Friday, 9 November 2018

প্যারিসে ‘মেকং’ নদী দেখে এলাম




দীপেন্দু চৌধুরী 

হেমন্ত ফুরায়ে গেছে পৃথিবীর ভাঁড়ারের থেকে
এরকম অনেক হেমন্ত ফুরায়েছে
                               সময়ের কুয়াশায়,
মাঠের ফসলগুলো বারবার ঘরে
তোলা হতে গিয়ে তবু সমুদ্রের পারের বন্দরে
পরিচ্ছন্নভাবে চলে গেছে।
মৃত্তিকার ঐ দিকে আকাশের মুখোমুখি যেন
                                 শাদা মেঘের প্রতিভা;
(নাবিকী, জীবনানন্দ দাশ)
কবি কবিতাটি লিখেছিলেন ১৩৫০ সালের মন্বন্তরের পরে। ইতিহাস এইভাবে উঠে আসে গানে কবিতায়, চলচ্চিত্রে, চিত্রশিল্পে। আজ থেকে কয়েক হাজার বছে আগে গুহাচিত্রে আমরা মানুষের, পশুপাখির জীবন, সমাজের ছবি দেখেছি। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্ব বিভিন্নভাবে সাহিত্যিক, লেখক, নাট্যকার লিখে যান। সামাজিক প্রেক্ষাপটকে সাজিয়ে গুছিয়ে যে লেখক লিখছেন তিনি নিজের সময়ে তুলে আনেন। যে-কালে লেখক অতীতের সামাজিক হোক বা ঐতিহসিক হোক প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখছেন, সেই সময়ের অনুষঙ্গকে আমাদের সামনে ছবির মতো করে  তুলে ধরার দায়িত্বও তিনি নিজে নিয়ে থাকেন। দূরের নীল আকাশে পাখিদের সরল রেখার মতো ‘শৃঙ্খল’ থাকে, বন্ধন থাকে সেইসব লেখায়। জীবনানন্দের কবিতার উধৃতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সময়ের কথা বলতে চাওয়া হয়েছে। প্রাসঙ্গিক অথবা অপ্রাসঙ্গিক সেটা পাঠক নিজের বিচারে দায়িত্ব নেবেন।      
ভারতে বাংলা থিয়েটারে ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই দশ বছরের সময় কালকে গিরিশ যুগ থেকে শিশির যুগের উত্তরণ বলা হয়ে থাকে। ভারতীয় থিয়েটার পঞ্চরস, খেঁউড়, পালাগান, লোকায়ত পালা, যাত্রাপালা প্রভৃতি পর্ব পার হয়ে এসে বর্তমান সময় বা রবীন্দ্রনাথ, ‘ব্রেখট’, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, বাদল সরকার পর্বতারপরে বর্তমান সময়ে এসে পড়ল। আরও আধুনিক হয়ে নতুন যুগের উত্তরণ। ‘টাচ’ আছে ‘গণনাট্য সঙ্ঘ’ সমাজের কুশীলবদের আন্তরিক প্রয়াসের। কি সমাপতন দেখুন ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল বাংলা থিয়েটারের ‘চলমান’ যুগ। আবার ওই একই সময়ে আমরা ফ্রান্সে পাচ্ছি মার্গারেট দুরাস (Marguerite Duras) কে। তিনি লিখছেন’Les Impudents’’ উপন্যাস। ১৯৪৩ সালে লিখলেন সেই কালজয়ী উপন্যাস।
আমি নিজে এই লেখিকা সম্পর্কে খুব বেশি জানি না। আগ্রহ তৈরি হল সম্প্রতি কলকাতার আলিয়সঁ ফ্রঁসেজ আয়োজন করেছিল এক ঘণ্টার একটি একক অভিনয়ের নাটকের। একুশ শতাব্দীর ফ্রান্সের অন্যতম নাট্য ব্যক্তিত্ব মাউদ আন্দ্রিয়াক্স (Maud Andrieux) নাটকটির মঞ্চায়ন করলেন সাফল্যের সঙ্গে। ৫ নভেম্বর হেমন্তের শেষ সন্ধ্যায় আমরা নাটক দেখলাম। আন্দ্রিয়াক্স নিজেও নারী। সাদা পেঁজা তুলোর মেঘেদের মতো সৌন্দর্য তাঁর। তাঁর একক অভিনয়ে তিনি আমাদের চিনের ‘মেকং’ নদীর উপত্যকায় নিয়ে গেলেন। তাই তিনিই আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন মার্গারেট দুরাসকে। তাঁর লেখা L’amant উপন্যাসকে। ১৯৮৪ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসটি ফরাসি সাহিত্যে মার্গারেটকে জনপ্রিয়তা এনে দেয়। পাশাপাশি তিনি ধ্রুপদী সাহিত্যের ঘরানায় নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হন। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ প্রেস বিবৃতিতে লিখছে,
L’Amant (the Lover) is an autobiographical novel by Marguerite Duras, published in 1984. In her short and powerful novel, which won the Prix Goncourt in France in 1984, Duras recounts the largely autobiographical story of her family’s struggles in Southeast Asia.  
এই উপন্যাসের মূল ভাষান্তর করেছেন বারবারা ব্রে। বারবারা নাম দিয়েছিলেনThe Lover’অনুবাদ করেছিলেন লেঘ হাফ্রে (Leigh Hafrey)তিনি নামকরণ করেন ‘The North China Lover’সেই অনুবাদকে ভিত্তি করে একক নাটকের প্রয়োজনে লিখিত সাহিত্য গুণসমৃদ্ধ নাট্যরূপ দিলেন ফ্রান্সের বর্তমান সময়ের আলোচ্য নাট্যব্যক্তিত্ব মাউদ আন্দ্রিয়াক্স। তাঁর অনুভবি কলমে উঠে এল নতুন ছন্দে শীতের শুরুর চেরি পাতার রঙের বহু স্বরের একক আলোর মূর্ছনায়। আন্দ্রিয়াক্স নাম দিলেনThe Lover and The North China’তিনি ৫ নভেম্বর সন্ধ্যেয় একঘণ্টার নাটকে অভিনয় করার আগে সকালে আমাদের সঙ্গে এক ঘণ্টার আডায় বসেছিলেন ‘মিট দ্য আর্টিস্ট’ অনুষ্ঠানে। সকালের আড্ডায় বারে বারে ফিরে আসছিলেন ফ্রান্সের উনবিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় লেখিকা মার্গারেটের বিষয়। আন্দ্রিয়াক্স নিজের সম্পর্কে যতটা না বলছিলেন তার থেকে অনেক বেশি তিনি বলেছেন সাহিত্যিক মার্গারেট বিষয়ে। মুক্তোরমতো দাঁত। অপরূপ সৌন্দর্যের ব্যক্তিত্ব আন্দ্রিয়াক্স। ফরাসি সভ্যতার সংস্কৃতির ধারা মেনে বিনয় আর সৌজন্যের মিশ্রণে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিলেন তিনি সাবলিলভাবেআমার আগ্রহ তৈরি হল সাহিত্যিক মার্গারেট বিষয়ে।
‘দ্য নিউ ইয়র্ক’ (The New York) পত্রিকায় ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসের ১০ তারিখ র‍্যাচেল কুশনার মার্গারেটকে নিয়ে ’A Man and a Woman, say what you like, They’re Different’’ : On Marguerite Duras শিরোনামে একটি নিবন্ধ লেখেন। সেই লেখাটির কিছুটা অংশ এখানে উধৃতি হিসেবে তুলে দিলাম।                      
‘’Marguerite wasn’t always Duras. She was born Donnadieu, but with the publication of her first novel, “Les Impudents,” in 1943, she went from Donnadieu to Duras and stayed that way. She chose, as her alias, the village of her father’s origins, distancing herself from her family, and binding herself to the emanations of that place name, which is pronounced with a regionally southern French preference for a sibilant “S.” The village of Duras is in Lot-et-Garonne, an area south of the Dordogne and just north of Gascony. The language of Gascon, from which this practice of a spoken “S” derives, is not considered chic. More educated French people not from the region might be tempted to opt for a silent “S” with a proper name. In English, one hears a lot of “dur-ah”—especially from Francophiles. Duras herself said “dur-asss,” and that’s the correct, if unrefined, way to say it.’’
৫ নভেম্বর সন্ধ্যেয় আন্দ্রিয়াক্স আমাদের রোমান্টিক ভাষায় হাঁটতে বললেন। তারপর তাঁর একক উচ্চারণে আমরা উত্তর চিনের ‘মেকং’ নদীর উপত্যকায় পৌঁছে গেলাম। অথবা বলা ভালো উত্তর চিনের ‘মেকং’ নদীর সভ্যতায় পৌঁছে গেলাম। আলিয়াসঁ ফ্রঁসেজ সভাঘরে মাত্র ৭০- ৮০ জন দর্শক আমরা। নাটকের সময়ে একটি ঘণ্টা বিদগ্ধ দর্শকদের মরমী উপস্থিততে পিন পড়ার আওয়াজ ছিল না। নাটকের মঞ্চ বলতে সভাঘরে একটা বেতের চেয়ার। একটি চিনের নাগরিক বা বাসিন্দাদের ঘরে যে মডেলের বাতি বা আলোক ঝুড়ি থাকে। সেই বাতি (আলোক ঝুড়ি) ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবহ সঙ্গীতে আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম ‘চিনা অপেরা’-র সুর। আন্দ্রিয়াক্স মৃদু স্বরে  ইউরোপীয় ঘরানার নাটকের ব্যকরণ মেনে তিনি তাঁর নিজের অনুভবি কলমে লেখা সংলাপ আমাদের সামনে উচ্চারণ করলেন। আমরা মোহিত হয়ে বসে থাকলাম। তাঁর রুপে, গুণে, উচ্চারণে, দৈহিক আন্দোলনে, সামগ্রিক ঐশ্বর্যে একটি প্রেমের গল্পের প্রেক্ষাপটে উত্তর চিনের তৎকালীন আর্থ-সামাজিক টানাপড়েন জানলাম। ২০০৪ সাল থেকে সাহিত্যিক এবং সিনেমা পরিচালক মার্গারেটের উপন্যাসের ভিত্তিতে নাট্যব্যক্তিত্ব আন্দ্রিয়াক্স ফ্রান্সে অভিনয় করছেন। আন্দ্রিয়াক্সের ‘সি ওয়াল’ (Sea Wall, title originally as Un barrage contre le pacifique) এবং ‘দ্য ভাইস কনসাল’ (The Vice-Consul) নাটক দুটিও ফ্রান্সে সমান জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এইসব তিনি শুরু করেন সি ওয়াল পড়ার পরে। যখন তিনি এই গল্পের সাহিত্যিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট খুঁজে পান। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,      
“It was a great autobiographical account of injustice and hope in yesteryear French Indochina. 
Duras first wrote the first novel in 1984 and won the Prix Goncourt, a literary prize that made her internationally known. This novel was later adapted on the big screen by Jean-Jacques Annaud. Duras, however, rewrote the same story after the release of the film because she was dissatisfied with the film adaptation. Therefore, in the second novel, she elaborates the elements of staging and light. So I worked on these two novels to make a combined show of one hour.” 
তিনি আরও বলেন, ‘’৩৫০ পাতার একটি সম্পূর্ণ উপন্যাসকে একঘণ্টার নাটকে নিয়ে আসার কাজটা যথেষ্ট পরিশ্রমসাধ্য কাজ। তবু আমি চেষ্টা করেছি। মানুষের আবেগ খুজতে চাই নাটকে। ফরাসি সংস্কৃতির বরফের টুকরোর মতো জলতরঙ্গ খুঁজি। জলের প্রবাহের মতো করে। নাটককে আমি দেখি জীবনের ছন্দের বিষয় করে।‘’  ফরাসি দেশের মননের ধারাবাহিকতায় একটি প্রেমের গল্প তিনি শুনিয়েছেন। একজন ফরাসি নারী এবং চিনা-ভিয়েতনামী সম্প্রদায়ের যুবকের প্রেমের গল্পের প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর নাটকে। কলোনি আছে এমন এক বসতি চিনা সমাজের প্রেমের গল্প তাঁর নাটকে উঠে এসেছে। যে কোনও দেশের বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এই লেখা। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,           
“Of course, the whole book is not there. But I always remain extremely faithful to her writing and narrative, The racism of the colonial era and the difference in social origins and skin colour make their destiny impossible. And yet both of them remember their whole life for the extraordinary love they shared,”
তিনি বলেন,  ‘’...... ‘L’Mant (The Lover) উপন্যাসের টেক্সট ভীষণ কঠিন। মার্গারেটের নিজের জীবনও ঘটনা বহুল। তাঁর কথায়, “Besides being engaged in the Second World War, she defended the rights of women in French society all her life. This text speaks about her childhood, family and her emotions — what made her a free and committed woman,”
প্যারিস শহরে ‘মেকং’ নদী দেখে ফিরলাম। আমার একান্ত প্রশ্ন ছিল  Who am I? This is the question of France Renaissance. I would like to ask you that what is your thinking regarding Impressionist movement. 12 years from 1874 to 1886, it was golden era of the creative group of the artist.  উত্তরে আন্দ্রিয়াক্স বলেন, ‘’ ওই গোষ্ঠীর তুলিতে উদার, আধুনিক মননের জীবনধারা যেমন প্রতিফলিত হয়েছে। পাশাপাশি নিজেদের প্রতিবাদকেও ক্যানভাসে তুলে ধরেছিলেন একুশ শতাব্দীর ওই শিল্পীগোষ্ঠী। আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল এই শিল্পী গোষ্ঠীর আন্দোলন। এই আন্দোলনের প্রভাব আমাদের মধ্যেও পড়েছে।‘’
থিয়েটার চলেছিল একটা বন্ধ ঘরের মায়াবি আলোয়। চিন-ভিয়েতনামের কলোনি সভ্যতার সমাজের আয়নায় যে ছবি শুনলাম। বা যে ছবি পড়লাম তারপর কি বলব? সভাঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় মনে মনে উচ্চারণ করলাম প্যারিস শহরে মেকং নদী দেখে ফিরলাম।           
 



No comments:

Post a Comment