পাড়ায় বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ শুনেছিলাম আমরা। কিন্তু তখন আমাদের বয়স কত
আর? মাত্র ১০ বছর বয়স আমার। আমার শৈশব আমাকে ওই বয়সে এক অবসন্ন অবসাদ থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। উদাস
চাউনি নিয়ে বড় হচ্ছি। বাবা, দাদাদের লড়াইয়ের প্রসঙ্গ ওই বয়সেই আমি অনুভব করতে
শিখেছি। ঘরভাঙা, দেশভাঙা যন্ত্রণা তাঁদের চোখের ভাষায়। সীমান্তপাড়ের ক্লান্ত মন
নিয়ে, অবসন্ন মেঘরোদ্দুরের ভেজা সংসার। আমার মা, ভবিষ্যৎ আলপনার স্বপ্নে সংসার আগলে রেখেছেন। কিন্তু শিকড় ছেঁড়া একটি পরিবার। আত্মীয়হীন লাল মাটির মোড়ামের ‘বার ঘর এক উঠোন’
সমাজের অব্যক্ত যন্ত্রণা চেপে নিয়ে সামাজিক থাকতে চাইছে তারা। আমি মাত্র ছ’বছর বয়সে সেই আগুন চিনেছিলাম। তাই হয়ত নীল আকাশকে কল্পনা মিশিয়ে দেখতে হয়,
এটা শিখতে পারিনি। সামাজিক অসাম্যের ঠাস বুনোট মূল্যবোধে আমি আক্রান্ত। ঘামে ভেজা লবণাক্ত লোমশ চামড়ার ভেতর থেকে একবুক যন্ত্রণা শুনতে পেতাম।
ক্লান্ত অবসন্ন ‘মন’ আমাকে টানতে টানতে বারেবারে
নদী, শশ্মানের কাছে নিয়ে যায়। সেই স্মৃতি আমি আজও কিছুতেই ছেড়ে বেরতে পারলাম
না। শশ্মানের দাউ দাউ আগুন। জ্বলছেতো
জ্বলছে। আজও জ্বলছে। প্রখর গ্রীষ্মের কামারের শালে তপ্ত থালার মত। আকাশের দুপুর সূর্যের আগুনও শশ্মানের আগুনকে
ভুলতে দিল না। বসন্তের ‘কৃষ্ণচূড়া’র গরিমাও আমাকে লালিত্য শিখতে দেয়নি। পলাশ রাঙা
বসন্তের বিকেলেও আমি আগুন খুঁজি। আগুনেই আমার মুক্তি। আমাকে আগুন দাও। আমি দাউ দাউ শশ্মানের কাছে বারে বারে ছুটে যাই। কেন শশ্মান? কেন নদী? আমার
মনে পড়ছে, আশির দশকের নকশাল নেতা কমরেড সন্তোষ রাণার নেতৃত্বে সিপিআই (এমএল)
গোষ্ঠীর এক ছাত্রনেতার সঙ্গে আলোচনার কথা।
১৯৮৩ সাল। আমরা অন্য একটি ‘নকশালপন্থী’ গোষ্ঠীর
সঙ্গে যুক্ত। কলেজ স্ট্রীটের ‘ব্যাপটিস্ট মিশন’-এর ছাত্রাবাসে ভারতে বিপ্লব নিয়ে
তাত্বিক আলোচনা করছিলাম। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি নিয়ে এম এ পড়ছে সন্তোষদার
নেতৃত্বে চলা গোষ্ঠীটির সেই ছাত্রনেতা। অত্যন্ত উজ্জ্বল ছাত্র। সে আমার সঙ্গে
আলোচনায় বসেছে। তাড়া তাড়া বিড়ির বান্ডিল শেষ হয়ে যাচ্ছে। ওরা প্রায় আট-দশজন ছাত্র।
প্রত্যেকে নিজের নিজের বিষয়ে ব্যতিক্রমী ছাত্র। আমি একা গিয়েছিলাম। গ্রামের তপ্ত
লাল মাটি আমার পায়ে, মনে লেগে রয়েছে। পাথর ভাঙা হাতুড়ির শব্দ। ঠুক ঠুক। ডিনামাইটের
শব্দ। আদিবাসীদের গান। নিমতেলের ঘ্রাণ আমার স্মৃতিতে নতুন স্তরে জায়গা পেয়েছে। শশ্মানের
আগুন সত্য খুঁজতে শিখিয়েছে। অন্তর্মুখী ‘দীপেন’ সত্য খুঁজছে। চতুর এবং
দ্বিধাবিভক্ত কৌশলী বাম নেতাদের ‘পার্থক্য’-এর কারণ হাতড়ে বেড়াচ্ছি।
ষাটের দশকের প্রেসিডেন্সি কলেজের এক আগুনখেকো ছাত্রনেতার
গোষ্ঠী থেকে আমি গিয়েছিলাম। আমি তখন সেই নেতার তৈরি গোষ্ঠীর ‘সর্বক্ষণের কর্মী’
(হোল টাইমার)। আলোচনায় ‘আধা সামন্ততান্ত্রিক, আধা ঔপনিবেশিক’ ভারতে বিপ্লবের নীতি,
সংগঠন গড়ে তোলার রণকৌশল, ছাত্র ফ্রন্টের কাজ, যুব ফ্রন্টের কাজ, কৃষক-শ্রমিক
ফ্রন্টের কাজ নিয়ে আমরা চা-বিড়ির বিপ্লব করলাম। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চস্তর
সাম্রাজ্যবাদ এসে পড়ল। সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ হাতছানি দিল। আমার মনে শশ্মান। আমার
আকাশে শশ্মান। আমার চোখে আগুন। নদী খুঁজছি। আলোচনা কিছুতেই শেষ হয় না। আমি বললাম,
‘সব নদী সাগরে গিয়ে মেশে।’
সেদিনের সাগর আবার আমি খুঁজে পেলাম এদিন। কলকাতার
আলিয়ঁস ফঁসেজ সভাঘরে। ১৭ মে একটি আলোচনা সভা ছিল। বিষয় ছিল ১৯৬৮ সালের সামাজিক
বিপ্লব। ‘Social Revolution of May 1968.’ অবশ্যই এই বিপ্লব ফ্রান্সে। পঞ্চাশ বছর
আগের ঘটনা। সেদিনের অন্যতম আলোচক অধ্যাপক চিন্ময় গুহ আমাদের মনে করিয়ে দিলেন,
‘’১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবের ৫০ বছর পর ফরাসী বিপ্লব।‘’ কি অদ্ভুত তাৎপর্য দেখুন
২০১৮ সালের ১৭ মে ‘আলিয়ঁস ফঁসেজ’ আয়োজন করল ফরাসী বিপ্লবের পঞ্চাশ বছর। আলোচনা
শুরু হওয়ার আগে ফরাসী বিপ্লবের উপর একটি তথ্যনিষ্ঠ তথ্যচিত্র ছিল। ‘Confrontation: Paris, 1968’ নামে তথ্যচিত্রটি শুরু হচ্ছে হাজার হাজার ছাত্র, যুবকের মিছিল দিয়ে। তাঁদের
হাতে মাও সে তুং’ (‘মাও জে দং’)-এর ছবি দেওয়া প্ল্যাকার্ড। হাতে সিগারেট। লম্বা
চুল, মুখে শ্লোগান। বিশ্ববিদ্যালয়ের কতৃপক্ষের গৃহীত নীতির প্রতিবাদ করতে
প্যারিসের রাস্তায় ছাত্ররা নেমেছিল। ছাত্রদের দাবি ক্রমশঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ
উত্তর ইউরোপের সামাজিক সমস্যাকে সামনে এনে আছড়ে ফেলল।
ফ্রান্সের এই ছাত্র আন্দোলনকে আমরা জানি, ‘Radical Revolution, heritage
of the world.’ যে কথা তথ্যচিত্রটি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে।
ফ্রান্সে ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার কয়েক বছর আগে আলজিরিয়া নামক ফ্রান্সের দখলে
থাকা এক অঙ্গরাজ্য স্বাধীনতার আন্দোলন করে স্বাধীন হয়েছে। আলজিরিয়ার স্বাধীনতার এই
আন্দোলনে বাস্তব সাহায্য দেওয়ার জন্য ফ্রান্সের কিছু বুদ্ধিজীবী এবং যুবকর্মী এক
গুপ্ত সংগঠন গড়ে তুললেন। এই সংগঠনের নাম ছিল ‘রেজো দ্য সুতিয়াঁ’। ফরাসী থেকে বাংলা
অনুবাদে আমরা পেয়েছি, ‘সাহায্যকারী দল’। ১৯৬০ সালের মুখে এই দলটি ধরা পড়ে। সামরিক
আদালতে তাঁদের বিচার শুরু হয়। এই দলের নেতা ছিলেন ফ্রাঁসিস ঝাঁসঁ। জঁ পল সাত্র এই
দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই অভিযোগে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী এবং লেখক সাত্রের বিরুদ্ধে
রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ তোলা হয়। সামরিক আদালত তাঁকে তলব করেছিল। তিনি একটি লিখিত উত্তর দিয়েছিলেন। সেই লেখা আজ ঐতিহাসিক দলিল। তৎকালের শাসক দলের অনেক পেটোয়া সংবাদপত্র,
সমাজপতি এবং তাঁদের অনুচরেরা সাত্রকে গ্রেপ্তার এবং বিচারের দাবি জানায়। কিন্তু
ফরাসী সরকার সেটা করতে সাহস পাননি।
১৯৬০ সালের পর থেকেই ফ্রান্সের সামাজিক আকাশে
বিদ্রোহের আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ইউরোপের পরাজিত
শাসকদের তথা শাসক দলের সামনে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যা এসে কড়া নাড়তে থাকে।
১৯২৯ সালের বিশ্বমন্দা সামলে উঠেছে ইউরোপ। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইউরোপের শ্রমিক
শ্রমের মূল্য চিনে নিতে চাইছে। আট ঘণ্টা কাজ, সম বেতন, সংসদীয় গণতন্ত্রের অধিকার
ইত্যাদি দাবিতে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টি আন্দোলন শুরু করেছে। সামনে
সোভিয়েত মডেল অথবা চিনের মডেল। অদূর ভবিষ্যতে ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টী সংসদীয়
পথে ক্ষমতা দখলের নীতিকে সামনে নিয়ে আসতে শুরু করবে। ওয়েস্টার্ন ফ্রান্সে আপার
মিডল ক্লাস থাকত। শ্রমিক, ছাত্র যুবদের মিছিল প্রসঙ্গে ১৯৬৮ সালে ‘ইভিনিং
স্ট্যান্ডার্ড’
(Ebening Standard) একটি খবর করে। আমরা ‘Confrontation: Paris, 1968’ তথ্যচিত্রে দেখি সেই খবরের কাগজের কাটিং., তাতে লেখা ’35, 000 workers and student marching on the Paris.’
সেদিনের অন্যতম বক্তা অধ্যাপক হরি বাসুদেবন বললেন, ‘’স্যুটেড অ্যান্ড বুটেড
মানুষ পঞ্চাশ বছর আগে রাস্তায় নেমেছিল। ফ্রান্স বিপ্লব। এটাকেও কমিউনিজম বলতে হয়।
ইউরোপিয়ান বুদ্ধিজীবীরা আধুনিক বিশ্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা
নিয়েছেন। ভারতে নকশালপন্থী আন্দোলনে ফ্রান্স বিপ্লবের প্রভাব পড়েছে।‘’
ইতিহাস বলছে, ১৯৬৮ সালের ফ্রান্সের রাজনৈতিক
প্রেক্ষাপট সামনে আসার প্রধান কারণ শ্রমিক শ্রেণীর বৈপ্লবিক আন্দোলন। এই আন্দোলনে
ছাত্রযুবক, বুদ্ধিজীবীদের সহযোগিতায় অল্প সময়ের জন্য সোবর্ণ, প্যারিস এবং অন্যান্য শিল্পাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ কারখানা, সাময়িক পুলিশ চৌকি দখল করেছিল।
ফরাসী সমাজের গভীর এক যন্ত্রণা ব্যপ্তি পেল সমস্ত
ইউরোপ। ইউরোপ থেকে সাগর পাড়ের ঢেউ আছড়ে পড়ল ভারতে। তথা কলকাতার অভিজাত কলেজে।
প্রেসিডেন্সি কলেজে। ১৭ মের আলোচনা সভায় সেই প্রসঙ্গ তুললেন অধ্যাপক শুভরঞ্জন
দাশগুপ্ত। আমাদের মনে করিয়ে দিলেন তিনি। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি কবিতা
উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘’ফ্রান্স বিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল ব্রিটেন এবং ভারতে।
প্রেসিডেন্সি কলেজের আন্দোলন উদাহারণ বলা যায়। ষাটের দশকে নকশাল বাড়ির কৃষক
আন্দোলনকে প্রেসিডেন্সী কলেজের মেধাবী ছাত্রদের সমর্থন অবশ্যই ছিল ফরাসী বিপ্লবের
ছায়ায়। আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক ভারতের আর্থ সামাজিক ছবিটা বদলে ফেলতে
নকশাল বাড়ির আন্দোল ছিল একটি ব্যতিক্রমী আন্দোলন।‘’
এদিন আলোচনা সভায় অধ্যাপক শোভনলাল দত্তগুপ্ত বলেন,
‘’লক্ষ করেছেন মিছিলে যারা হাটছেন তাঁদের হাতে ‘পোস্টার অব মাও’, ১৯৬৮ সালের ছাত্র
বিপ্লব। ইতালি, পোল্যান্ডের আন্দোলনও ফ্রান্স বিপ্লবে প্রভাব ফেলে। আসলে এটা ছিল
তৃতীয় বিশ্বের মার্কসবাদ। তাই এটা মাও এটা চেগুয়েভারা, হো-চি-মিন। এই আন্দোলনের
শুরু কিন্তু আমেরিকায়। ১৯৬৫ সালে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হয়। ভিয়েতনামে
আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন শুরু হয়। পরে ফ্রান্স কমিউনিস্ট পার্টি
ফ্রান্সের এই আন্দোলনের নেতৃত্বে আসে। ১৯৬৮ সালের ফ্রান্সের ছাত্রদের বিপ্লব নতুন
এক স্বাধীনতার কথা শুনিয়েছে আমাদের। নতুন গণতন্ত্রের পথ চিনতে আহ্বান করেছে।‘’
ফরাসী ভাষার অন্যতম অনুবাদক তথা লেখক অধ্যাপক
চিন্ময় গুহ বলেন, ‘’এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ছাত্রদের একটাই সম্পর্ক সেটা হচ্ছে
এই বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাঙা। রাস্তায় নামা’। ১৯৬৮ সালে বলেন, জঁ পল সাত্র। ৩৪ জন
ছাত্রের বহিষ্কারের প্রতিবাদ করেছেন সাত্র। ১৯১৭ সালের রূশ বিপ্লবের ৫০ বছর পর
ফরাসী বিপ্লব। ‘শুধু জীবন’। ‘We are the power, endless try’, মে, ১৯৬৮ সাল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র ইট ছোড়া নয়। আমি সেই
সময় যুবক। কলকাতায় আমরা ছাত্র আন্দোলন দেখেছি। আমাদের দেশের আন্দোলনের তুলনায়
ফ্রান্সের বিপ্লব ছিল ব্যতিক্রমী এক দিশা। ফ্রান্স বিপ্লবে সেই দেশের সব স্তরের
মানুষ নেমে এসেছিল। আজকের তথ্যচিত্রে সেই দলিল আমরা দেখলাম। কিন্তু তথ্যচিত্রে
ত্রুফো, গদার, জঁ পল সত্রের কথা বলা হয়নি। সত্রে ছিলেন ফ্রান্সের অন্যতম
বুদ্ধিজীবী। যিনি চিরকালীন হয়ে আছেন তাঁর সামাজিক ক্ষেত্রে উজ্জ্বল ভূমিকার জন্য।
১৯৬৫ সালে তিনি নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হলেও সত্র পুরষ্কার প্রত্যাখ্যান
করেন। রাষ্ট্র যখন দমন পীড়ন নামিয়ে আনে। সাধারণ মানুষ সেই অত্যাচারের প্রতিবাদ
করলে যে কোনও দেশের বুদ্ধিজীবীরা চুপ করে থাকেন না। উত্তর আধুনিক ভারতে তথা আমাদের
বাংলায় উদাহারন মৃণাল সেনের ‘ভূবন সোম’, সত্যজিৎ রায়ের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। ফ্রান্স
বিপ্লব সমস্ত বিশ্বকে নতুন সূর্যের স্বপ্ন দেখিয়েছিল।’’
‘নদী চলে যাবেই জানি সাগরের টানে।’ শশ্মান আমাকে
টানছে। নদী আমাকে ডাকছে। ‘সৃষ্টির মহানন্দে আমি সেইদিন হব শান্ত.........’ ।
সীমাহীন চেষ্টায় পাওয়া যায় শুধু জীবন।
No comments:
Post a Comment