মঞ্চে যে মানুষটা রাজারমত দেখতে, কিন্তু রাজা নন। পড়ে আছেন ঝলমলে এক রাজার
পোশাক। শেরোয়ানি বলা যায়। মাথায় ঝলমলে পাগড়ি। তিনি ম্যাজিক দেখাছেন। যে কোনও শহরের
যে কোনও মঞ্চে, নামজাদা অথবা অনামী জাদুকর, মঞ্চে জাদু দেখানোর সময় ‘ওয়াটার অব
ইন্ডিয়া’ নামে একটি ম্যাজিক দেখাতেন। আমরা ছোটবেলায় বিভিন্ন মঞ্চে এই জাদু দেখেছি।
বাংলা তথা ভারতের মানুষের কাছে জাদু প্রদর্শনীর পরিচিত খেলা হয়ে গিয়েছিল। অনেক
ম্যাজিসিয়ান জনপ্রিয় ম্যাজিকটি দেখাতেন। কিন্তু ওই জাদুটির আবিস্কারকের নাম আর কেউ
বলেন না। এটাই নিয়ম। আমরা বড় হয়ে জানলাম এই জাদুটির আবিস্কারক জাদু সম্রাট প্রতুল
চন্দ্র সরকার। চিনতে অসুবিধে হচ্ছে? না কোনও প্রয়োজন নেই পুরো নাম বলার। আসল নাম
পি সি সরকার। এবার চিনতে পারছেন? ম্যাজিকের সেই সম্রাটকে নিয়ে সম্প্রতি একটি বই
প্রকাশ হল। কলকাতার সাউথ সিটি মলের দোতলায় ‘স্টার মার্কে’। ‘THE MHARAJA OF MAGIC’ নামে বইটি
প্রকাশ হল। নিয়োগী বুকস থেকে প্রকাশিত বইটির লেখক জাদু সম্রাট পি সি সরকারের
সুযোগ্য মেজছেলে আরও এক পি সি সরকার (জুনিয়ার)। পুরো নাম প্রদীপ কুমার সরকার।
পি সি সরকার বিংশ শতাব্দীর অন্যতম আলোচ্য ব্যক্তিত্ব। ভারতে হারিয়ে যাওয়া
অথবা মন্থর গতিতে চলতে থাকা হাত সাফাইয়ের খেলাকে তিনি নতুন এক ভাষায় ফিরিয়ে দিয়ে
গেছেন। তাঁর সৃষ্ট ম্যাজিকের নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ইন্দ্রজাল’। এই ‘ইন্দ্রজালকে’
তিনি বিশ্বের মঞ্চে জনপ্রিয় করেছিলেন। তাঁর জাদুতে মিশে
আছে মনঃস্তত্ব, দর্শন এবং অবশ্যই বিঞ্জান। আলোচ্য বইটি জাদুসম্রাট পি সি সরকারের
জীবনের সময়কালের একটি মূল্যবান সময়ালেখ্য। জাদুসম্রাটের সুযোগ্য সন্তান তাঁর শৈশব,
কৈশোর যৌবনে দেখা পারিবারিক অভিভাবকের ছবি যেমন লিখেছেন, পাশাপাশি অত্যন্ত গুরুত্ব
দিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন ‘ইন্দ্রজাল’ নামক এক বিঞ্জানের স্রষ্টা মহারাজকে। প্রদীপ চন্দ্র সরকার সাফল্যের সঙ্গে
বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বের ক্যানভাস আমাদের সামনে এনে দিয়েছেন। যে
ক্যানভাসে ধরা আছে এক অনন্য কোলাজ। ‘The Maharaja of Magic’ নামে বইটির মূল্যবান আরও একটি অধ্যায় মহারাজের বহু মুল্যবান ছবি। এছাড়া বইয়ে আছে কিছু অপ্রকাশিত পোস্টার, বিভিন্ন খবরের কাগজে প্রকাশিত
প্রবন্ধ, কার্টুন ছবি, পারিবারিক ছবি, ব্যক্তিগত দলিল দস্তাবেজ, সম্মানপ্রাপ্তি
এবং পুরষ্কারের ছবি (ফ্যাকসিমিলি)। যে সব প্রদীপবাবু নিজের সংগ্রহ থেকে ব্যবহার
করেছেন বইয়ের মান এবং উচ্চতা বোঝাতে। কারণ তিনি নিজেও একজন স্বনামধন্য ম্যাজিসিয়ান
এবং উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব। বিঞ্জানমনস্ক চিরকালীন এবং মননশীল এক সামাজিক ব্যক্তিত্ব জাদুসম্রাট পি সি
সরকারকে কলমের চিরন্তন ভাষায় প্রদীপ সরকার আমাদের সামনে পৌঁছে দিয়েছেন। মেদহীন
অনন্য এক ধ্রুপদী বাংলা ভাষায়।
প্রদীপ সরকার বা পি সি সরকার (জুনিয়ার) প্রায়োগিক
দর্শনে (Applied
Psychology) এম এস সি পাশ করেছেন। কৃতিত্বের সঙ্গে। তিনি কিশোর বয়স থেকেই বাবাকে
‘ইন্দ্রজাল’ প্রদর্শনে সাহায্য করেছেন। প্রদীপ সরকারের কথায়, ‘‘আমি ছোটবেলায় বাবা
নিজের ঘরে কি করতেন সেটা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। আমি পাশের ঘর থেকে একটা টেবিলের
উপর টুল অথবা চেয়ার রেখে ‘ঘুলঘুলি’ দিয়ে দেখতাম। কিছু বুঝতে পারিনি। বাবা একটা
কাগজে কি সব হিজিবিজি লিখছেন। আমি ভাবতাম পড়াশোনা করছেন।‘’ বাবাকে সাহায্য করতে
করতেই প্রদীপ সরকার একদিন আবিষ্কার করেন তিনি নিজেও ভারতীয় ইন্দ্রজাল(ম্যজিকের)-এর একজন ব্যক্তিত্ব
হয়ে উঠেছেন। সালটা ১৯৭১। পি সি সরকার জাপানে গেছেন তাঁর প্রদর্শনীর
দল নিয়ে। সেখানে পি সি সরকারের হার্ট অ্যাটাক হল। মঞ্চে হাজির হলেন তাঁর সুযোগ্য
ছেলে পি সি সরকার (জুনিয়ার)। নিজের জাদুকাঠির ছোঁয়ায় তিনি সাগরপারের দর্শকদের কাছে
‘ইন্দ্রজাল’ নামক ম্যাজিকের নতুন অধ্যায় শুরু করলেন। একটি ট্রাঙ্কের ভেতরে নিজেকে
বন্দী করে ট্রাঙ্কটির দরজা তালাবন্ধ করে
সাগরের জলে ফেলে দেওয়া হল। কিছুক্ষণ পরে পি সি সরকার আবার দর্শকদের সামনে ফিরে
এলেন। উল্লেখযোগ্য আরও ম্যাজিক, যাত্রীসহ একটি আস্ত ট্রেনকে ভ্যানিস করে দেওয়া।
তাজমহল চোখের সামনে উধাও করে দিয়ে প্রদীপ সরকার ভারতীয় জাদুকে আন্তর্জাতিক স্তরে
আরও উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিন ডজন ব্যতিক্রমী এবং জনপ্রিয় ম্যাজিক (Illusions) এখনও পর্যন্ত সৃষ্টি করেছেন সরকার পরিবারের পরম্পরা প্রদীপ সরকার অথবা পি
সি সরকার (জুনিয়ার)। প্রদীপ সরকার শুধু হাত সাফাইয়ের জাদুকর নন। শব্দ এবং কথারও
উল্লেখযোগ্য ভাষাশিল্পী বর্তমান ভারতের অন্যতম ইন্দ্রজাল ব্যক্তিত্ব পি সি সরকার
(জুনিয়ার)। ২০ টি বইয়ের লেখক তিনি।
১১ মে অনুষ্ঠিত বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে একটি
ব্যতিক্রমী ‘কথাচারিতা’ ছিল। সরকার পরিবারের তিন প্রজন্মের পারিবারিক বন্ধু পঙ্কজ
সাহার সঙ্গে পি সি সরকারের কথোপকথন। কলকাতা দূরদর্শন কেন্দ্রের প্রাক্তন অধিকর্তা
এবং কবি এবং লেখক পঙ্কজ সাহা বলেন, ‘’আজকের এই অনুষ্ঠানকে ‘পরম্পরা’ বলতে পারি। এই
পরম্পরা মিলনের একটি ইতিহাস হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।‘’
পঙ্কজদার চর্চিত গলায় মননশীল শব্দের এই সূত্রায়নে
আমরা সংবাদ মাধ্যমের কর্মী এবং অন্যান্য উপস্থিত দর্শকরা অনুষ্ঠানে মজে গেলাম। আমাদের
সামনের আসনে বসে আছেন পি সি সরকার(জুনিয়ার)-এর স্ত্রী জয়শ্রী সরকার, মানেকা, মমতাজ
এবং মৌবনি তাঁর তিন মেয়ে। বিশ্বায়ন উত্তর অভিজাত বাজারের অভিজাত বিপণীর আলোকছটায় ঝলমল করছে সভাকক্ষ। ক্যামেরার ফ্ল্যাশবাল্ব ঘনঘন ‘পরম্পরা’
চেনাচ্ছে। কলকাতার অন্যতম খ্যাতনামা পরিবার তখন আমাদের সামনে। ঠিক এই সময়টাকে বেছে
নিলেন একসময়ের নাম করা সাংবাদিক পঙ্কজ সাহা। তিনি ছুড়ে দিলেন প্রশ্ন, ‘’তোমার বাবা
রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। তুমি ভোটে জিতলে কি করতে?’’
প্রদীপবাবু বলেন, ‘’আমি জনমনরঞ্জনের জন্য ম্যাজিক
করি। আমার রাজনীতিতে যোগদান একটা প্রতিবাদ। নাক গলিয়েছিলাম এই জন্য নয় যে কারও নাক
কাটতে চাই। আমি যদি দেশের কাজ করি আমি ধন্য হয়ে যাব।‘’
পরের প্রশ্ন করলেন পঙ্কজদা, ‘’আমি আশা করব মানেকা পি
সি সরকার (জুনিয়ার)-এর জীবনী লিখবেন। তোমার বাবা জাপানী ভাষা জানতেন। তুমি কি জান?
প্রদীপ সরকার উত্তরে বলছেন, ‘’বাবা জাপানী ভাষা লিখে নিয়ে বলতেন। আমি ৪৯ বার জাপান গিয়েছি। শুধু ম্যাজিক শো করার জন্য নয়। জাপানী
ভাষা আমি শিখেছি। জাপানী ভাষায় আমি কবিতা লিখতে পারি। জাপান আমার আর একটা
জন্মভূমি। বাবা বলতেন মাতৃভাষা ছাড়াও অন্তরের একটা ভাষা আছে।‘’
এদিনের অনুষ্ঠানের প্রারম্ভিক সুত্রায়নে আমাদের
বাঙালিদের প্রঞ্জা, মনন এবং পরম্পরা বিষয়কে সামনে এনে দিয়েছিলেন ‘নিয়োগী বুকস’-এর
ম্যানেজিং ডিরেক্টর বিকাশ দে নিয়োগী। তিনি বলেন, ‘’আমি বর্তমানে প্রবাসী বাঙালি
হলেও আমার এবং আমাদের শিকড় কলকাতায়। তাই বাংলাকে আমরা ভুলে যাইনি। নিজের দেশ,
নিজের শহর, মাতৃভাষা আমাদের চিরন্তনী চেনায়। পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হয়। আমরা সেই দায়িত্বের কথা মনে
রেখেছি।‘’
‘নিয়োগী বুকস’ প্রকাশনা সংস্থা সূত্রের খবর,
কলকাতায় বই পাড়ায় নতুন বই বিপণী শুরু করতে চলেছে এই সংস্থা। পরিকল্পনা অনুযায়ী
জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহেই এই সংস্থার তাদের নিজের শহরে নিজস্ব ঐতিহ্য নিয়ে
পদার্পণ করবে। আগামী দিনের ‘হিউম্যান বুক’ উপহার দেওয়ার জন্য। সারা বিশ্বের পাঠাগার
শিক্ষকরা নতুন করে বই পড়ার কথা বলছেন। এই বই হবে ‘হিউম্যান বুকস’। জ্ঞানের আলোর
জন্য বই ছিল। বই থাকবে। ‘ই বুকস’ হোক অথবা পুরনো ‘বাঁধাই বই’। নতুন করে চিনতে হবে
‘হিউম্যান বুকস’-এর পরম্পরা।
No comments:
Post a Comment