অতীতকে ফিরে দেখতে
চাই। শুধু সংস্কৃতিবোদ্ধা বাঙালিদের আছে এমনটা ভেবে নেওয়াটা খুব কিছু ঠিক হবে কি?
সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন জাতির বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ অতীতকে ফিরে
দেখতে চায়। এমনই একটি সংগঠন ‘ভারতীয় গণনাট্য সংঘ’ (আইপিটিএ)। এই নামের
সঙ্গে পরিচিত নয় এমন বামকর্মী ভূভারতে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভারতে গণআন্দোলনের
মঞ্চ তৈরি করতে বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত ভারতীয় গণনাট্য সংঘের উজ্জ্বল ভূমিকার
কথা আমরা জানি। স্বাধীনতা পূর্ব ভারতে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সদস্য ছিলেন ভারতীয়
চলচ্চিত্র, নাটক, সঙ্গীত এবং শিল্পকলা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের নামজাদা তথা প্রথিতযশা
প্রথমসারির বুদ্ধিজীবীর দল। যাঁদের অবদান ছাড়া গর্বিত বাঙালি, সংস্কৃতিদর্পী
বাঙালি আলাদা করে নিজেদের তৈরি আরও এক নতুন আলোকনিকেতন পেতেন না। বাংলা তথা ভারতীয়
সংস্কৃতির আকাশে রবীন্দ্রনাথের মত এক
উজ্জ্বল, চিরভাস্বর এবং প্রখর ব্যক্তিত্ব জ্বল জ্বল করেছে। সেই আলোয় আমরা ব্যপ্ত
থাকতে বাধ্য হতাম। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কিছু ব্যক্তির চেষ্টায় গণনাট্যসংঘের মঞ্চে
এসে সারা ভারতে শতফুল বিকশিত হয়েছে। বাংলার সাংস্কৃতিক অহংকার গড়ে দিয়েছিল এই
মঞ্চ। বিশ্বের যে কোনও সংস্থার যেমন সাফল্যের দিক থাকে আবার ব্যর্থতার দিকটাও অনেক
সময় বড় হয়ে দেখা দেয়। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের ক্ষেত্রেও
সাফল্যের সঙ্গে ভাঙ্গনের দিকটাও একসময় খুব বড় হয়ে সামনে এসেছিল।
অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি সিপিআইয়ের পার্টিকোর এই সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট গড়ে তোলার
ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ১৯৬৪ সালে দল মতাদর্শের কারণে আড়াআড়ি দুটো ভাগে
ভাগ হয়ে যায়। পরে সিপিআইএম বড় দল হিসেবে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভারতীয় গণনাট্যের মূল
চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল। ১৯৬৪ সালের পরে সিপিএম দলের আদর্শ নিয়ে অভ্যন্তরীণ
ক্ষেত্রে বিভিন্ন মতাদর্শের লড়াই হয়েছে। কিন্তু এটা বলতেই হবে গণনাট্য সংঘের প্রথমসারির
কিছু সাংস্কৃতিক নেতা এবং কর্মীর প্রচেষ্টায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘের বামপন্থী
সংস্কৃতির প্রচার এবং প্রসারে কখনও পূর্ণচ্ছেদ পড়েনি। সেইসব নাটক, গান, সাহিত্য,
সৃষ্টিশীল শিল্প, বাণিজ্যিক শিল্প, চলচ্চিত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে অতীতের মত যেমন
আমরা ধ্রুপদী ঘরানার শিল্পী সাহিত্যিক পেয়েছি আবার স্লোগানধর্মী শিল্পী
সাহিত্যিকদের ভীড়ও লক্ষ করেছি। যে সব ‘পেড শিল্পী’ বশংবদ চিন্তা নিয়ে ‘গণনাট্য
সংঘ’-এর মঞ্চকে ব্যবহার করতে চেয়েছেন তাঁরা কালের নিয়মে হারিয়ে গেছেন। আজও থেকে
গেছেন বিজন ভট্টাচার্য,সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস,
সুচিত্রা মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, চিন্তামণি কর, তাপস সেন, খাজা আহমেদ আব্বাস, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, তৃপ্তি মিত্র এবং মৃণাল সেন সহ একাধিক গণসংস্কৃতি
আন্দোলনের মুখ। মানবতার মুখ। এইযুগে এবং প্রাক স্বাধীনতার সময়ের মিলন মঞ্চের অগ্রপথিক
হিসেবে এরা বাংলা তথা বাঙালির যুগপুরুষ হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। রবীন্দ্রনাথের
সঙ্গে একসঙ্গে হেঁটেছেন। বিশ্বকবিকে ঋণী করেছেন। নিজেরা সমৃদ্ধ হয়েছেন।
সম্প্রতি কলকাতা গোর্কিসদন কতৃপক্ষ এবং ভারতীয় গণনাট্য সংঘের যৌথ আয়োজনে
একটি সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা হয়ে গেল। ২৮ মে কলকাতার গোর্কিসদনে অনুষ্ঠানে গিয়ে
প্রথমটায় ঠিক ঠাউর করতে পারছিলাম না। অনুষ্ঠানটা ঠিক কি হতে পারে। যদিও
আমন্ত্রণপত্রে লেখাছিল ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’। তবু ঠাউর করতে
কিছুটা অসুবিধা হচ্ছিল। গোর্কিসদনের একতলায় (নতুন করে সাজানো) প্রদর্শনী কক্ষে একটি ইজেলের ক্যানভাসে অষ্টাদশ শতাব্দীর একজন সোভিয়েত
ব্যক্তিত্বের ছবি। ছবির উপরে লেখা ‘A Tribute to Gerasim Stepanovich Lebdev, 1749-1817.
দেওয়ালে মৃণাল সেন পরিচালিত বিভিন্ন সিনেমার ছোট বড় পোস্টার। মৃগয়া, আকালের
সন্ধানে, একদিন প্রতিদিন, ভূবন সোম, নীল আকাশের নীচে, খারিজ, জেনেসিস, মহাপৃথিবী সিনেমার
ছোট বড় সাদাকালো পোস্টারের সঙ্গে রয়েছে উধৃতি। মৃণাল সেন লিখছেন, ‘’.........Behave
me. I do not feel fatigued, I still feel sufficiently energetic and youthful at
my age. I continue to make both friends and enemies and that. I believe. Saved
me from stagnation. Mrinal Sen, আমার ছেলেবেলা –(১) এবং (২)।
‘’......... শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে দিলাম দুজনকেই, আমি-ই বিড়াট দার্শনিকের
কথা বললাম। বলেছিলাম ‘’All are genius up to the age of ten.’’ সঙ্গে সঙ্গে দুজনের কাছ থেকেই একটা benefit of the doubt পেয়ে গেলাম। সেই benefit of the doubt নিয়ে চলে এলাম মহানগর কলকাতায়। ছেলেবেলা ডিঙিয়ে এলাম।‘’
মৃণাল সেন আরও লিখছেন, ‘’My entry to cinema was very accidental. I travelled a long and difficult
way-difficult, because I did not know how to walk, I learnt through
experience.’’- Mrinal Sen. কি করে তিনি সিনেমায় এলেন। আয়োজক কতৃপক্ষ মৃণাল সেনের
বক্তব্য তুলে ধরে আমাদের দেশের আর্থ-রাজনৈতিক সময়কে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ফ্যাসিবাদ, ফ্রান্স বিপ্লব, ভারতে নকশালপন্থী আন্দোলন এগুলি
কেমন যেন সব হাত ধরাধরি করে এগিয়ে এল। পরস্পর পরস্পরের দ্যোতক হয়ে। এদিনের আলোচনার
বিষয়বস্তু ছিল ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংস্কৃতি। খুব স্বাভাবিকভাবেই এসেছে দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়া, জার্মানি, হিটলার এবং মিত্রদেশগুলির ভূমিকা। ফ্যাসিবাদ বিরোধী
আলোচনায় অবশ্যম্বভাবী হিসেবে স্তালিনের নাম আসবে। আসবে মাও সেতুংয়ের (মাও জে দং)
নামও।
একটি তথ্য বলছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের ২৩-২৮ মিলিয়ন
নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিল। কেউ যুদ্ধে, কেউ যুদ্ধজনিত অনাহার বা অসুখে, কেউ কেউ
বিদেশে বন্দী শিবিরে। আলোচনায় বারে বারে ফিরে ফিরে এসেছে নাৎসি নেতাদের প্রসঙ্গ।
গণনাট্য সংঘের অন্যতম সংগঠক গৌতম ঘোষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার বিভিন্ন চিঠির
অ্যালবাম থেকে পাঠ করে আমাদের শোনান। মর্মান্তিক যন্ত্রণার নিষ্ঠুর ছবি উঠে এসছে
সেই সব চিঠি থেকে। সাধারণ নাগরিক যেমন তার মৃত্যুর আগের ঘটনার বর্ণনা লিখে গেছেন
তার কোনও আত্মীয়কে উদ্দেশ্য করে। সাধারণ সেনা মাকে লিখেছেন, স্ত্রীকে লিখেছেন
যুদ্ধক্ষেত্রের ভয়াবহতার কথা। নিজের আসন্ন মৃত্যুর কথা। সেনাধ্যক্ষ বীভৎস
অট্টহাস্যে তাঁদের অত্যাচারের বর্ণনা লিখেছেন সুপিরিয়রকে। একটি ১৫ বছরের মেয়ে তার
বাবাকে লিখে গেছে নিজের এবং তার মায়ের জীবন যন্ত্রণা, মৃত্যুর কথা। নাৎসি নেতৃত্ব
ঠাণ্ডা মাথায় ইহুদী এবং অন্যান্য সাধারণ মানুষকে যে ভাবে হত্যা করেছিল এসেছে সেই
প্রসঙ্গও। হিটলার বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক সময় জার্মানের মানুষও গর্জে
উঠেছিল। যার ফসল ১৯৪৫ সালে মে মাসে রাইখস্ট্যাগের মাথায় লাল পতাকার বর্ণাঢ্য
জয়যাত্রা। আমরা জানি হিটলার যে ঘোষণা করেছিল সেই ঘোষণা আজ ইতিহাসে স্থান করে
নিয়েছে। হিটলার বলেছিলেন, ‘’আমরা শ্ত্রুদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই করছি না।
......রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইঃ বলশেভিক কমিসার ও সমগ্র কম্যুনিস্ট বুদ্ধিজীবিদের
ধ্বংস করা।‘’
অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচক ছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘের কলকাতা জেলা কমিটির
সম্পাদক সমুদ্র গুহ। তিনি বলেন, ‘১৯৪৫ সালের ২রা মে রাইখস্ট্যাগের মাথায় লাল পতাকা
উঠেছিল। ওইদিন থেকেই ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এর পরে পুঁজিবাদের
বিকাশ হলেও বিভিন্ন উত্থান পতন আমরা লক্ষ্য করেছি। ১৯৩০ সালে প্রচন্ড ডামাডোল তৈরি
হয়েছিল। অর্থ নৈতিক মহামন্দা শুরু হয় এই সময়। কিন্তু বিশ্বের একমাত্র দেশ রাশিয়ায়
এই মহামন্দার প্রভাব পড়েনি। চার্লি চ্যাপলিনের ‘মডার্ন টাইমস’ সিনেমায় আমরা দেখি
মানুষ ভেড়ার পালের মত কারখানা থেকে বেড়িয়ে আসছে। পুঁজিবাদ আমাদের যে ভাবে দেখেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জার্মানিকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়া হয়। তবু বলতে হবে
ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তির জয় হয়েছে। শত ফুল বিকশিত হয়েছে।‘’
সমুদ্র গুহ চিনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে আরও বলেন, ‘’চিনের সাহিত্যে উপমা
ব্যবহার করা হয়। এবং রুপকের মাধ্যমে ঘটনাকে বোঝানোর চেষ্টা হয়। পাথর চাপা দেওয়া
কোনও গাছ বা ফুল গাছের উপর থেকে পাথরটা সরিয়ে দিন। দেখবেন ফ্যাকাসে ফুল বা গুল্ম
লতা,গাছ পাবেন। পাথরটা সরিয়ে দিন দেখবেন শতফুল বিকশিত হচ্ছে। আমাদের কাজ হচ্ছে
পাথরটা সরিয়ে দেওয়ার। শতফুল বিকশিত করতে হবে। যেটা মাও সে তুং (মাও জে দং) বলে
গেছেন।‘’
এদিনের অনুষ্ঠানে গণসংগীত গেয়ে শোনান অনন্যা চন্দ। ছিল একটি ৪৫ মিনিটের নাটক।
নাট্যকার মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের লেখা নাটক ‘পোকামাকড়ের দিনগুলি’’। নাটকটি প্রযোজনা
করে গণনাট্য, প্রত্যাশা গোষ্ঠী। এই নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার আগে আমার কাছে আরও একটি চমক
ছিল। আমি সাধারণ সাহিত্যের একজন পোড়
খাওয়া ব্যক্তি। সামাজিক এবং অন্যান্য অভিঘাতে স্মৃতি
ঘোলাটে হয়ে গেছে। আমি নিজে ইতিহাবেত্তাও নই। তাই বিশ্বের সব ইতিহাস আমার পক্ষে
জানা সম্ভবও নয়। গোর্কিসদনের প্রদর্শনী কক্ষে সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো একটি উধৃতি
চোখে পড়ল। ফ্রেমটি যথেষ্ট বড় মাপের। যে উধৃতি থেকে জানতে পারলাম ভারত এবং রাশিয়ার
সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মাত্র একশো বছর আগের নয়। এই সম্পর্ক আরও পুরনো। ভারতে
ব্রিটিশ আমল থেকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দশকে এই সম্পর্কে সূচনা।
সূচনা হয়েছিল গেরাসিম স্টেপানোভিচ লেবডেভ (১৭৪৭-১৮১৭)এর মাধ্যমে। প্রদর্শনী
কক্ষের দেওয়ালে একটি বোর্ডে লেখা রয়েছে, ‘’An Imparted review of the systems of
East Indian Brahmins, their Sacred Rites and people’s customs’’. First
published in St. Petersburg in 1805 (in Russia), পাশের বোর্ডটিতে লেখা রয়েছে,
‘Different times and different personalities have shaped India’s relations with
Russia. Gerasim Lebdev, a son of Yaroslavl, contributed to the development of
Indian-russian friendship in the last decade of the eighteenth century. Madras
and Kolkata are the two Indian cities Levdev lived from 1785 to 1797. Ten out
twelve years he stayed in Kolkata.
Lebdev possed the knowledge of the land, its customs and languages,
including Sanskrit, Bengali and particularly the Kolkata dialect of Hindustani,
spoken language of its natives.’’
এই দুটি
লেখা থেকে আমরা জানতে পারি ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার গাঁট বন্ধন কত শতাব্দী পুরানো। এই সম্পর্ককে যেমন
কংগ্রেস ঘরানার নেতৃত্ব একটা উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার
চিঠি’ সে ক্ষেত্রে অন্যতম মাধ্যম ছিল। বর্তমান সরকারের কাছেও আমরা আশা করব সেই
সম্পর্ক শুধু আর্থিক বা বিঞ্জান-কারিগরী নয়। সাহিত্য সংস্কৃতির বিনিময় এবং
সংস্কৃতির অন্যান্য ধারার ক্ষেত্রেও পুরনো ধারাবাহিকতা বজায় থাকবে।
No comments:
Post a Comment