীরে
ধীরে। চুঁইয়ে পড়ে আলোর অনুজ্জ্বল ভাষা। যোগ্যতার মানদণ্ডে হাতিয়ে নিতে হয়। না হলে এই দীর্ঘ পথ
হেঁটে এলাম কি করে? হেঁটে ফিরবই বা কি করে?
১২ জানুয়ারি ‘শিক্ষার জন্য হাঁটুন’ লায়ন্স ক্লাবের
মিছিলে ছিলাম। মিছিলটা দাঁড়িয়ে আছে পদ্ম পুকুরের কাছে। মোটর ভেহকেল স্টপেজের ফুটপাথে খাটিয়ায়
জবু থবু হয়ে একটি ছেলে পড়ছে। ভালো লাগল। আজ সকালের আমন্ত্রণে আমি আমাকে খুঁজে পেলাম।
ফুটপাথ না থাকলে আমাদের মতো মানুষ ‘নগর সভ্যতায়’ বেঁচে থাকে কি করে? গত বছর কাউকে
না জানিয়ে বর্ধমান শহরে গিয়েছিলাম। কাউকে না জানিয়ে। শহরের ভোল বদলে গেছে। আমি গিয়েছিলাম
এক রুগ্ন শিশুর জন্মের হাসপাতালকে চিনতে। গত বছর এই দিনে। সেই শিশু ৫৯ বছরের ‘বুড়ো
সূর্য’-এর গল্প চিনতে চেয়েছিল। হাসপাতালের কথা সবাই জানে। ডাক্তারবাবু থাকেন।
জুনিয়ার ডাক্তারবাবু থাকেন। নার্স থাকেন। হাউস স্টাফ থাকেন। কম্পাউন্ডার থাকেন। দালাল থাকেন।
বেশ্যারাও থাকেন। গাছ থাকে। পাখি থাকে। হ্যা সেদিন বুড়ো হুতোম ছিল।
আমাকে দেখে হুতোম
সেদিন বলেছিল, ‘এখানে কেন এসেছিস? এখানে কেউ তোকে চেনে না। চিনতে চাইবেই বা
কেন? চার চাকার দামি গাড়ি কোথায়? মেয়েছেল কোথায়? না নেতা হতে পারলি। না রক্ষক হতে
পারলি? তোর দেশে যা নিজের দেশে। সেখানে গিয়ে দেখ বট গাছের ঝুরি আরও ঝুরি নামিয়ে
তোর জন্য অপেক্ষা করছে। পাহাড় নেই, টিলা নেই কিন্তু গাছের ঝুরি আছে।‘’
আমি বলেছিলাম, ‘আমি বর্ধমান শহরে অন্য কাজে
এসেছিলাম। তাই একটু হাসপাতালটা দেখতে এলাম। তুমি এখানে কি করছ?’
হুতোম উত্তর দিয়ে বলেছিল, ‘’খ্যামটা নাচ দেখতে
দেখতে বড় হলাম। পরশমণি আর খুঁজতে যাইনা। আবার বলছি তুই তোর দেশের হাসপাতাল দেখ
গিয়ে। যে হাসপাতালে তোর দিদি, বৌদিদের সন্তান হয়েছে। তুই রিক্সা ঠেলে ঠেলে পাহাড়তলির হাসপাতালে নিয়ে
গিয়েছিলি। সেই হাসপাতালে যা। তোর আত্মীয়াদের সন্তান হতো আর তুই পাখির খাবার জোগার
করতে নেমে পড়তিস। সেই শহরে যা। বট গাছের ঝুরি তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
এরপর হুতোমের যে কাজ ফিচেল হেসে বলেছিল, ‘’স্কুলের
কাগজে ফেব্রুয়ারির ১ তারিখ সবাই মনে রাখে। কিন্তু বট গাছের ঝুরির নীচে পৌষ
সংক্রান্তির দু’দিন পরের কথা? বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানোদের কথা বট গাছের ঝুরি বলে
দেবে। যা হেঁটে হেঁটে যা, হামাগুড়ি দিয়ে যা, ছুটে ছুটে যা। তোর নিজের দেশে। মাটির
টানে। নবান্নের নতুন ফসলের টানে। নতুন ধানের টানে। বাড়ি না থাক, শহর আছে। মল আছে।
বুড়ো থুড় থুড়ো বন্ধুরা আছে। যা নিজের দেশে যা।‘’
এবছর গিয়েছিলাম আমার শহর নলহাটি। আমার নিজের শহর
নলহাটিতে। কাউকে না জানিয়ে গোপনে দেখেছি তারে। এলো খেলো চুলে দেখেছি। শিশির মাখা
জোছনা আলোয় দেখেছি তাঁকে। তারাদের ভিড়ে দেখতে গিয়েছিলাম। হাসি আর দেখতে পাইনি। আমি
দেখতে গিয়েছিলাম নলহাটি স্টেশনের কাছে। পাথরকল পাড়ায়। পাথর কল লাগোয়া এক বুড়ো বটগাছকে। আমরা যখন সত্তর
দশকের ঊষার সকালে খেলতে যেতাম পাথর কল মাঠে। সেই বুড়ো বট অথবা অশ্বত্থ গ্রীষ্মের
প্রখর রোদের প্রশ্রয়ে আমাদের সুশীতল বাতায়নে ডেকে নিত। সেই গাছের ঝুরি ছিল।
ঝুরিগুলি ঝুলতে ঝুলতে রোদ, বৃষ্টি, শিশিরে ভিজে শক্ত হয়ে গিয়েছিল। কোনোটা মাটি এসে ছুঁয়েছে। কোনোটা
মাটির খুব কাছাকছি। আমরা ক্লান্ত অবসন্ন দেহটাকে বুড়ো অশ্বত্থ গাছের সীমাহীন
বৃত্তের ছাওয়ায় এলিয়ে দিতাম। কেউ কেউ শক্ত
ঝুরির মেরুদন্ড ধরে দোল খেত। চেনা পাখি, অচেনা পাখি, ওই গাছে বসে কত না আলাপ শুনতে
বলত। না পেলাম না। আমার শৈশব হারিয়ে গেছে। আমার কৈশোর হারিয়ে গেছে। আমার যৌবন
আমাকে ‘নাগরিক সভ্যতা’ চিনতে বলেছিল। সেদিন গিয়ে দেখলাম সেই বুড়ো বট অশ্বত্থ কেউ
নেই। সভ্যতা ওদের গিলে খেয়েছে। নতুন নতুন ‘নাগরিক দালান’ বাড়ির স্থাপত্য বুড়ো
বটের, বুড়ো অশ্বত্থের দীর্ঘঃশ্বাস শুনছে। আমরা আর বলতে পারব না। ‘আমাদের ছোট রেল
চলে আঁকে বাঁকে/ সব মাসে তাঁরা পাথরে মুখ ঢাকে’। কাশিমবাজার রাজার পাথর কলের ছোট রেল
নিয়ে এই ছিল আমাদের ছোট বেলার ছড়া।
ফিরে গেলাম শৈশবে দেখা আরও একটা অশ্বত্থের কাছে।
শঙ্কর টকীজ হওয়ার পরে সংলগ্ন পুকুরটা কিছুটা ছোট হয়ে গেছে। এই সিনেমা হলে আমরা ১৯৮৫ সালে তিনটে তৃতীয়
ধারার ছবি দেখিয়ে ছিলাম। ‘পথের পাঁচালি’, ‘গৃহযুদ্ধ’ আর ‘চোখ’। বট এবং অশ্বত্থ
জানে সে কথা। সাক্ষী ছিল ওরা। সাক্ষী ছিল বনলতা। আকাশ ছিল সাক্ষী। তুমি কোনওদিন
সামন্ত দাদা- মায়ের অবাধ্য হতে চাওনি। তুমি সেদিনও খাঁচার মধ্যে ছিলে আজও প্রৌঢ়
শরীর নিয়ে খাঁচায় বন্দি আছ। সাক্ষী আছে তেতো- মিঠে নীমগাছ। সাক্ষী আছে মাধবীলতা।
জানো, সেই পকুরের ধারে যে যৌবন নিয়ে অশ্বত্থ
উঠেছিল সে আজও সাবলীল। আমাকে বলল, ‘ফিরে এলি কেন? এখানে এলে শুধু নিষ্পাপ কান্না
শুনতে পাবি। পাথরের বুকে হারিয়ে যাওয়া নিষ্পাপ শিশুর কান্না। আয় আমার এই সন্তানের
কোলে ঝুলে যা। আমার এই সন্তান আর কদিন পরে ষাট হবে। কেউ বলার নেই ‘বালাই ষাট’। বড়
বড় সভা ঘরের বাইরে ঘুরে ঘুরে এখনে আসিস। আমার ঝুরিতে তোকে স্থান দেব। তোর আতা গাছ
হারিয়ে গেছে। তোর বায়োস্কোপ হারিয়ে গেছে। তোর বাদুড় হারিয়ে যায়নি।
আমি নলহাটি স্টেশনে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শীত,
পাহাড়তলির শীত, ছোট নাগপুরের শীত। আমাকে ফিরিয়ে দিলো আশির দশকের স্মৃতি, আমার
হারিয়ে যাওয়া, স্মৃতি। আমার শহরের স্মৃতি। সবান্ধবের স্মৃতি, সামাজিক আলোর স্মৃতি।
তোমার না জানা শব্দের স্মৃতি। শিশির আচ্ছন্ন কুয়াশা শীতের শেষ প্রহরে সেদিন নলহাটি
স্টেশনে কেউ ছিল না। আমার সত্যটা বলবে। আমার মিথ্যেটা বলবে। তাই মনে পড়ল ঋত্বিক
ঘটকের কথা। এই ঘটক পরিবারের অনেককেই খুব বেশি করে চিনে ফেলাটা আমার কি মঙ্গল
হয়েছিল? না অমঙ্গল? এই পরিবারে এক সদস্যের কাছে শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, শক্তিপদ
রাজগুরুর কাহিনি ‘চিত্রকল্প’ নিয়ে ছবি করেছিলেন ঋত্বিক। নাম দিয়েছিলেন ‘মেঘে ঢাকা
তারা’। ছবি শেষ হওয়ার পর সেন্সর বোর্ডে যায়। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সেন্সর
বোর্ডের সদস্য ছিলেন। তিনি ছবি দেখে বলেছিলেন, ‘মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা ছাড়া কী আর
ছবি হয় না?’
চাছাছোলা ঋত্বিক ঘটক উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আপনার কাছে
যা বাস্তব, তা হয়তো আমার কাছে নয়।’
No comments:
Post a Comment