Sunday, 27 May 2018

বিশ্ব মানবতার পথিকৃৎ ছিলেন বিচারপতি সাচার


দীপেন্দু চৌধুরী       
আমরা কেউ কেউ ভাবি উচ্চ আদালতের বিচারপতি হয়ে অথবা নিম্ন আদালতের বিচারক হয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কাজ করা যায় না। এই ধারণা যে ঠিক নয় তার উজ্জ্বল উদাহারণ দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধানবিচারপতি এবং মানবাধিকার আন্দোলনের পথিকৃৎ জাস্টিস রাজিন্দর সাচার। আইনঞ্জ এই ব্যক্তি সম্পর্কে আমরা কতটা জানি? বা কতটা খবর রাখি? তাঁর সম্পর্কে বাংলায় কটা বই আছে জানি না। বাংলার কোনও খ্যতনামা  প্রকাশক তাঁকে নিয়ে গবেষণাধর্মী কোনও বই প্রকাশের জন্য আদৌ ভেবেছে বলেও মনে হয় না। প্রকাশকরা এমনিতেই আক্ষেপ করে থাকেন বইয়ের বাজার ভালো নয়। তারপর অচেনা বা কমচেনা একজন ব্যক্তি সম্পর্কে কতজন আগ্রহ দেখাবে? বিচারপতি সাচার কি সত্যি সত্যি অচেনা ব্যক্তি? এর চেয়ে ঢের ঢের ভালো বাজারে জনপ্রিয় কোনও সেলুলয়েডের নায়ক নায়িকাদের সম্পর্কে বই প্রকাশ করা।
বিচারপতি রাজিন্দর সাচার নামটি ভারতীয় রাজনীতিকদের কাছে মাত্র কয়েক বছর আগে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ২০০৫ সালে ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ দেশের মুসলিম সমাজের সামাজিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত অবস্থান খতিয়ে দেখতে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করেন। জাস্টিস সাচার তার চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ডঃ মনমোহন সিংহ যোগ্য ব্যক্তির হাতেই এই কমিটির দায়িত্ব তুলে দিয়েছিলেন। বিচারপতি সাচার পক্ষপাতহীন, তথ্যনির্ভর বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করেন। ঐতিহাসিক এই রিপোর্ট ব্যক্তি হিসেবে বিচারপতি রাজিন্দর সাচারকে যেমন আলোয় নিয়ে আসে, তার থেকেও অনেক বড় প্রশ্ন তুলে দেয় মুসলিম সমাজের আসল আর্থ-সামাজিক ছবি নিয়ে। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে রিপোর্ট পেশ করার আগে পর্যন্ত আমরা ভারতের সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে অনেক তথ্য জানতাম না। বা ভুল জানতাম। স্বাধীন ভারতে এই রিপোর্ট মুসলিম সম্প্রদায় সহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সামাজিক মান উন্নয়নে সহায়ক হয়ে ওঠে। কারণ ভারতের আপামর মানুষের মধ্যে একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল, ভারতের মুসলিমদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। মোটাদাগে বোঝাতে চাইছেন তোষণ করা হচ্ছে। বিচারপতি সাচারের আলোচ্য রিপোর্ট সেই ‘মিথ’ ভেঙে দেয়। রিপোর্টে উঠে আসে এক চরম সত্য। ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে পেশ করা রিপোর্টে বলা হয়, ভারতে এবং রাজ্যে রাজ্যে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আয়, শিক্ষা, চাকরি, স্বাস্থ্য, দারিদ্র, সরকারি আর্থিক সহায়তা বিষয়ে।   
অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থানে ভারতের তুল্যমূল্য নয় বাস্তবিকভাবেই মুসলিমরা অনেক পিছিয়ে আছে। তিনি এগুলির সংশোধন ছাড়াও অন্যান্য সুপারিশ করেন। পিছিয়ে থাকা মুসলিম সম্প্রদায়ের পাশাপাশি সমস্ত বঞ্চিত শ্রেণীর জন্য তার দেওয়া সুপারিশগুলি কার্যকর করতে বলেন।
আমাদের দেশে মোট জনসংখ্যা ১০২ কোটির মধ্যে মুসলিমদের সংখ্যা ১৩.৪ শতাংশ। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের ছবি কি? রাজ্যের ৮ কোটি জনসংখ্যার ২৫ শতাংশের বেশি মুসলমান। অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের মোট  জনসংখ্যার এক- চতুর্থাংশই মুসলমান। একটি সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে সেটা হল, সাচার কমিটির রিপোর্টকে ভিত্তি করে এগতে থাকলে আমরা পাই, পশ্চিমবঙ্গের তফসিলি জাতি-উপজাতি ভুক্ত মানুষদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ, এক-তৃতীয়াংশের কিছু কম, আর বর্ণহিন্দুদের সংখ্যা ৩৫ শতাংশ, এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশি। পাশাপাশি ওবিসি-দের সংখ্যা মাত্র ৬ শতাংশ
সাচার কমিটির রিপোর্ট বিস্তারিত দেখতে হলে তফসিলি জাতি-উপজাতিভুক্ত মানুষদের সংখ্যাও আলাদা আলাদাভাবে ভেঙে দেখতেই হবে। কারণ ভারতে এবং আমাদের রাজ্যে মুসলিমদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তফসিলি জাতি-উপজাতির সঙ্গে তুলনা করতেই হয়। ঐতিহাসিক মানদণ্ডে বিচার করলে এটাই বাস্তব। কারণ আমাদের দেশে মুসলমান জনসংখ্যার বেশিরভাগ জাতিভেদ প্রথার নিপীড়নে ধর্মান্তরিত নিম্নবর্ণের হিন্দু।
সাচার কমিটির রিপোর্ট এবং মণ্ডল কমিশনের রিপোর্টকে সামনে রেখে ২০১০ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে। ওই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একটি ঘোষণা করেন। তিনি বলেছিলেন, ওবিসিদের ১৭ শতাংশ সংরক্ষণ থেকে সংখ্যালঘু মুসলিমদের জন্য আলাদা করে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ করা হবে। এই সংরক্ষণের প্রয়োজনে রাজ্য সরকার একটি স্যাম্পেল সার্ভে করিয়েছিল। সেই স্যাম্পেল সার্ভে করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। ২০১০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দৈনিক ‘প্রাত্যহিক খবরে’ আমি একটি খবর করি। ‘পিছিয়ে থাকা মুসলিমদের তিনভাগে ভাগ করা হচ্ছে’ শিরোনামে খবরটি ছিল। খবরটির কিছুটা অংশ উল্লেখ করছি। ‘’............কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানথ্রপলজি দপ্তরের নিজস্ব মানদণ্ড এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। রাজ্যে ১০৬ টি সম্প্রদায় ওবিসি গোষ্ঠীভুক্ত। তার মধ্যে ৫১টি মুসলিম সম্প্রদায়ের। এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষও আছেন। যেমন খ্রীস্টান, জৈন, বৌদ্ধ, এবং দার্জিলিং পাহাড়ের মানুষ। এঁদের সবাই আবার বৌদ্ধ নয়। কেউ কেউ বৌদ্ধ। কেউ কেউ হিন্দু ধর্মাবলম্বী।‘’                                                    
বিচারপতি রাজিন্দর সাচারদের মত মানুষ মুখে সোনার চামচ নিয়ে জন্ম গ্রহণ করুন। অথবা রুপোর চামচ। এই ব্যক্তি বিরলতম ব্যক্তিত্বদের মধ্যে পড়েনমানবাধিকার রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী। ভারতের মত উন্নয়নশীল দেশের বিচারব্যবস্থার এক উল্লেখযোগ্য উজ্জ্বল ব্যক্তি ছিলেন তিনি। বাবা কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী হলেও বিচারপতি সাচার বেছে নিয়েছিলেন সোশালিস্ট আদর্শ। এছাড়াও খুব সম্ভবত এম এন রায়ের র‍্যাডিক্যাল হিউম্যানিস্ট গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর বর্ণময় কর্মজীবনে তিনি সিকিম এবং দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। ভারতীয় আইনের অতন্দ্র প্রহরী ছিলেন। গরিব সাধারন মানুষের আইনজীবী হিসেবে কর্ম জীবন শুরু করে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নাগরিকের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করে গেছেন।
২০০৪ সালে ‘প্রিভেনশন অব টেররিস্ট অ্যাক্টিভিটিভ অ্যাক্ট (POTA)’ প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে বিচারপতি সাচারের বিশেষ অবদান রয়েছে। রাষ্ট্রশক্তি এই আইন প্রত্যাহার করলেও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে আবার নতুন এক আইন তৈরি করল। ইউএপিএ (UAPA) আইন। ইউএপিএ (UAPA) আইনের ধারাগুলির সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই ‘পোটা’ (POTA) আইনের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। পোটা (POTA) আইন প্রত্যাহারের মত ইউএপিএ (UAPA) আইন প্রত্যাহারের জন্য বিচারপতি সাচার ২০০৯ সালে আবেদন করেন। তিনি আফস্পা (AFSPA) আইন প্রত্যাহারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আবেদন করেছেন একাধিকবার। কাশ্মীরের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। কাশ্মীরের মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি যেসব রিপোর্টের অংশীদার ছিলেন, সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন তিনি। ৩৭০ ধারা নিয়েও তার আলাদা মতামত ছিল। তিনি ৩৭০ ধারাকে অপপ্রয়োগ না করে সঠিকভাবে কার্যকর করার কথা বলে গেছেন। ভারত সহ সারা বিশ্বের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং মানবাধিকার আন্দোলনের অনির্বাণ পথপ্রদর্শক ছিলেন বিচারপতি সাচার। বিতর্কিত জরুরী অবস্থা নিয়েও তিনি প্রতিবাদে সামিল হয়েছিলেন।    
এই লড়াই করতে তাঁর সহায়ক হয়েছিল আইন নিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ। আইনজীবীর পেশায় আসার আগে থেকে ভারতীয় গণতন্ত্র এবং মানবতার অন্যতম মুখ বিচারপতি রাজিন্দর সাচার। ছাত্রজীবন থেকে তিনি গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে সামিল হন। সাচার সম্পর্কে যারা জানেন তাঁদের কাছ থেকে জানা গেল বাবা ভীমসেন সাচার কংগ্রেস করতেন। জওহর লাল নেহরুর আমলে পঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন ভীমসেন সাচার। লাহোর আইন কলেজ থেকে আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৫২ সালের এপ্রিল মাস থেকে রাজিন্দর সাচার সিমলা কোর্টে আইনজীবী হিসেবে তার পেশা শুরু করেন। ছাত্র অবস্থায় তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এবং কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টিতে অংশগ্রহণ করেন। পরে Peoples Union for Civil Liberty (PUCLL) কমিটিতে আজীবন সদস্য ছিলেন। ছাত্র জীবনে পুলিশের অত্যাচার সহ্য করেছেন আবার জেলও খেটেছেন।
১৯৬০ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে সুপ্রীমকোর্টে আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। সুপ্রীম কোর্টে আইনজীবী হিসেবে সিভিল, ক্রিমিনাল, রেভিনিউ সংক্রান্ত সব ধরণের মামলা তিনি লড়তেন। তার কর্মজীবন এতটাই বিস্তৃত ছিল সেটা আমরা জানতে পারি তার সঙ্গে যারা একসঙ্গে কাজ করেছেন তাঁদের কাছ থেকে। বিশিষ্ট আইনঞ্জ এবং হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধানবিচারপতি হিসেবে রাজিন্দর সাচারকে জাতিসংঘের ‘প্রমোশন অ্যান্ড প্রোটেকশন অব হিউম্যান রাইটস সাব কমিশন’-এর সদস্য নির্বাচিত করা হয়। এবং এটাও উল্লেখ করতে হয়, ‘প্রোটেকশন অব হিউম্যান রাইটস অ্যাক্ট ১৯৯৩’ রিভিউ করার জন্য প্রধানবিচারপতি জাস্টিস আজিজ মুসাব্বর আহমাদির নেতৃত্বে যে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি হয় সেই কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন বিচারপতি সাচার। ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন গঠন এবং সুপারিশ জরুরীভিত্তিতে কার্যকর করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিক নেয় এই কমিটি।
নারী স্বাধীনতা নিয়েও তার ভূমিকা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হয়। নারীদের সামাজিক অধিকার, সাবলম্বিতা এবং নারীর মর্যাদা নিয়েও তিনি ছিলেন মুখর। দেশের যে কোনও প্রান্তের নারী নির্যাতনের বিরূদ্ধে তার কণ্ঠস্বর গর্জে উঠেছে। কখনও আইন বিশেষঞ্জ হিসেবে কখনও আবার গণতান্ত্রিক অধিকারের কর্মী হিসেবে। মানবাধিকার কর্মী হিসেবে। অশীতিপর বয়সেও রাজপথে নেমে মহিলা সংগঠনের সমর্থনে পায়ে পা মিলিয়ে জনপথে রাজপথে হেঁটেছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন গণতন্ত্র, মানবাধিকারের অতন্দ্র প্রহরী। তথাকথিত অভিজাত সমাজের চকচকে দেখনদারি জৌলুস ভেঙে তিনি সামনের সারিতে নেমে এসেছিলেন। আমাদের তাঁকে চিনতে আরও সহায়ক হয়েছিল। তিনি ছিলেন মানবতার মূর্ত প্রতীক। একজন বিচারপতি হিসেবে তিনি যে উচ্চতায় উঠেছিলেন তারপরেও প্রান্তিক মানুষের অধিকারের জন্য লড়াইয়ে সঙ্গ দেওয়া অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। বিচারপতি সাচার সেই কাজটি অনায়াসে করে তথাকথিত ‘আভিজাত্য’ নামক এক মিথ্যের অহংকার ভেঙে  চুরমার করে দিয়েছেন। দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কাজের অধিকার বিষয়ক আন্দোলন, দুর্নীতি, জালিয়াতি, মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নিজের ইচ্ছায় ছুঁটে এসেছেন। একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে। আনুষ্ঠানিক কোনও আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করেননি তিনি। বিচারব্যবস্থা থেকে অবসরের পরে এই রুটিন কাজ আরও বেড়েছিল।
সম্প্রতি ৭ মে, ২০১৮ কলকাতায় মোলালি যুব কেন্দ্রে ‘সেন্টার ফর প্রোটেকশন অব ডেমোক্রাটিক রাইটস অ্যান্ড সেকুলারিজম(CPDRS)’ এবং লিগ্যাল সার্ভিস সেন্টার যৌথভাবে একটি স্মরণসভার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বিচারপতি সাচার সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জানার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ওই দিনের আলোচনাসভায় বিশিষ্ট আইনজীবী পার্থসারথী সেনগুপ্ত বলেন, ‘’মানুষের অধিকার রক্ষায় এক অক্লান্ত মানুষকে আমরা হারিয়েছি। যেখানে মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করতে হবে সেখানেই জাস্টিস সাচার হাজির হয়ে লড়াই করেছেন। তাই তিনি সংগ্রামী মানুষের আত্মার আত্মীয়।‘’
সিপিডিআরসি-এর সহ সম্পাদক গৌরাঙ্গ দেবনাথ বলেন, ‘’মানবাধিকার রক্ষার জন্য একজন প্রহরীকে আমরা স্মরণ না করে থাকতে পারিনি। আজকের সমাজে সৎ মানুষের বড়ই অভাব। রাষ্ট্রশক্তির বিরোধিতা করার জন্য তিনি সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি হতে পারেননি।‘’
এদিনের অন্যতম বক্তা ছিলেন শিক্ষাবিদ এবং মননশীল ব্যক্তিত্ব মীরাতুন নাহার। তিনি বিচারপতি রাজেন্দর সাচারকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতেন। বিভিন্ন গণআন্দোলনে একসঙ্গে কাজ করার সুবাদে মানবতাবাদী এই ব্যক্তিটি সম্পর্কে মীরাতুন খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, ‘’এই দেশে অনেক বড় বড় মানুষ জন্মেছেনআমরা যাঁদের দেখে সামনে হাঁটার প্রেরণা পাই। রাজেন্দর সাচার সেইরকম একজন মানুষ। আদর্শকে বাস্তবে পরিণত করা। আদর্শকে আচরণে প্রতিফলিত করা। এটা বিচারপতি রাজেন্দর সাচার করেছেন। তার জীবন অনুকরণযোগ্য। সব সময়ের জন্য বিচারপতি সাচার গ্রহণযোগ্য। তাঁকে অনুকরণ করলে নিজেকে ধন্য মনে করি।‘’
রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাডভোকেট জেনারেল এবং বিশিষ্ট আইনজীবী বিমল চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘’বিচারপতি সাচার ৯৪ বছর বয়সে মারা গেলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে মেলামেশা করেছি। আমি নিজেও PUCLL–এর আজীবন সদস্য। আমি নিজেও র‍্যাডিকযাল হিউম্যানিস্ট। রাজিন্দর সাচারও ওই কমিটির সদস্য ছিলেন। বুদ্ধি, বিদ্যা এবং প্রতিবাদের ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বিরাট মাপের মানুষ। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার সঙ্গে কথা বলে দেখেছি। নেহরু সম্পর্কে বিচারপতি সাচার PUCLL পত্রিকায় লিখে গেছেন। স্মৃতিচারণ করেছেন তার একটি প্রবন্ধে বিচারপতি সাচারের লেখাগুলি যদি সংগ্রহ করা যায় তাহলে দেখা যাবে তার প্রতিবাদের বিষয়গুলি। আমাদের দেশ নয় তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের প্রয়োজনে আসবে। বাম আমলে প্রচার ছিল পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম সংখ্যালঘুরা ভালো আছেন। সেই প্রচারে বিচারপতি সাচার জল ঢেলে দিয়েছেন। তার রিপোর্ট নিয়ে বাম নেতারাও প্রতিবাদ করতে পারেননি।[‘’
এসইউসিআই দলের প্রাক্তন সাংসদ তরুণ মণ্ডল বলেন, ‘’জাস্টিস সাচারকে দেখে মনে হয় সব মৃত্যু সমান হয় না। সাচারের মৃত্যু পাহাড় হিমালয়কেও হার মানিয়েছে। তিনিই একমাত্র বলতে পারেন, মানুষের ব্যাঙ্কের টাকা যারা লুঠ করেছেন তাঁদের নাম প্রকাশ করতে হবে। তিনি আরও বলেছেন, সরকার প্রভাব খাটিয়ে কোনও মামলার বিচারের কথা বলতে পারেন না। বিচারপতি সাচার ছিলেন সেই বিরল মানুষদের সমতুল্য। আমি ভলতেয়ার, আব্রাহাম লিঙ্কনের কথা বলছি। ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত অধিকারের কথা, নাগরিক অধিকারের কথা যারা বলে গেছেন। বিচারপতি সাচার সেই গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ।
বিচারপতি মলয় সেনগুপ্ত বলেন, ‘’বিচারপতি সাচারকে নিয়ে এই স্মরণসভা অত্যন্ত গর্বের। জানি না সিকিমে হয়েছে কিনা? সাচারকে নিয়ে এই ধরণের স্মরণসভা দেশে আরও হওয়া উচিৎ।‘’
বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘’আমার সঙ্গে পরিচয় ছিল ওর সঙ্গে। কিন্তু বিচারপতি সাচারের সিভিল লিবার্টি নিয়ে যা কাজ, এই বিষয়ে তার ভূমিকা সেই কাজে আমার কোনও ভূমিকা ছিল না। তার কর্মজীবনের বাইরে যে তার বৃহত্তর ভূমিকা ছিল সেটা আমরা জানি। যৌথভাবে বিচারের কাজ করার ক্ষেত্রে সবসময় সহমত হতে পারিনি। তবে তিনি সবসময় স্থীর এবং দৃঢ় সঙ্কল্পের মানুষ ছিলেন। ব্যক্তি স্বাধীনতা আন্দোলনে তার উৎসাহ বেশি ছিল। ঋজু ব্যক্তিত্ব। আপনি আমার মতের সঙ্গে ভিন্নমত হতে পারেন। বর্তমান সময়ে সহনশীলতা কমে যাচ্ছে। এটা আমাদের সময়ে ছিল না। ভিন্নমতের মানুষের কথাও শুনতে হবে। সাচার ছিলেন সেই ধরণের বলিষ্ঠ মানুষ। নেহরুর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাচারকে তুলনা করা যায়।‘’                                                 

No comments:

Post a Comment